বিগত ১০ হাজার বছর ধরে এই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিজেদেরকে পৃথিবীর একমাত্র মানব প্রজাতি বলে ভেবে আসছে। তাদের এই ধারণা এতই বদ্ধমূল যে তারা এ ব্যাপারে কোনো রকম ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। মানুষের অন্যান্য প্রজাতির উপস্থিতিকে অস্বীকার করে মানুষ খুব সহজে নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব এবং অন্য সবরকম প্রাণী থেকে আলাদা ভাবতে পারে। চার্লস ডারউইন যখন বললেন, মানুষ আর দশটা প্রাণীর মতোই আরেকটি প্রাণী, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া মোটেই ভালো হয়নি। আজকের দিনেও সে অবস্থা তেমন পাল্টায়নি। নিয়ান্ডার্থালরা যদি আজও টিকে থাকত, তাহলেও কি আমরা নিজেদেরকে সমগ্র প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা করে দেখতাম? সম্ভবত এটাই আমাদের পূর্বসূরীদের হাতে নিয়ান্ডার্থালদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ। তাদের সাথে আমাদের মিল এত বেশি ছিল যা অস্বীকার করা কঠিন, আবার পার্থক্যও এত বেশি যে তাদের সাথে সহাবস্থান করতেও রাজি হয়নি সেপিয়েন্স।
সেপিয়েন্স দায়ী হোক বা না হোক, এটা দেখা গেছে যে তারা যখনই কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছেছে তখন সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হোমো সলোয়েনসিসের সর্বশেষ অস্তিত্ব নির্ণয় করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে। তার কিছু পরেই হোমো ডেনিসোভা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়। নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। সর্বশেষ বিলুপ্ত হয় ফ্লোরেন্স দ্বীপের বামনাকৃতি মানুষের প্রজাতিটি, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। মানুষের এইসব প্রজাতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু তারা পৃথিবীতে রেখে গেছে তাদের দেহাবশেষ, পাথরের হাতিয়ার, আমাদের ডিএনএর মাঝে কিছু জিন আর অনেক অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন। আর রেখে গেছে আমাদের, মানুষের সর্বশেষ প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সকে।
সেপিয়েন্সদের এই বিপুল সাফল্যের রহস্য কী ছিল? কীভাবে মানুষ এত দ্রুত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো? কীভাবে এতরকম ভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকল তারা? মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্নই বা করল কীভাবে? শক্তসমর্থ, বুদ্ধিমান, শীতসহিষ্ণু নিয়ান্ডার্থালরাই বা কেন টিকতে পারল না সেপিয়েন্সদের আক্রমণের মুখে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলছে অন্তহীন বিতর্ক। এসব প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে ভাষা। ভাষার মত অনন্যসাধারণ একটি বৈশিষ্ট্যই সেপিয়েন্সদের সাহায্য করেছে পৃথিবী জয় করতে।
তথ্যসূত্র
1 Ann Gibbons, ‘Food for Thought: Did the First Cooked Meals Help Fuel the Dramatic Evolutionary Expansion of the Human Brain?’, Science 316:5831 (2007), 1,558–60.
০২. জ্ঞানবৃক্ষের বেড়ে ওঠা
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখলাম যে, সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় দেড় লাখ বছর ধরে বসবাস করে আসলেও, তারা আনুমানিক ৭০,০০০ বছর আগে থেকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং মানব গোত্রের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্ত করে ফেলে। এর মাঝামাঝি সময়টাতে, সেপিয়েন্সরা দেখতে আমাদের মতো হলেও এবং তাদের মস্তিষ্ক আমাদের মস্তিষ্কের সমান বড় হলেও, তারা তাদের জ্ঞাতিভাইদের থেকে খুব একটা এগোতে পারেনি। তারা এসময় তেমন কোনো সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করতে পারেনি কিংবা প্রাণিকুলের অন্যদের চেয়ে বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের নজিরও রাখতে পারেনি।
এমনকি সেপিয়েন্সদের সাথে তাদের আরেক সমগোত্রীয় নিয়ান্ডার্থালদের প্রথম যে লড়াইয়ের কথা জানা যায়, তাতে নিয়ান্ডার্থালরাই জয়লাভ করেছিলো। সে প্রায় ১ লক্ষ বছর আগের কথা। এই সময়ে কিছু সেপিয়েন্স আফ্রিকার উত্তরে নীল নদ ঘুরে সিনাই উপদ্বীপ পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পৌঁছায়। এই এলাকা তখন নিয়ান্ডার্থালদের দখলে ছিলো। সেপিয়েন্সরা এখানে পৌঁছাবার পর প্রাথমিকভাবে এখানে স্থায়ী বসতি গড়তে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় লোকজনের অসহযোগিতা, বৈরী জলবায়ু আর এ অঞ্চলের অচেনা রোগ-বালাই এই ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। যে কারণেই হোক, সেপিয়েন্সরা একসময় এই এলাকা থেকে পিছু হটে এবং নিয়ান্ডার্থালরাই মধ্য এশিয়া জুড়ে বসবাস করতে থাকে।
সেপিয়েন্সদের এই পরাজয়ের ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের এই ধারণা দেয় যে, সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ গঠন আমাদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা ছিলো। তারা দেখতে আমাদের মতোই ছিলো – কিন্তু তাদের শেখার, মনে রাখবার বা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা ছিলো খুবই সীমিত। এই রকম একজন সেপিয়েন্স আমাদের আধুনিক কোনো ভাষা শিখবে, ধর্ম কর্মের কথা জানবে বা বিবর্তনের তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে এমনটা আশা করাই বোকামি। আবার, এরকম একজন সেপিয়েন্সের ভাষা শেখা বা তারা কীভাবে চিন্তা করত সেটা বোঝার চেষ্টা করা আমাদের বর্তমানের মানুষদের জন্যও বেশ কঠিন একটা কাজ।
এর পরের ইতিহাস কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। আনুমানিক ৭০,০০০ বছর আগে থেকে সেপিয়েন্সরা তাক লাগানোর মত কাজকর্ম শুরু করলো। এই সময়কালে সেপিয়েন্সরা দ্বিতীয় বারের মতো আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। তবে এইবার তারা নিয়ান্ডার্থাল এবং মানুষের অন্যান্য প্রজাতিকে মধ্য এশিয়া থেকে তো বটেই, এমনকি দুনিয়ার বুক থেকেই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। খুব অল্প সময়ের মাঝেই তারা ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে যায়। প্রায় ৪৫,০০০ বছর আগে তারা সাগর পাড়ি দিতে শেখে এবং অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যায়। এর আগে এই মহাদেশে কোনো মানুষেরই পা পড়েনি। ৭০,০০০ বছর আগে থেকে ৩০,০০০ বছর আগের এই সময়টাতে সেপিয়েন্স নৌকা, তেলের প্রদীপ, তীর ধনুক এমনকি সুঁই-সুতা আবিষ্কার করে ফেলে। শীতের দেশে গরম কাপড় বোনার জন্য এই সুঁই-সুতা খুবই জরুরী ছিলো।