বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন যে, এতসব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পেছনে নিশ্চয়ই সেপিয়েন্সদের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার কোনো পরিবর্তন দায়ী। তাদের দাবী- যে সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডার্থাল নামের পুরো একটি প্রজাতিকে দুনিয়া থেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিতে পারে, সাগর পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করতে পারে এবং জার্মানির স্টেডেল গুহায় কাল্পনিক সিংহ-মানবের মূর্তি বানাতে পারে তারা নিশ্চয়ই আমাদের মতোই বুদ্ধিমান, আমাদের মতোই সৃষ্টিশীল এবং আমাদের মতোই সংবেদনশীল ছিল। সুতরাং কোনোভাবে যদি স্টেডেল গুহায় কাজ করা সেইসব শিল্পীদের সাথে আমাদের দেখা হয়ে যায়, আমরা তাদেরকে আমাদের ভাষা বোঝাতে পারব এবং চেষ্টা করলে আমরাও তাদের ভাষা শিখতে পারব। আমরা তাদের শোনাতে পারব অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এর মতো কাহিনী বা বোঝাতে পারব কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব। একইভাবে তারাও আমাদের বলতে পারবে তাদের মানুষদের চোখে কেমন ছিলো আমাদের পৃথিবী।
৭০,০০০ বছর আগে থেকে ৩০,০০০ বছর আগের এই সময়টায় সেপিয়েন্সদের এই যে নতুন ভাবে চিন্তা করার এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতার সূচনা হলো, সেটাকে আমরা বলছি – বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব। এই বিপ্লব কীভাবে সম্ভব হলো? আমরা এখনও সঠিকভাবে সেটা জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যে তত্ত্ব সবচেয়ে বেশী প্রচলিত সেটা জানবার জন্য আমাদের একটু বিজ্ঞানের আঙিনা থেকে ঘুরে আসতে হবে। বিজ্ঞান বলে – ‘জিন’ (gene) হলো জীবন্ত প্রাণের বংশগতির আণবিক একক। একটি জীবের বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য যা দায়ী, তা-ই জিন। এই জিনগুলোর বিভিন্নতার কারণে একটি জীবগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এই ভিন্নতার কারণেই কেউ জন্মগতভাবে একটু রাগী, কেউ চুপচাপ। কেউ খেলাধুলায় চৌকস, কেউ লেখালেখিতে। জিনের অভ্যন্তরীণ গঠনের পরিবর্তনকে আমরা বলি জিনের ‘পরিব্যক্তি’ (Mutation)। জিনের পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনও ঘটতে পারে।
এবারে আগের প্রশ্নে ফেরা যাক। সেপিয়েন্সদের ‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ এর কারণ হিসেবে সবচেয়ে প্রচলিত মতবাদে বলা হয় মোটামুটি ৭০,০০০ বছর আগে সেপিয়েন্সদের জিনের কোনো আকস্মিক পরিব্যক্তি তাদের মস্তিষ্কের নিউরনের মাঝে সংযোগের পদ্ধতি পাল্টে দেয়। এর ফলে তারা একে অপরের সাথে আরও সার্থকভাবে যোগাযোগ করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষা আয়ত্ব করতে পারে। আমরা এই রূপান্তরের নাম দিতে পারি – ‘জ্ঞান বৃক্ষের রূপান্তর’ (Tree of Knowledge mutation)। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে শুধু সেপিয়েন্সদের জিনেই কেন এই রূপান্তর হলো – নিয়ান্ডার্থাল বা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রে এই রূপান্তর হলো না কেন? এর উত্তরে বলা যায়, জিনের এই রূপান্তরের ব্যাপারটা পুরোপুরি আকস্মিক। ঘটনাক্রমে এটা সেপিয়েন্সদের ক্ষেত্রে ঘটেছে – এটা নিয়ান্ডার্থাল বা মানুষের অন্য কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত। কিন্তু এই রূপান্তরের কারণের চেয়ে এই ‘জ্ঞান বৃক্ষের রূপান্তর’ এর ফলে কী কী পরিবর্তন হলো সেটা জানা অনেক বেশি জরুরি। প্রশ্ন জাগে, সেপিয়েন্সদের এই নতুন ভাষায় এমন কী বিশেষত্ব ছিলো যা তাদেরকে পুরো দুনিয়া জয় করার ক্ষমতা দিয়ে দিলো?
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার সেপিয়েন্সদের এই ভাষা কিন্তু দুনিয়ার প্রথম ভাষা নয়। যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক প্রাণীর নিজেদের ভাষা আছে। প্রত্যেক পোকামাকড়, যেমন পিঁপড়া ও মৌমাছি ভালো মতোই জানে কীভাবে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করতে হয়, কীভাবে খাবারের খবরাখবর অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। যদি শুধু মুখের ভাষা বিবেচনা করি, সেই হিসেবেও সেপিয়েন্সদের এই ভাষা প্রথম ভাষা নয়। অনেক প্রাণীর যেমন গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং বানরের অনেক প্রজাতির নিজস্ব মুখের ভাষা আছে। উদাহরণ হিসেবে সোনালী-সবুজ পশমওয়ালা এক জাতীয় বানরের নাম করা যায় (Green Monkey বা সবুজ বানর), যারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন মৌখিক ধ্বনি ব্যবহার করে। জীববিজ্ঞানীরা এরকম একটি ধ্বনি সংকেত সনাক্ত করেছেন যার অর্থ – ‘সাবধান! ঈগল আসছে’। একটু আলাদা একটা ধ্বনি সংকেত বোঝায় – ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। গবেষকরা যখন প্রথম ধ্বনি সংকেতটি রেকর্ড করে একদল সবুজ বানরকে শোনাচ্ছিলেন – হুট করে বানরগুলো থেমে গেল এবং ভয়ার্ত চোখ নিয়ে উপরের দিকে তাকাল। যখন একই বানরের দলকে দ্বিতীয় ধ্বনিসংকেতটি শোনানো হল – যেটা সিংহ আসার সংকেত – সাথে সাথে বানরগুলো লাফ দিয়ে গাছে চড়ে বসল। সেপিয়েন্স বানরের চেয়ে অনেক বেশি ধরনের ধ্বনি সংকেত তৈরি করতে পারে, তবে তিমি এবং হাতিরও এরকম অনেক ধরনের ধ্বনি তৈরির ক্ষমতা আছে। আইনস্টাইন ধ্বনি ব্যবহার করে যা বলতে পারেন, একটা তোতাপাখিও শুনে শুনে সেই কথাগুলোই বলতে পারে, এমনকি সে ফোন বাজার শব্দ, দরজা ধাক্কানোর শব্দ বা দমকলের সাইরেনের শব্দও নকল করতে পারে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, শুধু ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারাটাই আইনস্টাইনের বিশেষত্ব নয়। অনেক রকম ধ্বনি তৈরির ক্ষমতাকে বাদ দিলে, কী সেই বিশেষ বিষয় যার জন্য আমাদের ভাষা এতটা গুরুত্বপূর্ণ, এতটা কার্যকর?