পথের মাঝে উটকো এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘোড়সওয়ার চাবুক নাচাল। ঘোড়র পায়ের নিচে পড়তে না চাইলে সামনে থেকে সরে যা!
থিবল্ট অর্ধ মাতাল হয়ে আছে। চাবুকের বাড়ি আর ঘোড়ার ধাক্কায় ছিটকে পড়ে কাদায় গড়াগড়ি খেল ও। ততক্ষণে ঘোড়সওয়ার সামনে এগিয়ে গেছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে অপস্রিয়মাণ আকৃতির দিকে আঙুল তুলে বলল থিবল্ট, যদি জুতোর কারিগর থিবল্ট না হয়ে, শুধু একদিনের জন্যও আপনাদের মতো লর্ড হতে পারতাম। পায়ে হাঁটার বদলে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে কেমন লাগে, পথচারীদের চাবুকপেটা করতে কেমন লাগে, কোতেস দু মন-গুবের মতো স্বামী প্রবঞ্চক স্ত্রীদের সাথে প্রেম করতে কেমন লাগে জানতে পারতাম।
সঙ্গে সঙ্গে দূরবর্তী ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠে পিঠের আরোহীকে মাটিতে ফেলে দিল!
ষষ্ঠদশ অধ্যায় – প্রেয়সী
তরুণ ব্যারনকে পড়ে যেতে দেখে খুশি হলো থিবল্ট। দৌড়ে দেখতে গেল কী অবস্থা। চাবুকের বাড়ির কারণে কাঁধ এখনও জ্বলছে ওর। পড়ে থাকা শরীরটার পাশে ঘোড়াটা ঘুরছে। কাছে গিয়ে দেখল, একটু আগেই ঘোড়ায় চড়ে ওর পাশ দিয়ে যে ছুটে গেছে, সে লোক এ নয়। এর পরনে এক দরিদ্র পথিকের পোশাক। উত্তরোত্তর ওর বিস্ময় বাড়তেই থাকল। আরও অবাক হলো যখন দেখল-অজ্ঞান শরীরটা হুবহু ওর মতো দেখতে, ওরই পোশাক পরা! নিজের দিকে তাকাল থিবল্ট। ওর পোশাকও পাল্টে গেছে। দামী শিকারি বুট ওর পায়ে, দামী কোটে সোনার কারুকাজ করা, ওয়েস্টকোটটা সুন্দর সাদা জিনসের, শার্টটাও অভিজাতদের উপযোগী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওর বেশভূষা পাল্টে গেছে। হাতে একটা চাবুকও চলে এসেছে। ওটা দিয়ে বাতাসে একবার বাড়ি মেরে শব্দ শুনল থিবল্ট। কোমরে ওর শোভা পাচ্ছে বড় একটা শিকারি ছুরি, যেটাকে তলোয়ারও বলা চলে।
নিজের পরনে এই চমৎকার পোশাক দেখে প্রচণ্ড খুশি হলো ও। এই পোশাকে ওকে কেমন মানিয়েছে দেখতে অধীর হয়ে উঠল। আর তখনই মনে পড়ল, বাড়ির বেশ কাছেই চলে এসেছে ও। আহ! আমার ঘরেই তো আয়না আছে!
ছুটে গেল থিবল্ট নিজের ঘরের দিকে, নার্সিসাসের মতো নিজের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে। কিন্তু ঘরের দরজা তালাবদ্ধ। চাবির জন্য পকেট হাতড়াতে লাগল ও। টাকা ভরা পার্স, চকলেট, ছোট পেন-নাইফ এসব খুঁজে পেল। কিন্তু দরজার চাবিটা কোথায় গেল? হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল ওর। চাবিটা হয়তো রাস্তায় শুয়ে থাকা থিবল্টের পকেটে আছে। ফিরে গিয়ে পকেট থেকে উদ্ধার করল ওটা। ঘরের ভেতরটা বাইরের চাইতেও অন্ধকার। দিয়াশলাই খুঁজে নিয়ে মোম জ্বালাতে জ্বালাতে বলে উঠল, শুয়োরগুলো এই নোংরার মধ্যে কীভাবে থাকে কে জানে!
আলো জ্বালিয়ে আয়নাটা নামিয়েই চমকে উঠল ও। আত্মাটা থিবল্টের হতে পারে, কিন্তু শরীরটা কোনমতেই থিবল্টের নয়। আয়নার ভেতর পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের এক সুদর্শন তরুণ তাকিয়ে আছে। নীল চোখ, গোলাপী গাল, লাল ঠোঁট, সাদা দাঁত। থিবল্টের আত্মা ব্যারন রাউল দু ভোপাফোর শরীরে প্রবেশ করেছে। এখন বুঝতে পারছে কেন জ্ঞান হারা মানুষটা ওর পোশাক পরে, ওর চেহারা নিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে।
একটা জিনিস ভুললে চলবে না-যদিও মনে হচ্ছে আমি এখানে, কিন্তু আমি আসলে বাইরে রাস্তায় শুয়ে আছি। সাবধান থাকতে হবে যেন আগামী চব্বিশ ঘণ্টা আমার কোন ক্ষতি না হয়। মঁসিয়ে দু ভোপাফোঁ, বেশি চিন্তা না করে বেচারাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দাও। মঁসিয়ের অভিজাত অনুভূতির কাছে কাজটা অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে হলেও, থিবল্ট রাস্তা থেকে নিজের দেহটাকে তুলে ঘরে নিয়ে এল, সাবধানে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। একটা গাছের খোড়লে লুকিয়ে রাখল চাবিটা।
পরের কাজ হচ্ছে ঘোড়াটাকে ধরে চড়ে বসা। সারাজীবন হেঁটেই চলাফেরা করেছে থিবল্ট, ভাল ঘোড়সওয়ার ও নয়। ঘোড়া ঠিকমতো চালাতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো না। রাউলের শরীরের সাথে সাথে শারীরিক দক্ষতাগুলোও আয়ত্তে চলে এসেছে ওর। পিঠে সওয়ারি টের পাওয়া মাত্র ঘোড়াটা লাফাতে শুরু করল। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী হয়েই রাশ চেপে ধরল ও। দুপা দিয়ে ঘোড়ার দুপাশ চেপে ধরে স্পার দাবাল। দুচারটা চাবুকের বাড়ি মেরে জটাকে বশে আনার প্রয়াস পেল।
ওর অবশ্য পরিষ্কার ধারণা নেই এরপর কী করবে। শুধু জানে কোতেফসের চিঠি অনুযায়ী মন-গুবেতে যেতে হবে। চিঠিতে কী লেখা? ঠিক কখন দেখা করার কথা? দুর্গে কীভাবে ঢুকবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর একটা একটা করে ওকে আবিষ্কার করতে হবে। আচ্ছা, চিঠিটা তো এখন ওর কাছেই থাকতে পারে। হাতড়াতে হাতড়াতে ভেতরের পকেটে চিঠির মতো একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। ঘোড়া থামিয়ে একটা ছোট চামড়ার ব্যাগ বের করল ও। ব্যাগের এক পকেটে কয়েকটা চিঠি আর এক পকেটে একটা চিঠি। এটাই সম্ভবত সেই চিঠি। পড়তে হলে আলো দরকার। কাছের একটা লোকালয়ে গেল থিবল্ট। কোন ঘরে আলো চোখে পড়ল না। একটা সরাইয়ের আস্তাবলে নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ডাক দিল। বাতি হাতে একটা ছেলে বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণ আলো ধরে রাখতে পারবে? খুব উপকার হত।
এরজন্যই ঘুম ভাঙিয়ে বিছানা থেকে ডেকে তুললেন? খুব রুক্ষ স্বরে বলল ছেলেটা। মানুষ বটে আপনি! বলে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো সে। ভুলভাবে ছেলেটার সাথে কথা শুরু করেছে, বুঝতে পারল থিবল্ট। এবার তাই গলা চড়িয়ে বলল, এই ছেলে! চাবুকের বাড়ি খেতে না চাইলে আলোটা নিয়ে এদিকে এসো!