এই প্রশ্নের বেশ সহজ এবং বহুল প্রচলিত একটি উত্তর আছে। সেটা হলো – আমরা মানুষেরা কিছু সীমিত সংখ্যক ধ্বনি এবং প্রতীককে বিভিন্নভাবে জোড়া লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য তৈরি করতে পারি যেই বাক্যগুলো প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। এইভাবে আমরা পৃথিবী সম্পর্কে অনেক রকম তথ্য জানতে পারি, জমা করতে পারি এবং অন্যদের জানাতে পারি। একটা সবুজ বানর তার সঙ্গীদের চিৎকার করে জানান দিতে পারে – ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ তার বন্ধুকে এভাবে বলতে পারে যে, আজ সকালে নদীর ধারে একটা সিংহ একটা বাইসনকে তাড়া করছিল। সে এটাও বলতে পারে ঠিক কোন জায়গায় সে ঘটনাটা ঘটতে দেখেছে, কোন কোন রাস্তা দিয়ে জায়গাটাতে পৌঁছানো যায়। এই তথ্যগুলো নিয়ে তার সঙ্গী-সাথীরা আলাপ আলোচনা করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে এ অবস্থায় বাইসনটাকে শিকার করতে যাওয়াটা উচিত কাজ হবে কি না।
এ ব্যাপারে আরেকটা তত্ত্ব যা বলে তা হলো – সেপিয়েন্সদের এই ভাষার উদ্ভব হয়েছে আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কিত তথ্যাদি একে অন্যকে জানানোর জন্য। আর এটা তো জানা কথা যে, সিংহ আর বাইসনের মতো জীব-জন্তুর খবরের থেকে অন্যান্য মানুষ সম্পর্কিত তথ্য আমাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আমরা মানুষেরা গল্প শুনতে, মানুষকে নিয়ে গল্প করতে বেশি পছন্দ করি। তাই বলতে পারি, আমাদের ভাষার উদ্ভব হয়েছে মূলত নিজেদের নিয়ে গল্প করার, আড্ডাবাজি করার এমনকি নিন্দা করার উপায় হিসেবে। এই তত্ত্বানুযায়ী মানুষ জন্মগতভাবেই সামাজিক প্রাণী। সামাজিক সহযোগিতা আমাদের টিকে থাকা এবং বংশবিস্তারের জন্য অপরিহার্য। শুধু সিংহ বা বাইসনের সম্পর্কে জানাই কোনো মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। এর চেয়ে একই গোষ্ঠীর মানুষের মাঝে কে কাকে হিংসা করে, কার সাথে কার বিয়ে হলো, কে সৎ আর কে অসৎ এটা জানা মানুষের জন্য অনেক জরুরি।

মানুষের সাথে মানুষের এই নিয়ত পরিবর্তনশীল সম্পর্ক সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখতে গেলে যতখানি তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে তার পরিমাণ বিশাল (৫০ জনের একটি দলে, ১,২২৫ ভাবে এক জন মানুষের সাথে আরকেজন মানুষের সম্পর্ক হতে পারে। একজন মানুষের সাথে একাধিক মানুষের সম্পর্কের রকমফেরের হিসাব করাটাই প্রায় অসম্ভব মানুষের পক্ষে)। সকল নরবানর নিজেদের এইসব সামাজিক সম্পর্কের তথ্য সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী, কিন্তু ভাষা সুবিধাজনক না হবার কারণে তাদের পক্ষে এই সকল বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া বা গল্প করা বেশ কঠিন ছিল। এমনকি নিয়ান্ডার্থাল বা একদম আদিম যুগের হোমো সেপিয়েন্সদেরও কথা বলার এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু এই কথা বলার ব্যাপারটা অনেকজন একসাথে মিলেমিশে থাকতে গেলে নিতান্তই অপরিহার্য ছিল। নতুন ধরনের ভাষা – যেটা সেপিয়েন্সরা মোটামুটি ৭০,০০০ বছর আগে রপ্ত করতে পেরেছিল- এই ভাষা তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুনসুটি করার, গল্প করার এমনকি পরনিন্দা করার একটা সুযোগ করে দিল। কথা বলে মানুষ বুঝতে শিখল দলের কার উপর ভরসা রাখা যায়, আর কার থেকে সাবধানে থাকা ভালো। এই বুদ্ধি ছোট ছোট মানবগোষ্ঠীকে বড় বড় মানব গোষ্ঠীতে পরিণত হবার সুযোগ করে দিল। সেপিয়েন্স তার ফলে আরও সঠিকভাবে আরও জটিল সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হল।১
আড্ডা, খুনসুটি বা পরচর্চা করার জন্যই সেপিয়েন্সদের ভাষার বিকাশ ঘটেছে- এরকম একটি তত্ত্বকে আমরা ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ (Gossip Theory) নামে ডাকতে পারি। যদিও পরচর্চার জন্যই ভাষার বিকাশ ঘটেছে- এই কথাটা শুনতে আপাতভাবে অনেক হাস্যকর মনে হয়, কিন্তু এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণাই কিন্তু এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। এমনকি আজকের দুনিয়ার কথা যদি ভাবি – এখনও মানুষের সাথে মানুষের বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনার বিষয় জুড়ে থাকে অপরে কী করল, কী খেল, কোথায় কোন মুখরোচক বা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল – এসব নিয়ে; হোক সে ই-মেইলে, ফোনে কিংবা সংবাদপত্রের পাতায়। পরচর্চা করার ব্যাপারটা আমাদের এতটাই মজ্জাগত যে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, বুঝিবা গল্প-গুজব আর পরনিন্দা-পরচর্চা করার জন্যই মানুষের ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ হয়েছে। আপনাদের কি মনে হয় একজন ইতিহাসের অধ্যাপক দুপুরের খাওয়া দাওয়া করার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে আলোচনা করেন বা একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কোয়ার্ক নিয়ে কোনো সম্মেলন এর ব্যাপারে আলোচনা করেন? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে যে করেন না তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তাদের আলোচনা জুড়ে থাকে কোন অধ্যাপক পরকীয়া করতে গিয়ে বৌয়ের কাছে ধরা পড়ল, বিভাগীয় প্রধান কিভাবে ডিনের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধাল কিংবা কোন অধ্যাপক গবেষণার টাকা মেরে বিলাসবহুল গাড়ি কিনল।