সম্ভবত ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ হিসেবে ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ এবং ‘নদীর-পাড়ে-একটি-সিংহ-ছিল তত্ত্ব’ এ দুটোই সঠিক। যদিও মানুষের সম্পর্কে, সিংহের সম্পর্কে বা দৃশ্যমান পৃথিবী সম্পর্কে আশেপাশের মানুষকে জানানোর ক্ষমতাই মানুষের ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এ ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এই ভাষায় মানুষ কাল্পনিক ঘটনা বা বস্তু, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই তার গল্প অন্যদের কাছে করতে পারে। আমরা যতদূর জানি, সেপিয়েন্সই একমাত্র প্রাণী যারা যেসব জিনিস কখনো চোখে দেখেনি, স্পর্শ করেনি কিংবা ঘ্রাণ নেয়নি সেসব নিয়েও অন্যদের সাথে গল্প করতে পারে।
‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ এর সাথে সাথে প্রথমবারের মতো উপকথা, পুরাণ, ঈশ্বর এবং ধর্মের উদ্ভব হল। আগে অনেক প্রাণী, এমনকি সেপিয়েন্সও বলত- ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকেই মানুষ এরকম কথা বলার সুযোগ পেল- ‘সিংহ হলো আমাদের গোত্রের কুলদেবতা’। কাল্পনিক কথাবার্তা বলার এই ক্ষমতাই মানুষের ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ।
এই কথার সাথে সম্ভবত আমরা সবাই একমত হব যে, একমাত্র সেপিয়েন্সই এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে যেগুলোর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই এবং একদিন সকালের নাস্তা করতে বসে তারা ছয়টা বানানো গল্প বিশ্বাস করে বসতে পারে যেগুলো বাস্তবে অসম্ভব। ধরা যাক, একটা বানরকে আপনি গল্পের ছলে বললেন আজকে যদি সে আপনাকে একটি কলা দেয়, পরকালে বানরের স্বর্গে সে দশ হাজার কলা পাবে। বানরকে অনেক কষ্ট করে আপনি এই প্রস্তাবটা বোঝানোর পরপরই সে আপনার হাত থেকে কলাটা নিয়ে নির্লিপ্তভাবে খাওয়া শুরু করবে। সে আপনার বানানো পরকালের গল্প মোটেই বিশ্বাস করবে না। অন্যদিকে, অনেক মানুষই কিন্তু এধরনের গল্প বিশ্বাস করে থাকে। কিন্তু, এতসব কথা বানিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তা কি? কে না জানে, বানিয়ে বানিয়ে বলা মিথ্যে গল্প আমাদের ভুল পথে চালিত করতে পারে? কোন মানুষকে যদি পরীর মিথ্যে গল্প শোনানো হয় এবং সে পরীর খোঁজে বনের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে তাহলে তার নানারকম বিপদের আশঙ্কা থাকে। সে যদি বনে ফলমূল বা হরিণের সন্ধানে যেত, তাহলে তার বিপদের সম্ভাবনা কম থাকত- কারণ সে সহজেই ফলমূল বা খাবার সংগ্রহ করে ফেলতে পারত। ঠিক একই ভাবে কেউ যদি বনদেবতার বানানো গল্পে বিশ্বাস করে সারাদিন তার আরাধনায়ই ব্যস্ত থাকে, তাহলে সে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে কখন, খাবার জোগাড় করবে কখন কিংবা বংশবিস্তারেরই বা সময় পাবে কখন?
আমরা যে কেবল বাস্তবের বাইরের জিনিস কল্পনা করতে পারি তা-ই নয়, আমরা অনেকে মিলেও একই জিনিস কল্পনা করতে পারি। আমরা সবাই মিলে একসাথে জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হলো তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করি, এক একটা সৃষ্টিতত্ত্ব দাঁড়া করিয়ে তাতে বিশ্বাস করতে থাকি। আমরা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে কল্পকাহিনী বানাই, আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য কল্পনা দিয়ে বানাই ‘জাতীয়তাবাদ’। এইসব কল্পনাজাত ধারণা মানুষকে অনেক বড় একটা দল বা গোষ্ঠী হয়ে জীবন ধারণ করার এক অসাধারণ সুযোগ করে দেয়। পিঁপড়া এবং মৌমাছিরাও একসাথে অনেক বড় দল হয়ে জীবনধারণ করে; কিন্তু তাদের কাজকর্মের পরিধি খুবই সীমিত এবং তাদের যোগাযোগ শুধু পরিচিতদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। নেকড়ে এবং শিম্পাঞ্জির কাজকর্মের পরিধি কিছুটা বেশি, কিন্তু তাদের দলগুলো খুব ছোট ছোট হয় এবং দলে শুধু তারাই থাকে যাদের মাঝে চেনাজানা অনেক বেশি। অপরদিকে সেপিয়েন্সরা অপরিচিত অসংখ্য লোকের সাথে খুব সাচ্ছন্দ্যে যোগাযোগ করতে পারে, একসাথে থাকতে পারে। এই কারণেই সেপিয়েন্স সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করছে, আর ওদিকে পিঁপড়ারা আমাদের উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে, শিম্পাঞ্জিরা তালাবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের বানানো চিড়িয়াখানায় অথবা গবেষণাগারে।
পিউজো – একটি রূপকথা
আমাদের জ্ঞাতিভাই শিম্পাঞ্জিরা ছোট ছোট দল তৈরি করে বসবাস করে। প্রতিটা দলে কয়েক ডজনের মতো শিম্পাঞ্জি থাকে। তারা একে অপরের সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করে, একসাথে শিকার করে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেবুন, চিতা বা শত্রুপক্ষের শিম্পাঞ্জির সাথে লড়াইও করে। এদের সমাজে এক ধরনের স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত পুরুষ শিম্পাঞ্জিরাই এসব দলের দলনেতা হয়। দলনেতাকে বলা হয় ‘আলফা পুরুষ’ (Alpha Male)। প্রজা যেমন রাজাকে মাথা নত করে কুর্ণিশ করে, অনেকটা তেমন করেই শিম্পাঞ্জি দলের বাকি সদস্যরা মাথা নিচু করে এবং ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে দলনেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ‘আলফা পুরুষ’ তার দলের মাঝে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে। দলের দুইজনের মাঝে মারামারি লাগলে দলনেতা এগিয়ে যায় এবং মারামারি বন্ধ করে। একটু দুষ্টু প্রকৃতির দলনেতা হলে সে অধিকার খাটিয়ে বেশি খাবার খায় এবং নিচের স্তরের পুরুষদের নারী শিম্পাঞ্জিদের সাথে মিলিত হতে বাধা দেয়।
যখন দুইজন শিম্পাঞ্জি দলনেতা হবার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে, তারা তখন অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদের নানা কৌশলে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। নিজের দলের লোকজনের সাথে নেতা পদপ্রার্থীর আন্তরিকতা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর, যেমন- সে তাদের সাথে নিয়মিত আলিঙ্গন করছে কিনা, বাচ্চাদের চুমু খাচ্ছে কিনা, তরুণদের নানা জিনিস শেখাচ্ছে কিনা এবং বিপদে আপদে সাহায্য করছে কিনা। মানুষের সমাজের নেতারা যেমন ভোটের আগে সবার কাছে যান, হাত মেলান, বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, সেরকম শিম্পাঞ্জি দলের নেতা পদপ্রার্থীও এসময় জড়িয়ে ধরতে, পিঠ চাপড়ে দিতে এবং বাচ্চাদের আদর করতে অনেকটা সময় ব্যয় করে। মজার ব্যাপার হল, সবচেয়ে শক্তিশালী শিম্পাঞ্জি ‘আলফা পুরুষ’ হিসাবে নির্বাচিত হয় না, যার সমর্থক সংখ্যা বেশী এবং যার ধারাবাহিক সমর্থন আছে এমন শিম্পাঞ্জিই ‘আলফা পুরুষ’ হিসাবে নির্বাচিত হয়। এই সমর্থক শ্রেণী শুধু যে নেতা নির্বাচনে অবদান রাখে এমন নয়, দৈনন্দিন নানা কাজেও এরা সাহায্য করে থাকে। একই দলের লোকজন নিজেদের সাথে বেশি সময় কাটায়, নিজেদের খাবার ভাগাভাগি করে খায় এবং বিপদে একে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করে।