বেইলিফ দৃশ্যতই খুশিতে হাততালি দিল।
ওর মাথা ধরেছে। চলো, বসে পড়ো। টেবিলে আগে থেকে রাখা কয়েকটা বোতলের পাশে সেলারের বোতলগুলোও জায়গা করে নিল।
দুজনেই বেশ ক্ষুধার্ত। দ্রুতই খাবার শেষ হতে লাগল। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কথা হচ্ছে।
মাছটা ভাল, তাই না?
খুব!
আর ওয়াইনটাও বেশ।
চমৎকার।
খেতে খেতে নেপোষুশেন ম্যাগলোয়ার ইতিহাস জানা হয়ে গেল থিবল্টের।
অর্লিয়ন্সের ডিউক লুই-এর চার্চের আসবাবপত্র তৈরি করত ম্যাগলোয়ার বাবা। লুইয়ের ছেলের প্রধান রাধুনী ছিল ম্যাগলোয়া। ছোট থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ তার। রান্নায় দক্ষতার কারণে অভিজাতমহলে প্রবেশাধিকারও ছিল। পঞ্চান্ন বছর বয়সে কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ম্যাগলোয়া।
ডিউক তাকে ডেকে পাঠায়। জানতে চায় কী পরিমাণ সঞ্চয় করেতে পেরেছে ম্যাগলোয়া তার চাকরি করে। ওর সঞ্চয়ের পরিমাণ শুনে প্রিন্স অসম্ভষ্ট হয়, যে লোক তিরিশ বছর তাকে সেবা করেছে, তার এত কম সঞ্চয় থাকলে সেটা তাকে অপমানেরই নামান্তর। তাই ম্যাগলোয়াকে আরও অর্থ দেয় সে চলার জন্য এবং বেইলিফের পদটাও তার জন্য বরাদ্দ করে, যাতে করে একটা মোটা অংকের বাৎসরিক আয় হয় ম্যাগলোয়ার। তার উপর ডিউক ওর বাড়িও সাজিয়ে দেয় বিলাসবহুল ভাবে।
থিবল্ট আরও জানল, মাদাম ম্যাগলোয়া হচ্ছে মঁসিয়ে ম্যাগলোয়ার চতুর্থ স্ত্রী। বিয়ে করেছে স্ত্রীর রূপের জন্য। বয়স যতই হোক না কেন, স্ত্রী মারা গেলে আবার বিয়ে করতে মঁসিয়ে ম্যাগলোয়ার আপত্তি নেই।
এরপর ম্যাগলোয়া শুরু করল স্ত্রীর গুণকীর্তন। স্বামীর মদ খাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করা এবং জামাকাপড়ের প্রতি দুর্বলতা ছাড়া, পৃথিবীতে এমন কোন গুণ নেই, যা মাদামের নেই। একসময় ম্যাগলোলায়ার নিজের এবং স্ত্রীর গল্প বলা শেষ হলো। এবার সে আশা করল থিবল্ট ওর গল্প বলবে। সত্য গোপন করে থিবল্ট বলল যে ও একজন ধনী খামার মালিক। নিজের এলাকায় বিশাল বন রয়েছে ওর। বনে শিকার উপযোগী প্রচুর পশুও আছে। শুনে খুব খুশি হলো ম্যাগলোয়া। হরিণের মাংস খুব পছন্দ করে সে। নতুন বন্ধুর মারফত শিকার করা হরিণ খাওয়ার সুযোগ পাবে।
সাত-সাতটা বোতল শেষ করার পর থামার সিদ্ধান্ত নিল ওরা দুজনে।
থিবল্ট যখন বিদায় নিয়ে বেরোল তখন মাঝরাত। খোলা বাতাসে আসার সাথে সাথে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফল টের পেল ও। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, কোনমতে গিয়ে একটা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করল। এসময় মাথার ছয় কি আট ফুট উপরে একটা জানালা খোলার আওয়াজ পেল ও। মনে হয় ম্যাগলোয়া তার নতুন বন্ধুকে আরেকবার বিদায় জানাতে চাইছে। তারপর হঠাৎ করেই ওর ডান কাঁধে বাড়তি ওজন এসে পড়ল! এরপর বাম কাঁধে। ভারের চাপে ধীরে ধীরে বসে পড়তে বাধ্য হলো থিবল্ট। কেউ একজন ওকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানুষটা বলে উঠল, ঠিক আছে, লেভিলি! ঠিক আছে। উপরে জানালা বন্ধের শব্দ হলো।
দুটো জিনিস থিবল্ট বুঝতে পারল। এক, কেউ ওকে লেভিলি বলে ভুল করেছে। আর দুই, কোন প্রেমাস্পদ ওকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুটোই ওর কাছে অপমানজনক মনে হলো।
মাতালের মতো হাত বাড়িয়ে আগন্তুকের জামা চেপে ধরল ও। কী করছ, বুদ্বু? কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগল থিবল্টের কাছে, কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারল না ও, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় করছ?
অবশ্যই, আমি জানতে চাই কে আমাকে মই হিসেবে ব্যবহার করল?
তারমানে তুমি লেভিলি নও?
না।
যে-ই হও, তোমাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ! তোমার কী ধারণা ধন্যবাদ বললেই ব্যাপারটা চুকে যাবে?
সেরকমটাই আশা করছি।
ভুল আশা করেছ।
ছাড়ো আমাকে! মাতাল কোথাকার!
মাতাল! মাত্র সাত বোতল খেয়েছি আমরা। এরমধ্যে বেইলি নিজেই চার বোতল খেয়েছেন।
ছাড়ো বলছি আমাকে! ব্যাটা মদখোর কোথাকার!
মদখোর! তিন বোতল ওয়াইন খেয়েছি বলে আমাকে মদখোর বলছ?
তিন বোতল খাওয়ার জন্য বলিনি। তিন বোতলে মাতাল হওয়ার জন্য বলেছি। আবারও নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলল লোকটা, এই গর্দভ, তুই আমাকে ছাড়বি কি না বলু?
এমনিতেই লোকের মুখে গালমন্দ শোনা পছন্দ করে না থিবল্ট, আর এখন মাতাল অবস্থায় তো সহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না।
শয়তানের দিব্যি, তুমিই হচ্ছ আসল গর্দভ। আমাকে ব্যবহার করে আমাকেই অপমান করছ। তোমার নাক বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়া উচিত।
বলার সাথে সাথে চোয়াল বরাবর একটা ঘুষি খেল থিবল্ট। এই নে, একজন সৎ ইহুদীর মতো পাওনা চুকিয়ে দিতে জানি আমি! কাকে কী বলছিস বুঝে বলিস!
থিবল্টও জবাব দিল প্রতিপক্ষের বুক বরাবর ঘুষি হাঁকিয়ে। ফলাফল দেখে মনে হলো, একটা ছোট বাচ্চা আঙুল দিয়ে কোন ওক গাছে ধাক্কা মারার চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তে আগের চেয়েও জোরদার আরেকটা ঘুষি খেল থিবল্ট। প্রমাদ গুনল ও। এভাবে ঘুষির জোর বাড়তে থাকলে, ভূমিশয্যা নেবার বেশি বাকি নেই।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল থিবল্ট। হাতে একটা পাথর ঠেকতে সেটা তুলে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে শত্রুর মাথা বরাবর হাকাল ওটা। এবারে কাজ হলো! গোড়া-কাটা ওকের মতো সটান মাটিতে পড়ে গেল ওর প্রতিপক্ষ।
ঝেড়ে দৌড় দিল থিবল্ট। লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে দেখার জন্য পেছন ফিরে একবার তাকালও না।
দ্বাদশ অধ্যায় – ভেড়ার পালে নেকড়ে
বেইলিফের বাড়ি থেকে বন বেশি দূরে ছিল না। সেই বনে ঢুকতেই নেকড়ের দল লেজ নেড়ে খুশি প্রকাশ করে ঘিরে ধরল থিবন্টকে। দুয়েকটা কথা বলে, কাছের নেকড়েটাকে একটু আদর করে, পথ চলতে চলতে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল থিবল্ট।