- বইয়ের নামঃ দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স
- লেখকের নামঃ আলেকজান্ডার ডুমা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী
দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স
১. কর্সিকা ভ্রমণ
১.
১৮৪১ সাল। মার্চ মাসের শুরু। কর্সিকা ভ্রমণে আমি বেরিয়ে পড়লাম। ছবির মতোই সুন্দর দেশ কর্সিকা। এ দেশে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই আছে।
কর্সিকা যেতে হলে ঠুলো থেকে জাহাজে চাপবেন। আজাইচো পৌঁছে যাবেন বিশ ঘণ্টার মধ্যে, বাস্তিয়ায় পরের দিন।
বাস্তিয়ায় পৌঁছে চলাচলের সুবিধার্থে একশো ফ্রা খরচ করে ঘোড়া কিনতে পারেন। আবার ঘোড়া ভাড়াও করতে পারেন। পাঁচ ফ্রা ভাড়া প্রতিদিন। দাম কম মনে হলেও ঘোড়াগুলো ফেলে দেবার মতো নয়। দুর্গম পাহাড় বা নড়বড়ে সেতু, কোনো কিছুই ওই ঘোড়াদের অজানা নয়। আরোহীরা নিশ্চিন্তে ওদের পিঠে চাপতে পারেন। তাদের পিঠে চাপলে আরোহীদের আর অন্যকিছু করার দরকার নেই। রাশ আলগা করে, চোখ বুজে থাকলেই হলো। ভয়ডর গ্রাহ্য না করে বাহন আপনাকে ঠিক পৌঁছে দেবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আর শক্তিশালী ঘোড়াগুলো টানা পঁয়তাল্লিশ মাইল চলতে পারে কোনো রকম খাবার ছাড়াই।
যাবার পথে চোখে পড়বে কোনো ভাঙা দুর্গ, মনে চাইলে ঘোড়া থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরে আসতে পারেন দুর্গ থেকে। অথবা মন চাইলে দুর্গের বাইরের ছবিও আঁকতে পারেন। ঘোড়ার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ওটা ছাড়া পেলেও পালিয়ে যাবে না। আশপাশেই ঘুরবে। ঘাসটাস পেলে খাবে, নয়তো চিবোবে ঝোঁপঝাড়ের পাতা, আর তাও না মিললে পাথরের শ্যাওলা চেটেই খুশি সে।
পথে যেতে যেতে রাতের আঁধার ঘনিয়ে এলেও ভয় নেই। দুশ্চিন্তা করতে হবে না রাত কাটাবার। কারণ খুবই অতিথিপরায়ণ কর্সিকার মানুষ। যে কোনো গ্রামের যে কোনো বাড়িতে গিয়ে রাত কাটানোর জন্য আশ্রয় চাইলে পাবেনই। আপনার যে বাড়িটা পছন্দ হয় সে বাড়ির সামনে নেমে কড়া নাড়লেই হলো, আদর অভ্যর্থনা করে গৃহস্বামী নিয়ে যাবে ঘরে। খাবার কিছু থাকলে সেটুকু অতিথিকে দিয়ে আপ্যায়িত করবে। আর একটি মাত্র বিছানা থাকলে তাতে শোবার বন্দোবস্ত করে দেবে। পরের দিন অতিথিকে ঘোড়ায় তুলে দেয়ার সময় বিনীত ভঙ্গিতে বলবে, ‘আমার বাড়িতে এসে আমাকে ধন্য করে গেলেন। এ অনুগ্রহ মনে রাখব আমি।’
ভুলেও আতিথ্যের বিনিময়ে টাকা দিতে যাবেন না। গৃহস্থ খুবই অপমান বোধ করবে তাহলে, মনে চাইলে বাড়ির চাকরানীকে একটা রঙিন রুমাল দিতে পারেন, সে সালাম করবে ওটা মাথায় বেঁধে। যদি চাকর থাকে তাকে চাকু বা ভেজোনি দিতে পারেন। শত্রু ঘায়েল করতে কাজে লাগবে।
চাকর চাকরানীকে উপহার দেয়ার আগে একটা ব্যাপার জেনে নেয়া দরকার–গৃহকর্তার সাথে ওদের কোনোরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে কি না। যদি থাকে উপহার দেয়া চলবে না।
কর্সিকায় ধনী আত্মীয়ের কাছে গরিব আত্মীয়রা এসে আশ্রয় নেয়। তবুও গলগ্রহ হয়ে থাকে না। ঘর সংসারের কাজ করে দেয়। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ছাড়াও পারিশ্রমিক কিছু পায়। কিন্তু কারও কাছ থেকে বকশিস নেবে না। কাজেই বকশিস দেয়া যাবে না ওদেরকে।
চাকরের কাজ করলেও আত্মীয়রা কখনও কাজে ফাঁকি দেয় না। ফরাসি দেশ নয় কর্সিকা দেশটা, যদিও দুটো দেশই আজ রাজনীতি সূত্রে বর্তমানে এক সাথে গাঁথা।
পথ চলার কথা বলছিলাম। পথে চোর ডাকাতের কোনও ভয় নেই। ঘোড়ার জিনেই সোনার মোহর ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারেন আজাইচো থেকে বাস্তিয়া পর্যন্ত। সম্পূর্ণ দ্বীপ এলাকা ঘুরতে পারেন নিশ্চিন্তে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে দ্বীপের বাসিন্দা কারো সাথে আপনার বংশগত বিবাদ না থাকে।
যদি সেটা থেকেই থাকে, আপনি সেডাকো থেকে ওশিয়ানা এ পথটুকুও নিরাপদে চলতে পারবেন না। যদিও মাত্র ছয় মাইল এর দূরত্ব।
আমার কর্সিকা ভ্রমণের কথাই এবার বলি। মার্চ মাসের শুরু। আমি একা বন্ধু সারাদিন রোমেই থেকে গেছে।
এলবা থেকে আসছি আমি। একটা ঘোড়া কিনেছি বাস্তিয়া থেকে নির্দিষ্ট দামে, কোটে, আজাইচো দেখে এগিয়ে যাচ্ছি সার্টেন অঞ্চল দিয়ে। এবার সুন্না কারো যাব আমি।
সার্টেন থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরত্ব সুন্না কারোর। দ্বীপের মধ্য দিয়েও পাহাড়গুলোর মাঝখান দিয়ে সোজা যাওয়া গেলে পথ অনেক কম হতো। একজন গাইড নিয়েছি সাথে, পাহাড় অঞ্চলে পথ হারানোর ভয় থাকে। বিকেল ৫টার সময় পাহাড়ের মাথায় উঠলাম। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে অলমোটা আর সুল্লাকারো।
এখানে বিশ্রাম নেবার সময় গাইড জানতে চাইল–আমি রাতে কোথায় থাকবো। নিচের সমতলে গ্রামগুলো একবার দেখে নিলাম।
গ্রামের পথ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ দেখা যাচ্ছে না। ভয়ার্ত ভাবভঙ্গির কয়েকজন মহিলা শুধু চোখে পড়ল।
মনে হলো গ্রামে বাড়ির সংখ্যা হবে একশো থেকে একশো বিশটার মতো। দেশের নিয়ম অনুযায়ী এর যে কোনো বাড়িতে আমি আশ্রয় নিতে পারি। সুতরাং আমার এখন কাজ হলো এর মধ্যে থেকে এমন একটা ঘর বেছে নেয়া যাতে একটু আরামের পরিমাণ বেশি থাকবে।
নজর কাড়ল একটা পাথুরে বাড়ি। একটা ছোট কেল্লার মতো দেখতে চারদিকে উঁচু দেয়াল, তার গায়ে বন্দুক চালাবার ছিদ্র।
সাধারণ বাড়িকে দুর্গের মতো করার চেষ্টা আমি এই প্রথম দেখলাম। অবাক হলাম না, কারণ আমার জানা আছে, বংশগত মারামারির মূল হচ্ছে সার্টেন প্রদেশ এই কর্সিকা দ্বীপে।
বাড়িটা দেখার পরে, গাইড বলল, আপনার পছন্দ-অপছন্দ আছে, কোথায় সুবিধা হবে, তা বেশ ভালো বুঝতে পারেন। চলুন–মাদাম ম্যাভিলিয়া দ্য ফ্রাঞ্চির বাড়িতেই আমরা যাই।
একটা খটকা লাগল আমার মনে, মহিলা যদি বাড়ির মালিক হয়, তাহলে তার ওখানে উঠতে গেলে সে আপত্তি করতে পারে।
‘আপত্তি কেন করবে?’ গাইড সে আশংকা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল।
আমার ভয়ের কারণ আমি তখন তাকে খুলে বললাম, বাড়ির মালিক যদি তরুণী হয় আর আমি তার ওখানে রাত কাটাই তাহলে তার বদনাম হতে পারে?
‘বদনাম!’ গাইড অবাক হলো।
‘মহিলা যদি বিধবা হয়।’
গাইড জানাল–‘বিধবাই তো’।
‘আমার মতো একজন যুবককে তিনি তাহলে কি বলে বাড়িতে থাকতে দেবেন।’
‘১৮৪১ সালে এই ডুমার বয়স ছিল সাড়ে ছত্রিশ। সুতরাং নিজেকে আমি যুবক বলেই মনে করতে পারি।’
‘আমার কথাগুলোই গাইড হুবহু আউড়ে গেল, আপনার মতো যুবককে কি বলে বাড়িতে থাকতে দেবেন?’ তারপর উল্টো প্রশ্ন করল,–‘আপনি যুবক হোন বা বৃদ্ধ, তার সঙ্গে অতিথি হওয়ার সম্পর্ক কী?’
এভাবে প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই আমাকে অন্য পথ ধরতে হলো।
‘মাদাম ম্যাডিলিয়ার বয়স কত?’
‘প্রায় চল্লিশ তার বয়স।’
‘মনটা খুশি হয়ে গেল, বাঁচা গেল। তাহলে তার ছেলেমেয়েও আছে?’ নিশ্চিত মনে বললাম।
‘দুই ছেলে, দুজনেই যুবক।’
‘তাদের সঙ্গে দেখা হতে পারে?’
‘যে ছেলেটি ওখানে থাকে, তার সাথে দেখা হতে পারে।‘
‘অপরজন?’
‘সে প্যারিসে থাকে।‘
‘ওদের বয়স কত?’
‘একুশ।’
‘দুজনেরই?’
‘কী করে ওরা?’
‘যে থাকে প্যারিসে, সে উকিল।’
‘আর দ্বিতীয়জন?’
‘সে আসল কর্সিকাবাসীর যেরকম হওয়া দরকার সেরকমই। অন্যজন ঠিক তেমনই।’
একটা আলাদা অর্থ আছে উত্তরটার। গাইড কিন্তু সে ব্যাপারে মোটেই সচেতন নয়। বললাম, ‘চলো তাহলে মাদাম ম্যাভিলিয়ার বাড়িতে যাই।’
মিনিট দশেক সময় লাগল গ্রামে পৌঁছাতে। পাহাড়ের উপর থেকে যা দেখা যায়নি। তা এখন চোখে পড়ল। প্রত্যেকটা বাড়িতেই ছোট ছোট আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। মাদাম ম্যাভিলিয়ার বাড়ির মতো না হলেও সবাই জানালার পিছনে মোটা মোটা কাঠ খাড়া করে রেখেছে। আততায়ী জানালা। ভাঙলেও কাঠের বেড়া দিয়ে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু কাঠের ফাঁক দিয়ে বাড়ির বাসিন্দা বন্দুক চালাতে পারবে। অনেক জানালা আবার সম্পূর্ণ ইট দিয়ে গেথে বন্ধ করে দিয়েছে।
গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম–বন্দুক চালানোর ওই ফাঁকগুলোকে ওদের ভাষায় কী বলে?
‘তীর ফাঁক। সে জানাল। বংশগত মারামারি যে এদেশে অনেক পুরানো তা নাম শুনেই বোঝা যায়। যখন বন্দুকের আবিষ্কার হয়নি, তীর ছিল যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র তখন থেকেই কর্সিকাবাসীরা তীর-ধনুক দিয়ে লড়াই করত।
গ্রামের পথে চলার সময় মনে হয় একটা ঠাণ্ডা থমথমে ভাব। অনেক বাড়ির দেয়ালেই গুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম।
মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে–‘তীর ফাঁক দিয়ে ভেতরের বাসিন্দাদের চাউনি, এক পলক আমাদের দেখে নিয়েই সরে যাচ্ছে। এরা পুরুষ না মেয়ে তা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।
উপর থেকে গাইডকে যে বাড়িটা দেখিয়েছিলাম, সেখানে এসে থামার পর দেখলাম গ্রামের সবচেয়ে ভালো বাড়িই এটা।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম কাছে এসে। উঁচু থেকে খুব সুরক্ষিত মনে হয়েছিল বাড়িটাকে, কিন্তু আসলে তা না! দেয়াল আছে, গম্বুজ আছে, তীর ফাঁক সব ঠিক আছে। কিন্তু জানালা? জানালাগুলো শুধু রুইতন আকৃতির কাঁচের টুকরো দিয়ে ঢাকা। তার পিছনে কাঠের বেড়া তো দূরের কথা কাঠের পাল্লা পর্যন্ত নেই। কোনো জানালা ইট দিয়ে বন্ধ করা নেই। অথচ আশেপাশের দেয়ালের গায়ে বহু গুলির চিহ্ন রয়েছে। অন্তত দশ বছরের পুরনো হবে সে দাগগুলো।
গাইড দরজায় নক করতেই দরজা খুলে গেল। উঁকি দেয়ার বা দ্বিধার ভাবে নয় একেবারে দরজা পুরো খুলে একজন খানসামা বেরিয়ে এল।
খানসামা বলে মনে হয় ভুল করলাম, খানসামা না বলে বলা উচিত ছিল–মানুষ। পোশাক না থাকলে কেউ তাকে খানসামা বলতে পারবে না। এর পরনে একটা শুধু ভেলভেটের জ্যাকেট ও পাজামা। একটা ডোরাদার রেশমি বেল্ট দিয়ে আটকানো। সেই বেল্টে আছে আবার বড় একটা স্পেনীয় ছোরা।
আমি তাকে লক্ষ করেই বললাম–‘বন্ধু আমি এদেশে নতুন। সুন্না কারাতে কাউকেই চিনি না। তোমার মালিকের বাড়িতে অতিথি হতে চাওয়া কি আমার পক্ষে অবিবেচনার কাজ হবে?’
‘না, মালিক, না’–লোকটি সবিনয়ে জবাব দিল–কারও বাড়িতে অতিথি হওয়া মানে তাকে সম্মানিত করা।’
এরই মধ্যে একজন দাসী এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে, লোকটি তাকে বলল, ‘যাও মেরায়া মাদাম ম্যাভিলিয়াকে বলো, একজন ফরাসী পর্যটক তার গৃহে অতিথি হতে চান।
কথা বলতে বলতে সে বাঁশের মইয়ের মতো খাড়া সেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আমার ঘোড়ার লাগাম হাতে তুলে নিল।
‘ভেতরে চলে আসুন আপনি। আমরা আপনার জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছি ।’
খুশি হলাম কথাটা শুনে। পথ চলার এই পরিশ্রমের পর এই কষ্টটুকু থেকে বাঁচাও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।
মইয়ের মতো সেই সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ভেতর উঠে গেলাম। সামনেই একটা লম্বা বারিন্দা। তার শেষ মাথায় এক মহিলার সঙ্গে দেখা হলো। পরনে কালো ড্রেস, বেশ লম্বা।
মনে হলো এর বয়স হতে পারে ৩৮ বা ৪০। এই বয়সেও বেশ সুন্দরী ইনি। বাড়ির মালিক বোধ হয়। থেমে গিয়ে সালাম দিলাম। তাকে ভদ্রভাবে বললাম, ‘মাদাম আমাকে হয়তো অবিবেচক ভাববেন আপনি। তবে দেশের নিয়মে এবং আপনার চাকর বাকরের আমন্ত্রণ–এই দুয়ের কথা চিন্তা করে আমাকে আপনি ক্ষমাও করতে পারেন।
‘আমি আনন্দিত আপনাকে স্বাগত জানাতে পেরে উত্তর দিলেন মাদাম ফ্রাঞ্চি ‘আপনাকে পেয়ে আমার ছেলেও খুশি হবে। এ বাড়িতে নিজের বাড়ি মনে করেই থাকুন।
‘ম্যাডাম, আমি কেবলমাত্র এক রাতের জন্যেই আশ্রয় চাই, কাল ভোরেই আমাকে চলে যেতে হবে। আবার তাকে সালাম দিয়ে আমি বললাম।
‘সে আপনার ইচ্ছে। যাতে আপনার সুবিধা হয়। তবে আমার আশা আপনি আপনার মত বদলাবেন এবং আরও দুই-চারদিন থেকে যাবেন এখানে।
আমি তৃতীয়বারের মতো তাকে সালাম দিলাম।
মাদাম ফ্রাঞ্চি তখন মেরীয়াকে বললেন–ভদ্রলোককে লুইয়ের ঘরে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি ঘরে আগুন জেলে গরম পানি পৌঁছে দাও। চাকরানি আদেশ শুনে চলে গেল।
মাদাম আমার দিকে ফিরে বললেন-’পরিশ্রান্ত পর্যটকের প্রথম দরকার হলো পানি আর আগুন। আপনি দয়া করে ওর সঙ্গে যান। যা কিছু দরকার হবে, ওকে বলবেন। এক ঘণ্টার ভেতরেই আমাদের রাতের খাবার খাবো। ততক্ষণে আমার ছেলেও এসে যাবে। আপনাকে দেখে সে খুশিই হবে।
সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম–‘আমার ভ্রমণের পোশাক পড়েই যদি খেতে যাই। বেয়াদবি হবে না তো?
মাদাম হেসে বললেন–‘না–কিন্তু বিনিময়ে আপনাকেও স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের গ্রাম্য আচার-ব্যবহারকে আপনি বেয়াদবি বলে ভাববেন না।’
উপর তলায় যাচ্ছে দাসী। আমি মাদামকে চতুর্থবারের মতো সালাম দিয়ে তার পিছনে চললাম।
দোতলায় একটা ঘরে আমরা গেলাম। জানালা দিয়ে বাড়ির পিছনটা চোখে পড়ে। পিছনে একটা ছোট বাগানে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে–পাশে ছোট একটি খাল, সেটা কিছুদূরে গিয়ে টাভারা নদীতে মিশেছে।
ফারগাছগুলো বাগানের শেষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভেদ করে পিছনে আর দেখা সম্ভব নয়। ঘরের ভেতর দেখা গেল, যা সাধারণত ইতালির সব ঘরেই দেখা যায়। বিভিন্ন দৃশ্যের ফ্রেস্কো দেখা গেল দেয়ালের চুনকামের উপর।
এই ঘরটা মাদাম ফ্রাঞ্চির যে ছেলে ফ্রান্সে থাকে তার ঘর। বাড়ির মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর ঘর। সেই জন্যে অতিথিকে দিয়েছেন। মালিকের রুচি ও অভ্যাসের খানিকটা আভাস পাওয়ার জন্য ঘরটা পরীক্ষা করলাম।
আধুনিক আসবাব সবই। কর্সিকার এতটা ভেতরে এই আধুনিক পরিবেশ তৈরি করতে যে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। লোহার একটা পালঙ্ক, তাতে একটার উপর আর একটা গদি। তার উপরও আর একটা। একটা লম্বা সোফা, চারটি ছোট সোফা, ছয়টি সাধারণ চেয়ার। বইয়ের আলমারি সংযুক্ত করা লেখার টেবিলের সাথে। প্রত্যেকটি ফার্নিচার দামি মেহগনি কাঠের, এগুলো শুধু আজাইচোর প্রথম শ্রেণির ফার্নিচারের দোকানেই পাওয়া যায়।
সবগুলো সোফা আর চেয়ারে ফুল তোলা দামি কাপড়ের ঢাকনা দেয়া। জানালার এবং বিছানার পর্দাও সেই একই কাপড়ের।
মেরায়া ভেতরে থাকার সময় শুধু চোখ দিয়ে দেখেছি, ও বাইরে চলে গেলে, বইয়ের আলমারিটা খুলে দেখলাম, কী আশ্চর্য। ভেতরে আমার দেশের সেরা কবি ও লেখকদের বই–কর্নিল, ব্যসিল, মলেয়ার, লা-ফান্তন, রসনার্ড, ভিক্তর হুগো, লা মাতিন–ঐতিহাসিক সেজার, স্যাটু ব্রায়ান্ড, থিয়েরি, দার্শনিক–মন্তেল, প্যাস্কান, লা ব্রইয়ের বিজ্ঞান কুভিয়ের, বেনদান্ট, এলিক দ্য বোমান্ট সব বই আছে আলমারীতে। উপন্যাসও আছে। কিছু। আমার সমুদ্রের স্মৃতি বইটাও রয়েছে দেখে মনটা ভরে উঠল। আলমারিগুলো চাবি দেয়া। আমি সবগুলো খুলে দেখলাম। একখণ্ড কর্সিকার ইতিহাস আছে। ভ্যান্ডেটা (বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসা) বন্ধ করার উপায়টি যে বিষয়ে প্রবন্ধ, ফরাসি ভাষায় লেখা কিছু কবিতা। ইতালীর ভাষায় লেখা সনেট–কিছু আছে পাণ্ডুলিপি।
এসব দেখেই আমি প্রবাসী লুই দ্য ফ্রাঞ্চির রুচি ও চরিত্রের একটা ছবি তৈরি করে ফেললাম।
যুবকটি অবশ্যই আলাপী এবং পড়ুয়া। কর্সিকায় ফরাসি সভ্যতা প্রচলন করতে ইচ্ছুক, তাতে সন্দেহ নেই। এখন এটাও বোঝা যাচ্ছে, উকিল হওয়ার জন্য কেন সে ফ্রান্সে গিয়েছে।
পোশাক পাল্টাতে গিয়ে আমি এগুলো চিন্তা করছিলাম। আমার পোশাক একদম খারাপ না হলেও, এগুলো পরে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কিছু লোকের উদার মনের প্রয়োজন আছে। কালো ভেনভেটে টাইট জামা হাতার দিকে সেলাই খোলা। যাতে গরমের দিনে বাতাস লাগে। ভেতরের রেশমি শার্ট নজরে পড়ার জন্য জ্যাকেটের গায়ে মাঝে মাঝে ফারা। পাজামা ও জ্যাকেটের একই রং। হাঁটুর নিচে স্প্যানিশ ফ্যাশনের পট্টি জড়ানো। সেখানে রঙিন রেশমের কাজ করা। মাথায় পশমী কাপড়ের নরম টুপি, সেটা বিভিন্ন আকার দেয়া যায়। ভ্রমণকারীদের পক্ষে এই পোশাক খুব আরামের এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
আমি তৈরি হবার সাথে সাথে আমাকে যে লোকটি প্রথমে স্বাগত জানিয়েছিল সে ভেতরে ঢুকে জানাল, তার তরুণ মালিক মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চি এই মাত্র ফিরে এসেছেন এবং আমার অসুবিধা না হলে তিনি আমার সাথে আলাপ করতে চান।
আমি তাকে বললাম, মঁসিয়ে লুসিয়েনের যদি সুবিধা হয় তাতে আমি রাজি। তার সাথে দেখা হলে আমি-সম্মানিত বোধ করব।
একটু পরেই তাড়াতাড়ি পা ফেলে কেউ এদিকে আসছে শুনতে পেলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম আমার গৃহকর্তা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
.
২.
হলো গাইডের কথাই। এর বয়স বিশ/একুশ। কালো চুল, কালো চোখ গায়ের রং তামাটে–বলা চলে একটু বেঁটেই। খুবই ভালো স্বাস্থ্য।
অতিথিকে শুভেচ্ছা জানাতে সরাসরি বাইরের পোশাকেই চলে এসেছেন আমার কাছে। তার পরনে সবুজ সুতি ছোট জামা, ছাই রং সুতি পাজামা, পায়ে কাঁটাওলা বুট, কোমরে বুলেট বেল্ট থাকায় চেহারাতে মিলিটারি ভাব এসেছে, মাথায় টুপি-অনেকটা ফরাসি বাহিনীর আফ্রিকার সেনাদের মতো।
বুলেট বেল্টের ভেতরে বুলেট। বাইরের একপাশে পানির বোতল, অন্য পাশে পিস্তল। কাঁধে ঝুলানো একটা বন্দুকও রয়েছে।
একটু দৃঢ় ভাব তার চলাফেরায়, চোখের দৃষ্টি তার স্থির। কাজের লোক তাতে সন্দেহ নেই।
আমার পোশাক, বাক্স-সবই। সেও একপলকে সবকিছুই দেখে নিয়েছে।
‘নিশ্চয় বিরক্ত করিনি মঁসিয়েকে? এ দিয়েই শুরু করল সে–মাফ করবেন। আপনার কোনো কিছুর দরকার আছে কি না, জানার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এবার একটু হেসে বলল, ‘আসলে বাইরে থেকে কেউ আমাদের গরিবের ঘরে এলে, আমি ভয়ানক ঘাবড়ে যাই। সত্য কথা, আমরা কর্সিকার লোকেরা এখনও অসভ্য। তাই সুসভ্য ফরাসিদের কথা ছেড়েই দিলাম, যে কোনো লোককে আমাদের পুরানো ধরনের আতিথ্যের জন্য ভয় করে। অবশ্য আমরা প্রাচীন এই মত পাল্টাতে রাজি না, কারণ আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য সবই তো চলে গেছে। শুধু এটাই আছে।
আমি জবাব দিলাম, আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন। মাদাম ফ্রাঞ্চি যেভাবে সব ব্যাপারে দেখাশুনা করেছেন এবং এই ঘরে বসে বাইরে না চাইলে মনে হয় না যে আমি বিদেশে আছি। ফ্রান্সের রাজধানীতে নেই। কাজেই নিজেকে অসভ্য বলে যা বলতে চেয়েছেন সেটা শুধু রহস্য ছাড়া আর কিছুই না।’
লুসিয়েন হেসে বলল, এই ঘরটা ফ্রান্সের ঘরগুলোর মতো করেই সাজানো। এটা ভাই লুইয়ের জন্য। সে ফরাসি ফ্যাশনে বাস করতে ভালোবাসে। তবুও আমার মনে হয় এই ঘর তাকে এবার ফ্রান্স থেকে ফিরে এলে আর তৃপ্তি দিতে পারবে না।
আমি জানতে চাইলাম–‘অনেক দিন থেকেই কি আপনার ভাই প্যারিসে আছেন?’
‘না। মাত্র দশ মাস।’
‘তাড়াতাড়ি কি ফেরার কথা আছে?’
‘তিন-চার বছরের ভেতর না।’
‘আপনাদের দুই ভাইয়ের মনে হয় আগে কখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি। এখন এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে কষ্ট হবে না?
‘অবশ্যই হবে। আমরা যে এক সাথে ছিলাম তাই না, একে অন্যের জন্য টানও বেশি।
‘তাহলে–সে অবশ্য পড়াশোনা শেষ হবার আগে আপনার সাথে দেখা করে যাবেন।
‘যেতে পারে। আমাকেও সে কথাই বলে গিয়েছে।
‘কিন্তু সে এলো না। আপনিও তো তার সাথে গিয়ে দেখা করতে পারেন।
‘আমি? আমি কখনও কর্সিকার বাইরে যাই না।’
দেশপ্রেমিক অনেক আছে। লুসিয়েনের বলার ভাব থেকে এটাই মনে হলো, তাদের জন্মভূমিই সবার চেয়ে সেরা অন্য সব দেশ তুচ্ছ। তার দেশ প্রেম একটু উগ্রই মনে হলো।
আমি হেসে ফেললাম।
লুসিয়েনও হেসে ফেলল তা দেখে, ‘আপনি, এমন অদ্ভুত লোক দেখেননি, যে কর্সিকার মতো হতভাগা দেশ ছেড়ে বেড়াতে যায় না, তাই হাসছেন। কিন্তু কি আশা করেন আপনি? আমার জন্ম এই মাটিতেই। এই সমুদ্রের বাতাসেই আমি বাঁচি। এখানের পাহাড়ের কুয়াশায় আমার চোখ যেমন পরিষ্কার হয়। সেটা আর কোথায়ও হয় না। ঝরনা-পাহাড় ঘুরে বেড়িয়ে জঙ্গলের রহস্য আবিষ্কার করে আমি যে আনন্দ পাই–সেটা অন্য কোথায়ও নেই। আমরা চাই অবাধ স্বাধীনতা। আমাকে যদি শহরে যেতে হয়, তাহলে বোধহয় মারাই যাব।’
আমি তাকে তাদের দু’ভাইয়ের এই পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলাম।
‘তাকে সামনে দেখলে, অন্য কিছু বলতেন আপনি। চেহারায় এমন হুবহু মিল থাকার পরেও, প্রকৃতি কেমন করে এত আলাদা হলো।
‘দুজন বুঝি একই রকম দেখতে?
‘একদম। ছোটকালে মা আমাদের জামায় আলাদা চিহ্ন দিয়ে রাখতেন। যাতে সহজে চেনা যায়।
‘বড় হবার পর?
বড় হওয়ার পর গায়ের রং একটু সামান্য তফাৎ হলো। আর কিছু নয়। সব সময় ঘরে বসে বই পড়া আর ছবি আঁকার জন্য ভাইয়ের রঙ একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল, ওদিকে আমি পাহাড়, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার ফলে গায়ের রং হলো তামাটে।
‘নিজের চোখে দুজনকেই পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। যাওয়ার সময় মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির কাছে কোনো চিঠি দেন, তাহলে সেটা দেয়ার সুযোগে তাকে দেখতে পাব বলে আশা করি।
‘আপনি যদি অনুগ্রহ করে সে কষ্ট স্বীকার করেন। অবশ্যই দেব। আনন্দের সঙ্গে দেব। কিন্তু আপনার পোশাক পরা প্রায় শেষ। আর আমি শুরু করিনি। কিন্তু আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা খেতে বসব।’
আমি জানতে চাইলাম, পোশাক বদল কি আমার খাতিরে?
উত্তর দিল, সে যদি হয়, দোষ আপনার। নিজে পোশাক পাল্টিয়ে আমাকে পথ দেখিয়েছেন। আমার পরা আছে ঘোড়ার চড়ার পোশাক। এগুলো বদলে পাহাড়ে চড়ার পোশাক আমাকে পড়তে হবে। রাতের খাবারের পর আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। এই কাটাওলা বুট তাই পাল্টাতে হবে।
‘খাবার খেয়েই বের হবেন?’
‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’
আমি হাসলাম।’
‘না, না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এটা অন্য কাজ।’
‘আমাকে সবকিছু খুলে বলবেন–এটা অবশ্যই আশা করি না।’
‘কেন করবেন না? আমার লুকোবার কিছু নাই। এমন ভাবি আমি চান না যাতে কোনো কিছু আমার লুকোবার প্রয়োজন হয়। আমার কোনো প্রেমিকা ছিল না। হবেও না কোনোদিন। তাই যদি বিয়ে করে, তার বাচ্চা হয়। তাহলে সম্ভবত আমি বিয়েও করব না। তবে সে যদি বিয়ে না করে। তখন বংশ রক্ষা করতে আমাকে বিয়ে করতেই হবে।’
এখানে কথা থামিয়ে একটু হেসে ফেলল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি রীতিমতো বর্বর একজন মানুষ। পৃথিবীতে আসতে আমার ১০০ বছর দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে যদি কথা বলতে থাকি, তাহলে খাওয়ার আগে পোশাক বদলানো হবে না আমার।’
‘কিন্তু পোশাক বদলাতে বদলাতেও তো কথা বলা যায়–এক মিনিটের জন্যও ওকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। ঐ সামনের ঘরটা তো আপনার। দরজাটা খুলে রেখে আপনার ঘর থেকে কথা বলুন, আমার ঘর থেকে আমি বলি।
‘তার চেয়েও ভালো হয়, আপনি যদি আমার ঘরে আসেন। ঘরের সাথেই আমার পোশাকের ঘর। আপনি অস্ত্রশস্ত্র ভালোবাসেন তো? আমার অস্ত্রশস্ত্র দেখুন। এর ভেতর কিছু ঐতিহাসিক মূল্যও আছে।’
এটাই চাইছিলাম আমি। দুই ভায়ের দুইটা ঘর দেখাতেই ওদের রুচি পার্থক্য সহজেই আমার চোখে পড়বে। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। কাজেই লুসিয়েনের মুখ দিয়ে কথা বেরুবার সাথেই আমি তার পেছনে চললাম।
নিজের ঘরের দরজা খুলে লুসিয়েন আমাকে তার ঘরে ঢুকার জন্য ইশারা করল। এক পা ভেতরে ঢুকে আমার মনে হলো–ঢুকে পড়েছি একটা অস্ত্রাগারে।
এখানের সব ফার্নিচার পনেরো/ষোলো শতাব্দীর। পালঙ্কের চারদিকে চারটি মোটা কাজ করা দামি কাঠের খুটি, তাদের মাথার উপরে সবুজ ভেলভেটের চাদোয়া, চাদোয়ার গায়ে সোনালি ফুলের বুটি। জানালাতেও ওই একই কাপড়ের পর্দা।
দেয়ালে স্পেনের চামড়ার আবরণ। যেখানে একটু ফাঁক রয়েছে, উঁচু টেবিলে বা ব্রাকেটের উপর আধুনিক বা মধ্য যুগীয় কোনো বিশেষ অস্ত্র রেখে দেয়া হয়েছে। যে লোক এ ঘরে থাকে তার রুচির ব্যানারে বুঝতে আর বাকি থাকে না। এর ভাই যেমন শান্তি প্রিয়, এ তেমনি যুদ্ধবাজ।
পোশাকের ঘরে ঢোকার সময় লুসিয়েন বলল, ‘ভালো করে এসব দেখুন। তিন শতাব্দীর অস্ত্রের নমুনা এখানে পাবেন। আমি ততক্ষণে পাহাড়ে চড়ার পোশাকটা পরেনি খাওয়ার পরেই বের হতে হবে।
আপনি বলেছিলেন কোনো কোনো অস্ত্রের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সে কোনগুলো? তরোয়াল, না বন্দুক, না ভোজালি?
সে ধরনের তিনটি আছে। এক নম্বর ওই ভোং টা যেটা আমার বিছানার মাথার কাছে রয়েছে, লম্বা হাতল বাটের উপর সীল মোহর আঁকা।
‘হ্যাঁ দেখেছি। বলুন এবার।’
‘ওটা হলো স্যামপিত্রোর ভোজালি।’
‘বলেন কি? সেই কুখ্যাত স্যামপিত্রো? ভ্যানিলাকে যে হত্যা করেছিল?
‘হত্যা করেছিল বলবেন না, বলুন ভ্যানিলার উপর প্রতিহিংসা নিয়েছিল।’
‘আমার কাছে তো দুটোই এক রকম লাগে।’
‘যারা কর্সিকার বাইরের লোক, তারা ওই রকমই ভাবে। স্যাসলিত্রো কর্সিকাবাসীদের চোখে অন্যরকম।
‘সে কথা থাক–ভোজালিটা সত্যি তার তো?’
‘লক্ষ্য করুন, স্যাসলিব্রোর বংশ পরিচায়ক অস্ত্র চিহ্ন খোদাই করা আছে। শুধু বাদ পড়েছে ফ্রান্সের রাজকীয় লিলি ফুল। পার্পিসার অবরোধের পরে স্যাসলিত্রোকে লিলি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
‘আমি কিন্তু এটা জানতাম না। কিন্তু আপনার হাতে এল কি করে এ ভোজালি?
‘আজ তিনশো বছর আমাদের বংশে রয়েছে এই ভোজালি। স্যাসপিত্রো নিজেই ওটা দিয়েছিলেন আমার পূর্ব পুরুষ লেলোলি’র দ্য ফ্রাঞ্চিকে।
‘উপলক্ষ্য?
‘উপলক্ষ্য হলো এই। স্যাসপিত্রো আর আমার ওই বুড়ো পূর্ব পুরুষ এক সময়ে একসঙ্গে জেনোয়াবাসীদের পাল্লায় পড়েন। জেনোয়ার সৈন্যরা ওত পেতে ছিল, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ওপর। অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন দুজনে, স্যাসপিত্রোর শিরস্ত্রাণ খুলে পড়ে যায় এক ঘোড়সওয়ার শক্ত লোহার মুগুর তোলে তার মাথার উপরে। ঠিক সেই সময়ে বুড়ো পিতামহ তার ভোজালি ঢুকিয়ে দেয় শত্রুর লৌহবর্মের জোড়ের মুখ দিয়ে। আহত হয়ে লোকটা তো ঘোড়া ছুটিয়ে দে দৌড়। কিন্তু বুড়ো পিতামহ আর তার ভোজালি খুলে নিতে পারলেন না তার দেহ থেকে। এত গভীরভাবে অস্ত্রটা ঢুকে গিয়েছিল, অত তাড়াতাড়ি তা বের করে আনা গেল না। তখন তাঁর আপসোস দেখে কে! তার বড় শখের হাতিয়ার ছিল ওটা, ভদ্রলোকের ক্ষতিটা অপূরণীয় মনে হতে লাগল। তার দুঃখ দেখে স্যামপিত্রো তাঁকে নিজের ভোজালি উপহার দিলেন, খাস স্পেনের তৈরি। দুটো পাঁচ ফ্রাঙ্ক মুদ্রা রেখে এই ভোজালি দিয়ে কোপ দিলে দুটোই কেটে যাবে।
‘বলেন কি?’
‘পরীক্ষা করেই দেখুন না।
আমি মেঝেতে দুইটা মুদ্রা একটার উপর আর একটা রেখে ভোজালি দিয়ে জোরে কোপ দিলাম। দেয়ার পর দেখা গেল, লুসিয়েনের কথাই ঠিক। দুটো মুদ্রা কেটে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে।
হেসে বললাম, ‘সন্দেহ নাই, এটা স্যামপিত্রোর ভোজালি, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে, এরকম ধারালো অস্ত্র থাকতেও তিনি স্ত্রীকে মারার জন্য দড়ির ফাঁস ব্যবহার করলেন।
‘বাঃ এ অস্ত্র তখন কোথায়? অনেক আগেই এটা আমার বুড়ো পিতামহকে দিয়ে দিয়েছেন।
‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক।
‘তার বয়স তখন ষাট। পৃথিবীকে একটা মূল্যবান শিক্ষা দেয়ার জন্য স্যামপিত্রোকে কনস্ট্যাল্টিলোপন থেকে আই-তে ছুটে আসতে হলো। শিক্ষাটা এই, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কোনো মহিলাকে নাক গলাতে দেয়া উচিত না।
এর উত্তর আমার কাছে ছিল না। নীরবে আগের জায়গায় ভোজালি রেখে দিলাম। লুসিয়েনের তখন পোশাক পরা হয়নি। আমি অন্য দুইটি ঐতিহাসিক জিনিস জানতে চাইলাম।
‘পাশাপাশি ওই দুটি ছবি দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, পাওনি আর নেপোলিয়ন।’
‘ঠিক, পাওলির পাশে একটা তরোয়াল।’
‘হ্যাঁ।’
‘তারই তরোয়াল।
‘বলেন কি তারই তরোয়াল? এটাও নিশ্চয়ই স্যামপিত্রোর ভোজালির মতো মূল্যবান।
‘হ্যাঁ, এটাও মালিক নিজে থেকে দিয়েছেন। তবে ওটা দিয়েছেন কোনো বুড়ো পিতামহ কে না, দিয়েছেন বুড়ো মাতামহীকে।
‘এক মহিলাকে তরোয়াল উপহার?
‘তাঁর কথা আপনি শুনতে পারেন। সুল্লাকারোর দুর্গে এক মহিলার আবির্ভাব হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তার সঙ্গী ছিল এক যুবক।
‘না। যদি আপনি ঘটনাটা বলেন।
‘সুল্লাকারোতে এসে মহিলা আর এই যুবক পাওলির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন, পাওলি তখন লেখার কাজে ব্যস্ত ছিল, বলে দিলেন দেখা হবে না। মহিলাটি চাপাচাপি করতে লাগল, প্রহরীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পাওলির কানে এই গোলমালের গেলে, তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
মহিলা জানালেন, ‘আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
পাওলি জানতে চাইলেন, কী বলতে চান?
‘আমার দুটি ছেলে, কাল খবর পেলাম যে বড় ছেলে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, শুনে আমি ষাট মাইল হেঁটে আপনার কাছে এসেছি, ছোট ছেলেটিকে আপনার সৈন্য দলে দেবার জন্য। সে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এক কালে স্পার্টার মহিলাদের সম্পর্কেই এ ধরনের কথা শোনা যেত। এ মহিলাটি কে?
‘আমার পিতামহ, নিজের কোমর থেকে খুলে পাওলি তরোয়াল তুলে দিয়েছেন আমার দাদীর হাতে। বলুন সে এই তরোয়াল পাওয়ার যোগ্য কি না?
‘নিঃসন্দেহে যোগ্য। কিন্তু ওপাশের তরোয়ালটি–
‘এটা তো নেপোলিয়নের তরোয়াল। পিরামিডের যুদ্ধে এটাই তিনি ব্যবহার করেছিলেন।’
‘এটাও নিশ্চয়ই আপনার পরিবারে ওইভাবে এসেছিল।’
‘তখন পিরামিডের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তখনও এক দল মামলুক সৈন্যরা তাদের আহত সর্দারকে নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য তৈরি। আমার পিতামহ ছিলেন গাইড সৈন্য দলের এক সেনাপতি। নেপোলিয়ন তাকে ওই দলটাকে আক্রমণ করতে আদেশ দিলেন। যুদ্ধে পরাজিত করে, আহত সর্দারকে বন্দি করে নিয়ে এলেন নেপোলিয়নের সামনে। তারপর তরোয়াল যখন খাপে ভরতে যাবেন, দেখলেন, মামলুকদের কারণে তরবারির আঘাতে আঘাতে তার তরোয়াল এমনভাবে বাঁকা হয়েছে যে, তা আর খাপে ঢোকানো যাচ্ছে না। পিতামহ তখন খাপ আর তরোয়াল দুটোই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বোনাপার্টি তখন নিজের তরোয়ালটিই তাকে দিয়ে দিলেন।
একটু সময় আমি চুপ থেকে বললাম–নেপোলিয়নের তরবারিটা আপনারা যত্ন করে টানিয়ে রেখেছেন, কিন্তু আমি হলে এ দেয়ালে আমার পিতামহের বাঁকা তরোয়ালটাই শোভা পেত।’
‘ওই উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখুন। নেপোলিয়নের ঠাকুরদার ভাঙা তরোয়ালটা যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তারপর তার হাতলে একটা হীরা বসিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওতে একটা লাইন লিখে দিয়েছিলেন, পড়ে দেখুন।
সামনে গেলাম, দুই জানালার মাঝখানে ভাঙা তরোয়ালটা রয়েছে। যতটা খাপের মধ্যে ঢোকে ততটা ঢোকানো বাকিটা বাইরে।
সামনে গিয়ে পড়ে দেখলাম–সেই বাকানো পাত্রের উপরে সোজা একটা লাইন খোদাই করা।
‘২১ জুলাই, ১৭৭৮ পিরামিডের যুদ্ধ।
সেই চাকরটি এবার এসে দেখা দিল, যে এর আগে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল এবং লুসিয়েনের ফেরত আসার খবরও জানিয়েছিল।
সে লুসিয়েনকে জানাল–মঁসিয়ে, মাদাম ফ্রাঞ্চি আপনাকে জানাতে বলল, যে খাবার তৈরি।
লুসিয়েন বলল–‘গ্রিফো–তুমি মাকে গিয়ে জানাও আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি ।’
পাহাড়ে চড়ার পোশাক পড়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, ভেলভেটের ছোট জামা, পাজামা আর পট্টি। কোমরে তার আগের দেখা কার্তুজ ভরা বেল্ট। এদিকে আমি তখন দুটি বন্দুক দেখছি। সামনের দেয়ালে ও দুটো ঝোলানো আছে। দুটোরই বাঁটের উপরে একই তারিখ খোদাই করা। ২১ সেপ্টেম্বর ১৮১৯ সকাল ১১টা।’
‘এ দুটোরও কোনো ঐতিহাসিক মূল্য আছে নাকি?’ বন্দুক দুটো দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম।
‘আছে, অন্তত আমাদের কাছে। একটি ছিল বাবার। সে থামল।’
‘দ্বিতীয়টি।
সে হেসে বলল। অন্যটি মায়ের। কিন্তু খাবার দিয়েছে। চলুন নিচে যাই।’
.
৩.
‘মায়ের বন্দুক।’
নিচে নামার সময় ওই কথাটাই আমার কানে বাজতে লাগল বারবার, মায়ের বন্দুক। খাওয়ার ঘরে ঢুকে, মাদাম ফ্রাঞ্চিকে ভালো ভাবে দেখলাম। প্রথম দেখায় এভাবে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। তার ছেলে ঘরে ঢুকেই মায়ের হাতে চুমু খেল। মাও সে শ্রদ্ধা নিবেদনকে সম্রাজ্ঞীর মর্যাদা দিয়েই গ্রহণ করলেন।
‘বড় দেরি হয়েছে, মা মাফ কর।
আমি সালাম দিয়ে বিনিতভাবে বললাম, ‘দোষটা আমারই। সিয়ে লুসিয়েন এত মূল্যবান ঐতিহাসিক জিনিস আমাকে দেখাচ্ছিলেন–তার ফলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই ওর এত দেরি হয়েছে।’
মা হাসিমুখে বললেন–‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমিও তো এই মাত্র নিচে নেমেছি। তারপর লুসিয়েনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমার কাছে লুইর খবর পাব।
আমি মাদাম ফ্রাঞ্চি না বলে পারলাম না। আপনার ছেলে কি অসুস্থ?’
‘লুসিয়েনের ধারণা তো তাই।’
‘চিঠি এসেছে নাকি?’
‘না, চিঠি পাইনি বলেই তো ভাবছিউত্তর দিল লুসিয়েন।’
‘কিন্তু অসুস্থ হয়েছেন। এমনটা ভাবছেন কেন?’
‘ভাবনা এ কারণে যে, কয়েকদিন ধরে নিজেই ভালো নেই।’
মাফ করবেন, বার বার প্রশ্ন করে বিরক্ত করছি। কিন্তু আপনি ভালো নেই বলে কীভাবে বোঝা গেল আপনার ভাইও অসুস্থ।
‘আপনি তো জানেন, আমরা যমজ ভাই।’
‘হ্যাঁ তা জানি, গাইড আমাকে জানিয়েছিল।
‘কিন্তু এটা শোনেননি জন্ম হবার সময় আমরা জোড়া লাগানো অবস্থায় ছিলাম?
‘না, এটা শুনিনি।’
‘ডাক্তার এসে অপারেশন করে আমাদের দুই ভাইকে আলাদা করে।’ এর ফলে আমরা দুই ভাই যত দূরেই থাকি। একজনের সাথে অন্যজনের একটা মানসিক যোগ রয়েছে। একজন শারীরিক মানসিক যে কোনো ভাবান্তর হলে, অপরজন তা সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করবে। বেশ কয়েকদিন থেকেই আমার মনটা ভালো লাগছে না-তার একটাই মানে হতে পারে যে, ভাই-এর নিশ্চয়ই কোনো অসুখ হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে, লুই কোনো বিপর্যয়ে পড়েছে।
‘এই সুস্থ সবল তরুণের দিকে তাকিয়ে আমি দেখছিলাম। এই সম্পূর্ণ অদ্ভুত ব্যাপারটা তার কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে, তার মাও তার এই বিশ্বাসকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
মাদাম ফ্রাঞ্চিই নীরবতা ভেঙে হালকা হেসে বললেন। সে আমাদের সামনে নাই, সেও সৃষ্টিকর্তার সামনে রয়েছে, এটাই সান্ত্বনা। তোমার কোনো সন্দেহ নেই তো, সে বেঁচে আছে।
লুসিয়েন শান্তভাবে জানাল–‘তার মৃত্যু হলে তাকে আমি দেখতে পেতাম।
‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে জানাতে।’
‘নিশ্চয়ই, সাথে সাথে, আমি শপথ করে বলছি মা।
তারপর তার মনে হয় খেয়াল হলো, আমার পক্ষে এই আলাপে অবাক হওয়ার কথা। তাই আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন–‘মঁসিয়ে, ক্ষমা করবেন। বোঝেনই তো মায়ের মন। দুশ্চিন্তা চেপে রাখতে পারছি না। লুই আর লুসিয়েন আমার দুই সন্তান। এ বংশের শেষ বংশধর। আপনি আমার ডান দিকে বসুন। বাদিকে লুসিয়েনকে বসালেন।
বেশ বড় লম্বা একটা টেবিলের এক পাশে আমরা তিনজন বসেছি। অন্য পাশে ছয়টা প্লেট সাজানো আছে তাদের জন্য–কর্সিকান ভাষায় যাদের সব মিলিয়ে নাম হলো–সংসার। বড় বাড়িতে মালিক এবং চাকরের মাঝামাঝি যে লোক থাকে, সংসার বলতেই তাদের বোঝায়।
টেবিলে প্রচুর আয়োজন–কিন্তু খাবারের দিকে আমার মন নেই। অনেকগুলো অবাস্তব চিন্তা আমার মনে আসা যাওয়া করছে, যার ফলে খাওয়ার দিকে মন দিতে পারছি না। জোরালো ক্ষিদে পেয়েছে, তাই কিছু খেতে হলো ঠিকই, তাতে খাবারের আনন্দ পেলাম না।
আমি এ বাড়িতে আতিথ্য নিয়ে মনে হচ্ছে একটা অন্য পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছি। অন্য জগতে আছি। এ মহিলা–সৈন্যদের মতো বন্দুক ব্যবহার করে। এ ভাই (এক লীগ তিন মাইল) তিনশো লীগ দূরের ভাই ব্যথা-বেদনা টের পায় এখানে বসে। মা শপথ করিয়ে নেয়, মৃত ভাইকে দেখতে পেলে সাথে সাথে তাকে জানাবে।
এই সব মনে করেই অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মনে হলো, এভাবে মাথা নিচু থাকা অসৌজন্যর পরিচয়। শেষ পর্যন্ত মনকে ফিরিয়ে, মাথা তুলে ওঁদের দিকে তাকালাম।
তাকাতেই লুসিয়েন কথা শুরু করল–ঠিক যেন পুরানো কথার রেশ ধরে শুরু করল। তাহলে এ ব্যাপারে কর্সিকায় এলেন।
‘দেখতেই পাচ্ছেন, ভাবনাটা বেশ কিছুদিন থেকেই মাথায় ছিল, তাই বেরিয়ে পড়লাম।
‘আর দেরি না করে ভালোই করেছেন। যেভাবে ফরাসি রুচি ও আচার আচরণ এদেশে এসে পড়েছে তাতে যারা আর কিছুদিন পড়ে এখানে আসবেন। তাঁরা কর্সিকান দেখতে পাবেন না।
‘যদি কোনোদিন সে সময় আসে, ফরাসি সভ্যতার তাড়া খেয়ে প্রাচীন কর্সিকা আসা বৈশিষ্ট্য যদি দেশের দূরে কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তবে যে কোনো কোথায় হবে, তা আমি ভাবিনি। সে হবে ট্যাভরো উপত্যকার সার্টেন প্রদেশে। আমি উত্তর দিলাম।
লুসিয়েন হেসে ফেলল–‘আপনার তাই ধারণা?
‘কেন হবে না সেই ধারণা? আমার সামনেই যে বসে আছে তার উজ্জল নমুনা।
তা, ঠিক, কিন্তু দেখুন, আমার মা আছেন, আমি আছি, চারশো বছরের পুরনো ঐতিহ্য আছে, তবে তার ফাঁক দিয়ে ফরাসি সভ্যতা ঢুকে পড়েছে, কেড়ে নিয়েছে আমার ভাইকে দূর প্যারিসে, যেখান থেকে সে উকিল হয়ে ফিরে আসবে, দেশে ফিরে এসে থাকবে আজাইচোতে, নিজের পিতার বাড়িতে না। সে ওকালতি করবে, হয়তো সরকারি উকিল হবে, মামলা চালাবে সেসব লোকের বিরুদ্ধে যারা বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসার পালা উদ্ধার করতে গিয়ে শত্রুকে নিজ হাতে হত্যা করেছে। অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাপালনকারীকে সে সাধারণ খুনির পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে কাজকে অবশ্য করণীয় বলে প্রচার করে গিয়েছেন, সেই কাজকে সে মহাপার বলে ঘোষণা করবে। শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবে তার আদেশ পালনকারীকে। সৃষ্টিকর্তার বিচার বাদ দিয়ে চালিয়ে দেবে মানুষের বিচার এবং প্রতিজ্ঞাপালনকারী একজনকে যদি সে ফাঁসি দিতে পারে। এই বলে সেদিন তার আত্ম প্রসাদ হবে যে সভ্যতার দেয়ালে একটা ইট সে গেঁথে দিয়েছে। হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর। ভাবাবেগের জন্য লুসিয়েনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা ডাকতে ডাকতে উপর দিকে এমনভাবে চোখ তুলে চাইল মনে হলো এ ঠিক এভাবে পরাজিত অনিবার্য (কার্থেজীয় বীর, রোমের পরম শত্রু) চেয়েছিল জামা যুদ্ধের পর।
আমি তার ব্যথায় সান্ত্বনা দিলাম, ‘সৃষ্টিকর্তা কিন্তু সুন্দর ভাগ করেছেন। আপনার ভাই যেমন নতুনের পক্ষে-তেমনি আপনি হয়েছেন প্রাচীন যুগের ভক্ত।
‘প্রাচীন যুগের অনুসারী? সেটা কোথায়? আমি তো এমন সব কাজ করি যা ফ্রাঞ্চি বংশধরের উপযুক্ত কাজ না।
সবিস্ময়ে বললাম, আপনি বলেন কী?
‘আপনি হাসবেন না, আমি জানি আপনি কেন এসেছেন এদেশে? বলল কি সে উদ্দেশ্য।
‘বলুন।’
আপনি পৃথিবী দেখতে বেরিয়েছেন, আপনার কর্সিকায় আসার প্রধান উদ্দেশ্য ওই প্রাচীন প্রথা ভেলডেটা’ এটাই আপনি দেখতে চান সচক্ষে কর্সিকা বাসীদের মধ্যেই মেরেসি ‘কলবা’ বইয়ে যে ধরনের চরিত্র এঁকেছে।
আমি তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, আমার সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। এ গ্রামে তো দেখেছি আপনাদের বাড়ি ছাড়া অন্য সব বাড়ি দুর্গের মতো সুরক্ষিত।
‘ঠিক, আমার বাড়ি ছাড়া অন্য সব বাড়ি সুরক্ষিত। এতেই কি প্রমাণ হয় না আমি এ বংশের মর্যাদা ধরে রাখতে পারিনি? এই গ্রামে গত দশ বছর ধরে একটা হানাহানি চলছে। গ্রামের সব লোক দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে, একমাত্র আমি কোনো দলে নেই। আমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন, কিংবা পিতামহ–তবে তারা যে কোনো একটা দলে ভিড়ে যেতেন। আর আমি এখন মিমাংসা করছি। একজন ছোরা মারছে, একজন গুলি চালাচ্ছে। আমি মাঝখানে থেকে দুজনকেই বলছি, থামো, থামো।’ আপনি সার্টেন প্রদেশে এসেছেন খুনি দেখতে, চলুন এখন আমার সঙ্গে, দেখাব আপনাকে খুনি?
‘আমাকে সঙ্গে নেবেন?
‘কেন নেব না? আপনার যদি কৌতূহল থাকে। তবে যাবেন কিনা সেটা আপনার উপর নির্ভর করে।
‘আমি তাহলে আনন্দের সঙ্গেই যাব।
মাদাম ফ্রাঞ্চি বললেন–‘উনি কিন্তু খুব ক্লান্ত। তার ইতস্তত ভাব দেখে মনে হয়। কর্সিকার প্রাচীন প্রথা ভেলডেটা বর্তমানে কমে যাওয়াতে ছেলের মতো তিনিও লজ্জিত।
মা তাতে কী হয়েছে? উনি গিয়ে দেখুক। পরে যখন প্যারিসে ফিরে গিয়ে গল্পের আসরে যোগ দিয়ে, কর্সিকার ভেলডেটা আর কর্সিকার এই খুনিদের নিয়ে অবাস্তব গল্প চলবে, তখন উনি সত্য কথা বলে লোকের ভুল ভাঙিয়ে দিতে পারবেন।
এইমাত্র আপনি যে দশ বছর ধরে ঝগড়ার কথা বলেছিলেন, যার। মিমাংসা আপনি করছেন, তার শুরু হয়েছিল কীভাবে?
‘শুরু যেভাবেই হোক, সেটা কোনো বিষয় না, ঝগড়ার পরিণাম কী হলো মানুষ সেটাই দেখে, মনে করুন একটা মাছি কোনো লোকের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। সেই কারণেই মানুষটা মারা গেল। এখানে গুরুত্ব মৃত্যুর মাছির না। সামান্য মাছির কারণে মারা গেলেও মৃত্যুটাই সত্য।
আমি দেখলাম, লুসিয়েন সুল্লাকারোর পুরুষেরা যেটা নিয়ে দশ বছর ধরে একে আরেকজনকে খুন করছে, তার কারণ আমাকে নিজের মুখে জানাতে চাচ্ছে না। কিন্তু তার দ্বিধাই আমার কৌতূহলকে বাড়িয়ে তুলল।
‘কিন্তু ঝগড়াটার একটা কারণ তো ছিল, তবে ব্যাপারটা যদি গোপনীয় কিছু হয়
‘আরে না, গোপন কিছু না, অলাৰ্ত্তি আর কলোনাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়।’
‘কীভাবে?
‘কারণ একটা মুরগি, অলাৰ্ত্তিদের বাড়ি থেকে একটা মুরগি গিয়েছিল কলোনাদের বাড়িতে। অলাৰ্ত্তিরা মুরগি আনতে গেলে, কলোনারা মুরগি। তাদের বলে দাবি করল। তাতে অলাৰ্ত্তিরা বিচারের ভয় দেখাল, তাতে। কলোনাদের এক বুড়ো মহিলা রেগে গিয়ে সবার সামনেই মুরগিটা ধরে। এনে গলাটা মুচড়ে ভেঙে দিয়ে অনাৰ্ত্তিদের এক মহিলার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, নে তোদের মুরগি তোরা খা। তখন ঐ মহিলার ভাই মরা মুরগি। দিয়েই কলোনা বুড়িকে ঘা মারতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাগ্য খারাপ এক কলোনা তার বন্দুক দিয়ে গুলি ছুড়ল, মরা মুরগি হাতে নিয়েই অলাত্তি যুবক মারা গেল।’
‘তাহলে এভাবেই শুরু হলো খুনাখুনি? এ পর্যন্ত কতজন মারা গেছে?’
‘মারা গেছে নয়জন, আহত হয়েছে আরও—’
‘সামান্য একটা মুরগির জন্যে-যার দাম—’
‘সেটাই তো বলেছিলাম–কারণটার কোনো গুরুত্ব নেই, পরিণামই হলো আসল।’
‘নয়জন মারা গেছে বলেই কি দশম জনকে মরতে হবে?’
‘না, তা হবে না, আমি মিমাংসার ভার নিয়েছি বলেই দশম লোকটা বেঁচে যাবে।’
‘কোন দল আপনাকে মিমাংসার জন্য অনুরোধ করেছিল?’
আরে, তাদের কেউ না। আগ্রহটা আমার ভাইয়ের। প্যারিসের বিচারমন্ত্রীর কাছে সে এ ব্যাপারটা জানিয়েছে। কর্সিকার এ গ্রামে কি ঘটেছে
তা নিয়ে প্যারিসের লোকের মাথা ঘামানোর কি দরকার বলুন তো? মূল। কাজই হলো ওই অঞ্চল শাসকটির। সে কিনা প্যারিসে চিঠি লিখে জানাল, একমাত্র আমার পক্ষেই নাকি এর একটা মধুর মিলন করা সম্ভব, আমার একটা কথাতেই–সবার রাগ উড়ে যাবে। শাসকের চিঠি পৌঁছানোর সাথে সাথে আমার ভাই আমাকে চিঠি লিখল, সে বিচার মন্ত্রীকে কথা দিয়েছে, এ ভেলডেটার মীমাংসা আমি করে দেব। এই হলো অবস্থা।
এরপর মাথায় একটা ঝাঁকানি দিয়ে লুসিয়েন বলল, আমার ভাই যখন কথা দিয়ে এসেছে, তখন আমাকে সে কথা রক্ষা করতে হবেই। না করলে সে ফ্রাঞ্চি বংশের যোগ্য হবে না।
হতাশ হয়ে বললাম, তা হলে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, ভেলডেটা দেখার সম্ভাবনা নাই।
বিরক্ত হয়েই জবাব দেয় লুসিয়েন, ‘সেটাই তো মনে হয়।
মনের হতাশ ভাব চেপে, উৎসাহ দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম, এখন তাহলে ওই দু-দলের কারও সাথে আপনার আলাপ করার কথা আছে?
‘হ্যাঁ–এক দলের সাথে কালকে কথা বলা হয়েছে।’
‘আজকে যার সাথে কথা বলবেন, সে কি অলাৰ্ত্তি না কলোনা?’
‘অলার্তি।’
‘কোথায় দেখা হবে? কাছেই?’
‘ইস্ত্রিয়া দুর্গে।’
‘ইস্ত্রিয়া! গাইড জানিয়েছিল কাছেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।’
‘তিন মাইলের মতো।’
‘তাহলে তো তিন কোয়ার্টারের মধ্যে যাওয়া যাবে।’
‘হ্যাঁ, বেশি হলে তিন কোয়ার্টার।
এবার মাদাম ফ্রাঞ্চি বললেন, ‘লুসিয়েন, তোমার নিজের জন্য তিন কোয়ার্টার ঠিক হলেও। এই পাহাড়ি রাস্তায় ইনি কি ঠিক তোমার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবেন?’
লুসিয়েন মাথা নেড়ে বলল, ‘সেটা ঠিক তাহলে অন্তত দেড় ঘণ্টা ধরে রাখতে হয়।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাদাম বললেন, ‘তাহলে এবার রওনা দিতে হয়।’
মাদাম হাত বাড়িয়ে দিলে, লুসিয়েন আগের মতোই সম্মানের সাথে হাতে চুমু খেল, তাহলে আমরা যাই মা?
লুসিয়েন আমার দিকে ফিরে বলল, ‘এখনও ভেবে দেখুন! আমার সঙ্গে পাহাড়ে ঘুড়ে না বেরিয়ে, এখানে বসে আস্তে খাবারটা শেষ করেন। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আগুনে আরামে হাত পা গরম করে—’
আমি এখানেই বাঁধা দিয়ে উঠলাম, ‘আমাকে খুনি দেখাবেন বলেছেন। আমি খুনি দেখবই।’
.
তাড়াতাড়িই রেডি হয়ে গেলাম।
প্যারিস থেকে বের হবার সময় একটা বিশেষ ধরনের বেল্ট আমি বানিয়েছিলাম। সেটাই এবার কোমরে বেঁধে নিলাম। তার এক পাশে ঝোলানো একটা শিকারের ছোরা, আর এক পাশে গুলি। লুসিয়েনের কোমরে বুলেট ভরা ব্যাগ এবং কাঁধে দোলনা ম্যান্টন বন্দুক। তার মাথায় চুড়া জােড়া টুপি, তাতে সুন্দর ফুলের কাজ করা।
গ্রিদো জিজ্ঞাসা করল, ‘মালিক, আমি কি আসব?
না, দরকার নেই-বলল, লুসিয়েন তবে ডায়ামন্টকে ছেড়ে দাও। পাখিটাখি ধরতে পারে, চাঁদের যা আলো, তাতে দিনের মতোই গুলি চালানো যাবে।
এক মিনিট পরেই একটা কুকুর লাফাতে লাফাতে আমাদের কাছে চলে এলো। বাড়ি থেকে কিছুদূর গিয়েই লুসিয়েন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, গ্রামের ভেতর জানিয়ে দাও পাহাড়ের উপর যদি বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায়, বুঝবে আমি গুলি চালিয়েছি। সে অন্য কেউ না।
‘আমি এক্ষুণি যাচ্ছি’ বলল গ্রিদো।
সামনে চলতে চলতে আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল লুসিয়েন, ‘এ কথাটা না বললে সমস্যা ছিল, আমরা পাহাড়ে পাখি মারছি। ওদিকে সুল্লাকারোর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা তার শব্দ শুনে ভাববে আবার কলোনা আর আলৰ্ত্তিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সমস্ত গ্রাম আবার জড়িয়ে পরবে তাতে।’
আমরা একটু সামনে এগিয়ে ডাইনে একটা সরু রাস্তা ধরলাম। সেটাই সোজা পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে।
৪. চাঁদ উঠেছে কাগনা পাহাড়ের পিছনে
৪.
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। মোটেই গরম নেই, ঠাণ্ডা বাতাস সমুদ্রের দিক দিয়ে এসে আবহাওয়াটাকে সুন্দর করে তুলেছে।
নীল আকাশে চাঁদ উঠেছে কাগনা পাহাড়ের পিছনে। এই পাহাড় কর্সিকা দ্বীপকে দুই ভাগ করেছে। একই দ্বীপে তৈরি হয়েছে রাজ্য, তুচ্ছ কারণেও তারা পরস্পরকে আক্রমণ করে বসে। ঘৃণা করে একে অপরকে।
চড়াই উঠতে উঠতে চারদিক চেয়ে দেখছি। টাভরো নদী কোথায় দিয়ে বইছে তা দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়ছে না। যদিও দূরে শান্ত ইস্পাতের আয়নার মতো দেখা যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরের জলরাশিকে।
রাতের নিজস্ব কিছু শব্দ আছে। দিনে হয়তো এগুলো হাজার শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে থাকে, বা শুরুই হয় রাতের সাথে সাথে। লুসিয়েন এতে পুরো অভ্যস্ত। তাই তার উপর এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি। নতুন বলেই সব শব্দকেই অদ্ভুত লাগছে, করে তুলছে আগ্রহী।
একটি তিন রাস্তার মোড়ে এসে লুসিয়েন থামল। একটা রাস্তা পাহাড় ঘুরে এগিয়ে গেছে। অন্যটা সোজা উঠে গিয়েছে উপরে। দ্বিতীয় রাস্তাটির চিহ্ন এত কম যে চোখে না পড়ার মতোই। লুসিয়েন জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিকমতো উঠতে পারবেন তো।’
আমি উত্তর দিলাম, ‘উঠতে ঠিকই পারব। তবে মাথা ঘুরতে পারে।’
‘মাথা ঘুরবে কেন?’
‘গভীর খাদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।’
‘তাহলে এ পথেই যাওয়া যাক, এ পথ দুর্গম হলেও কোনো খাদ নেই। আর এ পথে সময় অন্তত তিন কোয়ার্টার বাঁচবে।’
‘তাহলে এ পথেই চলুন।’
‘হোনি গাছের একটা ঝোলের ভেতর লুসিয়েন ঢুকল, আমিও তার পিছনেই চললাম। ডায়ামান্টি ঝোঁপঝাড় দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ষাট গজ আগে চলছে।’
কিছুক্ষণ পরপর থেমে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
প্যারিসে দেখেছি উঁচু পদের কর্মচারীরা ঘোড়াকে দুই ভাবে ব্যবহার করে। সকালে গাড়িতে লাগিয়ে অফিসে যায়। আবার বিকেলে সেই ঘোড়ার পিঠে চেপে হাওয়া খেতে বের হয়। এই ডায়ামাল্টির কাজও সেই ধরনের। এ দু পা ওলা মানুষ দস্যু এবং চার পা ওলা জন্তু শিকারে সমানভাবেই অভ্যস্ত। এ ব্যাপারে লুসিয়েনকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ধারণা ঠিক কি না?
‘না, আপনার ভুল হয়েছে, ডায়ামাল্টি মানুষ এবং জন্তু দুই-ই শিকারে অভ্যস্ত বটে, তবে যে মানুষের উপর তার আক্রোশ তারা মোটেই দস্যু শ্রেণির না, তারা হলো সৈনিক, ঘোড়সওয়ার পুলিশ আর স্বেচ্ছা সৈনিক, এই তিন সম্প্রদায়ের উপর তার রোখ।
‘তাহলে ডায়ামাল্টি কি ডাকাতের কুকুর?
‘হ্যাঁ, শুরু থেকেই মালিক ছিল এক অলার্তি। বহুদিন সে জঙ্গলে পালিয়েছিল। পালিয়ে থাকার সময় তার প্রয়োজনে আমি তাকে খাবার আর গুলি বারুদ এগুলো মাঝে মাঝে দিতাম। কলোনাদের হাতে লোকটি মারা গেল। ডায়ামাল্টি পরদিন আমার কাছে চলে এলে। আগেও জিনিসপত্র নিতে আমাদের বাড়ি আসত। কাজেই অসুবিধা হয়নি।
আমি জানালাম, কিন্তু আমার ঘর থেকে এ ছাড়াও আর একটা কুকুর চোখে পড়ল।
‘ব্রুক্কো, তার মালিক ছিল আবার বলো না। যে মারা যায় এক অলাৰ্ত্তির হাতে। জানেন এখন আমি কি করি? যখন কোনো কলোনাদের সাথে দেখা করি, সাথে থাকে ব্রুক্কো, আর যখন কোনো অৰ্ত্তির কাছে যাই, তখন সাথে নিই ডায়ামাল্টিক। কেউ যদি কোনোদিন ভুল করে কুকুর দুটো শিকল এক সাথে খুলে দেয়। তাহলে দুটোই নিজেরা মারামারি করে মারা যাবে।
থেমে, একটু দুখের হাসি দিল লুসিয়েন, মানুষ ঝগড়া করে। আবার ঝগড়া মিটেও যায়। ঝগড়া শেষে শান্তিতে থাকে। গির্জায় গিয়ে এক সাথে উপসনাও করে। কিন্তু কুকুররা একবার ঝগড়া করলে কখনও আর একপাত্র থেকে খাবার খাবে না।’
‘সত্যিকার কর্সিকার আবহাওয়ায় মানুষ আপনার কুকুর দুটো। হেসে বললাম আমি। কিন্তু ডায়ামাল্টির কথা বলার পর থেকেই তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথাও গেল ও।
‘ব্যস্ত হবেন না। ও গেছে লী মাচিওতে।
ভাবছি জিজ্ঞেস করব, কোথায় লী মাচিও। তখনই কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। ডাক না বলে কান্না বলাই উচিত। এত করুণ এবং একটানা আমি ক্ষেপে উঠলাম অমঙ্গল আশা করে। লুসিয়েনের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও কী?’
‘ডায়ামাল্টি কাঁদছে।’
‘কাঁদছে, কার জন্য?
‘ওর মালিকের জন্য। ও মানুষ না, যে ওর মালিক মরে গেছে বলেই তাকে ভুলে যাবে।’
‘আর একবার আরও করুণ, একটানা সুরে ডায়ামাল্টি কেঁদে উঠল।’
‘বুঝেছি ওর মালিক এর কাছাকাছিই শত্রুর হাতে মারা গিয়েছিল।
‘হ্যাঁ। তাই আমাদের পিছনে ফেলে ডায়ামাল্টি লী মাচিতে চলে গেছে।’
‘তার কবর কি লী মাচিওতে?’
‘তা, কবর বলুন বা স্মৃতিস্তম্ভ বলুন। আমাদের দেশের নিয়ম হলো যখন কোনো লোক নিহত হবে, তার কবরের পাশ দিয়ে যে কেউ হেঁটে যাবে। সেই কবরের উপর রেখে যাবে একটা গাছের ডাল অথবা এক টুকরো পাথর। তার ফলে সাধারণ লোকের কবর এক সময় ধুলায় মিশে গেলেও যারা এই ভেলডেটায় শহীদ হন তাদের কবর দিনে দিনে বাড়তে থাকে। যেমন বেড়ে চলে তাদের জীবিত আত্মীয়দের প্রতিহিংসা।’
তৃতীয় বার শোনা গেল ডায়ামাল্টির কান্না। এবার এত কাছে যে সব জানার পরও আমি শিউরে উঠলাম। তারপরেই পথের মোড় ঘুরতেই আমাদের বিশ গজ সামনে দেখলাম ৪/৫ ফুট উঁচু সাদা একটা পাথরের ঢিবি। সমাধিস্তম্ভ। এরই নাম লী মাচিও।
এই অদ্ভুত স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ডায়ামাল্টি সে আছে। লুসিয়েন একটা পাথর তুলে নিয়ে মাথার টুপি খুলে লী মাচিওর কাছে গেল।
লুসিয়েনের দেখাদেখি আমিও তার অনুসরণ করলাম।
স্তম্ভের কাছে দাঁড়িয়ে সে একটা ওক গাছের ডাল ভেঙে নিল। তারপর প্রথমে পাথর রাখল তারপর দিল ডাল। তারপর তাড়াতাড়ি বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল। স্বয়ং নেপোলিয়নকেও সংকটের সময় এই রকম চিহ্ন আঁকতে দেখা গিয়েছে।
লুসিয়েন যা করছে। আমিও তাই করছি।
তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম–ডায়ামাল্টি পিছনে বসে রইল। প্রায় দশ মিনিট পরে তার শেষ হাহাকার শুনতে পেলাম আমরা। প্রায় সাথে সাথে সে মাথা এবং নেজ নিচু করে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে এগিয়ে গেল। প্রায় একশো গজ এগিয়ে আবার ঝোঁপের ভেতর শত্রুর খোঁজ করতে লাগল।
.
পথ চলতেই বুঝলাম, লুসিয়েন ঠিকই বলেছিল। পথ বেশ কষ্টের চড়াই। বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। কারণ এবার উপরে উঠতে দুই হাতই দরকার। আমার সামনের লোকের কথা আলাদা। সে এমন ভাবে পথ চলছে যেন সমতল দিয়েই সে হেঁটে যাচ্ছে। পাথর থেকে পাথরে লাফাতে লাফাতে কিছুক্ষণ পরেই আমরা একটা সমান জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। তার মাথার উপর চারিদিকে ভাঙা দেয়াল। এই ইস্ত্রিয়া দুর্গ, আমাদের গন্তব্য স্থান।
আরও পাঁচ মিনিট চড়াই উঠতে হলো, আরও খাড়া আরও দুর্গম। সবচেয়ে উঁচু ধাপে উঠে লুসিয়েন হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে তুলল।
‘প্যারিসে বাড়ি হলে কি হবে? পাহাড়ে উঠতে আপনি আনাড়ি না।’
‘তা নই। এর আগেও আমি পাহাড়ে উঠেছি।’
লুসিয়েন হেসে বলল, ‘প্যারিসের মন্ট মার্টার পাহাড়ে বুঝি।’
‘তা তো ঠিক। কিন্তু মন্ট মার্টার পাহাড় ছাড়াও অনেক পাহাড়ে উঠেছি আমি রিগি, ফ্রাউন হল, জেসি, ভিসুভিয়াস, ঐখনি, এটনা।’
তাহলে এখন আপনার কাছে শিশু হয়ে গেলাম। আমি তো এক মন্ট রোগেন্ডে ছাড়া আর অন্য কোনো পাহাড়েই চড়িনি। যাক, আমরা এসে গেছি, চার শতাব্দী আগে এলে আপনাকে এখন আমার পূর্ব পুরুষেরা সিংহ দরজা খুলে দিয়ে ইস্ত্রিয়া দুর্গে স্বাগত জানাত। আজ তার বংশধর এই ভাঙা দেয়াল দেখিয়ে আপনাকে বলতে পারে। স্বাগত এই ধ্বংস স্তূপে।’
‘তাহলে কি এই দুর্গ ভিসেন্টনো দ্য ইস্ত্রিয়ার মৃত্যুর পর থেকে আপনাদের দখলে আছে।’
‘না, তা নেই লুসিয়েন তাড়াতাড়ি উত্তর দিল–কখনও এ দুর্গ আমাদের অধিকারে আসেনি। কিন্তু এর শেষ মালিক ছিলেন সেই বিখ্যাত স্যাভিলিয়া, লুসিয়েন দি ফ্রাঞ্চির বিধবা স্ত্রী। ওই লুসিয়েন যে আমাদের পূর্ব পুরুষ তা তো আপনাকে আগে জানিয়েছি।
এই মহিলার সম্পর্কে একটা ভয়াবহ গল্প প্রচলিত আছে না? একটু ইতস্তত ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ আছে, দিনে হলে থামলেই আর একটা ধ্বংসস্তূপ দেখতে পেতেন, সেটা ছিল সেনর দ্য গাইদিস এর বাড়ি। স্যাভিলিয়া যেমন ছিল সবার শ্রদ্ধার পাত্রী ওই গাইদিস ছিল সবার ঘৃণার পাত্র, স্যাভিলিয়া ছিলেন সুন্দরী, গাইদিস ছিল কুশ্রী। কিন্তু নিয়তি স্যাভিলিয়া বিধবা হবার পর গাইদিস তাকে বিয়ে করতে চাইল। স্যাভিলিয়া সে প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করার পর, গাইদিস শাসিয়ে খবর পাঠাল স্বেচ্ছায় বিয়ে না করলে, গায়ের জোরে সে স্যাভিলিয়াকে তুলে নিয়ে যাবে, তখন স্যাভিলিয়ার চাইতে গাইদিসের লোকজন ছিল বেশি, যুদ্ধ হলে স্যাভিলিয়ার জয়ের সম্ভবনা ছিল না। তাই তিনি আশ্রয় নিলেন কৌশলের। নিমরাজী ভাব দেখিয়ে তাকে দাওয়াত দিলেন এই দুর্গে খাবারের। ফাঁদে পা দিল মূর্খ গাইদিস। সে যে তাকে আগে ভয় দেখিয়েছিল, এ কথা ভুলে গিয়ে মাত্র একজন সঙ্গী নিয়ে ইস্ত্রিয়া দুর্গে এসে হাজির হলো। আসার সাথে সাথে তাকে বন্দি করলেন স্যাভিলিয়া।
গাইদিসের অনুচরেরা দুর্গ আক্রমণের সাহস পেল না, স্যাভিলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছিল, সেরকম কোনো চেষ্টা হলে সঙ্গে সঙ্গে গাইদিস মারা যাবেন।
অনেক দিন স্যাভিলিয়ার কারাগারে ছিলেন গাইদিস। তাকে না মেরে বাঁচিয়ে রাখাটা যে কত বড় ভুল হয়েছে, তা টের পেলেন অনেক দেরিতে। এক চাকরাণীর সাহায্যে গাইদিস পালিয়ে গেল কারাগার থেকে এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক সৈন্য নিয়ে এসে আক্রমণ করল ইস্ত্রিয়া। যুদ্ধে পরাজিত এবং বন্দি হলো স্যাভিলিয়া। গাইদিস এক লোহার খাঁচায় বন্দি করে তাকে রাস্তার উপর রেখে দিলেন। সেইখানেই কয়েকদিন দুঃখ ভোগের পর মারা গেলেন স্যাভিলিয়ার।’
কথা বলতে বলতে ততক্ষণে আমরা ভাঙা দুর্গের ভেতরে এসে পড়েছি। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে জ্যোা এসে প্লাবিত করে দিয়েছে সম্পূর্ণ দুৰ্গটা। কিন্তু দেয়ালের নিচেই জমাট অন্ধকার। সেদিকে তাকিয়েই লুসিয়েন ইতিহাস বলে চলল সেই দুর্গের।
স্যাভিলিয়ার মৃত্যুতে যে ভেনডেটা শুরু হলো, তা শেষ হলো চারশো বছর পর। আমার বাবার সময়। আমাদের বাড়ি পাশাপাশি দুটো বন্দুক ঝোলান দেখেছেন। তাতে একটাই তারিখ খোদাই কর আছে ১৮১৯ এর ২১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা। ঐ তারিখেই গাইদিস বংশের শেষ দুই বংশধর মারা যায়। একজন আবার বাবার গুলিতে, দ্বিতীয়জন আমার মায়ের গুলিতে।’
ওরা কি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করছিলেন? আমি জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না।
‘মোটেই না। গাইদিস বংশে ১৮১৯ সালে দুই ভাইই বেঁচে ছিল। আমাদের বংশে আমার বাবা। বাবা ২১ সেপ্টেম্বর সার্টেন গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন অনসেভো রোড ধরে। গাইদিসদের একজন সেই জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল, আড়াল থেকে গুলি করার জন্য। অন্য ভাই লোজন নিয়ে এসে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় আক্রমণ করল আমাদের সুল্লাকারোর বাড়ি। বাবা বাড়িতে নেই। অরক্ষিত ঘর দখল করে ধ্বংস করার এই সুযোগ।
সুযোগ কিন্তু দুর্যোগে পরিণত হলো ওদের জন্য। বাবা ছিলেন সর্তক। অলমেডোর রাস্তায় গাইদিস যে কোথায় লুকিয়ে আছে। তা তিনি আগেই জেনে ফেলেছিলেন। ফলে গাইদিস গুলি করার আগেই বাবার গুলিতে গাইদিস ভাই মারা পড়ল জঙ্গলে। বাবা পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখলেন তখন ঠিক বেলা এগারোটা।
ঠিক একই সময় সুল্লাকারোর বাড়িতে দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে মাও বন্দুক ছুড়ছেন। নিচে দ্বিতীয় গাইদিস ভাই দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে তার লোকজন নিয়ে। কিন্তু মায়ের বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলি কয়েক লোকের মধ্যে থেকে ঠিক দ্বিতীয় গাইদিস ভাইয়ের শরীরে ঢুকল। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে মারা গেল সে। মা মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের গায়ে ঘড়ি দেখলেন, দুপুর ঠিক এগারোটা।
চারশো বছর পরে স্যাভিলিয়ার মৃত্যুর প্রতিহিংসা শেষ হলো, এক সাথে গাইদিসের শেষ দুই বংশধর পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যেই বন্দুক দুটিতে সন তারিখ লিখে টানানো। হয়েছে।
ওই তারিখের ঠিক সাত মাস পর আমাদের জন্ম। এমন মা বাবার ছেলে হয়ে কি করে যে লুই দার্শনিক হয়। তা আমার বোঝার বাইরে।
ঠিক এমন সময়।
চাঁদের আবছায়া আলো।
সেই আলো ছায়ায় এসে দাঁড়াল একজন মানুষ সাথে কুকুর। এসেই খুনি বা দস্যু অলাৰ্ত্তি সাথে কুকুর ডায়ামন্টি। সময় রাত নয়টা।
সময়ানুবর্তিতাই রাজাদের সৌজন্য–‘বলতেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই। এই অলাৰ্ত্তি ও তারই অনুসারী।
অলাৰ্ত্তি দেখে আমরা দুইজনেই উঠে দাঁড়ালাম।
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘আপনার সঙ্গে ইনি কে, সেনর লুসিয়েন।
‘ওর জন্য চিন্তার কোনো কারণ নেই অলাৰ্ত্তি। ইনি আমার বন্ধু। আমার মুখ থেকে তোমার কথা শুনেই তোমার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহী হয়েছে। তাই তাকে সাথে নিয়ে এসেছি।
আমাকে সালাম জানিয়ে অলাৰ্ত্তি বলল, এদেশে মঁসিয়ে কে স্বাগত জানাচ্ছি।’
আমিও তাকে ফিরতি সালাম দিলাম।
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘আপনারা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন?’
‘প্রায় বিশ মিনিট হবে।’
‘মাচিওতে ডায়ামাল্টি যখন কাঁদছিল তখন আমি শুনেছি। তারপর পনেরো মিনিট আগে সে আমার কাছে এল। ডায়ামাল্টি সত্যিই খুব বিশ্বস্ত কুকুর। মঁসিয়ে লুসিয়েন।
ডায়ামাল্টিকে আদর করতে করতে বলল, তোমার কথা ঠিক, অলার্তি ডায়ামাল্টি সত্যিই বিশ্বস্ত কুকুর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যদি জানতেন লুসিয়েন এখানে কুড়ি মিনিট আগে এসেছেন, তাহলে এত দেরি করলেন কেন?
‘আসব কেন? অলাৰ্ত্তি বলল, আমাদের দেখা করার সময় ঠিক হয়েছে। রাত নয়টায়। ঠিক সময়ের পরে এলেও যেমন সময়ানুবর্তিতা ঠিক থাকে না তেমনি ঠিক থাকে না আগে এলেও।
‘তুমি কি আমাকে লক্ষ্য করে কথা বলছ?’ লুসিয়েন হেসে জিজ্ঞেস করল।
‘না–আপনার সাথে নতুন একজন বন্ধু রয়েছে, তার জন্যই আপনাকে আগে আসতে হয়েছে। তা আমি জানি। আমার জন্য অনেক কষ্ট আপনি করেছেন।’
তার জন্য আর ধন্যবাদ দিতে হবে না। অলাৰ্ত্তি, সে কষ্ট বোধ হয় শেষ হতে চলল এবার।
‘সে ব্যাপারে তো এখনও আলোচনা করার দরকার আছে, মঁসিয়ে লুসিয়েন।
আমার দিকে ফিরে লুসিয়েন বলল, আমরা যদি একটু আড়ালে যাই তা হলে আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না।
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম।
ভাঙা দেয়ালের যে পথ দিয়ে অলাৰ্ত্তি এসেছিল। সেই ফাঁক দিয়েই দুজনে বেরিয়ে গেল। জ্যোত্নার আলোয় এবার অলার্তিকে ভালোভাবে দেখতে পেলাম।
লোকটি বেশ লম্বা, মুখে দাড়ি, কাপড় ফ্রাঞ্চির মতোই। শুধু এটাই তফাৎ অলাৰ্ত্তির পোশাক ছেঁড়া এবং পুরানো। বিভিন্ন জায়গায় মাটি লেগে নোঙরা।
আমার থেকে তারা প্রায় বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে কর্সিকার এক গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছে, কাজেই তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব না, কিন্তু কথা না বুঝলেও ভাবভঙ্গি বোঝা যায়।
অলাৰ্ত্তি উত্তেজিত। একটু পরপরই জোরে হাত পা নাড়ছে। লুসিয়েনের যুক্তি সে যেন ফেরাতে চাইছে। কিন্তু লুসিয়েন ঠাণ্ডা। তার কথায়ও উত্তেজনা নেই। সে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে একটা মীমাংসার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
শেষে অলাৰ্ত্তির হাত পা নাড়া বন্ধ হলো, গলার স্বর ছোট হয়ে এলো।
তারপর সে একসময় হাত বাড়িয়ে দিলো লুসিয়েনের হাতের দিকে। আলোচনা শেষ করে তারা আমার দিকে এগিয়ে এল।
লুসিয়েন বলল, ‘প্রিয় সিয়ে, অলাৰ্ত্তি আপনার সাথে হাত মিলিয়ে ধন্যবাদ দিতে এসেছেন।
হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘কিন্তু ধন্যবাদটা কিসের জন্য?
‘আপনি ওর পক্ষে জামিন হতে রাজি হয়েছেন বলে। আমি কথা দিয়েছি যে আপনি জামিন হবেন।
‘আপনি যখন কথা দিয়েছেন, তখন আমারই কথা দেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাপারটা আমি কিছুই জানি না।’
আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতে, অলাৰ্ত্তি আঙুল দিয়ে তা ছুঁয়ে দিল মাত্র।
লুসিয়েন বলল, এবার প্যারিসে ফিরে গিয়ে আপনি লুইকে বলতে পারবেন, সমস্ত গোলমাল তার ইচ্ছায় মীমাংসা হয়ে গিয়েছে এবং চুক্তি নামায় আপনি নিজে সই করেছেন।
‘চুক্তি? কিসের চুক্তি? বিয়ের?’
‘না এখনই না, তবে হতে কতক্ষণ।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অলাৰ্ত্তি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আপনি শান্তির জন্য আগ্রহী। শান্তি স্থাপিত হোক, কিন্তু সম্পর্ক স্থাপনের কোনো কথা ওঠেনি। দলিলে ও ব্যাপারে কোনো লেখা হবে না।’
‘না, দলিলে ওসব লেখা হবে কেন? এটা হবে ভবিষ্যতের ব্যাপার। এখন অন্য কথা বল, আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, আমরা যখন ওদিকে কথা বলছিলাম, তখন একটা তিতির পাখির ডাক শুনেছিলেন?’
একবার যেন মনে হয়েছিল–একটা করর করর শব্দ শুনেছি, তারপরই ডাকটা থেমে গেল। মনে করেছিলাম ভুল শুনেছি।
‘না, ভুল আপনার হয়নি। পিছনের ওই বড় গাছটাতে একটা তিতির লুকিয়ে আছে। ওটাই কালকে আমাদের খাবার হবে।’
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘অনেক আগেই ওটাকে গুলি করে নামাতাম। শুধুমাত্র গ্রামের লোকেরা কি মনে করে এটা ভেবে, সেটা করা হয়নি।
‘আমরা সে কাজ সম্পূর্ণ করে এসেছি,’ বলল লুসিয়েন। তার বন্দুকে গুলি ভরা শেষ হলে সেটা কাঁধে নিয়ে আমাকে প্রথম গুলি করতে বলল।
আমি বাধা দিয়ে জানালাম, আমি আপনার মতো বন্দুক বা পিস্তলে ওস্তাদ না, আমরা যাওয়ার সময় আমার সহযোগিতা পাবেন।
এরপর একটা দারুণ ব্যাপার হলো। অলাৰ্ত্তি করর, করর করে তিতিরের ডাক ডাকতে লাগল, গাছের তিতিরটা ভাবল সত্যি বুঝি তার কোনো সঙ্গী ডাকছে, সঙ্গীর জন্য সে বেচারী যেই গাছ থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাওয়া শুরু করেছে, গুড়ম তিতিরটা ঝোঁপের মধ্যে পড়ে গেল, ডায়ামালি তাকে মুখে করে নিয়ে এলো, লুসিয়েনের গুলি পাখিটার ঠিক বুকেই লেগেছে।
‘তাহলে অলাৰ্ত্তি। কাল।’
‘হ্যাঁ মঁসিয়ে লুসিয়েন কাল।’
তোমার দেরি হবে না জানি। ঠিক সকাল দশটায়, তুমি, তোমার বন্ধুরা, আত্মীয়রা সবাই গ্রামের রাস্তার শেষ দিক দিয়ে ঢুকে গির্জায় আসবে। আমরা গির্জায় থাকব।
.
৫.
আবার জঙ্গলে ঢুকল অলাৰ্ত্তি, আমরা গ্রামের পথ ধরলাম। ডায়ামাল্টি প্রথমে ঠিক করতে পারছিল না কার সঙ্গে যাবে। তা শুধু এক মুহূর্তের জন্য তারপর আমাদের দিকেই ছুটে এল।
মনে পড়ল এবার, আসবার সময় কি কঠিন চড়াই না উঠতে হয়েছে। এখন আবার সে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামতে হবে। এ ভেবে অনেকটা দমে গেলাম। কারণ পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামা অনেক কঠিন।
কিন্তু লুসিয়েন মনে হয় মনের কথাটা বুঝতে পারেন, সে এবার অন্য পথ ধরল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ঢালু রাস্তা, কাজেই নামতে নামতে কথা বলার অসুবিধা নেই। পঞ্চাশ গজের মতো এগিয়েই আমি আবার প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।
‘তাহলে সত্যি সত্যি শান্তি স্থাপিত হলো।’
‘অনেক ঝামেলার পর, শেষ পর্যন্ত ওকে বোঝাতে পেরেছি যে যতটুকু ক্ষতি স্বীকার করবার, তা করেছে কলোনারা। দেখুন কলোনাদের মারা পড়েছে পাঁচজন, অলাৰ্ত্তিদের চার। কলোনারা শান্তি আনতে রাজি হয়েছে। গতকাল। অলাৰ্ত্তিরা রাজি হলো আজ। এ ছাড়াও কলোনারা সবার সামনে একটা জ্যান্ত মুরগি দেবে অলাৰ্ত্তিদের দশ বছর আগের সেই মুরগির জন্য। এতেই তো তারা স্বীকার করে নিল দোষটা তাদের। শুধু এই শর্তটার জন্যই। অলাৰ্ত্তিরা নরম হয়েছে।
‘তাহলে কালকে একটা মর্মস্পর্শি পূণর্মিলন হচ্ছে।’
‘সকাল দশটার সময়। আপনি ভেনডেটা দেখতে চেয়েছিলেন, একটা ভেনডেটার শেষ দেখতে পাচ্ছেন। আপনার ভাগ্য একবারে খারাপ বলতে পারি না। হ্যাঁ, চারশো বছর ধরে কর্সিকার লোকের মুখে ভেনডেটা ছাড়া অন্য কোনো কথা ছিল না। কিন্তু ভেনডেটার শুরু চাইতে দুর্লভ হলো এর অবসান দেখা, আমাদের দেশে।
আমি হেসে ফেললাম।
লুসিয়েন বলল, আপনার হাসি পাচ্ছে। তা আমাদের চরিত্র এবং রীতি হাসি পাবার মতোই।
না, সে কারণে হাসিনি আমি। হেসেছি এটা লক্ষ্য করে যে, আপনার এই মীমাংসার সাফল্যে আপনি খুশি না হয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন।
‘তাই? তাহলে শুনুন, এ মীমাংসার ব্যাপারে আমার যে কি আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, তা আপনি ভাষা না বোঝার কারণে বুঝতে পারবেন না। তবে ভাষার ব্যাপারে কোনো চিন্তা নাই। আপনি দশ বছর পরে এলে দেখবেন, সবাই ফরাসি ভাষায় কথা বলছে।
‘আপনি চমৎকার উকিল হতে পারতেন।
‘মোটেই না। মীমাংসার ব্যাপারটা হয়তো কিছুটা পারি। সেটা হলো ঝগড়া মেটানোর কাজ, সবাই মিলে আমাকে ঈশ্বর আর শয়তানের মধ্যে সালিশ করে দিতে বলে তবে আমি নিশ্চয়ই সফল হব। আবার এটাও মানতে হবে আমার যুক্তি তর্ক মেনে নেয়া ঈশ্বরের পক্ষে চরম বোকামি হবে।
আর আলোচনা চালিয়ে গেলে লুসিয়েনের পক্ষে ধৈৰ্য্যচুত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমি কথা বলা বন্ধ করলাম। লুসিয়েন ও চুপ রইল। ফলে বাকিটা পথ নীরবে চলতে চলতে এক সময় বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
.
আমাদের জন্য গ্রিদো অপেক্ষায় ছিল।
লুসিয়েন কিছু বলার আগেই গ্রিদো তার জামার লম্বা পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিতির পাখিটা বের করল। বন্দুকের আওয়াজেই সে পরিস্থিতি বুঝেছিল।
মাদাম ফ্রাঞ্চি তখন ঘুমাননি। তবে ঘরে চলে গিয়েছেন, গ্রিদোকে বলে গিয়েছেন, লুসিয়েন ফিরলে তার খবর পাঠিয়ে দিতে।
লুসিয়েন আমাকে জিজ্ঞেস করল, বিছানায় যাবার আগে কোনো কিছু আমার দরকার আছে কিনা। উত্তরে আমি জানালাম আর কিছু দরকার নেই।
সে তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইল, আমি তাকে যেতে বলে নিজের ঘরে ঢুকলাম।
ঘরটাকে আবার ভালো করে দেখলাম, এই ঘরটাই লুইর চরিত্র সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিয়েছিল। আমার সে অনুমান সত্য। লুই কেন লুসিয়েন। সম্পর্কেও আমার ধারণা সত্য। কিন্তু লুসিয়েনকে সামনে দেখেছি–লুইকে দেখিনি।
জামা কাপড় ছেড়ে বসলাম। এদের কাছে এসে কর্সিকার জনগণের হাবভাব সম্বন্ধে জানতে পেরে, সনাতা বেশ খুশি। ঘুম এলো না, লুই ওর আনসিরা থেকে ভিক্টর হুগো, ওরিয়েন্টালস’ বইটা বের করলাম। আগেও অনেকবার পড়েছি, তবু পড়তে ভালো লাগে। প্রথম পৃষ্ঠা পড়া শেষ হয়েছে, সেই সময় বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেলাম। দরজার কাছেই থেমে গেল সে শব্দ। বুঝলাম লুসিয়েন আমাকে শুভ রাত্রি জানাতে এসেছেন। কিন্তু আমি ঘুমিয়েছি ভেবে ডাকতে সাহস করছেন না।
বই টেবিলে রেখে ডাকলাম, ভেতরে আসুন।
সাথে সাথে দরজা খুলে লুসিয়েন ভেতরে এল।
এসেই বলল, ‘ফেরার পথে তেমন একটা কথা বলিনি বলে হয়তো আমাকে আপনি অভদ্র ভাবছেন, তাই আপনার কাছে ক্ষমা না চেয়ে শুতে যেতে পারছি না। ক্ষমা করুণ এবং আমার কাছে আরও যদি কিছু জানার থাকে, প্রশ্ন করুন।
আমি বললাম, ধন্যবাদ, আমার যা জানার ছিল তা জেনে গিয়েছি। তবে একটা ব্যাপারে আমি প্রশ্ন করব না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘কেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
‘ও নিয়ে আর কথার দরকার নেই। যদি জেদ ধরে বসেন, তবে প্রশ্নটা করলে আপনাকে বিব্রত হতে হবে।’
‘জেদ ধরলেই বলবেন, এ যদি হয় তাহলে আমি জেদই ধরলাম। বলে ফেলুন, কৌতূহলই সন্দেহের সৃষ্টি করে। সন্দেহই হয় অপ্রীতিকর। অপ্রিয় সন্দেহের চেয়ে অপ্রিয় সত্য ভালো।’
‘ও ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনার ব্যাপারে একটা মাত্র ধারণা আমার, সেটা হলো আপনি যাদুকর।
লুসিয়েন হেসে ফেলল, ‘বেশ ভেবেছেন, এখন আপনার চেয়ে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। তা আমাকে আপনি যাদুকর ভাবলেন কি ভাবে?
দেখুন, আগে যা অস্পষ্ট ছিল আমার কাছে তা আপনি সবই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর দেখিয়েছেন ঐতিহ্যপূর্ণ অস্ত্রগুলি, যা আর একবার দেখার ইচ্ছা আমার আছে, একই নেয়ার দুই বন্দুকের ইতিহাসও আপনি জানিয়েছেন।
‘কিন্তু এগুলোতেই কেউ যাদুকর হয়ে যায় না।’
‘হ্যাঁ, আসল বিষয় হলো জন্মের সময় একটা দেহের বৈশিষ্ট্যের জন্য আপনি নয়শো মাইল দূরের আপনার ভাইয়ের সমস্ত অনুভূতি আপনি এখানে বসেই সমান ভাবে অনুভব করতে পারেন। আপনার ভাইও নিশ্চয়ই এই ভাবে আপনার সুখ-দুঃখের অনুভব করছে। তারপর মাদাম ফ্রাঞ্চি আপনার বিষণ্ণতার ব্যাপারে প্রশ্ন করায় আপনি জানালেন। আপনার ভাই নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছেন, কিন্তু আপনার ভাই মারা গিয়েছেন কিনা এর উত্তরে–আপনি জানালেন–না, মরে গেলে আপনি তাকে দেখতে পেতেন।
লুসিয়েন এবার গম্ভীর হয়ে গেল, ‘হ্যাঁ সেটা ঠিকই বলেছিলাম।
‘যদি অপরাধ না হয়, তাহলে ওই কথাগুলোর অর্থ আমাকে খুলে বলুন। এটাই আমার শেষ কৌতূহল।
লুসিয়েনের মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হতে দেখে আমি বেশ দ্বিধার সাথেই শেষ কথাগুলো বললাম।
কথা শেষ হওয়ার পরে আমি চুপ করে যাওয়ার পরেও লুসিয়েন নীরব রইল।
কাজেই আমি আবার বললাম। সত্যিই আমার প্রশ্নটা যে বিব্রতকর তাতে এখন আমার সন্দেহ নাই। ও কথা আপনি ভুলে যান। মনে করুন ও প্রশ্ন আমি করিনি।
না ও ব্যাপারে শুধু এই বলতে পারি। আপনি একজন সাধারণ লোকের মতোই সন্দেহ পিপাসু। চার শতাব্দী থেকে আমাদের বংশে একটা প্রবাদ একটা অন্ধ বিশ্বাস চলে আসছে। সেটার সত্যতা সম্পর্কে আপনি সন্দেহ করলে আমাদের পক্ষে খুবই দুঃখের কারণ হবে।
আমি জানালাম–‘একটা কথা জেনে রাখুন। প্রবাদ বা উপকথা যাই বলুন না কেন–এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বড় বিশ্বাসী আপনি আর কাউকে পাবেন না। এমন অনেক জিনিস আছে, যা অন্য কেউ অসম্ভব বললেও আমি সেটা সম্পূর্ণ সম্ভব বলে মনে করি।
‘তাহলে নিশ্চয়ই ধরে নিতে পারি, আপনি প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী?’
‘এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতাটি আপনাকে বলব?’
‘বললে আমার পক্ষে সুবিধা হয় আমার ব্যাপার বলতে।’
‘আমার বাবা মারা যায় ১৮০৭ সালে, তখন আমার বয়স সাড়ে তিন বছর মাত্র। আমাকে এক বৃদ্ধা আত্মীয়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো, যখন। ডাক্তার বাবার সম্পর্কে শেষ উত্তর দিয়ে গেলেন। আত্মীয়ার কাছেই একটা ছোট বাড়িতে আলাদা বাস করতেন।
তিনি তার বিছানার সামনে আমার জন্য আলাদা বিছানা করে দিলেন। আমাকে ওখানে শুইয়ে দেয়ার পর এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। বাড়িতে তখন কি বিপদ চলছে তা জানতাম না, জানলেও বুঝতাম না।
ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ শুনলাম দরজায় পরপর তিনবার শব্দ। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে ছুটলাম।
আত্মীয়া বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
দরজায় নক করার শব্দ তিনিও শুনেছেন। তা শুনেই ঘুম ভেঙেছে তাঁরও। তিনি ভয়ে কাঁপছেন। কারণ তিনি তো জানেন যে সদর দরজায় তালা বন্ধ করা আছে। কোনো দেহধারীর পক্ষেই উপরে উঠে এসে শোবার ঘরের দরজায় শব্দ করা সম্ভব না।
আত্মীয়ার প্রশ্নে আমি উত্তর দিলাম–‘শুনছ না, বাবা এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন? তিনি বিদায় নিতে এসেছেন আমার কাছে, আমি তাকে দরজা খুলে দিতে যাচ্ছি।’
কথা শুনেই তিনি বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। আর আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ধরে রাখলেন। আমি কেঁদে বার বার চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম।
‘বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছেন। আমি তাঁকে শেষ বারের মতো দেখব না?’
ছোটবেলার সেই দুঃখের অভিজ্ঞতার কথা স্বল্প পরিচিত এক যুবকের কাছে বলার সময় এতদিন পরেও কান্নায় আমার গলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি চুপ করে রইলাম।
লুসিয়েন জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাবার আত্মা পরে কখনো এসেছিল?’
‘না। যদিও আমি অনেক সময় ব্যাকুল হয়ে তাকে স্মরণ করেছি। অবশ্য এর কারণ হিসেবে আমি ধরে নিয়েছি, নিষ্পাপ শিশুর সাথে আত্মা সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু বয়স্ক পাপীর ভাগ্যে সে রকম হয় না।’
লুসিয়েন মৃদু হেসে জানাল। আমাদের পরিবারের লোকেরা কিন্তু ওদিক থেকে ভাগ্যবান।
‘আপনারা তাহলে মৃত আত্মার দেখা পান?’
‘পাই যখনই কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটবে বা ঘটেছে।
‘আপনাদের এই সৌভাগ্য কিভাবে ঘটল সে ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?
আমার কোনো ধারণা নেই, এটা আগে থেকে ঘটে আসছে, আপনাকে যে স্যাভেলিয়ার কথা বলেছিলাম তার দুই ছেলে ছিল, মায়ের মারা যাবার সময়, আজাইচোতে এক চাচার কাছে থেকে লেখাপড়া করছিল। বড় হবার পরে তারা পরস্পর ভাইকে এমন ভালোবাসায় জড়িয়ে গেল, একদিন প্রতিজ্ঞা করল, মৃত্যুও দুজনে আলাদা করতে পারবে না। মুখে প্রতিজ্ঞা করেও তারা তৃপ্ত হতে পারল না। পাঁচমেন্টের উপরে রক্ত দিয়ে লিখে তাতে পরস্পর সই দিল। তাতে লিখল, দুজনের ভেতর একজন যদি আগে মারা যায়, তবে অন্য জনকে যে মারা যাওয়ার সাথে সাথে দেখা দেবে। আরও তার জীবনে প্রত্যেক সংকটময় সময় একবার করে দেখা দেবে।
এরপর মাত্র তিন মাস গিয়েছে।
এই ভাই দেশের বাইরে, অন্যজন বাড়িতে। প্রবাসী ভাই গুপ্তশত্রু দ্বারা। নিহত হন। ঠিক সেই সময় অন্য ভাই দেশের বাড়িতে বসে তাকে একটা চিঠি লিখছিল। চিঠি শেষ করে মোম দিয়ে মুখ আটকাতে যাবে, এমন সময় কে যেন ঠিক তার পিছনে নিঃশ্বাস ফেলল। চমকে গিয়ে সে পিছনে ফিরে দেখে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। যার কাছে সে এতক্ষণ চিঠি লিখছিল।
তার কাঁধে হাত রেখে ভাই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু হাতের স্পর্শ তার কাঁধে অনুভব করতে পারছে না, কিন্তু ভাই তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সে তখন বুঝতে পারছিল কিনা জানি না। এ ভাই এইমাত্র লেখা চিঠিটা ও ভায়ের হাতে দেয়া মাত্র, চিঠিটা নিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওই ভাইকে সে পরেও একবার দেখতে পেয়েছিল নিজের মৃত্যুর আগে। তাদের যে শপথ এবং চুক্তি শুধু তাদের দুজনকেই বাঁধেনি। তাদের ভাবী বংশধরদেরও যুগ যুগ ধরে বেঁধে রেখেছে। প্রতি পুরুষে এ বংশের লোক মারা যাওয়ার আগে আপনজনের আত্মাকে দেখতে পায়। তারা দেখা দেয় গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার আগে।
‘আপনি নিজে কোনো আত্মার দেখা পেয়েছেন?
‘না তবে নিশ্চয়ই পাব। আমার বাবা তার মারা যাওয়ার আগে তার বাবাকে দেখেছিলেন। সেভাবে আমিও আমার বাবার আত্মার দেখা পাব। বলে আশা করি। এতদিন যে অনুগ্রহ আমাদের বংশে পেয়ে আসছে, তা আমাদের বেলায় বাতিল হয়ে যাবে। এমন কোনো অপরাধ আমরা করিনি।’
‘কিন্তু এই অনুগ্রহ কি শুধু মাত্র পুরুষদের বেলায়?’ প্রশ্ন করলাম আমি।’
‘হ্যাঁ।’
‘আশ্চর্য।’
‘আশ্চর্য হতে পারেন কিন্তু সত্য।
আমি তার দিকে ভালো করে দেখলাম। অন্য যে কোনো লোক এসব কথা বললে পাগল বলেই তাকে মনে হবে। কিন্তু লুসিয়েন শান্ত অবিচলিতভাবে এই অবাস্তব ব্যাপারকে সত্য বলে বলছে। ওর মনে হ্যামনেটের সেই মনোভাব রয়েছে–‘বন্ধু হোরেশিও। দর্শন বিজ্ঞান যা স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেনি কোনোদিন, স্বর্গে এমন পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে।’
এই যুবকের সাথে যদি প্যারিসে বসে আমার সাথে দেখা হত, তবে তাকে আমি ধাপ্পাবাজ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এই কর্সিকার অজ গ্রামে বসে কি ভাবা যায়। নির্বোধ বলে, না বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী অপদেবতা বা অতিথি মানুষ বলে। অতি মানুষ যদি হয় তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে যে অনেক বেশি সুখি।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে জিজ্ঞেস করল। ‘আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন তো।’
‘নিশ্চয়ই। আপনাকে ধন্যবাদ। বিশ্বাস করে আমাকে সব কথা বলার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি আপনার এ গোপন কথা কখনও ফাঁস করব না।’
আশ্চর্য হয়ে সে বলল, কিন্তু কোনোটাকে গোপন কথা বলছেন? এর মধ্যে তো কোনো কিছুই গোপনের নেই। এ গ্রামের যে কোনো লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি আমাদের সম্বন্ধে এসব কথা জানতে পারতেন। কর্সিকাতে এ কথা গোপন করার কোনো কারণও নেই। তবে আমার ভাই যদি প্যারিসে বসে সব কথা বলতে থাকে, তাহলে সমস্যা হবে–পুরুষেরা মুখ ঘুরিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসবে আর মেয়েরা ভয়ে। চিৎকার করবে।
এরপর সে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
খুব বেশি ক্লান্ত থাকলেও ঘুম আসছিল না। শেষে ঘুম এলেও তা ছিল আজকে দেখা হওয়া সব লোককে নিয়ে আজগুবি স্বপ্নে বোঝাই, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। শেষ রাত্রে একটু গভীর ঘুম আসার ফলে, সকালে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেল।
লুই ফ্রাঞ্চির আরামের প্রমাণ পেলাম হাতের কাছেই ঘরে ঘণ্টা রয়েছে চাকরদের ডাকার জন্য। মনে হয় এই গ্রামে এটাই একমাত্র ঘণ্টা।
ঘণ্টা বাজাতেই গরম জল নিয়ে এলো গ্রিফো, লুই ফ্রাঞ্চি তার চাকরকে ভালো শিক্ষাই দিয়েছে।
লুসিয়েন এর মধ্যে দুবার আমার খোঁজ নিয়েছেন এবং সাড়ে নয়টার সময় আমার ঘরে আসার জন্য অনুমতি চেয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি নটা পঁচিশ বাজে। লুসিয়েন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘরে এসে হাজির হলেন।
ফরাসি স্টাইলের পোশাক পরে একজন সৌখিন ফরাসি রূপে সে আমার ঘরে এসে ঢুকল। সাদা প্যান্টের উপর চটকদার জামা, তার উপরে কালো কোট। মার্চ শুরু হয়েছে কাজেই সাদা প্যান্টই তখন রেওয়াজ।
আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে, লুসিয়েন বলল, আমার পোশাক দেখে আপনি অবাক হয়েছেন? আমি যে সভ্য মানুষ তার প্রমাণ পেলেন?
‘পেলাম, আজাইচোতে এত ভালো দরজি আছে তা আমি ভাবতে পারিনি। এই ভেনভেটের কোট পরে আপনার পাশে দাঁড়ালে আমাকে প্যারিসের রাজপথের মজুরের মতো লাগবে।’
আজাইচোর কথা কি বলছেন, আমার এ পোশাক বানিয়ে আনা হয়েছে, প্যারিসের হুমালের ওখান থেকে। অর্থাৎ পোশাকটা প্রথমে আমারই জন্য বানানো হয়নি, হয়েছিল লুই এর জন্য। আমরা দুজনে লম্বায়-চওড়ায় একই মানের হওয়ায়–লুই নিজের গায়ের পোশাক আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে একটু আনন্দ করতে চেয়েছে। এই একটাই নয়, অনেকগুলো পাঠিয়েছে। বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকলে আমি সেগুলো পড়ি। যখন জেলা শাসক আসেন। আঞ্চলিক সৈন্যের সেনাপতি পরিদর্শনে বের হন। কিংবা আপনার মতো মাননীয় অতিথি যখন পায়ের ধুলো দেন, বিশেষ করে তার সাথে জড়িত থাকে আজকের এই অনুষ্ঠানের মতো মর্মস্পর্শী ব্যাপার। তখন সাদাসিধে পোশাক পরলে কি ফ্রাঞ্চি বংশের মর্যাদা বজায় থাকে।
লুসিয়েন ভদ্র ভাষায় তিক্ত ব্যঙ্গ করার ব্যাপারে সুদক্ষ। কিন্তু সে ব্যঙ্গ রুচিকে অতিক্রম করে না। আর অন্যকে আঘাত করার চাইতে নিজেকেই চাবুক মারার দিকে তার ঝোঁক বেশি। কাজেই কথার উত্তর না দিয়ে ঘাড় নেড়ে তাতে সায় দিলাম। সে তখন হাতে দস্তানা পরছে। বয়সিন বা রুসোর বাড়ির হলুদ দস্তানা–যা ঠিক মতো পরতে হলে এক কৌশল জানা প্রয়োজন।
এদিকে আমিও পোশাক পরে নিয়েছি। পৌনে দশটা বাজল।
লুসিয়েন বলল, এবার যাওয়া উচিত, অনুষ্ঠানটা দেখতে হলে নাশতার টেবিলে বসা চলে না। আপনি কি করবেন? না খেয়ে ওখানে যাওয়া নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
‘কেন হবে না? ফিরে এসে তো খেতে পারব। এগারটার আগে আমি সকালের নাস্তা করি না।’ এই বলে টুপিটা হাতে নিয়ে আমি ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম।
.
৬.
ফ্রাঞ্চিদের সদর দরজার আট ধাপ সিঁড়ির উপর দাঁড়ালেই গ্রামের গির্জাটার সামনের চত্বর চোখে পড়ে।
কালকেও চত্বরের পাশ দিয়েই এসেছি। কিন্তু তখন ছিল পুরো নির্জন। এখন ওখানে লোকের ভিড়, শুধুমাত্র নারী এবং শিশু। কোনো পুরুষ চোখে পড়ল না।
তিন রঙের চাদর বুকে আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়র ভদ্রলোক।
সামনে টেবিল চেয়ার নিয়ে উকিল ভদ্রলোক বসে আছেন। হাতে মীমাংসার দলিল লেখা কাগজ।
টেবিলের পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম–ওখানে অর্লাত্তি অন্য জামিনদার দাঁড়িয়ে আছে। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে–কলোনার জামিনদারেরা লুসিয়েন দাঁড়িয়েছে উকিলের পিছনে, উনি তো উভয় পক্ষের লোক।
ঘড়িতে দশটা বাজল।
জনতার মধ্যে সাথে সাথে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল। গ্রামের পথের দিকে সবাই একসাথে তাকাল। অবশ্য একে পথ বলা যায় কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। পঞ্চাশটা বাড়ি ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে একেবেকে চলে গেছে লম্বাটে একটা জমি, ওখান দিয়ে তোক চলাচল করে, কাজেই ওটাকেই পথ বলতে হবে।
আমাদের উৎসুক চোখের সামনে দুই পাশ দিয়ে দুটো মিছিল দেখা দিল। পাহাড়ের দিক থেকে অলাৰ্ত্তি, নদীর দিক থেকে কলোনাদের মিছিল। প্রত্যেকের হাতে জলপাইর ডাল (জলপাইর ডাল চিরদিনই ইউরোপের শান্তির প্রতীক) সাথে আত্মীয় বন্ধু। শুধু মুখগুলোর ভাবভঙ্গি যদি সহজ হত তাহলে একটা ধর্মীয় মিছিল বলে চালিয়ে দেয়া যেত।
দুই দলের দুই নেতা, চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত। অলাৰ্ত্তি হলো লম্বা ছিপছিপে, কালো চুল ভাবভঙ্গি চটপটে। কলোনা ঠিক এর উল্টো, বেঁটে, মোটা, শক্তিশালী। ওর চুল দাড়ি লালচে ছোট করে কাটা এবং কোকড়ানো।
মেয়রের নির্দেশেই দুজনের হাতে দুটো জলপাইর ডাল, মেয়রের ভেতর বিত্ব আছে।
কলোনার হাতে জলপাইর ডাল ছাড়া আর একটি জিনিস আছে। তার হাতে ঝুলছে একটা সাদা মুরগি। এটা দশ বছর আগের মুরগিটার
ক্ষতিপূরণ, যেটা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছিল।
অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছিল এই ক্ষতিপূরণ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মীমাংসাই নষ্ট হতে গিয়েছিল এই সমস্যা নিয়ে। কলোনা ভেবেছিল মরা মুরগির ক্ষতিপূরণ বাবদ জ্যান্ত মুরগি দিলে তার অপমান হবে, অনেক কষ্টে অনেক বুঝানোর ফলে তাকে জীবিত মুরগি দিতে রাজী করিয়ে ছিল লুসিয়েন।
যেই সময় দুই দল দেখা গেল গির্জার দুই পাশে। সজোরে গির্জার ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করল আনন্দের ধ্বনি তুলে।
কিন্তু অলাৰ্ত্তি আর কলোনা? তাদের মুখে আনন্দের চিহ্ন নেই। তারা পরস্পরের দিকে চোখ পড়লেই হিংসায় রাগে ফেটে পড়ছে। যা হোক তারা কোনো ঝগড়া না করে চুপচাপ এগিয়ে এল।
গির্জার গেটের সামনে এসে তারা চার গজ ফাঁক রেখে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়াল। মাত্র তিন দিন আগেও যদি কেউ কারো ১০০ গজের ভেতরেও চোখে পড়ত, তবে যে কোনো একজন মারা যেত।
পুরো মিনিট পাঁচেক চুপ। শুধু মিছিলে লোকই না, উপস্থিত সমস্ত জনতা। অনুষ্ঠানটি যদিও শান্তির জন্যই। তবুও নীরবতাকে শান্তির সপক্ষে ভাবার কোনো কারণ নেই।
অবশেষে মেয়র নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। কলোনা প্রথমে তুমি বলবে, সেটা ভুলে গেছ?
কলোনা অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল, তারপর নিচু স্বরে গ্রাম্য ভাষায় বিড়বিড় করে কিছু বলল।
আমি অতিকষ্টে তার বক্তৃতা থেকে এটুকুই শুধু বুঝলাম যে গত বছর ধরে তার মহৎ প্রতিবেশী অলাৰ্ত্তির সঙ্গে তার যে শোচনীয় ভেনডেটা চলছে, তার জন্য সে দুঃখিত এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে অলাৰ্ত্তিকে এই সাদা মুরগিটা দিচ্ছে।
কলোনার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অলাৰ্ত্তি চুপ করে ছিল। তারপর কর্সিকার ভাষায় সেও কিছু বলল, তার কথার অর্থ হলো অতীতের কথা সে ভুলে যাবে। মনে রাখবে শুধু আজকের ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান এবং পুর্ণমিলনের কথা। স্বয়ং মেয়রের উপস্থিতিতে এবং মঁসিয়ে লুসিয়েন ফ্রাঞ্চির মাধ্যমে যে পুর্ণমিলন আজ ঘটল, মাননীয় উকিল যার দলিল নিজ হাতে লিখে এনেছেন।
তারপর আবার দুজনেই চুপ।
মেয়র আবার বলতে বাধ্য হলেন–এই যে ভদ্রলোকেরা–তোমরা হাত মিলাবে এরকম একটা কথা হয়েছিল না।’
নিজেদের অজান্তেই প্রতিদ্বন্দ্বীরা দুজনেই নিজে নিজের হাত পিছনে লুকিয়ে ফেলল।
বাধ্য হয়ে মেয়র সিঁড়ির মাথা থেকে নেমে এলেন। প্রথমে কলোনার হাত তার পিছন থেকে টেনে সামনের দিকে আনলেন, তারপর অলাৰ্ত্তির হাতও তেমনিভাবে সামনে নিয়ে এলেন, তাকে এই টানাটানিতে বেশ কষ্ট করতে হলো–কিন্তু মুখে দরাজ হাসি ফুটিয়ে নিজের বিব্রত অবস্থা ঢাকার চেষ্টা করলেন।
তারপর কোনো রকমে মেয়র দুই শত্রুর হাত এক করে শক্ত করে চেপে রাখলেন। উকিল এই শুভ সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি দলিল হাতে উঠে দাঁড়ালেন।
মেয়র দুই শত্রুর হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছিল দুজনেই। কিন্তু না পেরে এখন ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
উকিল দলিল পড়তে শুরু করেছেন–মার্টেন প্রদেশের সরকারি উকিল। আমি গাইসেল আন্তোলিও সরোনা আমার উপস্থিতিগ্রামের গির্জার সামনে মাননীয় মেয়র। বিশেষ অতিথি এবং যাবতীয় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে–
এক পক্ষে গাইতালো অর্সো-অলার্তি-সংক্ষেপে অলাৰ্ত্তি–এদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিচার করে এভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে–
আজ ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ তারিখে দশ বছর আগে উভয় পক্ষের মধ্যে যে ভেনডেটা ঘোষিত হয়েছিল আজ তার শেষ হলো।
আজ থেকে তারা সহৃদয় প্রতিবেশী এবং বন্ধুর মতো পাশাপাশি বাস করতে থাকবে–যেমন করত তারা–এই ঝগড়া শুরু হওয়ার আগে।
তার প্রমাণ স্বরূপ তারা আজ এই দলিলে সই দিয়েছে। এই গ্রামের গির্জার সামনে মেয়র পোলো আরজরি। সালিস লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চি। উভয় পক্ষের লোক এবং সরকারি উকিলের সামনে।
.
লুল্লাকারো, ৪ মার্চ, ১৮৪১।
লেখাটা শুনে মনে মনে উকিলের প্রশংসা করলাম, মুরগির কথাটা না লিখে খুব ভালো কাজ করেছেন। ওই মুরগির ব্যাপারেই কলোনার আপত্তি ছিল। ওটাই তার পরাজয়ের চিহ্ন।
দলিল শুনতে শুনতে যেমন কলোনার মুখ উজ্জ্বল হচ্ছে, তেমনি অলাৰ্ত্তির মুখ তত কালো হয়ে যাচ্ছিল, অলাৰ্ত্তি স্থির চোখে হাতের মুরগির দিকে তাকিয় আছে, যেন এক্ষুনি ওটা কলোনার মুখের উপর ছুঁড়ে মারবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মনের ইচ্ছে কাজে পরিণত করার আগে মুখ তুলতেই লুসিয়েনের সাথে চোখাচোখি হলো, সেই ইচ্ছাটা শেষ হয়ে গেল।
মেয়র দেখলেন আর দেরি করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি পিছন হেঁটে সিঁড়ির মাথায় উঠতে লাগলেন, কলোনা আর অলাৰ্ত্তির হাত দুইটি তার হাতে ধরাই আছে। তার চোখও দুজনকেই পর্যবেক্ষণ করছে।
এবার দলিলে সই করার পালা, এখানেও সংকট আছে। যাকে আগে সই করতে বলা হবে সেই অপমানিত বোধ করবে। হয়তো কলম ছুঁড়ে ফেলে চত্বর থেকে বেরিয়েও যেতে পারে। মেয়র বুদ্ধি করে এ সংকটটা কাটিয়ে দিলেন, তিনি নিজেই সবার আগে সই করলেন। কাজেই আগে এখন সই করাটা অপমানের বিষয় না হয়ে সম্মানের হয়ে দাঁড়াল। অলাৰ্ত্তির হাতে কলম দিলেন মেয়র–অলাৰ্ত্তি সই করে কলম দিল লুসিয়েনকে। লুসিয়েনের পর কলোনা-কলোনা আবার সই জানে না। সে দিল একটা ক্ৰশ চিহ্ন।
এর মধ্যে গির্জার ভেতরে ঈশ্বরের মহিমা গান শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে বিরাট একটা যুদ্ধের জয় হয়েছে।
এদিকে স্বাক্ষরের পর স্বাক্ষর। যে কোনো স্তরের লোক গ্রামের বা বাইরের, নির্বিচারে এসে দলিলে সই করে যাচ্ছে।
তারপর এই নাটকের দুই নায়ক এক সথে গির্জায় ঢুকে বেদীর এক পাশে এক একজন প্রার্থনার জন্য বসল। এতক্ষণ পরে লুসিয়েন সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। একটা দুশ্চিন্তার বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গিয়েছে। আর চিন্তা নেই, প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেনে নিয়েছে, শুধু মানুষের সামনে না, ঈশ্বরের সামনেও। প্রার্থনা শেষ হলো। অলাৰ্ত্তি আর কলোনা বের হবার সময় আর একবার মেয়রের অনুরোধে হাত মেলাতে বাধ্য হলো।
তারপর ওরা নিজের নিজের দলের সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। গত তিন বছরের মধ্যে ওরা কেউই এ ঘরে ঢুকতে পারেনি।
লুসিয়েন আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপরই ডিনার সকালের নাস্তাটা আমাদের বাদ পড়েছে।
ডিনারে দেখলাম বিশেষ আয়োজন। যেন মস্ত একটা লোকের আপ্যায়ন হচ্ছে। বুঝলাম ব্যাপারটা। আমাকে দলিলে যখন নাম সই করতে হয়েছিল তখন নিশ্চয়ই নামটা লুসিয়েন দেখে নিয়েছে। নিশ্চয়ই এ নাম তার একেবারে অজানা না।
সকালেই আমি বলে ছিলাম যে, ডিনারের পরেই আমি রওনা হয়ে যাব। আমার একটা নাটকের রিহার্সাল প্যারিসে শুরু হতে যাচ্ছে। কাজেই ফিরে যাওয়াটা আমার পক্ষে একান্ত জরুরি। কাজেই লুসিয়েন এবং তার মায়ের বিশেষ অনুরোধ ফেলে আমাকে রওয়ানা দিতে হলো।
লুসিয়েন বলল, আপনি তো লুইকে একটা চিঠি পৌঁছে দেবার কথা বলেছিলেন, তাহলে সেই চিঠিটা লিখে দেই।’ মাদাম ফ্রাঞ্চির বাইরের কঠোরতা তো ছদ্মবেশ মাত্র। ভেতরে মাতৃ হে একেবারে কোমল। তিনি আমায় শপথ করিয়ে নিলেন, চিঠিটা আমি নিজ হাতে লুইকে দেব। সেটা অবশ্য আমার পক্ষে কষ্টের হবে না, কারণ রু দ্য হেলডার ৭নং সে থাকে। আমার বাসা থেকে কাছেই।
বিদায় নেবার আগে লুসিয়েনের ঘরে আর একবার গেলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা জিনিস, লুসিয়েন উদার হৃদয়ে আমায় অনুমতি দিল–
‘এখান থেকে যে কোনো একটা জিনিস উপহার হিসাবে আপনি নিলে আমি অত্যন্ত খুশি হব।’
এখন কিছু একটা না নিলে অভদ্রতা দেখায়। কাজেই আমি এক পাশ থেকে একটা ছোরা তুলে নিয়ে কোমরে রাখলাম। এখন আমি কি উপহার দেই? আমার বেল্টটি শিকারিদের কাজে লাগার কথা, কারণ ওটা শিকারিদের জন্যই তৈরি। আমি সেটা লুসিয়েনকে উপহার দিলাম। সেটা যে সহজ ভাবেই নিল, শুধু বন্ধুত্বের উপহার হিসাবে।
গ্রিদো এসে খবর দিল, আমার ঘোড়া তৈরি এবং গাইডও এসে পড়েছে। গ্রিদোকে আমি একটা শিকারের ভোজালি দিলাম তার ফলার দুই পাশে দুদিকে দুটো পিস্তল। উপহার পেয়ে গ্রিদো এমন আনন্দ প্রকাশ করল, যা আমি আর কাউকে দেখিনি।
নিচে এসে দেখলাম, মাদাম ফ্রাঞ্চি সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, বিদায় জানাবার জন্য ঠিক সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন–যেখান থেকেই উনি স্বাগত জানিয়েছিলেন কালকে। তার হাতে চুমু খেয়ে বিদায় নিলাম। সাধারণ জীবনে এভাবে সম্মানীয়া মহিলা আমি কমই দেখেছি। তার প্রতি এখন আমার সম্ভম অটুট, অক্ষুণ্ণ।
লুসিয়েন আমার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এল।
‘অন্য কোনো সময় হলে আমি ঘোড়া নিয়ে পাহাড় পর্যন্ত আপনার সাথে যেতাম। কিন্তু আজকে অলাৰ্ত্তিরা কলোনাদের জন্য সে সাহস পাচ্ছি না, ওরা যে কোনো সময় আবার একটা অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। শান্তির জীবনে অভ্যস্ত হতে ওদের সময় লাগবে।’
এই অল্প পরিচিত বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম, বললাম, আবার দেখা হবে?
‘নিশ্চয়ই হবে, যদি দয়া করে আবার কর্সিকায় আসেন।’
‘আপনিও তো প্যারিসে আসতে পারেন।’
‘না, ওখানে আমার যাওয়া হবে না।
‘আপনার ভাইয়ের ঘরে টেবিলের উপর আমার কার্ড রেখে এসেছি। ঠিকানাটা অন্তত ভুলবেন না।
‘না, তা ভুলব না। যদি কখনও ইউরোপে কোথাও যেতেই হয়, গিয়ে সবার আগে আপনার সাথে দেখা করব।’
‘তাহলে এই কথাই রইল।’ বলে আর একবার হাত মিলিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম। গ্রাম ছেড়ে নদী, নদীর পর পাহাড়। পাহাড়ে দেখা হলো অলাৰ্ত্তির সাথে।
সে আমাকে বিদায় জানাবার জন্য এখানে এসে অপেক্ষা করছে। গির্জার অনুষ্ঠানের সময় তার পরনে ছিল সভ্য পোশাক। কিন্তু এখন তার পরনে সেই পাহাড়ে চড়ার পুরানো ছেঁড়া পোশাক। বলল, ‘গ্রামে কি মানুষ থাকতে পারে? কেবলই মনে হয় ঘরের ছাদ এই বুঝি মাথায় ভেঙে পড়ল।
আমি বললাম, ‘কলোনার সঙ্গে মিলনটা যেন স্থায়ী হয়।
সে মুখ বাঁকাল। আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু কলোনা যে মুরগি দিয়েছিল, তার মাংসটা যেন ছিবড়ে।
৭. প্যারিসে এসে পৌঁছলাম
৭.
প্যারিসে এসে পৌঁছলাম আটদিন পর।
পৌঁছেই মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি ঘরে নেই।
আমার নামের কার্ড রেখে এলাম। চাকরকে জানিয়ে এলাম আমি কিছুদিন আগে সুল্লাকারো থেকে এসেছি এবং মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চির কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছি, যা আমি শুধুমাত্র মঁসিয়ে লুইর হাতে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
চাকরটি আমাকে তার মনিবের পড়ার ঘরে বসতে দিয়েছিল, খাওয়ার ও বসার ঘর দুটো পেরিয়েই সে ঘরে যেতে হয়। যাবার সময়ই আমি দুটো ঘরের আসবাবপত্র দেখে নিলাম। সেই একই রুচি, যা সুল্লাকারোতে আমি লুইর ঘরে দেখে এসেছি। বরং এখানে এটা আরও বেশি মার্জিত। সেটা নিশ্চয়ই প্যারিসের কাতারের জন্য। অবিবাহিত এক যুবক। তা একার পক্ষে এই এলাকাটি খুবই আরামের বলে মনে হলো।
পরের দিন বেলা এগারোটার সময় আমি যখন পোশাক পড়ছি, তখন আমার চাকর এসে মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির আসার খবর জানাল, আমি বললাম–ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে খবরের কাগজগুলো পড়তে দাও আর বল আমি এক্ষুনি আসছি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি লুইর কাছে গেলাম।
গিয়ে দেখি ‘প্রেস’ কাগজে আমার যে ধারাবাহিক লেখাটা ছাপা হচ্ছে, সেটা উনি পড়ছেন। কিন্তু আমাকে আকর্ষণ করল লুসিয়েনের সাথে এই লুইয়ের দৈহিক সাদৃশ্য।
লুই বলল, মঁসিয়ে কাজের লোকের হাত থেকে এই ছোট চিঠিটা যখন পেলাম, আমি আমার সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি অন্তত বিশবার আপনার চেহারার বর্ণনা তার মুখ থেকে শুনে নিলাম বর্ণনা মিলিয়ে নিলাম, কাগজে দেখা আপনার ছবির সাথে। ফলে দেখছেন তো বড় বেশি সকাল সকাল আপনার কাছে এসে গেছি। আপনার হয়তো অসুবিধা হলো। কিন্তু দুটো কারণে আমি আর ধৈৰ্য্য রাখতে পারছিলাম না। প্রথমত আপনাকে ধন্যবাদ দেয়া আমার কর্তব্য। দ্বিতীয়ত বাড়ির খবরের জন্য আমি বড় বেশি অস্থির।
লুই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে বাধা দিলাম। আমার প্রশংসার জন্য আপনাকে পরে ধন্যবাদ দেব, আগে বলুন তো আমি কি মঁসিয়ে লুসিয়েন না মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির সাথে কথা বলছি?’
লুইয়ের ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি ফুটে উঠল।
‘আমাদের আকৃতি হুবহু এক। আমি যখন সুল্লাকারোতে ছিলাম, তখন শুধুমাত্র দুজনের ভুল হতো না–কে লুইয়ের আর কে লুসিয়েন, তারা হলো আমরা দু ভাই নিজেদের। তবে চেহারায় পার্থক্য না হলেও, পোশাকে তফাৎ ছিল প্রচুর। এর মধ্যে যদি লুসিয়েন তার কর্সিকার পোশাক পরিবর্তন না করে থাকেন এবং আপনি তা দেখে থাকেন। তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন। পোশাকের জন্যই সাধারণ লোকের আমাদের চিনতে ভুল হতো না।’
আমি স্বীকার করলাম কথাটা সত্য, কিন্তু শেষ যখন আমি তাকে দেখি, তখন পরনে ছিল এই ফরাসি পোশাকই, তাতে তার সাথে আপনার বর্তমানে কোনো তফাৎ ধরতে পারছি না।
ব্যাগ থেকে চিঠি দুটো বের করে লুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই বাড়ির খবরের জন্য অস্থির হয়ে রয়েছেন। কালকে এই চিঠি আপনার চাকরের হাতে দিয়ে আসিনি, তার কারণ, আপনার মায়ের কাছে আমি শপথ করেছিলাম যে চিঠি নিজের হাতে আমি আপনাকে দেব।
‘বাড়িতে সকলকে ভালো দেখে এসেছেন তো?
‘সবাই ভালো। কিন্তু আপনার জন্য চিন্তিত। চিঠি পড়লেই জানতে পারবেন।’
‘আপনি কিছু মনে করবেন না তো?’
‘না আপনি পড়ন।
লুই চিঠি খুলে পড়তে লাগল, আমি চুরুট পাকাতে লাগলাম।
আমি তার মুখের দিকে লক্ষ্য রাখছি। কোনো ভাবান্তর যেন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে না পারে। সে তাড়াতাড়ি চিঠি পড়ছে। আর মাঝে মাঝে একটু হাসছে। মধ্যে মধ্যে অস্ফুট স্বরে দুই একটা মন্তব্য করছে। চেহারার দিক দিয়ে দুই ভাইয়ের এত মিল যে, সে ধাক্কাটা তখনও আমি সামলে উঠতে পারিনি। তবে লক্ষ করেছি যে, লুসিয়েনের কথাই ঠিক। লুইয়ের গায়ের রং একটু বেশি সাদা এবং তার ফরাসি উচ্চারণ অনেক বেশি নিখুঁত।
তার চিঠি পড়া শেষ হতে, তাকে একটা নিজের পাকানো চুরুট দিলাম। আমার জ্বলন্ত চুরুট থেকে সেটা জ্বালিয়ে নিল। বললাম, চিঠিতে পড়লেন তো? ওরা আপনার জন্য খুবই চিন্তায় আছেন। তবে আমি আশ্বস্ত হচ্ছি এই দেখে যে তাদের দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না।’
লুই একটু দুঃখিত গলায় বলল, একেবারে কারণ ছিল না, তা নয়। আমি অসুস্থ ছিলাম তারচেয়েও গুরুতর ব্যাপার হলো একটা ব্যাপারে আমি দারুণভাবে মানসিক অশান্তিতে আছি। স্বাভাবিক অবস্থায় আমি এত অস্থির হতাম না। কিন্তু যখন ভাবছি আমার জন্য লুসিয়েনকেও কষ্ট দেয়া হচ্ছে—’
বাঁধা দিয়ে বললাম–ব্যাপারটার কিছুটা ইঙ্গিত আপনার ভাইয়ের মুখ থেকে পেয়েছিলাম। এভাবে আশ্চর্য রকম যোগাযোগ যে দুই মানুষের মধ্যে থাকতে পারে তা সহজ বুদ্ধিতে বিশ্বাস হয় না। তবে আমার সামনে প্রমাণ রয়েছে। আপনাদের চেহারার মিল, এটা সচক্ষে দেখার পর মানসিক মিল সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা চলে না।
লুই বিষণ্ণভাবে হাসল।
‘তা হলে আপনিও বিশ্বাস করেন আপনার ভাই যে অশান্তি ভোগ করেছেন তা আপনার অশান্তির ফলে।
‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
‘আপনার এই বিশ্বাস দেখে একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। কৌতূহলের জন্য নয়। আপনাদের উপরে আকর্ষণের জন্য। যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি? আপনার সেই মানসিক অশান্তি শেষ হয়েছে?
একটু চুপ থেকে লুই বলল, আপনি তো জানেন যে, দুঃখ যত তীব্রই হোক না সময়ের জন্য তা আস্তে আস্তে কমে যায়।
আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত যদি কোনো কারণে বিষিয়ে না ওঠে, তাহলে কয়েকদিন তা থেকে রক্ত ঝরবে। তারপর নিজে থেকেই ক্ষত শুকিয়ে যাবে। আপনি যে অনেক কষ্ট করে চিঠি নিয়ে এসেছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখন আপনি যদি বিরক্ত না হয়ে আপনার কাছে আসার অনুমতি দেন, তাহলে মাঝে মাঝে এসে আপনার সাথে সুল্লাকারোর গল্প করে যাব।’
‘আপনি যদি আসেন এবং গল্প করেন তবে আমিও প্রচুর আনন্দ পাব, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা না করে, এখনই কিছু আলাপ করা যাক। আসুন দুজনে নাস্তা খাই আর গল্প করি।’
‘কিন্তু আজকে সম্ভব নয়। কালকে বিচার মন্ত্রীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি, আজকে তার সাথে দেখা করার কথা, একটা আলোচনা আছে, আমার মতো নতুন উকিলের পক্ষে তার ডাক অগ্রাহ্য করা সম্ভব না।
বিচার মন্ত্রী কি সেই অলাৰ্ত্তি আর কলোনাদের ব্যাপারে ডেকেছেন?
‘খুব সম্ভব তাই। আমি মন্ত্রীকে সুখবরটা দিতে পারব। কারণ লুসিয়েন লিখেছে যে, ব্যাপারটার মীমাংসা হয়ে গিয়েছে।’
‘আমি নিজের চোখে দেখেছি, সরকারি উকিলের সামনে, আমিও অলাৰ্ত্তির পক্ষে জামিনদার ছিলাম।
‘লুসিয়েন সব কিছু লিখেছে। ঘড়ি বার করে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, আমি গিয়ে আমার ভাইয়ের প্রতিশ্রুতি পালন করার কথা বলে আসছি।’
‘সব সুন্দর ভাবে হয়েছে, আমি তার সাক্ষী।
‘আমি জানতাম এ কাজ লুসিয়েনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেও সে এ কাজ করবে।’ লুসিয়েনের মতো ছেলে হয় না।’
‘নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধের কাজও যেরকম নিষ্ঠার সাথে তিনি করেছেন। তার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
‘নিশ্চয়ই, আপনার সাথে কথা বলে আমি প্রচুর আনন্দ পাচ্ছি। আমার মাকে, ভাইকে, আমার প্রিয় স্বদেশকে যেন চোখের সামনে দেখছি, আপনার কথার ভেতর থেকে, তবুও আজকে আর সম্ভব না, কোনো সময় এলে আপনাকে একটু একা পাব
‘অনেকদিন পর প্যারিসে ফিরে এসেছি, এখন কিছুদিন ব্যস্ত থাকতে হবে, তার চেয়ে আপনাকে কোথায় পাব তা যদি বলেন
‘কাল মাই বারেসের উৎসব-’ (ধর্মীয় উৎসব)
‘কালকেই উৎসব নাকি?’
‘আপনি কি গিয়ে অপেরার নাচের উৎসবে যোগ দেবেন।
‘যদি আপনাকে গিয়ে সেখানে পাওয়া যায়, তাহলে যেতে পারি, কিন্তু আর কোনো আগ্রহ নেই ও ব্যাপারে।
‘আমাকে কিন্তু যেতেই হবে। যেতে আমি বাধ্য।
আমি হেসে বললাম, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, সময় সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। হৃদয়ের ক্ষত নিজ থেকেই শুকিয়ে যায়।
লুই মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল, ‘আপনি ভুল করছেন। আমি সেখানে আনন্দের জন্য যাচ্ছি না, যাবার জন্য হয়তো নতুন করে অশান্তি শুরু হতে পারে। তবু আমাকে যেতেই হবে।’
‘কেন উপায় নেই? ঝামেলার সম্ভাবনা যেখানে, সেখানে যাবেন না।
‘মানুষ কি নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারে? ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাগ্য, না গেলে যে ভালো হয় তা আমি জানি। তবু যেতে হবে।’
‘ঠিক আছে আপনি যখন যাবেন, আমিও কালকে অপেরায় যাব। কখন?
‘সাড়ে বারোটায়, যদি আপনার অসুবিধা না হয়।’
‘কোথায়?
‘ঘড়ির নিচে। ঠিক একটার সময় সেখানে আমার সাথে একজনের দেখা করার কথা।
হাত মিলিয়ে সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রায় বারোটা বাজে।
এরপর সেদিন বিকেল এবং পরদিন সমস্ত দিনই আমাকে ব্যস্ত থাকতে হলো। আঠারো মাস পরে ফেরার জন্যই আমাকে এই ব্যস্ততার মাঝে কাটাতে হলো। এর কোনো বিকল্প নেই।
নির্দিষ্ট স্থানে রাত বারোটার সময় লুইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। তখনও লুই আসেনি। সে এলে পর শুনলাম, এক মুখোশধারিনীর পিছনে সে এতক্ষণ ছুটছিল। তাকে ধরতে পারেনি শেষ পর্যন্ত, ভিড়ের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
আমি চাইছিলাম কর্সিকার কথা আলোচনা করতে। কিন্তু লুইয়ের মন এখন শুধু ঘড়ির উপর ব্যস্ত। শুধু ঘড়িই দেখছে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল : ওই যে আমার ভায়োলেট ফুলের তোড়া।
বলেই সে উধাও হয়ে গেল।
নাচ ঘরে বিভিন্ন ধরনের তোড়া উপস্থিত। ক্যাসিনিয়ার একটা ভোড়া এসে আমাকে বলল : প্যারিসে আপনার পুনঃরাগমনের উপলক্ষ্যে অভিনন্দন জানাতে চাই।’
ক্যাসিনিয়ার পরে এল গোলাপের তোড়া। গোলাপের পরে হেলিওট্রোন, তারও পরে ৪নং তোড়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা বন্ধু ডি’র সঙ্গে।
ওর পুরো নামটা কেউ বলে না। দরকার হয় না। ডি বললেই সবাই বুঝে নেয়।
ডি নিজেই ডেকে বলল, ‘আরে বন্ধু তুমি ঠিক সময়েই এসেছ। আজ আমার বাড়িতে একটা নৈশ ভোজনের ব্যবস্থা আছে। তোমাকে আসতেই হবে, এই বলে আরও তিন-চার জনের নাম করে বলল, এরা সবাই আসছে।
আমি ধন্যবাদ দিয়ে মাফ চাইলাম। তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু আমার আর একজন সাথী আছে।
‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা প্রত্যেকেই একটি করে তোড়া নিয়ে যাব। তুমিও এনো। টেবিলে ছয় কলসি ‘জল’ রেখেছি তোড়াদের তাজা রাখার জন্য।’
‘তুমি ভুল করেছ বন্ধু, তোড়া নয়। আমার সাথে আছে এক পুরুষ বন্ধু।
‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই, প্রবাদই তো আছে বন্ধুর যে বন্ধু, সে আমার বন্ধু।
‘কিন্তু যুবকটিকে তো তোমরা চেন না?’
‘চিনে নেব।’
‘তাহলে তাকে গিয়ে তোমার নিমন্ত্রণের কথা বলি।’
‘বলো, যদি আসতে না চায় জোর করে ধরে এনো।’
‘যতদূর পারি চেষ্টা করব, খেতে বসবে কখন?’
‘রাত তিনটে। ছয়টা পর্যন্ত খাওয়া চলবে, যথেষ্ট সময় পাবে।’
‘আচ্ছা, বলে বিদায় নিলাম ‘ডি’-এর কাছ থেকে।
মাইওমোটিস এর একটি তোড়া দূরে থেকে আমাদের কথা শুনছিল, এবার এগিয়ে এসে ‘ডি’-এর হাত ধরে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই লুইর সঙ্গে দেখা। তার সাথে আর ভায়োলেটের তোড়া নেই। আমার সাথে তখন যে তোড়াটি ছিল, তা এক বন্ধুর সাথে দিয়ে আমি লুইয়ের সঙ্গ নিলাম।
‘যা জানার দরকার ছিল, জানতে পেরেছেন?
‘তা জেনেছি, মুখোশ নাচের ব্যাপার তো জানেন? সেসব কথা বাদ দেয়া উচিত, সেটাই এখানকার একমাত্র কথা।’
‘বেচারী’ এই বলেই হঠাৎ মনে হলো, মাত্র দুদিনের পরিচিতর সাথে এই ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা হয়তো উচিত হলো না। সাথে সাথে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাইয়ের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সেটাই আপনার উপর ব্যবহারে চাপিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কথাটি কী? ভাগ্যের চাকা বুঝি নিচে দিয়ে যাচ্ছে।
লুই চুপ। বুঝলাম, তার দুশ্চিন্তার কারণটা সে গোপন রাখতে চায়, কাজেই ও নিয়ে আর কোনো কৌতূহল নয়।
চুপচাপ দুজনে বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা হাটছি। আমার তো সত্যিই কারো সঙ্গে দেখা বা আলাপ করার কথা নাই। সুতরাং আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু লুই প্রত্যেকটা গোড়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে।
আমি বললাম, ‘শুনুন এক কাজ করুন।
সে একেবারে চমকে উঠল, আমার কথা তার মনে ছিল না। তারপর অপ্রতিভের মতো বলল, ‘কী কাজ?
‘কিছু একটা করুন যাতে একটু অন্যমনস্ক হওয়া যায়।’
‘যেমন?’
‘আমার এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত আছে। সেখানে চলুন।
না, এমন দুঃখিত চেহারার অতিথিকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইবেন ।’
‘দুঃখিতদের তো ওই রকম জায়গায় যাওয়া দরকার। সেখানে সব অবাস্তব কথাবার্তা হবে। তাতে আপনার মনের মেঘ কেটে যাবে।
এরমধ্যে মাইওমোটিসের তোড়া নিয়ে ‘ডি’ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, চোখ পড়তেই ছুটে এল।
‘কথা ঠিক আছে তো? তিনটের সময়—’
‘না, বন্ধু। আমার আসা সম্ভব নয়।’
‘ডি’ রাগ করে চুলোয় যাও’ বলে চলে গেল।
লুই তার সম্পর্কে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে, ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করল, ‘ভদ্রলোকটি কে?
‘এ আমার বন্ধু ‘ডি’। একটা নামকরা কাগজের মালিক। খুব আমুদে লোক।
‘ডি, ওকে আপনি ভালো করে চেনেন নাকি?’
‘চিনি না? দুই তিন বছর ধরে ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
‘রাতের দাওয়াত কি ওর বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ, ওখানে তো তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।’
‘তাহলে আমি আনন্দের সাথে রাজি।
‘খুব ভালো কথা। কিন্তু শুধু আমাকে খুশি করার জন্য খাবার দরকার নেই, কারণ খাওয়া না খাওয়া আমার কোনো লাভ ক্ষতি নেই।
দুঃখের হাসি হেসে লুই বলল, আমারও হয়তো যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু কাল যে বলেছিলাম, মনে আছে? যেখানে যাওয়া উচিত সেখানে আমরা যাই না, যাই সেখানে ভাগ্য আমাদের টেনে নিয়ে যায়। আসল কথা হলো–আজকে আমি এখানে না এলেই সব চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। করতাম।’
তখনই আবার ‘ডি’-এর সাথে দেখা হলো।
তাকে থামিয়ে, আমার তার ওখানে যাবার কথা জানিয়ে দিলাম।
যাবে, পরশু রাতেও তাকে আমাদের সাথে খেতে হবে।’
‘কারণ?’
‘শ্যাটো রেনোর সাথে একটা বাজি হয়েছে।’
লুই আমার পাশেই ছিল। সে আমার হাতটা বেশ জোড়েই চেপে ধরল হঠাৎ। তার দিকে তাকালাম, মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
‘ডি’ কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাজিটা কি?
এখানে দাঁড়িয়ে অত বড় গল্প বলা যাবে না। তাছাড়া এর সাথে এক মহিলা জড়িয়ে আছেন, তাঁর কানে বাড়ির কথা উঠলে, শ্যাটো রেননা। অবশ্যই ঠকে যাবেন।
‘ঠিক আছে, তিনটার সময় তাহলে
‘ডি’ চলে গেল। ঘড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম দুটো পঁয়ত্রিশ।
লুই নিজেকে স্থির রাখতে ব্যর্থ হয়ে জানতে চাইল আমি শ্যাটো রেনোকে চিনি কিনা?
‘মুখটাই শুধু পরিচিত। বন্ধুদের বাড়িতে দু একবার শুধু দেখেছি।’
‘তাহলে সে আপনার বন্ধু না?
‘বন্ধু তো নয়ই। সাধারণ পরিচিতও না।’
‘বাঁচলাম।’
‘কেন? কীভাবে বাঁচলেন?’
‘না, এমনিই। এমনিই বলেছি ও কথা।‘
‘পালটা প্রশ্ন করলাম–‘আপনি কি চেনেন নাকি?’
‘মোটামুটি।’
এই এড়িয়ে উত্তর সত্ত্বেও বোঝা গেল সে মঁসিয়ে ফ্রাঞ্চি এবং মঁসিয়ে শ্যাটো রেনোর মধ্যে একটা রহস্য আছে এবং সে ব্যাপারে যোগ সূত্র হচ্ছে এক মহিলা। আমার কেমন যেন মনে হতে লাগল, আমি এবং লুই বাড়িতে চলে গেলেই আমাদের জন্য ভালো হবে।
সে কথা আমি লুইকে বললাম, ‘ডি’র বাড়িতে না যাবার জন্য। কিন্তু উত্তরে বলল, ‘কেন? যাব না কেন? তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। আপনি নিজেই তো তাকে একজন অতিথি নিয়ে আসবেন বলে জানিয়েছেন।
‘সব ঠিক আছে। তবুও আমার মন কেন যেন বলছে, আমরা না গেলেই ভালো হয়।’
‘একটু আগেই তো আপনি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি করেছেন, এখন আবার ওরকম ভাবছেন কেন?’
শ্যাটো রেনোর সঙ্গে সেখানে দেখা হবেই।
দেখা হলে ভালোই তো। শুনেছি খুব আমুদে লোক, তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হলে আমি খুশিই হব।
বেশ তাহলে চলুন, আপনার যখন এত আগ্রহ।
নিচে গিয়ে কোট পরলাম। অপেরার কাছেই ‘ডি’র বাসা। পরিষ্কার আবহাওয়া তাই হেঁটে যাওয়ার জন্য লুইকে বললাম, লুই রাজি হলো, আশা হলো, ঠাণ্ডা বাতাস লুইসের মাথা শান্ত করে দিতে পারবে।
.
৭.
ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমার বন্ধুদের অনেককেই দেখতে পেলাম। এরা সবাই নিয়মিত অপেরা দেখতে যায়। থিয়েটারের বক্সের দর্শনার্থী সবাই। মুখোশ খোলা কয়েকজন নাচিয়েও আছেন। সাথে ‘তোড়া’রা আছে।
তাদের কয়েকজনের সঙ্গে লুই দ্য ফ্রাঞ্চিকে আলাপ করিয়ে দিলাম। সবাই তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করল।
‘ডি’ তার মাইওমোটিস তোড়াকে সাথে নিয়ে দশ মিনিট পর এসে পড়ল। এসে সহজে মুখোশ খুলে ফেলল মাইওমোটিস, তার দ্বিধা করার কথাও না। এরকম পার্টিতে তার যাতায়াত অভ্যাস আছে তারপর সে। অত্যন্ত সুন্দরী।
‘ডি’র সাথেও ফ্রাঞ্চির পরিচয় করিয়ে দিলাম।
ডি, ঘোষণা করল–‘আমি প্রস্তাব করছি–সবার সাথে পরিচয়ের কাজ যদি শেষ হয়, তবে এবার খাবার টেবিলে গিয়ে বসা যাক।
‘কিন্তু শ্যাটো রেনো এখনও আসেনি?’
‘তাই তো। তার সে বাজি?’
‘বাজি ঠিক আছে, যে হারবে, সে বারোজন বন্ধুকে ডিনার খাওয়াবে।’
‘কিন্তু বাজিটা কি নিয়ে?
‘শ্যাটো রেনো বাজি ধরেছে, সে বিশেষ এক মহিলাকে এই খাবার আসরে নিয়ে আসবে। আমরা বলেছি সে পারবে না।’
মাইওমোটিস তোড়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘কে সেই মহিলা? যাকে নিয়ে এভাবে বাজি ধরা চলে?
আমি তাকিয়ে আছি লুই ফ্রাঞ্চির দিকে, বাইরে সে সম্পূর্ণ শান্ত। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখলাম, তার মুখ মরা মানুষের মতো সাদা।
‘ডি’ বলল, আমি তার নাম বলায় কোনো বাঁধা আছে বলে মনে করি না। আপনারা তাকে অনেকেই চেনেন না।
‘ডি’, হাত ধরল লুই–‘মঁসিয়ে দয়া করে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন কি?
‘ডি’ ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘কি অনুরোধ?
‘শ্যাটো রেনোর সাথে যে মহিলার আসার কথা। তার নামটি প্রকাশ করবেন না। তিনি বিবাহিতা, তা তো জানেন।
‘হোক বিবাহিতা, কিন্তু তার স্বামী তো ভারতবর্ষ বা মেক্সিকো বা ওইরকম বহু দূর কোনো দেশের প্রবাসী। অতদূরে স্বামী থাকা আর না থাকা সমান।’
‘কিন্তু সেই স্বামী আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশে আসছেন, আমি তাকে চিনি। সাহসী পুরুষ। ফিরে এসে যদি শোনেন যে, তার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি মনে আঘাত পাবেন। সম্ভব হলে সে আঘাত থেকে আমি তাঁকে বাঁচাতে চাই।’
‘ডি’ বলল, আমাকে মাফ করবেন। আমি জানতাম না, আপনার সাথে মহিলার পরিচয় আছে। এও আমি সত্যি জানতাম না যে তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আপনি যখন ও ব্যাপারে নিশ্চিন্ত এবং স্বামীকেও চেনেন-’
‘তা চিনি।’
এখন অবশ্যই কথাবার্তায় আমাদের সংযত হতে হবে। ভদ্রমহিলা মহোদয়গণ, শ্যাটো রেননা আসুক বা না আসুক। বাজিতে তিনি জিতুন বা হারুন। আমার অনুরোধ এই ব্যাপারে আপনারা আর একটাও কথা বলবেন না।’
সবাই এর কথায়, এ ব্যাপারে আর কোনো কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিল। সামাজিক শালীনতার জন্যই যে এ প্রতিজ্ঞা তারা করল তা বোধহয় না। আসল কারণ হয়তো এই যে প্রত্যেকের দারুণ ক্ষুধা লেগেছিল। ফাও তর্ক করার উৎসাহ ছিল না।
ডি-এর সাথে হাত মেলালো ফ্রাঞ্চি। ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আমার সন্দেহ তাই। আপনি মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন।’
এবার সবাই খাবার ঘরে গিয়ে খেতে বসল। দুটো চেয়ার খালি রইল একটি শ্যাটো রেনের অন্যটি তার সাথে আসার সেই মহিলার।
বাড়তি চেয়ার দুটি চাকরেরা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
‘ডি’ মানা করল, ‘শ্যাটো রেনো চারটে পর্যন্ত সময় নিয়েছে, এখনও সময় আছে। চারটা বাজার সাথে সাথে চেয়ার সরিয়ে নিয়ে যাবে। চারটে বেজে গেলে সে হেরে গেল।
আমি ফ্রাঞ্চির দিকে তাকিয়ে আছি, সে চেয়ে আছে ঘড়ির দিকে। ঘড়িতে তখন চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।
‘ডি’ কে ফ্রাঞ্চি জিজ্ঞেস করল-’আপনার ঘড়ি ঠিক আছে তো?
‘ঘড়ি ঠিক বেঠিকের ব্যাপারে মাথা ঘামাবে শ্যাটো রেনো–আমার কোনো দরকার নেই। তবু সে যাতে এ ব্যাপারে আপত্তি তুলতে না পারে। তার জন্য তার ঘড়ির সাথে আমি ওই দেয়াল ঘড়ির সময় মিলিয়ে নিয়েছি।’
মাইওসোটিম তোড়া বলে উঠল–‘মঁসিয়ে শ্যাটো রেনো এবং তার বান্ধবীর ব্যাপারে কথা বলা যখন নিষেধ, তখন ও প্রসঙ্গ বাদ দিন। কারো। নাম বলতে না পারলে প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে হয়। ঘরোয়া আলাপের ভেতর এই ব্যাপারটা আমার অসহ্য বলে মনে হয়।
‘ডি’ বলল–তুমি ঠিক বলেছ এটা। আর কোনো দুঃখেই বা আমরা প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে যাব? যাদের নাম ধরে ডাকা যায়, এমন সুন্দরীর অভাব এখনও পড়েনি। তাঁদের সম্বন্ধে কথা বললে তারা বরং খুশিই হবে।’ আসুন তাঁদের সকলের স্বাস্থ্যই আমরা পান করি।
প্রত্যেক অতিথির হাতের কাছেই একটি করে বোতল। তা থেকে বরফ দেয়া শ্যাম্পেন ঢালছে গ্লাসে, আর গ্লাসের পানীয় ঢালছে গলায়।
লুই খুব কমই গ্লাস মুখে তুলছে।
আমি বললাম–‘আসুন, একটু পান করুন। দেখছেন তো শ্যাটো রেননা আসছে না।’
লুই বলল সে পরে পান করবে। আমি আর কিছু না বলে নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম।
আমরা কথা বলছি বেশ আস্তে। কিন্তু বাকি সবার গলা আস্তে আস্তে বাড়ছে। রীতিমতো গোলমাল শুরু হয়েছে। মাত্র দুজন লোক সেই হট্টগোলে যোগ দিচ্ছে না, সে লোক দুজন হলো–ডি এবং লুই। তারা ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আমি আবার লুই-এর দিকে তাকালাম। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। বলে গ্লাস মুখে উঠালাম।
সেও মৃদু হেসে তার গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়াল। গ্লাস প্রায় অর্ধেক খালি হয়েছে। এমন সময় জোরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
তার মুখ প্রথম থেকেই বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। কিন্তু সেটা যে আরও বিবর্ণ হতে পারে এ ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল ন। কিন্তু চোখের উপরেই দেখলাম তার মুখটা একেবারে ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গেল।
‘এ সেই’ ফ্রাঞ্চি বলল।
আমি ভরসা দিলাম–বোধহয় সেই। হয়তো সে মহিলাকে আনতে পারেনি।’
‘এখনি দেখা যাবে।’
ঘণ্টা বেজে উঠার পর প্রত্যেকের মনোযোগ সেই দিকে চলে গিয়েছে। এতক্ষণ আলাপ চলছিল হট্টগোলের মতো, মাঝে মাঝে সেটা চিৎকার পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে গোলমাল একদম চুপ হয়ে গেল।
সামনের ঘরে একটা কিছু নিয়ে তর্ক হচ্ছে।
‘ডি’ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
লুই আমার কবজি চেপে ধরল জোরে। ‘তার গলা শুনছি।‘
আমি বললাম, তাতে কী! একদম ভেঙে পড়বেন না, মনে জোর আনুন, ভেবে দেখুন–কোনো মহিলা যদি তার অল্প পরিচিত বন্ধুর সাথে অপরিচিত কোনো বাড়িতে রাতে খেতে আসেন, যেখানে অন্য পুরুষরাও তার অপরিচিত, তাহলে বুঝতে হবে তিনি তরল প্রকৃতির মহিলা। চরিত্রহীনাই তাকে বলা যেতে পারে এবং তাই যদি মেনে নেয়া হয়। তাহলে সেকি আর কোনো ভদ্রলোকের শ্রদ্ধা বা সম্মান দাবি করতে পারে?
শুনতে পেলাম ও ঘরে ‘ডি’ বলছে–‘আসুন মাদাম, আসুন, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি–এ একটা একান্ত নিজস্ব পার্টি, বিশেষ অন্তরঙ্গ কয়েকটি বন্ধু।
শ্যাটো রেনোর গলা শুনতে পেলাম–এসো না এমিলি। ইচ্ছে না হলে তুমি মুখোশ খুলো না।
লুই দ্য ফ্রাঞ্চির মুখ থেকে একটা হিস হিস শব্দ বের হলো-’দুবৃত্ত।
শ্যাটো রেনো আর ডি দুজনে প্রায় টানতে টানতে এক মহিলাকে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। বেচারি ‘ডি’–তার হয়তো মনে মনে ধারণা–অতিথি অ্যাপায়নের জন্য যেটুকু করা দরকার সে সেটুকু করছে।
চারটে বাজতে তখনও তিন মিনিট বাকি। মৃদু স্বরে ‘ডি’, কে জানাল শ্যাটো রেননা।
‘ঠিক আছে বন্ধু, তুমি জিতেছ।
অজানা মহিলা বলে উঠলেন, না, এখনও পুরোপুরি জেতা হয়নি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি শ্যাটো রেনোকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনার অত জেদের কারণ এখন বুঝতে পারছি। আপনি বাজি ধরেছিলেন যে এখানের এই ডিনারে আমাকে নিয়ে আসতে পারবেন কেমন?
শ্যাটো রেনো কোনো জবাব দিল না। তখন মহিলা ‘ডি’-এর দিকে ফিরল।
‘মঁসিয়ে, এই ভদ্রলোক জবাব দিচ্ছেন না। কাজেই আপনাকেই প্রশ্ন করি শ্যাটো রেনো কি এই রকম কোনো বাজি ধরেছিলেন হে।’
‘ম্যাডাম, শ্যাটো রেনো আমাকে ঠিক এই ধরনের কথা বলেছিলেন, তা আমি আপনার কাছে অস্বীকার করতে পারি না।’
তাহলে শুনুন, শ্যাটো রেনো বাজি হেরেছেন। কারণ তিনি আমাকে কোথায় নিয়ে আসছেন, তা আমকে মোটেই বলেননি। আমাকে বলেছিলেন, আমার একটি বিশেষ বন্ধুর বাড়িতে খাবার দাওয়াতে আমরা যাচ্ছি। সুতরাং আমি যখন নিজের ইচ্ছায় আসিনি তখন আমার ধারণা, শ্যাটো রেনো বাজি হেরেছেন।’
এতক্ষণ পর শ্যাটো রেনো কথা বলল, ‘এসে যখন পড়েছ তখন থেকে যাও। এত সব সম্মানী ভদ্রলোক রয়েছেন। এমন সুন্দরী সব মহিলা
‘এসে যখন পড়েছি তখন যে ভদ্রলোক এ ঘরের মালিক, তাকে তার ভদ্রতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু তাঁর নিমন্ত্রণ আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব না। মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চি আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন? আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন?
লুই দ্য ফ্রাঞ্চি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অজ্ঞাত মহিলাকে শ্যাটো রেনোর সামনে থেকে আড়াল করে দাঁড়াল।
শ্যাটো রেননা তখন রাগে দাঁতে দাঁত পিষছে। মাদাম, আপনি ভুলে যাবেন না, আপনি আমার সাথে এসেছেন, আমি যখন এনেছি, আপনাকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও আমার।
মুখোশ পড়া মহিলা উত্তর দিলেন, ‘মঁসিয়েরা, এখানে আপনারা ভদ্রলোকেরা উপস্থিত আছেন। আমি আপনাদের আশ্রয় নিচ্ছি। আশা করি আপনারা দেখবেন যেন শ্যাটো রেনো আমার কোনো অপমান করতে না পারে।
শ্যাটো রেননা সামনে এগোতে গিয়েছিল আমরা সবাই এক সাথে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। শ্যাটো রেননা পিছিয়ে এলো। বলল, ঠিক আছে। ম্যাডাম আপনার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারেন। তবে কার সাথে আমাকে ফয়সালা করতে হবে, তা আমি জানি।
লুই দ্য ফ্রাঞ্চি যে মর্যাদার সাথে এই পরিস্থিতিতে সামনে এগোল, তা ভাষায় বোঝান যায় না–মঁসিয়ে যদি আমার প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে কাল সম্পূর্ণ দিন ৭নং রু দ্য হেয়ডারে আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকব।’
‘খুব ভালো কথা, তবে আমি নিজে যেতে পারব না। আমার বদলে আমার দুই বন্ধু আপনার সাথে দেখা করতে যাবেন।
‘কোনো মহিলার সামনে এ ব্যাপারে আলোচনা করা অবিবেচনার কাজ। লুই কাঁধ নাড়িয়ে বলে মহিলাটির দিকে ফিরে তার হাত ধরে তাকে বলল, চলুন ম্যাডাম, আমার উপর বিশ্বাস রেখে যে সম্মান আমাকে দিয়েছেন। তার জন্য আপনাকে আমার ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
ওরা দুজন চলে গেল। ঘর একদম নীরব।
‘বেশ তাহলে আমি হেরে গেলাম। চেয়ারে বসতে বসতে শ্যাটো রেনো বলল–পরশু ফ্রেয়ার্স হোটেলে নৈশ ভোজ খাব। সে তার গ্লাস বাড়িয়ে দিল, ‘ডি’ তা সম্পূর্ণ ভরে দিল শ্যাম্পেনে।
এরপরে আর কারও খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখা গেল না।