কিন্তু সামনাসামনি যোগাযোগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই যে গোষ্ঠী বা দল, এর একটা সীমাবদ্ধতা হলো – এভাবে খুব বড় আকারের দল গঠন করা সম্ভব নয়। দুই জন শিম্পাঞ্জি যারা কখনো একে অপরকে দেখেনি, একসাথে লড়াই করেনি বা একসাথে শলা-পরামর্শ করেনি, তাদের পক্ষে একজন অন্যজনকে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। একজন অচেনা শিম্পাঞ্জি অন্যজনকে সাহায্য করবে কি করবে না, দুইজন অচেনা শিম্পাঞ্জির মাঝে কার সামাজিক মর্যাদা উঁচুতে, কার নিচুতে এসব তাদের পক্ষে বোঝা খুবই কঠিন।২
একই ধরনের জীবনাচরণ আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। শিম্পাঞ্জির মতো মানুষের মাঝেও দলবদ্ধ হবার, একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর, সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরি করার, দলবেঁধে শিকার বা লড়াই করার একটা সহজাত প্রবণতা কাজ করত। স্বাভাবিকভাবেই, সহজাত প্রবৃত্তি থেকে গড়ে ওঠা এইসব গোষ্ঠী বা দলগুলো হতো শিম্পাঞ্জিদের দলগুলোর মতোই ছোট আকারের। যখনই দলগুলো বড় হতে শুরু করত, দলের মাঝে নানারকম বিশৃঙ্খলা দেখা দিত এবং দলগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। এই যে বড় দল হিসাবে থাকতে না পারার ব্যাপার, এটা যে শুধু খাবারের সরবরাহ বা অন্যান্য সুবিধাদির উপর নির্ভর করতো এমন নয়। একটা উর্বর উপত্যকায় ৫০০ জন লোককে খাওয়ানোর মতো শস্য জন্মালেও তখনকার দিনে ৫০০ জন লোক একসাথে বসবাস করা অসম্ভব ছিলো। কারণ, তখনকার দিনের মানুষ এটা ঠিক করতে পারত না যে এতগুলো লোকের মাঝে কাকে তারা নেতা হিসাবে মানবে, কে কোন এলাকায় শিকার করবে এবং কে কার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করবে।
এ অবস্থার অবসান ঘটল বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর। মানুষ কথা বলতে শিখল। প্রতিবেশীর সমালোচনা বা পরচর্চা করতে শিখল এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এই পরচর্চাই মানুষকে বড় বড় এবং অপেক্ষাকৃত স্থায়ী দল বা গোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়তা করল। কিন্তু একজন মানুষ কতজনের ব্যাপারেই বা পরচর্চা বা আলোচনা করতে পারে? সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাগুলো থেকে দেখা যায়, এভাবে একে অন্যের সমালোচনা বা পরচর্চার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১৫০ জনের একটা দল গঠন করা যেতে পারে, এর বেশি নয়। বেশিরভাগ মানুষই ১৫০ জন মানুষকেও কাছ থেকে জানতে বা তাদের সবার সম্পর্কে মন্তব্য বা সমালোচনা করার ব্যাপারে অক্ষম।
আশ্চর্যজনকভাবে, সমাজতাত্ত্বিক এই গবেষণাটির বাস্তব প্রয়োগ কিন্তু আমরা আজকের সমাজেও অনেক দেখতে পাই। একটু খেয়াল করলে দেখব, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যা এই ১৫০ সংখ্যাটির নিচে বা তার কাছাকাছি। এই সংখ্যাটির চেয়ে কম সদস্য সংখ্যা হলে কোনো দল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক মাধ্যম বা সেনাবাহিনী তেমন কোনো আইন কানুন ছাড়াই একে অপরকে সামনা-সামনি চেনার মাধ্যমে বা একে অন্যের সমালোচনা করার মাধ্যমে তাদের গোষ্ঠী বা দলটি পরিচালনা করতে পারে।৩ ত্রিশ জনের এক প্লাটুন সৈন্য বা ১০০ জনের এক কোম্পানি সৈন্য পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর মতো কোনো পদবী নির্ধারণ বা কঠোর আইন প্রণয়নের দরকার পড়ে না। সৈন্যদের নিজেদের মাঝে সুসম্পর্ক থাকলে এবং সবাই কিছুটা নিয়মানুবর্তিতা মেনে চললে সহজেই সেটা করা সম্ভব। এই আকারের একটি কোম্পানিতে একজন সম্মানিত সার্জেন্ট কখনো কখনো কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন তাদের শিরোমণি। একই কথা প্রযোজ্য পারিবারিক ব্যবসাগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে সাধারণত সদস্যসংখ্যা খুব একটা বেশি হয় না। এই ব্যবসাগুলো কোনো পরিচালনা পরিষদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা হিসাবরক্ষণ বিভাগ ছাড়াও সচ্ছন্দে চলতে পারে।
কিন্তু যখন গোষ্ঠী বা দলের সদস্যসংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে যায়, এভাবে নিয়ম কানুন ছাড়া নিজেদের মতো করে গোষ্ঠী পরিচালনা করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক প্লাটুন সৈন্য যত সহজে পরিচালনা করা যায়, হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত একটা ডিভিশন সেই একই উপায়ে পরিচালনা করা অসম্ভব। সফল পারিবারিক ব্যবসাগুলোও তখনই সংকটের সম্মুখীন হয় যখন তারা আকারে বড় হয়ে ওঠে এবং অনেক লোকজনকে তাদের ব্যবসায় নিযুক্ত করে। তারা যদি এই বাড়তি লোকজনকে সঠিকভাবে পরিচালনার কোনো কৌশল বের করতে না পারে, তাহলে তাদের ব্যবসা ভণ্ডুল হতে বাধ্য।
এই পর্যায়ে এসে অপরিহার্যভাবেই যে প্রশ্নটা মনে আসে সেটা হলো সেপিয়েন্সরা কীভাবে এই ১৫০ জনের সীমা অতিক্রম করে হাজার হাজার সদস্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলল নগর বা লাখ লাখ সদস্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলল সাম্রাজ্য? কল্পনা বা গল্পের উদ্ভবই সম্ভবত এই রহস্যের সমাধান। একটি লোককথা বা পুরাকাহিনীতে বিশ্বাস করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ লোক গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে।
যে কোনো বড় আকারের মানব সংগঠন- হোক সেটা আধুনিক রাষ্ট্র, মধ্যযুগের চার্চ, প্রাচীন কোন নগর বা কোন প্রাচীন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী – প্রতিটির মূলেই আছে কিছু সাধারণ বিশ্বাস, কিছু উপকথা; যার অস্তিত্ব শুধু ওই গোষ্ঠীর সামষ্টিক কল্পনায় বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, চার্চগুলোর মূলে রয়েছে সাধারণ ধর্মীয় বিশ্বাস। দুইজন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের লোক, যারা কেউ কাউকে কোনোদিন দেখেনি, তারাও বিনা যুক্তি-তর্কে একসাথে মুসলিম নিধনের জন্য ধর্মযুদ্ধে যেতে রাজি হতে পারে বা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একসাথে চাঁদা তুলতে পারে। কারণ, তারা দু’জনেই এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, স্রষ্টা মানুষের রূপ ধারণ করে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং আমাদের দুঃখ দূর করার জন্য স্বেচ্ছায় ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ‘রাষ্ট্র’ নামক প্রতিষ্ঠানটির মূলে রয়েছে সবার একই জাতীয়তাবাদের ধারণায় বিশ্বাস। দু’জন সার্বিয়ান যাদের একজনের সাথে অন্যজনের আগে কখনো পরিচয় হয়নি, তারাও কখনো কখনো একে অন্যকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে। এটা সম্ভব হয় কারণ, তাদের দু’জনেই সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করে, সার্বিয়াকে তাদের মাতৃভূমি হিসেবে জানে এবং সার্বিয়ান পতাকাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। বিচার ব্যবস্থাগুলোর মূলে আছে ‘ন্যায়’ নামক ধারণাটির উপর বিশ্বাস। দুইজন অপরিচিত আইনজীবী একযোগে চেষ্টা করতে পারে তাদের সম্পূর্ণ অচেনা মক্কেলকে বাঁচানোর জন্য। কারণ তারা দুইজনই বিশ্বাস করে আইন, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারকে এবং এসবের রক্ষায় তাদেরকে পারশ্রমিক হিসেবে দেওয়া অর্থকে।