- বইয়ের নামঃ দ্য উলফ লিডার
- লেখকের নামঃ আলেকজান্ডার ডুমা
- প্রকাশনাঃ বহুমাত্রিক প্রকাশনা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
দ্য উলফ লিডার
অনুবাদকের কথা
দ্য উলফ লিডার – আলেক্সান্ডার দ্যুমা
রূপান্তর-ফারুক বাশার
অনুবাদকের কথা
এতদিন ধরে নিজেই বই পড়ে যাচ্ছি। আজ যখন একটা অনুবাদ বই বেরোচ্ছে, যে বইয়ের অনুবাদক হিসেবে আমার নাম যাবে, তখন ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।
মানুষ হিসেবে আমার গড়ে উঠবার, আজকের এই জায়গায় এসে দাঁড়াবার পেছনে বইয়ের যেমন অবদান আছে, তেমনি আছে আমার কাছের কিছু মানুষের। স্বজন, বন্ধু-আলাদাভাবে সবার নাম করতে গেলে বিশাল লিস্ট হয়ে যাবে। শুধু এটুকুই বলব, এই মানুষগুলোর কাছে আমার প্রাপ্তি অনেক। এদেরকে আমার জীবনে পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ। আজীবন যেন তারা এভাবেই আমার সাথে থাকে, এটাই চাওয়া।
হঠাৎ করেই সৈয়দ অনির্বাণ একদিন প্রস্তাবটা দিয়ে বসলেন। আলেক্সান্ডার দ্যুমার একটা উপন্যাস, অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার স্যাপার আছে, তার উপর প্রকাশক নিজেই প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাই আর না বলিনি। উপন্যাসটা খুঁজে বের করার কৃতিত্ব অবশ্য তানভীর মৌসুমের। দুজনেই নানান কারণে নিজেরা অনুবাদে হাত না দিয়ে আমাকে করার সুযোগ দেয়ায় দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরও ধন্যবাদ দিতে হবে সাজেদুল হক রনি ভাইকে। উৎসাহ, পরামর্শ এবং উপন্যাসটা দেখে দেয়ার জন্য। হুমাইরা আহমেদ তিহিকে ধন্যবাদ প্রচ্ছদের জন্য। আরও যারা বইটা প্রকাশের সাথে জড়িত, যাদের সবার নাম হয়তো আমি জানিও না, তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
যতটুকু পারি নিজের জ্ঞানে অনুবাদটা সহজ করার চেষ্টা করেছি। পড়তে পারছেন কি না সেটা পাঠকেরাই বিবেচনা করবেন। ভাল লাগলে তার কৃতিত্ব লেখকের, আর খারাপ লাগলে সে দায় অনুবাদক হিসেবে মাথা পেতে নিচ্ছি।
ফারুক বাশার
জানুয়ারি ২০১৮
দ্য উলফ লিডার প্রসঙ্গে
যদিও সূচনায় সাক্ষরের তারিখ ৩১ মে, ১৮৫৬, কিন্তু ধারণা করা হয় উলফ লিডার রচিত হয় ১৮৫২ থেকে ১৮৫৪-এর মধ্যে। ওই সময়টায় দ্যুমা নির্বাসনে ছিলেন। সে সময়ের প্রকাশিত আরও কিছু উপন্যাসের সাথেই এটা লেখা হয়।
দ্যুমার পৈতৃক আবাসস্থল ছিল ভিলারস-কটেরেট। সেখানেই প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে গল্পটা শুনেছিলেন তিনি। পরে তাতে কল্পনার রঙ মিশিয়ে আর নাটকীয়তা যোগ করে পুরো কাহিনীটা লিখে ফেলেন। সূচনায় শৈশবের কিছু স্মৃতিচারণ করেছেন। এবং স্বীকারও করেছেন শোনা গল্পটা তিনি নিজের মতো করে বলেছেন। এই উপন্যাসে প্রেমের সাথে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা এবং অরণ্য জীবনের মিশেল দিয়েছেন মা।
মূল গয়ে ডুবে যেতে যেতে পাঠক যেন অরণ্যের মুক্ত জীবনের ছোঁয়া পায়। সেদিকে লক্ষ রেখেছেন। বনের ভেতর একটা পরিষ্কার অংশে অবস্থান একটা ছোট্ট শহরের। সেই শহরেরই ছেলে আলেক্সান্ডার। প্রায়ই সে পালিয়ে যায়। কখনও পালায় স্কুলের বাধাধরা রুটিন থেকে, কখনও বা সেই আত্মীয়ের হাত থেকে যে ওকে যাজক বানাতে চায়। এভাবেই শৈশবে দ্যুমা কাব্যিক সৌন্দর্য্য এবং রহস্যের আধার বনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়েছিলেন তাকে লুকোবার জায়গা এবং শিকারের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। নিকটবর্তী পার্কে যখন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, তখন সেই কষ্ট তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর স্মৃতিকথায়।
উলফ লিডার প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৭ সালে, তিন খণ্ডে। পরে ১৮৬০ সালে দমা দ্য মন্টেক্রিস্টো পত্রিকায় উপন্যাসটা আবার প্রকাশ করেন।
প্রারম্ভ – মোকেটের পরিচয়
১
ছোট্ট একটা শহরে আমার জন্ম। কাছেই একটা বন আর কিছু গ্রাম। ১৮২৭ থেকে ১৮৪৭, সাহিত্য জীবনের প্রথম বিশ বছর জন্মস্থানকে উপেক্ষা করে গেছি। কেন সেটা আমি নিজেও জানি না। কীভাবে যেন শৈশব আমার কাছ থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, যেন মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে!
জীবনের শুরুতে আমাদের পথ দেখায় আশা, তাই ভবিষ্যতটা থাকে অনেক পরিষ্কার। তারপর একসময় যাত্রার ক্লান্তি আমাদের ধরে ফেলে। তখন সবকিছু একপাশে রেখে আমরা বসে পড়ি। ফিরে তাকাই ফেলে আসা পথের দিকে। জীবনের শেষে এসে সঙ্গী হয় বাস্তবতা। ভবিষ্যৎ তখন হয়ে পড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন।
একসময় বুঝতে পারি, সামনে ধূসর মরুভূমি আমাদের অপেক্ষায়। তখন অবাক হয়ে পেছনের ফেলে আসা ছোট ছোট মরূদ্যানগুলোকে আবিষ্কার করি। যেগুলোকে অবহেলায় ও অলক্ষ্যে পাশ কাটিয়ে এসেছি।
সুখের খোঁজে কত তাড়া ছিল আমাদের। কিন্তু কোন পথই কাউকে কখনও কাক্ষিত সুখের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না। কতটা অন্ধ আর অকৃতজ্ঞ ছিলাম আমরা! আবার যদি এমন কোন ছায়া সুনিবিড় জায়গায় ফিরে যেতে পারতাম, সেখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।
শরীরের পক্ষে সম্ভব না ফিরে যাওয়া, কিন্তু স্মৃতির বেলায় সে বাধা নেই। স্মৃতি ছাড়া শরীর তারাহীন রাতের মতো, আলোহীন বাতির মতো। তাই শরীর আর স্মৃতি দুটো ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে।
অজানার দিকে যখন এগিয়ে যায় শরীর, স্মৃতি তখন ঘুরে বেড়ায় ফেলে আসা সময়ে। ফেলে আসা কোন মরূদ্যানই সে বাদ দেয় না। ভ্রমণ শেষে আবার ফিরে আসে শরীরে। যা কিছু দেখেছে সেসবের গল্প শোনায়।
শুনতে শুনতে ক্লান্ত পথিকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, মুখে ফুটে ওঠে হাসি। শৈশবে ফিরতে পারে না সে, তাই শৈশবকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
তে জীবন কি অনেকটা চক্রের মতো নয়? দোলনা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। কবরের দিকে যত এগোই, ততই আবার দোলনার দিকেই কি ফিরে আসি না?
২
এখন আমি আপনাদের থিবল্ট, ওর নেকড়ের পাল, লর্ড ভেয, আর অ্যানলেটের গল্পটা বলব। গল্পটি আমি শুনেছি মোকেটের কাছ থেকে। মোকেট সম্বন্ধে আমি আরেকটু বিস্তারিত বলব যাতে পাঠক ওকে ভাল করে বুঝতে পারেন।
আমার তখন তিন বছর বয়স। বাবা-মায়ের সাথে লে ফস নামের একটা দুর্গে থাকি। এন আর ওইযের সীমান্তে, আহামো আর লোপোর মাঝে। আমার বোন প্যারিসে থাকত। বছরে একবার মাসখানেকের জন্য বাড়ি আসত।
আমাদের বাড়িতে আরও ছিল ট্রাফল নামে একটা কুকুর-আমি প্রায়ই ওটার পিঠে চেপে ঘুরতাম; মালি পিয়ের-আমাকে খেলার জন্য সাপ ব্যাঙ যোগাড় করে দিত; বাবার নিগ্রো ভ্যালে হিপোলাইট; অতঃপর মোকেট-বাড়ি দেখাশোনা করত; আর ছিল রাধুনী মেরি, যার ব্যাপারে নাম ছাড়া আর তেমন কিছুই অবশ্য আমার মনে নেই।
মোকেট আমাকে নেকড়ে-মানব আর ভূতের গল্প বলত যতক্ষণ না জেনারেল-আমার বাবাকে জেনারেল বলেই ডাকা হত-এসে বাধা দিতেন।
তবে এই কাহিনীর বয়ানে একমাত্র মোকেটই উঠে আসবে, সুতরাং তাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা যাক।
৩
মোকেটের বয়স বছর চল্লিশের মতো হবে। ছোটখাটো কিন্তু শক্তপোক্ত গড়নের লোক। মাথায় তেকোনা টুপি, কাঁধে ঝোলা, হাতে পিস্তল আর ঠোঁটে পাইপ।
পাইপটা সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলা এখানে আবশ্যক। ওটা বাহ্যিক একটা বস্তু থেকে বদলে মোকেটের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। পাইপহীন মোকেটের কথা কেউ স্মরণ করতে পারবে কি না সন্দেহ। কখনও যদি পাইপটা ঠোঁটে না থাকত, তাহলে নির্ঘাত সেটা ওর হাতে থাকবে।
এই সর্বদা পাইপ মুখে চলার ফলে একটা সমস্যা তৈরি হলো। মোকেটের মুখের বাদিকের শ্বদন্তগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গেল। তাছাড়া পাইপ মুখে আর পাইপ হাতে কথা বলার মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য টের পাওয়া যেত।
এই ছিল মোকেটের বাহ্যিক রূপ। সামনে মোকেটের বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানবিক গুণাবলীর কিছু নমুনা পাওয়া যাবে।
৪
একদিন ভোরবেলা। বাবা তখনও বিছানা ছাড়েননি। মোকেট ঘরে ঢুকে পায়ের কাছে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে গেল।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার মোকেট? এত সকাল সকাল?
জেনারেল, মোকেট গম্ভীর ভাবে বলল, আমি দুঃস্বপ্নিত হচ্ছি। মোকেটের ব্যাকরণজনিত বেশ কিছু ঝামেলা ছিল। ও নিজের অজান্তেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দুটো ক্রিয়াপদই একসাথে ব্যবহার করে ফেলে।
তুই দুঃস্বপ্নিত হচ্ছিস? আহারে বেচারা! মোকেটের অনুকরণে জবাব দিলেন বাবা, এ তো খুবই খারাপ কথা। তা কতদিন ধরে হচ্ছিস?
ঠিকই বলেছেন, বেচারাই বটে।
বলে মোকেট দুর্লভ একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে নিল সে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার ঘটলেই কেবল এই কাজটা করে ও।
বাবা সহানুভূতির সুরে জানতে চাইলেন, তা কতদিন ধরে হচ্ছিস?
পুরো এক সপ্তাহ ধরে।
তা কে দেখাচ্ছে দুঃস্বপ্ন?
কে দেখাচ্ছে সেটা খুব ভালমতোই জানি। পাইপটা তখনও ওর হাতে, আর হাতটা পেছনে। তাই যতটা সম্ভব চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মোকেট।
তার পরিচয়টা কি জানতে পারি?
আহামোর মাদার ডুরান্ড। নিশ্চয়ই চেনেন, সেই বুড়ি ডাইনিটা।
না রে, অমন কাউকে চিনি না আমি।
ওহ! আমি খুব ভালভাবে চিনি। ডাইনিদের উৎসবে ওকে ঝাড়ুতে করে উড়তে দেখেছি!
ঝাড়ুতে করে উড়তে দেখেছিস?
পরিষ্কার দেখেছি। তাছাড়া ওর বাড়িতে একটা কালো ছাগল আছে যেটাকে সে পূজা করে।
কিন্তু মহিলা কেন এসে তোকে দুঃস্বপ্ন দেখাবে?
প্রতিশোধ নিতে। একদিন মাঝরাতে ওকে শয়তানের চক্রের চারদিকে নাচতে দেখে ফেলেছিলাম।
খুবই গুরুতর অভিযোগ এনেছিস ওর বিরুদ্ধে। আমাকে যা বলেছিস, তা অন্য কাউকে বলার আগে তোর উচিত নিরেট প্রমাণ যোগাড় করা।
প্রমাণ? প্রমাণ কেন লাগবে? গ্রামের সবাই জানে যৌবনে সে নেকড়েদের নেতা থিবল্টের রক্ষিতা ছিল।
ব্যাপারটা আমাকে একটু তলিয়ে দেখতে হবে মোকেট।
আমার দেখা হয়ে গেছে। ওই বুড়ি ছুঁচোকে মাশুল দিতেই হবে!
ছুঁচো শব্দটা মালি পিয়েরের কাছ থেকে ধার করা। বাগানের সবচেয়ে বড় শত্রু ছুঁচো। তাই মালি যাকে বা যেটাকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে, সেটাকেই ছুঁচো বলে গাল দেয়।
বাবা এসব কু-সংস্কারে বিশ্বাস করেন না। এমনকি মোকেটের দুঃস্বরিত হওয়াকেও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তিনি জানতেন এসব গুজবের ফলে অনেক দুঃখজনক এবং নির্মম ঘটনা ঘটেছে। মাদার ডুরান্ডের কথা বলার সময় মোকেট যেভাবে পিস্তলটা চেপে ধরেছিল, তাতে বাবা ভবিষ্যৎ কোন বিপর্যয় এড়ানোর জন্যই তলিয়ে দেখার কথা বলেছেন। যাতে মোকেটের মনে হয়, তিনি কথাটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।
৫
যা-ই হোক, মোকেট। কাউকে দায়ী করার আগে দেখা দরকার, কেউ তোর দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারে কি না? প্রশ্রয় পেয়ে মোকেট কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে ভেবে বললেন বাবা।
কেউ পারবে না, জেনারেল, জোর গলায় ঘোষণা করল মোকেট।
কী বলিস! কেউই পারবে না?
কেউ না। অসম্ভব চেষ্টাও করেছি আমি।
কীভাবে করেছিস?
প্রথমে এক বালতি মদ খেয়ে বিছানায় গেলাম!
তা নিদানটা কে দিল? মঁসিয়ে লুকোস? মঁসিয়ে লুকোস গ্রামের নামকরা ডাক্তার।
মঁসিয়ে লুকোস? সে মন্ত্র-তন্ত্রের কী জানে? না না, সে না।
তাহলে?
লোপো-এর রাখাল।
তাই বলে এক বালতি মদ? তোর তো বেহেড মাতাল হয়ে থাকার কথা রে!
অর্ধেকটা রাখালই খেয়েছিল।
আচ্ছা। এখন বুঝতে পারছি, ব্যাটা কেন এই নিদান দিয়েছিল। তা এক বালতি মদে কাজ হলো?
নাহ্, কোন কাজ হয়নি। বরাবরের মতোই স্বপ্নে হানা দিয়ে গেছে হতভাগা বুড়িটা।
তারপর? এক বালতি মদেই তোর চেষ্টা নিশ্চয়ই শেষ হয়নি?
চোরা পশু ধরার সময় যা করি, তাই করলাম।
মোকেটের নিজস্ব কিছু শব্দের ব্যবহার আছে। ওকে দিয়ে কোনভাবেই বুনো পশু বলানো যায়নি। যখনই বাবা বুনো পশুর কথা বলত, ওর জবাব ছিল, জি, জেনারেল। চোরা পশু। বুঝতে পেরেছি।
বাবা একবার বলেই বসলেন, তুই তাহলে চোরা পশুই বলবি?
জি, জেনারেল। তবে একগুয়েমির কারণে নয়।
তাহলে কেন?
কারণ, জেনারেল, কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আপনি একটু ভুল করছেন।
ভুল? আমি? কীভাবে?
করেছো।
বুনো পশু নয়, আপনার বলা উচিত চোরা পশু।
তা চোরা পশুটা কী?
এসব পশু শুধু রাতে বেরোয়। বিড়ালের মতো কবুতর ধরে, শিয়ালের মতো মুরগী চুরি করে, নেকড়ের মতো ভেড়া মারে। মানে-এসব পশু খুব ধূর্ত, ধোকা দিতে ওস্তাদ। সোজা কথায় চোরা পশু।
এমন যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের পর অবশ্য আর কিছু বলার থাকে না। বাবাও তাই চুপ মেরে গেছিলেন। আর মোকেটও জিতে গেছে ভেবে চোরাতেই আটকে রইল, বুনোতে আর ফিরল না।
চোরা পশুর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বর্ণনার মাঝপথে বাধা দিতে হলো। বাবা ও মোকেটের অবশ্য এই ব্যাখ্যার দরকার ছিল না, তাই তাদের কথা চলছিল বিনা বাধায়।
৬
তা মোকেট, এই পশুগুলোকে ধরতে তুই কী করিস? বাবার জিজ্ঞাসা।
ফাঁত পাতি জেনারেল। ফাঁদকে সবসময়ই ফাঁত বলে মোকেট।
তুই কি বলতে চাইছিস মাদার ডুরান্ডের জন্যও তুই ফাঁদ পেতেছিস? বাবা ফাঁদই বলেছিলেন; কিন্তু কেউ ভিন্ন উচ্চারণ করলে মোকেটের সেটা পছন্দ হয় না।
মাদার ডুরান্ডের জন্য আমি আসলে ফাঁত পেতেছি।
তা ফাঁদটা কোথায় পেতেছিস? দরজার বাইরে? বোঝাই যাচ্ছে বাবা ছাড় দিতে রাজি আছেন।
আমার দরজার বাইরে? তাতে কী লাভ! প্রতিরাতে আমার ঘরে সে আসে জানি, কিন্তু কোন্ পথে আসে তা তো জানি না!
চিমনি দিয়ে?
আমার ঘরে কোন চিমনি নেই। তাছাড়া ওর উপস্থিতি টের পাওয়ার আগে ওকে দেখতে পাই না।
পরে কি দেখতে পাস?
হ্যাঁ। ঠিক যেমন এখন আপনাকে দেখছি।
কী করে সে?
বুঝতেই পারছেন, ভাল কিছু না। আমার বুকের উপর উঠে ধুপ ধাপ লাফায়!
তো তোর ফাঁদটা কোথায় পেতেছিলি?
ফাঁত, কেন, আমার পেটে!
তা কী ধরনের ফাঁত ব্যবহার করেছিস? বোধহয় বিরক্ত হয়েই ফাঁদ বলা বাদ দিলেন বাবা।
খুবই ভাল ফাঁত।
কী ছিল সেটা?
ধূসর নেকড়েটাকে ধরতে যে ফাঁতটা ব্যবহার করেছিলাম, মঁসিয়ে দিথু নেলের ভেড়াগুলোকে মারত যেটা।
ভাল হলো কোথায়? ধূসর নেকড়েটা তো তোর টোপকে খেয়ে ভেগেছিল।
জেনারেল, আপনি জানেন কেন ওটা ধরা পড়েনি।
না, জানি না।
কারণ ওটা আসলে ছিল স্যাবট কারিগর থিবস্টের কালো নেকড়ে।
ওটা থিবল্টের কালো নেকড়ে হতেই পারে না। তুই এই মাত্র নিজেই বললি মঁসিয়ে দিথু নেলের ভেড়া ধরে নিয়ে যেত একটা ধূসর নেকড়েটা!
এখন ধূসর; কিন্তু ত্রিশ বছর আগে থিবল্ট যখন বেঁচে ছিল, তখন ওটা কালোই ছিল। প্রমাণ দেখবেন? আমার চুলই দেখুন। ত্রিশ বছর আগে কালোই ছিল, কিন্তু এখন ডক্টরের মতো ধূসর হয়ে গেছে!
ডক্টর হচ্ছে একটা বিড়ালের নাম। কোটের মতো দেখতে লোমের কারণে এই নাম দেয়া হয়েছে।
থিবল্টকে নিয়ে তোর গল্পটা জানি। তোর দাবি অনুযায়ী, কালো নেকড়েটা যদি আসলেই শয়তান হয়ে থাকে, তাহলে তো রঙ পাল্টানোর কথা না।
অবশ্যই না, জেনারেল। সাদা হতে ওর একশো বছর সময় লাগে। তারপর এক মাঝরাতে ও আবার কয়লার মতো কালো হয়ে যায়!
আচ্ছা বাদ দে! একটা কথা বলি, পনেরো বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত তুই আমার ছেলেকে এই গল্প বলবি না।
কেন, জেনারেল?
নেকড়ে সাদা হোক, কী ধূসর বা কালো; যতদিন নেকড়ের গল্প শুনে হাসার মতো বড় না হচ্ছে, ততদিন এসব উদ্ভট কথা দিয়ে ওর মাথা ভারি করার কোন দরকার নেই।
আপনার আদেশ শিরোধার্য, জেনারেল। ওনাকে আমি এসব কিছুই বলব না।
তারপর বল।
কোথায় ছিলাম, জেনারেল?
ফাঁত পেতেছিলি তোর পেটের উপর। দাবি করছিলি খুবই ভাল ফাঁত।
আসলেই ভাল ফাঁত ছিল, জেনারেল, বিশ্বাস করুন। দশ পাউন্ড ওজন হবে। দশ পাউন্ড বলছি কেন, চেনসহ পনেরো পাউন্ড হবে। চেনটা আমার কব্জিতে জড়িয়ে রেখেছিলাম।
এরপর রাতে কী হলো?
রাতে? আরও খারাপ হলো। অন্যদিন চামড়ার জুতো পরে আসত, সেদিন। আসল কাঠের জুতো পরে।
এভাবে আসে…?
প্রতিটা রাত। দেখতেই পাচ্ছেন, জেনারেল, আমি শুকিয়ে যাচ্ছি। সেকারণেই, আজ সকালে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম।
কী সিদ্ধান্ত নিলি?
পিস্তল নিয়ে ওর মুখোমুখি হব!
সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। তা কখন ঘটনাটা ঘটবে?
আজ সন্ধ্যায়, না হলে কাল অবশ্যই, জেনারেল।
ঝামেলা হয়ে গেল! তোকে ভিলার-সেইলনে পাঠাব ভাবছিলাম।
সমস্যা নেই, জেনারেল। এখনই যেতে হবে?
হ্যাঁ, এখনই।
বেশ, ভিলার-সেইলনে যাব। খুব বেশি দূরের রাস্তা নয়। বনের মধ্যে দিয়ে গেলে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরতে পারব। যাওয়া আসা মিলে প্রায় চব্বিশ মাইল হবে। শিকারে গিয়ে এরচেয়ে বেশি রাস্তা আমরা পাড়ি দিয়েছি।
তাহলে ঠিক আছে। মঁসিয়ে কলার্ডকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে দিচ্ছি, তুই রওনা হয়ে যা।
একটুও দেরি করব না, জেনারেল।
বাবা উঠলেন। মঁসিয়ে কলার্ডকে চিঠিতে লিখলেন:
প্রিয় কলার্ড,
একটা গাধাকে পাঠালাম। তুমি ওকে চেনো। ওর মাথায় ঢুকেছে এক বুড়ি নাকি ওকে প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখায়। ওই ভ্যাম্পায়ারের হাত থেকে বাঁচতে বুড়িকে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বদহজম সারানোর এই তরিকাটা বিচারকরা ঠিক পছন্দ করবে না। তুমি ওকে দূরে কারও কাছে পাঠাও। সে যেন ওকে আরও দূরে কারও কাছে পাঠায়। এভাবে ওকে যতদূর পাঠাতে পারো। জাহান্নাম হলেও আমার আপত্তি নেই।
অন্তত দিন-পনেরো ও যেন দৌড়ের উপরে থাকে। ততদিনে আমরাও আঁটিলি চলে যাব। গাধাটাও আহামোর বাইরে চলে যাবে। আশা করা যায় এরমধ্যে দুঃস্বপ্নের ভূতও ওকে ছেড়ে যাবে। এদিকে মোকেট আশেপাশে না থাকায় মাদার ডুরান্ডও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে।
গতকালের শিকার করা একটা খরগোশ আর ছয়টা পাখি পাঠালাম।
হামাইনিকে শুভেচ্ছা আর ছোট্ট ক্যারোলিনকে আমার আদর দিও।
তোমার বন্ধু,
আলেক্স দ্যুমা
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মোকেট রওনা হয়ে গেল। এর তিন সপ্তাহ পর আঁটিলিতে চলে এল ও।
বাবা ওর চনমনে চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তো, মাদার ডুরান্ড আর কী করল?
হাসিমুখে মোকেট বলল, জেনারেল, বুড়ি ছুঁচোটার নিজের এলাকার বাইরে কোন ক্ষমতাই নেই!
৭
মোকেটের দুঃস্বপ্ন দেখার ওই ঘটনার পর বারো বছর পেরিয়ে গেছে। আমার বয়সও পনেরো ছাড়িয়েছে। বাবা মারা গেছেন দশ বছর হলো। আগের কাজের লোকদের কেউ আর নেই। বাড়িও পাল্টেছে। ভিলারস কটেরেটে থাকি এখন আমরা। ঝর্ণার উল্টোদিকের একটা ছোট্ট বাড়িতে।
খেলাধুলার প্রতি আমার খুব উৎসাহ ছিল। প্রিন্সেস বোর্গিসের মনোগ্রাম খোদাই করা একটা একনলা বন্দুক দিয়েছিলেন বাবা আমাকে। বাবার মৃত্যুর পর অনেককিছুই বিক্রি করে দেয়া হয়। কিন্তু আমার জোরাজুরিতে বন্দুকটা শেষ পর্যন্ত আর বিক্রি করা হয়নি।
শীতকাল ছিল আমার পছন্দের সময়। পাখিগুলো খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসত। বাবার কিছু বন্ধুর বিশাল বাগান ছিল। সেখানে গিয়ে ইচ্ছামতো পাখি শিকারের অনুমতি ছিল আমার। শীতকাল যদি দীর্ঘায়িত হত, তাহলে আরেকটা ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ত। যদি কোন নেকড়ের বাসা খুঁজে বের করা যেত, তবে সবাই মিলে নেকড়ে শিকারে বেরোত। মায়ের শত আপত্তি সত্ত্বেও আমি বন্দুক নিয়ে সামিল হতাম।
১৮১৭ আর ১৮১৮-এর শীত বেশ চরম আর লম্বা ছিল। একদিন বেলা চারটার দিকে মোকেট এসে হাজির। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। আমি ওর পিছু নিলাম।
কী হয়েছে, মোকেট?
বুঝতে পারছেন না?
নাহ।
তাহলে বুঝতে পারছেন না আহামো না গিয়ে আপনার মায়ের কাছ থেকে বারুদ কিনছি কেন? আচ্ছা, সংক্ষেপে বলি, পৌনে এক মাইলের বদলে তিন মাইল হেঁটে এসেছি, তারমানে নিশ্চয়ই কোন শিকারের প্রস্তাব আছে?
তাই নাকি মোকেট? কী শিকার? কোথায়?
নেকড়ে, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার।
সত্যি?
গতরাতে, মঁসিয়ে দিথু নেলের একটা ভেড়া ধরে নিয়ে গেছে। আমি বনের কাছে ওটার ছাপ খুঁজে পেয়েছি।
তারপর?
তারপর আর কী? আমি নিশ্চিত আজ রাতে ওটাকে আবার দেখা যাবে। তখন ওটার ডেরাও খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যস, কাল সকালে সব খতম।
দারুণ!
প্রথমে আমাদের অনুমতি নিতে হবে মাদামের কাছ থেকে।
চলো, এখনই যাই।
জানালা দিয়ে মা আমাদের লক্ষ করছিলেন। দেখেই বুঝেছেন কোন একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা ঢুকতেই তিনি বললেন, তোমাকে নিয়ে আর পারি না, মোকেট।
কেন, মাদাম?
আসতে না আসতে ওকে উসকে দিচ্ছ শিকারের জন্য।
না মাদাম, এটা ওনার রক্তেই আছে। ওনার বাবাও শিকারি ছিলেন, উনিও শিকারি; ওনার ছেলেও তা-ই হবে। আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে।
ওর যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায়?
জেনারেলের ছেলের কোন ক্ষতি হবে? মোকেট সাথে থাকতে? জীবন বাজি রাখতে রাজি। কখনও হবে না। কখনও না।
মা মাথা নাড়তে লাগলেন। আমি কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
লক্ষ্মী, মা। যাই? অনুরোধ করলাম।
মোকেট, তুমি ওর বন্দুকে গুলি ভরে দেবে।
চিন্তা করবেন না। ঠিক মতো গুলি ভরে দেব।
সবসময় ওর সাথে থাকবে।
থাকব, একেবারে ছায়ার মতো।
আমি ওকে শুধু তোমার দায়িত্বে ছাড়ছি, মোকেট।
এবং নিরাপদে আপনার কাছে ফিরিয়ে আনব। তো, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার, তৈরি হয়ে নিন। মায়ের অনুমতি পাওয়া গেছে।
আজ বিকেলে তো তুমি ওকে নিতে পারবে না, মোকেট।
সকালে অনেক দেরি হয়ে যাবে, মাদাম। ভোরেই নেকড়েটার পিছু নেব।
নেকড়ে। তুমি ওকে নেকড়ে শিকারে নিতে এসেছ?
আপনি কি ভয় পাচ্ছেন যে নেকড়েটা আপনার ছেলেকে খেয়ে ফেলবে?
মোকেট! মোকেট!
আমি তো আপনাকে কথা দিলাম যে আমি দায়িত্ব নিচ্ছি!
তা ও কোথায় ঘুমোবে?
অবশ্যই মোকেটের সাথে। তুষারের মতো সাদা ভাল চাদর বিছিয়ে দেব। দুটো গরম কাপড়ও থাকবে যাতে শীত না লাগে।
মা, কিছু চিন্তা কোরো না, আমি ঠিকই থাকব। মোকেট, আমি তৈরি।
যাবার সময় মা-কে একটা চুমুও খাবি না?
একটা কেন মা, অনেকগুলো খাব। বলেই মা-কে জড়িয়ে ধরলাম।
তোকে আবার কখন দেখতে পাব?
মোকেট বলল, সন্ধ্যা হবে ফিরতে ফিরতে।
সন্ধ্যায় তুমি তো মাত্রই বললে ভোরে বেরোবে!
যদি নেকড়েটাকে মারতে না পারি, তাহলে নদীর ধারে দুয়েকটা পাখি শিকার করতে নিয়ে যাব।
আচ্ছা! তুমি আমার ছেলেটাকে ডুবিয়ে মারার ধান্ধা করছ।
ঈশ্বর জানেন, আপনি যদি জেনারেলের বিধবা না হতেন, তাহলে বলতাম…
কী? কী বলতে?
বলতাম আপনি ছেলেটাকে এখনও কোল থেকে নামাচ্ছেন না। চিন্তা করুন একবার! আপনার মতো যদি জেনারেলের মা-ও ছেলেকে কোল-ছাড়া না করতেন, তাহলে কি জেনারেল সমুদ্র পেরিয়ে অভিযানে যেতে পারতেন?
ঠিকই বলেছ, মোকেট। আমি আসলেই একটা বোকা। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও ওকে।
মা ঘুরে চোখের জল মুছে নিলেন। মায়ের একেকটা অশ্রুবিন্দু, হৃদয়ের একেকটা হীরক খণ্ড, পৃথিবীর আর সব মণির চেয়ে দামী। ছুটে গিয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তুমি না চাইলে আমি যাব না, মা।
না, না মা। মোকেট ঠিকই বলেছে। আজ হোক কাল হোক, তোকে তো দায়িত্ব নেয়া শিখতে হবে।
মা-কে আরেকটা চুমু খেয়ে মোকেটের পিছু নিলাম।
কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। মা রাস্তার মাঝখান পর্যন্ত চলে এসেছেন। যতক্ষণ পারা যায় আমাকে দৃষ্টির সীমানায় রাখতে চাইছেন। এবার আমার চোখ আর্দ্র হয়ে এল।
কী ব্যাপার মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার? আপনিও কাঁদছেন!
কী যে বলো না! ঠাণ্ডায় চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে।
কিন্তু যে ঈশ্বর অশ্রু দিয়েছেন তিনি জানেন, আমার চোখের পানির কারণ ঠাণ্ডা নয়।
৮
মোকেটের বাড়ি পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। খরগোশের স্টু আর অমলেট দিয়ে রাতের খাবার সেরেছি। মা-কে দেয়া কথা রেখেছে মোকেট। ভাল চাদর আর গরম কাপড় দিয়ে আমার বিছানা করে দিয়েছে।
নিন, শুয়ে পড়ুন। কাল ভোর চারটার দিকে বেরোতে হবে।
যখন তুমি বলবে, তখনই রওনা দেব।
আমি জানি আপনার ঘুম খুব গাঢ়। সকালে হয়তো পানি ঢেলে আপনার ঘুম ভাঙাতে হতে পারে।
বারবার ডাকলেও যদি তাহলে তাই কোরো। দেখা যাক।
তোমার কি ঘুমোবার তাড়া আছে?
কেন? এতরাতে আমাকে দিয়ে কী করাতে চাইছেন?
ভাবছিলাম, ছোটবেলার মতো করে যদি আমাকে গল্প শোনাতে…
আমি যদি মাঝরাত পর্যন্ত আপনাকে গল্প শোনাই, তাহলে রাত দুটোয় আমাকে কে ডেকে দেবে? আমাদের পুরুতমশাই?
তা ঠিক।
যাক, বুঝতে পেরেছেন। বিছানায় যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় মোকেট নাক ডাকা শুরু করল। এপাশ-ওপাশ করে আমার ঘুম আসতে আসতে দুই ঘণ্টা। শিকারের আগে নিঘুম রাত তো কম যায়নি। শেষপর্যন্ত ক্লান্তির কাছে হার মানতে হলো। চারটার দিকে হঠাৎ ঠাণ্ডায় ভেঙে গেল ঘুম। মুখে হাসি নিয়ে মোকেট আমার গায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়েছে।
কী করছিলে মোকেট?
ডেরাটা খুঁজে পাওয়া গেছে।
নেকড়েটার? কে খুঁজে বের করল?
এই বুড়ো মোকেট!
চমৎকার!
কোথায় লুকিয়েছিল কল্পনাও করতে পারবেন না। তিন ওকের অঞ্চলে।
তাহলে তো আমরা ওকে বাগে পেয়ে গেছি।
আশা করি।
তিন ওকের অঞ্চল জায়গাটা জঙ্গল থেকে শ পাঁচেক পা দূরে একটা সমতল এলাকার মাঝে অবস্থিত। সেখানে অনেক গাছ আর বুনো ঝোঁপ আছে।
বনরক্ষকেরা যাবে?
মএনা, মিদে, ভেটা, লাফুইলে, সেরা সব বন্দুকবাজদের খবর দেয়া হয়েছে। মঁসিয়ে শাপোতি, আপনি আর আমি ভ্যালু থেকে, লানি থেকে মঁসিয়ে হোশদি, লে ফস থেকে মঁসিয়ে দিথু নেল, আর মাঠ রক্ষীরা কুকুরদের সামলাবে। ধরা ওকে পড়তেই হবে, এতে কোন ভুল নেই।
আমাকে ভাল একটা জায়গা বেছে দেবে, মোকেট?
আপনাকে তো বলেইছি আপনি আমার সাথে থাকবেন। তবে সব কিছুর আগে বিছানা ছাড়তে হবে।
একদম ঠিক।
আপনার অল্প বয়স বিবেচনা করে আগুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছি।
তোমার অশেষ দয়া। কথাটা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।
মোকেট কাঠ এনে আগুনে ফেলল। আমি দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। আমাকে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হতে দেখে মোকেটও অবাক হয়ে গেল।
এটা গলায় ঢেলেই রওনা হয়ে যাব আমরা, দুটো গ্লাসে হলুদ রঙের তরল ঢালল। দেখেই বুঝতে পারলাম ওটা কী।
মোকেট, তুমি তো জানো আমি ব্র্যান্ডি খাই না।
আহ, একদম বাবার মতন। তাহলে কী নেবেন?
কিছুই না।
একটা কথা আছে, খালি বাড়িতে শয়তান বাসা বাঁধে। মাদামের আদেশ অনুযায়ী আপনার বন্দুকে গুলি ভরে দিচ্ছি, ততক্ষণে পেটে কিছু দিয়ে নিন।
তাহলে এক টুকরো রুটি আর এক গ্লাস পিনিউলে নেব। পিনিউলে হচ্ছে এক প্রকারের ওয়াইন। জিনিসটা এমন জায়গায় বানানো হয়, যেখানে ওয়াইন তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যায় না। খেতে তিনজন লোক লাগে। একজন খায় আর দুজন তাকে ধরে রাখে। আমার অবশ্য কোন অসুবিধা হয় না। খাওয়া শেষ হতে হতে দেখি মোকেটের কাজও শেষ।
কী করছ, মোকেট?
আপনার গুলিতে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে রাখছি। আপনি তো আমার পাশেই থাকবেন। একসাথেই গুলি ছুঁড়ব। চিহ্ন থাকলে কার গুলিতে নেকড়েটা মরল বোঝা যাবে। নিশানা সোজা রাখবেন?
আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
এই যে আপনার বন্দুক, শিকারের জন্য তৈরি। কাঁধে নিন, চলুন বেরিয়ে পড়ি।
৯
পাঁচটার মধ্যেই শভিনি যাওয়ার রাস্তায় সবাই মিলিত হলো। ঠিক হলো-দূরত্ব বজায় রেখে তিন ওকের অঞ্চল নিঃশব্দে ঘিরে ফেলব আমরা। সবাইকে খেয়াল রাখতে বলা হলো যাতে নেকড়েটা পালিয়ে না যায়। এরমধ্যে মোকেটের হাউন্ডগুলোকে সামলে রাখা হবে।
সবাই যার যার অবস্থান নিয়ে নিল। আমার আর মোকেটের জায়গা পড়ল উত্তরের বনের দিকে।
এলাকাটা ঘিরে ফেলার পর কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। বার দুয়েক ডেকে কুকুরগুলোও ঠাণ্ডা হয়ে গেল, এক পা-ও আর এগোয় না।
কিপার বলল, মোকেট, তোমার এই নেকড়েটা মনে হচ্ছে বিশেষ ধরনের। হোকাড়ু ও টুষে তো নড়তেই চাইছে না।
মোকেট জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। চায় না নেকড়েটার কাছে ওর অবস্থান ফাঁস হয়ে যাক।
কিপার গাছে বাড়ি দিতে দিতে এগোল। কুকুরগুলোও সাবধানে পেছন পেছন একপা একপা করে এগোতে লাগল। ঘেউ ঘেউ না করলেও মাঝে মাঝে মৃদু গরগর করছে।
হঠাৎ কিপারের চিৎকার শোনা গেল। আরেকটু হলেই নেকড়েটার লেজ মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। মোকেট। খেয়াল রেখো!
তখনই নেকড়েটা লাফ দিয়ে আমাদের মাঝ দিয়ে বিদ্যুতের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। বিশাল আকার ওটার, বয়সের কারণে সাদা হয়ে গেছে গায়ের রঙ। ঘুরেই ওটাকে লক্ষ্য করে দুটো গুলি ছুঁড়ল মোকেট। আমি দেখলাম লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি দুটো বরফে নাক গুঁজেছে।
গুলি করো! গুলি করো! আমাকে তাগিদ দিল মোকেট।
তাক করে গুলি ছুঁড়লাম। নেকড়েটাকে দেখে মনে হলো কাঁধ কামড়ে ধরতে চাইছে।
লেগেছে! ছেলেটা গুলি লাগিয়েছে।
কিন্তু নেকড়েটা না থেমে মনা আর মিদে যেদিকে আছে সেদিকে ছুটে গেল।
নেকড়েটা খোলা প্রান্তরে থাকতেই ওরা প্রথম দফা গুলি ছুঁড়ল। ওটা জঙ্গলে ঢুকতে দ্বিতীয় দফা। কল্পনা করা কঠিন যে ওদের গুলি ফসকে গেছে। একটাও গুলি মিস না করে, মনাকে সতেরোটা পাখি পর পর শিকার করতে দেখেছি আমি নিজে। আর মিদেকে দেখেছি এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিয়ে যেতে থাকা কাঠবিড়ালি পেরে ফেলতে।
জঙ্গলে নেকড়েটাকে খুঁজতে গেল কিপাররা। একটু পর ব্যর্থ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে এল।
এতক্ষণে বহুদূর চলে গেছে ওটা।
পালিয়ে গেছে। তারমানে ওদিককার গাধাগুলোও মিস করেছে।
বলে কী লাভ? তুমি নিজেও তো মিস করেছ।
কোন একটা অশুভ ব্যাপার আছে এরমধ্যে। আমার মিস না হয় হলো, তাই বলে মনাও দুবার মিস করবে, এটা তো সম্ভব না।
কিন্তু তাই ঘটেছে।
মোকেট আমাকে বলল, সে যাই হোক, আপনি কিন্তু লাগিয়েছেন।
১০
তুমি… তুমি নিশ্চিত?
আমাদের জন্য ব্যাপারটা লজ্জাজনক। তবে আমার নাম মোকেট, এটা যেমন সত্যি; আপনি গুলি লাগিয়েছেন-সেটাও তেমন সত্যি।
আমার গুলি যদি লেগে থাকে, তাহলে বরফে রক্ত থাকবে। এসো মোকেট, দেখে আসি। বলেই ছুট লাগালাম।
দাঁত কিড়মিড় করে পা দাপিয়ে মোকেট বলল, আর যা-ই করুন, দয়া করে ছুটবেন না। যতক্ষণ না পুরো ঘটনাটা পরিষ্কার হচ্ছে, আমাদের সাবধানে। চলাফেরা করা উচিত।
ঠিক আছে, চুপিচুপিই সই, তবু চলো।
মোকেট নেকড়েটার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে শুরু করল।
ছাপ হারানোর ভয় নেই।
সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
হুম। কিন্তু আমি অন্য জিনিস খুঁজছি।
কী?
দুই-এক মিনিটের মধ্যেই জানতে পারবে।
অন্য শিকারিরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিল। কিপার পরিস্থিতিটা তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাল। এদিকে আমি আর মোকেট পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করছি। বরফে গম্ভীর হয়ে বসে গেছে ছাপগুলো। অবশেষে আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছলাম।
দেখেছ মোকেট, আমার গুলিটাও লাগেনি।
কীভাবে বুঝলেন?
বরফে কোন রক্তের দাগ নেই।
তাহলে বরফে আপনার গুলির চিহ্নটা খুঁজে বের করুন।
যেদিকে গুলিটা যেতে পারে সেদিকে এগোলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে ব্যর্থ অনুসন্ধান চালিয়ে মোকেটের কাছে ফিরে এলাম। কিপারদের এগোবার ইঙ্গিত করে ঘুরে আমাকে বলল, বুলেট?
খুঁজে পাইনি।
আমি তো তাহলে আপনার চেয়ে ভাগ্যবান। আমি খুঁজে পেয়েছি।
তুমি পেয়েছ?
আসুন আমার সাথে।
বাকি শিকারিদের সাথে আমিও মোকেটের কাছে গেলাম। মিদে আর মএনাও যোগ দিল। মোকেট ওদের দিকে তাকাল, কী খবর?
দুজনেই বলল, গুলি মিস করেছে।
প্রান্তরের গুলি মিস করতে দেখেছি। কিন্তু জঙ্গলের গুলি?
ওগুলোও লাগাতে পারেনি।
তোমরা নিশ্চিত?
দুটো গুলিই গাছের গুঁড়িতে পাওয়া গেছে।
ভেটা বলল, বিশ্বাস হতে চাইছে না।
হুম, কিন্তু একটা জিনিস দেখানোর আছে যেটা বিশ্বাস করা আরও কঠিন হবে।
দেখাও তাহলে।
ওদিকে বরফের ওপর তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ?
নেকড়ের পায়ের ছাপ, তো?
ডান পায়ের ছাপের দিকে খেয়াল করো, দেখতে পাচ্ছ?
একটা ছোট্ট ফুটো।
কী বুঝলে? বিস্ময়ে শিকারিরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল।
কী বুঝলে? আবার জিজ্ঞেস করল মোকেট।
অসম্ভব!
অসম্ভব হলেও সত্যি। আমি প্রমাণ করে দেব। বলে বরফে হাত ঢুকিয়ে দিল। একটুক্ষণ হাতড়ে একটা চ্যাপ্টা বুলেট বের করে নিয়ে এল।
এটা তো আমার গুলিটা। বললাম আমি।
চিনতে পারছেন তাহলে?
অবশ্যই, তুমিই তো চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলে।
কী চিহ্ন দিয়েছিলাম?
ক্রুশ চিহ্ন।
সবাই দেখেছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু এর ব্যাখ্যা কী?
আর দশটা সাধারণ গুলি ফিরিয়ে দিতে নেকড়েটার কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ক্রুশ চিহ্ন আঁকা গুলি সে ফেরাতে পারেনি। আমি ওটাকে দেখেছি কাঁধ কামড়ে ধরার চেষ্টা করতে।
শিকারিদের মাঝে নীরবতা নেমে এল। আমি প্রশ্ন করলাম, কিন্তু গুলিটা যদি লেগেই থাকবে, তাহলে মরল না কেন নেকড়েটা?
কারণ গুলিটা সোনা বা রূপো দিয়ে তৈরি নয়; আর ওই দুই ধাতুর তৈরি নাহলে কোন গুলির ক্ষমতা নেই শয়তানকে বা তার অনুসারীদের মারার বা তাদের চামড়া ভেদ করার।
কেঁপে উঠে একজন কিপার বলল, মোকেট, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না…
অবশ্যই তা ভাবছি। আজ আমরা স্যাবট-কারিগর, থিবল্টের নেকড়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম।
সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। দু-তিন জন বুকে ক্রুশ আঁকল। বোঝা যাচ্ছে, সবাই থিবল্টের নেকড়ের গল্পটা জানে এবং মোকেটের সঙ্গে একমত। একা আমিই কিছু জানি না। অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, এই স্যাবট-কারিগর থিবল্টের নেকড়ের ঘটনাটা কী?
মোকেট একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, জেনারেল বলেছিলেন আপনার বয়স পনেরো হওয়ার আগে যেন এই গল্পটা না বলি। আপনার বয়স তো পনেরো হয়েছে, তাই না?
আমি কিছুটা গর্বের সুরেই বললাম, আমার মোলো চলছে।
তাহলে তো হয়েই গেল, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার। স্যাবট-কারিগর থিবল্টের নেকড়ে হচ্ছে স্বয়ং শয়তান। কাল রাতে আপনি গল্প শুনতে চেয়েছিলেন না?
হ্যাঁ।
আমার সাথে বাড়ি চলুন। আজ আপনাকে একটা গল্পের মতো গল্প বলব।
শিকারি এবং কিপারেরা মাথা নেড়ে যে যার পথ ধরল। আমিও মোকেটের সাথে ফিরে এলাম। তারপর মোকেট আমাকে যে গল্পটা বলল, সেটাই আমি এখন আপনাদের বলব। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন আজ এত বছর পর গল্পটা আমি বলছি। আসলে এই গল্পটা আমার স্মৃতির এক মণিকোঠায় লুকিয়ে ছিল। দিন তিনেক আগে আবার খুঁজে পেয়েছি। কী আমাকে গল্পটা বলতে উৎসাহিত করল তা আমি বলতে পারি, কিন্তু ভয় হচ্ছে তা আপনাদের ভাল না-ও লাগতে পারে। আর তাছাড়া বলতে সময় লাগবে। তাই অহেতুক দেরি না করে গল্পটা শুরু করছি।
আমার গল্প শুরু করি। বলা ভাল মোকেটের গল্প, আমার ভাষায়। আটত্রিশ বছর যদি একটা ডিমের ওপর বসে থাকেন, সে-ই ডিমটা আপনি পেড়েছেন না অন্য কেউ, তাতে বোধহয় খুব বেশি কিছু যায় আসে না!
০১. নেকড়েদের গ্র্যান্ড মাস্টার
প্রথম অধ্যায় – নেকড়েদের গ্র্যান্ড মাস্টার
ভেযের ব্যারন সিনর জাঁ, শিকারে অত্যুৎসাহী একজন মানুষ।
বেভাল আর লোগোর মাঝে একটা উপত্যকার অবস্থান। সেখানে একটা উঁচু টাওয়ার আছে। এককালে এটা ভেযের প্রাসাদোপম বাসস্থানের অংশ ছিল। এখন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও, যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ ১৭৮০ সালের দিকে তা ছিল না। দুৰ্গটা নির্মিত হয়েছিল বারো কি তেরো শতকের দিকে।
এখন পথচারীরা বা পশুপাখি ঝড় বৃষ্টির সময় অনায়াসে এখানে আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু তখন সাধারণ মানুষ এটাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখতে পারত না। অতীতের সেই জাকজমক, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত আর নেই। নেই বিপদের ছায়া দেখলেই ঝুল সেতু উঠিয়ে নেয়া বা পোর্টকুলিস নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু এখনও এর বিশালতা মানুষকে বিস্মিত করে।
এই দুর্গের লর্ডকে বাইরে থেকে খুব জাদরেল মনে হত। কিন্তু যারা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনত তারা জানত-সে যত গর্জে তত বর্ষে না। তবে বনের পশুপাখির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ছিল ওদের আজন্ম শত্রু।
ভেযের লর্ড ছিল নেকড়ে শিকারিদের নেতা। এই পদমর্যাদার কারণে নেকড়ে শিকারের ভূত মাথায় চাপলে তাকে থামানো যেত না।
উপরন্তু তার স্ত্রীর ব্যাপারে রটনা ছিল যে সে নাকি প্রিন্সের মেয়ে-যদিও অবৈধ! নিজের পদমর্যাদার এবং ক্ষমতাবান শ্বশুরের বদৌলতে, কেউ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহসও পেত না।
লর্ড প্রায় প্রতিদিনই শিকারে বেরোত লোকলস্কর নিয়ে। শিকারের সময় তার সাথে থাকত গোটা বারো ঘোড়া আর চল্লিশটা কুকুর। শিকার হিসাবে লোকটার প্রথম পছন্দ ছিল নেকড়ে, তারপর বুনো শুয়োর এবং সবশেষে হরিণ।
তবে যত ঘোড়া আর কুকুরই থাকুক না কেন, প্রতিবারই তো আর ভাল শিকার জোটে না।
এমনই একদিন, শিকারি কুকুরগুলোর প্রধান রক্ষণাবেক্ষণকারী ম্যাকোট, গম্ভীর মুখে অপেক্ষারত ব্যারনের সাথে দেখা করতে এল।
ভুরু কুঁচকে গেল ব্যারনের, কী ব্যাপার ম্যাকোট, তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে শিকারের জন্য আজকের দিনটা ঠিক সুবিধার হবে না।
মাথা নাড়ল ম্যাকোট।
খুলে বলল।
কালো নেকড়েটাকে দেখা গেছে, মাই লর্ড।
ওহ! তাই নাকি? বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যারন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও এই পশুটার নাগাল পায়নি।
জি, ম্যাকোট বলতে লাগল। জানোয়ারটা ভীষণ চালাক, এমনভাবে দৌড়াদৌড়ি করে পায়ের ছাপ ফেলেছে, যে আমি অনুসরণ করতে করতে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আবার সেখানেই ফিরে এসেছি।
তাহলে তুমি বলতে চাইছ, ওটাকে বাগে পাবার সম্ভাবনা নেই।
মনে হচ্ছে না।
খিস্তি করে উঠল লর্ড। মহান নমরুদের পর খিস্তি ঝাড়ায় তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। আমার শরীরটাও বেশি ভাল লাগছে না। ওই কালো নেকড়েটার বদলে আর কী শিকার করা যেতে পারে?
নেকড়েটার পিছু নেয়ায় আর কোন পশুকে খেয়াল করতে পারিনি। লর্ড কি বেরিয়ে পড়বেন? সামনে প্রথম যেটা পাবেন, ওটাই শিকার করে নেবেন?
সম্মতি দেয়ার আগেই এনগুভাকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল।
ওই যে এনগুভা আসছে। দেখা যাক, ও কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারে কি না।
বিনয়ের পরাকাষ্ঠা সাজল এনগুভা। আপনার মতো মহান লর্ডকে দেয়ার মতো কোন পরামর্শ আমার ঝুলিতে নেই। তবে এটা জানানো আমার দায়িত্ব যে, কাছেই একটা চমৎকার হরিণ দেখে এলাম।
চলো তোমার হরিণ দেখে আসি। ভুল খবর না হলে পুরস্কার পাবে।
তা কোথায় তোমার এই হরিণ? জিজ্ঞেস করল ম্যাকোট। সাবধান, অহেতুক আমাদের দৌড় করিও না।
ম্যাটাডো আর জুপিটাকে আমার সাথে দিন, তারপর দেখুন। ম্যাটাডো আর জুপিটা লর্ডের সেরা দুই শিকারি কুকুর। সত্যি সত্যিই এনগুভা ওদের নিয়ে শ খানেক গজ এগোতে না এগোতেই বিশাল একটা পুরুষ হরিণ চোখে পড়ল। ম্যাকোট শিঙায় ফুঁ দিল। যদিও কালো নেকড়েটা পেলে ভাল হত, তারপরও যা পাওয়া গেছে তাতেই সম্ভষ্ট লর্ড ভেয। শুরু হলো ধাওয়া-দুঘণ্টা ধরে অক্লান্ত ভাবে ছুটল হরিণটা।
নিচু জমিতে ছোট নদীর কাছে পৌঁছে গতি একটু কমলো ওটার। কিন্তু পানি পেরিয়ে তীরে উঠেই আবার ছুটতে লাগল। শিকারি কুকুরগুলোও নাছোড়বান্দা। ছড়িয়ে পড়ে হরিণটার গন্ধ খুঁজে বের করল ওগুলো। ব্যারন আর তার শিকারিরা সেইন্ট আঁতোয়ার পুকুরে পৌঁছল। এদিকেই বাস করে স্যাবট-কারিগর, থিবল্ট।
বয়স পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে ওর, লম্বা, সুঠামদেহী। বিষণ্ণতায় ভোগে থিবল্ট। প্রতিবেশী যারাই ওর চেয়ে ভাল আছে, তাদের প্রতি এক ধরনের ঈর্ষা নিয়ে বেঁচে আছে ও। ওই সময়ে, এখনকার মতো নিজের জন্মগত সামাজিক অবস্থান থেকে উত্তরণের উপায় ছিল না। অক্ষরজ্ঞান ছিল থিবল্টের। কিছুটা ল্যাটিন ভাষাও জানত। প্রচুর বই পড়ত ও। তবে এত পড়াশোনার পরও, ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ওর দুর্বলতা ছিল।
বিশ বছর বয়সে জুতো-প্রস্তুতকারীর পেশা বাদ দিয়ে, অন্যকিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখত থিবল্ট। সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওর। কিন্তু পরিচিতরা সবাই পাঁচ-ছয় বছর গাধার খাটুনি খেটেও কোন পদোন্নতি পায়নি-কেউ এমনকি সামান্য কর্পোরালও হতে পারেনি।
নৌ-বাহিনীতেও একই অবস্থা। কোন জুতো-প্রস্তুতকারীর ছেলে পদোন্নতি পেয়েছে এমনটা কখনও শোনেনি ও।
নোটারি হিসেবে কলম পিষে বড় হওয়ার স্বপ্নও দেখেছিল। কিন্তু শুরু করতে যে ত্রিশ হাজার ফ্লা দরকার, সেটা আর যোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
এর মাঝে থিবল্টের বাবা মারা গেল। তাকে কবর দেয়ার পর ওর হাতে তেমন কোন টাকা পয়সা ছিল না। বছর তিনেক ফ্রান্সের নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়াল ও। তখন অনেক কিছুই শিখেছে। ভালো নাচতে শিখেছে, চমঙ্কার লাঠি খেলতে শিখেছে, শিখেছে বর্শা দিয়ে শিকার করতে। আর একটা জিনিস শিখেছে-একজন ব্যবসায়ীর কথার যে দাম আছে, প্রেমাস্পদের কথার সে দাম নেই। অনেক অভিজাতের চেয়েই থিবল্ট সুদর্শন, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান। কিন্তু তারপরও ওর সামাজিক অবস্থানের কোন উন্নতি হলো না। কেন ও গরীব ঘরে জন্মেছে, কোন অভিজাত ঘরে নয়, সে-ই আফসোস ওকে কুরে কুরে খায়।
থিবল্ট আবিষ্কার করল, এইসব নাচ, খেলাধুলায় অহেতুক পরিশ্রম ছাড়া কিছু হয় না। ওর বাবা যদি জুতো তৈরি করে জীবন ধারণ করতে পেরে থাকে, সে-ও পারবে। আর তাই অরলিয়ন্সের রাজকীয় পদমর্যাদাধারী লুই ফিলিপের স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বনে একটা কুঁড়েঘর তৈরি করে জুতো তৈরির ব্যবসা শুরু করল।
নিজের হাতেই ঘর আর আসবাবপত্র তৈরি করল থিবল্ট।
তিন বছর হয়ে গেল ও ফিরে এসে সব গুছিয়ে বসেছে। ওর ত্রুটি বলতে অন্যের প্রতি ঈর্ষাবোধটাই যা। কিন্তু তাতে করে কারো কোন ক্ষতি অন্তত হচ্ছিল না।
দ্বিতীয় অধ্যায় – সিনর জাঁ এবং স্যাবট-কারিগর
শরতের মাঝামাঝি। থিবল্ট খোলা জায়গায় কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ মুখ তুলে কয়েক পা দূরে কম্পমান পশুটাকে দেখতে পেল ও। হরিণটার ভীত চাহনির আড়ালে বুদ্ধির ছটা লক্ষ করা যায়। থিবল্ট অনেকক্ষণ ধরেই টের পাচ্ছিল যে ওটা ওর কুঁড়ের পাশ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। শিকারিদের এড়ানোর চেষ্টায় কখনও গ্রামের দিকে যাচ্ছে আবার ফিরেও আসছে।
থিবল্টের জন্য এতে বিস্ময়ের কিছু না থাকলেও ও হাতের কাজ থামিয়ে দিল।
বাহ্! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল ও, কী চমৎকার প্রাণীটা। মাংসের স্বাদও খুব ভাল হবে। বছর চারেক আগে ভোফিনে জুতো কারিগরদের একটা ভোজ হয়েছিল। সেখানে খেয়েছিলাম এমন হরিণের মাংস। ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে। যারা রোজ এমন মাংস খেতে পায় তারা আসলেই ভাগ্যবান। এই লর্ডেরা প্রতি বেলায় মাংস আর ওয়াইন দিয়ে খুঁড়িভোজ করে। আর এদিকে আমি হতভাগা শুধু আলু আর পানি খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। এমনকি রবিবারেও সবসময় ভাল এক টুকরো বেকন আর সজী জোটে না।
থিবল্ট নিজের সাথে কথা শুরু করতেই হরিণটা হাপিশ! হাতের কাজটা গুছিয়ে উঠতেই কর্কশ একটা কণ্ঠ ওকে উদ্দেশ করে হেঁকে উঠল, এই যে বেওকুফ! শোন এদিকে।
কুকুরগুলোকে অস্থির দেখে ব্যারন নিশ্চিত হতে চাইছিল ভুল দিকে যাচ্ছে না তারা।
এই গাধা! জানোয়ারটাকে দেখেছিস?
ব্যারনের কথার ধরণ আমাদের দার্শনিক জুতোর কারিগরের ঠিক পছন্দ হলো না। তাই জেনেও না জানার ভান করল ও, কোন্ জানোয়ার?
আরে মুখপোড়া! যে হরিণটা আমরা তাড়া করছি। এদিক দিয়েই তো যাওয়ার কথা ওটার। এত সুন্দর একটা হরিণ দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ নেই। জলদি বল্ কোনদিকে গেছে, নয়তো মার খাবি।
বিড়বিড় করে থিবল্ট নিজেকে বলল, প্লেগ হোক তোর নেকড়ের বাচ্চা। তারপর মুখে গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে জোরে বলল, ও হরিণ! হ্যাঁ দেখেছি তো।
বিশাল শিংওয়ালা একটা সুন্দর হরিণ, তাই না?
হ্যাঁ, হরিণই বটে। বড় শিং-নাকি বড় খুর ছিল? আপনাকে এখন যেমন পরিষ্কার দেখছি, তেমনি পরিষ্কার দেখেছি। তবে পায়ের দিকে খেয়াল করিনি, তাই খুরগুলো বড় ছিল কি না বলতে পারছি না। তবে ওটার দৌড়তে যে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না এটুকু বলতে পারি।
অন্য সময় হলে বোকার মতো কথা শুনে হয়তো হেসে ফেলত ব্যারন। কিন্তু এতক্ষণে হরিণটার কাছে বার বার নাকানি-চুবানি খেয়ে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে।
যথেষ্ট হয়েছে। আমি মজা করার মানসিকতায় নেই।
মাই লর্ড আমাকে যে মানসিকতায় চাইবেন, আমি তাতেই থাকব।
তাহলে প্রশ্নের জবাব দে।
কিছু তো জিজ্ঞেসই করেননি।
হরিণটাকে কি ক্লান্ত মনে হয়েছে?
খুব একটা না।
কোন্ পথে এসেছিল?
আসেনি তো, দাঁড়িয়ে ছিল।
কোন না কোন পথে তো নিশ্চয়ই এসেছিল।
তা তো বটেই, তবে আমি দেখিনি।
কোন্ পথে গেছে?
মাই লর্ড, আপনাকে অবশ্যই বলতাম, কিন্তু ওকে যেতেও দেখিনি।
লর্ড ভে থিবল্টের দিকে রাগী চোখে তাকালেন।
তো জনাব গোবেচারা, হরিণটা কি অনেকক্ষণ হলো এদিক দিয়ে গেছে?
খুব বেশিক্ষণ নয়।
কতক্ষণ?
থিবল্ট মনে করার ভান করল, বোধহয় পরশুদিন, বলার সময় মুখের হাসিটা লুকাতে পারল না ও। ব্যারনও হাসিটা দেখে চাবুক উঁচিয়ে থিবল্টের দিকে এগিয়ে গেল।
একছুটে গিয়ে ঘরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট।
তুই প্রলাপ বকছিস মিথ্যেবাদী! বিশ গজও হবে না, মাক্যাসিনো, মানে আমার সেরা হাউন্ডটা ডাকাডাকি করছে। ওদিকে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে হরিণটা এদিক দিয়েই গেছে। আর এদিক দিয়ে গেলে তুই দেখিসনি এটা হতেই পারে না।
ক্ষমা করবেন মাই লর্ড। আমাদের ভালমানুষ পাদ্রীর কথা অনুযায়ী পোপ ছাড়া আর সবারই ভুল হতে পারে। মঁসিয়ে মাক্যাসিনোও সম্ভবত ভুল করেছেন।
কান খুলে শুনে রাখ বদমাশ, মাক্যাসিনো কখনও ভুল করে না। আর প্রমাণ হিসেবে মাটির ওপর আমি হরিণটার পায়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।
ব্যারনকে ভুরু কোঁচকাতে দেখে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল থিবল্ট, যা-ই হোক, মাই লর্ড আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলছি…
চুপ, এদিকে আয় বদমাশ।
ব্যারনকে আর রাগানোটা ঠিক হবে না, হয়তো আবার কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবে একটু ইতস্তত করে হলেও বেরিয়ে এল বিবল্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্য থিবল্টের, যতটুকু রাগার এরইমধ্যে রেগে গেছে লর্ড ভেয। আড়াল ছেড়ে বেরোনো মাত্র
ওর দিকে তেড়ে গেল সে। চাবুকের বাট দিয়ে বাড়ি মারল ওর মাথায়!
আঘাতের আকস্মিকতায় সামনের দিকে ঝুঁকে গেল থিবল্ট। ঠিক তখনই ব্যারন ওর বুকে গায়ের জোরে একটা লাথি কষাল। লাথির ধাক্কায় থিবল্ট পেছন দিকে উড়ে গিয়ে কুঁড়ের দরজার উপর আছড়ে পড়ল।
চাবুক চালিয়ে ব্যারন বলল, নে, এটা মিথ্যে বলার জন্য! আর পা চালানোর পর বলল, আর এটা অনর্থক বাজে বকার জন্য!
পড়ে থাকা মানুষটার দিকে ফিরেও তাকাল না সে। এদিকে মাক্যাসিনোর ডাক শুনে বাকি হাউডগুলোও এসে হাজির হয়েছে। শিঙা ফুঁকে ওদের উৎসাহ দিতে দিতে ছুটে চলে গেল ব্যারন।
উঠে দাঁড়াল থিবল্ট। ভাল করে দেখে নিল কোন হাড় ভেঙেছে কি না।
নাহ, হাড়গোড় কোনটা ভাঙেনি, সব ঠিকই আছে। তো ব্যারন সাহেব, প্রিন্সের বেজন্মা মেয়েকে বিয়ে করেছ বলে মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করছ। একটা কথা বলে রাখি, ওই হরিণ আর তোমার কপালে নেই! এই গোবেচারা, বেওকুফ, বদমাশের ভাগ্যেই হরিণটা জুটবে। এটা আমার প্রতিজ্ঞা! চিৎকার করে বলল থিবল্ট। আর প্রতিজ্ঞা করে যে রাখতে পারে না, সে তো পুরুষই নয়!
তাড়াতাড়ি শিকারের অস্ত্র নিয়ে তৈরি হলো থিবল্ট। যেদিক থেকে হাউন্ডগুলোর চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, সেদিকেই ছুটল ও। একজন মানুষের পক্ষে যত জোরে ছোটা সম্ভব। হরিণ আর তার পিছু ধাওয়াকারীদের বাঁকানো পথের দিক আন্দাজ করে নিল। তারপর কোনাকুনি সেদিকে ছুটল, যাতে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে পারে।
দৌড়াতে দৌড়াতেই হরিণটাকে কীভাবে শিকার করবে, একমাস ধরে কীভাবে খাবে সেই পরিকল্পনা করতে লাগল থিবল্ট। ফলশ্রুতিতে ব্যারন আর তার লোকদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হবে। এটাই হবে লোকটার অহেতুক নিষ্ঠুরতার জবাব। ভাবতে ভাবতে আপনমনেই হেসে উঠল ও।
থিবল্টের হিসাব অনুযায়ী হরিণটা নিকটবর্তী একটা কাঠের সেতুর দিকে যাবে। তাই সেতুটার কাছেই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ও।
অল্পক্ষণ পরেই হরিণটার দেখা পাওয়া গেল। বাতাসে কান খাড়া করে শত্রুর আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছে। উত্তেজিত হয়ে উঠল থিবল্ট। আড়াল থেকে উঠে জন্তুটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল হাতের বর্শাটা।
হরিণটা প্রথম লাফে সেতুর অর্ধেক, দ্বিতীয় লাফে বাকি সেতু আর তৃতীয় লাফে পগার পার!
এক ফুটের জন্য হরিণকে মিস করে ঘাসে নাক খুঁজল বর্শাটা। থিবল্টের জানা ছিল না এত বাজে ভাবে বর্শা ছোঁড়াও ওর পক্ষে সম্ভব। যাদের সাথে পুরো ফ্রান্স চক্কর দিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে ওর নিশানাই ছিল সবচাইতে নিপুণ। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো থিবল্টের। বর্শাটা তুলে নিয়ে হরিণটার প্রায় সমান ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ওটার পিছু নিল আবার।
এলাকাটা হরিণটার চেয়ে কম চেনে না ও। আবারও আগেভাগে অনুমান করে পথের পাশে লুকিয়ে পড়ল। এবার প্রাণীটা অনেক কাছ দিয়ে গেল। কিন্তু বিধিবাম! বর্শা দিয়ে বাড়ি মারবে, না ওটা ছুঁড়ে-মারবে ভাবতে ভাবতে হরিণটা ওকে পার হয়ে গেল। অবশেষে ওটা যখন প্রায় বিশ কদম দূরে সরে গেছে, তখন বর্শা ছুঁড়ল থিবল্ট। কিন্তু এবারও পরিণতি আগের মতোই হলো-লক্ষ্যভেদ করতে পারল না ও।
হাউন্ডগুলোর ডাক ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। আর কিছু সময় পরে পরিকল্পনা সফল করার সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পরিস্থিতি যত কঠিন হচ্ছে, হরিণটাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হয়ে উঠছে থিবল্টের মনে।
হরিণটা আমার চাই-ই চাই। ব্যারন ব্যাটা তো আমাকে মানুষই মনে করে! গরীবের যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকে তো তাকে বলছি। প্রমাণ করতে চাই যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, আমিও মানুষ! আবার বর্শাটা তুলে দৌড় শুরু করল থিবল্ট। কিন্তু গরীবের ঈশ্বর হয় ওর কথা কানে তোলেননি আর নয়তো ওর পরীক্ষা আরও কঠিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তৃতীয় চেষ্টাটাও বিফলে গেল বেচারার।
ঈশ্বর! অধৈর্য হয়ে উঠেছে থিবল্ট, মনে হচ্ছে ঈশ্বর কানে শুনতে পায় না! তাহলে শয়তানকেই বলি! ঈশ্বর নয় শয়তান, যে-ই শুনুক, হরিণের বাচ্চা হরিণ, তোকে আমি ধরবই!
এই দ্বিমুখী নীতিসূচক কথা শেষ করতে করতেই হরিণটা চতুর্থবারের মতো ওকে ফাঁকি দিয়ে ঝোঁপের আড়ালে হারিয়ে গেল। হাউন্ডগুলোর ডাক এত কাছে শোনা যেতে লাগল যে এই মুহূর্তে হরিণটার পিছু ধাওয়া করার চিন্তা আপাতত বাদ দিতে হলো ওকে। ঝোঁপের আড়ালে বর্শাটা লুকিয়ে একটা গাছে উঠে পড়ল ও। কুকুরগুলো এখনও গন্ধ খুঁজে যাচ্ছে। আর ওগুলোর পেছন পেছনই এসে হাজির হলো ব্যারন। লর্ড ভেযের মেজাজ যারপরনাই খারাপ হয়ে আছে। রাগের চোটে এমন হন্তদন্ত হয়ে চলাফেরা করছে সে, যে পঞ্চান্ন বছর বয়স হলেও হাবভাব দেখে বিশ বছরের যুবক বলে মনে হচ্ছে তাকে।
সামান্য একটা হরিণের পেছনে চার-চারটা ঘণ্টা খরচ করেও ধরা যাচ্ছে না। এমনটা আগে কখনও হয়নি।
লোকদের তাড়া দিচ্ছে ব্যারন, কুকুরদের ওপর চালাচ্ছে চাবুক; স্পরের নির্মম খোঁচায় আগেই ঘোড়াগুলোকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। সেতু পেরোতেই কুকুরগুলো আবার হরিণটার গায়ের গন্ধ খুঁজে পেল।
খুশিতে শিঙায় ফুঁ দিল ব্যারন।
কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষণ টিকল না।
কারণ থিবল্টের গাছের নিচে এসেই যাদুমন্ত্রের মতো থেমে গেল কুকুরগুলো। কর্তার হুকুমে ঘোড়া থেকে নেমে হরিণটার পায়ের ছাপ খুঁজতে শুরু করল ম্যাকোট, এনগুভা এবং অন্যরা। ওদিকে কুকুরগুলোও গাছে কাছ থেকে সরতে নারাজ। অনেক খুঁজেও কোন ছাপ বের করতে পারল না কেউ। কুকুরগুলোকে নড়ানোর চেষ্টা করেও বিফল হলো ওরা। সবাইকে ছাপিয়ে শোনা গেল ব্যারনের রাগান্বিত কণ্ঠ।
বজ্জাত কুকুরগুলো কি গর্তে গিয়ে পড়ল না কি, ম্যাকোট?
না, মাই লর্ড। এখানেই আছে। কিন্তু নড়াচড়া করছে না।
কী বলছ! নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন শুধু শুধু?
কী করব, মাই লর্ড? ঘটনা যে কী ঘটছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
দাঁড়িয়ে পড়েছে। এগোচ্ছে না! তা-ও এই বনের মধ্যে! যেখানে গন্ধ হারানোর জন্য না আছে নদী না আছে পাহাড়তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ম্যাকোট!
আমার মাথা খারাপ হয়েছে, মাই লর্ড?
হ্যাঁ, তুমি একটা গর্দভ আর তোমার কুকুরগুলো সব বেহুদা জঞ্জাল।
নিজের ওপর সব অপমান নীরবে হজম করতে অভ্যস্ত ম্যাকোট, কিন্তু প্রাণ প্রিয় কুকুরের ওপর আক্রমণটা আর সহ্য হলো না ওর। মুখের ওপর প্রশ্ন করে বসল, জঞ্জাল, মাই লর্ড? আমার কুকুরগুলো সব বেহুদা জঞ্জাল! আপনার আস্তাবলের সেরা ঘোড়াটাকে নেকড়ে মেরে ফেলল। সেই নেকড়েটাকে তাড়িয়ে এনেছিল যারা, তারা জঞ্জাল!
হ্যাঁ, আবারও বলছি, বেহুদা জঞ্জাল! একটা হরিণের পিছনে এত ঘণ্টা তাড়া করে এসে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল, জঞ্জালই তো!
ম্যাকোট পরিষ্কার কিন্তু কিছুটা দুঃখ মেশানো স্বরে বলল, মাই লর্ড, আমাকে বোকা, গাধা, মাথামোটা, অপোগন্ড যা খুশি বলুন; এমনকি আমার বউ, বাচ্চাদেরকেও যত খুশি অপমানসূচক কথা বলুন, কিছু মনে করব না আমি; কিন্তু এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে আপনার চাকরি করছি, তার খাতিরে হলেও দয়া করে আমার কাজকে, আপনার কুকুরগুলোকে অপমান করবেন না।
তাহলে ওদের এই হঠাৎ থেমে যাওয়ার ব্যাখ্যাটা কী? বলল কী ব্যাখ্যা, আমি শুনতে রাজি আছি।
আপনার মতোই আমারও কোন ধারণা নেই, মাই লর্ড। হরিণটা হয় আকাশে, নয় পাতালে মিলিয়ে গেছে।
কী আজেবাজে বকছ? হরিণটার কি পাখা গজিয়েছে যে উড়ে যাবে, না কি খরগোশের মতো গর্তে লুকাবে?
ওটা তো কথার কথা বললাম, মাই লর্ড। আসল কথা হচ্ছে, এর পেছনে কোন জাদুর কারসাজি আছে। কথা নেই বার্তা নেই সবগুলো কুকুর একসাথে গন্ধ শোঁকা বাদ দিয়ে শুয়ে পড়ল। আপনার কাছে এটাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
চাবকে ওগুলোর পিঠের চামড়া তুলে ফেলল তাহলে! ভূত তাড়ানোর এর চেয়ে ভাল রাস্তা আর নেই।
আদেশ দিয়ে নিজেও এগিয়ে গেল ব্যারন। ম্যাকোট আদেশ পালন শুরু করল। এনগুভা হ্যাটটা হাতে নিয়ে ব্যারনের কাছে এগিয়ে এল। ঘোড়ার লাগামে হাত রেখে বলল, মাই লর্ড, এইমাত্র গাছের পাতার আড়ালে একটা কোকিল দেখলাম। মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।
কোকিল, কী আবোল তাবোল বকছিস, বানর কোথাকার? দাঁড়া, অনর্থক আমাকে বিরক্ত করতে আসার মজা তোকে টের পাওয়াচ্ছি। চাবুক তুলল ব্যারন। এনগুভা মাথার ওপর হাত তুলে নিজেকে আড়াল করে বলল, মারতে চাইলে মারবেন, মাই লর্ড। কিন্তু একবারটি উপর দিকে তাকান। গাছের ডালে বসা পাখিটাকে দেখলে চাবুকের বাড়ি নয়, আমাকে পুরস্কার দিতে চাইবেন।
থিবল্ট ওক গাছের মগডালে বসে ছিল। সেদিকেই নির্দেশ করল এনগুভা।
কপালে হাত দিয়ে সরাসরি সূর্যের আলো আড়াল করে উপরে গাছের দিকে তাকাল ব্যারন-এবং দেখতে পেল থিবন্টকে।
এনগুভা বলল, মাই লর্ড, যদি চান তো আমি গিয়ে… বলে গাছে চড়ার ইঙ্গিত করল সে।
হাত তুলে নিষেধ করল ব্যারন।
এই যে, উপরে যে আছ, থিবকে তখনও চিনতে পারেনি ব্যারন, আমার একটা কথা জানার ছিল। জবাব দেবে?
উত্তরের অপেক্ষায় একটুক্ষণ চুপ করে থাকল ব্যারন।
তাহলে জবাব দেবে না! তুমি বোধহয় কানে কম শোনো। অসুবিধা নেই, কথা বলানোর ট্রাম্পেট আছে আমার, বলে ম্যাকোটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে আর ম্যাকোট সেই হাতে ধরিয়ে দিল বন্দুক।
এদিকে থিবল্ট একমনে গাছের ডাল কাটার ভান করতে লাগল। ব্যারন কী করছে সেটা যেন ও দেখেইনি। বা দেখলেও গুরুত্ব দেয়নি।
উত্তরের জন্য একটু অপেক্ষা করে গুলি ছুঁড়ে দিল ব্যারন। করাৎ করে আওয়াজ হলো ডাল ভাঙ্গার।
ব্যারনের নিশানা খুবই ভাল। থিবল্টের ডালের গোড়াতেই গিয়ে লেগেছে গুলিটা। আশেপাশে আরও ডাল থাকলেও পতন ঠেকাতে পারল না ও। তবে গাছটায় ডালপালা অনেক আর খুব ঘন। তাই পতনটা থেমে থেমে হলো। অবশেষে ও মাটিতে এসে পড়ল।
আরে! নিজের নিশানার সাফল্যে নিজেই মুগ্ধ ব্যারন। এ তো সকালের সেই জোকারটা। তো, আমার চাবুকের সাথে কাটানো সময়টা খুব কম মনে হয়েছিল তোর, তাই না? আবার চলে এসেছিস দেখা করতে?
নিখাদ আন্তরিকতার সুরে থিবল্ট বলল, একদমই না, মাই লর্ড।
তাহলে সেটা তোর চামড়ার জন্যই ভাল, এখানে গাছের মগডালে বসে কী করছিস?
মাই লর্ড নিজেই দেখতে পাচ্ছেন, আশপাশে ছড়ানো ছিটানো শুকনো কাঠের দিকে নির্দেশ করল থিবল্ট। জ্বালানীর জন্য কাঠ সংগ্রহ করছিলাম।
এবার আর ফালতু কথা না বলে সরাসরি বল, হরিণটার কী হয়েছে?
শয়তানের দিব্যি, ও যেখানে বসেছিল, ওখান থেকে সব পরিষ্কার দেখা যাওয়ার কথা, ম্যাকোট যোগ করল।
বিশ্বাস করুন, মাই লর্ড। হরিণটার ব্যাপারে আপনি কী জানতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমিও সেরকমই ধারণা করেছিলাম, ব্যঙ্গের সুরে বলল ম্যাকোট। ও হরিণটাকে দেখেনি। হরিণটার ব্যাপারে কী জানতে চাইছি তা-ও বুঝতে পারছে না। কুকুরগুলো যেখানে থেমে গেছে, ওখান পর্যন্ত হরিণটার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অথচ মাটির ওপর যেখানে আরও চিহ্ন থাকার কথা, সেখানে কোন দাগই নেই।
শুনেছিস? ব্যারনও যোগ করল। তুই উপরে ছিলি আর হরিণটা নিচে। ইঁদুরের মতো নিঃশব্দে চলাফেরা নিশ্চয়ই করেনি। আর তুই বলছিস বটে যে কিছু দেখিসনি তুই, শুনিসওনি। কিন্তু আমি বলছি তুই অবশ্যই দেখেছিস, নয়তো শুনেছিস!
ম্যাকোট বলল, এটা পরিষ্কার যে ও হরিণটাকে মেরে কোন একটা ঝোপে লুকিয়ে রেখেছে।
মাই লর্ড, থিবল্ট খুব ভাল করেই জানে ম্যাকোটের ধারণা কতটা ভুল। স্বর্গের সব সাধু-সন্তদের দিব্যি দিয়ে বলছি, আমি হরিণটাকে মারিনি। আমি যদি হরিণটার গায়ে একটা আঁচড়ও কেটে থাকি, তাহলে জায়গায় দাঁড়িয়ে বলছি, আমার আত্মা কোনদিন মুক্তি পাবে না। তাছাড়া আঘাত না করে কীভাবে হরিণটাকে মারতাম। আর আঘাত করলে তো রক্তের দাগ থাকত। খুঁজে দেখুন, মাই লর্ড। ম্যাকোটের দিকে তাকিয়ে বলল, ঈশ্বর জানেন, কোথাও কোন রক্তের দাগ আপনি পাবেন না। তাছাড়া নিরীহ জটাকে আমি মারব কী দিয়ে? অস্ত্র কোথায় আমার? আপনিই দেখুন মাই লর্ড, এই কাটারিটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।
কিন্তু থিবল্টের কপাল খারাপ। এনভা আশেপাশের ঝোঁপঝাড়ে চুঁ মেরে বেড়াচ্ছিল। একটা ঝোঁপ থেকে থিবল্টের বর্শাটা কুড়িয়ে এনে ব্যারনের হাতে দিল সে।
কোন সন্দেহ নেই-এনগুভা হচ্ছে থিবল্টের শনি!
তৃতীয় অধ্যায় – অ্যানটে
ব্যারন নীরবে এনগুভার বাড়িয়ে দেয়া বর্শাটা নিল, উল্টেপাল্টে দেখল। ফ্রান্স ঘোরার সময়, নিজের অস্ত্র চেনার জন্য হাতলে একটা জুতো খোদাই করে রেখেছিল থিবল্ট। চিহ্নটা দেখিয়ে ব্যারন বলল, আহহা, মঁসিয়ে গোবেচারা! এই জিনিসটা তো আপনার বিপক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে! যাই-হোক, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, তুই চোরাশিকার করেছিস, এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার উপর সত্য গোপন করেছিস, যেটা কিনা মহাপাপ। যে আত্মার নামে প্রতিজ্ঞা করেছিস, সেই আত্মার মুক্তির জন্য তোর মুখ থেকে সত্যটা আমি বের করব।
তারপর ম্যাকোটকে আদেশ করল, বদমাশটার জামা খুলে ওকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর ওর পিঠে ছত্রিশবার চাবুক চালাও-সত্য গোপন করার জন্য বারোটা আর চোরা শিকারের জন্য চব্বিশটা। না, বরং বারোটা চোরা শিকারের জন্য আর চব্বিশটা সত্য গোপনের জন্য হোক। ঈশ্বরের ভাগটা বেশি থাকা উচিত।
দলের লোকেরা খুশি হয়ে উঠল। যাক, ভালই হলো, সারাদিনের দুর্ভোগের ঝাল একজনের ওপর মেটানোর সুযোগ পাওয়া গেছে।
থিবল্ট বারবার বলার চেষ্টা করল হরিণ তো দূরের কথা, ও একটা ছাগলও শিকার করেনি। তা সত্ত্বেও ওর জামা খুলে গাছের সাথে বেঁধে ফেলে ব্যারনের দেয়া আদেশ কার্যকর করা শুরু হলো।
থিবল্ট চিৎকার না করার চেষ্টায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। কিন্তু আঘাতগুলোতে এত জোর ছিল, যে তিন নম্বর বাড়ির পর আর চুপ থাকতে পারল না ও।
ব্যারন খুব রূঢ় স্বভাবের মানুষ হলেও থিবল্টের যন্ত্রণাকাতর আর্ত-চিৎকার সহ্য করতে এমনকি তারও অসুবিধা হচ্ছিল। নিয়মিত বিরতিতে চিৎকার চলছে। শাস্তি কার্যকর হতে দিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল ব্যারন।
ঠিক এই সময় একটা মেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল বনের ভেতর থেকে। ঘোড়ার পাশে অশ্রুভেজা সুন্দর চোখজোড়া তুলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। ব্যারনকে অনুনয়ের সুরে বলল, ঈশ্বরের দোহাই মাই লর্ড, মানুষটাকে দয়া করুন।
নিচের দিকে তাকাল ব্যারন। বেশি হলে ষোলো বছর হবে ওর বয়স। চমৎকার হালকা-পাতলা শরীর। দুধে আলতা গায়ের রঙ। বড় বড় নীল চোখ। মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল কাঁধ ছাড়িয়েছে। কমনীয় মুখভঙ্গিতে মেয়েটাকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় লাগছে।
এতসব কিছু লক্ষ করতে ব্যারনের মাত্র একটা মুহূর্ত লাগল। সাধারণ অনাড়ম্বর পোষাকে ঢাকা থাকলেও সুন্দরকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি তার। কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটার আকুল চোখের দিকে তাকিয়ে রইল ব্যারন।
চাবুকের বাড়ি বন্ধ হচ্ছে না দেখে আবার কেঁদে উঠল মেয়েটা।
মাই লর্ড, ঈশ্বরের দোহাই, দয়া করুন! আপনার লোকদের থামতে বলুন। মানুষটার চিৎকার আর সহ্য করতে পারছি না।
বিরক্তি প্রকাশ করে লর্ড ভেস বলল, এই বদমাশটার জন্য কাঁদছ? কে হয় ও তোমার, ভাই?
না, মাই লর্ড।
তোমার কাজিন? না, মাই লর্ড।
তোমার প্রেমিক?
প্রেমিক! মাই লর্ড, মজা করছেন আমাকে নিয়ে।
কেন, হতে পারে না? সত্যি হলে স্বীকার করছি, মেয়ে, ওকে আমার অনেক হিংসা হবে।
চোখ নিচু করল মেয়েটা।
ওকে আমি চিনি না, মাই লর্ড আজকের আগে কখনও দেখিনি।
এনগুভা একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না। উল্টো দিক থেকে দেখছে তাই বোধহয় চিনতে পারছে না।
চুপ! কড়া সুরে বলল ব্যারন। তারপর আবার হাসিমুখে মেয়েটার দিকে ফিরল।
আচ্ছা! তাহলে স্বজন নয়, বন্ধু নয়, এমন কারো জন্য কতদূর ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছ, দেখা যাক।
কীভাবে মাই লর্ড?
ওই বদমাশটার জন্য দয়ার বিনিময়ে একটা চুমু চাই!
একটা চুমুর বিনিময়ে একটা মানুষের জীবন বাঁচবে। আমি নিশ্চিত এতে কেউ কোন পাপ ধরবে না।
ব্যারনের অনুমতির অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। কাঠের জুতো জোড়া খুলে ফেলল। নেকড়ে শিকারির বুটের ওপর পা রেখে ঘোড়ার কেশর ধরে নিজেকে উঁচু করল ও। পরিষ্কার, নরম চিবুকটা এগিয়ে দিল ব্যারনের দিকে।
একটা চুমুর কথা থাকলেও ব্যারন দুটো চুমু খেল। তবে কথা রাখল সে। ম্যাকোটকে ইঙ্গিত করল শাস্তি বন্ধ করতে।
ম্যাকোট ওদিকে নিষ্ঠার সাথে গুণে গুণে চাবুকের বাড়ি মারছিল। বাবো নম্বরটা যখন নামতে শুরু করেছে, তখন মার বন্ধ করার আদেশ পেল সে। চাবুকের এই শেষ বাড়িটা না থামিয়ে দ্বিগুণ জোরে চালাল-যেন বারোর সঙ্গে তেরো নম্বরটাও মিশিয়ে দিতে চাইছে! এটার দাগ থিবল্টের কাঁধে আগেরগুলোর চাইতেও গভীরভাবে বসে গেল। তবে তার পরপরই খুলে দেয়া হলো ওর বাঁধন।
ব্যারন তখন মেয়েটার সাথে কথা বলছে।
নাম কী তোমার?
জর্জিনা অ্যানলেট, আমার মায়ের নামে নাম। অবশ্য গাঁয়ের লোক আমাকে শুধু অ্যানলেট বলেই ডাকে।
নামটা শুভ নয়।
কোন্ দিক থেকে, মাই লর্ড?
যে কোন সময় নেকড়ের শিকার হয়ে যেতে পারো! তুমি থাকো কোথায়, অ্যানলেট?
পোসিয়ামন-এ, মাই লর্ড।
ওখান থেকে একা একা এই বনে চলে এসেছ? তোমার সাহস আছে।
বাধ্য হয়েই আসতে হয়, মাই লর্ড। আমার আর দাদীমায়ের তিনটা ছাগল পালতে হয়।
আচ্ছা, ছাগলের ঘাস নিতে আসো?
জি, মাই লর্ড।
একে তোমার বয়স কম, তায় সুন্দরী আবার সাহসীও?
মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠি মাই লর্ড।
কীসের ভয়ে?
শীতের সন্ধ্যায় নেকড়ে-মানবদের অনেক গল্প শুনেছি, মাই লর্ড। যখন একা থাকি, বাতাসের ধাক্কায় গাছের শাখা থেকে শব্দ ওঠে, তখন আমার শরীরে ভয়ের শিহরণ বয়ে যায়, গায়ের নোম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু যখন শিকারি কুকুরগুলোর চিৎকার আর আপনার শিঙার শব্দ ভেসে আসে, তখন আবার নিজেকে নিরাপদ মনে হয়।
মেয়েটার জবাবে খুশি হয়ে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে ব্যারন বলল, তা বটে, নেকড়েদের আমরা দৌড়ের ওপর রাখি। তবে মেয়ে, একটা রাস্তা আছে তোমার এই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার।
কীভাবে, মাই লর্ড?
ভেযের দুর্গ-প্রাসাদে চলে এসো। নেকড়ে-মানব তো দূরের কথা, কোন ধরনের কোন হিংস্র পশুই ওর সীমানায় ঢুকতে পারে না। অন্তত জীবিত অবস্থায় তো নয়ই।
অ্যানলেট না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল।
কেন, আসবে না কেন?
নেকড়ের চাইতেও খারাপ কিছু থাকতে পারে ওখানে।
শুনে হাসতে শুরু করল ভেযের লর্ড। মনিবকে হাসতে দেখে দলের অন্যরাও অনুকরণ করল। আনলেটের দর্শনে আবার খোশমেজাজে ফিরে গেছে ব্যারন। আরও অনেকক্ষণ হেসেই যেত সে, কিন্তু মাঝখান থেকে বাগড়া দিল ম্যাকোট। কুকুরগুলোকে জড়ো করে এনে মনে করিয়ে দিল, দুর্গে ফিরতে হলে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে সবাইকে। ব্যারন উৎফুল্ল মনে মেয়েটার দিকে আঙুল নাচিয়ে দলের সাথে ফিরতি পথ ধরল।
থিবল্টের সাথে একা হয়ে গেল অ্যানলেট। সুন্দরী ও, তাছাড়া থিবল্টের জীবনও বাঁচিয়েছে। এমন মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে নিজেকে একা আবিষ্কার করার পরও, থিবল্টের চিন্তা জুড়ে তখনও শুধুই প্রতিশোধ আর ঘৃণা। সকাল থেকেই অন্ধকারের পথে একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছে ও। শয়তান যদি আমার আর্জিটা এই বেলা শুনত, অপস্রিয়মাণ শিকারি দলের দিকে হাত নেড়ে বলল ও। যদি শুধু একবার শুনত, আমাকে যে পরিমাণ কষ্ট দিয়েছ, তার উচিত জবাব তোমরা পেতে
এভাবে বলছ কেন? কাছে এসে বলল অ্যানলেট, ব্যারন খুবই দয়ালু লোক। গরিবদের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করেন। মেয়েদের সঙ্গেও খুবই ভদ্র ব্যবহার করেন তিনি।
তা তো বটেই, যে মারগুলো আমাকে মেরেছে, তার প্রতিটার জবাব কী দেই দেখো।
এটা তো স্বীকার করবে যে মার খাবার মতো কাজ তুমি করেছ।
আচ্ছা! ব্যারনের চুমু খেয়ে সুন্দরী অ্যানলেটের মাথা ঘুরে গেছে নাকি?
মঁসিয়ে বিবল্ট, অন্তত তোমার কাছ থেকে এই চুমু নিয়ে কোন কথা আমি। আশা করিনি। তারপরও বলব, ব্যারন তার অধিকারের মধ্যে থেকেই কাজটা করেছেন।
আমাকে এভাবে মেরে!
তুমি কেন লর্ডদের এলাকায় শিকার করতে গেছ?
কৃষক কি ধনী, শিকারের অধিকার সবার আছে।
অবশ্যই না। জম্ভগুলো ঘুরে বেড়ায় ওদের এলাকায়, ওখানকার ঘাস খায়। অরলিয়ন্সের ডিউকের এলাকার হরিণকে লক্ষ্য করে বর্শা ছোঁড়ার অধিকার তোমার নেই।
তোমাকে কে বলেছে আমি বর্শা ছুঁড়েছি? আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অ্যানলেটের দিকে একটু এগোল থিবল্ট।
কে বলবে? আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাকে মিথ্যে বলল না। গাছের আড়াল থেকে তুমি যখন বর্শাটা ছুঁড়লে, তখনই দেখেছি আমি তোমাকে।
মেয়েটার সরল সত্যবাদিতার সামনে মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাওয়ায় থিবল্টের রাগ মিইয়ে গেল।
যা-ই হোক, গরীবদেরও কখনও না কখনও লর্ডদের মতো ভালমন্দ খেতে ইচ্ছা করতেই পারে। মাদমোয়াজেল অ্যানলেট, তুমি হলে কী করতে, খরগোশ মারার জন্য কাউকে ফাঁসিতে ঝোলাতে? আর তাছাড়া, ঈশ্বর কি শুধু ব্যারনদের জন্যই হরিণ সৃষ্টি করেছেন?
মঁসিয়ে থিবল্ট, ঈশ্বর অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করতে বলেছেন। ঈশ্বরের আইন মেনে চলল, ভাল থাকবে।
তুমি আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছ, তারমানে কি আমাকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। উৎসবের দিন বুসোনে তোমাকে দেখেছি। ওরা তোমাকে সুন্দর নাচিয়ে বলছিল। যারা চারপাশে দাঁড়িয়ে নাচ দেখছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম।
প্রশংসা শুনে থিবল্ট একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
আচ্ছা, আচ্ছা, তোমাকে দেখেছি মনে হচ্ছে। একসাথে বোধহয় আমরা নেচেওছিলাম। তখন এত লম্বা ছিলে না, তাই চিনতে পারিনি। কিন্তু এখন একটু একটু মনে পড়ছে। তুমি গোলাপি আর সাদা রঙের জামা পরেছিলে। আমরা একটা খামারে নেচেছিলাম। আমি তোমাকে চুমু খেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি রাজি হওনি।
তোমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভাল, মঁসিয়ে থিবল্ট।
তোমাকে দেখেছিলাম তা প্রায় একবছর হবে। কী জানো অ্যানলেট, এই একবছরে তুমি শুধু লম্বাই হওনি, অনেক সুন্দরও হয়েছ। একসাথে এই দুটো কাজ যে সাফল্যের সাথে করতে পারো, এটা স্বীকার করতেই হবে।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটার গাল। চোখ নামিয়ে নিল ও। লজ্জা পাওয়ায় ওকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে।
থিবল্ট আরও ভাল করে অ্যানলেটকে লক্ষ করতে লাগল। পরের প্রশ্নটা করার সময় ওর গলায় উদ্বেগ প্রকাশ পেল।
তোমার প্রেমিক আছে, অ্যানলেট?
না, কখনও ছিল না। আর আশা করি হবেও না।
কেন? প্রেমের দেবতা কি এতই খারাপ যে তুমি তাকে ভয় পাও?
তা নয়, আমি আসলে প্রেমিক চাই না।
কী চাও তাহলে?
স্বামী।
থিবরে নড়ে ওঠাটা অ্যানলেট হয় দেখেনি, আর নয়তো দেখেও না দেখার ভান করল।
ও আবারও বলল, দাদীমা অসুস্থ। তার দেখাশোনা আমাকেই করতে হয়। প্রেমিক থাকলে দাদীমার দেখাশোনা ঠিক মতো করতে পারব না। কিন্তু ভাল একজন স্বামী হলে, সে আমাকে দাদীমার দেখাশোনা ছাড়াও অন্যান্য কাজে সাহায্য করতে পারবে।
কিন্তু স্বামী কি চাইবে, তুমি দাদীকে তার চেয়ে বেশি ভালবাসো? যদি ঈর্ষাবোধ করে?
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অ্যানলেট উত্তর দিল, সেটা নিয়ে কোন ভয় নেই। আমি আমার স্বামীকেও এতটা ভালবাসব যাতে সে অভিযোগ করার কোন সুযোগ না পায়। সে যত ধৈর্য আর নম্রতা দেখাবে দাদীমার প্রতি, আমি তত তার প্রতি মনোযোগ দেব। আরও পরিশ্রম করব যাতে সংসারে কোন কিছুর কমতি না থাকে। আমাকে দেখে ছোটখাটো মনে হতে পারে, কিন্তু পরিশ্রম করার মানসিকতা আমার আছে। মনের জোর থাকলে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করা যায়। আমি, আমার স্বামী এবং দাদীমা, আমরা ঠিক সুখী হব।
বলতে চাইছ, তিনজন একসাথে খুব গরীব থাকবে।
তোমার কি ধারণা গরীবদের ভালবাসা ধনীদের চাইতে একটা মুদ্রাও কম? যখন দাদীমা আমাকে দুর্বল হাতে জড়িয়ে ধরে, বয়স্ক, কোঁচকানো মুখটা আমার মুখের সাথে চেপে ধরে, তার ভালবাসার অশ্রুতে আমার গাল ভিজে যায়, আমিও কাঁদতে শুরু করি, মঁসিয়ে থিবল্ট। আমাদের দুজনের মতো অভাবী হয়তো এ দেশে আর কেউ নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস ওই মুহূর্তে আমি যতটা সুখ অনুভব করি, রাণী বা রাজকুমারীরা তাদের সর্বোচ্চ সুখের দিনেও ততটা সুখ অনুভব করে না।
মেয়েটার কথা শুনতে শুনতে নানান কথা ভাবছিল থিবল্ট; যে কিনা লর্ড, ডিউক এদের দুর্গ-প্রাসাদে কত উৎসব অনুষ্ঠান হতে দেখেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে অভিজাত কোন নারীকে সঙ্গী হিসেবে পাবার। সে-ই এখন ভাবছে, অ্যানলেট নামের এই সুন্দর, নম্র স্বভাবের মেয়েটিকে যদি নিজের করে পায়, তাহলে ব্যারনদেরও ঈর্ষার পাত্র হতে পারবে ও।
আচ্ছা, অ্যানলেট। যদি আমার মত কেউ তোমার স্বামী হতে চায়, তুমি তাকে গ্রহণ করবে?
সবাই বলে থিব সুদর্শন। তাছাড়া সারা ফ্রান্স ভ্রমণের সুবাদে নিজ কাজে দক্ষতা ছাড়াও আরও অনেক কিছুই জানে ও। তার ওপর বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে, একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েই যায়। অ্যানলেট থিবল্টের জীবন বাঁচানোয় এক্ষেত্রে যেমন হয়েছে। ম্যাকোট যেভাবে মারছিল, তাতে ছত্রিশ ঘা খেলে থিবলের আর বাঁচার আশা ছিল না।
হ্যাঁ, যদি তাতে আমার দাদীমার ভাল হয়।
থিবল্ট অ্যানলেটের হাত ধরল।
ঠিক আছে অ্যানলেট, খুব শীঘ্রই আমরা আবার কথা বলব।
যখন তুমি চাও, থিবল্ট।
অ্যানলেট, আমি যদি তোমাকে বিয়ে করি, তুমি কথা দিচ্ছ তুমি আমাকে ভালবাসবে?
স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে কি আমার ভালবাসার কথা?
শুধু একটা প্রতিজ্ঞা করো। বল, মঁসিয়ে থিবল্ট, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি ভালবাসব না।
প্রতিজ্ঞার কী দরকার? একজন সৎ লোকের জন্য এক সত্যবাদী মেয়ের মুখের কথাই কি যথেষ্ট নয়?
আমরা কবে বিয়ে করব, অ্যানলেট? বলতে বলতে অ্যানলেটের কোমরে . হাত রাখল থিবল্ট।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অ্যানলেট।
দাদীমার সাথে দেখা করো। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। এখন আমাকে বোক নিয়ে বাড়ি যেতে সাহায্য করো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অ্যানলেটকে গ্রামের কাছে পৌঁছে দিল থিবল্ট। বিদায় নেয়ার আগে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে একটা চুমু আদায় করল ও। ব্যারনকে চুমু খাওয়ার সময় কোন অস্বস্তিবোধ হয়নি। কিন্তু এই চুমুতে লজ্জাবোধ করল অ্যানলেট। মাথার ভারি বোঝাটা নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে গেল ও। নীল আকাশের পটভূমিতে ছায়ার মতো অপস্রিয়মাণ মেয়েটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল থিবল্ট। অ্যানলেট দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। এই চমৎকার তরুণীটি ওর হবে, এটা ওর চিন্তার কারণ নয়। অন্যের জিনিস পাওয়ার একটা দুর্ভাগ্যজনক আকাঙ্ক্ষা ওর ভেতর আছে। অ্যানলেট সুন্দরী এক তরুণী। অন্য কেউ আগেই যাতে অ্যানলেটকে পেতে না পারে, তাই ও অ্যানলেটকে চেয়েছে। যে সরলতা নিয়ে অ্যানলেট ওর সাথে কথা বলেছে, তাতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে এটা ক্ষণিকের আবেগ, গভীর কোন অনুভূতি নয়। এখানে হৃদয়ের চেয়ে হিসেবের জায়গা বেশি। থিবল্টের পক্ষে প্রেমিকের মতো ভালবাসা সম্ভব নয়। নিজে দরিদ্র হয়েও আরেকটা দরিদ্র মেয়েকে ভালবাসা পাওয়ার জন্য ভালবাসার চিন্তা করা ওর পক্ষে অসম্ভব। তাই অ্যানলেট যত দূরে সরে যেতে লাগল, ততই নিজের ঈর্ষাকাতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থিবকে অধিকার করতে লাগল। ও যখন বাড়ি পৌঁছল, ততক্ষণে পুরো অন্ধকার নেমে গেছে।
চতুর্থ অধ্যায় – কালো নেকড়ে
সারা দিনের ধকলে প্রচণ্ড ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত থিবল্ট। হরিণটাও মারতে পারেনি। তাই খাওয়াটা প্রত্যাশা অনুযায়ী হলো না ওর। কিন্তু ভয়ংকর ক্ষুধার কারণে শুকনো রুটির স্বাদও হরিণের মাংসের চেয়ে খারাপ লাগল না।
হঠাৎ করেই ওর পোষা ছাগলটা ডাকতে শুরু করল। ওটারও মনে হয় খিদে পেয়েছে। এক বোঝা ঘাস নিয়ে ছাউনির দরজা খুলল থিবল্ট। দরজা খোলার সাথে সাথে ছাগলটা ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল। ঘাসের বোঝা ফেলে ওটাকে ধরতে গেল থিবল্ট। শিং ধরে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর অবশেষে আবার ছাগলটাকে ছাউনিতে নিতে পারল ও। তারপর ফিরল খাওয়া শেষ করতে। কিন্তু ঘাস খাবার বদলে করুণ স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল ছাগলটা। অগত্যা আবার খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়তে হলো থিবল্টকে। সাবধানে দরজা খুলে ছাউনিতে ঢুকে অন্ধকার কোনাগুলো হাতড়ে দেখতে লাগল ও। যথেষ্ট সাহসী থিবল্ট। কিন্তু ঈষদুষ্ণ, মোটা চামড়ার ভিন্ন একটা প্রাণীর স্পর্শ পাওয়া মাত্র চমকে উঠে হাত টেনে নিল ও। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বাতি এনে আলো ফেলল ছাউনিতে। ছাগলটা যে প্রাণীটাকে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করছিল, সেটাকে চিনতে পেরে ওর হাত থেকে বাতিটা পড়ে যাবার উপক্রম হলো। সেই হরিণটা, যার পিছনে ব্যারন আর তার হাউন্ডগুলো সারাদিন ঘুরেছে। যেটাকে ঈশ্বরের নামে মারতে না পেরে থিবল্ট এমনকি শয়তানের কাছে পর্যন্ত আর্জি জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওকে চাবুকের বাড়িও খেতে হয়েছে এটারই কারণে। দরজাটা বন্ধ আছে কি না ভাল করে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল ও। তারপর হরিণটার দিকে এগিয়ে গেল। হয় খুব ক্লান্ত, নয়তো প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ওটা। ওকে এগোতে দেখেও কিছুই করল না। শুধু কালো বড় মসৃণ চোখজোড়া তুলে তাকিয়ে রইল।
নিজেকেই বলল থিবল্ট, নিশ্চয়ই দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। কোথায় লুকাবে বুঝতে না পেরে হরিণটা শেষমেশ এখানে এসে ঢুকেছে। কিন্তু তারপরই মনে পড়ল ওর, হুড়কোটা এত শক্ত ভাবে এটে গিয়েছিল যে একটু আগেই হাতুড়ি এনে খুলতে হয়েছে ওটা। তাছাড়া দরজা খোলা থাকলে তো ছাগলটা আরও আগেই বেরিয়ে যেত। আরেকটু ভাল করে খেয়াল করে দেখল, হরিণটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
ভীতু নয় থিবল্ট, কিন্তু এখন ওর কপালে ঘাম জমতে শুরু করল। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ছাউনি থেকে বের হয়ে দরজা আটকে দিল ও। ছাগলটা এই সুযোগে আবার বেরিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে আগুনের পাশে বসে পড়েছে। ওখান থেকে নড়ার বিন্দুমাত্র কোন লক্ষণ নেই ওটার।
ও শয়তানের কাছে আর্জি জানিয়েছিল সত্যি, কিন্তু এভাবে সেটা সত্যি হয়ে যাবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে থিবল্টের। অন্ধকারের শক্তির ছত্রছায়ায় থাকার ব্যাপারটা ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে গিয়ে বাণী মনে করতে পারল না। বুকের কাছে ক্রুশ আঁকতে চেষ্টা করল, কিন্তু হাত উঠল না।
থিবল্টের মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে চারপাশে ওর ফিসফিস করছে অশুভ আত্মারা।
ওর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাল, ঈশ্বর বা শয়তান যে-ই দিয়ে থাকুক, হরিণটাকে কাজে না লাগানো বোকামি হয়ে যাবে। অন্ধকারের জগৎ থেকে পাঠানো হলেও, আমি তো আর খেতে বাধ্য নই। তাছাড়া একা এটা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবও না। অন্য কাউকে সাথে নিতে হলেও তো ঠকা হয়ে গেল। তার চেয়ে মঠের নানদের কাছে বিক্রি করে দিলে ভাল দাম পাব। আর অন্ধকারের ছোঁয়া থাকলেও, ওখানকার পবিত্র পরিবেশে তা দূর হয়ে যাবে, আমিও বেঁচে যাব। হরিণটাকে বিক্রি করে যা পাব, সারাদিন খাটনি করে তার এক-চতুর্থাংশও পাই না। মুখ ঘুরিয়ে থাকা ঈশ্বরের চেয়ে সাহায্যকারী শয়তান অনেক ভাল। শয়তান আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু আমিও তো বোকা নই। আমার যা খুশি, তাই করতে পারি।
অনেক যুক্তি বের করে ফেলল থিবল্ট। অথচ মিনিট পাঁচেক আগেও কপাল পর্যন্ত হাত তুলতে পারছিল না। হরিণটা রেখেই দেবে ও। সুযোগমতো বিক্রি করে দেবে। এমনকি এ-ও চিন্তা করল-ওই টাকায় ওর হবু বৌয়ের জন্য বিয়ের কাপড় কিনবে। অ্যানলেটের মতো এক দেবদূত বাড়িতে থাকলে, কোন শয়তানই বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর সাহস পাবে না।
শয়তান যদি বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়, আমি অ্যানলেটের দাদীর কাছে গিয়ে ওকে চাইব। শয়তানের ধোকায় প্রার্থনা ভুলে গেলেও কোন সমস্যা নেই, লক্ষ্মীমন্ত একটা বউ থাকবে, যার সাথে শয়তানের কোন দেনা পাওনা থাকবে না, সে-ই আমার হয়ে প্রার্থনা করবে।
এভাবে নিজেকে আশ্বস্ত করে হরিণটাকে খাবার দিয়ে এল থিবল্ট। ওটার ঘুমানোর জায়গাটা আরামদায়ক আছে কি না তাও দেখল। ভাল দাম পেতে হলে একটু যত্ন-আত্তি তো করতে হবে।
ওদিকে পরদিন সকালে আবার শিকারে বেরোল ব্যারন। তবে এবার কোন দুর্বল হরিণ নয়-আগেরদিন যার পিছু নিয়েছিল ম্যাকোট, সেই নেকড়েটাই ওদের লক্ষ্য।
নেকড়েটা যে আসলেই ঘাগু নেকড়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বহুবছরের অভিজ্ঞতা ওর সম্বল এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। গায়ের রঙ পুরোটাই কালো। অনেক ঘোরাল ওটা শিকারি-দলকে। পিছু ধাওয়া করে আগেরদিনের এলাকায় চলে এল ব্যারন। এগিয়ে চলল জুতো-কারিগরের কুঁড়ের দিকে।
সন্ধ্যায় অ্যানলেটের সাথে দেখা করতে যাবে, তাই সকাল সকাল কাজ শুরু করেছে থিবল্ট। দিনের বেলা হরিণটাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি হবে। বনরক্ষকের সামনে পড়লে কোন সদুত্তর দিতে পারবে না। কোন এক সন্ধ্যায় বেরিয়ে চুপি চুপি কনভেন্টে চলে যাবে।
শিঙার আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই ছাউনির দরজার সামনে একগাদা লতাপাতা এনে স্তূপ করল। যাতে দরজাটা কারও চোখে না পড়ে। তারপর এসে এত গভীর মনোযোগে কাজ শুরু করল, যেন চোখ পর্যন্ত তোলার ফুরসত নেই। ওর।
হঠাৎ দরজায় খামচাননার শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়াল ও। কিন্তু যাওয়ার আগেই দরজা খুলে গেল। থিবকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে একটা কালো নেকড়ে এসে ঢুকল ভেতরে! তবে ঘরের মাঝখানে এসে নেকড়েদের মতো করেই বসে পড়ল ওটা। জুলজুল করে তাকাল জুতোর কারিগরের দিকে।
নেকড়েটাকে তাড়ানোর জন্য একটা কুঠার মাথার ওপর তুলে নিল থিবল্ট।
হেসে উঠল নেকড়েটা! কেমন একটা কৌতুকের আভাস খেলে গেল ওটার মুখে। থিবল্ট এর আগে কখনও কোন নেকড়েকে হাসতে শোনেনি। কুকুরের মতো ডাকতে শুনেছে, কিন্তু ওরা মানুষের মতো হাসে তা জানত না। আর সে কী হাসি! কোন মানুষও যদি এভাবে হাসত, তবুও পিলে চমকে যেত থিবল্টের। কুঠার ধরা হাতটা নামিয়ে নিল ও।
তুমি একটা মানুষ বটে! ওর বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ভরাট এবং গম্ভীর গলায় বলে উঠল নেকড়েটা। তোমার অনুরোধ রাখতে রাজার বন থেকে সবচেয়ে চমৎকার হরিণটাকে পাঠালাম। আর তুমি কিনা আমারই মাথা দুভাগ করে দিতে চাইছ! মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ দেখি নেকড়েদের মতোই! একটা পশুর গলা দিয়ে ওর মত কথা বেরোচ্ছে দেখে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল থিবল্টের। হাত থেকে খসে?
নেকড়েটা আবার বলতে লাগল, এসো, অবুঝ না হয়ে বন্ধুর মতো বসে কথা বলি। গতকাল তুমি ব্যারনের হরিণটা চেয়েছিলে। আমি ওটাকে ধরে তোমার ছাউনিতে নিয়ে এলাম। যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তাই দড়ি দিয়ে বেঁধেও রাখলাম। তার বিনিময়ে তুমি আমাকে কুঠার দেখাচ্ছ?
আমি কীভাবে জানব তুমি কে?
আচ্ছা, আমাকে চিনতে পারোনি! ভাল কারণ বের করেছ।
আমার কোন বন্ধুর কি এমন বিদঘুঁটে কোট পরে আসার কথা?
বিদঘুঁটে কোট? তা বটে! রক্তের মতো লাল জিভ বের করে নিজের পশম চেটে দিল নেকড়ে। আচ্ছা লোক বটে তুমি! তোমাকে খুশি করা তত বেশ কঠিন দেখা যাচ্ছে। যা-ই হোক, আমি তোমার কাজটা যে করে দিলাম, তার বিনিময়ে কিছু দিতে রাজি আছ তো?
অবশ্যই, বললেও, অস্বস্তিবোধটা এড়াতে পারল না। তবে আগে জানা দরকার তুমি কী চাও? বলো! কী চাও?
প্রথমেই এক গ্লাস পানি। কুকুরগুলোর ধাওয়া খেয়ে আমার দম শেষ।
এখনই দিচ্ছি।
ঘরের কাছেই একটা পানির উৎস আছে। সেখান থেকে পরিষ্কার পানি এনে দিল থিবল্ট। এবং এত অল্পে পার পেয়ে যাওয়ার স্বস্তিটা ও লুকাতে পারল না।
পানির পাত্রটা রেখে একটু কুর্ণিশ করল ও। নেকড়েটাও তৃপ্তির সাথে পানি খেয়ে মেঝেতে লম্বা হলো।
আচ্ছা, এখন শোনো।
আমার কাছ থেকে আরও কিছু চাও? কেঁপে উঠল থিবল্ট।
হ্যাঁ, খুবই জরুরি জিনিস। কুকুরগুলোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি। ক্রমেই কাছে আসছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এখানে চলে আসবে।
ওদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করো।
উদ্ধার করব, কীভাবে? আঁতকে উঠল থিবল্ট। এর আগে ব্যারনের শিকারে বাগড়া বাধানোয় কী ফল হয়েছিল খুব ভাল মনে আছে ওর।
ভাবো, একটা কিছু বুদ্ধি বের করো আমাকে বাঁচানোর।
কুকরগুলোর হাত থেকে এখন তোমাকে বাঁচানো মানেই তোমার জীবন বাঁচানো। ওরা যদি একবার তোমার নাগাল পায়, তাহলে তোমাকে টুকরো টুকরো করতে বেশি সময় লাগবে না ওদের। থিবল্ট বুঝতে পারছে, ও এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। যদি তোমাকে এখন উদ্ধার করি, বিনিময়ে আমি কী পাব?
বিনিময়ে? কেন, হরিণটা?
তাহলে পানির হিসেবটা?
আমরা বরং নতুন করে আবার আলোচনা শুরু করি। তুমি যদি সমঝোতায় আসতে চাও, আমার আপত্তি নেই। তাড়াতাড়ি বলল, কী চাও আমার কাছে?
তোমাকে এমন বেকায়দায় পেলে অধিকাংশই সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান এসব বাহ্যিক জিনিসই চাইত, কিন্তু আমি তা করব না। গতকাল আমি হরিণটা চেয়েছিলাম, তুমি দিয়েছ। কাল আবার আরেকটা জিনিস চাইতে পারি। আমার এই সমস্যাটা আছে। কখন কী চাই তার ঠিক নেই। সবসময় তো আর তোমার কাছে চাইতে পারব না। শয়তান বা আর যা-ই হও, তোমার কাছে আমার চাওয়া এটাই যে, এখন থেকে আমার সব ইচ্ছা পূরণ হোক।
নেকড়েটার মুখে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি ফুটে উঠল। এ-ই? তোমার কথার শুরু আর শেষের সুরটা মিলল না।
একজন দরিদ্র মানুষ হিসেবে আমার চাওয়াগুলোও খুব সাধারণ আর ঘোট ছোটই হবে। একটুকরো জমি, ঘর, দুবেলা অন্নসংস্থান, এর বেশি আমার মতো মানুষ আর কী চাইতে পারে।
আমি পারলে খুশি মনে তোমার ইচ্ছা পূরণ করে দিতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব
সেক্ষেত্রে কুকুরগুলো তোমার কী হাল করতে পারে সে ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করো।
তাহলে তোমার ধারণা যেহেতু সাহায্য চেয়েছি, তুমি যা খুশি তাই চাইতে পারো?
ধারণা না, আমি নিশ্চিত।
তাই! তাহলে তাকাও।
কোনদিকে?
আমি যেখানে ছিলাম। আতঙ্কে পিছিয়ে গেল থিবল্ট। নেকড়েটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কীভাবে, বলার কোন উপায় নেই।
এখনও মনে হচ্ছে তোমার সাহায্য ছাড়া আমি নিরুপায়?
ওহ! শয়তান, তুমি আছ কোথায় এখন?
নাম ধরে ডেকে প্রশ্ন করলে আমাকে উত্তর দিতেই হবে। ঘোত করে জবাব দিল নেকড়েটা। আগের জায়গাতেই আছি।
কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না তো।
কারণ অদৃশ্য হয়ে আছি।
কিন্তু কুকুর, শিকারি, ব্যারন সবাই এখনই চলে আসবে তোমার খোঁজে।
তা আসবে, তবে আমাকে খুঁজে পাবে না।
তোমাকে না পেলে তখন আমার ওপর চড়াও হবে ওরা।
গতকালের মতোই। গতকাল হরিণটাকে ধরার জন্য ছত্রিশ ঘা চাবুকের শাস্তি দিয়েছিল। আজ দেবে বাহাত্তর ঘা। তার উপর আজ আর চুমুর বিনিময়ে বাঁচানোর জন্য অ্যানলেটও আসবে না।
তাহলে এখন কী করব?
হরিণটাকে ছেড়ে দাও। কুকুরগুলো ভুল করে হরিণটাকে ধাওয়া করবে। তোমার বদলে ওরা মার খাবে।
এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর, নেকড়ের গন্ধ বলে ভুল করে হরিণকে ধাওয়া করবে, এটা কী সম্ভব?
অদৃশ্য কণ্ঠ উত্তর দিল, সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন তাড়াতাড়ি করো, কুকুরগুলোর আগেই যদি ছাউনিতে পৌঁছাতে না পারো, ব্যাপারটা সুখকর হবে না। আমার জন্য নয় অবশ্য, আমাকে তো ওরা খুঁজে পাবে নাকিন্তু যাকে পাবে, তার জন্য।
থিবল্ট আর অপেক্ষা করল না। একছুটে গিয়ে ছাউনির দরজা খুলে দিল। সাথেসাথেই লাফিয়ে বেরিয়ে এল হরিণটা। নেকড়েটার পায়ের ছাপের উপর দিয়ে ছুটে বনে হারিয়ে গেল। ওদিকে ঘরের একশো গজের মধ্যে চলে এসেছে কুকুরগুলো। পুরো দলটাই দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। তারপর ডাক ছেড়ে একযোগে হরিণটা যেদিকে গেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করল। ভুল গন্ধের পিছনে ছুটছে ওরা। নেকড়েটাকে ছেড়ে হরিণটার পিছু ধাওয়া করেছে।
স্বস্তির একটা শ্বাস ছাড়ল থিবল্ট। তারপর ব্যারনের শিঙার আওয়াজ শুনতে শুনতে ফিরে এল ঘরে। নেকড়েটা সেই আগের জায়গায় শুয়ে আছে। কীভাবে। আবার হাজির হলো কে জানে!
পঞ্চম অধ্যায় – অশুভ চুক্তি
চৌকাঠে জমে গিয়েছিল থিবল্ট। নেকড়েটা এমনভাবে আবার কথা বলতে শুরু করল যেন মাঝখানে কোন বাধা পড়েনি, আমি বলেছি যে তোমার ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কথাটা পুরোপুরি সত্যি না। আসলে তোমার নিজের সুবিধা এবং আরামের জন্য ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
তারমানে তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই আশা করতে পারি না?
ঠিক তা নয়, অন্যদের ক্ষতি চাওয়ার ইচ্ছাপূরণে আমি সাহায্য করতে পারি।
তাতে আমার কী লাভ হবে?
আরে বোকা! কে যেন বলেছিল না, অন্যের দুর্ভাগ্যে-সেটা যদি খুব কাছের বন্ধুরও হয়, তাতেও কিছু না কিছু লাভ থাকেই।
কে বলেছিল, কোন নেকড়ে? নেকড়েরাও যে নিজেদের মধ্যে এমন দর্শন চালাচালি করে তা জানা ছিল না।
না, মানুষই বলেছিল।
পরে কি তার ফাঁসি হয়েছিল?
উল্টো, সে পরে গভর্নর হয়েছিল। ওখানে অবশ্য নেকড়ের সংখ্যাও কম ছিল না। কাছের বন্ধুর দুর্ভাগ্যেও যদি সুখ থেকে থাকে, শক্রর দুর্ভাগ্যে কতটা আনন্দ হবে চিন্তা করো।
কথাটা একেবারে ভুল বলোনি।
প্রতিবেশী, সে তোমার বন্ধু হোক বা শত্রু, তার ক্ষতিতে লাভবান হবার সুযোগ তো থাকেই।
উত্তর দেয়ার আগে একটু ভেবে নিল থিবল্ট, খুব একটা ভুল বলোনি তুমি। ঠিক আছে, আমি রাজি। কিন্তু এর বিনিময়ে আবার নিশ্চয়ই কিছু চাইবে। কী চাও?
অবশ্যই। প্রতিবার তোমার কোন এমন একটা ইচ্ছা, যাতে তোমার তাৎক্ষণিক কোন উপকার হচ্ছে না, তাহলে সেটা পূরণ করার বিনিময়ে তোমার শরীরের কিছু একটা আমি নেব।
আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠল থিবল্টের চেহারায়।
ভয় পেও না। আমার চেনা জানা এক বিশেষ ইহুদীর মতো ঋণগ্রহীতার শরীরের মাংস চাইব না।
তাহলে কী চাও?
তোমার প্রথম ইচ্ছাপূরণের জন্য একটা চুল, দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণের জন্য দুটো, তৃতীয়টার জন্য চারটা। এভাবে প্রতিবার আগেরবারের দ্বিগুণ হবে।
থিবল্ট হেসে ফেলল, ওহ, এইই। তাহলে আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে মেনে নিলাম। আমি প্রথমদিকেই এমন কিছু চেয়ে নেব যাতে পরে আমাকে আর পরচুলা পরতে না হয়। তাহলে চুক্তি হয়ে যাক! থিবল্ট হাত বাড়িয়ে দিল। নেকড়েটা থাবা উঁচু করেও থেমে গেল।
কী হলো?
ভাবছিলাম, আমার বাবার নখগুলো খুবই ধারালো। তোমার আহত হবার সম্ভাবনা আছে। এরচেয়ে বরং আমরা আরেকটা বিনিময় করি। আমার একটা সোনার আংটি আছে, ওটার সাথে তোমার রূপার আংটি। এতেও অবশ্য তুমিই লাভবান হচ্ছ। থাবা মেলে ধরতেই তাতে নিখুঁত একটা সোনার আংটি দেখতে পেল থিবল্ট। কোনরকম দ্বিধা না করে চুক্তিটা মেনে নিল ও। আংটিবদল করল। দুজন।
তাহলে! এখন আমরা এক হয়ে গেলাম। বলল নেকড়ে।
মানে বলতে চাইছ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। একটু বেশি তাড়াতাড়ি এগোচ্ছ তুমি।
দেখা যাক। এখন তাহলে যে যার কাজে যাই।
বিদায়, মহামান্য নেকড়ে।
আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত, মঁসিয়ে থিবল্ট।
বলার সাথে সাথেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নেকড়েটা। পেছনে রেখে গেল ঝাঁঝালো কটু গন্ধ।
বিস্মিত ভাবে চারপাশে নেকড়েটাকে খুঁজল থিবল্ট। এখনও এমন হুট করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ব্যাপারটার সাথে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি ও।
একবার মনে হলো পুরোটাই স্বপ্ন ছিল কি না। কিন্তু অনামিকার সোনার আংটিটা দেখে বুঝতে পারল ঘটনাটা সত্যি ঘটেছে। আংটিটা খুলে ভাল করে দেখল। আংটিটাতে থ আর শ অক্ষর-দুটো খোদাই করা।
শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর। থিবল্ট আর শয়তান, চুক্তিবদ্ধ দুইজনের নামের আদ্যক্ষর। শয়তানের সাথে চুক্তি করতে গেলে কিছু ছাড় তো দিতেই হবে।
একটা গানের সুর ভঁজার চেষ্টা করল ও। কিন্তু ভয় ওর কণ্ঠ বিকৃত করে দিয়েছে, তাই সে বিরক্ত হয়ে বাদ দিল। নিজের কাজে মন দিল এবার।
শুরু করেও আবার ব্যারনের কুকুর আর শিঙার আওয়াজ শুনে কাজ থামিয়ে দিল থিবল্ট।
ফুলবাবু, যত ইচ্ছা নেকড়ের পিছু ধাওয়া করো। তোমার প্রাসাদে ওর একটা থাবাও নিতে পারবে না। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াও বা আর যা-ই করো, একটা অভিশাপেই তোমার চাবুকের শোধ তুলে নিতে পারব আমি। ভাবতে ভাবতেই থেমে গেল ও।
নেব না-ই বা কেনই? ব্যারন আর ম্যাকোটের ওপর শোধ তো নিতেই পারি। একটা চুলেরই তো ব্যাপার। মাথা ভরা সিংহের কেশরের মতো চুলে আঙুল চালাল থিবল্ট।
একটা গেলেও আরও অনেক চুল থাকবে। তাছাড়া শয়তান আমাকে ধোকা দিল কি না, সেটাও প্রমাণ হয়ে যাবে। ঠিক আছে, ব্যারনের কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটুক, আর অপদার্থ ম্যাকোটেরও, আমার সাথে যেমন করেছিল, তেমন খারাপ কিছুই ঘটুক।
অভিশাপ দেয়ার সময় বেশ উদ্বিগ্ন বোধ করছিল ও। শয়তানের ব্যাপার, কিছুই বলা যায় না। আবার কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করল থিবল্ট। অমনোযোগের ফলে হাত কেটে রক্ত বেরোল ওর। দামী একজোড়া জুতোও নষ্ট হলো। তারপর হঠাৎ দূরে জোরালো চেঁচামেচি শুনে কী ব্যাপার দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে এল ও। অদূরে কিছু লোকজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। বেশ ধীরে আসছে তারা। কাছে পৌঁছানোর পর বোঝা গেল ওরা ব্যারনের লোক। কিছু একটা বয়ে নিয়ে আসছে। অনেকটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো। আরও কাছে আসার পর দেখা গেল ওরা ব্যারন আর ম্যাকোটকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। থিবল্টের কপালে ঘাম জমল। কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল ও।
হরিণটাকে দৌড়ে যেতে দেখে ব্যারন ভেবেছিল হাউন্ডগুলোর ডাক শুনে ভয় পেয়ে লুকোবার চেষ্টা করছে ওটা। পরে কুকুরগুলোর আচরণ দেখে বুঝল, ওরা হরিণটাকেই তাড়া করছে। তখন প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় ব্যারন। শাপশাপান্ত আর মারামারিতেই ক্ষান্ত হয়নি। ঘোড়া নিয়ে কুকুরের পালে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কুকুরদের এই ভুলের জন্য ম্যাকোটকেই দায়ী করে ব্যারন।
ম্যাকোটও কোন প্রতিবাদ করল না। ও নিজেও কুকুরগুলোর ওপর চড়াও হয়। কুকুরগুলোকে ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে।
ওদিকে কুকুরগুলো হরিণটাকে তাড়া করে নদীর দিকে এগোচ্ছিল। ম্যাকোট এগিয়ে গিয়ে ওগুলোকে থামানোর চেষ্টা করল। ঘোড়াটাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন স্রোতের বেগ খুবই বেশি ছিল। ম্যাকোটের ঘোড়াটা তাল সামলাতে পারল না। প্রথমে ডুবল ঘোড়াটা, তারপর ম্যাকোট নিজে।
ম্যাকোটকে ডুবে যেতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল লর্ড ভে। নিজের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের প্রতি একটা মায়া আছে তার। যে করেই হোক, ম্যাকোটকে উদ্ধার করো। যে ওকে উদ্ধার করতে পারবে তাকে পঁচিশ, না পঞ্চাশ, না একশো লুই পুরস্কার দেব! বলে নিজেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল ব্যারন। কিন্তু দলের অন্যরা তাকে বাধা দিল। আর তাতে করে যে সময়টা নষ্ট হলো, সেটাই নিশ্চিত করল ম্যাকোটের মৃত্যু! শেষবারের মতো যখন ম্যাকোটের মাথা জেগে উঠল পানির উপর, সে তখনও কুকুরগুলোকে ফিরে যেতে বলছিল। সোয়া এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া গেল মৃতদেহটা। এদিকে ম্যাকোট মারা গেছে বোঝার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ব্যারন।
থিবল্ট উপলব্ধি করল, কালো নেকড়ে ওর ইচ্ছাটা ঠিক কীভাবে পূরণ করেছে। বিনিময়টা কখন নেবে সেটা অবশ্য বুঝতে পারছে না ও। ইচ্ছাটা পূরণ হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত চুলের গোড়ায় কোন অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে না। কয়েকটা চুলেই কালো নেকড়ে থেমে যাবে কি না তা-ও বুঝতে পারছে না। ম্যাকোটকে ও দেখতে পারত না বটে। কিন্তু মৃতদেহ দেখে কোনরকম আনন্দও অনুভব করছে না। পছন্দ করার কোন কারণ না থাকলেও, লোকটার মৃত্যু কামনা করেনি ও। আবার এ-ও ঠিক, থিবল্ট পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ভবিষ্যতে ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে ওকে।
ব্যারনও মৃতবৎ পড়ে আছে। ম্যাকোটের মৃতদেহ দেখার পর থেকে আর তার জ্ঞান ফেরেনি। ঘাসের স্তূপে এনে ব্যারনকে শোয়াল ওরা। জ্ঞান ফেরানোর মতো কিছু পাওয়া যায় কি না খুঁজতে লাগল সবাই। কেউ ভিনেগারের কথা বলল, কেউ বলল অম্নের কথা। এরমধ্যে এনগুভার গলা শোনা গেল, এসব কিছুই না, একটা ছাগল দরকার। যদি একটা ছাগল পাওয়া যেত।
ছাগল? ব্যারনের জ্ঞান ফিরলে নিজেকে কিছুটা ভারমুক্ত মনে করতে পারত থিবল্ট। আমার একটা ছাগল আছে!
সত্যি! আছে? যাক, মাই লর্ডকে এখন বাঁচানো যাবে। খুশিতে থিবকে। জড়িয়ে ধরল এনগুভা। নিয়ে এসো তোমার ছাগল, বন্ধু!
থিবল্ট ছাউনি থেকে ছাগলটাকে নিয়ে এল।
ওটার শিংগুলো শক্ত করে ধরো, আর সামনের একটা পা ভোলো। আরেক শিকারি একটা ছুরি বের করে ধার দেয়া শুরু করল।
তোমরা কী করবে? প্রস্তুতি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেল থিবল্ট।
কেন? তুমি জানো না! ছাগলের হৃদপিণ্ডের কাছে ক্রুশের আকৃতির একটা হাড় আছে। ওটাকে গুড়ো করতে পারলে, তার মতো দাওয়াই আর হয় না।
ছাগলটার শিং আর পা ছেড়ে দিয়ে থিবল্ট জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমার ছাগলটাকে মেরে ফেলতে চাইছ?
ছি, ছি! মঁসিয়ে থিবল্ট, এটা কোন কথা হলো। আমাদের ব্যারনের জীবনের চাইতে এই ছাগলটার জীবনের দাম তোমার কাছে বেশি হলো? খুবই লজ্জার ব্যাপার।
তোমার জন্য বলা খুব সহজ। আমার নিজের বলতে এই ছাগলটাই আছে। ওর উপর আমি নির্ভর করি। আমাকে নিয়মিত দুধ দেয় ও। তাছাড়া একটা মায়াও পড়ে গেছে।
মঁসিয়ে থিবল্ট, এভাবে তোমার চিন্তা করা উচিত হচ্ছে না। ব্যারন যদি শুনতে পেতেন ওনার জীবন নিয়ে এভাবে দর কষাকষি হচ্ছে, উনার হৃদয় ভেঙে যেত।
আরেকজন বাঁকা হাসি হেসে বলল, ওর যদি মনে হয় ছাগলের দাম শুধু ব্যারনই মেটাতে পারবেন, তাহলে ও দুর্গে আসুক। গতকাল যে হিসাবটা বাকি ছিল, ওটা দিয়ে না হয় দাম মেটানো যাবে।
এদের সাথে এখন শক্তিতে পারবে না, তাছাড়া এখন শয়তানকেও ডাকতে চায় না ও। এটা বুঝে গেছে, ওর সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ নেই। এখানে যারা আছে, তাদের কারো আর কোন ক্ষতি চায় না গিবল্ট।
একজন মারা গেছে, আরেকজন মৃতপ্রায়-যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে ওর। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুখ ঘুরিয়ে রাখল ও। অসহায়ভাবে ডাকতে থাকা ছাগলটার গলা কেটে হৃদপিণ্ড উন্মুক্ত করে হাড়টা খুঁজে বের করল ব্যারনের লোকেরা। হাড়টা গুড়ো করে ভিনেগার আর অন্য দুয়েকটা জিনিস দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করা হলো। তারপর ছুরি দিয়ে দাঁত ফাঁক করে ওটা খাইয়ে দেয়া হলো ব্যারনকে।
জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হলো। নাক ঝেড়ে উঠে বসল ব্যারন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় পানীয় চাইল।
এনভা একটা কাঠের কাপে পানি এনে দিল। কাপটা থিবল্টের পারিবারিক সম্পত্তি। ঠোঁটে লাগানো মাত্র ব্যারন টের পেল কী পানীয় তাকে দেয়া হয়েছে। রাগে কাপটা ছুঁড়ে ফেলল সে। বাড়ি লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ওটা। ওয়াইন চাইল ব্যারন। একজন ঘোড়ায় চড়ে দুর্গে গিয়ে দুটো বোতল নিয়ে এল। আর কোন কাপ না পাওয়ায় বোতল দুটোই পালা করে গলায় ঢালল ব্যারন।
তারপর বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
ষষ্ঠ অধ্যায় – অভিশপ্ত চুল
ব্যারনের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটার পর, তার লোকেরা হাউন্ডগুলোর খোঁজে গেল। ওগুলোকে পাওয়া গেল ঘুমন্ত অবস্থায়। চারপাশে রক্তের দাগ। বোঝ গেল-ওরা হরিণটাকে ধরতে পেরেছিল। হরিণটার শরীরের দুয়েকটা অবশিষ্টাংশও আশেপাশে পাওয়া গেল। কুকুরগুলোকে ছাউনিতে আটকে রাখা হলো। তখনও ব্যারনের ঘুম ভাঙেনি দেখে, লোকগুলো থিবল্টের ঘরে খাওয়ার মতো যা ছিল, জড়ো করল সব। ছাগলটাকেও রান্না করে ডাকল থিবল্টকে। কিন্তু থিবল্ট জানাল ব্যারন আর ম্যাকোটের অবস্থা দেখে ওর খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।
ভেঙে যাওয়া কাপটা তুলল ও। ওটাকে জোড়া লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। গত দুদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওর অবস্থা বেশ নাজুক। এখান থেকে পরিত্রাণের জন্য কী করা ওর পক্ষে সম্ভব ভাবতে লাগল। তখন আনলেটের মুখটাই প্রথম ওর মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ছোট বাচ্চারা স্বপ্নে যে রূপে দেবদূতদের দেখে, অনেকটা সে রূপে। অ্যানলেটের গায়ে সাদা রঙের পোশাক, পিঠে সাদা রঙের বিশাল ডানা, নীল আকাশের বুকে ভেসে যাচ্ছে। ওকে খুব সুখী মনে হচ্ছে। পিছু নিতে ইশারা করছে ও, বলছে, যারা আমার সাথে আসবে, তারা সুখী হবে। কিন্তু থিবল্ট যে উত্তরটা খুঁজে পেল তা হলো ভিন্ন, হ্যাঁ অ্যানলেট, গতকাল পর্যন্ত তোমাকে অনুসরণ করলে ঠিক ছিল। কিন্তু আজ আমি রাজার মতো জীবন-মৃত্যুর অধিকারী। মাত্র একদিন বয়সী ভালবাসার পেছনে ছোটার মতো বোকা আমি নই। তোমাকে বিয়ে করার মানে জীবনের অভাব অভিযোগকে দ্বিগুণ-তিনগুণ করা। না অ্যানলেট, তুমি প্রেমিকা হতে পারো; কিন্তু স্ত্রী হবে এমন কেউ-যে অর্থ নিয়ে আসবে। আর আমার তো ক্ষমতা রইলই।
অ্যানলেট ওর বাগদত্তা, কিন্তু এই সম্পর্ক ভাঙলে বরং মেয়েটারই ভাল।
আমার মতো সৎ মানুষের উচিত নিজের আনন্দের চেয়ে অন্যের ভালটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। অ্যানলেট অল্পবয়সী, মিষ্টি একটা মেয়ে। একজন কাঠ জুতো কারিগরের স্ত্রী হওয়ার চেয়ে অনেক ভাল একজন সঙ্গী ওর প্রাপ্য। আগের দিনের আবেগের বশে করা প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটাই উচিত ওর। তারপরই ক্ৰয়োলের বিধবা মিল মালকিনের কথা ওর মনে পড়ল। তার বয়স ছাব্বিশ থেকে আটাশের মধ্যে হবে-সুন্দরী। আর তার মিলটাও কখনও বন্ধ থাকে না, সুতরাং যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ আছে বলা যায়। ঠিক এমন একজনকেই দরকার থিবল্টের।
আগে যতবারই মাদাম পুলের কথা ভেবেছে, তখন কোন আশা দেখেনি। কিন্তু নেকড়ের কারণে এখন অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা পেয়েছে ও, সুতরাং এখনকার কথা আলাদা। মাদাম পুলেকে পাওয়ার জন্য ওর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাতে কোন বেগ পেতে হবে না ওকে। যদিও সবাই বলে মহিলা বদমেজাজি আর হৃদয়হীন। কিন্তু ওইসব ছোটখাটো দোষ সামলানো ওর জন্য এখন কোন বিষয়ই না। সকাল হতেই সিদ্ধান্ত নিল ও, ক্ৰয়োল যাবে।
****
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল ব্যারনের। বাতাসে চাবুক হাঁকিয়ে বাকিদের জাগাল সে। ম্যাকোটের মৃতদেহটা পাঠিয়ে দিল প্রাসাদে। অন্তত একটা বুনন শুয়োর শিকার করে তারপর নিজে ফিরবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। আতিথেয়তার জন্য থিবল্টের সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দিল সে।
ব্যারন তার কুকুর আর লোকজন নিয়ে বিদায় নিল। শূন্য ছাউনি, আলমিরা, ভাঙা আসবাব আর ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র দেখে দুঃখ হলো থিবল্টের। অভিজাতদের চলার পর পথের অবস্থা এমনই হয়! তবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, ওর বর্তমানের দুঃখকে হালকা করে দিল। খুঁজে পেতে শেষ রুটিটা দিয়ে ছাগলের মাংসের শেষ টুকরোটা গলাধঃকরণ করল ও। তারপর ঝর্ণা থেকে পানি খেয়ে তৈরি হয়ে ক্রয়োলের পথ ধরল। নটার সময় বেরিয়ে পড়ল যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতেই মাদামের সাথে দেখা করতে পারে।
ক্ৰয়োল যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তা ছেড়ে দীর্ঘ পথ বেছে নিল থিবল্ট। এ পথেই অ্যানলেটের সাথে ওর দেখা হয়েছিল। অবচেতন মন ওকে এদিকেই টেনে এনেছে। আর কী আশ্চর্য! হঠাৎ থিবল্ট দেখতে পেল, পেছন ফিরে ছাগলের জন্য ঘাস কাটছে অ্যানলেট। চাইলে মেয়েটার অলক্ষ্যে চলে যেতেই পারত বটে, কিন্তু ওর ভেতরের শয়তানটা ওকে অ্যানলেটের দিকেই টেনে নিয়ে গেল। টের পেয়ে মুখ তুলে থিবকে দেখতে পেল অ্যানলেট। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল ও, হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল।
ও তুমি। কাল রাতে আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, আর তোমার জন্য প্রার্থনা করেছি।
অ্যানলেটের দেবদূতের মতো আকাশে ভেসে যেতে থাকার দৃশ্যটা মনে পড়ল থিবল্টের। আমাকে স্বপ্নে দেখেছ, আমার জন্য প্রার্থনা করেছ, কেন? প্রশ্নে আন্তরিকতার ছোঁয়া কিছুটা কমই ছিল।
মেয়েটা ওর বড় নীল চোখজোড়া তুলল। স্বপ্ন দেখেছি, কারণ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আর প্রার্থনা করেছি কারণ, আমি দেখেছি ব্যারন আর তার শিকারিরা কী দুর্ঘটনায় পড়েছিল। তার ফলে তোমাকে কী ভোগান্তিটা পোহাতে হয়েছে, সেটাও আমি জানি। আমার মনের কথা যদি শুনতাম, তাহলে এক ছুটে চলে যেতাম তোমাকে সাহায্য করতে।
হুম, আসলে মন্দ হত না, আমার সঙ্গ পেতে।
এমন সঙ্গ পাওয়ার চেয়ে ব্যারন আর তার লোকদের সামলানোর কাজে তোমাকে সাহায্য করতে পারলে বেশি ভাল লাগত। বাহ! তোমার আংটিটা তো সুন্দর। কোথায় পেলে?
নেকড়ের দেয়া আংটিটা চোখে পড়েছে মেয়েটার। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল থিবল্টের। এই আংটিটা?
হ্যাঁ, এই আংটিটা, বিবল্ট উত্তর দিতে চাচ্ছে না বুঝতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল অ্যানলেট। নিচু স্বরে বলল, নিশ্চয়ই কোন মেয়ে তোমাকে দিয়েছে?
পাকা মিথ্যেবাদীর মতো জবাব দিল ও, ভুল করছ অ্যানলেট, এটা বিয়ের দিন তোমাকে পরাব বলে কিনেছি।
কেন সত্যিটা আমাকে বলছ না?
সত্যি বলছি, অ্যানলেট।
না, মুখ ভার করে মাথা নাড়ল অ্যানলেট।
তোমার কেন মনে হলো আমি মিথ্যে বলছি?
কারণ আংটির ভেতর আমার অন্তত দুটো আঙুল ঢুকবে। থিবল্টের একটা আঙুল আসলেই অ্যানলেটের দুআঙুলের সমান।
একটু বড় হয়তো, কিন্তু ছোট করা যাবে।
বিদায়, মঁসিয়ে থিবল্ট।
কী! বিদায়?
হ্যাঁ।
তুমি চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ, যাচ্ছি।
আপনার মা
কেন, অ্যানলেট?
আমি কোন মিথ্যেবাদীকে ভালবাসি না।
অ্যানলেটকে আশ্বস্ত করার মতো কোন কথাই ওর মাথায় আসল না।
শোনো, চোখে জল অ্যানলেটের। ওরও চলে যেতে কষ্ট হচ্ছে। যদি সত্যিই তুমি এটা আমার জন্য এনে থাকো…
বিশ্বাস করো এটা তোমার জন্য, অ্যানলেট।
তাহলে এটা আমাকে রাখতে দাও। বিয়ের দিন এটা আশীর্বাদের জন্য ফেরত দেব।
আমি এটা তোমার সুন্দর হাতে দেখতে চাই। কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ, এটা আসলেই তোমার হাতের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি আজই মঁসিয়ে দুর্জোর কাছে যাচ্ছি। তোমার হাতের মাপ নিয়ে আংটিটা ঠিক করব।
অ্যানলেটের চোখের জল শুকিয়ে গেল, ফিরে এল মুখের হাসি। নিজের হাত বাড়িয়ে দিল ও। থিবল্ট মেয়েটার হাতটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল। তারপর চুমু খেল হাতে।
চুমু খাওয়া তোমার ঠিক হয়নি, মঁসিয়ে থিবল্ট, আমার হাত নোংরা হয়ে আছে।
তাহলে চুমু খাওয়ার জন্য অন্য কিছু দাও। অ্যানলেট ওর কপাল এগিয়ে দিল।
বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বাস আর খুশি নিয়ে অ্যানলেট বলল, এখন তাহলে আমাকে আংটিটা দেখতে দাও।
থিবল্ট আংটিটা খুলে মেয়েটার হাতে পরিয়ে দিতে গেল। ও খুবই অবাক হলো যখন আঙুল আঙটিতে ঢুকল না। এমনটা হতে পারে কে জানত?
অ্যানলেট হাসতে হাসতে বলল, মজার ব্যাপার তো!
একের পর এক আঙুলে চেষ্টা করতে থাকল থিবল্ট। আংটিটা যেন ক্রমেই ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে, কোন আঙুলেই পরানো যাচ্ছে না। যেন আংটিটা এই নিষ্পাপ হাতটাকে। ট করতে চায় না। থিবল্ট ঘামতে শুরু করল। ওর হাতের ভেতর অ্যানলেটের হাতও কাঁপতে শুরু করল। কোন আঙুলেই যখন ঢুকল না, তখন মেয়েটা কেঁদে ফেলল। এসবের মানে কী?
হতচ্ছাড়া আংটি, দূর হ পাথরের গায়ে সজোরে ওটা ছুঁড়ে-মারল থিবল্ট। কিন্তু বাড়ি খেতেই একটা স্ফুলিঙ্গ উঠল। ভাঙার বদলে ফিরে এসে থিবল্টের আঙুলে ঢুকে গেল আংটিটা! অ্যানলেট বিস্মিত চোখে ঘটনাটা দেখে থিবল্টের দিকে তাকাল। থিবল্ট স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, কী দেখছ?
নিরুত্তর মেয়েটার চোখে ক্রমেই ভয়ের চিহ্ন বাড়তে লাগল। থিবল্ট বুঝে পাচ্ছে না মেয়েটা কী দেখছে। অবশেষে মেয়েটা ওর মাথার দিকে আঙুল তুলে বলল, মঁসিয়ে থিবল্ট, মঁসিয়ে থিবল্ট, ওখানে কী হয়েছে?
কোথায়?
ওখানে! ওখানে! মেয়েটার চেহারা ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
মাটিতে পা ঠুকে প্রশ্ন করল থিবল্ট, ওখানেটা কোথায়? কী দেখছ তুমি?
মেয়েটা ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। দুহাতে মুখ ঢেকে একটা চিৎকার দিল। তারপর ঘুরে যত জোরে পারে দৌড়াতে শুরু করল।
হতভম্ব হয়ে জায়গায় জমে গেল থিবল্ট, পিছু ধাওয়া করার কথা ওর মাথাতেই এল না।
কী দেখে এত ভয় পেল অ্যানলেট? আঙুল দিয়ে কী দেখাচ্ছিল? প্রথম খুনির মতো ঈশ্বর কী ওকেও চিহ্নিত করে দিয়েছেন? আর করবেন না-ই বা কেন? ও ও তো কেইনের মতো একটা মানুষকেই খুন করেছে। পাদ্রী তো বলেছেন, প্রতিটি মানুষই পরস্পরের ভাই। থিবল্টের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ওর জানতেই হবে কী দেখে অ্যানলেট এত ভয় পেল। শহরে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে আসতে পারে। কিন্তু অ্যানলেট যা দেখেছে, আরও মানুষ তা দেখে ফেলবে। কয়েক পা দূরেই একটা স্বচ্ছ পানির ঝরনা আছে। ওখানে গেলেই নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাবে। ঝরনার পাশে গিয়ে হাটু গেড়ে বসল ও সেই একই মুখ, নাক, অন্যরকম কিছু নেই। কিন্তু কিছু তো একটা অবশ্যই আছে। কপালের ওপর উজ্জ্বল কিছু একটা চোখে পড়ল। আরেকটু ঝুঁকে দেখল লাল রঙের চুল। লাল, তবে সাধারণ কোন লাল নয়। রক্তের মতো, আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল! কীভাবে চুলটা ওখানে এল চিন্তা করার আগেই ওটা তুলে ফেলার চেষ্টা করল থিবল্ট। কিন্তু অনেকরকম ভাবে চেষ্টা করেও চুলটা ওঠাতে পারল না। শেষে ক্ষান্ত দিল। বরং ক্ৰয়োলেই যাওয়া যাক। একটা লাল চুলের কারণে বিয়েতে সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু খুঁতখুতানি রয়েই গেল ওর মনে চুলটার চিন্তা মাথা থেকে তাড়াতে পারল না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে বাড়ির পথ ধরল থিবল্ট। ঘরে ফিরে একটা ধারাল যন্ত্র হাতে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করল চুলটা কাটার। কিন্তু কোন লাভ হলো না! পরীক্ষা করে দেখল যন্ত্রের ধার ঠিক আছে, কিন্তু চুলটা কিছুতেই কাটা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে হতাশ হয়ে একসময় হাল ছেড়ে দিল। বুঝতে পারছে, চুক্তি অনুযায়ী এই চুলটা এখন কালো নেকড়ের।
সপ্তম অধ্যায় – মিলের ছেলেটা
কাটতে ব্যর্থ হয়ে আশপাশের চুল দিয়ে লাল চুলটাকে ঢাকার চেষ্টা করল থিবল্ট। আশা করা যায় সবার দৃষ্টি অ্যানলেটের মতো তীক্ষ্ণ হবে না। চুলটা অন্যরা লক্ষ করবে না। অভিজাতদের দেখেছে চুলের রঙ টাকার জন্য পরচুলা ব্যবহার করতে। কিন্তু আইন ওকে সে অনুমতি দেয়নি। তাই চিরুনি দিয়ে সাবধানে আঁচড়ে চুলটা ঢাকার প্রয়াস পেল। তারপর আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী মিল মালকিনের সাথে দেখা করতে বেরোল। এবার অবশ্য আর ভুল করল না। সংক্ষিপ্ত রাস্তাটাই ধরল, যাতে অ্যানলেটের সাথে দেখা না হয়।
ক্রয়োলে যাওয়ার রাস্তায় উঠে থিবল্ট দেখল, একটা লম্বা ছেলে দুটো গাধা নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটাকে চিনতে পারল, ওর কাজিন ল্যান্ড্রি। মিল মালকিনের ওখানেই কাজ করে। আশা করা যায় ল্যান্ড্রি ওর সাথে মিল মালকিনের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে। ভালই হলো ছেলেটাকে পেয়ে। থিবল্ট এগিয়ে গেল ল্যান্ড্রির দিকে।
পেছনে পায়ের শব্দ পেল ল্যান্ড্রি। ফিরে তাকিয়ে থিবকে চিনতে পারল। ল্যান্ড্রি বরাবরই আমুদে একজন সঙ্গী। কিন্তু এখন ল্যাড্রিকে মনমরা দেখে বেশ অবাক হলো। ল্যান্ড্রি গাধা দুটোকে এগোতে দিয়ে থিবল্টের জন্য দাঁড়াল।
কী ব্যাপার, ল্যাড্রি, ছয় সপ্তাহ পর, কাজ রেখে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম, আর তুমি এমন মুখ ভার করে রেখেছ?
মুখ দেখে মন খারাপ মনে হতে পারে; কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে দেখে খুবই খুশি হয়েছি।
বলছ বটে, কিন্তু মনে তো হচ্ছে না।
মানে?
তোমার গলার স্বরটাও বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। তুমি তো সবসময় হাসিখুশি থাকতে, গান গাইতে। আজ মনে হচ্ছে তুমি শবযাত্রায় অংশ নিয়েছ। পানির অভাবে মিল বন্ধ হয়ে গেছে?
না না, তেমন কিছু হয়নি। বরং উল্টো, পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। ভুট্টার দানার বদলে আমার হৃদয় মিলের চাকার নিচে পড়েছে। এখন শুধু কিছু ঔড়ো অবশিষ্ট আছে।
আচ্ছা! মিলে তাহলে তুমি খুশি নও?
প্রথম যেদিন মিলে পা রেখেছি, সেদিন থেকেই আমি চাকার নিচে চাপা পড়েছি।
ল্যাড্রি, তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ। সমস্যাটা কী খুলে বলল তো!
ল্যান্ড্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
দেখো ভাই, টাকা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করার সঙ্গতি হয়তো আমার নেই। কিন্তু দুটো ভাল কথা বলে তোমার দুঃখ ভোলানোর চেষ্টা তো করতে পারি।
অনেক ধন্যবাদ, থিবল্ট। কিন্তু অর্থ বা উপদেশ-কোনটাই আমার কোন কাজে আসবে না।
যা-ই হোক, আমাকে বলো। বললে নিজেকে হালকা লাগবে।
আমি কিছু বলব না। বলে কোন লাভ নেই।
থিবল্ট হাসতে শুরু করল।
তুমি হাসছ? ল্যান্ড্রি কে বিস্মিত এবং রাগান্বিত মনে হলো। আমার বিপদ দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে?
তোমার বিপদ দেখে হাসছি না, ল্যান্ড্রি। হাসছি কারণ তোমার ধারণা তুমি আমার কাছ থেকে সমস্যাটা লুকিয়ে রাখতে পারবে। কী সমস্যা হতে পারে সেটা তো আন্দাজ করাই যায়।
আন্দাজ করো তাহলে।
বাজি ধরতে পারি তুমি প্রেমে পড়েছ।
আমি, প্রেমে! কে তোমাকে এসব বাজে কথা বলেছে?
বাজে নয়, সত্যি কথা।
আগেরবারের চাইতেও দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ল ল্যাড্রি।
বেশ। ঠিকই ধরেছ, আমি প্রেমে পড়েছি!
যাক! অবশেষে স্বীকার করলে! ওর হৃৎস্পন্দন একটু বেড়ে গেল কাজিনের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীর ছায়া দেখে। তো, কার প্রেমে পড়েছ?
কার?
হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করেছি কার প্রেমে পড়েছ?
তুমি যদি আমার বুক থেকে হৃদপিণ্ডটাও বের করে ফেলো তা-ও আমি বলব না।
এরইমধ্যে বলে দিয়েছ।
কী? বলে দিয়েছি? বিস্মিত চোখে থিবল্টের দিকে তাকাল ল্যান্ড্রি।
অবশ্যই।
তুমি বানিয়ে বলছ!
প্রথম যেদিন মাদাম পুলের মিলে পা রেখেছ, সেদিন থেকেই মিলের চাকায় তুমি আটকা পড়ে গেছ। তারপর তার ডান হাত হয়েছ। মিলে তুমি অসুখী কারণ তুমি প্রেমে পড়েছ। সুতরাং, মিল মালকিনের প্রেমে পড়েছ, তাই তুমি অসুখী।
থিবল্ট, চুপ! যদি ও শুনে ফেলে।
কীভাবে শুনবে? নাকি তোমার ধারণা সে অদৃশ্য হতে পারে, অথবা প্রজাপতি বা ফুলের রূপ ধরতে পারে।
যা-ই হোক, থিবল্ট, চুপ থাকো।
মিল মালকিন তাহলে কঠিন হৃদয়ের মহিলা? তোমার দুর্দশা দেখেও কোন দয়া দেখান না? যদিও সান্ত্বনাসূচক কথা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিল্ট খুশি।
কঠিন হৃদয়! তা বলা যায়। প্রথমদিকে বোকার মতো ভাবতাম আমার ভালবাসাটাকে খারাপ চোখে দেখবে না। সারাদিন কাজ করতাম আর ওকে দেখতাম। ও-ও মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাত। তারপর হাসত। সেই দৃষ্টি আর হাসিতে যে কী সুখ ছিল, থিবল্ট। তাতেই কেন যে সন্তুষ্ট থাকতে পারলাম ্না?
থিবল্ট দার্শনিক উত্তর দিল, কিছুই করার নেই, পুরুষেরা এমনই।
আমার মনের কথা বলার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম আমার অবস্থানের উপরের কারও সাথে কথা বলছি। মাদাম পুলে ভয়ংকর ক্ষেপে গেল। আমাকে ভিক্ষুক বলে গাল দিল। হুমকি দিল পরের সপ্তাহেই আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে।
হুম, কদিন আগের ঘটনা এটা?
প্রায় তিন সপ্তাহ।
সেই পরের সপ্তাহ আসতে এখনও বাকি আছে? প্রশ্নটা করার পর থেকেই একটা অস্বস্তি হতে থাকল থিবল্টের। ল্যান্ড্রির চেয়ে মেয়েদের ও ভাল বোঝে। একমিনিট চুপ থেকে বলল, দেখে যতটা মনে হয়েছিল, ততটা অসুখী তুমি আসলে নও।
ততটা অসুখী নই?
না।
যদি দেখতে কীভাবে দিন কাটাচ্ছি। তাকায় না, হাসে না। আমাকে দেখলেই উল্টো ঘুরে যায়। কাজের কথা বলতে গেলেও এত অবহেলার ভাব দেখায়, আমি সব ভুলে কাঁদতে শুরু করি। তখন আমাকে সামলে নিতে বলে। আমি দৌড়ে পালিয়ে আসি।
তোমার মালকিনের পেছনেই পড়ে থাকতে হবে কেন? আরও তো অনেক মেয়ে আছে, যারা তোমার মতো ছেলে পেলে বর্তে যাবে।
ওকে আমি ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
আমি হলে ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করতাম না। অন্য কাউ নাও।
আমি পারব না।
অন্তত চেষ্টা তো করো। যদি সে দেখে তুমি অন্য কারও প্রতি ঝুঁকেছ, ঈর্ষাবোধ করতে পারে। এখন যেমন তুমি তার পেছনে ছুটছ, তখন হয়তো সে তোমার পেছনে ছুটবে। মেয়েরা খুব অদ্ভুত।
যদি জানতাম তাতে কাজ হবে, তাহলে চেষ্টা অবশ্যই করতাম। কিন্তু এখন…
এখন কী?
যা কিছু ঘটেছে তারপর এসব করে আর কোন লাভ নেই।
কী ঘটেছে? সব তথ্য জানার তাগিদ বোধ করল থিবল্ট।
সে কথা আমার বলার সাহস নেই।
কেন?
ওই যে একটা কথা আছে না, ঘুমন্ত কুকুরকে জাগিও না।
ওরা মিলের কাছে চলে এসেছে, কথা শুরু হলেও শেষ করা যেত না, তাই আর ল্যান্দ্রিকে জোরাজুরি করল না থিবল্ট। ল্যান্ড্রি ভালবাসলেও ওই মহিলা ওকে ভালবাসে না। অল্প বয়সী, সাধারণ চেহারার ল্যান্ড্রি ওর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাত্তাই পাবে না। সামান্যতম রুচিবোধ থাকলেও মহিলা ওকেই পছন্দ করবে। নিজের সাফল্যের ব্যাপারে তাই মোটামুটি নিশ্চয়তা বোধ করতে লাগল ও। সবুজ উপত্যকার একেবারে গোড়ায় মিলটার অবস্থান। ঝরনার স্রোত এখানে একটা পুকুর তৈরি করেছে। তার আশেপাশে রয়েছে বিশাল সব গাছের সারি। মিলের বিশাল চাকা ছোট ছোট শাখা নদী তৈরি করেছে। নুড়ি ছড়ানো পথে মিষ্টি শব্দ তুলে শাখাগুলো ছুটে যাচ্ছে অনবরত।
দূর থেকে তাকালে মিলের চিমনিটাই আগে চোখে পড়ে। কাছে না আসলে এই দৃশ্যগুলো দেখা যায় না। জায়গাটা থিবল্টের চেনা। তবে এবার অন্য দৃষ্টিতে দেখছে থিবল্ট। মালকিন যে দৃষ্টিতে তার সম্পত্তির দিকে তাকায়, অনেকটা সে দৃষ্টিতে।
খামারে ঢুকতেই চোখে পড়ল কবুতর, হাঁস আর মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানারঙের দুধেল গরু দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে মালপত্র নামছে। ঘোড়াগুলোও দেখতে চমৎকার। একটা ছেলে গুদাম থেকে বস্তা টেনে আনছে। একটা মেয়েকেও দেখা গেল মাল বইতে। একটা শুয়োর ঘুমোচ্ছে। সবমিলে নানান ধরনের পশুপাখির বাস এখানে।
মুগ্ধ এবং তৃপ্ত ভঙ্গিতে দেখছে থিবল্ট। ল্যান্ড্রি যদি নিজের চিন্তায় বুঁদ না হয়ে থাকত, তাহলে বিষয়টা লক্ষ করত। বিধবা ডাইনিং রুমে ছিল। থিবকে দেখে পরিচয় জানতে চাইল।
নিজের পরিচয় দিল থিবল্ট। জানাল, ওর কাজিনের সাথে দেখা করতে এসেছে।
বিধবা হাসিমুখে ওকে অভ্যর্থনা জানাল। সেই সাথে দিনটা খামারে কাটাবার আমন্ত্রণও জানিয়ে দিল! মহিলার হাসিকে শুভলক্ষণ বলেই ধরল থিবল্ট।
বন থেকে কিছু জাম নিয়ে এসেছে ও উপহার হিসেবে। মহিলা সেগুলো সাজিয়ে আনতে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। থিবল্ট লক্ষ করল, বিধবা ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে কিছু একটা দেখছে। পেছনে তাকিয়ে দেখল ল্যান্ড্রি মাল নামাচ্ছে। মহিলা ওকেই দেখছিল। থিবল্ট এটা টের পেয়েছে বুঝে তার গাল লাল হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল মাদাম, আপনার ভাইকে যদি একটু সাহায্য করেন, দেখতেই পারছেন কাজটা ওর একার পক্ষে কঠিন হয়ে গেছে বলে ঘরে ঢুকে গেল সে।
কপাল। প্রথমে মাদাম পলে, পরে ল্যাভিকে দেখে মন্তব্য করল থিবস্ট। ও তো মনে হচ্ছে ওর ধারণার চাইতেও ভাগ্যবান। আবার কি কালো নেকড়েকে ডাকতে হবে?
মালকিনের অনুরোধ অনুযায়ী ভাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল থিবল্ট। মাদাম ভেতর থেকে দেখছে এ ব্যাপারে ও নিশ্চিত। তাই কাজে সাহায্যের বেলায় নিজের শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে কসুর করল না। কাজ শেষ হলে খাবার ঘরে গিয়ে বসল ওরা। কাজের মেয়েরা টেবিল সাজিয়ে দিল। মাদাম টেবিলের মাথায় বসেছে, আর থিবল্ট বসেছে তার ডানে। থিবল্টের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিল মাদাম পুলে। আশান্বিত হয়ে উঠল ও। তবে ভুল ভাঙতে দেরি হলো না! ওর রসিকতায় হাসতে হাসতেই ল্যাড্রির দিকে চোরা চোখে তাকাতে লাগল মাদাম পুলে। এদিকে ও বেচারা মাদামের বেড়ে দেয়া কোন খাবারই স্পর্শ করেনি। ছেলেটার দুগাল বেয়ে পানি পড়ছে। ছেলেটার দুঃখ মহিলার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। মাদাম নরম দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে ল্যাভ্রিকে খেতে অনুরোধ করল।
.
এই ছোট্ট ইঙ্গিতের ভেতর না বলা অনেক প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে ছিল। সাথে সাথে মালকিনের অনুরোধে খেতে শুরু করল ল্যান্ড্রি।
এসবের কছুই থিবল্টের নজর এড়াল না।
এখন যেহেতু শয়তান ওর পাশে আছে, সিনর জঁ-এর মতো করে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল থিবল্ট, মহিলা এই বাচ্চা ছেলেটাকে ভালবাসে, এ-ও কি সম্ভব? স্বীকার করতেই হবে মহিলার রুচি খুব একটা উন্নত নয়। আমারও তাতে কোন উপকার হচ্ছে না। না, না সুন্দরী, তোমার দরকার আমার মতো একজন পুরুষ, যে এই মিলের দেখাশোনা করতে পারবে।
থিবল্ট লক্ষ করল, বিধবা ল্যান্ড্রির প্রতি তার প্রথম দিককার দৃষ্টি আর হাসিতে ফিরে গেছে। ব্যবস্থা একটা তাহলে নিতেই হচ্ছে। আমার জন্য এরচেয়ে ভাল জুড়ি আশেপাশে আর কোথাও নেই। কিন্তু ল্যান্ড্রির কী করব? ওর ভালবাসা তো আমার পরিকল্পনা কেঁচে দিচ্ছে। আমি কখনও-ই চাই না ল্যান্ড্রির পরিণতি ম্যাকোটের মতো হোক। এটা নিয়ে আমি ভাবছি কেন? এটা তো কালো নেকড়ের মাথাব্যথা। তারপর নিচু স্বরে বলল, কালো নেকড়ে, এমন ব্যবস্থা করো যাতে ল্যান্ড্রির কোন দুর্ঘটনা না ঘটে, কিন্তু আমার পরিকল্পনায়ও ও কোন বাগড়া বাধাতে না পারে। প্রার্থনা শেষ হয়েছে কি হয়নি, মিলিটারি উর্দি পরা জনা চার-পাঁচজন লোককে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মিলের দিকে আসতে দেখা গেল। ল্যান্ড্রি ওদের দেখে চিৎকার দিয়ে পালাতে গিয়েও আবার বসে পড়ল।
অষ্টম অধ্যায় – থিবটের ইছা
সৈনিকদের আসতে দেখল সবাই। ল্যাস্ট্রির প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় পেয়ে গেল বিধবা।
ঈশ্বর। কী হয়েছে ল্যাড্রি?
থিবল্টও জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, ল্যান্ড্রি, কী ব্যাপার?
গত বৃহস্পতিবার দো-ফা ইনে রিক্রুটিং-সার্জেন্টের সাথে দেখা হয়েছিল। তখন মুহূর্তের হতাশাবোধের কারণে আমি আমার নাম তালিকাভুক্ত করেছিলাম।
মুহূর্তের হতাশাবোধ! কেন জানতে পারি? প্রশ্ন করল মাদাম।
সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেলল ল্যান্ড্রি, হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। কারণ আমি আপনাকে ভালবাসি!
বোকা ছেলে! আমাকে ভালবাসো, তাই তুমি সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছ?
আপনি তো বলেছিলেন, আমাকে মিল থেকে তাড়িয়ে দেবেন।
কিন্তু তাড়িয়ে কি দিয়েছি? মাদাম পুলের মুখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তাতে ভুল বুঝবার কোন অবকাশ নেই।
ঈশ্বর! আপনি আমাকে সত্যিই তাড়িয়ে দিতেন না?
বোকা ছেলে! মিল মালকিনের হাসি আর অভিব্যক্তি দেখে অন্য সময় হলে খুশিতে পাগল হয়ে যেত ল্যান্ড্রি, কিন্তু এখন ওর দুঃখ আরও বেড়ে গেল। চেষ্টা করলে হয়তো এখনও লুকাতে পারব আমি।
লুকাবে! থিবল্ট বলল, মনে হয় না তাতে কোন লাভ হবে।
কেন হবে না? বলল মাদাম।চেষ্টা করে দেখা যাক। এসো ল্যান্ড্রি।
থিবল্টের চোখ ওদের অনুসরণ করল, ঘটনা তোমার অনুকূলে যাচ্ছে না, বন্ধু! নিজেকেই শোনাল ও, তবে আশার কথা, সৈন্যরা বোকা নয় মোটেও, যেখানেই লুকাক, ঠিক খুঁজে বের করবে। এই কথা বলে নিজের অজান্তেই আরেকটা ইচ্ছা প্রকাশ করে ফেলল থিবল্ট।
কাছেই কোথাও ল্যাভ্রিকে লুকিয়ে ফিরে এল মহিলা। আর তখনই এসে ঢুকল রিক্রুটিং সার্জেন্ট আর তার লোকেরা। দুজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল যাতে ল্যান্ড্রি পালাতে না পারে। ঘরের চারপাশে নজর বুলাল সার্জেন্ট। মাদাম হাসিমুখে সার্জেন্টকে কিছু খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। খাবার ফাঁকে তাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইল। সার্জেন্ট জবাব দিল, তারা একটা ছেলেকে খুঁজতে এসেছে। ছেলেটা নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেছে কিন্তু তারপর আর হাজিরা দেয়নি-জানা গেছে ওর নাম ল্যান্ডি। ক্ৰয়োলের মিল মালকিন বিধবা মাদাম পুলের কাছে থাকে ও। সে কারণেই সার্জেন্টকে এখানে আসতে হয়েছে।
মহিলা জবাব দিল ল্যান্ড্রির ব্যাপারে সে কিছু জানে না। এই নামের কেউ কখনও মিলে কাজও করেনি।
সার্জেন্ট মাদামের চোখ এবং মুখের প্রশংসা করল। তারপর বলল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই চোখের দৃষ্টি এবং মুখের কথা তার বিশ্বাস করতে হবে। মিলটা খুঁজে দেখতে সে বাধ্য।
মিনিট পাঁচেক পরে সার্জেন্ট এসে মাদামের কাছে তার রুমের চাবি চাইল। বিধবা বিস্মিত হলেও শেষ পর্যন্ত চাবি দিতে বাধ্য হলো। তারও এক-দুমিনিট পর সার্জেন্ট ল্যাভ্রিকে টেনে নিয়ে আসল। এই দৃশ্য দেখে মহিলার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। থিবল্টের হৃদপিণ্ড এত জোরে চলছে যে ভয় হলো ওটা ফেটে না যায়। কালো নেকড়ে পেছনে না থাকলে, বিবল্ট নিশ্চিত সার্জেন্ট ল্যাড্রিকে ওখানে খুঁজতে যেত না।
ব্যঙ্গের সুরে সার্জেন্ট বলল, তো রাজার বদলে সুন্দরীর সেবা করতে চাইছ? বুঝতে পারছি। কিন্তু এটাও তো ঠিক, যে রাজার রাজ্যে জন্ম নিয়েছ। তার স্বাস্থ্য পান করেছ। সময় এলে তার সেবাও করতে হবে। কয়েকবছর রাজার সেবা করে তারপর না হয় আবার এখানে ফিরে এসো। চলল।
বিধবা প্রতিবাদ করল, কিন্তু ওর বয়স এখনও বিশ হয়নি। তোমরা ওকে নিতে পারো না।
উনি ঠিকই বলেছেন, আমার এখনও বিশ হয়নি। কবে হবে?
আগামীকালের আগে নয়।
বেশ, আজ রাতটা তাহলে খড়ের বিছানায় কাটাও, সকালেই তুমি প্রস্তুত হয়ে যাবে।
কাঁদতে শুরু করল ল্যান্ড্রি। বিধবা অনেক অনুনয় বিনয় করল। সৈনিকদের চুমু খাবার অনুমতি দিল। টাকাও সাধল। কিন্তু কোন লাভ হলো না। ল্যাড্রিকে হাত বেঁধে নিয়ে গেল সৈনিকরা। যাওয়ার আগে ল্যান্ড্রি জানিয়ে গেল, কাছে থাকুক বা দূরে, সবসময় ও মাদামকে ভালবাসবে। মৃত্যুর সময়ও মুখে তার নাম নিয়েই মরবে। এই বিপর্যয়ের মুখে, দুনিয়া কী ভাববে তার পরোয়া করল না সুন্দরী বিধবা। ল্যাড্রিকে নিয়ে যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরল। ওরা দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার পর বিধবাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হলো। উপরে উপরে অনেক আন্তরিকতা দেখাল থিবল্ট। ল্যান্ড্রির প্রতি মহিলার আবেগের প্রকাশ দেখে ও একটু দমে গিয়েছিল। তবে এখন আবার আশা ফিরে পাচ্ছে। মূলসহ আগাছাটা তো উপড়ে ফেলা গেছে। ল্যান্ড্রির নাম নিয়ে কাঁদতে শুরু করল বিধবা। বেচারা! ওর মতো দুর্বল আর নরম ছেলের কী হবে এখন? বন্দুক আর বোঝার ভারেই তো মারা যাবে ও। তারপর অতিথির দিকে ফিরে বলল, এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা বিপর্যয়, মঁসিয়ে থিবল্ট। বুঝতেই পারছেন, আমি ওকে ভালবাসি। ভদ্র, দয়ালু একটা ছেলে। জুয়া, মদ বা কোনরকম বদ-অভ্যাস ছিল না। ও কখনও আমার ইচ্ছার বিরোধিতা করত না। দেখে বোঝা যায় ওর স্ত্রী কখনও আতংকে থাকবে না। দুটো কঠিন বছর মঁসিয়ে পুলের সাথে কাটানোর পর, ও ছিল আমার জন্য সুবাতাস। মঁসিয়ে থিবল্ট, আমার মতো দুঃখী মহিলার জন্য ভবিষ্যৎ সুখ আর শান্তির সম্ভাবনা নষ্ট হতে দেখাটা যে কতটা কষ্টের!
থিবল্ট ভাবল এটাই নিজের কথা বলার আদর্শ সময়। ও যখনই কোন মহিলাকে কাঁদতে দেখে, ওর মনে হয় মহিলা সান্ত্বনার বাণী শুনতে চায়। অধিকাংশ সময়ই যে এটা ভুল, সেটা অবশ্য ও বুঝতে পারেনি।
আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। আমিও আপনার সাথে সমব্যথী। ও তো আমারও ভাই। ল্যারি প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আপনার উচিত ওর মতো অন্য কাউকে খুঁজে নেয়া।
ওর মতো! এমন ভাল আর সুন্দর ছেলে আমি আর কোথায় পাব? ওর তরুণ মুখটা দেখতে পাওয়াই আমার সুখের জন্য যথেষ্ট ছিল। দিনরাত কাজ করতে পারত ও। কিন্তু আমি ওর দিকে তাকালেই কুঁকড়ে যেত। ওর স্মৃতিই আমাকে আর কারও দিকে তাকাতে দেবে না। বাকি জীবন আমাকে বিধবা হিসেবেই কাটাতে হবে।
যাহ্! কিন্তু ল্যান্ড্রির বয়স তো খুবই কম ছিল।
সেটা কোন দোষ নয়।
ও যে সবসময় এমনই থাকত সেটা কেউ বলতে পারে না। আমার কথা শুনুন, মাদাম, এমন কাউকে খুঁজে বের করুন যে আপনাকে ওর কথা ভুলিয়ে দেবে। বাচ্চা বাচ্চা মুখ নয়, আপনার দরকার একজন শক্তসমর্থ পুরুষ। ল্যান্ড্রির যে গুণগুলো আছে বা নেই, সব তার ভেতর থাকবে। সে হবে সুবিবেচক, যাতে হঠাৎ করে আবিষ্কার করতে না হয় যে, আপনি ভুল করে একজন খারাপ লোককে বিয়ে করে বসেছেন।
মিল মালকিন মাথা নাড়তে লাগল। ওদিকে থিবল্ট বলে চলেছে, সংক্ষেপে, আপনার এমন কাউকে খুঁজে নেয়া উচিত যাকে আপনি সম্মান করতে পারবেন। যে মিলটাকে এখনকার চেয়েও লাভজনক ভাবে চালাতে পারবে, আপনার দেখাশোনা করতে পারবে।
এমন একটা লোক আমি কোথায় পাব? মহিলা উঠে দাঁড়াল। যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল থিবল্টের দিকে। মহিলার কথার সুরটা ধরতে না পেরে থিবল্ট ভাবল, এটাই হচ্ছে ওর ইচ্ছার কথা জানানোর সুযোগ।
এখন আমাকে বলতেই হচ্ছে। আপনার মতো সুন্দরীকে স্বামী খুঁজতে বেশিদূর যেতে হবে না। আমি যখন আপনার জন্য যোগ্য লোকের বর্ণনা দিচ্ছিলাম, তখন আসলে আমার কথাই বলছিলাম। আপনার স্বামী হতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবব আমি।
মহিলা চোখে বিবমিষা নিয়ে থাকল থিবল্টের দিকে। কিন্তু ওর সে খেয়াল নেই, বলে চলেছে, আমি কখনও আপনার ইচ্ছার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব না। আমার একটাই নীতি এবং ইচ্ছা আছে। নীতি আপনার কথা অনুসারে চলা, আর ইচ্ছা আপনাকে সুখী করা। আপনার সম্পদ বাড়ানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে, সে ব্যাপারে আপনাকে পরে বলব… আর…
বক্তব্যটা শেষ করতে পারল না থিবল্ট।
কী! এতক্ষণ চেপে রাখায় রাগটা অনেক বেশি তীব্রভাবে প্রকাশ পেল মাদাম পুলের কণ্ঠে। তুই! যাকে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম, আমার হৃদয় দখল করতে চাইছিস! তোর ভাইয়ের চিন্তা থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিস! বেরিয়ে যা, বদমাশ! বেরিয়ে যা এখান থেকে! না গেলে লোক দিয়ে তোকে মিলের চাকার নিচে ফেলব!
হিবল্ট কোন জবাব দেয়ার সুযোগ পেল না। হতভম্ব হয়ে গেছে। নিজের পক্ষে বলার মতো কিছু মাথায়ই আসল না ওর। ওদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মিলের কর্মচারীরা এসে হাজির। দেখল তাদের মালকিন হাতের কাছে যা পাচ্ছে-জগ, চেয়ার, ইত্যাদি, তা-ই ছুঁড়ে-মারছে থিবল্টের দিকে। আর থিবল্ট কোনমতে সেগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। মালকিন চেঁচাচ্ছে, মেরে ফেলল ওকে! বদমাশ! শয়তান!
বিধবার দল ভারি হতে দেখে ভোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ও। ঠিক এমন সময় ঘুমিয়ে থাকা বড়-সড় শুয়োরটা জেগে উঠল। চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে দৌড় দিল ওটা। এসে পড়ল থিবল্টের পায়ের ওপর। ডিগবাজি খেয়ে কাদায় গড়িয়ে পড়ল থিবল্ট। রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল, নরকে যা হারামজাদা!
.
বলতে যা দেরি, শুয়োরটা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সব ভেঙে-চুরে দৌড় শুরু করল। কর্মচারীরা ওটাকে ধরার জন্য পেছন পেছন ছুটল। কিন্তু সবাইকে ফেলে দিয়ে শুয়োরটা দৌড়ে গেল। তারপর মিলের চাকার নিচে ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে গেল ওটা। মিল মালকিন পুরো দৃশ্যটা অবিশ্বাস নিয়ে দেখল। থিবল্টের অভিশাপ দেয়া এবং তারপরের সব ঘটনা। চেঁচিয়ে বলল সে, থিবল্টকে ধরো! পালাতে দিও না! ও একটা জাদুকর। একটা নেকড়ে-মানব! এই বন-জঙ্গলে এটা একটা ভয়ঙ্কর অভিযোগ। মিলের লোকেরা মালকিনের কথা শুনে থমকে গিয়েছিল। যতক্ষণে ওরা হাতে লাঠিসোটা তুলেছে, ততক্ষণে থিবল্ট খামার থেকে বেরিয়ে গেছে। পাহাড়টা সরাসরি পার হয়ে গেল ও। এত দ্রুত পার হলো যে মিল মালকিনের অভিযোগটাই যেন তাতে সত্য প্রমাণিত হলো।
কী হলো! থেমে গেলে কেন? ওর পিছু নাও, ধরো ওকে! তাগাদা দিল মাদাম পুলে।
কর্মচারীরা কিন্তু নড়তে নারাজ, কী লাভ মাদাম। নেকড়ে-মানবের বিরুদ্ধে আমরা কী-ই বা করতে পারি?
নবম অধ্যায় – নেকড়ে-অধিনায়ক
পালিয়ে সোজা বনের দিকে গেল থিবল্ট। ওখানে কেউ পিছু নিতে আসবে না। আসলেও কালো নেকড়ের কল্যাণে ও যে ক্ষমতা পেয়েছে, তাতে শক্রর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কোন ব্যাপারই না। সমস্যা হচ্ছে, একটা শুয়োরকে যেভাবে শয়তানের ভোগ পাঠানো যায়, মানুষকে সেভাবে পাঠানোটা ঠিক হবে না। ম্যাকোটের মৃত্যুটা এখনও ওর হৃদয়কে ভারি করে রেখেছে। মাঝেমাঝেই পেছন ফিরে দেখছে ও-কেউ পিছু নিয়েছে কি না। শরতের অন্ধকার রাত। বাতাসের ধাক্কায় শুকনো পাতা খসে পড়ছে গাছ থেকে। হাওয়া এ গাছে ও গাছে ধাক্কা খেয়ে বিষণ্ণ সুর তুলছে।
থেকে থেকে পাচার ডাক শুনে মনে হচ্ছে পথ হারানো মানুষের আওয়াজ। এগুলো ওর খুবই পরিচিত শব্দ। এসবে কান না দিয়ে বনে ঢুকেই ডাল কেটে চার ফুট লম্বা একটা লাঠি বানিয়ে নিল ও। এখন শত্রুর মোকাবেলা করতে তৈরি থিবল্ট। মেয়েদের শাপশাপান্ত করতে লাগল ও। কোন যুক্তি ছাড়াই জলজ্যান্ত একটা পুরুষ মানুষকে ছেড়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে পছন্দ করা-কোন মানে হয় না! হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ পেল ও। ঘুরে দেখল অন্ধকারে একজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখল একটা নেকড়ে ওর পিছু নিয়েছে। কিন্তু এটা সেই কালো নেকড়েটা নয়। এর রঙ লালচে বাদামি। আকারেও মিল নেই। সব নেকড়েই তো আর প্রথম নেকড়ের মতো ওর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে না। হাতের লাঠিটা কয়েক পাক ঘুরিয়ে নিল বিল্ট, যাতে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, নেকড়েটার মধ্যে আক্রমণের কোন লক্ষণ নেই। ওর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ছে ওটা, ও এগোলে এগোচ্ছে। মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ছে দল ভারি করার জন্য। এই ডাকগুলো থিবল্টকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। একটু পর সামনেও একজোড়া উজ্জ্বল বিন্দু চোখে পড়ল। লাঠি উঁচিয়ে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেল থিবল্ট। নিচে একটা নেকড়ে শুয়ে ছিল। কোন চিন্তা ভাবনা না করেই নেকড়েটার মাথায় একটা বাড়ি মেরে বসল ও। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে গেল জটা। তারপর মনিবের হাতে মার খাওয়া কুকুরের মতো কান নাড়তে নাড়তে ওর আগে আগে হাঁটা শুরু করল। থিবস্ট ঘুরে দেখতে পেল যে প্রথম নেকড়েটা এখনও ওর পেছন পেছন আসছে। ডানে বামে আরও দুটো নেকড়ে এসে হাজির হলো-আরও আসছে। মাইলখানেক যাওয়ার আগেই সংখ্যাটা এক ডজনে পৌঁছে গেল। থিবল্ট টের পাচ্ছে, পরিস্থিতিটা জটিল হয়ে পড়ছে। গান গাওয়ার চেষ্টা করল ও; আশা, মানুষের গলার আওয়াজ শুনে হয়ত নেকড়েগুলো ভয় পেতে পারে। কিন্তু কাজ হলো না। সবগুলো নেকড়ে কম্পাসের কাটার মতো ওর সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। মোটা ডাল দেখে কোন গাছে উঠে দিনের আলোর অপেক্ষা করার চিন্তা মাথায় এলেও পরে ওটা বাতিল করে দিল থিবল্ট। সিদ্ধান্ত নিল বাড়ির দিকেই এগোবে। এখন পর্যন্ত নেকড়েগুলোর হাবভাব শত্রুভাবাপন্ন নয়। যদি বেগতিক দেখে, তখন গাছে উঠে গেলেই হবে। ও এতটাই অন্যমনস্ক ছিল, কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেছে টেরই পায়নি। প্রথমটা চিনতেই পারেনি নিজের বাড়ি। ওকে বিস্মিত করে দিয়ে সামনের নেকড়েগুলো সম্মানের সাথে দুভাগ হয়ে দুলাইনে বসে পড়ল। যেন রাস্তা করে দিল ওর জন্য। তবে সেজন্য আর নেকড়েগুলোকে ধন্যবাদ জানাতে গেল না থিবল্ট। বরং সোজা ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। শুধু খিল লাগিয়েই ক্ষান্ত দিল না, একটা ভারি আসবাবও এনে রাখল দরজার সামনে। রাতে যদি আক্রমণ আসে, কিছুক্ষণ অন্তত ঠেকাতে পারবে। অবশেষে চেয়ারে বসে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল ও।
একটু দম নেয়ার পর উঠে গিয়ে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে সামনের বনের দিকে তাকাল থিবল্ট।
চলে যাওয়ার বদলে নেকড়েরা সব ওর বাড়ির সামনে বসে আছে।
অন্য কেউ হলে পশুগুলোকে দেখে ভয় পেত। কিন্তু থিবল্ট একটু আগেই ওগুলোর পাহারায় বাড়ি ফিরেছে। এখন ওগুলোর আর ওর মাঝে, যতই পাতলা হোক, একটা দেয়াল অন্তত আছে।
টেবিলে একটা লোহার বাতি রাখল থিবল্ট, তারপর আগুন জ্বালাল। কিন্তু এই নেকড়েগুলো অন্য জাতের। আগুন দেখেও নিজেদের জায়গা ছেড়ে নড়ল না ওরা। অস্বস্তি নিয়ে থিবল্টের আর ঘুমানো হলো না। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। আকাশের তারাগুলো নিভতে শুরু করল। নেকড়েগুলো তখনও কীসের যেন অপেক্ষায় শুয়ে-বসে আছে। শেষ তারাটা নিভে যাওয়ার পর প্রথম সূর্যকিরণ এসে পড়ল। তখন সবগুলো নেকড়ে একসাথে উঠে দাঁড়াল। করুণ সুরে একসাথে ডাক ছেড়ে একেকটা একেক দিকে চলে গেল। এতক্ষণে বসে একটু চিন্তা করার সুযোগ পেল থিবল্ট। আচ্ছা, মিল মালকিন কেন ল্যান্ড্রির বদলে ওকে পছন্দ করল না? ও কি আর সুদর্শন থিবল্ট নেই? নাকি ওর চেহারায় কোন পরিবর্তন এসেছে? পরীক্ষা করে দেখার জন্য আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথম দর্শনেই মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল ওর। এখনও সেই সুদর্শন থিবল্টই আছে বটে, কিন্তু গতদিনের হুট করে বেরিয়ে যাওয়া ইচ্ছাগুলোর কল্যাণে মাথার একটা লাল চুল বেড়ে এক গোছ লাল চুলে পরিণত হয়েছে।
চুলগুলো কাটার বা তোলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, জানে থিবল্ট। সাবধান থাকতে হবে যাতে আর কোন ইচ্ছে এভাবে বেরিয়ে না যায়। সবচেয়ে ভাল হয়, মন থেকে সব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঝেড়ে ফেলে নিজের আদি জীবিকায় ফিরে গেলে। নিজের কাজে লেগে যাবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু কিছুতেই মন বসল না। আগে সুন্দর দিনগুলোতে মনের আনন্দে গান গাইত। কিন্তু কোন গানই মনে করতে পারল না। নিজের অভাবের দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাওয়াটা কি ভাল, যখন চাইলেই ইচ্ছাপূরণ করে সুখী হওয়ার সুযোগ আছে? আগে রান্নার সখ ছিল ওর, কিন্তু এখন সেটাও ভাল লাগছে না। অবশেষে ক্ষুধার তাড়নায় কালো রুটি খেতে বাধ্য হলো থিবল্ট। মানুষের ওপর ওর রাগ আরও বেড়ে গেল। দিনটা এত লম্বা যেন কাটতেই চাইছে না। দরজার বাইরে নিজের বানানো বেঞ্চিটায় গিয়ে বসল ও। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে, এমনি সময় একটা দুটো করে নেকড়ে এসে হাজির হতে শুরু করল। নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে পড়ল ওগুলো। কয়েকটা নেকড়ে চলে আসতেই আবার ঘরে গিয়ে দরজা দিল থিবল্ট। বেশ ক্লান্ত লাগছে, রাত জাগার শক্তি নেই। তাই সারারাতের জন্য আগুন জ্বেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল ও। ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ঘুম যখন ভাঙল তখন দিন হয়ে গেছে। সূর্য উঠে গেছে অনেক আগেই।
জানালার কাছে গিয়ে দেখল নেকড়েগুলো মাটিতে ওদের রাত্রিযাপনের চিহ্ন রেখে গেছে।
পরের সন্ধ্যায় আবার নেকড়েরা এসে হাজির। ইতিমধ্যে ওদের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে থিবল্ট। সম্ভবত কালো নেকড়ের সাথে ওর সম্পর্কের কারণেই ওগুলো ওর প্রতি সহমর্মিতা বোধ করছে। ওর প্রতি জম্ভগুলোর এই মনোভাব কতদূর গভীর জানার সিদ্ধান্ত নিল থিবল্ট। দা-বর্শা সঙ্গে নিয়ে, আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। নেকড়েগুলো তেড়ে না এসে বরং প্রভুভক্ত কুকুরের মতো লেজ নাড়তে লাগল। তখন কাছে গিয়ে দুয়েকটার পিঠ চুলকে দিল ও। এতে আরও খুশি হয়ে উঠল ওগুলো।
বাহ! একটু সুবিধা পেলেই কল্পনার ঘোড়ার লাগাম ছুটিয়ে দেয় থিবল্ট। এমন বাধ্য এবং দ্ৰ শিকারি দল কোন লর্ড ব্যারনেরও নেই। চাইলেই এখন আমি হরিণ শাবক দিয়ে রাতের খাবার সারতে পারি।
বলতে যা দেরি, দল থেকে চারটা বড়সড় নেকড়ে ছিটকে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর নেকড়ের ডাকাডাকি শোনা গেল। আধঘণ্টা পর একটা হরিণ শাবক নিয়ে ফিরে এল নেকড়েগুলো। শিকারটাকে থিবল্টের পায়ের কাছে ফেলল। খুশি হয়ে নিজের জন্য মাংস রেখে বাকিটুকু ভাগ করে দিল থিবল্ট। ওদের কাছে নিজের অবস্থান মেনে নিল। সম্রাটের মতো ওদের ইশারা করল চলে যেতে। পরের দিন যাতে আবার ফিরে আসে।
পরের দিন সরাইখানায় বেঁচে যাওয়া মাংসটুকু বিক্রি করে দিয়ে এল ও। তারপরের দিন বুনো শুয়োরের মাংস। অল্পদিনেই সরাইখানার সবচেয়ে বড় জোগানদারে পরিণত হলো থিবল্ট। জুতো তৈরির কাজ ছেড়ে ভাটিখানায় ঘুরে বেড়াতে লাগল ও। কেউ কেউ ওর লাল চুল নিয়ে ঠাট্টা করার চেষ্টা করত। কিন্তু ও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিত-এই ব্যাপারে কোন রকম মশকরা ও বরদাশত করবে না।
এমন সময় ডিউক আর তার স্ত্রী লর্ড ব্যারনের বাড়িতে বেড়াতে এল। আশপাশের এলাকা থেকে অনেক অভিজাত লর্ড এবং লেডিরাও যোগ দিল। থিবল্টের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পালেও হাওয়া লাগল। ব্যারনের শিকারের শিঙা আরও জোরে বাজতে শুরু করল। বিশাল দল নিয়ে সে প্রতি রাতে শিকারে বেরোত।
প্রায় রাতেই ভোজ আর নাচ-গান হত। কখনও কখনও দলবেঁধে ঘুরতে বেরোত সবাই। সাধারণ মানুষেরা তাকিয়ে দেখত এইসব জৌলুস। থিবল্ট আফসোস করত, কেন ও লর্ড হয়ে জন্ম নেয়নি। কেন সঙ্গী হিসেবে কোন লেডিকে ও পাবে না। অ্যানলেট তো হতদরিদ্র আর মাদাম পুলে একটা জরাজীর্ণ মিলের মালিক।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিল। থিবল্ট এরই মধ্যে অনেকটাই শয়তানের কজায় চলে গেছে। অল্প যা একটু ভাল অবশিষ্ট ছিল, তা-ও ফিকে হতে বসেছে। সরাইখানা থেকে কত আর পায়। ওর মন যা চায়, একবছর ধরে টাকা জমালেও তা হবে না। বিবল্ট, শুরু করেছিল ব্যারনের হরিণ দিয়ে; তারপর অ্যানলেটকে চেয়েছিল। এরপর মাদাম পুলের মিলের আশা করেছিল। এখন কোন প্রাসাদ দুর্গ পেলেও কি ওর মন ভরবে? সুন্দর পা, নিখুঁত গোড়ালি, অভূতপূর্ব সৌরভ, দামী পোশাক, এসব বিলাসিতাও তো চাই ওর।
অবশেষে একদিন ও সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল। হাতে এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গরীব থাকাটা অন্যায়। ওর সব চুল যদি লাল হয়েও যায়, তবু পরোয়া করে না! ক্ষমতা ব্যবহার করে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওকে পূরণ করতেই হবে।
১০. সম্মানীয় ম্যাগলোয়া
দশম অধ্যায় – সম্মানীয় ম্যাগলোয়া
নতুন বছর শুরু হয়েছে, কিন্তু থিবল্ট কী করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সরাইখানা থেকে দ্বিগুণ লাভের আশায় বেশি করে শিকার করাতে লাগল ও।
থিবস্টের শরীর ঠিক থাকলেও আত্মা বদলে যাচ্ছে। দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে মাথার লাল চুল। ভাল পোশাক, পকেটে পয়সা, সব মিলে এখন আর ওকে জুতো-কারিগর মনে হয় না। মনে হয় অবস্থাপন্ন কৃষক বা সচ্ছল নাগরিক, কোন ব্যবসার কাজে এসেছে।
একটা গ্রামের উৎসবে যোগ দিল ও। সেখানে বিল পেঁচার আয়োজন ছিল। বিল সেঁচার বিষয়টা বেশ উত্তেজনাকর। দূর দূরান্ত থেকে লোকে দেখতে আসে। অনেক আগে থেকেই ঘোষণা দেয়া হয়। এক থেকে তিন মাইল লম্বা বিলে একদিক থেকে পানি ছাড়া হয়, আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে যায় সেই পানি। শুধু মাছ থেকে যায়। সেই খালি বিলে ছোট বড় সব মাছ ধরার নামই বিল পেঁচা। এই কাজ সমাধা হতে অনেক সময় সাত দিনও লেগে যায়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী এবং দর্শকদের সবাই প্রস্তুত হওয়ার আগে মাছ ধরা শুরু হয় না।
অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দর্শকেরা এসে হাজির হয়। যে যেখানে পারে, জায়গা করে নেয়। তারপর বিলে পানি ছাড়া শুরু হয়। প্রথমে পরিষ্কার পানি, তারপর একটু ময়লা, তারপর আরও ময়লা। একসময় মাছের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরাতে থাকে মাছ। তখন একদল লোক নেমে সেই মাছ তুলতে শুরু করে। জীবিত মাছগুলো ঝুড়িতে ভরে ট্যাংকে জমা করা হয়; আর মরা মাছ ঘাসে ফেলা হয় দিন শেষ হবার আগেই বিক্রি করার জন্য।
সুইসগেট দিয়ে পানি বেরোতে থাকে। আসল খেলাটা শুরু হয় যখন মাছের চাপে পানি বেরোনো বন্ধ হয়ে যায়। মাছ তোলার দলকে তখন বিশাল সব মাছের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়! দর্শকরা এসময় এসে হাততালি দিতে থাকে।
এভাবে চলে পাঁচ-ছয় দিন। তারপর কাদার ভেতর থেকে বেয়োয় ঈল মাছগুলো। ওগুলোর জন্য পিস্তলধারীরা ঘুরে বেড়ায় পুকুরের কাছে।
থিবল্টও হাত-পা চালিয়ে বিলের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল। পথে এক মহিলার জামা কুঁচকে দিল ও। মহিলা পরিপাটি জামা পরতে পছন্দ করে, তাই ঘুরেই একটা ঝাড়ি মেরে বসল। পাল্টা জবাব দিতে তাকিয়ে থিবল্ট আবিষ্কার করল, মহিলা খুবই সুন্দরী। পিছিয়ে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল ও।
সৌন্দর্যের জয় সবসময়। এমন যদি হত যে মহিলা খুব ক্ষমতাশালী, কিন্তু দেখতে সুন্দর না-তাহলেও থিবল্ট পাল্টা জবাব ঠিকই দিত। আবার এটাও হতে পারে, মহিলার সঙ্গীকে দেখে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্যবান, ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষ। কালো রঙের পোশাক পরা। লম্বায় এতই খাটো, মাথাটা কোনমতে মহিলার কনুই পর্যন্ত পৌঁছেছে। ভালই হয়েছে-লোকটার হাত ধরে রাখা মহিলার জন্য হত শাস্তির নামান্তর। লোকটার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে আছে সে। বেখাপ্পা ধরনের কিছু আধুনিক চীনা মূর্তি আছে না? ছোট পা, বিশাল ভূঁড়ি, মোটা হাত, সুন্দর করে ঝুঁটি বাধা চুল? সেগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে লোকটা। কিছু পোকাও আছে, যেগুলোর পা শরীরের তুলনায় এতই ছোট যে হাটার বদলে গড়িয়ে যাওয়াটাই তাদের জন্য সুবিধাজনক। সেই পোকাগুলোর আকৃতির সাথেও কেমন একটা সাদৃশ্য আছে লোকটার। তবে এসব সত্ত্বেও হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি দেখে তার প্রতি যে কেউ আকর্ষণ বোধ করবে। লোকটা যেন জীবনটা উপভোগ করতেই ধরাধামে এসেছে। মহিলাকে থিবল্টের উপর ক্ষেপে উঠতে দেখে বাধা দিল সে।
ধীরে, মাদাম ম্যাগলোয়া, ধীরে। এই বেচারাকে এত কঠিন কথা বলার দরকার নেই, ও নিজে থেকেই যথেষ্ট দুঃখিত।
আমার এত সুন্দর জামাটা নষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ দেব, তাই না? পায়ে পাড়া দেয়ার কথা তো বাদই দিলাম।
থিবল্ট বলল, ক্ষমা করবেন, মাদাম। আপনি যখন তাকালেন, এত সুন্দর মুখ দেখে খেয়াল করতে পারিনি কোথায় পা দিচ্ছি।
তিন মাস থিবল্ট নেকড়েদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে। সে হিসেবে প্রশংসার ভাষাটাকে খারাপ বলা যাবে না। অবশ্য প্রশংসায় মহিলা গলল না। থিবল্ট ভাল পোশাক পরে আছে। কিন্তু তারপরও মেয়েদের কৌতূহলী অন্তদৃষ্টি দিয়ে সে বুঝে ফেলেছে-থিবল্ট তাদের সমপর্যায়ের মানুষ নয়।
মহিলার সঙ্গী অবশ্য তার খাটো হাতে হাততালি দিয়ে বসল।
বাহ! তোমাকে বেশ বুদ্ধিমান বলেই মনে হচ্ছে বন্ধু। মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তুমি জানো। মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কত সুন্দর করে তোমার প্রশংসা করল। আমাদের উচিত ওকে ড্রিংকের দাওয়াত দেয়া।
নেপোমুশেন, তোমাকে আমি চিনি। সবসময় তুমি ড্রিংক করার তালে থাকো। উপলক্ষ না থাকলে সুযোগ তৈরি করে নাও। ভুলে গেছ, ডাক্তার তোমাকে মদ খেতে নিষেধ করেছে?
তা ঠিক। তাই বলে তো ভদ্রতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করেনি। সুজান, এই রুক্ষ মনোভাবটা তোমাকে মানাচ্ছে না। বাইরের কেউ শুনলে ভাববে একটা গাউন নিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছ। এই ভদ্রলোককে আমাদের সাথে বাড়ি যেতে রাজি করাও। যদি পারো, বাড়িতে পা দেয়া মাত্র তোমার পছন্দের সিল্কের জামা কেনার টাকা আমি দেব।
এই কথায় জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হলো। মাছ ধরার পালাও শেষের পথে। মহিলা থিবল্টের বাড়িয়ে দেয়া হাত জড়িয়ে ধরল।
ওদিকে থিবল্ট তো মহিলার রূপে মুগ্ধ। স্বামী-স্ত্রীর কথা থেকে বুঝতে পারল, মহিলা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী। বেরোবার সময় ভিড় আলগা করার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করল ও।
থিবল্ট ভাবছে এই বেইলিফের স্ত্রীর পছন্দের লোক হিসেবে কী কী সুবিধা ও ভোগ করতে পারবে। মহিলা তার নিজের সুখ কল্পনায় বিভোর। থিবল্টের দিকে তেমন একটা মনোযোগও দিচ্ছে না। মহিলার ক্ষুদে সঙ্গী ওদের পাশে হাস্যকর ভঙ্গীতে হাঁটছে আর গল্প করছে। বলতে গেলে যাত্রাপথটা সেই জমিয়ে রেখেছে।
একাদশ অধ্যায় – ডেভিড আর গোলাইয়াথ
ওরা হেঁটে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত গেল। বেইলিফ সাহেব সিঁড়ি টপকে গিয়ে বেশ কষ্ট করে ঘণ্টা বাজাল। বাড়ির কর্তা অতিথিসহ বাড়ি ফিরেছে। এক সুবেশী গৃহপরিচারিকা এসে দরজা খুলে দিল। তাকে নিচু কণ্ঠে খাবার আয়োজনের নির্দেশ দিয়ে ঘুরল ছোটখাটো মানুষটা। আসুন, বেইলিফ নেপোষুশেন ম্যাগলোয়ার বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।
মাদামকে আগে যেতে দিল থিবল্ট। তারপর ও ড্রইংরুমে ঢুকল।
থিবল্ট মুগ্ধ হয়ে ঘরের চাকচিক্য লক্ষ করছিল। এমন সুযোগ এর আগে কখনও পায়নি ও। মাদাম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লক্ষ করল ওর মুগ্ধতা। কিন্তু স্বামীর মন রক্ষার্থে অতিথিকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। একটু পর অবশ্য ক্লান্তির কথা বলে ঘরে চলে গেল সে। যাওয়ার আগে, থিবল্ট যেন ওদের বাড়িতে আবার আসে, এই আশা ব্যক্ত করে হাসিমুখে বিদায় নিল।
মাদাম চলে যেতেই মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া সে উপলক্ষে পান করার তোড়জোড় শুরু করল। কোন জমায়েতে বা বল-রুমে মেয়েরা আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু মদের আসরে, পুরুষের চেয়ে উত্তম সঙ্গী আর হয় না। কী বলে?
পরিচারিকা পেরিন এসে জানতে চাইল কোন ওয়াইনটা আনবে। কিন্তু ওয়াইনের ব্যাপারে কোন মেয়েকে বিশ্বাস করতে রাজি নয় বাড়ির কর্তা। তাই জবাবে পেরিনকে নিচু হতে বলল ম্যাগলোয়া। ও ঝুঁকতে একটা চুমু খেল ওর গালে। কিন্তু মোটেই লজ্জা পেল না মেয়েটা। সম্ভবত এটা অভিজাতদের স্বাভাবিক আচরণ।
মেয়েটা হাসিমুখে আবার জানতে চাইল, স্যার, কোটা আনব?
কোনটাই না, পেরিন। ভাল ব্র্যান্ড সংখ্যায় এত আছে, যে সঠিকটা তুমি খুঁজেই পাবে না। তাই আমিই সেলারে যাচ্ছি। ছোট ঘোট পায়ে দম দেয়া খেলনার মতো করে হেঁটে সেলারের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল সে। পার্থক্য, এই পুতুলটার দম ঈশ্বর নিজে দিয়েছেন! থিবল্ট নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। নিতান্ত কপালগুণেই এমন বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাসরত সৌহার্দ্যপূর্ণ স্বামী এবং সুন্দরী স্ত্রীর সাথে পরিচয় হয়েছে ওর। মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলে বেইলিফ দুহাতে আর দুবগলে দুটো দুটো চারটা বোতল নিয়ে ফেরত এল।
এরইমধ্যে সাপারের সময় হয়ে গেছে। যে সময়ের কথা, তখন ডিনার হত মধ্য দুপুরে এবং সাপার ছটা নাগাদ। ছটা বাজার আগেই অবশ্য সন্ধ্যা নেমে গেছে। তা ছটাই বাজুক কি বারোটা, যদি আলো জ্বালিয়েই খেতে বসতে হয়, তাহলে সেটাকে সাপার বলাই ভাল!
বোতল নামিয়ে ঘন্টা বাজাল বেইলিফ। পেরিন আবার এসে ঢুকল।
খাবার কখন সাজানো হবে? ম্যাগলোয়া প্রশ্ন করল।
যখন আপনি চাইবেন। জানি আপনি দেরি পছন্দ করেন না, তাই আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি।
তাহলে যাও, মাদামকে জিজ্ঞেস করো আসবে কি না। এটাও বলল, আমরা অপেক্ষা করছি।
পেরিন চলে গেল।
চলো বন্ধু, খাবার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করি। নিশ্চয়ই তোমার ক্ষুধা পেয়েছে। আর ক্ষুধা পেলে পেট ভরাবার আগে চোখ ভরাই আমি!
মনে হচ্ছে আপনি বেশ পেটুক মানুষ!
ভোজনরসিক…ভোজনরসিক, পেটুক না! দুটোকে গুলিয়ে ফেলো না। আমি আগে যাচ্ছি, পেছন পেছন এসো।
মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া তার অতিথিকে খাবার ঘরে নিয়ে এল। তারপর থিবল্টের পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল, রাধুনী হিসেবে মেয়েটাকে তোমার কেমন মনে হচ্ছে? আয়োজনটা দেখো, খুবই সাধারণ। কিন্তু আমার মন ভরে গেছে। আমার বিশ্বাস, বালশাজারের ভোজও সামলাতে পারবে ও।
আপনি ঠিকই বলেছেন, মাননীয় বেইলিফ। দেখেই যে কারও মন ভরে যাবে। থিবল্টের চোখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
খুব জমকালো আয়োজন না হলেও, দেখে মনে হচ্ছে বেশ উপাদেয় হবে। টেবিলের এক মাথায় রাখা আছে নানা রকম মসলা দিয়ে সিদ্ধ করা বড়সড় একটা মাছ। অন্য প্রান্তে শোভা পাচ্ছে বন্য শূকরের মাংস আর পালং শাক দিয়ে প্রস্তুত করা সুস্বাদু চেহারার ঝোল। এছাড়াও রয়েছে দুটো তিতির পাখি দিয়ে বানানো একটা মাংসের পাই এবং আরও কিছু আনুষঙ্গিক ডিশ। থিবল্ট খাবার দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল, পেরিনের ফিরে আসাটা লক্ষই করেনি। মাদাম অতিথির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে এই বলে যে তার খুব মাথা ধরেছে। পরেরবার এলে অতিথির উপযুক্ত সত্ত্বার করবে।
বেইলিফ দৃশ্যতই খুশিতে হাততালি দিল।
ওর মাথা ধরেছে। চলো, বসে পড়ো। টেবিলে আগে থেকে রাখা কয়েকটা বোতলের পাশে সেলারের বোতলগুলোও জায়গা করে নিল।
দুজনেই বেশ ক্ষুধার্ত। দ্রুতই খাবার শেষ হতে লাগল। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কথা হচ্ছে।
মাছটা ভাল, তাই না?
খুব!
আর ওয়াইনটাও বেশ।
চমৎকার।
খেতে খেতে নেপোষুশেন ম্যাগলোয়ার ইতিহাস জানা হয়ে গেল থিবল্টের।
অর্লিয়ন্সের ডিউক লুই-এর চার্চের আসবাবপত্র তৈরি করত ম্যাগলোয়ার বাবা। লুইয়ের ছেলের প্রধান রাধুনী ছিল ম্যাগলোয়া। ছোট থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ তার। রান্নায় দক্ষতার কারণে অভিজাতমহলে প্রবেশাধিকারও ছিল। পঞ্চান্ন বছর বয়সে কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ম্যাগলোয়া।
ডিউক তাকে ডেকে পাঠায়। জানতে চায় কী পরিমাণ সঞ্চয় করেতে পেরেছে ম্যাগলোয়া তার চাকরি করে। ওর সঞ্চয়ের পরিমাণ শুনে প্রিন্স অসম্ভষ্ট হয়, যে লোক তিরিশ বছর তাকে সেবা করেছে, তার এত কম সঞ্চয় থাকলে সেটা তাকে অপমানেরই নামান্তর। তাই ম্যাগলোয়াকে আরও অর্থ দেয় সে চলার জন্য এবং বেইলিফের পদটাও তার জন্য বরাদ্দ করে, যাতে করে একটা মোটা অংকের বাৎসরিক আয় হয় ম্যাগলোয়ার। তার উপর ডিউক ওর বাড়িও সাজিয়ে দেয় বিলাসবহুল ভাবে।
থিবল্ট আরও জানল, মাদাম ম্যাগলোয়া হচ্ছে মঁসিয়ে ম্যাগলোয়ার চতুর্থ স্ত্রী। বিয়ে করেছে স্ত্রীর রূপের জন্য। বয়স যতই হোক না কেন, স্ত্রী মারা গেলে আবার বিয়ে করতে মঁসিয়ে ম্যাগলোয়ার আপত্তি নেই।
এরপর ম্যাগলোয়া শুরু করল স্ত্রীর গুণকীর্তন। স্বামীর মদ খাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করা এবং জামাকাপড়ের প্রতি দুর্বলতা ছাড়া, পৃথিবীতে এমন কোন গুণ নেই, যা মাদামের নেই। একসময় ম্যাগলোলায়ার নিজের এবং স্ত্রীর গল্প বলা শেষ হলো। এবার সে আশা করল থিবল্ট ওর গল্প বলবে। সত্য গোপন করে থিবল্ট বলল যে ও একজন ধনী খামার মালিক। নিজের এলাকায় বিশাল বন রয়েছে ওর। বনে শিকার উপযোগী প্রচুর পশুও আছে। শুনে খুব খুশি হলো ম্যাগলোয়া। হরিণের মাংস খুব পছন্দ করে সে। নতুন বন্ধুর মারফত শিকার করা হরিণ খাওয়ার সুযোগ পাবে।
সাত-সাতটা বোতল শেষ করার পর থামার সিদ্ধান্ত নিল ওরা দুজনে।
থিবল্ট যখন বিদায় নিয়ে বেরোল তখন মাঝরাত। খোলা বাতাসে আসার সাথে সাথে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফল টের পেল ও। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, কোনমতে গিয়ে একটা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করল। এসময় মাথার ছয় কি আট ফুট উপরে একটা জানালা খোলার আওয়াজ পেল ও। মনে হয় ম্যাগলোয়া তার নতুন বন্ধুকে আরেকবার বিদায় জানাতে চাইছে। তারপর হঠাৎ করেই ওর ডান কাঁধে বাড়তি ওজন এসে পড়ল! এরপর বাম কাঁধে। ভারের চাপে ধীরে ধীরে বসে পড়তে বাধ্য হলো থিবল্ট। কেউ একজন ওকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানুষটা বলে উঠল, ঠিক আছে, লেভিলি! ঠিক আছে। উপরে জানালা বন্ধের শব্দ হলো।
দুটো জিনিস থিবল্ট বুঝতে পারল। এক, কেউ ওকে লেভিলি বলে ভুল করেছে। আর দুই, কোন প্রেমাস্পদ ওকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুটোই ওর কাছে অপমানজনক মনে হলো।
মাতালের মতো হাত বাড়িয়ে আগন্তুকের জামা চেপে ধরল ও। কী করছ, বুদ্বু? কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগল থিবল্টের কাছে, কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারল না ও, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় করছ?
অবশ্যই, আমি জানতে চাই কে আমাকে মই হিসেবে ব্যবহার করল?
তারমানে তুমি লেভিলি নও?
না।
যে-ই হও, তোমাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ! তোমার কী ধারণা ধন্যবাদ বললেই ব্যাপারটা চুকে যাবে?
সেরকমটাই আশা করছি।
ভুল আশা করেছ।
ছাড়ো আমাকে! মাতাল কোথাকার!
মাতাল! মাত্র সাত বোতল খেয়েছি আমরা। এরমধ্যে বেইলি নিজেই চার বোতল খেয়েছেন।
ছাড়ো বলছি আমাকে! ব্যাটা মদখোর কোথাকার!
মদখোর! তিন বোতল ওয়াইন খেয়েছি বলে আমাকে মদখোর বলছ?
তিন বোতল খাওয়ার জন্য বলিনি। তিন বোতলে মাতাল হওয়ার জন্য বলেছি। আবারও নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলল লোকটা, এই গর্দভ, তুই আমাকে ছাড়বি কি না বলু?
এমনিতেই লোকের মুখে গালমন্দ শোনা পছন্দ করে না থিবল্ট, আর এখন মাতাল অবস্থায় তো সহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না।
শয়তানের দিব্যি, তুমিই হচ্ছ আসল গর্দভ। আমাকে ব্যবহার করে আমাকেই অপমান করছ। তোমার নাক বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়া উচিত।
বলার সাথে সাথে চোয়াল বরাবর একটা ঘুষি খেল থিবল্ট। এই নে, একজন সৎ ইহুদীর মতো পাওনা চুকিয়ে দিতে জানি আমি! কাকে কী বলছিস বুঝে বলিস!
থিবল্টও জবাব দিল প্রতিপক্ষের বুক বরাবর ঘুষি হাঁকিয়ে। ফলাফল দেখে মনে হলো, একটা ছোট বাচ্চা আঙুল দিয়ে কোন ওক গাছে ধাক্কা মারার চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তে আগের চেয়েও জোরদার আরেকটা ঘুষি খেল থিবল্ট। প্রমাদ গুনল ও। এভাবে ঘুষির জোর বাড়তে থাকলে, ভূমিশয্যা নেবার বেশি বাকি নেই।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল থিবল্ট। হাতে একটা পাথর ঠেকতে সেটা তুলে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে শত্রুর মাথা বরাবর হাকাল ওটা। এবারে কাজ হলো! গোড়া-কাটা ওকের মতো সটান মাটিতে পড়ে গেল ওর প্রতিপক্ষ।
ঝেড়ে দৌড় দিল থিবল্ট। লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে দেখার জন্য পেছন ফিরে একবার তাকালও না।
দ্বাদশ অধ্যায় – ভেড়ার পালে নেকড়ে
বেইলিফের বাড়ি থেকে বন বেশি দূরে ছিল না। সেই বনে ঢুকতেই নেকড়ের দল লেজ নেড়ে খুশি প্রকাশ করে ঘিরে ধরল থিবন্টকে। দুয়েকটা কথা বলে, কাছের নেকড়েটাকে একটু আদর করে, পথ চলতে চলতে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল থিবল্ট।
সন্ধ্যাটা নেহাত মন্দ যায়নি ওর। নিমন্ত্রণদাতার সাথে তাল মিলিয়ে মদ খেয়েছে। হাতাহাতিতে একজনকে পরাজিত করেছে। নিজেকেই বলল, থিবল্ট, স্বীকার করতেই হবে, তোমার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। মাদাম সুজানের মতো কাউকেই তুমি এতদিন খুঁজছিলে। বেইলিফের স্ত্রী! স্ত্রী হিসেবে এমন মেয়ে আর পাওয়া যাবে না, এখন শুধু বেইলিফ মারা গেলেই হয়। স্ত্রী তোক বা প্রেমিকা, মেয়েটা পাশে থাকলে তোমাকে ভদ্রলোক না ভেবে কারও কোন উপায় থাকবে না। যদি কোন ভুল না করো, তাহলে সবই তোমার হবে। প্রথম পরিচয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছিল মেয়েটা। তবে বাড়ি যাবার পর কত ভাল ব্যবহারই না করল। সময়মতো ব্যবস্থা নিলেই আর কোন সমস্যা হবে না। যদিও বেচারা ম্যাগলোয়ার মৃত্যু আমি চাই না। চাওয়া উচিতও না। স্বাভাবিকভাবে মারা গেলে ঠিক আছে, কিন্তু হত্যার চিন্তা করাটা ঠিক হবে না। হাজার হোক ওয়াইন আর প্রচুর সুস্বাদু খাবার খাইয়েছে। তারপর একটা রহস্যময় হাসি হেসে যোগ করল, তবে যে হারে মদ আর খাবার খায় নোকটা, ওপারে যেতে বেশি সময় লাগার কথা না। কোন অসুস্থতা বা অস্বাভাবিক মৃত্যু চাই না আমি ওর। আর দশজনের ভাগ্যে যা জোটে, ওর ভাগ্যে যেন তার চেয়ে একটু বেশি জোটে!
খুশিতে হাত ঘষতে লাগল ও। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে শহরে চলে এসেছে। টেরই পায়নি। এখন ব্যাপারটা লক্ষ করে ইশারায় নেকড়েগুলোকে চলে যেতে বলল। নেকড়ের পাহারায় কেন বা কীভাবে চলাফেরা করছে এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। তাছাড়া কোন কুকুর দেখে ফেললে ডেকে ডেকে লোকের ঘুম ভাঙিয়ে ফেলবে।
বাড়ি ফিরে থিবল্ট দেখল, নেকড়েগুলো তখন বিদায় নিলেও, ঠিকই ওর ঘরের সামনে এসে অপেক্ষা করছে। ওগুলোকে পরের রাতে একই সময়ে আবার আসতে বলল ও।
বাড়ি পৌঁছতে যদিও রাত দুটা বেজেছিল, থিবল্টের ঘুম কিন্তু সকাল সকালই ভাঙল।
ম্যাগলোয়াকে যে জমির কথা বলেছে ও, সেটা আসলে অর্লিয়ন্সের ডিউকের। ও একটা পরিকল্পনা করছে। বেইলিফ শিকারের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সেকারণেই সকাল সকাল ওঠা। সারাদিন ঘুরে হরিণ, বুনো শুয়োর, খরগোশ এগুলোর ডেরা খুঁজে বের করল থিবল্ট। অন্ধকার নামলে নেকড়েদের মতো ডাক ছাড়ল ও। সেই ডাক শুনে বুড়ো, বাচ্চা সমেত নেকড়ের দল আরও ভারি হয়ে ছুটে এল।
থিবল্ট নিজেও ওদের সাথে শিকারে যাবে।
সে রাতে শিকার যেটা হলো তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সারারাত বন জুড়ে হুটোপুটির আওয়াজ শোনা গেল।
নেকড়েরা দলবদ্ধ হয়ে শিকার করছে আর থিবল্ট তাদের সাথে ছুরি হাতে কাটাকাটি করছে। হরিণ, শুয়োর, খরগোশ সবরকম শিকারই হলো সে রাতে।
থিবল্টের ঘরের সামনে শিকারের স্তূপ জমে গেল। সকালে একটা ঠেলা ভর্তি করে মাংস নিয়ে গেল ও বিক্রি করতে। আর সেরা মাংসগুলো রেখে দিল মাদাম ম্যাগলোয়ার জন্য।
নিজে না গিয়ে আগে উপহার পাঠানোর বুদ্ধিটা মাথায় এল ওর। এক লোককে টাকা দিল শিকারগুলো বেইলিফের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। একটা কাগজে লিখে দিল, মঁসিয়ে থিবল্টের পক্ষ থেকে। একটু পরেই ও রওনা হলো। যখন পৌঁছল ততক্ষণে শিকারের মাংস টেবিলে রাখা হয়েছে।
খুশির চোটে হাত মিলিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল বেইলিফ। যদিও উচ্চতার স্বল্পতা এবং স্বাস্থ্যের আধিক্যের কারণে ব্যর্থ হলো চেষ্টাটা। তারপর হয়তো ভাবল, যে কাজ সে নিজে পারেনি, সে কাজে মাদাম ম্যাগলোয়া হয়তো সাহায্য করতে পারবে! দরজার কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে ডাকল, সুজান, সুজান!
স্বামীর ডাক শুনে উপর থেকে নেমে এল সুজান। এসে দেখল তার স্বামী ঘুরে ঘুরে টেবিলে রাখা শিকারগুলো দেখছে। দেখো, দেখো সুজান! হাতে তালি দিয়ে বলল ম্যাগলোয়া, দেখো থিবল্ট কী করেছে! ও এমন একজন লোক যে জানে কীভাবে কথা রাখতে হয়। সেদিন কথা দিয়েছিল আমাদের শিকারের মাংস খাওয়াবে। আজ গাড়ি ভর্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওর সাথে হাত মেলাও, ধন্যবাদ জানাও ওকে।
স্বামীর কথা অনুযায়ী হাত মেলাল মাদাম। চুমু খাবার জন্য গাল এগিয়ে দিল। টেবিলের শিকারগুলোর দিকে তাকাল সে।
কোনটা দিয়ে কী রান্না হবে সে নির্দেশনা দিল ম্যাগলোয়া। স্বামীর এই উচ্ছ্বাসের তুলনায় স্ত্রীকে কিছুটা ম্লান মনে হলো। তবে মাদাম জানাতে ভুলল না-থিবল্টকে শুধু খেয়েই না, থেকেও যেতে হবে। এই আমন্ত্রণে থিবল্টের খুশি সহজেই অনুমেয়। যতক্ষণে মাদমোয়াজেল পেরিন উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করছে, ততক্ষণ থিবল্ট একসাথে গলা ভেজানোর প্রস্তাব রাখল।
থিবল্ট রাধুনীর নামও মনে রেখেছে দেখে মাদাম ম্যাগলোয়া একটু অবাকই হলো। সেলার থেকে ফ্রান্সে কম পরিচিত ডাচ ভারমুথ আনা হলো গলা ভেজানোর জন্য।
তৈরি হবার জন্য নিজের ঘরে ফিরে গেল সুজান। ফেরার পর তার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে কষ্ট হলো থিবল্টের। চোরা দৃষ্টি হানছে ও সুজানের দিকে, শুধু তাই নয়, দুঃসাহস দেখিয়ে টেবিলে তলা দিয়ে হাঁটুর গুতো দিচ্ছে মহিলার হাঁটুতে। সুজান এক সময় চোখ তুলে থিবল্টের দিকে তাকাল। তারপর হঠাই ফেটে পড়ল হাসিতে। বেইলিফও একটু চমকে উঠল। থিবল্টের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল হঠাৎ কী ঘটল। তারপর চেঁচিয়ে উঠে বলল, বন্ধু! আগুন লেগে গেছে তো!
দাঁড়িয়ে পড়ল থিবল্ট, কোথায়? কীভাবে? তোমার চুলে। বলেই জরুরি ভঙ্গিতে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে গেল সে। হাত তুলে নিষেধ করে বসে পড়ল থিবল্ট। বুঝে ফেলেছে কী ঘটেছে। গত দুদিনের দৌড়াদৌড়িতে ভুলেই গিয়েছিল আজ চুল ঢেকে আসার কথা। তাছাড়া বিগত দিনগুলোতে ছোটখাটো অনেক ইচ্ছাও পূরণ করেছে। তাতে লাল চুলের সংখ্যা আরও বেড়েছে ওর। অস্বস্তি ঢাকার চেষ্টা করল থিবল্ট। আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন!
কিন্তু, কিন্তু… এখনও কিছুটা ভয় মেশানো দৃষ্টিতে চুলের দিকে তাকিয়ে আছে বেইলিফ।
এটা কিছু না। চুলের এই রং দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একবার গরম কয়লা ভর্তি একটা পাত্রের কারণে মায়ের চুলে প্রায় আগুন লেগে গিয়েছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল মা। আমার জন্মের আগের কথা। সে কারণেই রংটা এমন হয়েছে।
হাসি থামাবার জন্য পানি খেল মাদাম সুজান। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আজই প্রথম এটা চোখে পড়ল।
তাই? বলার মতো কোন উত্তর খুঁজে পেল না থিবল্ট।
আগেরদিন আমি আপনাকে ভালমতোই লক্ষ করেছি। সেদিন কিন্তু আপনার চুল কালোই ছিল।
এই কথায় থিবল্টের আশার পালে হাওয়া লাগল।
আহ! মাদাম! আপনি নিশ্চয়ই এই প্রবাদগুলো শুনেছেন-রক্তিম চুল, উষ্ণ হৃদয়, আর এটা, কিছু মানুষ বাজে জুতোর মতো-বাইরে সুন্দর, ভেতরে ক্ষত।
জুতোর উদ্ধৃতি শুনে মুখ কোঁচকাল মাদাম সুজান। কিন্তু তার স্বামী, স্ত্রীর সাথে একমত হতে পারল না।
থিবল্ট একেবারে খাঁটি কথা বলেছে।
এরপর থিবল্টের চুল নিয়ে আর কোন কথা হলো না। তবে মাদাম সুজানের চোখ বারবার ওর চুলের দিকে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা থিবকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। হাত দিয়ে চুল ঠিক করার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু চুলগুলো তো আর মানুষের চুল নেই। ঘোড়ার চুলের মতো খাড়া হয়ে গেছে। কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছে না। তবে আশার কথা, হাঁটুর ব্যাপারে মাদাম সুজান কোন অভিযোগ করেনি। এতে করে থিবল্টের ধারণা হলো, কিছুটা অগ্রসর হওয়া গেছে।
অনেক রাত পর্যন্ত ওরা বসে ছিল। এর মাঝে বেশ কয়েকবার সুজান অন্য ঘরগুলোয় ঘুরে এসেছে। সেই ফাঁকে ম্যাগলোয়াও সেলারে ঢু মেরে এসেছে।
গোপনে আনা অনেক বোতল জমে গেল বেইলিফের ওভারকোটের ভেতরে, পুরাদস্তুর নেশার ঘোরে ডুবে আছে সে। মাদাম সুজানকে প্রেম নিবেদনের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। থিবল্ট রাতের মতো ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করল। সে রাতের পানাহার পর্বের ওখানেই যবনিকা পড়ল। পেরিন থিবকে নিয়ে গেল তার ঘরে। ওকে জিজ্ঞেস করে থিবল্ট জেনে নিল কার ঘর কোনটা।
মাদাম সুজান তার স্বামীকে ঘরে যেতে সাহায্য করছে। এদিকে পা টিপে টিপে নিজের ঘর থেকে বেরোল থিবল্ট। মাদাম সুজানের ঘরের দরজার কাছে এসে কান পাতল। ভেতরে কোন শব্দ শোনা গেল না। চাবিটা দরজার তালার সাথেই লাগানো। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে তারপর চাবি ঘোরাল ও।
ঘরটা অন্ধকার। তবে সেটা কোন সমস্যা না-নেকড়েদের সাথে থেকে থেকে থিবল্ট এখন অন্ধকারেও দেখতে পায়। ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোথায় কী আছে দেখে নিল ও। তারপর সবচেয়ে দূরের জানালার পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। ওর হৃদপিণ্ড ধুকধুক করছে। সুজান ঘরে ঢুকল। দরজার আওয়াজটা ক্রয়োলের সেই মিলের চাকার অশুভ আওয়াজের কথা মনে করিয়ে দিল থিবল্টকে। ওর প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল-মাদাম সুজান ঘরে ঢোকা মাত্র বেরিয়ে আসা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তাতে সুজান চমকে গিয়ে চিৎকার করে উঠলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে। তারচেয়ে সুজান ঘুমিয়ে পড়লে নাহয় বেরোনো যাবে।
ও সুজানকে ভালবেসে ফেলেছে-এই কথাটা নিজেকে বোঝাতে গিয়ে সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে ফেলেছে থিবল্ট। কালো নেকড়ের ছত্রছায়ায় থাকলেও, নতুন প্রেমিকের মতোই নার্ভাস বোধ করছে ও। সুজান আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর শুরু করল সাজতে। মনে হচ্ছে কোন একটা ভোজ বা উৎসবে যাবে। খুব যত্নের সাথে কাপড় বাছাই করছে সে, গলায়-হাতে গহনা পরছে, চুল ঠিক করছে।
এসবের মানে খুঁজে পেল না থিবল্ট। জানালায় শব্দ হতে চমকে উঠল ও। সুজানও আলো নিভিয়ে জানালায় উঁকি দিল। ফিসফিস করে কথা শোনা গেল কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। পর্দা একটু সরাতে দেখতে পেল কেউ একজন জানালা বেয়ে উঠে আসছে।
আগের রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল থিবল্টের। এই জানালা থেকেই সম্ভবত ওর দুকাধকে মই বানিয়ে নেমেছিল লোকটা। তাই যদি হয়ে থাকে, তারমানে সে মাদাম ম্যাগলোয়ার পরিচিত। এখন যে উঠছে, সম্ভবত সেই একই লোক।
সুজান হাত বাড়িয়ে আগন্তুককে উঠতে সাহায্য করল। বিশালদেহী একটা লোক আসবাবপত্র কাঁপিয়ে লাফ দিয়ে এসে ঢুকল ঘরর ভেতর।
সাবধানে, মাই লর্ড, সুজানের গলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। আমার স্বামী ঘুমাচ্ছে। এত শব্দ হলে জেগে যাবে ও।
কিন্তু সুন্দরী, আমি তো আর পাখির মতো হালকা নই। কণ্ঠ শুনে থিবল্ট বুঝল এ আগের রাতের সেই নোকটাই। অবশ্য নিচে যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল পাখির মতো ডানা থাকলে ভাল হত, উড়ে চলে আসতে পারতাম।
আমারও, মাই লর্ড, আপনাকে শীতের রাতে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে খুবই খারাপ লাগছিল। কিন্তু কী করব, আমাদের অতিথি এই আধঘণ্টা আগে ঘুমোতে গেল।
আর গত আধঘণ্টা কী করেছ?
মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া যেন রাতে আর আমাদের বিরক্ত করতে না আসেন তার ব্যবস্থা করছিলাম।
হৃদয়েশ্বরী, সবদিকে তোমার খেয়াল থাকে।
কী যে বলেন না, মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কথাটা শেষ করতে পারল না। সুজান। শব্দ শুনে কী কারণে তার মুখ বন্ধ হয়েছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না থিবল্টের। আবারও ওকে হতাশ হতে হচ্ছে। কাশির শব্দ শুনে ওর চিন্তায় ছেদ পড়ল।
কাশি থামার পর লোকটা বলল, জানালাটা মনে হয় বন্ধ করা উচিত।
ওহ, মাই লর্ড, আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল। মাদাম উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে ভাল মতো পর্দা টেনে দিল। আগন্তুক এরপর একটা চেয়ার নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ ঠাণ্ডার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। সুজান তার চেয়ারের পেছনে হাত রেখে দাঁড়াল। দেখে বাড়তে লাগল থিবল্টের রাগ। শরীর কিছুটা গরম হওয়ার পর আগম্ভক জিজ্ঞেস করল, তা এই লোকটা, মানে তোমাদের অতিথিটা কে?
মাই লর্ড, আমার তো ধারণা আপনি ওকে খুব ভাল করেই চেনেন।
কীবলতে চাইছ সেই রাতের ওই মাতালটা?
সে-ই।
ওকে যদি হাতে আরেকবার পাই না…
সঙ্গীতের মতো মধুর সুরে সুজান উত্তর দিল, এমন অশুভ চিন্তা মনে ঠাই দেবেন না। পবিত্র ধর্মের উপদেশ অনুসারে শত্রুকে ক্ষমা করতে শেখা উচিত আমাদের।
আরও একটা ধর্ম অবশ্য আছে, তুমি সেই ধর্মের দেবী আর আমি সামান্য এক অনুসারী। ওই বদমাশটার ক্ষতির চিন্তা করা অবশ্য আমার উচিত না। ওর অন্যায়ভাবে করা আঘাতে আমি জ্ঞান হারাই। আমাকে অজ্ঞান দেখে তুমি তোমার স্বামীকে ডেকে তুললে। সে এসে আমাকে তোমার জানালার নিচে আবিষ্কার করে ভেতরে নিয়ে গেল। তুমি দয়াপরবশ হয়ে আমাকে থাকতে দিতে রাজি হলে। সেভাবে চিন্তা করলে ওর কারণেই তোমার বাড়িতে প্রবেশের আমার এতদিনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তারপরও, ব্যাটাকে যদি আমার চাবুকের নাগালে পাই, সেটা ওর জন্য মোটেই সুখকর হবে না।
দেখা যাচ্ছে আমার ইচ্ছা আবারও একজনের সুবিধা করে দিয়েছে। নেকড়ে সাহেব, আমার এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আমি এমনভাবে ভেবেচিন্তে চাইব, যাতে ছাত্রই তখন শিক্ষক হয়ে উঠবে। থিবল্ট মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু কণ্ঠটা কার, খুব চেনা চেনা লাগছে?
একটা কথা বলতে পারি, যেটা শুনলে বেচারার উপর আপনার রাগ আরও বেড়ে যাবে!
কী সেই কথা?
আপনার ভাষায় সেই অকর্মার টেকি, আমার সাথে প্রেম করতে চাইছে।
ফুঃ!
সুজান হাসতে হাসতে বলল, সত্যি কথা।
কী! কোথায়, ওই বজ্জাতটা কোথায়? বিলজেবাবের দিব্যি! ওকে আমার কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেব! বলতে বলতে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেল লোকটা।
এবং এই কথা শোনার সাথে সাথেই লোকটাকে চিনে ফেলল থিবল্ট। আহ, লর্ড ব্যারন, আপনিই তাহলে এসেছেন?
ওকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই, মাই লর্ড। প্রেমিকের কাঁধে হাত রেখে আবার বসিয়ে দিল সুজান। আপনিই একমাত্র মানুষ যাকে আমি ভালবাসি। আর তা যদি নাও হত, অমন কপালের মাঝে লাল চুলওয়ালা লোককে ভালবাসতে আমার বয়েই গেছে! ডিনারের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার হাসতে শুরু করল সে।
বেইলিফের স্ত্রীর প্রতি একটা ভয়ঙ্কর রাগ জমে উঠল থিবল্টের মনে।
বিশ্বাসঘাতিনী! এই মুহূর্তে এই ঘরে তোর ভাল, সৎ, দয়ালু স্বামীর প্রবেশের বিনিময়ে বিসর্জন দিতে রাজি নই-এমন কিছু নেই আমার।
থিবল্ট ইচ্ছাটা পোষণ করার সাথে সাথেই খুলে গেল ঘরের দরজা। হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া। মাথার লম্বা টুপিটার কারণে তাকে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা মনে হচ্ছে।
আহহা! চমৎকার! মাদাম ম্যাগলোয়া, এবার হাসার পালা আমার, নিচু স্বরে বলল থিবল্ট।
ত্রয়োদশ অধ্যায় – মুখরা অপেক্ষা জিভ সংবরণ করে চলা নারীর ভাষ্য যে অনেক বেশি পরিষ্কার, তার একটা উদাহরণ
সুজান ব্যারনকে ফিসফিস করে কী বলেছে খেয়াল করতে পারেনি থিবল্ট। শুধু দেখল টলে উঠে অজ্ঞানের মতো করে ব্যারনের উপর পড়ে গেছে মাদাম।
ম্যাগলোয়া মোম হাতে বিস্মিতভাবে দৃশ্যটা দেখল। ব্যারনও বেইলিফের মধ্যে বিস্ময় ছাড়া আর কিছু দেখতে না পেয়ে স্বাভাবিক সুরে প্রশ্ন করল, আরে, ম্যাগলোয়া, কী অবস্থা আপনার?
আপনি নাকি, মাই লর্ড? বেইলি চোখ বড় বড় করে পাল্টা প্রশ্ন করল।
আপনাকে এখানে দেখতে পাব জানলে এই পোশাকে আসতাম না।
আরে ছাড়ুন!
না, না, মাই লর্ড। অনুমতি দিন জামাটা পাল্টে আসি।
ব্যস্ত হওয়ার কোন দরকার নেই। মাঝরাতে বন্ধুর সাথে যে কোন পোশাকেই দেখা করা যায়। তাছাড়া এখন আরও জরুরি বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।
কী বিষয়ে, মাই লর্ড?
মাদাম ম্যাগলোয়া অজ্ঞান হয়ে গেছেন। ওনার জ্ঞান ফেরানো দরকার।
সুজান অজ্ঞান হয়ে গেছে। ঈশ্বর। মোমটা চিমনির উপর নামিয়ে রাখল বেইলিফ। কীভাবে হলো?
দাঁড়ান, দাঁড়ান, মঁসিয়ে ম্যাগলোয়া। আগে মাদামকে একটু ভাল ভাবে আরামকেদারায় বসিয়ে দিই।
ঠিক বলেছেন। সুজানকে আগে ভালভাবে শুইয়ে দিই। বেচারি সুজান। কিন্তু এমনটা হলো কীভাবে?
এত রাতে আমাকে আপনার বাড়িতে আবিষ্কার করে দয়া করে খারাপ কিছু ভাববেন না।
প্রশ্নই আসে না, মাই লর্ড। আপনার বন্ধুত্ব পেয়ে আমরা গর্বিত। আর মাদাম ম্যাগলোয়ার বিশ্বস্ততার ওপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা আছে। যে কোন সময় আপনার উপস্থিতি আমাদের বাড়িকে সম্মানিতই করবে।
বিড়বিড় করল থিবল্ট, লোকটা কি আসলে উজবুক, না চালাক…হবে কিছু একটা! দেখা যাক ব্যারন কীভাবে বেরোয় এই পরিস্থিতি থেকে।
একটা ভেজা কাপড় দিয়ে স্ত্রীর কপাল মুছতে মুছতে প্রশ্ন করল ম্যাগলোয়া, যা-ই হোক। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, কীভাবে আমার স্ত্রীর এই অবস্থা হলো?
বলছি। এক বন্ধুর সাথে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা জানালায় এক মহিলা ইশারায় সাহায্যের আবেদন করছেন।
ঈশ্বর!
তারপর আমার মনে পড়ল যে এটা আপনার বাড়ি। এমন কী হতে পারে যে মাদাম ম্যাগলোয়া কোন বিপদে পড়েছেন?
আপনি ভাল মানুষ, মাই লর্ড। আশা করি সত্যি সত্যি তেমন কোন বিপদ হয়নি।
ঠিক তার উল্টো।
উল্টো? কী বলছেন?
শুনুন।
মাই লর্ড, আমাকে আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন। আপনি বলতে চাইছেন, সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, অথচ আমার স্ত্রী আমাকে ডাকেনি?
প্রথমে আপনাকেই ডাকবেন ভেবেছিলেন। পরে চিন্তা করলেন, এখানে আসলে আপনিও বিপদে পড়তে পারেন। এমনকি আপনার জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে!
ফ্যাকাসে হয়ে গেল বেইলিফ, আমার জীবন, আপনার ভাষ্যমতে বিপন্ন?
এখন যেহেতু আমি আছি তাই আর বিপদ নেই।
দয়া করে বলুন, মাই লর্ড। স্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করতাম, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, সে জবাব দেয়ার মতো অবস্থায় নেই।
উনার বদলে উত্তর দেয়ার জন্য আমিও কি নেই?
বলুন, মাই লর্ড, বলুন, আমি শুনছি।
ব্যারনও মাথা নেড়ে আবার বলতে শুরু করল, আমি দৌড়ে তার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মাদাম ম্যাগলোয়া, কী হয়েছে, আপনি এমন করছেন কেন? উনি উত্তর দিলেন, মাই লর্ড, গতকাল এবং আজ, পর পর দুদিন এক লোকের আতিথেয়তা করছেন আমার স্বামী। লোকটা সন্দেহজনক। আমার ম্যাগলোয়ার বন্ধু সেজে আছে। কিন্তু সে আমার সাথে প্রেম করার চেষ্টা করছে…
ও আপনাকে বলেছে এই কথা?
হুবহু এই কথাই বলেছেন। আমরা কী বলছি সেটা আশা করি উনি শুনতে পাচ্ছেন না।
কীভাবে শুনবে? অজ্ঞান হয়ে আছে তো।
ঠিক আছে। জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞেস করবেন নাহয়। যদি আমার কথা না মেলে, আমাকে আপনি যা খুশি বলতে পারেন।
এসব লোক খুবই ভয়ঙ্কর দেখছি!
সাপের মতো। আরও শুনতে চান?
অবশ্যই!
আমি মাদামকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন সে আপনার সাথে প্রেম করার চেষ্টা করছে?
হ্যাঁ, বেইলিফ বলল। কীভাবে বুঝল? আমি নিজেই তো কিছু টের পাইনি।
টেবিলের নিচে তাকালেই বুঝতে পারতেন। টেবিলের ওপর আর নিচ, দুজায়গায় তো একসাথে তাকানো সম্ভব না।
সত্যি কথা বলতে কি, মাই লর্ড, আমরা চমৎকার সাপার করেছি। খালি একবার চিন্তা করুন, কচি বুনো-শুয়োরের কাটলেট…
আমার গল্পের সাথে আপনার স্ত্রীর জীবন এবং সম্মান জড়িত! সেই গল্প শোনার বদলে আপনি কী এখন আমাকে সাপারের গল্প শোনাবেন?
সত্যিই তো, বেচারি সুজান। ওর হাতটা বের করতে সাহায্য করবেন? তালুটা ঘষে দিতাম। স্ত্রীর হাত ঘষতে ঘষতে গল্পের বাকিটা শুনতে চাইল ম্যাগলোয়া।
কোথায় থেমেছিলাম?
বলছিলেন, বেচারি সুজান, যাকে সতী-সাধ্বী সুজানও বলা চলে…
তা তো বলতেই পারেন!
অবশ্যই বলি! বেচারি সুজান বুঝতে পেরেছিল…
ওহ হ্যাঁ, আপনার অতিথি, প্যারিসের মতো আপনাকে মেনেলাউস১০ বানাবার চেষ্টা করছিল। মনে আছে, কখন আপনার স্ত্রী টেবিল ছেড়ে উঠে যান?
ঠিক মনে নেই… তখন আমি কিছুটা…
ঠিক আছে। তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে বলেন যে বিছানায় যাওয়ার সময় হয়েছে।
আমি সর্বশেষ এগারোটার ঘণ্টা বাজতে শুনেছি।
তখনই আড্ডাটা ভাঙে।
আমি বোধহয় টেবিল ছাড়িনি তখনও।
না, মাদাম আর আপনার অতিথি ছেড়েছিলেন। মাদাম সুজান পেরিনকে বলেন অতিথিকে ঘরে নিয়ে যেতে। তারপর বিশ্বস্ত স্ত্রীর মতো আপনাকে বিছানায় শুইয়ে নিজের ঘরে চলে আসেন।
আবেগ ভর করল বেইলিফের কণ্ঠে, আমার লক্ষ্মী সুজান!
ঘরে একা হঠাৎই ভয় পেয়ে যান মাদাম সুজান। জানালাটা খুলে দেন। তিনি। বাতাস এসে মোমটা নিভিয়ে দেয়। হঠাৎ একটা আতঙ্ক পেয়ে বসলে কেমন লাগে, নিশ্চয়ই জানেন আপনি?
হ্যাঁ, আমি নিজেও একটু ভীতু।
উনাকেও হঠাৎ আতঙ্ক পেয়ে বসে। আপনাকে ডাকার সাহস পেলেন না। প্রথম যে ঘোড়সওয়ারকে দেখলেন, ভাগ্যক্রমে সেটা আমি ছিলাম। সাহায্যের জন্য ডেকে বসলেন।
আসলেই সৌভাগ্য, মাই লর্ড।
তাই না? আমি দৌড়ে এসে আমার পরিচয় দিলাম। উনি বললেন, উপরে আসুন, মাই লর্ড, উপরে আসুন! তাড়াতাড়ি, আমি নিশ্চিত আমার ঘরে কেউ ঢুকেছে।
আপনিও নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।
একদম না! সদর দরজার ঘন্টা বাজিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে সময়ের অপচয় হবে ভেবে লেভিলিকে আমার ঘোড়াটা রাখতে দিলাম। ভেতরের লোকটা যাতে পালাতে না পারে, সেজন্য বারান্দা দিয়ে উঠে ভিতরে ঢুকে জানালা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দে আর সহ্য করতে না পেরে মাদাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
মাই লর্ড! কী ভয়ঙ্কর সব কথা আপনি আমাকে বললেন।
আমি কোন কিছুই বানিয়ে বলিনি। মাদাম উঠলে আপনি উনাকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন।
দেখুন, মাই লর্ড, ও একটু একটু নড়ছে। খুশির স্বরে বলে উঠল বেইলিফ।
তাই তো দেখছি! একটা পালক পুড়িয়ে নাকের নিচে ধরুন।
পালক?
হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে খুব কাজের। নাকের নিচে ধরুন, সাথে সাথে জ্ঞান ফিরবে।
এখন পালক কোথায় পাব?
আমার হ্যাট থেকে নিন। হ্যাট থেকে একটা উটপাখির পালক ভেঙে ম্যাগলোয়াকে দিল ব্যারন। সেটা পুড়িয়ে ধোঁয়া মাদামের নাকের নিচে ধরল বেইলিফ। সাথে সাথে ফল পাওয়া গেল। হচি দিয়ে উঠল সুজান।
বেইলিফের খুশি আর দেখে কে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ফিরছে। আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরছে!
মাদাম ম্যাগলোয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মাই লর্ড! মাই লর্ড! ও বেঁচে গেছে! বেঁচে গেছে! চেঁচিয়ে বলল বেইলিফ।
মাদাম ম্যাগলোয়া চোখ খুলে প্রথমে বেইলিফের দিকে তাকাল। ব্যারনের দিকে ফিরতে বড় হয়ে গেল তার চোখ। তারপর আবার বেইলিফের দিকে তাকাল সে।
ম্যাগলোয়া, সত্যিই তুমি তো? ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর তোমাকে দেখে কী যে ভাল লাগছে!
থিবল্ট বিড়বিড় করল, অসতী রমণী! যাক গে যেসব মহিলাদের পেছনে ছুটেছি, না পেলেও অন্তত তাদের মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তা খুঁজে পেয়েছিলাম!
আমার মিষ্টি, সুজান! ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না, যা দেখেছ সবই ছিল সত্যি।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তারপর এমনভাবে ব্যারনের দিকে তাকাল যেন তাকে প্রথমবারের মতো দেখছে! বলল, মাই লর্ড, আপনার কাছে অনেক বাকোয়াজ করেছি। আশা করি আমার স্বামীকে সেসব কিছু বলেননি।
কেন বলব না, বলতে পারেন?
একজন সতী নারীর জানা উচিত, নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয়। সেজন্য তার স্বামীকে এতসব কিছু বলে বিব্রত করারও কোন মানে হয় না।
আমি আমার বন্ধুকে সবই জানিয়েছি।
আপনি কি এ-ও বলেছেন, যে সাপারের পুরোটা সময় ওই লোকটা থেকে থেকে আমার হাঁটু স্পর্শ করছিল?
অবশ্যই বলেছি।
ইতর! বেইলিফ বকে উঠল।
তারপর ন্যাপকিন তুলতে গিয়ে টেবিলের নিচে তার হাত পেয়েছিলাম?
আমার বন্ধুর কাছ থেকে আমি কিছুই লুকোইনি।
বদমাশ! চেঁচিয়ে উঠল বেইলিফ।
ঘোরগ্রস্ত ম্যাগলোয়ার চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছিল সে, এটাও বলেছেন?
আমার মতে একজন স্বামীর সব সত্য জানা উচিত।
চরিত্রহীন! আবারও চেঁচিয়ে উঠল বেইলিফ।
আপনি কী এটাও বলেছেন, ঘরে আসার পর বাতাসে মোম নিভে গেল। তখন পর্দা নড়ে ওঠায় আমি ভেবেছিলাম লোকটা আমার ঘরে ঢুকেছে। তাই সাহায্যের জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম?
না, বলতে যাচ্ছিলাম। তখনই আপনি হচিটা দিলেন।
শয়তান! গর্জে উঠে টেবিলের ওপর রাখা ব্যারনের তলোয়ারটা নিয়ে স্ত্রীর নির্দেশ করা জানালার দিকে ছুটল বেইলিফ। ও যদি পর্দার আড়ালে থাকে, আমি ওকে দুটুকরো করে ফেলব। বলে বার কয়েক তলোয়ার চালাল সে।
তলোয়ারের আঘাতে পর্দা সরে যেতে থিবন্টের ওপর চোখ পড়ল বেইলিফের। সে আশা করেনি পর্দার আড়ালে কেউ থাকবে। একটু আগে হম্বিতম্বি করলেও ওকে দেখে পিলে চমকে গেল বেইলিফের। হাত থেকে শব্দ করে পড়ে গেল তলোয়ারটা। ঘরের বাকি দুজনও চমকে উঠল থিবন্টকে দেখে। তাদের বলা গল্পটা সত্যের এত কাছে ছিল ওরা ধারণা করেনি। ব্যারনও চিনতে পারল থিবল্টকে।
ওর কাছে গিয়ে ব্যারন বলল, নিকুচি করি। আমার ভুল না হলে এ সেই শুয়োর-মারা বর্শাওয়ালা লোকটা।
শুয়োর-মারা বর্শাওয়ালা লোক? বেইলিফের দাঁতের সাথে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে। এখন অবশ্য মনে হয় না ওর কাছে কোন বর্শা আছে। বলে দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীর পেছনে লুকিয়ে পড়ল খর্বাকায় ভীতু লোকটা।
ভয় পাবেন না। বর্শা নিয়ে আসলেও কথা দিচ্ছি ওর হাতে বেশিক্ষণ থাকত না ওটা। তো, জনাব চোরাশিকারি, থিবল্টকে উদ্দেশ্য করে বলল ব্যারন, ডিউকের এলাকায় শিকার করেই ক্ষান্ত হওনি, এখন ম্যাগলোয়ার এলাকায়ও হানা দিয়েছ?
চোরাশিকারি? উনি ভূ-স্বামী আর অনেক খামারের মালিক নন? শত শত একর জমি থেকে উনার আয় হয় না?
কী? আপনাকে এই সব আজগুবি গল্প শুনিয়েছে ও? মুখ আছে বলতে হবে ওর। ভূ-স্বামী! হুহ! খাবার জোটে না। সামান্য একজন স্যাবট-কারিগর ও। আমার লোকেরা যেসব কাঠের জুতো পরে, ওগুলোই ওর সম্পত্তি। ওগুলোই বানায় ও!
ঘৃণায় মুখ কুঁচকে ফেলল মাদাম ম্যাগলোয়া। বেইলিফের মুখও লাল হয়ে গেল। ক্ষুদে ভালমানুষটা দাম্ভিক বা উদ্ধত হয়তো নয়, কিন্তু প্রতারণা সে পছন্দ করে না। একজন জুতোর কারিগরের সাথে ওয়াইন পান করতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু একজন মিথ্যাবাদী এবং বিশ্বাসঘাতকের সাথে আছে।
এতসব অপমানের মুখেও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে থিবল্ট। ওর কথা বলার পালা এসেছে এবার। ও এখন প্রতিশোধ নিতে পারবে। ওর চেয়ে উঁচু অবস্থানের লোকের সাথে কথা বলায় এখন অভ্যস্ত সে। বলতে শুরু করল ও, শয়তান আর তার শিং-এর দিব্যি, মাই লর্ড, আমি যদি আপনার মতো অন্যকে নিয়ে গল্প বানাতে পারতাম, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এখন কী বলতে হবে, সে নিয়ে আমাকে কোন চিন্তাই করতে হত না।
এই কথার ভেতরের আক্রমণটুকু ভেযের লর্ড আর বেইলিফের স্ত্রী দুজনেই টের পেল। জ্বলন্ত চোখে থিবল্টের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাদাম বলল, ও নিশ্চয়ই এখন আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মুখরোচক কোন গল্প বলবে।
আত্মসংযমের সাথে থিবল্ট বলল, ভয়ের কোন কারণ নেই, মাদাম, আমাকে বানিয়ে কিছুই বলতে হবে না।
বদমাশ! দেখেছ, আমি ঠিকই বলেছি। আমার নামে ও আজেবাজে কথা বলবে। আমি ওর আহ্বানে সাড়া দেইনি, তার শোধ নেবে।
এই ফাঁকে ব্যারন তলোয়ার নিয়ে এগোচ্ছিল। মাঝপথে বেইলিফ বাধা দিল। তাতে থিবল্টের ভালই হলো। নয়তো শেষ মুহূর্তে ওকে আরও একটা ইচ্ছা খরচ করতে হত।
মাই লর্ড, শান্ত হোন। আপনার ক্রোধের যোগ্য নয় ও। আমি খুবই সাধারণ একজন নাগরিক। ওর বক্তব্যের উপর আমার আর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই আর আমার আতিথেয়তার যে অন্যায় সুযোগ ও নিয়েছে, সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি আমি।
পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার জন্য এবারে কাঁদতে শুরু করল মাদাম।
কেঁদো না, সুজান, সদয় কণ্ঠে বলল বেইলিফ। তোমার নামে কী অভিযোগ সে আনবে? আমাকে ধোকা দেয়ার? আমাকে যে সুখ তুমি দিয়েছ, তারজন্য তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই আমি শেষ করতে পারব না। ওর কথায় তোমার প্রতি আমার ভালবাসার কোন পরিবর্তন ঘটবে না। আমি আমার বন্ধুদের জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু তোমার জন্য হৃদয়ের দরজা কখনও বন্ধ করব না। মানুষ খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। নিজের ক্ষুদ্রতা স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করাটাই ভাল। খারাপ মানুষদের নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস ওদের সংখ্যাও অনেক কম। দুর্ভাগ্য যদি কখনও দরজা বা জানালা দিয়ে ঢেকেও, উফুল্ল গান-বাজনা আর গ্লাসের ঠোকাঠুকির শব্দে পালাবার পথ পাবে না সে।
বিষণ্ণ দর্শন মিশ্রিত বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই সুজান বেইলিফের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল, ওর হাতে চুমু খেতে লাগল। বিদগ্ধ পাদ্রীর গভীর ধর্মবোধ সম্পন্ন বক্তব্যও মাদামের ওপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারত কি না সন্দেহ। ভেযের লর্ডের চোখের কোণেও জল জমল। সেটা মুছে হাত বাড়িয়ে দিল ব্যারন, বন্ধু, আপনি আসলেই সৎ এবং দয়ালু একজন মানুষ। আপনাকে কোন কষ্ট দেয়াটাও পাপ। অতীতে আমি যদি কখনও আপনার সাথে কোন অন্যায় করার চিন্তাও করে থাকি, ঈশ্বর যেন আমাকে ক্ষমা করেন। তবে এটুকু বলতে পারি, যা-ই ঘটুক, ভবিষ্যতে কখনও এমন চিন্তা আমার মনেও আসবে না।
বিবল্ট বুঝতে পারছে না-ওর মনে অন্ধকারের রাজত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ক্রমেই ও স্বার্থপর, খারাপ একটা মানুষে পরিণত হচ্ছে। ওর রাগ বাড়তে লাগল। চিৎকার করে বলল, বুঝতে পারছি না, কেন আমি এই নাটকটা বন্ধ করছি না!
বিপদ বুঝতে ব্যারন আর সুজানের দেরি হলো না। ব্যারন আরও একবার তলোয়ার বাগিয়ে এগোতে গিয়ে বেইলিফের বাধার সম্মুখীন হলো।
মাই লর্ড ব্যারন, এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আপনি মনে মনে আমাকে খুন করলেন। চিন্তার দিক দিয়ে আপনি একজন খুনি। সাবধান! পাপ জমাবার অনেক রাস্তা কিন্তু আছে।
শয়তানের দিব্যি! বজ্জাতটা আমাকে নীতিশিক্ষা দিচ্ছে। আপনি একটু আগেও ওকে দ্বি-খণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন। এখন আমাকে একবার অন্তত মারতে দিন।
আপনার অনুগত হিসেবে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, মাই লর্ড। ওকে নিরাপদে যেতে দিন। ও আমার অতিথি, আমার এই গরীবখানায় যেন ওর কোন ক্ষতি না হয়।
তবে তাই হোক। কিন্তু ওর সাথে আমার আবার দেখা হবে। ওর নামে অনেক কথা কানে আসছে। শুধু শুধু চোরাশিকারই ওর একমাত্র অপরাধ নয়, একদল বাধ্যগত নেকড়ের সাথে ঘুরতেও নাকি দেখা গেছে ওকে। আমার ধারণা মাঝরাতে ও জাদুটোনা করে বেড়ায়। ক্রয়োলের মিল মালকিন এরইমধ্যে ওর জাদুটোনার ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। ওর ঘর খুঁজে সন্দেহজনক কিছু পেলে জ্বালিয়ে দেয়া হবে। এই এলাকায় জাদুকরের কোন জায়গা নেই। এখন এখান থেকে ভাগ, জলদি!
অন্ধকারেও দেখতে পায় তাই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে কোন সমস্যা হলো না থিবল্টের। বাড়ি কাঁপিয়ে ওর পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। অহেতুক ইচ্ছা খরচ করে লাল চুলের সংখ্যা বাড়ানোর কোন মানে হয় না, তাই পুরো বাড়িটা জালিয়ে দেয়ার ঝোঁকটা কোনমতে দমন করল বিল্ট। বৃষ্টি শুরু হলো। যদিও বরফ শীতল, তবু ভালই লাগল ওর-মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল।
বেইলিফের বাড়ি পেছনে ফেলে এগোতে লাগল থিবল্ট। একা থাকা দরকার। কখন যেন ক্রয়োলের মিলের কাছে চলে এল। বাড়িটা চোখে পড়তে মিলের মালকিনকে একটা অভিশাপ দিয়ে বনে ঢুকে পড়ল ও।
চতুর্দশ অধ্যায় – বিয়ের অনুষ্ঠান
কিছুদূর যাওয়ার পরই নেকড়েরা ঘিরে ধরল। খুশি হয়ে ওদের কাছে ডেকে আদর করে দিল থিবল্ট। ওরাই হচ্ছে ওর খাস শুভাকাঙ্ক্ষী, ওর আগুনচোখা শিকারি দল। মাথার ওপর রাত-পেঁচার দল ডালে ডালে ডেকে চলেছে। ওদের চোখগুলোও জ্বলন্ত কয়লার মতো। আর এই অশুভচক্রের ঠিক মাঝেই অবস্থান থিবল্টের।
নেকড়েদের মতো পেঁচারাও ওর কাছে উড়ে আসতে লাগল। ওর মাথা ছুঁয়ে কাঁধে বসতে লাগল।
মানুষ আমাকে ঘৃণা করলে কী হবে, পশুপাখি ঠিকই আমাকে ভালবাসে।
সৃষ্টির মধ্যে এই প্রাণীগুলোর অবস্থান কোথায়-সেটা ওর মাথায় নেই। ও ভুলে গেছে-যে প্রাণীগুলো ওকে ভালবাসে, তারা মনুষ্যত্বকে ঘৃণা করে।
প্রাণীজগতের মধ্যে এরা হচ্ছে অন্ধকারের জীব। মানুষের মধ্যে থিবল্টও অন্ধকারের জীবে পরিণত হচ্ছে। তাই ওরা থিবকে ভালবাসছে। এসব প্রাণীর সান্নিধ্যে থেকে ক্ষতি ছাড়া ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। ক্ষতি করার কী ভীষণ ক্ষমতা ওর আছে ভেবে হাসল থিবল্ট।
বাড়ি এখনও অনেক দূর। ক্লান্ত লাগছে থিবল্টের। কাছেই একটা কয়েকশো বছরের প্রাচীন ওক গাছ আছে। সেখানে রাতটা কাটানো যেতে পারে। নেকড়েগুলো ওর মন বুঝে পথ না দেখালে পৌঁছতে পারত কি না সন্দেহ। যে গাছ মানুষের আয়ুর চেয়ে দশ, বিশ বা এমনকি তিরিশ গুণ লম্বা সময় ধরে টিকে থাকে, তাদের বয়স দিন-রাতে না…ঋতুতে হিসাব করা উচিত। শরৎ হবে গোধূলি, শীত হলো রাত, বসন্ত ভোর আর গ্রীষ্ম হচ্ছে দিন। চল্লিশ জন মানুষ মিলেও হয়তো প্রাচীন ওক গাছটার বেড় পাবে না।
গাছের গুঁড়ির গর্তটা অনেকটা আরামকেদারার মতো। থিবল্ট সঙ্গী-সাথীদের শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নেকড়েরা গাছের চারপাশে আর পেঁচারা ডালে জায়গা করে নিল।
সকালে ঘুম ভাঙল থিবল্টের। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগে। ওর সঙ্গী সাথীরাও যার যার ডেরায় চলে গেছে।
দূর থেকে বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। ক্রমেই কাছে চলে আসছে সেই শব্দ। বাজনা শুনে একটা পাখি ডেকে উঠল। মানুষের সুরের জবাবে সৃষ্টিকর্তার সুর। এই শীতে বসন্তের মতো উত্সবের মানে কী?
পাখির ডাক এই উজ্জ্বল, সুন্দর সকালকে স্বাগত জানাচ্ছে। ফুল ওকে দেখতে আসার জন্য সূর্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তা-ও নিজে উজ্জ্বলতা দিয়ে। প্রকৃতির সাথে মিলে আনন্দ করছে মানুষ। ওদিকে থিবল্টের রাগ আর তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। ওর মনের মতো সব যদি অন্ধকার আর বিষণ্ণ হত, তাহলে হয়তো ভাল লাগত থিবল্টের। চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু কী একটা শক্তি যেন ওকে আটকে রাখল। গাছের গর্তে লুকিয়ে থাকল ও। আনন্দিত হৈ-চৈ শোনা যেতে লাগল আশপাশ থেকে। কেউ বাজি ফোঁটাল বা বন্দুক ছুঁড়ল। নিশ্চয়ই কোন বিয়ের অনুষ্ঠান। একদল সুসজ্জিত নারী-পুরুষ যাচ্ছে। এর মাঝে লর্ড ভেযের লোকদেরও দেখতে পেল থিবল্ট। এনগুভা, লর্ড ভেযের দ্বিতীয় শিকারি, এক অন্ধ বৃদ্ধাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। থিবল্ট বিস্মিত চোখে কনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজেকে বোঝাতে চাইল ভুল দেখেছে। কিন্তু কাছে আসার পর বুঝতে পারল ভুল দেখেনি। কনে হচ্ছে অ্যানলেট।
অ্যানলেট!
ওর অপমানের মুকুটে আরেকটা পালক। ওর গর্বে বিশাল একটা ধাক্কা। কেউ টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাচ্ছে না। অ্যানলেট হাসি মুখে, খুশির সাথে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
লেডি ভেযের দেয়া পোশাক এবং গহনায় সজ্জিত হয়ে আছে মেয়েটা।
অ্যানলেটের খুশির কারণ তার হবু স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম নয়। ও এমন একজনকে চেয়েছিল যে ওর সাথে ওর অন্ধ দাদীর দায়িত্ব ভাগাভাগি করবে। থিবল্ট সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বটে, কিন্তু মন থেকে নয়। এখন দেখা যাচ্ছে দায়িত্ব ভাগাভাগি করার মতো মানুষ পেয়ে গেছে অ্যানলেট। ধীরে ধীরে মিছিলটা দূরে চলে যাচ্ছে। সাথে নিয়ে যাচ্ছে বাজনার শব্দ। বেশ অনেকক্ষণ পর বনটা আবার শান্ত হয়ে গেল। কিন্তু থিবল্টের হৃদয়ে আগুন জ্বলছে-ঈর্ষার আগুন।
অ্যানলেটের নিষ্পাপ সৌন্দর্য্যে সুখের ছোঁয়া লেগেছে। গত তিনটা মাস অ্যানলেটের কোন খোঁজ রাখেনি ও। আজ যখন দেখল তখন সে অন্য কারও স্ত্রী হতে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখার কোন রকম অভিপ্রায় থিবল্টের ছিল না। তারপরও সিদ্ধান্তে আসল, অ্যানলেটকে ও সবসময়ই ভালবেসেছে।
নিজেকে বোঝাল, অ্যানলেট ওর প্রতিশ্রুত বাগদত্তা ছিল। এনগুভা ওর অ্যানলেটকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটু হলে ছুটে যেত ওদের পিছু। এখন। যখন অ্যানলেট আর ওর নয়, তখন মেয়েটা যেন নতুন করে তার সব সৌন্দর্য্য আর গুণ নিয়ে ওর চোখের সামনে হাজির হচ্ছে। শুধু চাইলেই মেয়েটা ওর হতে পারত। অথচ তখন ও বুঝতেই পারেনি।
এতবার প্রতারিত হওয়ার পর নিজের বলতে যে সম্পদটুকু ছিল, তা-ও খুইয়ে বসেছে থিবল্ট। ভেবেছিল যে কোন সময় ফিরতে পারবে আনলেটের কাছে। অন্য কেউ যে সেই সম্পদের দিকে হাত বাড়াতে পারে তেমন ধারণাও কখনও ওর মাথায় আসেনি। দুর্ভাগ্যের চূড়ান্ত ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যায়? হাত কামড়াল থিবল্ট, গাছে মাথা ঠুকল। শেষে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু এ কান্না হৃদয় দ্রবীভূত করার কান্না নয়। হৃদয় থেকে ঘৃণাকে তাড়ানোর ক্ষমতা চোখের এই জলের নেই।
থিবল্ট এখন নিশ্চিত যে অ্যানলেটকে ও ভালবাসে। মেয়েটাকে হারিয়ে ও রাগান্বিত হয়ে উঠেছে। স্বামীসহ মেয়েটার মৃত্যু কামনা করারইচ্ছা ওর ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের পরিকল্পনা বোধহয় অন্যরকম। তাই থিবল্টের মনে চিন্তাটা এল না।
কিছুক্ষণ পর কেঁদে ফেলার জন্য লজ্জা বোধ করল থিবল্ট। কান্না সামলানোর চেষ্টা করল। গর্ত থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো ঘরের উদ্দেশে ছুট লাগাল। তাতে মন কিছুটা শান্ত হলো। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল ও।
অতীতে যেমন অনেক মানুষ দুঃখে-কষ্টে জীবন কাটিয়েছে, ভবিষ্যতেও কাটাবে। কেন কিছু মানুষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে আর কিছু মানুষ অভাবে?
এত অসাম্য কেন যখন জন্ম সবার একইরকম ভাবে হয়?
প্রকৃতির এই খেলার কোন্ নিয়মে কারও ভাগ্যে সুতো হেঁড়ে, আর কারও ভাগ্যে ছেড়ে না?
একজন ওস্তাদ খেলোয়াড় কি ভাগ্যকে পক্ষে আনার জন্য শয়তানের সাহায্য নেয় না? ও-ও তো সেভাবেই ভেবেছিল।
আর খেলায় চুরির কথা? নিয়ম ভেঙ্গে খেলার চেষ্টা তো করেছিল ও। তাতে কী লাভ হয়েছে? যতবার ভেবেছে এবার ও জিতবে, ততবার জিতে গেছে শয়তান।
অন্যদের ক্ষতি করার এই ক্ষমতা থেকে ও কী পেয়েছে?
কিছুই না।
অ্যানলেটকে হারিয়েছে। মিল মালকিন ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বেইলিফের স্ত্রী খেললছে ওকে নিয়ে।
ওর প্রথম ইচ্ছার কারণে বেচারা ম্যাকোট মারা গেল। এমনকি যে হরিণের জন্য এত কাহিনী, সেই হরিণটাও শেষ পর্যন্ত পায়নি। এখান থেকেই ওর হতাশার শুরু। কালো নেকড়ের জন্য হরিণটাকে কুকুরগুলোর কাছে ছেড়ে দিতে হলো।
তার উপর চুলের ব্যাপারটা তো রয়েছেই! সেই যে এক দার্শনিকের গল্প শুনেছিল। দাবার প্রতি ঘরের জন্য আগের ঘরের দ্বিগুণ গমের দানা চেয়েছিল লোকটা। শেষ ঘরের হিসাব মেলানোর জন্য হাজার বছর ধরে গম চাষ করতে হত। ওর আর কটা ইচ্ছা বাকি আছে? বেশি হলে সাত-আটটা হবে। নিজের দিকে তাকাতে ভয় হলো ওর। অনিশ্চিত ভোরের চেয়ে অনন্ত রাতই ভাল।
ওর যদি ভাল পড়াশোনা থাকত, তাহলে হয়তো অন্যের দুর্ভাগ্য থেকে কীভাবে নিজের সুখ আর সম্পদ অর্জন করা যায় তা বের করতে হবে। শিক্ষিত হলে ডক্টর ফাউষ্টের গল্পটা ওর জানা থাকত। মেফিস্টোফিলিসের কাছ থেকে এত ক্ষমতা পাওয়া সত্বেও তার মতো জ্ঞানী চিন্তাবিদের এই পরিণতি হলো কেন? ভ্যালেন্টিনকে১৩ হত্যা! মার্গারেটের আত্মহত্যা! ট্রয়ের হেলেনের১৫ পেছনে, মিথ্যে ছায়ার পেছনে ছোটা কেন?
থিবল্ট ঈর্ষায় জ্বলছে। অ্যানলেট যখন চিরজীবনের জন্য অন্যের হয়ে যাচ্ছে, তখন যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা কি ওর পক্ষে সম্ভব?
তা-ও কার? না, এনওভার। যার কারণে গাছের ওপর ধরা খেয়েছিল ও। যে ঝোঁপ থেকে ওর বর্শাটা খুঁজে বের করেছিল।
আহ! আগে যদি জানত তাহলে ম্যাকোটের বদলে এনগুভার ক্ষতি চাইত থিবল্ট। চাবুকের জ্বালাও এই জ্বালার কাছে কিছু নয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা এভাবে পেয়ে না বসলে, সুখের একটা জীবন হত ওর। দিনে ছয় ফ্রা আয় করত, আর অ্যানলেটের মতো একটা মেয়ে হত ওর ঘরণী। তখন নিশ্চয়ই অ্যানলেট ওকেই বেশি ভালবাসত। অন্যকে বিয়ে করলেও, অ্যানলেট এখনও হয়তো ওকেই ভালবাসে।
দিন শেষ হয়ে রাত নামতে লাগল।
নবদম্পতির সামর্থ্য যা-ই হোক, এখন নিশ্চয়ই বর-কনে আর অতিথিরা সবাই একসাথে আনন্দ করছে।
আর থিবল্ট এখন একা। খাবার তৈরি করে দেবার মতোও কেউ নেই। খাবার মতোই বা কী আছে? সামান্য রুটি আর পানি। আর যাকে লোকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ বলে, সে-ই ভগ্নি, প্রেমিকা বা স্ত্রীর বদলে আছে একরাশ নীরবতা!
তবে সম্পূর্ণ অসহায় নয় থিবল্ট। কে বলেছে ও মন ভরে খেতে পারবে না? মন যা চায়, চাইলেই তা খেয়ে আসতে পারে ও। শিকার বিক্রির টাকাটা তো এখনও ওর কাছেই আছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ওরা যা খরচ করছে, তার চেয়ে বেশিই ও খরচ করতে পারবে। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে খুশি করার প্রয়োজন ওর নেই।
আমি একটা গাধা! পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঈর্ষায় জ্বলার কোন মানেই হয় না। ভাল খাবার আর দু-তিন বোতল ওয়াইন হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব জ্বালা ভুলে যাওয়া যাবে।
ফের্তে-মিলোর পথ ধরল থিবল্ট। ওখানে দোফা-দেঁ নামে একটা চমৎকার রেস্তোরাঁ আছে। ওদের খাবার ডিউকের প্রধান রাধুনীর রান্নার সাথে তুলনা করার মতো।
পঞ্চদশ অধ্যায় – লর্ড ভোপাফে
রেস্তোরাঁয় পৌঁছে ডিনার অর্ডার করল থিবল্ট। চাইলে প্রাইভেট রুম নিতে পারত। কিন্তু ও সবাইকে শুনিয়ে অর্ডার দিল। দামী খাবার, তিন রকমের ওয়াইন। জাহির করতে চাইল নিজেকে।
সামনে আধ বোতল ওয়াইন নিয়ে ঘরের কোনার দিকে একটা লোক বসে ছিল। থিবল্টের গলা শুনে পরিচিত মনে হওয়ায় ঘুরে তাকাল সে। আসলেই থিবল্টের মুখচেনা। একটা গুঁড়িখানায় আলাপ হয়েছিল।
জুতো বানানো ছেড়ে দেয়ার পর থেকে এমন অনেক লোকের সাথেই আলাপ-পরিচয় হয়েছে থিবল্টের। ওকে চিনতে পেরে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল লোকটা। কিন্তু ততক্ষণে লর্ড ভোপাফোঁর চাকর অগাস্ত ফনগোয়াঁ লেভাসোকে চিনে ফেলেছে থিবল্ট।
আরে ফনগোয়াঁ! কোনায় একা বসে কী করছ? এসো, সবার সাথে বসে ডিনার করা।
কোন জবাব না দিয়ে ইশারায় থিবকে চুপ থাকতে বলল।
আমি কথা বলব না? বলব না কথা? কিন্তু যদি আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে? একা একা খেতে ভাল না লাগে, তাহলেও বলতে পারব না-ফনগোয়াঁ, বন্ধু আমার, এখানে এসো। আমার সাথে ডিনার করো। করবে না? সত্যিই করবে না? তাহলে আমিই তোমার কাছে আসছি। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের জায়গা ছেড়ে বন্ধুর কাছে গেল থিবল্ট। সজোরে একটা চাপড় বসিয়ে দিল ফনগোয়াঁর কাঁধে।
ভাব দেখাও তুমি ভুল করেছ, থিবল্ট, নয়তো আমার কাজটা মাটি হবে। দেখছ না, আমি ধূসর কোট পরে আছি? মনিবের হয়ে প্রক্সি দিতে এসেছি আমি। এক মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি আসার কথা।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তারপরও আপনার সাথে ডিনার করতে পারলে আমার ভাল লাগবে।
ঠিক আছে। আপনি বরং অন্য একটা ঘরে আপনার খাবার দিতে বলুন। আমি রেস্তোরাঁর মালিককে বলে দিচ্ছি, আর কোন ধূসর কোট পরা লোক এলে উপরে পাঠিয়ে দেবে। ওনার সাথে আমার ভাল আলাপ আছে, আশা করি সমস্যা হবে না।
বেশ, থিবল্ট ওর খাবার ওপরে একটা ঘরে নিয়ে যেতে বলল, যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়।
ওপরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল থিবল্ট। ও যে খাবার অর্ডার দিয়েছে তা দুজনের জন্য যথেষ্ট। আরও এক বোতল ওয়াইন অর্ডার দিল। এই সময়ে ওয়াইনে ডুবে থাকার পাশাপাশি একজন বন্ধুর সাথে কথা বললে ভাল লাগবে।
ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। হ্যাটটা মাথায় চেপে বসিয়ে দিল। থিবল্ট। চায় না ফনগোয়াঁ ওর মাথার লাল চুল দেখতে পাক।
বন্ধু, এখন আমাকে বুঝিয়ে বলো তখন কী বললে। আমি পুরোটা বুঝিনি।
তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, চেয়ারে হেলান দিল ফনগোয়াঁ। লর্ডদের চাকরি করতে গেলে দরবারি ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করতে হয়। সে ভাষা আবার সবাই বোঝে না।
হয়তো না, তবে তুমি বুঝিয়ে বললেই তোমার বন্ধুরা বুঝবে।
তা ঠিক। বলো কী জানতে চাও।
ঠিক আছে। প্রথম প্রশ্ন, ধূসর কোট পরেছ কেন?
বন্ধুর অজ্ঞতায় হাসল ফনগোয়াঁ। ধূসর ওভারঅল পরে তুমি ভেতরের পোশাকটাকে ঢেকে রাখতে পারো। অনেকটা প্রহরীর মতো কাজ করে ওটা।
তারমানে তুমি প্রহরীর কাজ করছ? কে আসবে?
কোতেস দু মন-গুবেরের পক্ষ থেকে চিঠি নিয়ে শস্পেন আসবে।
আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। লর্ড ভোপাফোঁ, তোমার মনিব, কোঁতেস দু মন গুবেরকে ভালবাসেন। মাদামের পক্ষ থেকে শস্পেন চিঠি নিয়ে আসবে, তুমি তার অপেক্ষায় আছ।
মঁসিয়ে রাউলের ছোট ভাই বলে, শিক্ষক হিসেবে আমি খারাপ নই।
লর্ড রাউল সৌভাগ্যবান।
তা বটে।
কাউন্টেস অনেক সুন্দরী।
তুমি চেন?
ডিউক আর মাদাম দু মতির সাথে শিকার করতে দেখেছি।
ওয়াইন খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখল দুজনে। তখনই আরেকজন ধূসর কোটকে আসতে দেখল ওরা। ওদের ডাক শুনে সে উপরে চলে এল। তার সাথে একটা চিঠি আছে।
তাহলে আজ রাতে কি সাক্ষাত হচ্ছে? ফনগোয়াঁ জানতে চাইল।
হ্যাঁ, আনন্দের সাথে জবাব দিল শস্পেন।
বেশ, ফনগোয়াও খুশি।
মনিবের খুশিতে চাকরদেরও খুশি হতে দেখে অবাক হলো থিবল্ট।
তোমরা এত খুশি হচ্ছ কেন? দেখ তো মনে হচ্ছে মনিব না, বরং তোমাদের নিজেদের ইচ্ছাই পূরণ হতে যাচ্ছে?
ব্যাপারটা তা নয়। মনিব ব্যস্ত মানে আমাদের ছুটি।
ফনগোয়া বলল, ভৃত্য হতে পারি, কিন্তু সময় কীভাবে উপভোগ করা যায় সেটা ভালই জানা আছে আমার।
শস্পেন, তুমি?
শস্পেন গ্লাসটা আলোতে ধরে বলল, আমিও সময়টা উপভোগ করতে চাই।
থিবল্ট বলল, সবার ভালবাসার উদ্দেশে পান করা যাক। দেখা যাচ্ছে সবারই কেউ না কেউ আছে।
আর আমরা পান করছি তোমার ভালবাসার উদ্দেশে।
জুতো কারিগরের চোখে ঘৃণার দৃষ্টি ফুটল। আমার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব-আমি কাউকে ভালবাসি না, আমাকেও কেউ ভালবাসে না।
ওর সঙ্গীরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল।
তাহলে তোমার সম্বন্ধে যেসব কথা ভেসে বেড়াচ্ছে তা কি সত্যি?
আমার ব্যাপারে কথা?
হ্যাঁ, তোমার ব্যাপারে। শস্পেন বলল।
ভোপাফোর মতো মন-বেতেও আমার ব্যাপারে কথা শোনা যায়?
শস্পেন মাথা নেড়ে সায় জানাল।
তা, কী শোনা যায়?
তুমি একটা নেকড়ে-মানব।
থিবল্ট হেসে উঠল। আমার কি কোন লেজ দেখতে পাচ্ছ? নেকড়ের মতো থাবা বা লম্বা নাক?
আমরা বলিনি। লোকে যা বলছে তাই বললাম।
তবে এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, নেকড়ে-মানবের ওয়াইনের রুচি খুবই উন্নত।
কোন সন্দেহ নেই। দুই ভৃত্য একই সাথে জবাব দিল।
যে এসব সম্ভব করেছে, সেই শয়তানের উদ্দেশে, থিবল্ট গ্লাস উঁচু করল।
বাকি দুজন গ্লাস নামিয়ে রাখল।
কী হলো?
শয়তানের স্বাস্থ্যের উদ্দেশে পান করতে চাইলে অন্য কোন সঙ্গী খুঁজে নাও, আমি নেই, ফনগোয়াঁ বলল।
আমিও না, শস্পেনও যোগ করল।
ঠিক আছে, আমি একাই তিন গ্লাস পান করব তাহলে, বলে হাত বাড়াল থিবল্ট।
থিবল্ট, এখন আমার যেতে হবে, ফনগোয়াঁ বলল।
এত তাড়াতাড়ি?
লর্ড অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, শস্পেন… চিঠিটা?
এই যে।
আমরা বিদায় নিয়ে যে যার কাজে যাই। থিবল্ট এখানে সময়টা নিজের মতো উপভোগ করুক। বলে ফনগোয়াঁ শস্পেনের উদ্দেশে চোখ টিপ দিল।
শেষ আরেকবার খেয়ে তারপর যাও।
খেতে পারি, তবে ওই গ্লাসে নয়।
তোমরা বড় খুঁতখুঁতে। এখন তাহলে হোলি ওয়াটার দিয়ে এই গ্লাসগুলো ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তা নয়। বন্ধুর অনুরোধকে উপেক্ষা করার চাইতে আমরা ওয়েটারকে ডেকে নতুন গ্লাস দিতে বলব।
থিবল্টের ওপর মদের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এই তিনটা গ্লাস তাহলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া উচিত? গোল্লায় যা! বলে একে একে তিনটা গ্লাসই জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ও। আশ্চর্য ব্যাপার, অন্ধকারে হারিয়ে যাবার আগে পেছনে বিদ্যুতের মতো আলোর রেখা তৈরি করল গ্লাসগুলো। আর শেষ গ্লাসটা নিচে পড়ার পরপরই শোনা গেল বজ্রপাতের বিকট আওয়াজ।
জানালা বন্ধ করে ফিরে এসে থিবল্ট দেখল ওর সঙ্গী দুজন চলে গেছে।
কাপুরুষের দল! বিড়বিড় করল থিবল্ট, তারপর গ্লাস খুঁজতে গিয়ে দেখল আর কোন গ্লাস অবশিষ্ট নেই। আজব! বোতল থেকেই খেতে হবে দেখছি। যেই ভাবা সেই কাজ, গলায় ঢেলে বোতলটা খালি করে ফেলল ও। তাতে করে মস্তিষ্কের স্থিরতা অবশ্য আরও কমে গেল ওর।
রাত নটার দিকে বিল মিটিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল থিবস্ট। পুরো দুনিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছে ও। যে যন্ত্রণা থেকে পালাতে চাইছিল সেটাই বারবার ফিরে আসছে। যত সময় যাচ্ছে অ্যানলেট ওর কাছ থেকে তত দূরে চলে যাচ্ছে। অথচ সবারই হয় স্ত্রী আছে, নয় প্রেমিকা। আজ ওর এই দুর্দশা। কিন্তু জগতের আর সবাই খুশি। লর্ড ভোপাফো, দুই ভৃত্য ফনগোয়াঁ আর শস্পেন, সবাই আনন্দিত। ও-ই শুধু একা অন্ধকারে ফিরে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর ওপর কোন অভিশাপ আছে।
আকাশের দিকে হাত নাচিয়ে ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরের কাছে চলে এল থিবল্ট। পেছনে ঘোড়র ক্ষুরের আওয়াজ শুনতে পেল।
নিজের মনেই বলল থিবল্ট, লর্ড ভোপাফোঁ, প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। স্যার রাউলকে লর্ড মন-গুবে যদি ধরতে পারেন, কী যে হবে ভেবেই হাসি পাচ্ছে। সবাই তো আর ম্যাগলোয়া নয় যে সহজেই পার পেয়ে যাবে। এই বেলা ঠিকই অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাবে।
পথের মাঝে উটকো এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘোড়সওয়ার চাবুক নাচাল। ঘোড়র পায়ের নিচে পড়তে না চাইলে সামনে থেকে সরে যা!
থিবল্ট অর্ধ মাতাল হয়ে আছে। চাবুকের বাড়ি আর ঘোড়ার ধাক্কায় ছিটকে পড়ে কাদায় গড়াগড়ি খেল ও। ততক্ষণে ঘোড়সওয়ার সামনে এগিয়ে গেছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে অপস্রিয়মাণ আকৃতির দিকে আঙুল তুলে বলল থিবল্ট, যদি জুতোর কারিগর থিবল্ট না হয়ে, শুধু একদিনের জন্যও আপনাদের মতো লর্ড হতে পারতাম। পায়ে হাঁটার বদলে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে কেমন লাগে, পথচারীদের চাবুকপেটা করতে কেমন লাগে, কোতেস দু মন-গুবের মতো স্বামী প্রবঞ্চক স্ত্রীদের সাথে প্রেম করতে কেমন লাগে জানতে পারতাম।
সঙ্গে সঙ্গে দূরবর্তী ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠে পিঠের আরোহীকে মাটিতে ফেলে দিল!
ষষ্ঠদশ অধ্যায় – প্রেয়সী
তরুণ ব্যারনকে পড়ে যেতে দেখে খুশি হলো থিবল্ট। দৌড়ে দেখতে গেল কী অবস্থা। চাবুকের বাড়ির কারণে কাঁধ এখনও জ্বলছে ওর। পড়ে থাকা শরীরটার পাশে ঘোড়াটা ঘুরছে। কাছে গিয়ে দেখল, একটু আগেই ঘোড়ায় চড়ে ওর পাশ দিয়ে যে ছুটে গেছে, সে লোক এ নয়। এর পরনে এক দরিদ্র পথিকের পোশাক। উত্তরোত্তর ওর বিস্ময় বাড়তেই থাকল। আরও অবাক হলো যখন দেখল-অজ্ঞান শরীরটা হুবহু ওর মতো দেখতে, ওরই পোশাক পরা! নিজের দিকে তাকাল থিবল্ট। ওর পোশাকও পাল্টে গেছে। দামী শিকারি বুট ওর পায়ে, দামী কোটে সোনার কারুকাজ করা, ওয়েস্টকোটটা সুন্দর সাদা জিনসের, শার্টটাও অভিজাতদের উপযোগী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওর বেশভূষা পাল্টে গেছে। হাতে একটা চাবুকও চলে এসেছে। ওটা দিয়ে বাতাসে একবার বাড়ি মেরে শব্দ শুনল থিবল্ট। কোমরে ওর শোভা পাচ্ছে বড় একটা শিকারি ছুরি, যেটাকে তলোয়ারও বলা চলে।
নিজের পরনে এই চমৎকার পোশাক দেখে প্রচণ্ড খুশি হলো ও। এই পোশাকে ওকে কেমন মানিয়েছে দেখতে অধীর হয়ে উঠল। আর তখনই মনে পড়ল, বাড়ির বেশ কাছেই চলে এসেছে ও। আহ! আমার ঘরেই তো আয়না আছে!
ছুটে গেল থিবল্ট নিজের ঘরের দিকে, নার্সিসাসের মতো নিজের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে। কিন্তু ঘরের দরজা তালাবদ্ধ। চাবির জন্য পকেট হাতড়াতে লাগল ও। টাকা ভরা পার্স, চকলেট, ছোট পেন-নাইফ এসব খুঁজে পেল। কিন্তু দরজার চাবিটা কোথায় গেল? হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল ওর। চাবিটা হয়তো রাস্তায় শুয়ে থাকা থিবল্টের পকেটে আছে। ফিরে গিয়ে পকেট থেকে উদ্ধার করল ওটা। ঘরের ভেতরটা বাইরের চাইতেও অন্ধকার। দিয়াশলাই খুঁজে নিয়ে মোম জ্বালাতে জ্বালাতে বলে উঠল, শুয়োরগুলো এই নোংরার মধ্যে কীভাবে থাকে কে জানে!
আলো জ্বালিয়ে আয়নাটা নামিয়েই চমকে উঠল ও। আত্মাটা থিবল্টের হতে পারে, কিন্তু শরীরটা কোনমতেই থিবল্টের নয়। আয়নার ভেতর পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের এক সুদর্শন তরুণ তাকিয়ে আছে। নীল চোখ, গোলাপী গাল, লাল ঠোঁট, সাদা দাঁত। থিবল্টের আত্মা ব্যারন রাউল দু ভোপাফোর শরীরে প্রবেশ করেছে। এখন বুঝতে পারছে কেন জ্ঞান হারা মানুষটা ওর পোশাক পরে, ওর চেহারা নিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে।
একটা জিনিস ভুললে চলবে না-যদিও মনে হচ্ছে আমি এখানে, কিন্তু আমি আসলে বাইরে রাস্তায় শুয়ে আছি। সাবধান থাকতে হবে যেন আগামী চব্বিশ ঘণ্টা আমার কোন ক্ষতি না হয়। মঁসিয়ে দু ভোপাফোঁ, বেশি চিন্তা না করে বেচারাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দাও। মঁসিয়ের অভিজাত অনুভূতির কাছে কাজটা অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে হলেও, থিবল্ট রাস্তা থেকে নিজের দেহটাকে তুলে ঘরে নিয়ে এল, সাবধানে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। একটা গাছের খোড়লে লুকিয়ে রাখল চাবিটা।
পরের কাজ হচ্ছে ঘোড়াটাকে ধরে চড়ে বসা। সারাজীবন হেঁটেই চলাফেরা করেছে থিবল্ট, ভাল ঘোড়সওয়ার ও নয়। ঘোড়া ঠিকমতো চালাতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তবে সমস্যা হলো না। রাউলের শরীরের সাথে সাথে শারীরিক দক্ষতাগুলোও আয়ত্তে চলে এসেছে ওর। পিঠে সওয়ারি টের পাওয়া মাত্র ঘোড়াটা লাফাতে শুরু করল। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী হয়েই রাশ চেপে ধরল ও। দুপা দিয়ে ঘোড়ার দুপাশ চেপে ধরে স্পার দাবাল। দুচারটা চাবুকের বাড়ি মেরে জটাকে বশে আনার প্রয়াস পেল।
ওর অবশ্য পরিষ্কার ধারণা নেই এরপর কী করবে। শুধু জানে কোতেফসের চিঠি অনুযায়ী মন-গুবেতে যেতে হবে। চিঠিতে কী লেখা? ঠিক কখন দেখা করার কথা? দুর্গে কীভাবে ঢুকবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর একটা একটা করে ওকে আবিষ্কার করতে হবে। আচ্ছা, চিঠিটা তো এখন ওর কাছেই থাকতে পারে। হাতড়াতে হাতড়াতে ভেতরের পকেটে চিঠির মতো একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। ঘোড়া থামিয়ে একটা ছোট চামড়ার ব্যাগ বের করল ও। ব্যাগের এক পকেটে কয়েকটা চিঠি আর এক পকেটে একটা চিঠি। এটাই সম্ভবত সেই চিঠি। পড়তে হলে আলো দরকার। কাছের একটা লোকালয়ে গেল থিবল্ট। কোন ঘরে আলো চোখে পড়ল না। একটা সরাইয়ের আস্তাবলে নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ডাক দিল। বাতি হাতে একটা ছেলে বেরিয়ে এল। কিছুক্ষণ আলো ধরে রাখতে পারবে? খুব উপকার হত।
এরজন্যই ঘুম ভাঙিয়ে বিছানা থেকে ডেকে তুললেন? খুব রুক্ষ স্বরে বলল ছেলেটা। মানুষ বটে আপনি! বলে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো সে। ভুলভাবে ছেলেটার সাথে কথা শুরু করেছে, বুঝতে পারল থিবল্ট। এবার তাই গলা চড়িয়ে বলল, এই ছেলে! চাবুকের বাড়ি খেতে না চাইলে আলোটা নিয়ে এদিকে এসো!
ক্ষমা করবেন, মাই লর্ড! অন্ধকারে বুঝতে পারিনি কার সাথে কথা বলছি। কাছে এসে বাতিটা উঁচু করে ধরল ছেলেটা।
চিঠির ভাঁজ খুলল থিবল্ট, লেখা:
প্রিয় রাউল,
ভালবাসার দেবী নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষে আছে। আগামীকাল একটা বড় শিকারের আয়োজন হয়েছে। সেটায় যোগ দিতে আজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে যাচ্ছে ও। তুমি নটার দিকে রওনা দিলে সাড়ে দশটার মধ্যে চলে আসতে পারবে। কোন দিক দিয়ে আসবে সেটা তো তুমি জানোই। পরিচিত একজন তোমাকে আনতে যাবে। তোমার দোষ ধরছি না, তবে মনে হলো গতবার তুমি করিডোরে অনেকক্ষণ ছিলে।
নিচে কোন সই নেই।
কপাল! স্বগতোক্তি করল থিবল্ট।
কিছু বললেন, মাই লর্ড?
কিছুই না, তোমার কাজ শেষ তুমি এখন যেতে পারো।
শুভ যাত্রা, মাই লর্ড। মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল ছেলেটা।
কপাল! প্রেমের দেবী আমাদের পক্ষে আছে, কোতেসের খ্রিষ্টান নাম জেন, জেনের স্বামী সন্ধ্যায় বেরিয়ে যাচ্ছে, আর ও আমাকে সাড়ে দশটায় আশা করছে। এর বাইরে, কোন পথে যেতে হবে সেটা আমার জানা থাকার কথা। পরিচিত কেউ একজন এসে আমাকে নিয়ে যাবে। দুশ্চিন্তায় কান চুলকাতে লাগল থিবল্ট। ওর শরীরে বন্দী লর্ড ভোপাফোঁকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? নাহ, তাতে ঝামেলার সম্ভাবনা আছে। ব্যাটা নিজের শরীরের সাথে যোগ দিতে চাইলে মারামারি লেগে যাবে। তাতে ওর শরীরের কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। অন্য কোন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ও বহুবার শুনেছে ঘোড়ার ইন্দ্রিয় খুব প্রখর। ঘোড়াটাকে নিজের মতো চলতে দিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রধান সড়কে এসে তাই মন-গুবের দিকে মুখ করে ঘোড়াটাকে ইচ্ছামতো চলতে দিল ও। ঘোড়াটাও বুঝতে পেরে ছুটতে শুরু করল। পার্কের কোনার কাছে এসে ঘোড়াটা ইতস্তত করতে শুরু করল। কান খাড়া করে ফেলেছে। থিবল্টের মনে হলো দুটো ছায়া দেখতে পেয়েছে। ঘোড়া থামিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে অবশ্য আর কিছু দেখতে পেল না ও। সম্ভবত কোন চোরাশিকারি হবে। ঘোড়াটা আবার চলতে শুরু করল। দেয়ালের গা ঘেঁষে নরম মাটির ওপর দিয়ে, যাতে শব্দ না হয় বা খুব কম হয়। বুদ্ধিমান প্রাণীটা জানে এখানে কীভাবে চলতে হবে।
একপর্যায়ে দেয়ালে একটা ভাঙা অংশ চোখে পড়ল। ঘোড়াটা সেই ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা সমস্যার সমাধান হয়েছে। চেনা পথে এসে পড়েছে প্রাণীটা। এরপর ওর পরিচিত লোককে খুঁজে বের করতে হবে। আরও মিনিট পাঁচেক চলার পর দুর্গ থেকে একটু দূরে অমসৃণ কাঠ, খড় আর কাদা দিয়ে বানানো একটা কুঁড়ের সামনে এসে দাঁড়াল থিবল্টের বাহন। ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনে খুলে গেল দরজা। একটা সুন্দর মেয়ে বেরিয়ে এল, কে, মঁসিয়ে রাউল?
হ্যাঁ, আমি, ঘোড়া থেকে নামতে নামতে বলল থিবল্ট।
মাদাম ভয় পাচ্ছিলেন, মাতাল শস্পেন আপনাকে চিঠিটা ঠিকমতো দিতে পেরেছিল কি না ভেবে।
ভয় নেই। শস্পেন সময়মতোই চিঠি পৌঁছে দিয়েছে।
ঘোড়াটা রেখে চলে আসুন।
ঘোড়াটা দেখবে কে?
খামোজি। ও-ই তো সবসময় দেখে।
ও আচ্ছা, খামোজি দেখবে, এমনভাবে বলল থিবল্ট যেন এটা ওর আগে থেকে জানা।
তাড়াতাড়ি আসুন, নইলে মাদাম আবার অভিযোগ করবেন আমরা করিডোরে বেশি সময় কাটিয়েছি।
রাউলকে লেখা চিঠিতে এ ধরনের একটা কথা ছিল। মনে পড়ল ওর। মেয়েটা মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বের করে হাসল। তাই দেখে থিবল্টের ইচ্ছা করল করিডোরে ঢোকার আগে পার্কেই কিছু সময় কাটায়।
হঠাৎ থেমে গেল মেয়েটা। ঘাড় কাত করে কী যেন শোনার চেষ্টা করল।
কী হলো?
কারও পায়ের চাপে ডাল ভাঙার শব্দ শুনলাম বলে মনে হলো।
হয়তো খামোজি।
সে কারণেই, এখানে যা-ই করুন খুব সাবধানে করবেন।
মানে?
আপনি কি ভুলে গেছেন যে আমি খামোজির বাগদত্তা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যইতোমার সাথে একা থাকলেই এসব ভুলে যাই রাণী।
রাণী! এখন আমার নাম হয়ে গেল রাণী? জানতাম না আপনি এতটা ভুললামনের মানুষ, মঁসিয়ে রাউল।
তোমাকে রাণী ডাকলাম কারণ, তুমি মহিলা পরিচারিকাদের রাণী!
সত্যি কথা বলতে কী, মাই লর্ড, আপনাকে সজীব, বুদ্ধিমান একজন মানুষ বলেই জানি। তবে আজ আপনি সব ধারণা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
এই মন্তব্যে খুশি হলো থিবল্ট।
আশা করি, তোমার মালকিনও তেমনটাই ভাববেন।
সে ব্যাপারে এটুকু বলতে পারি, জিভ সংবরণ করতে পারলেই এইসব কেতাদুরস্ত মহিলারা, পুরুষদের চালাক-চতুর ভাবে।
ধন্যবাদ, পরামর্শটা মনে রাখব।
চুপ! ড্রেসিং রুমের পর্দার আড়ালে মাদাম দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পেছন পেছন আসুন।
পার্কের প্রান্ত থেকে দুর্গের সিঁড়ি পর্যন্ত একটা খোলা জায়গা আছে। থিবল্ট সেদিকে এগোতে যেতেই মেয়েটা বাধা দিল।
হাত চেপে ধরে বলল, বোকার মতো কী করছেন?
কী করছি আমি? সুযেত, স্বীকার করছি। আমি আসলেই জানি না কী করছি!
সুযেত! এখন আমার নাম, সুযেত! মঁসিয়ে বোধহয় আমাকে একের পর এক সব রক্ষিতাদের নাম ধরে ডেকেই যাচ্ছেন। রিসেপশন রুম দিয়ে নিশ্চয়ই যাওয়ার চিন্তা করছেন না? তাহলে লর্ড কাউন্টের হাতে ধরা খেতে সময় লাগবে না। এদিক দিয়ে আসুন।
মেয়েটা ছোট একটা দরজা পেরিয়ে প্যাচানো সিঁড়িতে তুলল ওকে। অর্ধেক উঠতেইথিবন্ট সঙ্গীর সরু কোমর জড়িয়ে ধরল।
আমরা করিডোরে চলে এসেছি তাই না? মেয়েটার সুন্দর গালে চুমু খাবার চেষ্টা করতে করতে বলল থিবল্ট।
এখনও না। তবে তাতে কিছু যায় আসে না।
বিশ্বাস করো, আজ সন্ধ্যায় আমার নাম রাউল না হয়ে যদি থিবল্ট হত, তোমাকে তুলে নিয়ে দোতলায় না থেমে সোজা চিলেকোঠায় চলে যেতাম।
এ সময় একটা দরজার কবাট নড়ার শব্দ ভেসে এল।
তাড়াতাড়ি মঁসিয়ে, মাদাম অধৈর্য হয়ে পড়ছেন।
থিবল্টকে টেনে নিয়ে করিডোর পেরোল মেয়েটা। তারপর একটা দরজা খুলে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আটকে দিল। এই ভেবে আশ্বস্ত হলো সে যে ব্যারন রাউল দু ভোপাফোঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে ভুললামনা মানুষটাকে নিরাপদে নিয়ে আসতে পেরেছে!
সপ্তদশ অধ্যায় – ব্যারন দু মন-গুবে
কাউন্টেসের কামরায় নিজেকে আবিষ্কার করল থিবল্ট। বেইলিফের বাড়িতে অনেক দামী দামী আসবাব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ও। আর এখানে যা দেখল তাতে বিস্মিত হলো। একজন মানুষ যা কখনও দেখেনি, যা সে কখনও কল্পনাও করতে পারে না।
ওর মনের চোখে একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল। অ্যানলেটের ছোট্ট কুঁড়ে, মাদাম পুলের খাবার ঘর, বেইলিফের স্ত্রীর শোবার ঘর। কিন্তু এই ঘরের তুলনায় সেগুলো কিছুই নয়। যা দেখছে তা সত্যি, না কোন জাদুকরের প্রাসাদে চলে এসেছে-বুঝতে পারছে না থিবল্ট। কেন ও চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ব্যারন হতে চাইল? এরচেয়ে সারাজীবনের জন্য মাদামের কুকুর হতে চাইলেও তো পারত। এইসব অকল্পনীয় আসবাব দেখার পর আবার থিবল্ট হিসেবে কীভাবে ও জীবন কাটাবে?
ড্রেসিংরুমের দরজা খুলে কাউন্টেস হাজির হলো। এমন ঘরে এমন নারীকেই মানায়! মাথায় হীরের পিন লাগানো। লেসের কাজ করা গোলাপি গাউন শরীরের কোন আকর্ষণকেই ঢাকতে পারছে না। পায়ে রূপোর জুতো। গলায় মুক্তোর একটা হার ছাড়া আর কোন গহনা নেই। আর সে মুক্তোও বোধকরি শুধু রাজার ঘরেই শোভা পায়!
এই বিলাসী সৌন্দর্য্যের ভারে যেন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বিল্ট।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিচু হও। আরও নিচু। আমার পায়ে চুমু খাও। কার্পেটে, তারপর মেঝেতে। তা-ও আমি তোমাকে ক্ষমা করব না। তুমি একটা অসুর।
সত্যি কথা বলতে কী মাদাম, তোমার তুলনায় আমি তার চেয়েও অধম।
হ্যাঁ, ভাব দেখাও যেন তুমি আমার কথার ভুল মানে করছ। ভাবছ, আমি তোমার বেশভূষা আর চেহারা নিয়ে কথা বলছি? কিন্তু না, আমি কথার বিষয়বস্তু তোমার চরিত্র। তোমার ভেতরের চেহারাটা যদি বাইরেও দেখা যেত, তাহলে তোমার দিকে আর তাকানো যেত না। শত দোষ থাকার পরও, তুমি সবচাইতে সুদর্শন পুরুষ। কিন্তু মঁসিয়ে, এটা তো স্বীকার করবে যে তুমি লজ্জিত?
লজ্জিত, কারণ আমি সবচেয়ে সুদর্শন? কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারছে থিবল্ট, অপরাধ যা-ই করে থাকুক ব্যারন, সেটা ক্ষমার অযোগ্য নয়।
না, কারণ হাসিখুশি মুখের আড়ালে তোমার মনটা কালো, আর তোমার হৃদয় বলে কিছু নেই। এখন ওঠো। কাউন্টেস তার হাত বাড়িয়ে দিল। সে হাত একই সঙ্গে ক্ষমা নির্দেশ করছে আবার চুম্বনও আশা করছে।
থিবল্ট নরম, মিষ্ট হাতটায় চুমু খেল। একটা সোফায় বসে পড়ল কাউন্টেস। রাউল রূপী থিবকে ইঙ্গিত করল পাশে বসার।
এবার বলল, শেষবার দেখা হওয়ার পর কী কী করেছ?
তার আগে মনে করিয়ে দেবে, শেষ কখন এসেছিলাম?
ভুলে গেছ? নাকি ঝগড়া করতে চাইছ? নইলে এসব কথা কেউ বলে না।
ঠিক তার উল্টো। শেষবারের কথা এখনও এত তাজা মনে হচ্ছে, যেন গতকালের ঘটনা। তারপর যে কী করেছি, মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস করো, গতকালের পর থেকে, তোমাকে ভালবাসা ছাড়া আর কোন অপরাধ আমি করিনি।
মন্দ বলোনি। তবে প্রশংসা দিয়ে পদস্থলনের দোষ থেকে মুক্তি পাবে না।
জবাবদিহির কাজটা অন্য কোন সময়ের জন্য তুলে রাখি?
না, আমার এখনই জবাব চাই। শেষবার দেখা হওয়ার পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে তুমি কী করেছ?
কাউন্টেস, তুমি না বললে আমি কীভাবে জানব? আমি তো জানি, আমি নির্দোষ।
বেশ! করিডোরে তোমার কালক্ষেপণ নিয়ে কোন কথা শুরু করব না আমি।
এটা দিয়েই শুরু করি! তোমার মতো সেরা হীরের টুকরো পাওয়ার পর, নকল মুক্তো নিয়ে আমি কী করব?
হুঁহ! পুরুষের স্বভাব আমার জানা আছে। তাছাড়া লিযেট যথেষ্ট সুন্দরী।
ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, জেন। লিযেট আমাদের সব জানে। ওকে ঠিক পরিচারিকা হিসেবে ভাবাটা ঠিক হবে না।
কী যুক্তি! আমি কোতেস দু মন-গুবের সাথে প্রতারণা করছি, আবার আমি মঁসিয়ে খামোজির প্রতিদ্বন্দ্বীও।
ঠিক আছে তাহলে। করিডোরে আর দেরি হবে না। বেচারি লিযেট আর কোন চুমুও পাবে না, যদি বা কখনও পেয়েও থাকে!
যা-ই হোক, তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
তার মানে আমি এরচেয়েও খারাপ কিছু করেছি?
তোমাকে যে রাতে এনেভিলা আর ভিলারস-কটেরেটের মাঝের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল, সে রাতে কোথায় ছিলে?
কেউ আমাকে দেখেছিল?
হ্যাঁ। এনেভিলার রাস্তায়। কোথা থেকে আসছিলে?
মাছ ধরে ফিরছিলাম।
মাছ ধরে?
পুকুর খালি হচ্ছিল।
তুমি কত বড় জেলে সেটা আমার খুব ভাল জানা আছে। তা রাত দুটোর সময় কোন্ মাছটা তুমি ধরে আনছিলে?
ব্যারন, আমার বন্ধু, ভেযে ওর সাথে খাওয়া-দাওয়া করছিলাম।
তোমার বন্ধু যে সুন্দরীকে বন্দী করে রেখেছে, নিশ্চয়ই তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছ। কিন্তু সেটাও আমি ক্ষমা করে দিতে পারি।
কী, এরচেয়েও খারাপ অপরাধ থাকতে পারে? অপরাধ যত বড়ই হোক, তারপরই ক্ষমা আসতে দেখে থিবল্ট আশ্বস্ত হতে শুরু করেছে।
হ্যাঁ, ডিউক অফ অরলিয়ন্সের দেয়া নাচের আসরে।
কোন্ নাচের আসর?
কেন, গতকালেরটা? অনেকদিন আগের কথা তো নয়।
ওহ, গতকালেরটা? তোমার রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
তাই বুঝি, কিন্তু আমি তো সেখানে ছিলাম না।
তোমার রূপে মুগ্ধ হওয়ার জন্য তোমার থাকাটা কি জরুরি? মনের চোখে তোমাকে দেখে কি আমি মুগ্ধ হতে পারি না? তুলনা করতে গেলে, না গিয়েও তো তুমি জিতে গেছ।
সেই তুলনার সর্বোচ্চ চূড়াটা কী, মাদাম দু বোনোইয়ের সাথে চারবার নাচা? চড়া সাজগোজ করা কালো মেয়েগুলো দেখতে খুব সুন্দর, তাই না?
ওই চারটা নাচে আমরা কী নিয়ে কথা বলেছি জানো?
তাহলে স্বীকার করছ চারবার নেচ্ছে?
তুমি যখন বলছ তখন কোন সন্দেহ নেই এটা সত্যি।
এটা কি ভাল উত্তর হলো?
আর কী উত্তর দেব? এমন সুন্দর একটা মুখের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে? এই মুখ আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেও, আমার পক্ষে সম্ভব না।
কথাটা বলেই থিবল্ট কাউন্টেসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর তখনই দরজা ঠেলে ঢুকল লিযেট।
মঁসিয়ে, মঁসিয়ে, নিজেকে বাঁচান! লর্ড কাউন্ট চলে এসেছেন।
কাউন্টেস বিস্মিত হলো, কাউন্ট!
সাথে ওঁর শিকারি লেস্টকও আছে।
অসম্ভব!
বিশ্বাস করুন, মাদাম; খামোজি, নিজের চোখে দেখেছে। ভয়ে ও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
তারমানে শিকারের ব্যাপারটা ভান ছিল। আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য?
কে জানে, মাদাম? পুরুষেরা এত প্রবঞ্চনা করতে পারে!
এখন কী করা যায়?
আবার সৌভাগ্য হাতের মুঠোয় এসে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে ক্ষেপে গেল থিবল্ট। কাউন্টের জন্য অপেক্ষা করি, তারপর ওকে মেরে ফেলব!
মেরে ফেলবে, কাউন্টকে? রাউল, তুমি কি পাগল হয়েছ? না না, তুমি পালাও, নিজেকে বাঁচাও। লিযেটা ব্যারনকে আমার ড্রেসিংরুম দিয়ে বাইরে নিয়ে যাও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিফেটের হাত ধরে নিরাপদে বেরিয়ে এল থিবল্ট। অল্পের জন্য রক্ষা পেল ও। অন্যদিকে কাউন্টেস তার শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল। অনেক ঘর ঘুরে যে সিঁড়ি দিয়ে প্রাসাদে উঠেছিল সেখানে চলে এল থিবল্ট। দোতলার অফিসের মতো একটা ঘরের জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে লিযেট। লাফ দিয়ে নিচে নামল থিবল্ট।
ঘোড়া কোথায় আছে তা তো জানেনই। ভোপাফো না পৌঁছানো পর্যন্ত থামবেন না।
আস্তাবলের কাছে এসে ঘোড়ার আওয়াজ পেল থিবল্ট। জটার পিঠে উঠে বসল ও। কিন্তু ঘোড়াটা খোঁড়াতে লাগল। ও তাড়া দিতে সোজা হওয়ার চেষ্টা করেও কাত হয়ে পড়ে গেল ওটা। কিন্তু ও নেমে যেতেই ঘোড়াটা আবার দাঁড়াতে পারল। কোন সন্দেহ নেই, ব্যারন যাতে পালাতে না পারে তাই ঘোড়ার পা খোঁড়া করে দিয়েছে মঁসিয়ে কোঁত দু মন-গুবে। থিবল্ট প্রতিজ্ঞা করল, যদি আপনার সাথে কখনও দেখা হয়, যেভাবে এই অসহায় প্রাণীটাকে খোঁড়া করেছেন, সেভাবে আপনাকেও খোঁড়া করে দেব আমি!
যে পথে ঢুকেছিল সেদিক দিয়েই বেরিয়ে এল ও। আর বেরিয়েই দেখল কোঁত দু মন-গুবে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টও ওকে রাউল দু ভোপাফো বলে চিনতে পারল।
তলোয়ার হাতে নাও, ব্যারন! আহবান জানাল কাউন্ট। প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ক্ষিপ্ত থিবল্টও হাতে শিকারের ছুরি তুলে নিল। শুরু হলো অস্ত্রের ঝনঝনানি।
থিবল্ট তলোয়ারবাজি জানে না। কিন্তু দেখা গেল দিব্যি তলোয়ার চালাতে পারছে ও। এবং বেশ ভালই লড়ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কাউন্ট বলল, শুনেছিলাম, সেইন্ট-জর্জেসকে ধুলোয় গড়াগড়ি খাইয়েছিলে তুমি!
জর্জেস কে থিবল্ট জানে না। তবে এই মুহূর্তে নিজের কব্জির শক্তি আর ক্ষিপ্রতা সম্বন্ধে ও ওয়াকিবহাল। স্বয়ং শয়তানের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে। সুযোগমতো ফাঁক পেয়ে কাউন্টের কাঁধে ছুরি বিধিয়ে দিল ও। কাঁধ চেপে ধরে তলোয়ার ফেলে দিল কাউন্ট। হাঁটু মুড়ে বসে চিৎকার করে উঠল, লেস্টক, বচাও!
তখন ছুরিটা ঢুকিয়ে রেখে পালিয়ে গেলেই ভাল করত থিবল্ট। কিন্তু অবলা খোঁড়া ঘোড়াটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। মনে পড়ে গেল প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞার কথা। অস্ত্র ধরা হাতটা কাউন্টের ভাঁজ করা হাঁটুর নিচে ঢুকিয়ে টান দিল ও। ব্যথায় আর্ত-চিৎকার ছাড়ল কাউন্ট। কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই থিবল্টও পিঠে তীব্র ব্যথার অস্তিত্ব টের পেল। বুকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করল। ওর বুক ভেদ করে একটা অস্ত্রের মাথা বেরিয়ে এসেছে। প্রচুর রক্ত বেরোচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। মনিবের ডাক শুনে লেস্টক ছুটে এসেছিল। থিবকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ওর পিঠে শিকারের ছুরি বসিয়ে দিয়েছে ভৃত্য।
অষ্টাদশ অধ্যায় – মৃত্যু এবং পুনরুত্থান
সকালের ঠাণ্ডা বাতাসে জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে কিছুই মনে পড়ল না থিবল্টের। শুধু অনুভব করল তীব্র ব্যথা, আর দেখল মাটিতে প্রচুর রক্ত। দেয়ালের ফাঁকটা চোখে পড়ল তারপর ধীরে ধীরে আগের ঘটনা সব মনে পড়ে গেল। কাউন্টকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোন সন্দেহ নেই লেস্টক তার মনিবকে নিয়ে গেছে। ওকে ফেলে রেখে গেছে মরার জন্য। চাইলে একটা ইচছার জোরে ওদের শেষ করে দিতে পারে থিবল্ট। কিন্তু করল না। কারণ যা-ই করে থাকুক, সেটা ওরা থিবল্টের সাথে করেনি, করেছে রাউলের সাথে।
ওর হাতে নটা পর্যন্ত সময় আছে। কিন্তু ততক্ষণ টিকবে তত? তার আগেই যদি ও মারা যায়, তাহলে আসলে কে মারা যাবে? ও, না ব্যারন? সম্ভবত ব্যারনের শরীর আর ওর আত্মা মারা যাবে। এই দুর্ভাগ্যের জন্য আসলে ও-ই দায়ী। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পাল্টাপাল্টির আগের ইচ্ছাটার পরিণাম ছিল কাউন্টের হাতে ব্যারনের ধরা পড়া এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
অনেক পরিশ্রমের পর, অনেক ব্যথা সহ্য করে থিবল্ট হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠতে পারল। একটু দূরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মুখে রক্ত চলে আসায় ডাকতে পারল না। হ্যাট খুলে সেটা ছুরির আগায় ধরে উঁচু করার চেষ্টা করল। তাও শক্তিতে কুলালো না। আবার অজ্ঞান হয়ে গেল ও। একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরল। টের পেল ওর শরীরটা এপাশ-ওপাশ দুলছে। কিছু পথিক ওকে দেখতে পেয়েছে শেষ পর্যন্ত। এই সুদর্শন তরুণটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভিলারস-কটেরেটে। পিউযো পর্যন্ত গিয়ে আহত মানুষটা আর পারল না। কাতর অনুনয় করল কাছাকাছি কোন বাড়িতে ওকে রেখে ডাক্তার ডেকে আনতে। গ্রামের পাদ্রীর বাড়িতে ওকে রেখে গেল ওরা। বিল্ট পার্স থেকে ওদের সোনা বের করে দিল এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল। পাদ্রী তখন বাড়িতে ছিল না। ফিরে এসে রাউলকে দেখে প্রচণ্ড দুঃখ প্রকাশ করল সে। রাউল নিজেও হয়তো এরচেয়ে ভাল হাসপাতাল খুঁজে বের করতে পারত না। পাত্রী একসময় রাউলের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। আঘাতটা ভাল করে দেখল পাদ্রী। ছুরিটা ডানদিকের ফুসফুসটা ফুটো করে পাজরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়েছে।
আঘাতের গুরুত্ব বুঝলেও ডাক্তার না আসা পর্যন্ত কিছু বলল না পাদ্রী। ডাক্তার এসে দেখে মাথা নাড়তে লাগল।
ওর রক্ত বের করবেন?
কী লাভ? আঘাত পাওয়ার পরপরই যদি বের করা যেত, হয়তো উপকার হত। কিন্তু এখন নাড়াচাড়া করাও বিপজ্জনক।
ওর বাঁচার কোন সম্ভাবনা আছে? ডাক্তার যদি হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে পাদ্রীর চেষ্টা করার সুযোগ বাড়বে।
ডাক্তার নিচু গলায় বলল, যদি এভাবে চলে, তাহলে আজকের দিনটাও যাবে না।
তারমানে আপনি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন?
একজন ডাক্তার কখনও রোগীর ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয় না। দিলেও এই বিশ্বাসটুকু রাখে যে প্রকৃতি রোগীর প্রতি দয়া দেখালেও দেখাতে পারে। ভেতরে কিছু জমাট বাঁধলে রক্তক্ষরণটা বন্ধ হবে। কাশলে আর জমাট বাঁধবে না, তাতে রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হবে।
তাহলে আপনার মতে আমার এখন এই যুবককে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা উচিত?
ডাক্তার কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, সবচেয়ে ভাল হয় ওকে একা থাকতে দিলে। প্রথমত-এখন ও ক্লান্ত এবং ওর শরীরে শক্তি নেই তেমন; আপনার কথায় মনোযোগ দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত-পরে ও পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে চলে যাবে, আপনার কথা কিছুই বুঝবে না। কিন্তু থিবল্ট সবই শুনতে পাচ্ছে। লোকে একটা ভুল ধারণা নিয়ে থাকে-মনে করে যে খুব অসুস্থ মানুষ কিছু শুনতে পায় না, কিন্তু মানুষটা সবই শুনতে পায়। অবশ্য থিবল্টের আত্মাটা এই শরীরের নয়। হয়তো এ কারণেই শারীরিক দুর্বলতা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না ওর ওপর।
পেছনের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করলেও সামনেরটাতে শুধু ঠাণ্ডা পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে রাখতে নির্দেশ দিল ডাক্তার। একটা পানির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মেশাল সে। পাদ্রীকে বলল পানি চাইলে রোগীকে যেন এটা দেয়। পরের দিন সকালে আবার আসবে বলল। যদিও আশঙ্কা করল আসাটা বৃথাই হবে।
থিবল্ট কিছু বলতে চাইলেও শরীরের দুর্বলতার জন্য পারল না। পাদ্রীও ওকে ঝাঁকিয়ে ওঠাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। পাদ্রীর চেষ্টাটা থিবল্টের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। পাদ্রীর ভাগ্য ভাল থিবল্টের অতিমানবীয় ক্ষমতা এখন কাজ করছে না। নয়তো বেচারাকে বহুবার নরক ঘুরে আসতে হত।
একসময় ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গরম লাগতে শুরু করল। শরীরের রক্ত যেন গরম পানির মতো ফুটতে শুরু করেছে। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আটকে থাকা চোয়াল খুলে গেল। অসার জিভে সার ফিরল।
ডাক্তার যেই ঘোরের কথা বলেছিল, সম্ভবত সেই ঘোরে চলে যাচ্ছি। বেশ অনেকটা সময়ের জন্য এটাই ছিল ওর শেষ স্বাভাবিক চিন্তা।
হরিণের পিছু ধাওয়া থেকে শুরু করে গত রাত পর্যন্ত সব ঘটনা একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে থিবল্টের। কাউন্টেসের হাতে চুমু খাওয়ার পর ও পালাচ্ছে। একটা তেরাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিন রাস্তার মাথায় তিনজন মানুষ পাহারা দিচ্ছে। প্রথমজন ডুবন্ত ম্যাকোট। দ্বিতীয়জন হাসপাতালে জ্বরের ঘোরে মৃত্যুপথযাত্রী ল্যান্ড্রি। তৃতীয়জন আহত বিধ্বস্ত এক পা নিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকা একজন মানুষ, কোত দু মন-গুবে।
ও এক এক করে সবার গল্প বলতে থাকল। এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে একপর্যায়ে আহত লোকটার চেয়েও ফ্যাকাসে হয়ে গেল পাদ্রীর চেহারা। মৃত্যুপথযাত্রী লোকটার চেয়েও বেশি কাঁপছে সে। পাদ্রী ওকে পাপমুক্ত করতে এগোতে চাইলে থিবল্ট তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। বিচিত্র এক হাসি হেসে উচ্চস্বরে বলল, আমার কোন পাপমুক্তি নেই! আমি অভিশপ্ত। আমার নিয়তি নির্ধারিত!
এই ঘোরের মধ্যেও থিবল্ট ঘড়ির ঘন্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। ঘণ্টা বাজছে আর ও গুনছে। ঘড়িটার আকৃতি হয়ে গেছে বিশাল সংখ্যাগুলো যেন আগুনের শিখা। ঘড়িটা হচ্ছে অনন্তকাল। প্রকাণ্ড পেন্ডুলামটা যেন এপাশ ওপাশ দুলছে আর বলছে, কখনও না। সবসময়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে ও এই লম্বা দিনটা পার করল। এক সময় নটার ঘণ্টা বাজল। সাড়ে নটায় আবার যে যার শরীর ফিরে পাবে। ঘণ্টার শেষ ধ্বনিটা মিলিয়ে যেতেই জ্বরটা চলে গেল। তার পেছন পেছন এক শীতলতার অনুভব। শীতে কাঁপতে লাগল থিবল্ট। চোখ খুলল। পাদ্রী বিছানার পায়ের কাছে বসে প্রার্থনা করছে। ঘড়ির কাটা সময় সোয়া নটা নির্দেশ করছে। সাড়ে নটা বাজতেই প্রবলভাবে শরীরটা কাঁপতে শুরু করল ওর। পা থেকে ধীরে ধীরে সারা শরীর অসাড় হয়ে যেতে শুরু করল। কপালে ঘাম জমছে। না ও নিজে মুছতে পারছে, না কাউকে বলতে পারছে মোছার কথা। অদ্ভুত সব আকৃতি দেখতে পাচ্ছে ও। কোনটাই মানুষের নয়। চোখের আলো মরে আসছে। বাদুড়ের মতো ডানা বের হয়ে ওর যেন শরীরটা উড়ে গেল কোন এক অদ্ভুত জায়গায়, যেখানে গোধূলির মতো আবছা আলো বিরাজ করছে। সেটা না জীবন, না মৃত্যু, দুটোরই অংশ যেন। ধীরে ধীরে অন্ধকার বাড়ছে। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছে ও। ডুবে যাচ্ছে কোন এক অন্তহীন গহ্বরে। শুনতে পাচ্ছে কোথাও একটা ঘণ্টা বাজছে।
ঘণ্টাটা একবারই বাজল। শব্দটা মিলিয়ে যেতেই আহত লোকটা কাতর আওয়াজ করে উঠল। পাদ্রী উঠে বিছানার পাশে গেল। সাড়ে নয়টা বাজার ঠিক এক সেকেন্ড পর ব্যারন রাউল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
উনবিংশ অধ্যায় – মৃত এবং জীবিত
ব্যারন যে মুহূর্তে মারা গেল, সেই একই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল থিবল্ট। চারদিকে আগুন জ্বলছে। কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে? চারপাশে থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, নেকড়ে-মানব মরে যাক! জাদুকর নিপাত যাক! না কোন দুঃস্বপ্ন নয়, ওর বাড়ির ওপর আক্রমণ এসেছে।
আর বেশি দেরি করলে জ্যান্ত পুড়ে মরতে হবে। শুয়োর-মারা-বর্শাটা হাতে নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে দৌড় দিল থিবল্ট। ওকে দেখার সাথে সাথে আরও জোরে রব উঠল, মারো ওকে! মারো! ওর পাশ দিয়ে কয়েকটা গুলি ছুটে গেল। এরা যে লর্ড ভেযের লোক তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আইন আর ওর জন্য প্রযোজ্য নয়। ওকে শেয়ালের মতো আগুন জ্বেলে গর্ত থেকে বের করা যায়। হরিণের মতো ওর উদ্দেশে গুলি ছোঁড়া যায়। সৌভাগ্যক্রমে আগুনটা বেশি ছড়ায়নি, আর কোন গুলিও ওর গায়ে লাগেনি। ছুটে বিশাল অন্ধকার অরণ্যে হারিয়ে গেল ও। দূরে উন্মত্ত জনতার চিৎকার ছাড়া পুরো বন শান্ত। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় এ ঘটনা ঘটেছে, চিন্তা করার মতো বিষয়ের কোন অভাব নেই।
গত চব্বিশটা ঘণ্টা যেন স্বপ্ন ছিল। শপথ করে বলতে পারবে না ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটেছে কি না। দশটার ঘণ্টা বাজতেই চমকে উঠল থিবল্ট। মাত্র আধঘণ্টা আগেও ও রাউলের শরীরে ছিল। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করেছে।
পিউযো এখান থেকে তিনমাইল। যেতে আধঘণ্টা লাগবে। জানা দরকার, ব্যারন শেষ পর্যন্ত বাঁচল না মরল। ওর কথার জবাবেই বাইরে থেকে ভেসে এল বিষণ্ণ ডাক। ওর বিশ্বস্ত অনুচর নেকড়ের দল আবার হাজির হয়েছে।
আয়, আমাদের যেতে হবে। লর্ড ভেযের এক লোক দেখল একজন মানুষ পেছনে ডজনখানেক নেকড়ে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। থিবল্ট যে আসলেই জাদুকর সে বিষয়টা এতে করে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। আরও কেউ যদি থিবকে নেকড়েদের সাথে নিয়ে ওদেরই গতিতে ছুটে যেতে দেখত, তারাও তবে একই কথা ভাবত।
গ্রামের কাছে এসে থামল থিবল্ট। নেকড়েদের দিকে ঘুরে বলল, বন্ধুরা, আজ রাতে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই। আমি একটু একা থাকতে চাই। আশপাশের আস্তাবলগুলোতে যা খুশি করতে পারো। দুপেয়ে জীব, যারা নিজেদের মানুষ বলে, দাবি করে তারা ঈশ্বরের প্রতিরূপ; সেসব দাবির কথা ভুলে যাও, যদি কোনটার দেখা পাও, ভয় পেও না। ইচ্ছামতো তোমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করো! খুশিতে ডাকাডাকি করতে করতে ছড়িয়ে পড়ল নেকড়ের দল। পাদ্রীর বাড়ি গির্জার সাথেই। ক্রুশটাকে এড়ানোর জন্য ঘুরপথে তার বাড়ি গেল থিবল্ট। জানালা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। ঘরে মোম জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে আছে সাদা চাদরের নিচে ঢাকা একটা মানুষ। পাদ্রী সম্ভবত মৃত্যুর খবর কর্তৃপক্ষকে জানাতে গেছে। ঘরে ঢুকল থিবল্ট। বিছানার চাদরটা তুলল। হ্যাঁ, রাউল দু ভোপাফো, কোন সন্দেহ নেই। প্রথম দর্শনে মনে হবে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু একটু ভাল মতো দেখলেই মৃত্যুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
খোলা দরজা দিয়ে পায়ের শব্দ ভেসে এল। ঘরের পেছনদিকের দরজার সামনে পর্দা ঝুলছে। মৃতদেহটা আবার চাদর ঢাকা দিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা এক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ঢুকতে ইতস্তত করছে। আরেক মহিলা উঁকি দিয়ে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করল।
মাদাম, ভেতরে যেতে পারেন। কেউ নেই মনে হচ্ছে। আমি পাহারায় আছি।
বিছানার দিকে এগোল মহিলা। তাকে চিনতে পারল থিবল্ট, এ আর কেউ নয়, গত রাতে দেখা কাউন্টেস স্বয়ং! কপালের ঘাম মুছতে একবার থামল সে। তারপর তুলে ধরল চাদরটা।
ঈশ্বর! ওরা তাহলে সত্যি কথাই বলেছে! হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল কাউন্টেস। কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল এভাবে। অবশেষে দীর্ঘ প্রার্থনার পর সে উঠে দাঁড়াল। উবু হয়ে চুমু খেল মৃত ব্যারনের ক্ষতস্থানে আর কপালে। ওই, রাউল, কে আমাকে তোমার হত্যাকারীর সন্ধান দেবে? কে আমাকে প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করবে? কথাটা শেষ করেই শুনতে পেল, আমি করব! চেঁচিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল কাউন্টেস। সবুজ রঙের পর্দাটা দুলে উঠল। কাউন্টেস ভীতু নয়। বিছানার মাথার কাছে রাখা মোমটা তুলে নিয়ে পর্দাটা সরাল সে। আড়ালে কেউ নেই, শুধু ওপাশের দরজাটা খোলা। পকেট বাক্স থেকে কেঁচি বের করল মাদাম। তারপর কেটে নিল প্রেমিকের মাথার এক গোছা চুল। বুকের কাছে ঝুলে থাকা ভেলভেটের থলেটায় রাখল গোছাটা। শেষ একটা চুমু খেয়ে চাদর টেনে বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে। চৌকাঠ পেরোবার সময় পাদ্রীর সাথে দেখা হয়ে গেল। পিছিয়ে গিয়ে মুখের নেকাব ভাল করে টেনে দিল। সে।
কে আপনি?
আমি শোক, জবাব দিয়ে পাদ্রীকে কাটিয়ে চলে গেল কাউন্টেস।
পায়ে হেঁটেই এসেছিল কাউন্টেস আর তার সঙ্গী-আবার পায়ে হেঁটেই ফিরে যাচ্ছে। গির্জা থেকে মন-গুবে মাত্র আধ-মাইল। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর আড়াল থেকে হঠাৎ তাদের পথ আটকে দাঁড়াল এক লোক। লিযেট চেঁচিয়ে উঠলেও কাউন্টেস জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
আপনি হত্যাকারীর হদিশ জানতে চাওয়ার পর যে বলেছিল আমি করব, সে।
তুমি আমাকে শোধ নিতে সাহায্য করবে? যখন আপনি চান।
এই মুহূর্তে?
এখানে ঠিকমতো কথা বলা যাবে না।
কোথায় যাবে?
আপনার ঘরে বলা যেতে পারে।
কিন্তু একসাথে দুর্গে ঢাকা ঠিক হবে না আমাদের।
না। তবে পার্কের ভাঙা অংশটা দিয়ে যেতে পারি। মঁসিয়ে রাউল যেখানে তার ঘোড়া রাখতেন, মাদমোয়াজেল লিযেট সে ঘরটার কাছে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। প্যাচানো সিঁড়িটা দিয়ে আমাকে ওপরে, আপনার ঘরে নিয়ে যেতে পারেন। আপনি যদি ড্রেসিংরুমে থাকেন, গতরাতে মঁসিয়ে রাউলের মতো আমিও অপেক্ষা করতে পারি।
দৃশ্যত দুই মহিলাই কেঁপে উঠল।
এতসব খুঁটিনাটি আপনি কীভাবে জানলেন? প্রশ্ন করল কাউন্টেস।
সময়মতো সব বলব আপনাকে। কাউন্টেস একটু ভাবল। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, বেশ, ওভাবেই আসুন। লিযেট আপনার অপেক্ষায় থাকবে।
লিযেট বলল, ওহ, মাদাম, এই লোকটাকে আপনার কাছে নেয়ার সাহস আমার কখনও হবে না।
সেক্ষেত্রে আমি নিজেই যাব।
ভাল বলেছেন! মন্তব্য করল থিবল্ট। সত্যিকারের নারী বলতে হলে আপনার কথাই বলতে হয়। তারপর রাস্তার পাশে নেমে গেল ও। লিযেটকে দেখে মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে।
কাউন্টেস লিযেটকে বলল, আমার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটো। আমার জানতে হবে, লোকটা কী বলতে চায়।
খামার হয়ে দুর্গে প্রবেশ করল দুই মহিলা। কেউ ওদের বেরোতে বা ঢুকতে দেখেনি। ঘরে পৌঁছে লোকটাকে আনার জন্য লিযেটকে পাঠিয়ে দিল কাউন্টেস। মিনিট দশেক বাদে ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে ফিরে এল লিযেট। মাদাম, লোকটাকে আনার জন্য আমার যাবার কোন দরকার ছিল না।
কী বলছ তুমি!
লোকটা উপরে ওঠার রাস্তা চেনে। আর সে আমাকে কী বলেছে যদি শুনতেন! আমার মনে হচ্ছে লোকটা সাক্ষাত শয়তান!
ওকে ভেতরে নিয়ে এসো।
আমি এখানে? ঘোষণা করল থিবল্ট।
তুমি এখন যেতে পারো, লিযেটকে উদ্দেশ্য করে বলল কাউন্টেস। থিবল্টের সাথে একা হয়ে গেল সে। থিবল্টের বেশভূষায় আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু নেই। ওর ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, চোখে অশুভ একটা দ্যুতি খেলা করছে। লাল চুল ঢাকার কোন চেষ্টাই আজ করেনি ও। মাথার ওপর অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে ওগুলো। তারপরও কাউন্টেস কোনরকম ভাবান্তর ছাড়াই ওর মুখের দিকে তাকাল। আমার পরিচারিকা বলল, তুমি আমার ঘরের রাস্তা চেনো। আগে কখনও এসেছিলে?
হ্যাঁ, মাদাম, একবার।
সেটা কবে?
গত পরশু।
কখন?
সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে।
কাউন্টেস কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল।
মিথ্যে বলছ।
জানতে চান আর কী কী ঘটেছে সে রাতে?
যে সময়ের কথা বললে, সে সময়ের মধ্যে?
সে সময়ের মধ্যে।
বলো।
থিবল্ট বলতে শুরু করল, মঁসিয়ে রাউল এই দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন। করিডোরের দিকের দরজা দেখাল থিবল্ট। লিযেট তাকে এখানে একা ছেড়ে গিয়েছিল। ড্রেসিংরুমের দরজা দেখিয়ে বলল, আপনি এই দরজা দিয়ে এসে তাকে হাটু গেড়ে থাকতে দেখেন। আপনার চুলে হীরার পিন লাগানো ছিল। সিল্কের গোলাপী একটা গাউন পরে ছিলেন আপনি। গলায় ছিল মুক্তোর মালা।
আমার জামার বর্ণনা তো ঠিকমতোই দিলে। বলতে থাকো।
মঁসিয়ে রাউলের সাথে ঝগড়া করার চেষ্টা করলেন আপনি। প্রথমে করিডোরে আপনার পরিচারিকাকে চুমু খাওয়া নিয়ে, পরে এনেভিলা আর ভিলারস-কটেরেটের রাস্তায় অনেক রাতে কার সাথে দেখা হয়েছিল তা নিয়ে, শেষে নাচের আসরে মাদাম দু বোনোইয়ের সাথে চারবার নাচা নিয়ে।
তারপর…?
জবাবে আপনার প্রেমিক ভাল-মন্দ কিছু অজুহাত দাঁড় করাতে লাগল। আপনিও খেলাচ্ছলে তাকে ক্ষমা করতে লাগলেন। আর এমনি সময় লিযেট দৌড়ে এসে মঁসিয়ে রাউলকে পালাতে বলল। জানাল, আপনার স্বামী আসছে।
লিযেট ঠিকই বলেছে, তুমি সাক্ষাৎ শয়তানই হবে, তিক্ত একটা হাসি দিল কাউন্টেস। আমার মনে হচ্ছে আমরা একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারব…তোমার কথা শেষ করো।
ব্যারন রাউলের প্রস্থান থেকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ঘটনা বর্ণনা করল থিবল্ট। এ পর্যায়ে কাউন্টেস জানতে চাইল, কাউন্ট একা ছিল?
দাঁড়ান…কাউন্টকে একাই মনে হয়েছিল। কিন্তু কাঁধে আঘাত পাওয়ার পর তিনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, লেস্টক, বাঁচাও বলে। তারপর ব্যারন তার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে কাউন্টের পায়ে আঘাত করলেন, যেমন তার ঘোড়াকে করা হয়েছিল। কাউন্টকে খোঁড়া করে দিয়ে ব্যারন উঠে দাঁড়াতেই লেস্টক পেছন থেকে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় তার শরীরে। পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায় ফলাটা। ক্ষতটা কোথায় আপনি জানেন্য সেখানে আপনি চুমু খেয়েছেন।
তারপর?
ব্যারনকে মরার জন্য ফেলে রেখে কাউন্ট আর তার সঙ্গী দুর্গে ফিরে গেলেন। ব্যারনের জ্ঞান ফিরলে বহু কষ্টে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি। পথচারীরাই তাকে বয়ে নিয়ে যায় পাদ্রীর কাছে। যেখানে আপনি আজ তাকে দেখেছেন, সেখানেই ঠিক সাড়ে নটার পর পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়াল কাউন্টেস। গহনার বাক্স খুলে মুক্তোর মালাটা বের করে থিবল্টের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।
এটা কেন?
নাও, এর দাম পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর উপর হবে।
এখনও প্রতিশোধ নিতে চান?
হ্যাঁ।
তাহলে আরও বেশি লাগবে।
কত? আগামীকাল রাতে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন, আমি জানাব।
কোথায় অপেক্ষা করব?
এখানেই, নিচু স্বরে বলল থিবল্ট, ওর চোখে বুনো পশুর দৃষ্টি।
আমি অপেক্ষা করব।
আগামীকাল তাহলে দেখা হচ্ছে।
হ্যাঁ, আগামীকাল। থিবল্ট চলে গেল। মালাটা রেখে দিল কাউন্টেস। তারপর খুলে ফেলল বাক্সের নিচের লুকানো একটা ঢাকনা। রঙিন তরল ভরা একটা ছোট বোতল আর খাটো একটা ড্যাগার বের করল। রত্নখচিত হাতল আর স্বর্ণালী ফলা ড্যাগারটার। দুটোই বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল সে। তারপর প্রার্থনা সেরে পোশাক পাল্টে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়।
২০. প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত
বিংশ অধ্যায় – প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত
কাউন্টেসের সাথে দেখা করে বেরোনোর পর, সত্যিকার অর্থে যাওয়ার কোন জায়গা খুঁজে পেল না থিবল্ট। ঘর পুড়ে গেছে, কোন বন্ধুও নেই। কেইনের মতো পৃথিবীর বুকে সে-ও এখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে। শেষ আশ্রয় হিসেবে তাই বনের দিকেই ফিরে গেল। দিনের শেষভাগে বনের কাছে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি চোখে পড়ল থিবল্টের। অর্থের বিনিময়ে একটা রুটি খেতে চাইল সেখানে। বাড়ির কর্তা তখন ঘরে ছিল না। কত্রী রুটি দিলেও টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানাল। ওর বেশভূষা মহিলাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যাই হোক, চলার মতো খাবার পেয়ে বনে ঢুকে পড়ল ও। রাতে বিশ্রাম নেয়ার জন্য পছন্দসই একটা জায়গা খুঁজতে লাগল। হঠাত্র ঢালের নিচে চকচকে কিছু একটা চোখে পড়ল ওর। একটা মৃতদেহের কাঁধের বেল্টে লাগানো রূপোর ব্যাজ। মৃতদেহ না বলে কংকাল বলাই ভাল। লাশটার আশপাশ দেখে মনে হয়। মাত্র গতরাতেই ওখানে ফেলা হয়েছে ওটা, কিন্তু শরীরে কোন মাংস অবশিষ্ট নেই!
নিশ্চয়ই আমার নেকড়েদের কাজ। দেখা যাচ্ছে আমার অনুমতি পেয়ে ওরা ভালই ভোজ সেরেছে!
মৃতদেহটা কার জানার কৌতূহল হলো। ব্যাজে নাম লেখা আছে। খাবার যোগ্য নয় বলে নেকড়েরা ওটা ছুঁয়েও দেখেনি।
ব্যাজটা তুলে দেখল থিবল্ট। জে. বি. লেস্টক! কোঁত দু মন-গুবের লোক।
চমৎকার! হেসে উঠল ও, অবশেষে একজন পাওয়া গেল যে কিনা খুন করে পার পায়নি!
কিন্তু একটা কথা মনে হতেই ভুরু কুঁচকে গেল থিবল্টের। হাসি থামিয়ে নিচু গলায় নিজেকে প্রশ্ন করল ও, তাহলে কি লোকে যেমন বলে, ঈশ্বরের বিচার বলে আসলেই কিছু আছে?
লেস্টক সম্ভবত মনিবের কোন আদেশ পালন করতে মন-গুবে থেকে লোপো যাচ্ছিল। পথে নেকড়ের আক্রমণের শিকার হয় সে। যে ছুরির আঘাতে ব্যারন রাউল নিহত হয়েছে ওই একই ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল শিকারি। বলা বাহুল্য-সফল হয়নি। একটু দূরেই ছুরিটা খুঁজে পেল থিবল্ট।
থিবল্ট সবকিছুর ব্যাপারে খুব নির্লিপ্ত বোধ করে এখন। লেস্টকের মৃত্যুতে না পেল আনন্দ, না কোন দুঃখ। শুধু এটাই মনে হলো যে কাউন্টেসের কাজটা আরেকটু সহজ হয়ে গেল এতে। এখন শুধু তার স্বামীই বাকি আছে। দিনটা পার করার জন্য একটা পাথরের ছায়া খুঁজে নিল থিবল্ট। দুপুরের দিকে শুনল লর্ড ভেযের শিঙার আওয়াজ। লোকটা আবার শিকারে বেরিয়েছে। তবে থিবল্টের দিনটা নিরুপদ্রবেই কাটল।
রাত নটা বাজতে মন-গুবের দুর্গে হাজির হলো ও। একই জায়গায় অপেক্ষা করছে লিযেট। তবে আজ ওকে শঙ্কিত এবং উৎকণ্ঠিত বলে মনে হলো। আগের মতো মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেল থিবল্ট। কিন্তু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল মেয়েটা।
আমাকে ছোঁবে না, নয়তো আমি চেঁচাব!
আচ্ছা! তা সুন্দরী, আগের দিন ব্যারন রাউলের সাথে তো এমন আচরণ করোনি।
হয়তো না, কিন্তু তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে।
আরও জল গড়াবে, উৎসাহ ফুটল থিবল্টের কণ্ঠে।
হয়তো, শোকাভিভূত গলায় বলল মেয়েটা। তারপর সামনে এগোতে শুরু করে বলল, আসতে চাইলে আমার পেছন পেছন আসো।
আড়াল দিয়ে যাওয়ার কোন চেষ্টাই করল না মেয়েটা।
আজ তোমাকে খুব সাহসী মনে হচ্ছে। কেউ যদি আমাদের দেখে ফেলে…
ভয় নেই, দেখার মতো চোখ সবগুলোই আজ বন্ধ!
কথার অর্থ না বুঝলেও বলার সুরটা শিউরে তুলল ওকে।
ওপরে দরজা খোলার জন্য হাত রাখতে লিযেটকে থামাল থিবল্ট। বাড়িটার নিস্তব্ধতা ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে কারও অভিশাপ পড়েছে জায়গাটার ওপরে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি।
কাউন্টেসের ঘরে?
হ্যাঁ, কাউন্টেসের ঘরে।
উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?
হ্যাঁ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভেতরে যাও। দরজা খুলে দিল লিযেট। তারপর থিবল্ট ভেতরে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।
ঘরটা একইরকম আছে। আগের মতোই আলোকিত, সুগন্ধি ভেসে বেড়াচ্ছে। কাউন্টেসকে খুঁজল ও। আশা করল ড্রেসিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াবেন, কিন্তু দরজাটা বন্ধই থাকল। ঘড়ির টিক টিক আর ওর বুকের ধুক ধুক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। একটা অপরিচিত ভয়ের অনুভূতি ওর ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ভাল করে চারপাশে আরেকবার লক্ষ করতেই চমকে উঠল থিবল্ট-বিছানায় শুয়ে আছে কাউন্টেস! চুলে সেই হীরার পিন লাগানো, গলায় সেই মুক্তোর হারটাও আছে। সে রাতের একই পোশাক তার পরনে। থিবল্ট এগিয়ে গেল, কিন্তু কাউন্টেস নড়ল না।
ঝুঁকে প্রশ্ন করল থিবল্ট, ঘুমাচ্ছেন, কাউন্টেস?
উত্তর নেই! থিবল্টের ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল। কাউন্টেস ঘুমাচ্ছে, কিন্তু সেই ঘুম কি এই দুনিয়ার না অনন্তকালের?
কাঁপা কাঁপা হাতে বাতিদান থেকে আলো এনে কাউন্টেসের ঘুমন্ত মুখের ওপর ধরল ও। ফ্যাকাসে মুখ, কপালে শিরার রেখা দেখা যাচ্ছে, আর ঠোঁটটা এখনও লাল। এক ফোঁটা মোম গলে পড়ল ঘুমন্ত মুখের ওপর। কিন্তু ঘুম ভাঙল না মাদামের।
আহ! কী হচ্ছে এসব! মোমবাতিটা নামিয়ে রাখল থিবল্ট। কাঁপা হাতে ওটা আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। কাউন্টেসের দুহাতের মুঠিতে কিছু ধরা আছে মনে হলো ওর। অনেক চেষ্টার পর খুলতে পারল মুঠি দুটো। এক হাতে রয়েছে একটা ছোট বোতল আরেক হাতে এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা-প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত! হ্যাঁ, আমৃত্যু স্থিরচিত্ত এবং বিশ্বস্ত। কারণ কাউন্টেস আর বেঁচে নেই!
থিবল্টের সমস্ত কল্পনা একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, যেমন করে রাতের স্বপ্ন ভোরে মিলিয়ে যায়।
কপালের ঘাম মুছল থিবল্ট। দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে এল। লিযেট হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছে।
কাউন্টেস তাহলে মারা গেছেন?
কাউন্ট, কাউন্টেস দুজনেই।
ব্যারন রাউলের আঘাতের ফলে?
না, কাউন্টেসের ছুরির আঘাতে।
এই পরিস্থিতিতে জোর করে হাসতে গিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল থিবল্ট, তুমি যে গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছ, তা আমার কাছে নতুন।
লিযেট তখন পুরো ঘটনাটা বলল। সরল, কিন্তু হৃদয়বিদারক সে কাহিনী।
প্রায় সারাদিন নিজের ঘরেই ছিল কাউন্টেস। গ্রাম থেকে ভেসে আসছিল ঘণ্টাধ্বনি। ব্যারনের লাশ ভোপাফোতে নেয়া হচ্ছে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করার জন্য। চারটার দিকে ঘণ্টা বন্ধ হলে কাউন্টেস জামার নিচে ড্যাগার লুকিয়ে নিয়ে স্বামীর ঘরের দিকে যায়। কাউন্টের দরজায় দাঁড়ানো পরিচারক খুব খুশি হয় তাকে দেখে। ডাক্তার বলে গেছেন, কাউন্ট এখন বিপদমুক্ত।
মাদাম নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন-এটা আনন্দের খবর।
আনন্দের খবর তো বটেই। বলে স্বামীর ঘরে ঢুকে পড়ে কাউন্টেস। পাঁচমিনিট পরে আবার বেরিয়ে আসে। কাউন্ট ঘুমোচ্ছেন। উনি না ডাকলে ভেতরে যেও না।
মাথা ঝুঁকিয়ে সায় জানায় পরিচারক। তারপর বসে কখন মনিবের ডাক আসে তার অপেক্ষা করতে লাগল।
কাউন্টেস ফিরে গেল নিজের ঘরে। পরিচারিকাকে ডেকে বলল, লিযেট, আমার পোশাক বদলে দাও। ওর সাথে শেষ দেখার সময় যে পোশাক পরে ছিলাম সেগুলো দাও।
হুবহু সেই একই পোশাক পরল কাউন্টেস। তারপর একটা কাগজে কিছু লিখে ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
মাদাম, কিছু খাবেন না?
বাঁ হাতের মুঠি খুলে একটা ছোট একটা বোতল দেখাল কাউন্টেস।
খাব, লিযেট, এই বোতলে যা আছে সেটা।
সে কী! আর কিছু খাবেন না?
এটাই যথেষ্ট, লিযেট। এটা খাওয়ার পর আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন পড়বে না। বোতলটা খুলে মুখে উপুড় করে দিল সে। তারপর বলল, লিযেট, গতকাল রাস্তায় যে লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল, সে সাড়ে নটার সময় আবার আসবে। তুমি গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে এসো। আমি চাই না কেউ বলুক আমি কথা দিয়ে কথা রাখি না। এমনকি সেটা আমার মৃত্যুর পরে হলেও।
থিবল্টের কিছু বলার ছিল না। কাউন্টেস তার কথা রেখেছে। পার্থক্য কাউন্টেস একাই তার প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে। কাউন্টের পরিচারকের একসময় অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। আস্তে করে ঘরের ভেতর উঁকি দেয় সে। এবং দেখে বুকে ছুরি নিয়ে নিথর অবস্থায় পড়ে আছে কাউন্টের মৃত দেহ! আর্ত চিৎকার করে ওঠে সে। তারপর দৌড়ে-মাদামকে জানাতে এসে আবিষ্কার করে যে মাদামও মারা গেছে।
মালিক-মালকিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে দুর্গে। মৃত্যু-দেবতা হানা দিয়েছেন, এই ভয়ে চাকর-বাকর সবাই পালিয়ে যায়। শুধু পরিচারিকা লিযেট তার মালকিনের শেষ নির্দেশ পালন করতে রয়ে গেছে।
এখানে থিবল্টের আর কিছু করার নেই। লিযেটকে কাউন্টেসের কাছে রেখে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এল ও। আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। জানুয়ারি মাস না হলে বলা যেত এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। রাস্তায় আলো খুব অল্প। এক-দুবার থেমে দাঁড়াল থিবল্ট। ওর মনে হলো যেন পথের দুপাশে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের শাখা ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে।
ভাঙা দেয়ালের কাছে আসা মাত্র থিবল্ট শুনতে পেল, এই সেই লোক! তারপরই চারপাশ থেকে চারজন পুলিশ ওকে চেপে ধরল।
লিজেটের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয়ে রাতে টহল দিচ্ছিল খামোজি। তখনই এক অদ্ভুত লোককে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসতে দেখে সে। পুলিশকে সেটা জানিয়েও আসে। সাম্প্রতিক নানান দুর্ঘটনার পর একথা শুনে চারজন পুলিশকে পাঠানো হয় সন্দেহজনক কোন লোককে দেখলে ধরে আনার জন্য। খামোজির সংকেত পাওয়া মাত্রই তারা চারজনে মিলে থিবল্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
নিরস্ত্র থিবল্টের প্রতিরোধ কোন কাজে আসল না। পুলিশরা ওকে চিনে ফেলেছে। মাটিতে পেড়ে বেঁধে ফেলা হলো ওকে। গত কিছুদিনের ঘটনাবলিতে থিবল্ট অনেক দুর্নাম কামিয়ে ফেলেছে। ওর আশেপাশে প্রচুর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য নিজের অশুভ ক্ষমতার বলে চাইলেই পুলিশদেরকে মেরে ফেলতে পারে থিবল্ট। কিন্তু ও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। একটা ইচ্ছাও যদি
অবশিষ্ট থাকে, বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখলেও, মানুষের বিচার এড়ানো ওর জন্য কোন সমস্যা না।
দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল পুলিশেরা। জাদুকর হয়েও কেন থিবল্ট ওদের হাতে ধরা পড়ল তা নিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগল। হাসাহাসি আর বিদ্রূপ চলছে সমানে। থিবল্টের জবাব ছিল একটা প্রচলিত প্রবাদ, শেষ হাসিই সার্থক হাসি। জবাবে পুলিশেরা বলল ওদের ধারণা শেষ হাসিটাও ওরাই হাসবে।
পিউযো পেরিয়ে বনে প্রবেশ করল ওদের দলটা। কালো মেঘ অনেক নিচে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে গাছগুলো কালো চাদর মাথায় দিয়েছে। চার-পা সামনে কী আছে দেখা যায় না। তবে থিবল্ট ঠিকই দেখতে পাচ্ছে যে আশেপাশে অনেকগুলো আলোর বিন্দু ঘোরাফেরা করছে। ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে সেই বিন্দুগুলো। একসময় শুকনো পাতায় ছন্দময় পদচারণার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। পুলিশদের ঘোড়াগুলো অস্থির হয়ে বাতাসে নাক টানছে। ঘোড়াগুলোকে কাঁপতে দেখে পুলিশদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। এবার থিবল্টের হাসার পালা।
হাসছ কেন? জিজ্ঞেস করল একজন।
তোমাদের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে দেখে হাসছি।
থিবল্টের কণ্ঠ শুনে আলোর বিন্দুগুলো আরও কাছে চলে এল। পায়ের শব্দ আরও পরিষ্কার শোনা যেতে লাগল। গা শিউরে ওঠার মতো কিছু শব্দ কানে এল ওদের-চোয়াল খোলা আর বন্ধ হবার শব্দ, দাঁতে দাঁত ঘষা খাবার শব্দ।
তো, বন্ধুরা, মানুষের মাংসের স্বাদ তো তোমরা পেয়েছ, এবং তোমাদের ভালও লেগেছে! আলোর বিন্দুগুলোর উদ্দেশে বলল থিবল্ট।
জবাবে আধা-কুকুর আধা-হায়নার মতো মৃদু গরগর ধ্বনি শোনা গেল।
বুঝতে পেরেছি। শিকারির স্বাদ পাওয়ার পর এবার পুলিশের স্বাদ পেতে আপত্তি নেই তোমাদের।
পুলিশেরা এরইমধ্যে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। অ্যাই! কার সাথে কথা বলছ তুমি?
যারা আমার ডাকের জবাব দিতে পারে, বলেই নেকড়ের মতো করে ডাক ছাড়ল থিবল্ট। জবাবে বিশটা বা তারও বেশি ডাক শোনা গেল। কিছু খুব কাছে, কিছু খানিকটা দূরে।
এগুলো কি শ্বাপদ? আমাদের পিছু নিয়েছে? এই অকর্মণ্যটা মনে হচ্ছে পশুগুলোর ভাষা বোঝে?
কী মনে হয়! তোমরা রাতের বেলা বনের মধ্যে দিয়ে নেকড়েদের নেতা থিবল্টকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছ। আর জিজ্ঞেস করছ তোমাদের পিছু নেয়া আলো আর ডাক কীসের? চেঁচাল থিবল্ট, বন্ধুরা শুনেছ? এই ভদ্রলোকেরা জিজ্ঞেস করছে তোমরা কারা? জবাব দাও, একসাথে, যাতে ওদের মনে আর কোন সন্দেহ না থাকে।
নেকড়েরা বাধ্যগতের মতো দীর্ঘ একটা ডাক ছাড়ল। সেই ভয়াবহ শব্দ শুনে ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল। দুয়েকটা পিছিয়েও গেল। পুলিশেরা ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণীগুলোকে শান্ত করার প্রয়াস পেল।
এটা তো কিছুই না, অপেক্ষা করো। যখন একেকটা ঘোড়ার পেছনে লাগবে দুটো করে নেকড়ে, আরও, একটা ঘোড়ার গলা কামড়ে ঝুলে থাকবে তখন দেখো।
নেকড়েরা ঘোড়ার পায়ের নিচে চলে এল। থিবল্টের গায়ে গা ঘষতে লাগল ওরা। একটা পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে থিবল্টের বুকে থাবা রাখল। যেন অনুমতি চাইছে।
ধীরে বস, ধীরে। অনেক সময় আছে। স্বার্থপর হয় না। সবাইকে আসতে দাও।
ঘোড়াগুলোকে আর বশে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
একটা চুক্তিতে আসি চলল, থিবল্ট বলল। তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, তাহলে আজ রাতে নিজের বিছানায় ঘুমাতে পারবে।
আমরা যদি খুব ধীরে আগাই, তাহলে সমস্যা হবে না, বলল এক পুলিশ।
আরেকজনের বুট কামড়ে ধরল এক নেকড়ে। সে তলোয়ার বের করে জানোয়ারটার শরীরে ঢুকিয়ে দিল। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পড়ে গেল ওটা।
খুব বোকার মতো কাজ করলে। নেকড়েদের নিজেদের মাংস খেতে কোন আপত্তি নেই। একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে, এমনকি আমিও ওদের ঠেকাতে পারব না।
নেকড়েরা ওদের আহত সঙ্গীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই সুযোগে পুলিশের দল থিবল্টকে নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। থিবল্ট যা ধারণা করেছিল তা ই হলো। আহত নেকড়েটাকে খেয়ে নেকড়েগুলো ঝড়ের মতো ওদের পিছু ধাওয়া করল।
ঘোড়াগুলো দৌড়ানো শুরু করার পর আর গতি কমাতে রাজি হলো না। সওয়ারিরা যতই চেষ্টা করুক, ভয়ে পূর্ণ গতিতে ছুটছে ঘোড়া। থিবল্টের দড়ি ধরে রাখা পুলিশটাও দড়ি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ঘোড়া সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুরো নেকড়ের পাল ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলোর ওপর। নেকড়ের দাঁত শরীরে ফোঁটার সাথে সাথে ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল।
থিবল্ট চিৎকার করে নেকড়েগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে। তবে তা না করলেও চলত। একেকটা ঘোড়ার পেছনে পাঁচ-সাতটা করে নেকড়ে জুটে গেছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল থিবল্ট। ঘোড়া আর নেকড়েরা একেক দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের আতঙ্কিত চিৎকার, ঘোড়ার যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ, নেকড়ের ডাক ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে।
থিবল্ট আরও একবার মুক্ত, এবং যথারীতি একা। তবে ওর হাত এখনও বাঁধা। দাঁত দিয়ে বাঁধন কাটার চেষ্টা করল ও, গায়ের শক্তিতে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দড়ি খুলল না। লাভের মধ্যে দড়ি কেটে বসে যেতে লাগল। চামড়ায়। কোনভাবেই খুলতে না পেরে আকাশের দিকে হাত তুলে ও বলল, কালো নেকড়ে! আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও। তুমি তো জানো আমি আরও অনিষ্ট করার জন্যই এই বাঁধন খুলতে চাইছি।
সাথে সাথেই ওর হাত বেঁধে রাখা দড়ি খুলে মাটিতে পড়ে গেল।
একবিংশ অধ্যায় – মেধাবী শয়তান
থিবল্ট ওর ঘরের অবস্থা দেখতে গেল। ছাইয়ের ভগ্নস্তূপ পড়ে আছে। ওর নেকড়েগুলো ধ্বংসস্তূপকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ভঙ্গীতে তীব্র ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। ওরা যেন বুঝতে পারছে, কালো নেকড়ের কল্যাণে নেতা হিসেবে যাকে পেয়েছে, এই পোড়াস্থূপের কারণে সে এখন ভুক্তভোগীতে পরিণত হয়েছে। থিবল্ট ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ডেকে উঠে আর অঙ্গভঙ্গি করে থিবন্টকে বলার চেষ্টা করল, প্রতিশোধ নিতে ওকে সাহায্য করবে ওরা।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল থিবল্ট। তাকিয়ে থাকল পোড়া ঘরটার দিকে। অসুখী সব চিন্তারা এসে ভিড় করছে ওর মনে। তবে একবারও এটা ভাবল না, এগুলো ওর ঈর্ষাকাতর উচ্চাকাঙ্ক্ষারই ফলাফল। যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ওর ভেতর কোন দুঃখবোধ কাজ করল না। বরং এখন সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে যারা ওর ক্ষতি করেছে, তাদের জবাব দিতে পারবে ও।
নেকড়েরা ডাকছে। থিবল্ট বলল, হ্যাঁ বন্ধুরা, তোমাদের ডোক আমার অন্তরের কান্নার জবাব দিচ্ছে। মানুষ আমাদেরকে ঘৃণা করে। ওদের কাছ থেকে আমরা দয়া বা করুণা আশা করতে পারি না। ওরা আমাদের শত্রু। ওদেরও আমরা কোনরকম দয়া বা করুণা দেখাব না। চলো, দুর্গে যাই। যে ধ্বংস ওরা এখানে নিয়ে এসেছে, আমরা সেটাকে আবার ওখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।
বেরিয়ে পড়ল থিবল্ট, নেকড়েদের নেতা এখন দস্যুদলের নেতার মতো অনুসারীদের নিয়ে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।
হরিণ বা অন্য কোন প্রাণী নয়, ওদের লক্ষ্য এখন ভেযের প্রাসাদ-দুর্গ। থিবল্টের প্রধান শত্রু ব্যারনের আস্তাবল ভর্তি ঘোড়া আছে, আছে গরু, ভেড়া। পরদিন সকালে, দুটো ঘোড়া, চারটা গরু আর দশটা ভেড়ার মৃতদেহ পাওয়া গেল।
ব্যারন কিছুটা সন্দিহান হয়ে পড়ল। এটা কি নেকড়েদের আক্রমণ? পশুর আক্রমণ হলেও, কোথায় যেন চিন্তার ছাপ লক্ষ করা যায়। চিহ্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে আক্রমণকারী পশুগুলো নেকড়ে। পরের রাতে আস্তাবলে পাহারা বসাল ব্যারন। কিন্তু সে রাতে বনের অন্যপ্রান্তে ব্যস্ত রইল থিবল্ট। এবার সুসি আর ভিভিয়ারের আস্তাবল আর পার্ক আক্রান্ত হলো। তারপরের রাতে বুলোনা আর ইভ নামক আরও দুটো এলাকা। কাজটা একবার শুরু করার পর আর থামার কোন উপায় নেই। বেপরোয়া নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। থিবল্ট এখন পুরোটা সময় নেকড়েদের সাথেই থাকে। ওদের সাথেই ঘুমায়। ওদের রক্তের তৃষ্ণা চাঙ্গা রাখে।
বনে কাজ করতে যাওয়া কাঠুরে, পাতা-কুড়ানি এবং আরও অনেকে নেকড়ের মুখোমুখি হয়েছে। কেউ বেঁচে গেছে নিজের সাহস আর বুদ্ধির জোরে আর কেউ বা মরেছে। মানুষের নেতৃত্ব পেয়ে নেকড়েরা সুসংবদ্ধ এবং সুশৃঙ্খল একটা দলে পরিণত হয়েছে। যারা সাধারণ হিংস্র পশুর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। অস্ত্র ছাড়া কেউ শহর বা গ্রামের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কারও কাজ শেষ হয়ে গেলে বাকিদের অপেক্ষা করে সে, একা বন পাড়ি দিয়ে ফেরার চেষ্টা করে না। সয়সনের বিশপ গণপ্রার্থনার আয়োজন করলেন। নেকড়েদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য ঈশ্বরের কাছে করুন আবেদন জানালেন তিনি। প্রচুর বরফ পরার কারণে নেকড়েরা আরও বেশি হিংস্র হয়ে পড়েছে। তবে এমন খবরও আসতে লাগল যে নেকড়েদের সাথে একজন মানুষও আছে। যার উপস্থিতির কারণে নেকড়েরা আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। নেকড়েদের মতোই কাঁচা মাংস খায় সেই লোক! রক্ত দিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। লোকে এমনও বলতে লাগল যে সেই মানুষটা হচ্ছে থিবল্ট!
বিশপ জুতোর কারিগরকে চার্চের আশ্রয় থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করলেন। চার্চের বহিষ্কারাদেশের কারণে থিবল্টের মাথায় বাজ পড়বে-এমন ভরসা লর্ড ভ্যে অবশ্য করে না। শিকারে বেরোতে পারলে হয়তো কিছু করা যাবে। নেকড়েদের দমন করাটা তার অন্যতম প্রধান কাজ। আর সেই নেকড়েদের হাতেই তার গরু-ঘোড়া মারা পড়ায় যারপরনাই ক্ষিপ্ত ব্যারন।
লর্ড ভেয অবশ্য কিছুটা খুশিও, কারণ নেকড়েদের এই উপদ্রব বন্ধ করতে পারলে বিশাল সম্মান পাবে সে। শিকারে প্রবল আগ্রহ তার সাফল্যের সম্ভাবনাকেই শক্তিশালী করল। আবারও দলবল নিয়ে শিকারে বেরোল সে। দিন। রাত লেগে রইল নেকড়েদের পেছনে। স্যাডল থেকে বলতে গেলে নামাই বন্ধ করে দিল। হাউডগুলোকে নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব ছুটে বেড়াতে লাগল সে। সঙ্গে থাকে লেভিলি আর এনগুভা। বিয়ের পর এনগুভার পদোন্নতি হয়েছে। কিন্তু এত ঘুরেও কোন লাভ হলো না। একটা-দুটা দলছুট বা বাচ্চা নেকড়ের দেখা পেলেও, আসল ধাড়ী নেকড়েগুলোর টিকির নাগালও পাওয়া যাচ্ছে না। থিবল্টের কারণে যোগ্য প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হয়েছে শিকারিল।
লর্ড ভেয যেমন সবসময় তার কুকুরের সাথেই থাকছে, থিবল্টও তেমনি অবস্থান করছে নেকড়েদের সাথে। একরাতের আক্রমণের পর একটা নেকড়ের পিছু নিল ব্যারন। সেই নেকড়েটাকে সাহায্য করার জন্য পুরো পালকে সতর্ক রাখল থিবল্ট। নেকডেটা থিবল্টের নির্দেশমত সবরকম ভাবে ফাঁকি দিতে লাগল ব্যারনের দলকে। ওটার শক্তিতে যখন আর কুলাচ্ছে না তখন পালের অন্য নেকড়েগুলোও যোগ দিল। ব্যারনের কুকুরগুলো বুঝে উঠতে পারল না, কোন্ নেকড়েকে ওরা তাড়া করছে। ব্যারন নিজেও মাঝে মাঝে ভুল করতে লাগল।
সেদিনের ব্যর্থতার পর মাঝে মাঝে নেকড়েরাই শিকারিদের পিছু নিতে শুরু করল। কোন হাউন্ড পিছিয়ে পড়লে বা দলছুট হয়ে গেলে সাথে সাথে নেকড়েরা ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। একবার এনগুভা পিছিয়ে পড়েছিল। নেহায়েত ঘোড়াটার কল্যাণে সে যাত্রা ওর জীবন বাঁচল।
ব্যারনের হাউন্ডের দল পাতলা হয়ে এল। নিরন্তর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার কারণে ওগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়তে শুরু করল। সেরা হাউন্ডগুলোর অধিকাংশই মারা পড়ল নেকেড়েদের সুনিয়ন্ত্রিত আক্রমণে।
বাধ্য হয় অন্য রাস্তা ধরল ব্যারন। আশেপাশে সক্ষম যত লোক ছিল, সবাইকে জড়ো করল সে। এত লোক সমাগম হলো যে তারা যেখান দিয়ে যায়, একটা খরগোশও লুকিয়ে থাকতে পারে না।
কিন্তু বিল্ট আগে থেকেই লক্ষ রাখতে লাগল ওরা কোনদিক দিয়ে যাবে। ওরা যেদিক দিয়ে যেত, থিবল্ট ওর পাল নিয়ে তার উল্টোদিকে চলে যেত।
থিবল্ট সাফল্যের সাথে ওর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে লাগল। ব্যারন বা তার লোকজন কেউ একটা নেকড়েকেও খুঁজে পেল না। যদি কোন কারণে থিবল্ট আবিষ্কার করত-ব্যারনের পথ বুঝতে ওর ভুল হয়েছে, তাহলে সতর্কতার স্বার্থে রাতের আঁধারে সবার চোখ এড়িয়ে নেকড়ের পাল নিয়ে অন্য বনে চলে যেত ও। মাসের পর মাস এভাবে চলতে লাগল।
ব্যারন আর থিবল্ট দুজনেই নিষ্ঠার সাথে নিজেদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যারনের অতিপ্রাকৃতিক কোন ক্ষমতা না থাকায় প্রতিপক্ষকে কাবু করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। তবে লর্ড ভভয যেমন অশান্তিতে আছে, তেমনি নেকড়েদের নেতাও শান্তিতে নেই। যা করছে, তার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে না ও। দায়ী ভাবে তাদেরকে, যাদের জন্য ও বাধ্য হয়েছে এসব করতে। মাঝে মাঝে আনলেট এসে হানা দেয় ওর মানসপটে। অ্যানলেট যেন ওর সুখী জীবনের প্রতীক চিহ্ন! চাইলেই মেয়েটা ওর হতে পারত। ওর মনে হয় অ্যানলেটকে ও এখন আরও বেশি ভালবাসে, এতটা ভাল আর কাউকে বাসা ওর পক্ষে সম্ভব না। কখনও কখনও হারানো সুখের জন্য ওর প্রাণ কেঁদে ওঠে।
জরুরী কাজ পড়ায় একদিনের জন্য শিকারে ক্ষান্ত দিয়ে অন্য দিকে যেতে হলো ব্যারনকে। নেকড়েদের একটু শান্তিতে থাকার সুযোগ মিলল।
গ্রীষ্মের এক সুন্দর সন্ধ্যা। অনেকদিন পর নেকড়েদের সঙ্গ ছেড়ে হাঁটতে বেরোল থিবল্ট। মনে পড়তে লাগল সেই সময়ের কথা যখন কোন সমস্যা বা দুশ্চিন্তা ছিল না। এমনই সময় হঠাৎ একটা আর্ত-চিৎকার কানে এল ওর। ভয়ার্ত কণ্ঠে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে কে যেন! অন্যসময় হয়তো পাত্তা দিত না, কিন্তু অ্যানলেটের চিন্তায় ওর মনটা তখন নরম হয়ে আছে। এদিকেই মেয়েটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল ওর।
শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিল থিবল্ট। বিশাল এক নেকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে একটা মেয়ে। থিবল্ট বলতে পারবে না কেন, কিন্তু দৃশ্যটা ওকে নাড়া দিল। দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে পশুটাকে সরিয়ে দিল ও। পাজাকোলা করে তুলে নিল অজ্ঞান-প্রায় মেয়েটাকে, তারপর একপাশে এনে সাবধানে নামিয়ে রাখল ঘাসের ওপর। মেয়েটার মুখের ওপর চাঁদের এক ঝলক আলো এসে পড়তে আবিষ্কার করল থিবল্ট-মেয়েটা আর কেউ নয়, অ্যানলেট!
কাছেই বইছে পানির ধারা, সেখানেই প্রথমবার ওর লাল চুলটা দেখেছিল মেয়েটা। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে এসে অ্যানলেটের চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল থিবল্ট।
চোখ খুলেই আতংকে চিৎকার দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল মেয়েটা। কিন্তু ওকে ধরে ফেলল থিবল্ট, কী হয়েছে? এমনভাবে বলল, যেন এখনও আগের সেই স্যাবট-কারিগর থিবল্টই আছে ও, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, অ্যানলেট?
কেঁদে উঠে বলল অ্যানলেট, হ্যাঁ, পারছি, থিবল্ট, আর পারছি বলেই ভয় পাচ্ছি।
হাঁটুর ওপর বসে হাত জোড় করল মেয়েটা। আমাকে মেরো না, থিবস্ট! কাঁদতে লাগল ও। দয়া করো! আমাকে মেরো না! আমার বুড়ি দাদী বড় কষ্টে পড়ে যাবে। থিবল্ট, মেরো না আমাকে!
আজকের আগ পর্যন্ত থিবল্টের ধারণা ছিল না মানুষ ওকে কী চোখে দেখে। যে মেয়েটা একদা ওকে ভালবেসেছিল, যাকে ও নিজে এখনও ভালবাসে, তার চোখে ভয় দেখে ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল নিজের ব্যাপারে।
আমি তোমাকে মারব, অ্যানলেট? আমি! মাত্রই না তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালাম? ওহ! কতটা ঘৃণা আমাকে করলে তোমার মাথায় এমন একটা চিন্তা আসতে পারে।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি না থিবল্ট। কিন্তু তোমার সম্বন্ধে যা শুনি, তাতে তোমাকে ভয় পাই।
তাই? নিশ্চয়ই জঘন্য সব কথা শোন তুমি আমার নামে! কিন্তু কেউ কি বলে না, কেন থিবল্ট এই অন্যায়গুলো করছে?
স্বর্গীয় নীল চোখজোড়া থিবল্টের দিকে তুলে ধরল অ্যানলেট। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না, থিবল্ট।
বুঝতে পারছ না আমি তোমাকে ভালবাসতাম? তোমাকে পূজা করতাম আমি। তোমাকে হারানোর পর আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
যদি আমাকে ভালইবাসতে, তবে বিয়ে করতে কী বাধা ছিল?
অশুভ আত্মা!
আমিও তোমাকে ভালবাসতাম থিবল্ট। তোমার অপেক্ষা অনেক কষ্ট দিয়েছে আমাকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল থিবল্ট, আমাকে ভালবাসতে?
মৃদু স্বরে, নরম চোখে মেয়েটা উত্তর দিল, হ্যাঁ।
কিন্তু এখন সেসব অতীত মাত্র। এখন আর তুমি আমাকে ভালবাসো না।
আমি তোমাকে ভালবাসি না, কারণ তোমাকে ভালবাসাটা এখন অন্যায়। কিন্তু প্রথম ভালবাসাকে কেউ চাইলেও ভুলতে পারে না, থিবল্ট।
অ্যানলেট! কাঁপতে শুরু করল থিবল্ট। কী বলছ বুঝে বলল, মেয়ে!
বোঝাবুঝির কী আছে, যা সত্যি তাই বলছি, সরল মেয়েটা মাথা নাড়ল।
তুমি যেদিন আমাকে বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, আমি তোমাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলাম। চাবুক পেটা থেকে তোমাকে বাঁচিয়েছি, তারপরও কী করে ভাবব তুমি আমাকে মিথ্যে বলবে? আমি কিন্তু তোমাকে খুঁজতে যাইনি! তুমিই আমার সাথে আবার দেখা করতে এসেছিলে। বলেছিলে ভালবাসার কথা। তুমিই প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো তোমার আংটিটাকে ভয় পাওয়ার পেছনেও আমার কোন দোষ নেই। তোমার হাতের জন্যও যথেষ্ট বড় ছিল ওটা। অথচ কী ভয়ংকর! আমার কোন আঙুলেই ঢুকল না অভিশপ্ত জিনিসটা!
তুমি কি চাও আমি আংটিটা আমি খুলে ফেলি? ছুঁড়ে ফেলে দেই? বলে আঙুল থেকে ওটা বের করার চেষ্টা শুরু করল থিবল্ট। কিন্তু বিধিবাম! অ্যানলেটের আঙুলে পরানোর সময় যেমন ছোট হয়ে গিয়েছিল, তেমন এখনও তেমনি ছোট হয়ে গেছে আংটিটা। শত চেষ্টাতেও ওটা খুলতে পারল না থিবল্ট।
আংটিটা ভোলা কোনভাবেই সম্ভব না! কানো নেকড়ে আর ওর মাঝের চুক্তিপত্র ওটা। হতাশ হয়ে হাত ছেড়ে দিল থিবল্ট।
অ্যানলেট বলতে লাগল, সেদিন আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। জানি সেটা আমার ঠিক হয়নি। তাছাড়া… চোখ তুলে থিবল্টের চুলের দিকে তাকাল ও। থিবল্টের মাথায় কোন টুপি নেই। চাঁদের আলোয় অ্যানলেট দেখল এখন আর একটা নয়, মাথার অর্ধেক চুল ওর শয়তানের রঙে রাঙানো।
আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। বলল, থিবল্ট। আমাদের শেষ দেখা হবার পর কী ঘটেছে?
মুখ নিচু করে দুহাতে মাথা চেপে ধরল থিবল্ট। অ্যানলেট! কোন মানুষ, এমনকি কোন পাদ্রীকেও আমি বলতে পারব না ঠিক কী ঘটেছে আমার জীবনে। শুধু এটুকুই বলব, আমি অসুখী, আমার প্রতি করুণা করো।
আনলেট এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরল।
তুমি তখন আমাকে ভালবাসতে? ভালবাসতে আমাকে? নিষ্পাপ মিষ্টি কণ্ঠে মেয়েটা বলে চলল, আমার কী করার ছিল, থিবল্ট? আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। দরজায় টোকা পরলেও ভাবতাম, তুমি এসেছ দাদীকে বলতে, দাদী, আমি অ্যানলেটকে ভালবাসি, অ্যানলেটও আমাকে ভালবাসে। ওকে স্ত্রী হিসেবে আমার হাতে তুলে দেবেন? তারপর যখন দরজা খুলে দেখতাম তুমি নও-অন্য কেউ, ঘরের কোনায় লুকিয়ে কাঁদতাম আমি।
আর এখন?
তোমার কাছে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু তোমার নামে লোকে যত ভয়ংকর গল্পই বলুক, আমার কখনও ভয় লাগত না। আমার কখনও মনে হয়নি তুমি আমার ক্ষতি করতে পারো। নির্ভয়ে বনে ঘুরে বেড়াতাম আমি। আজও তেমনি বেড়াচ্ছিলাম, তখনই ওই নেকড়েটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! তুমি না বাঁচালে এতক্ষণে ওটা আমাকে মেরেই ফেলত।
কিন্তু তুমি তোমার পুরানো বাড়িতে কেন? স্বামীর সাথে থাকো না?
কিছুদিন ভেয়ে ছিলাম। কিন্তু ওখানে আমার দাদীর জায়গা হয়নি। আমার স্বামীকে বললাম, আমাকে আমার দাদীর কথা প্রথমে ভাবতে হবে। তাই দাদীর কাছে যাচিছ। তোমার যখন ইচ্ছা আমাকে এসে দেখে যেও।
সে রাজি হলো?
রাজি হতে চাইছিল না। তখন বললাম দাদীর বয়স সত্তর বছর। আর হয়তো দুতিন বছর বাঁচবেন। ঈশ্বর চান তো আরও কিছুদিন বেশি বাঁচতে পারেন। তবে সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দুতিন বছর হয়তো সমস্যা হবে, কিন্তু আমাদের পুরো জীবন সামনে পরে আছে। তখন রাজি হয়েছে সে।
থিবল্টের মাথায় শুধু এই চিন্তাই খেলা করছে-ওর প্রতি অ্যানলেটের ভালবাসা মরেনি!
তুমি আমাকে ভালবাসতে? আবারও তো ভালবাসতে পারো?
অসম্ভব, থিবল্ট! আমি যে এখন অন্য কারও।
অ্যানলেট! অ্যানলেট! শুধু একবার বলো তুমি আমাকে ভালবাসো?
না থিবল্ট, যদি বাসতামও, তোমার কাছে কখনও-ই সেটা প্রকাশ করতাম না।
কেন? তুমি আমার ক্ষমতা জানো না। আমার হয়তো আর একটা বা দুটা ইচ্ছা অবশিষ্ট আছে। তোমার সাহায্য পেলে আমি তোমাকে রাণীর মতো ধনী করে দিতে পারি। এই দেশ, ফ্রান্স, ইউরোপ ছেড়ে চলে যেতে পারি আমরা। পৃথিবীতে আরও অনেক বড় বড় দেশ আছে যার নামও তুমি জানো না আমেরিকা, ইন্ডিয়া। পুরো স্বর্গ, অ্যানলেট! নীল আকাশ, বিশাল গাছ, নানা বর্ণের পাখি। অ্যানলেট, শুধু বলো তুমি আমার সাথে আসবে। কেউ জানবে না আমরা একসাথে কোথায় চলে গেছি। কেউ জানবে না আমরা একজন আরেকজনকে ভালবাসি। এমনকি আমরা যে বেঁচে আছি, তাও কেউ বুঝতে পারবে না।
তোমার সাথে চলে যাব? অ্যানলেট যেন বুঝতে পারছে না থিবল্ট কী বলছে। তুমি কী ভুলে গেছ, আমি আর তোমার নই? আমার বিয়ে হয়ে গেছে?
তাতে কী যায় আসে! যদি তুমি আমাকে ভালবাসো, আমরা ঠিক সুখী হব!
থিবল্ট! এসব কী বলছ তুমি?
শোনো অ্যানলেট, এপারের জীবন আর ওপারের জীবনের দিব্যি দিয়ে বলছি। তুমি কি চাও না আমার শরীর এবং আত্মা দুটোই বাঁচুক? যদি চাও তাহলে না কোরো না। দয়া করো, চলো আমার সাথে। এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাই। যদি ধনী হয়ে থাকতে না চাও, আবার যেখানে স্যাবট কারিগর হিসেবে কাজ করে খেতে পারব সেখানেই চলে যাব আমরা। আমার পরিচয় হবে গরীব, কিন্তু কাজ নিয়ে সুখী থিবল্ট। যার ঘরে আছে অ্যানলেটের মতো চমৎকার স্ত্রী।
আমি তো তোমার স্ত্রী হতেই চেয়েছিলাম। তুমিই তো আমার হৃদয় পুড়িয়ে দিয়েছ।
আমার সব পাপ ভুলে যাও, অ্যানলেট ভয়ঙ্কর শাস্তি আমি পেয়েছি।
থিবল্ট, তুমি যেটা করতে চাওনি, অন্য কেউ সেটা করেছে। অসহায় মেয়েটাকে গ্রহণ করেছে। অন্ধ বৃদ্ধার দায়িত্ব নিয়েছে। আমাকে নাম দিয়েছে আর দাদীর অন্ন সংস্থান করেছে। আমার ভালবাসা ছাড়া অন্যকিছু চায়নি সে। আমার প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোন যৌতুকও দাবি করেনি। তুমি কি আমাকে ভালর বিনিময়ে অনিষ্ট করতে বলছ? তুমি কি বলতে চাইছ আমি তাকে ছেড়ে আসব, যে ভালবাসার প্রমাণ দিয়েছে, এমন কারো জন্য জন্য যে কোন প্রমাণ দিতে পারেনি?
তুমি যখন ওকে ভালবাসো না, আমাকেই বাসো, তখন তাতে কী যায় আসে?
আমার মুখে কথা বসিয়ো না, থিবল্ট। আমি বলেছি তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা আমি ভুলে যাইনি, কিন্তু কখনও-ই বলিনি আমার স্বামীকে আমি ভালবাসি না। আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই। আমি চাই তুমি খারাপ কাজ ছেড়ে দাও। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো। আর সব শেষে আমি চাই ঈশ্বর তোমাকে দয়া করুন। যে অশুভ আত্মার কথা তুমি বললে, তার হাত থেকে যেন মুক্তি পাও। আমি তোমার জন্য দিনরাত প্রার্থনা করব। কিন্তু প্রার্থনা করার জন্য আমার নিজেকে শুদ্ধ রাখতে হবে। যে কণ্ঠ দয়া ভিক্ষা করবে, ঈশ্বরের কানে সে কষ্ঠ পৌঁছুতে হলে সেই তাকে নিষ্পাপ হতে হবে। আর ঈশ্বরের বেদীতে যে প্রতিজ্ঞা করেছি, কোন কিছুর বিনিময়েই আমি তা ভাঙতে পারব না, থিবল্ট।
অ্যানলেটের এই পরিষ্কার সিদ্ধান্ত থিবন্টকে ক্ষুব্ধ করে তুলল।
তুমি কি জানো না এই সুরে আমার সাথে কথা বলাটা বোকামি হয়ে যাচ্ছে?
বোকামি হবে কেন?
এখন রাত, আর আমরা এখানে একা। এই সময়ে কেউ স্বপ্নেও এখানে আসার সাহস পাবে না। এখানে আমার যতটা ক্ষমতা আছে, স্বয়ং রাজারও তার রাজ্যে ততটা ক্ষমতা নেই।
মানে?
প্রার্থনার কথা বলছ, আমাকে পাল্টাতে বলছ। আমাকে শাসাচ্ছ?
তোমাকে শাসাব কেন?
যেটা বোঝাতে চাইছি, অ্যানলেটের কথা পাশ কাটিয়ে গেল থিবল্ট। তুমি যা বলেছ-তাতে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা যত না বেড়েছে, তোমার স্বামীর প্রতি আমার ঘৃণা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভেড়ার জন্য নেকড়েকে ক্ষেপানো বোকামি, যখন নেকড়ের ক্ষমতা ভেড়ার চেয়ে বেশিই হয়।
আমি তোমাকে বলেছি, থিবল্ট, তোমার সাথে দেখা হওয়া নিয়ে আমার ভেতর কোন ভয় কাজ করেনি। অন্যদের বলা কথা মাথায় ছিল বলে হঠাৎ মুহূর্তের জন্য আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন তুমি চাইলেও আমাকে ভয় পাওয়াতে পারবে না।
এভাবে কথা বোলো না অ্যানলেট, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না শয়তান আমার কানে কী মন্ত্র পড়ছে আর আমাকে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে সেটা অগ্রাহ্য করার জন্য।
তুমি চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারো। কিন্তু কাপুরুষের মতো তুমি যা বলছ তা আমি করব না। তুমি আমাকে মেরে ফেললেও আমি আমার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, মরার সময়েও তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব।
তোমার স্বামীর নামও উচ্চারণ কোরো না, অ্যানলেট। ওর কথা মনে করতে বাধ্য কোরো না আমাকে। নাহলে ওর ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারব না।
আমাকে তুমি যত খুশি শাসাতে পারো, থিবল্ট, কারণ আমি তোমার সামনে আছি। কিন্তু ও তোমার থেকে অনেক দূরে আছে। এখান থেকে ওর কিছুই করতে পারবে না তুমি।
কে বলেছে তোমাকে? যে ক্ষমতা আমার আছে, তা ঠেকানো আমার পক্ষে কঠিন। কাছে-দূরে সব জায়গায় আমি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারি।
তাতে আমি হয়তো বিধবা হব। কিন্তু তোমার কি ধারণা? যার কারণে আমি স্বামী হারিয়েছি, তার হাত ধরব?
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল থিবল্ট, অ্যানলেট, নতুন করে আরও কোন অপরাধ করার হাত থেকে আমাকে বাঁচাও দয়া করে।
তোমার অপরাধের জন্য তুমিই দায়ী, থিবল্ট, আমি নই। আমি তোমাকে আমার জীবন দিতে পারি, কিন্তু সম্মান নয়।
গর্জে উঠল থিবল্ট, ঘৃণা যখন অন্তরে প্রবেশ করে, ভালবাসা তখন পালিয়ে যায়। নিজের খেয়াল রেখ, অ্যানলেট। স্বামীর খেয়াল রেখ। আমার ভেতরে শয়তান আছে। সে আমার মুখ দিয়েই কথা বলে। তোমার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ভালবাসা যখন পেলাম না, প্রতিশোধ নেয়া থেকে নিজেকে চাইলেও বিরত রাখতে পারব না আমি। এখনও সময় আছে। এই হাত ধরো। অভিশাপ থেকে, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচো। নয়তো এটা জেনো, আমি নই, তুমিই তোমার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হবে!
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল থিবল্ট, তারপর অ্যানলেটকে নিরুত্তর থাকতে দেখে বলল, তুমি আমাকে থামালে না অ্যানলেট? তবে তাই হোক! আমাদের তিনজনের ওপরই অভিশাপ নামুক। তুমি, আমি আর সে। আমি চাই তোমার স্বামী মারা যাক, এবং সে মারা যাবে!
তীব্র একটা আর্ত-চিৎকার করে উঠল অ্যানলেট। তবে পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। থিবল্ট যা-ই দাবি করুক না কেন, এতদূর থেকে ওর দেয়া অভিশাপ ফলে যাবে এটা অসম্ভব মনে হলো মেয়েটার কাছে। না, না, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ। বলল ও, আমার প্রার্থনা ওকে সব রকমের বিপদ থেকে বাঁচাবে।
যাও তাহলে, দেখো ঈশ্বর তোমার প্রার্থনার কী জবাব দেয়। একটা কথা, যদি তোমার স্বামীকে জীবিত দেখতে চাও, তাড়াতাড়ি করো। নয়তো শুধু মৃতদেহটাই দেখতে পাবে।
শেষ কথাগুলো যে সুরে বলা হলো, তাতে আনলেটকে একটা আতংক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। থিবল্টের ইশারা করা দিকে ছুট লাগাল ও। একসময় রাতের অন্ধকারে, দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল মেয়েটা। উচ্চ-নিনাদে কেঁদে উঠল থিবল্ট, আমার আত্মা এখন সত্যিই অভিশপ্ত হয়ে গেল!
দ্বাবিংশ অধ্যায় – থিবল্টের শেষ ইচ্ছা।
প্রাণপণে ছুটে চলেছে অ্যানলেট। দম ফুরিয়ে গেলে থামছে। নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে-থিবল্টের অভিশাপ আসলে শুধুই একজন ঈর্ষাকাতর মানুষের প্রলাপ মাত্র। কথাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে গেছে, এর কোন ক্ষমতা নেই। দম ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে আবার ছুট দিচ্ছে সে। স্বামীকে আবার না দেখা পর্যন্ত ও শান্তি পাবে না। বন-জঙ্গল পেরিয়ে ছুটে চলেছে ও। নেকড়ের ভয়ও ওকে থামাতে পারছে না। একটাই ভয় কাজ করছে এখন ওর মনে, স্বামীর মৃতদেহ দেখার ভয়। লম্বা পথ দৌড়ে অবশেষে গ্রামের কাছে পৌঁছল অ্যানলেট। চাঁদের রূপালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অন্ধকার থেকে সেই আলোয় বেরিয়ে আসতেই আড়াল থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। হাসতে হাসতে বলল, এই রাতের বেলা এত জোরে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছ, মাদাম? অ্যানলেট ওর স্বামীকে চিনতে পারল।
এটিয়েন! স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ও। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমি যে কী খুশি হয়েছি। তুমি ঠিক আছ তো?
কী ভেবেছিলে, বিবল্ট আর ওর নেকড়েরা আমাকে রাতের খাবার বানিয়েছে।
থিবল্টের কথা বোলো না। চলো, আশেপাশে মানুষজন আছে এমন কোথাও চলো।
হেসে উঠল তরুণ শিকারি। তুমি তো আমার দুর্নাম করিয়ে ছাড়বে! স্বামীরা দেখি কোন কাজেই আসে না। এমনকি স্ত্রীর সাহস জোগানোর জন্যও স্বামীর কোন দরকার নেই!
ঠিকই বলেছ, এটিয়েন। বনের ভেতর দিয়ে একা দৌড়ে আসার সাহস পেয়েছি। আর এখন যে তুমি সাথে আছ তাতে নিশ্চিন্ত বোধ করা উচিত। কিন্তু তারপরও কেন যেন প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে আমার।
কী হয়েছে, বলল তো? স্ত্রীকে চুমু খেল এনগুভা।
নেকড়ের আক্রমণ থেকে শুরু করে থিবল্টের সাথে আলাপচারিতা, সব খুলে বলল আনলেট। মন দিয়ে শুনল এনভা, তারপর বলল, চলো, তোমাকে দাদীর কাছে নিরাপদে রেখে আসি। লর্ড ভেষকে জানাতে হবে থিবল্ট কোথায় আস্তানা গেড়েছে।
না, তাহলে তোমাকে বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কোথায় কোন্ বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কে জানে।
অন্য রাস্তা ধরব আমি। ক্ৰয়োল দিয়ে ঘুরে গেলে বন এড়াতে পারব।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে-মাথা ঝাঁকাল অ্যানলেট। প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। এনগুভা পিছু হটবে না। তার চেয়ে বরং ঘরে পৌঁছে আবার অনুরোধ করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করা যাক।
তরুণ শিকারি তার কর্তব্যটুকুই শুধু করতে চায়। অ্যানলেটের সাথে থিবল্টের যেখানে দেখা হয়েছে, নিশ্চয়ই তার কাছাকাছিই আছে নেকড়ে নেতা। পরদিন লোক-লস্কর নিয়ে যেদিকে যাবার পরিকল্পনা করছে ব্যারন, সেটা অনেক দূরে। এটিয়েন তাই তাড়াতাড়ি তার মনিবকে খবরটা পৌঁছে দিতে চায়। খুব বেশি রাত আর বাকি নেই, সব ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে।
অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল অ্যানলেট। অবশেষে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে এনগুভাকে বোঝাবার চেষ্টা করল ও। নেকড়ে-মানব হলেও ওর কোন ক্ষতি করেনি থিবল্ট। বরং নেকড়ের কবল থেকে জীবন বাঁচিয়েছে। কোনরকম ক্ষমতা ওর ওপর প্রয়োগও করেনি। অ্যানলেটকে স্বামীর কাছে আসতে দিয়েছে। এখন থিবল্টের অবস্থানের কথা ওর ঘোর শত্রু লর্ড ভেযের কাছে বলে দেয়া বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। অমনটা করা হলে থিবল্ট ঠিকই টের পেয়ে যাবে। এবং এরপর ও আর কাউকে কখনও দয়া না-ও দেখাতে পারে। থিবল্টের হয়ে অনুরোধ করল অ্যানলেট। বিয়ের সময় এনভাকে থিবল্টের কথা সবই জানিয়েছিল ও। অ্যানলেটকে এনগুভা বিশ্বাসও করে। কিন্তু তারপরও সে একটা ঈর্ষার খোঁচা ঠিকই অনুভব করল। সেই প্রথম দিন থিবল্টকে গাছের ওপর আবিষ্কার করার পর থেকেই দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষি আছে। অ্যানলেটের কথা মন দিয়ে শুনলেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল সে। দুজনের মাঝে কে ঠিক-তা নিয়ে তর্ক করতে করতে পথ চলছিল ওরা। থিবল্টের আক্রমণের অত্যাচারে গ্রামে বেড়া দেয়া হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে টহল বাহিনী। নিজেদের কথায় মগ্ন হয়ে থাকার ফলে এনগুভা এবং অ্যানলেট কেউই পাহারাদারের প্রশ্ন, কে যায়? শুনতে পায়নি। কোন জবাব না পেয়ে পাহারাদার অন্ধকারে ভুলভাল কল্পনা করে ফেলল। বন্দুক তাক করে গুলি করতে উদ্যত হলো সে। এনগুভার চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। বন্ধু! বলে চিৎকার করে অ্যানলেটকে আড়াল করে জড়িয়ে ধরল সে। তারপর আর একটা শব্দ না করে কাটা কলা গাছের মতো পড়ে গেল মাটিতে। হৃদপিণ্ড ফুটো হয়ে গেছে ওর।
গুলির শব্দ শুনে সবাই ছুটে এসে এনভাকে মৃত আবিষ্কার করল। ওর লাশের পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে অ্যানলেট। ধরাধরি করে ওকে ওর দাদীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরলেও মানসিক স্থিরতা ফিরল না মেয়েটার। পাগলের মতো আচরণ শুরু করল ও। স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করল নিজেকে। অপ্রকৃতস্থ ভাবে স্বামীর আত্মার জন্য শান্তি কামনা করল ও। থিবকে উদ্দেশ্য করেও অনেক অনুরোধ করল। আশপাশে যারা ছিল, ওর করুণ আকুতি শুনতে শুনতে চোখে পানি এসে গেল তাদের।
ধীরে ধীরে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেল অ্যানলেটের কাছ থেকে। সবাই জেনে গেল, অলৌকিক শক্তি বলে নেকড়ে-মানব এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তার অভিশাপেই এই দুর্ভাগ্যটা নেমে এসেছে বেচারা এনগুভার উপর। আদপে এটা একটা হত্যাকাণ্ড! থিবল্টের বিরুদ্ধে জনরোষ তাই আরও বেড়ে গেল।
এদিকে কিছুতেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না অ্যানলেট। স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ছে ওর। ডাক্তার-বৈদ্য দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি-সব চিকিৎসাই বিফল হয়েছে। সবাই ধরেই নিল অ্যানলেটও শীঘ্রই স্বামীর পথ ধরবে। একমাত্র ওর দাদীর কণ্ঠই ওকে কিছুটা শান্ত করতে পারে। অন্ধ বৃদ্ধা কথা বললেই শুধু ওর দৃষ্টি নরম হয়ে যায়। চোখে জমা হয় অশ্রু। তার হাত কপালে পড়লেই ওর মুখে বিষণ্ণ একটা হাসি ফোটে।
এক রাতে অ্যানলেটের অবস্থার প্রচণ্ড অবনতি হয়েছে। লর্ড ভেযের পাঠানো দুজন মহিলা ওর দেখাশোনা করছে। সম্ভবত কোন দুঃস্বপ্ন দেখে মেয়েটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। এমনি সময় হাট করে খুলে গেল ঘরের দরজা। যেন আগুনের শিখায় মোড়ানো একটা মানুষ এসে ঢুকল ভেতরে। বিছানায় উঠে মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটার কপালে চুমু খেয়ে আবার বেরিয়ে গেল সে। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল যে ভুল দেখেছে না ঠিক দেখেছে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল উপস্থিত ব্যক্তিদের। অদৃশ্য কোন কিছুকে উদ্দেশ্য করে অ্যানলেট বলে উঠল, ওকে নিয়ে যাও! ওকে নিয়ে যাও! কিন্তু ততক্ষণে প্রত্যক্ষদর্শী দুজন থিবল্টকে চিনতে পেরেছে। অ্যানলেটের অবস্থার কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারেনি থিবল্ট। ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ছুটে এসেছিল হতভাগ্য মেয়েটাকে দেখতে।
অ্যানলেটের ঘরের দুই মহিলা দেখিয়ে দিল কোন্ দরজা দিয়ে থিবস্ট বেরিয়ে গেছে। তখন লোকজন জড়ো হয়ে ওকে তাড়া করল। তাড়া খেয়ে জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যাবার লক্ষ্যে ছুটতে শুরু করল থিবল্ট।
থিবল্টের আকস্মিক আগমনের ধাক্কায় অ্যানলেটের অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। রাত পোহানোর আগেই পাদ্রী ডেকে আনা হলো মুমূর্ষ মেয়েটার জন্য। আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা টিকবে ও! মাঝরাতের দিকে পাদ্রী এসে পৌঁছাল। চার্চের লোকেরা ক্রুশ আর ছেলেরা হোলি ওয়াটার বয়ে নিয়ে এল। পাদ্রী গিয়ে বসল ওর মাথার কাছে। তখন কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে অনেকটা শক্তি ফিরে পেল অ্যানলেট। পাদ্রীর সাথে লম্বা সময় ধরে নিচু গলায় কথা বলল মেয়েটা। ওর নিজের আর প্রার্থনার দরকার নেই। কিন্তু তাহলে কার জন্য প্রার্থনা করল ও? সেটা শুধু পাদ্রী, অ্যানলেট আর ঈশ্বরই জানেন।
ত্রাবিংশ অধ্যায় – বর্ষপূর্তি
পেছনের তাড়া করা মানুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে আসার পর গতি কমিয়ে দিল থিবল্ট। এখানে বনটা শান্ত। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, ধাতস্থ হবার জন্য একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল ও। আশেপাশে কিছু কালো পাথর ছড়িয়ে আছে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে ওগুলো। তাহলে কি ভাগ্যের ফেরে ওর পুড়ে যাওয়া কুটিরটার কাছে চলে এসেছে বিল্ট?
কুটিরের সেই শান্তির জীবনের সাথে বর্তমান ভয়ংকর জীবনের তুলনা করে তিক্ততায় ছেয়ে গেল ওর মন। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পায়ের কাছের কয়লার ওপর পড়ল। দূরে গির্জাগুলোতে একে একে মাঝরাতের ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করেছে।
ঠিক সেই সময়েই মৃত্যুপথযাত্রী অ্যানলেটের প্রার্থনা শুনছে পাদ্রী।
এদিকে নিজের সাথেই কথা বলছে থিবল্ট, দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ ছিলাম আমি। ভাগ্যে ঈশ্বর যা রেখেছেন, তার বাইরে কিছু চাইতে গিয়েছিলাম। সেদিন সেদিনটা ছিল অভিশপ্ত এক দিন! কালো নেকড়ে যেদিন আমাকে অন্যের ক্ষতি করার ক্ষমতা দিল, সেটাও একটা অভিশপ্ত দিন ছিল। ওই ক্ষমতা দিয়ে যা করেছি, তাতে জীবনের সব সুখই ধ্বংস হয়ে গেছে আমার।
পেছনে উচ্চস্বরের একটা হাসি শুনে ফিরে তাকাল বিল্ট। কালো নেকড়েটা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে! জ্বলন্ত চোখ দুটো ছাড়া বাকি শরীরটা অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। থিবল্টের সামনে এসে বসে পড়ল ওটা।
তারপর! মাস্টার থিবল্ট কি অসন্তুষ্ট? মাস্টার থিবন্টকে খুশি করা তো খুব কঠিন দেখা যাচ্ছে।
অসন্তুষ্ট না হবার উপায় কি রেখেছ? তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ব্যর্থ চাওয়া আর অনিঃশেষ মর্মপীড়া ছাড়া কিছুই পাইনি। ধন-সম্পদ চেয়েছিলাম। সেসব তো পেলামই না, উল্টো যা-ও বা ছিল, তা-ও হারালাম। একটা ঘর ছিল, যে ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। যে ঘর আমাকে রোদ-ঝড় থেকে বাঁচাত। এমনকি সেই ঘরটাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সম্মান চেয়েছিলাম। আর এখন? নিম্নবিত্ত মানুষগুলো পর্যন্ত আমাকে মারার জন্য খুঁজছে। ভালবাসা চেয়েছিলাম। একটা মাত্র মেয়ে যে আমাকে ভালবেসেছিল, আমিও যাকে ভালবেসেছিলাম, সে-ও অন্যের স্ত্রী হয়ে গেল। মৃত্যুর মুখে এসে ও এখন আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। তোমার দেয়া বিশাল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ওর জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না!
শুধু নিজেকে ভালবাসা বন্ধ করো, থিবল্ট।
আমাকে নিয়ে মজা করছ, করো!
তোমাকে নিয়ে মজা করছি না। আমার সাথে পরিচয়ের আগে কি তুমি অন্যের সম্পদের দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাওনি?
একটা হরিণের দিকে তাকিয়েছি। অমন শত শত হরিণ বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তুমি কি ভেবেছিলে, একটা হরিণে তোমার চাওয়া শেষ হয়ে যেত? দিনের শেষে রাত আসে আর রাতের শেষে দিন। ঠিক তেমনি, একটা চাওয়া থেকে জন্ম হয় আরেকটা চাওয়ার। হরিণ চেয়েছ, এরপর হরিণটা পরিবেশনের জন্য দামী রূপোর পাত্র চাইতে। সেখান থেকেই জন্ম হত একটা খানসামার চাহিদার। যে তোমাকে খাবার পরিবেশন করবে। উচ্চাকাক্ষা আকাশের মতো, সীমাহীন! মনে হয় দিগন্তরেখার ওপারে এর শেষ আছে, কিন্তু আসলে পুরো পৃথিবীটাকেই ঘিরে আছে এই চাহিদার খেলা। মাদাম পুলের মিলের জন্য তুমি অ্যানলেটকে ত্যাগ করেছিলে। মিলটা পেলে তারপর তুমি মাদাম ম্যাগলোয়ার বাড়িটা চাইতে। কিন্তু মন-গুবের দুর্গ-প্রাসাদ দেখার পর ওই বাড়ির প্রতি তোমার আর কোন আকর্ষণ থাকত না।
তোমার-আমার প্রভু, স্বর্গচ্যুত দেবদূতের সাথে ঈর্ষাকাতরতায় তুমি একই পথের পথিক। পার্থক্য এই যে তুমি ফলটা ভোগ করার মতো বুদ্ধিমান ছিলে না। আর তাই সৎ জীবন যাপন করাটাই তোমার জন্য ভাল হত।
ঠিকই বলেছ, যে ক্ষতি চায় তারই ক্ষতি হয়। আচ্ছা যদি মন থেকে চাই, তাহলে কি আবার আমি সৎ মানুষ হতে পারব না?
জবাবে নেকড়েটা একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসল।
শয়তান শুধু মাত্র একটা চুল ধরে টেনে মানুষকে নরকে নিয়ে যেতে পারে। তোমার কয়টা চুলের মালিক এখন সে, বলতে পারো?
না।
সেটা অবশ্য আমিও বলতে পারব না। তবে কটা অবশিষ্ট আছে তা বলতে পারব। তোমার নিজের আর মাত্র একটা চুল বাকি আছে।
কোন মানুষ যখন একটা বাদে আর সব চুলই শয়তানের কাছে হারিয়েছে, তখন সেই অবশিষ্ট চুলটার কল্যাণে ঈশ্বর কি তাকে বাঁচাতে পারে না?
চেষ্টা করে দেখতে পারো।
তোমার সাথে দরাদরি করার সময় আমার ধারণা ছিল না চুক্তিটা এই ধরনের হবে।
আরে বোকা, যখন তোমার চুল আমাকে দিয়েছ, সেটা কি চুক্তি ছিল না? ব্যাপটিজম আবিষ্কার করার পর থেকে আমরা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম কীভাবে তোমাদের ধরব তাই ভেবে। সেজন্য কাউকে কোন সুবিধা দিতে গেলে বিনিময়ে শরীরের কিছু একটা চাই আমরা। যাতে সে জায়গাটা ধরতে পারি। তুমি তোমার চুল আমাদের দিয়েছ। আর নিজেই দেখেছ, সেই চুল তুমি চাইলেও উঠিয়ে ফেলতে পারবে না। এই পোড়া ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দরাদরি শেষ হওয়ার পর থেকেই তুমি আমাদের সম্পত্তি হয়ে গেছ। প্রতারণা আর নৃশংসতার বীজ তোমার মনেই ছিল!
ক্ষিপ্ত বিবল্ট মাটিতে পা ঠুকে বলল, তাই বলে এই দুনিয়ার কোন সুখ ভোগ না করেই ওই দুনিয়া হারালাম আমি?
এই দুনিয়ার সুখ ভোগ করার সময় এখনও আছে, থিবস্ট।
কীভাবে?
ভাগ্যক্রমে যে রাস্তা তুমি ধরেছ তার ফল পেতে চাইলে সংশয়ে না থেকে পুরোপুরি আমাদের একজন হয়ে যাও।
সেটা কীভাবে করব?
আমার জায়গাটা নাও তুমি।
তারপর কী হবে?
তুমি আমার ক্ষমতা পাবে। তাহলে আর তোমার কিছু চাওয়ার থাকবে না।
যদি তোমার ক্ষমতা এতই হয়ে থাকে, যত খুশি সম্পদ তুমি পেতে পারো, যা খুশি করতে পারো, তাহলে এই ক্ষমতা ছাড়বে কেন?
ওটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমার প্রভু আমাকে পুরস্কৃত করবেন।
তোমার জায়গা নেয়ার মানে কি তোমার চেহারাও নিতে হবে?
রাতে নিতে হবে, দিনে তুমি মানুষের বেশেই থাকবে।
রাত অনেক লম্বা। শিকারির গুলিতে মারা পড়তে পারি আমি, অথবা ধরা পড়তে পারি ফাঁদে। তাহলে ধন-সম্পদ, সম্মান আর সুখের সাথে সাথে প্রাণটাও হারাব।
সেই ভয় কোরো না। লোহা, সীসা বা ইস্পাত এই চামড়া ভেদ করতে পারবে না। এই চামড়া গায়ে থাকলে শুধু যে কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না তা-ই নয়, তুমি হয়ে যাবে অমর! আর সব নেকড়ে-মানবদের মতো, বছরে শুধু একদিনের জন্য তোমাকে পুরোপুরি নেকড়ে হিসেবে কাটাতে হবে। শুধু ওই চব্বিশ ঘণ্টা আর সব প্রাণীর মতো বিপদের আশংকা থাকবে তোমার। একবছর আগে তোমার সাথে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আমার ওই সময়টাই চলছিল।
এখন বুঝলাম, কেন লর্ড ব্যারনের কুকুরগুলোকে ভয় পাচ্ছিলে তুমি।
মানুষের সাথে চুক্তিতে আসার সময় পুরো সত্যটা বলতে আমরা বাধ্য। এরপর মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে সে চুক্তি করবে কি না।
খুব তো ক্ষমতার কথা বলছ। বলল, এই ক্ষমতাটা দিয়ে আমি কী করতে পারব?
পরাক্রমশালী রাজারাও এই ক্ষমতার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ তাদের ক্ষমতা মনুষ্য সীমা দিয়ে বাঁধা।
ধনী হতে পারব?
এত সম্পদ পাবে, যে সম্পদের ওপর বিতৃষ্ণা এসে যাবে তোমার। সম্পদ বলতে মানুষ শুধু সোনা-রূপাই সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু শুধু ইচ্ছা শক্তি দিয়ে তুমি মানুষের কল্পনাতীত সম্পদের মালিক হতে পারবে।
আমার শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারব?
যে কোন অশুভ ব্যাপারে তোমার ক্ষমতা হবে সীমাহীন।
যদি আমি কোন মেয়েকে ভালবাসি, তবু তাকে হারানোর সম্ভাবনা থাকবে?
মানুষের ওপর প্রভাব খাটাতে পারবে তুমি। সুতরাং ওদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারবে।
আমার ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা ওদের থাকবে না?
কোন অবস্থাতেই না-এক মাত্র মৃত্যু ছাড়া! মৃত্যু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী।
তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে মাত্র একদিন আমার মৃত্যুভয় থাকবে?
মাত্র একদিন। বাকি দিনগুলোতে, আগুন, পানি, লোহা, ইস্পাত কিছুই তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
এবং তুমি আমাকে কোনরকম কথার ফাঁদে ফেলছ না।
নেকড়ে হিসেবে দিব্যি করে বলছি, তোমাকে কোনরকম ফাঁদে ফেলছি না আমি!
বেশ, তাহলে তাই হোক। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নেকড়ে আর বাকি দিনগুলোয় সম্রাট। কী করতে হবে? আমি তৈরি।
একটা পাতা নিয়ে দাঁত দিয়ে তিন ভাগ করো। তারপর যতদূর পারো ছুঁড়ে ফেলল ওটা।
থিবল্ট তাই করল।
রাতটা ছিল শান্ত। কিন্তু পাতার টুকরোগুলো বাতাসে ভাসিয়ে দেয়া মাত্র বজ্রের গর্জন শোনা গেল। একটা ঘূর্ণিবায়ু ওগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
ভাই, থিবল্ট, এখন আমার জায়গা নাও। আর শুভকামনা রইল! চব্বিশ ঘণ্টার জন্য নেকড়ে হতে হবে তোমাকে। এই যাত্রাটা পার করতে পারলে দেখবে-আমি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সবই সত্যি। শয়তান যেন তোমাকে ব্যারনের কুকুরের হাত থেকে বাঁচায়। প্রভুর কাছে আমি তোমার জন্য বিশেষভাবে প্রার্থনা করব। শয়তানের দিব্যি! তোমার ব্যাপারে আমি সত্যিই আগ্রহী বন্ধু।
ধীরে ধীরে নেকড়েটা লম্বা হয়ে একটা মানুষের আকৃতি নিল। তারপর থিবল্টের উদ্দেশে একবার হাত নেড়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মাঝে।
থিবল্টের মনে হলো কিছুক্ষণের জন্য ও কোনরকম চিন্তা-ভাবনা বা নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়েছে। তারপর আবিষ্কার করল ওর শরীরের আকৃতি বদলে গেছে। একটু আগে যে নেকড়ের সাথে কথা বলছিল, সেই নেকড়ের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়েছে ও। মাথায় একটা কালো চুল অবশিষ্ট ছিল ওর। আর এখন কালো নেকড়ের চেহারায়, মাথার একটা মাত্র চুল সাদা হয়ে আছে।
এই অচিন্তনীয় পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিতে নিতেই অদূরে কুকুরের চিৎকার শুনতে পেল থিবল্ট। ডাক শুনে মনে হলো কোন ব্লাডহাউন্ড হবে। কাছেই ঝোঁপ থেকে ভেসে এল নড়াচড়ার আওয়াজ। ব্যারন আর তার কুকুরের কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠল ও। দৌড়াতে শুরু করল। খুশি হলো এটা আবিষ্কার করে যে ওর শক্তি আর ক্ষিপ্রতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
শিকারির উদ্দেশে লর্ড ভেকে বলতে শুনল থিবল্ট, তুমি কোন কাজেরই। কুকুরগুলোকে ঠিকমতো বেঁধে আসোনি। ডাকাডাকি করছে। নেকড়েটা যে পালিয়ে গেল। ওটাকে কি আর পাব?
স্বীকার করছি আমার ভুল হয়ে গেছে, মাই লর্ড। গতকালই নেকড়েটাকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি। ভাবিনি আজ আবার এদিকেই থাকবে ওটা।
তুমি নিশ্চিত এটাই বারবার আমাদের হাত থেকে পালিয়ে গেছে?
গত বছর ম্যাকোট যখন ডুবে গেল, তখন এই নেকড়েটাকেই আমরা তাড়া করছিলাম।
কুকুরগুলোকে ওটার পেছনে লেলিয়ে দেয়া উচিত।
আপনি শুধু হুকুম দিন। রাত শেষ হতে আর দুঘণ্টা বাকি আছে।
যদি একদিন সময় পায়, লেভিলি, তাহলে বহুদূরে চলে যাবে ওটা।
অন্তত ত্রিশ মাইল। মাথা নাড়তে নাড়তে সায় দিল লেভিলি।
এই অভিশপ্ত নেকড়েটাকে কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারছি না। ওর চামড়াটা আমার চাই-ই-চাই! এই চিন্তায় চিন্তায় কোনদিন না পাগল হয়ে যাই আমি!
তাহলে আর দেরি না করে হুকুম দিন, কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেই।
ঠিক বলেছ, লেভিলি। নিয়ে এসো হাউন্ডগুলোকে।
দশ মিনিটের মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে কুকুরগুলোকে নিয়ে এল লেভিলি। যদিও লর্ড ভেযের কাছে মনে হলো একহাজার বছর সময় লেগেছে।
ধীরে, ধীরে, লেভিলিকে বলল ব্যারন, এরা নতুন। আগেরগুলোর মতো কড়া প্রশিক্ষণ পাওয়া নয়। বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে কোন কাজে আসবে না। আগে এগুলোর গা গরম করাও।
ছাড়া পাওয়ার পর প্রথমে একটা দুটো করে কুকুর গন্ধ শুঁকে আগানোর চেষ্টা করল। তারপর বাকিগুলোও একে একে যোগ দিল সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ পর পর ডাকতে লাগল ওগুলো। নেকড়েটা যে পথে গেছে সে পথ আবিষ্কার করার পর বেড়ে গেল ডাকাডাকি।
ভাল সূচনা মানেই অর্ধেক কাজ শেষ! ব্যারনের কণ্ঠে উল্লাস প্রকাশ পেল। লেভিলি, খেয়াল রেখো। আর তোমরা, বাকিদের দিকে ফিরে বলল সে, অনেকবার মার খেয়েছি, আর না। যদি তোমাদের কারও ভুলে সুযোগটা নষ্ট হয়, নেকড়ের বদলে তাকেই কুকুরের ভোগে লাগাব।
উদ্দীপনামূলক বাণী শেষ করে ঘোড়া ছোটাল ব্যারন। হাউন্ডগুলোর কাছাকাছি পৌঁছানোর ইচ্ছা। ওদের ডাকের শব্দ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে।
চতুর্বিংশ অধ্যায় – নেকড়ে-মানব শিকার
ব্লাডহাউন্ডের ডাক শুনেই দৌড় শুরু করায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পেরেছে। থিবল্ট। বেশ কিছুক্ষণ আর কোন আওয়াজ পায়নি, তাই দৌড়ের গতি কমিয়ে দিল ও। তারপর হঠাৎ করেই দূরাগত বজ্রের আওয়াজের মতো ধ্বনি তুলে একসাথে ভেসে আসতে লাগল সবগুলো হাউন্ডের ডাক। এবার কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করল ও। শত্রুর সাথে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য দৌড়ের গতি আবার বাড়িয়ে দিল। বেশ খানিকক্ষণ একটানা ছুটে অবশেষে মন-টেগুতে এসে থামল থিবল্ট। মাথা কাত করে শোনার চেষ্টা করল, নেকড়েতে রূপান্তরিত হওয়ায় ওর শ্রবণশক্তি অনেক বেড়ে গেছে। বুঝতে পারল হাউন্ডগুলো এখনও বেশ দূরে আছে।
পাহাড় থেকে নেমে এল থিবল্ট। ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে গিয়ে উঠল কম্পিয়েইনার তীরে, তারপর ঢুকে পড়ল বনের গভীরে। টানা তিন ঘণ্টা দৌড়েও ওর নেকড়ে পাগুলো ক্লান্ত হয়নি। তবে বনটা অপরিচিত বলে তেমন একটা ভরসা পাচ্ছে না।
আরও মাইলখানেক দৌড়াল থিবল্ট। নদী পেরিয়ে, ঘুরপথে ছুটে আর পিছিয়ে এসে কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিতে পেরেছে আশা করা যায়। পিয়েরফে আর মন-গুবের ভোলা প্রান্তর পেরিয়ে শমুতার বনে গিয়ে ঢুকল ও। আরও কিছুদূর ঘুরে একসময় লঙোফোর বনে পৌঁছাল। কিন্তু উ দু পন্ডেউ-এর শেষ মাথায় এসেই হঠাৎ বিশটা কুকুরের একটা দলের মুখোমুখি পড়ে গেল ও। এরইমধ্যে প্রতিবেশীদের সবার কাছে কালো নেকড়েকে তাড়া করার খবর পাঠিয়েছে ব্যারন। তাই মঁসিয়ে দু মন্টবুটোনের শিকারিরা বেরিয়েছে রেকি করতে। নেকড়ে দেখা মাত্র ওরা কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিল। শুরু হলো নেকড়ে আর কুকুরের মধ্যে তীব্র বেগে ধাওয়া। ঘোড়া নিয়ে ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারদেরও বেগ পেতে হচ্ছে। বন-প্রান্তর সব পেরিয়ে ধাওয়া চলতে লাগল।
বিদ্যুতের বেগে ধাওয়া চলছে। পেছনে সৃষ্টি হচ্ছে বিশাল ধুলোর মেঘ। শোনা যাচ্ছে শিঙার শব্দ আর চিৎকারের প্রতিধ্বনি। পাহাড়-উপত্যকা, জল কাদা, উঁচু পাথর, সব পেরিয়ে ছুটছে থিবল্ট। ঘোড়া আর কুকুরগুলোরও যেন হিপোগ্রিফের মতো ডানা গজিয়েছে। এদিকে পেছনে ব্যারনও তার দল নিয়ে এসে হাজির। চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে কুকুরের পালকে। তবে কালো নেকড়ে এখনও অক্লান্ত ভাবে একই গতিতে দৌড়ে যাচ্ছে। নতুন একপাল কুকুর পেছনে লাগায় একটু দমে গেছে বটে থিবল্ট। কিন্তু এই গতিতে দৌড়ানোর মধ্যেও মানবিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা থাকাটা ওর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। যদিও এই যাত্রা নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না জানে না, হয়তো ও মরবে, তবে তার আগে যত কষ্ট আর যন্ত্রণা ওকে সহ্য করতে হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে। সুখের যত প্রতিশ্রুতি ও পেয়েছে, তা ভোগ করতে হবে। এই অবস্থার মধ্যেও অ্যানলেটের কথা ওর মাথায় এল। অবশ্যই অ্যানলেটের ভালবাসাও ওকে ফিরে পেতে হবে। এখনই হয়তো থিবল্ট আতঙ্কিত, পর মুহূর্তেই আবার রাগান্বিত হয়ে পড়ছে। মাঝেমাঝেই নিজের বর্তমান আকৃতির কথা ভুলে যাচ্ছে। ও। তখন মনে হচ্ছে ঘুরে মুখোমুখি হয় কুকুরগুলোর। রাগে পাগল হওয়ার পরক্ষণেই আবার মৃত্যুভয় জেগে ওঠে। যখন দৌড়ায়, মনে হয় যেন হরিণের পায়ে ছুটছে। যখন লাফায়, মনে হয় ঈগলের মতো পাখা আছে ওর। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সম্ভাব্য হন্তারকদের তাড়া করার শব্দ দূর হয় না। এই মনে হচ্ছে পেছনে ফেলে এসেছে ওদের, পর মুহূর্তে টের পাচ্ছে যে আরও জোর উদ্যমে কাছে চলে আসছে ধাওয়াকারীর দল। ওর বাঁচার ইচ্ছা মরেনি। শক্তি এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আবার কোন নতুন দলের মুখোমুখি হলে আর উপায় থাকবে না। মরিয়া হয়ে কুকুরগুলোর সাথে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল থিবল্ট। ঠিক করল ওর চেনা বনে, ওর ডেরায় ফিরে যাবে। পরিচিত জমিতে কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিতে পারবে ও। এই ভেবে আরও একবার দিক পরিবর্তন করল। পিউযো, ভিভিয়ে পেরিয়ে কম্পিয়েইনার বনে ঢুকে পড়ল আবার। তারপর লাগের বন হয়ে অবশেষে ভিলারস-কটেরেটের বনে ফিরে এল কালো নেকড়ে রূপী থিবল্ট। ওর বিশ্বাস এবারে লর্ড ভেযের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারবে। কোন সন্দেহ নেই কয়েক জায়গায় সে তার কুকুরদের বসিয়ে রেখেছে সে, কিন্তু ও যে এই দিকে ফিরে আসতে পারে এমন চিন্তা ব্যারনের মাথায় আসার কথা না।
নিজের এলাকায় ফিরে মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিল থিবল্ট। ও এখন দাঁড়িয়ে আছে উক নদীর ধারে। ওপার থেকে নদীর ওপর খাড়া পাহাড়ের ঝুলে থাকা একটা পাথরের ওপর লাফ দিল। তারপর সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচের নদীতে। সাঁতরে আবার এপাশে এসে নদীর ওপর পাহাড়ের গায়ে একটা গর্তে আশ্রয় নিল নেকড়ে রূপী থিবল্ট। গর্তের মুখটা পানির স্তরের নিচে। গর্তের ভেতরের দিকে চলে গেল ও। অন্তত তিন মাইল পেছনে ফেলে এসেছে কুকুরের পালকে। মিনিট দশেক পর ডাক ছাড়তে ছাড়তে এসে পৌঁছল কুকুরগুলো। উত্তেজনায় হয় খেয়াল করল না সামনে নদী, অথবা ভেবেছিল ওরাও লাফিয়ে ওপাশের পাথরের মাথায় পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু কালো নেকড়ের মতো অত জোরে লাফ দেয়া ওদের সাধ্যের বাইরে। ব্যর্থ হয়ে একে একে পানিতে পড়তে লাগল কুকুরগুলো। ছিটকে ওঠা পানি এসে লাগছে থিবল্টের গায়ে। কুকুরগুলো দুর্ভাগা, তার উপর নেকড়ে রূপী থিবল্টের মতো অতটা শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না ওদের। নদীর স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারল না ওরা। ঘোড়সওয়ার যতক্ষণে এসে হাজির হলো, ততক্ষণে একে একে সব কুকুরই নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ব্যারনের শাপ-শাপান্ত শুনতে পেল ও। ব্যারন আর তার শিকারিরা তখন নদীর ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। এই সুযোগে বেরিয়ে এল থিবল্ট। কখনও আঁতরে, কখনও পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে নদীর উৎসের দিকে এগোল। অবশেষে যথেষ্ট দূরত্ব আদায় করা গেছে নিশ্চিত হয়ে একটা গ্রামে ঢুকে পড়ল থিবল্ট। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে দৌড়ে বেড়াল। তারপর পোসিয়ামন গ্রামের কথা মনে পড়ল ও। ওখানে অ্যানলেট আছে। সেদিকে ছুটতে শুরু করল থিবল্ট। সন্ধ্যা ছটা বেজে গেছে। প্রায় পনেরো ঘণ্টা ধরে ধাওয়া চলেছে। না হলেও পঞ্চাশ লীগ১৯ রাস্তা পাড়ি দিয়েছে শিকারি ও শিকার সবাই। সূর্য পাটে বসেছে। সাদা, গোলাপী এবং গোধূলির আরও নানা রঙের শোভা পশ্চিম আকাশে। নানা ফুলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে, গান গাইছে পাখি। প্রকৃতির এই শান্ত সৌন্দৰ্য্য থিবল্টের ওপর এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলল। চারপাশে প্রকৃতি কত সুন্দর, অথচ মানসিক অস্থিরতা ওর ভেতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রথম চুক্তির মতো দ্বিতীয় চুক্তিতেও ও ধোঁকা খায়নি তো?
একটা পায়ে চলা পথ দিয়ে এগোতে এগোতে মনে পড়ল, এই পথ দিয়েই প্রথম দিন ও অ্যানলেটকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। আবার অ্যানলেটের ভালবাসা পাবার আশায় ওর মন সজীব হয়ে উঠেছে।
গির্জার ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল থিবল্টের কানে। কালো নেকড়ের মনে পড়ে গেল ওকে তাড়া করে আসা মানুষের কথা। কোন একটা খালি বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার আশায় মাঠের ওপর দিয়ে গ্রামের দিকে দৌড়াল ও। কবরখানার দেয়ালের পাশ দিয়ে যাবার সময় একই রাস্তা দিয়ে আসতে থাকা কিছু লোকের কণ্ঠ শুনতে পেল। মানুষের চোখ এড়ানোর আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে লাফিয়ে দেয়াল পেরোল থিবল্ট। ঢুকে পড়ল কবরখানার ভেতরে। গির্জাটা করবখানার লাগোয়া। দেখাশোনার লোক নেই। লম্বা লম্বা ঘাস জন্মেছে। আরও আছে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝোঁপ-ঝাড়। তেমনি একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট। ভেতরে থেকে বাইরে চোখ রাখতে অসুবিধা হবে না। একটা সদ্য খোঁড়া কবর দেখা যাচ্ছে। পাদ্রীর প্রার্থনার আওয়াজও ভেসে আসছে কানে। গির্জার আশেপাশে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না ও। কেটে পড়া দরকার-এতক্ষণে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকবে বলে আশা করল থিবল্ট।
সবে আড়াল থেকে নাকটা বের করেছে, এমন সময় কবরস্থানের দরজা খুলে গেল। বাধ্য হয়ে আবার লুকিয়ে পড়ল বিল্ট। সাদা পোশাক পরা একটা ছেলে প্রথমে হোলি-ওয়াটার নিয়ে বেরোল। তারপর রূপোর কুশ হাতে একটা লোক এবং সব শেষে পাদ্রীকে দেখা গেল। সবার মুখে মৃতের মঙ্গল কামনা করে করা প্রার্থনা শোনা যাচ্ছে।
চারজন লোক একটা কফিন বয়ে নিয়ে এল। কফিনটা ফুল-লতা-পাতা আঁকা কাপড়ে ঢাকা। যা ঘটছে সবই খুব সাধারণ ঘটনা, তবুও কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে থিবল্টের। সামান্য নড়াচড়াও ওর উপস্থিতি ফাঁস করে দিতে পারে। তাই মূর্তির মতো স্থির হয়ে, উদ্বেগের সাথে কী হয় দেখতে লাগল ও। কফিনটা নামিয়ে রাখা হলো। রীতি অনুযায়ী, কোন তরুণ বা তরুণী যদি খুব অল্প বয়সে মারা যায়, তার কফিন শুধু একটা কাপড়ে ঢেকে কবরের পাশে রাখা হয়। যাতে তার কাছের মানুষেরা শেষ বিদায় জানাতে পারে। এরপর কফিনের ডালা আটকে দিলেই সব শেষ। এক বৃদ্ধাকে ধরে ধরে আনা হলো। দৃশ্যতই মহিলা অন্ধ। মৃতের কপালে একটা চুমু দিতে চাইল সে। কফিনের ওপর থেকে কাপড় সরানো হলো। কফিনে শুয়ে আছে অ্যানলেট! থিবল্টের যন্ত্রণাকাতর মূদ গর গর ধ্বনি উপস্থিত মানুষের কান্নার সাথে মিশে গেল। মৃত অ্যানলেটকে জীবিতকালের চেয়েও সুন্দর লাগছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থিবল্টের হদয় ভেঙে যাচ্ছে। আর কেউ নয়, মেয়েটাকে ও-ই খুন করেছে। সত্যিকারের দুকুল ছাপানো কষ্ট অনুভব করল থিবল্ট। অনেক অনেক দিন পর নিজের কথা ভাবতে ভুলে গেল ও। ভাবল শুধু মেয়েটারই কথা। যে ওর জীবন থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। এমনকি কালো নেকড়ের দেয়া ক্ষমতাও ওকে ফেরত আনতে পারবে না।
কফিনে পেরেক ঠোকার শব্দ শোনা গেল। থিবল্ট টের পেল, কবরে মাটি আর পাথর ফেলা হচ্ছে। ওর একমাত্র ভালবাসার মানুষের ওপর চাপা পড়ছে মাটি আর পাথর! তার নরম শরীরে আঘাত লাগছে! কদিন আগেও কতই না সজীব আর প্রাণবন্ত ছিল মেয়েটা। গতরাতেও প্রাণ ছিল ওর শরীরে। থিবল্ট ছুটে যেতে চাইল আনলেটকে আনতে। জীবিত অ্যানলেট হয়তো ওর ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর পর সে অন্য কারও হতে পারবে না।
মানুষের শোক ওর পশুর অনুভূতিকে ঠেলে উপরে উঠে এল। কালো চামড়ার নিচে শরীরটা কেঁপে উঠল থিবল্টের। হিংস্র লাল চোখ দিয়ে গড়াতে লাগল অশ্রু। অসুখী একটা মানুষ কেঁদে উঠল, ঈশ্বর! আমাকে নাও। যাকে আমি খুন করেছি, তার জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য আমি খুশি মনে আমার নিজের জীবন দিয়ে দেব!
তারপরই গলা ছেড়ে ডেকে উঠল থিবল্ট। আর সেই অমানুষিক ডাক কানে যেতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল উপস্থিত লোকজন। দ্রুত ফাঁকা হয়ে গেল কবরস্থান। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য দলের হাউন্ডগুলোও, যেগুলো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সলীল সমাধির শিকার হয়নি, কবরের দেয়াল টপকে এসে হাজির হলো। আর ওগুলোর পেছনে ঘর্মাক্ত ব্যারনও স্পরের ঘায়ে রক্তাক্ত ঘোড়ায় চড়ে হাজিরএগিয়ে এসে ঝোঁপটা ঘিরে দাঁড়াল কুকুরের পাল। ঘোড়া থেকে নেমে শিকারি ছুরি হাতে নিয়ে দৌড়ে এল ব্যারন। দেখল, কুকুরগুলো একটা নেকড়ের চামড়া নিয়ে কামড়া-কামড়ি করছে, কিন্তু সেই খোলসের ভেতরে শরীরটার কোন অস্তিত্ব নেই!
কোন সন্দেহ নেই, এটাই সেই নেকড়ে-মানব, যেটাকে ওরা সারাদিন তাড়া করেছে। চামড়াটায় একটাই সাদা চুল, বাকি সব কুচকুচে কালো।
কিন্তু নেকড়ে-মানবের শরীরটা তাহলে কোথায় গেল? সেই উত্তর কেউ জানে না। এরপর বিবল্টকে আর কখনও দেখা যায়নি। তবে লোকের বিশ্বাস, প্রাক্তন স্যাবট-কারিগর আর নেকড়ে-মানব একই ব্যক্তি।
কবরস্থানে উপস্থিত একজন জানাল সে শুনেছে কেউ একজন বলছে, ঈশ্বর! আমাকে নাও! যাকে আমি খুন করেছি, তার জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য আমি খুশি মনে আমার নিজের জীবন দিয়ে দেব। যেহেতু নেকড়ে-মানবের শরীরটাও পাওয়া যায়নি, তাই পাদ্রী ঘোষণা করল, এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কারণে থিবল্ট মুক্তি পেয়েছে।
এরপর থেকে ফরাসী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত একটা রীতি চালু ছিল। পোসিয়ামন থেকে মাইল দেড়েক দূরে একটা মঠ আছে। প্রতিবছর অ্যানলেটের মৃত্যু-দিবসে সেখান থেকে একজন ধর্মযাজক আসত। মেয়েটার কবরের পাশে বসে প্রার্থনা করত সে।
এই হচ্ছে কালো নেকড়ের ইতিহাস। যেটা আমাকে বলেছে আমার বাবার সহকারী মোকেট।
-সমাপ্ত-
নির্ঘণ্ট
১। ভ্যালেঃ পোশাক-আশাকের দায়িত্বে থাকা পুরুষ ভৃত্য।
২। স্যাবটঃ কাঠের জুতো।
৩। পোর্টকুলিসঃ দুর্গের প্রবেশদ্বারে ও অধঃকরণের উপযোগী লোহার গরাদ বিশেষ।
৪। নমরুদঃ নমরুদ শব্দের অর্থ খোদদ্রোহী। বাইবেল অনুযায়ী সে ছিল সিনারের রাজা যে কিনা ঈশ্বরকে শিকার করতে চেয়েছিল।
৫। এক বিশেষ ইহুদীঃ উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস নাটকের শাইলক চরিত্রটি দ্রষ্টব্য।
৬। কেইনঃ বাইবেল মতে অ্যাডামের প্রথম যমজ সন্তানদের একজন, যে তার যমজ ভাই অ্যাবলকে হত্যা করে মানব-জাতির প্রথম খুনিতে পরিণত হয়।
৭। বেইলিফঃ আইন সংরক্ষণ বিষয়ক সরকারি কর্মকর্তা।
৮। বালশাজার-এর ভোজঃ বাইবেলে বর্ণিত রাজা বালশাজার। এক বিশাল ভোজ।
৯। বিলজেবাবঃ নরকের ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এক দানব। অথবা মতান্তরে শয়তানের অন্যতম একটি নাম।
১০। মেনেলাউসঃ হোমার-এর মহাকাব্য ইলিয়াড দ্রষ্টব্য। মেনেলাউস ছিলেন হেলেনের স্বামী, যার কাছ থেকে প্যারিস হেলেনকে চুরি করেন। এর ফলশ্রুতিতেই গ্রীক ও ট্রয়ের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়।
১১। ডক্টর ফাউস্টঃ ইয়োহান গিয়র্গ ফাউস্ট নামক পনেরো শতকের একজন আলকেমিস্ট, জ্যোতিষী, রেনেসাঁ যুগীও মঞ্চ-জাদুকর। পরে তিনি লোককথার কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ডক্টর ফাউস্টের কাহিনী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একাধিক নাটক লেখা হয়েছে, যার মাঝে ইংরেজ ক্রিস্টোফার মারলো এবং জার্মান ইয়োহান উলফগ্যাঙ ফন গোয়েথে-এর কাজগুলো সর্বাধিক স্বীকৃত। গল্প অনুযায়ী ফাউস্ট শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আর ক্ষতি ছাড়া ভাল হয়নি।
১২। মেফিস্টোফিলিসঃ জার্মান লোককথার দানব বিশেষ। প্রথমে ফাউস্টের কাহিনীতে বর্ণিত এবং পরে অন্যান্য অনেক সাহিত্য-কর্মেই এর দেখা পাওয়া যায়।
১৩। ভ্যালেন্টিনঃ ডক্টর ফাউস্টকে নিয়ে লেখা নাটকের অন্যতম চরিত্র।
১৪। মার্গারেটঃ ডক্টর ফাউস্টকে নিয়ে লেখা নাটকের অন্যতম চরিত্র।
১৫। ট্রয়ের হেলেনঃ হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াডের বর্ণনা মতে হেলেন অফ ট্রয় ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। ট্রয় নগরীর রাজপুত্র প্যারিসের সঙ্গে তিনি পালিয়ে যাবার ফলেই গ্রীস ও ট্রয়ের মাঝে যুদ্ধ বাঁধে এবং দীর্ঘ দশ বছর প্রতিরোধের পর গ্রীকদের কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ট্রয়ের পতন ঘটে।
১৬। নার্সিসাসঃ গ্রীক পুরাণের শিকারি চরিত্র যে জলে আপন প্রতিবিম্ব দেখে নিজের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।
১৭। ব্যাপটিজমঃ খ্রিষ্টানদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে একজন ব্যক্তিকে আরেকজন খ্রিষ্টান ব্যক্তির দ্বারা পবিত্র পানিতে নিমজ্জিত করে এবং বের করে আনার মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় ধর্ম-সংঘের সদস্য করে নেওয়া হয়।
১৮। হিপোগ্রিফঃ পুরাণে বর্ণিত অর্ধ-ঈগল অর্ধ-ঘোড়া।
১৯। লীগঃ দূরত্বের পরিমাপ বিশেষ। তিন মাইলে এক লীগ হয়ে থাকে।