কাপ্তেন বললো,–আচ্ছা, এবার তাহলে ওর পেট থেকে জলগুলো বের করবার ব্যবস্থা করো।
সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার জন লোক মিলে এডমন্ডের দেহটিকে উপুড় করে শুইয়ে তার হাত আর পা ধরে নানা-রকম প্রক্রিয়া শুরু করলো। কিছুক্ষণ ঐ ভাবে প্রক্রিয়া করবার পর এডমন্ডের পেট থেকে জল বের হয়ে গেল। কাপ্তেন তখন তাকে শুকনো পোশাক পরিয়ে গরম কাপড় দিয়ে সেঁকতে আদেশ দিলো। কিছুক্ষণ সেঁকবার পর চোখ মেলে চাইলো এডমন্ড।
সে চোখ মেলে তাকাতেই খানিকটা ব্র্যান্ডি খাইয়ে দেওয়া হলো তাকে।
ব্র্যান্ডি পেটে পড়তেই তার শরীরটা চাঙা হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে বললো–আমি কোথায়?
কাপ্তেন বললো–আমার জাহাজে।
–কোন দেশের জাহাজ এটা?
–ভয় নেই, আমরা তোমাকে ধরিয়ে দেব না! কিন্তু তুমি জেল থেকে পালালে কি করে?
–সে অনেক কথা। এখন বলতে পারবো না। একটু সুস্থ হলে সব কথাই বলবো আপনাকে। কিন্তু দোহাই আপনার, আমাকে ওদের হাতে ধরিয়ে দেবেন না যেন।
কাপ্তেন মৃদু হেসে বললো–না, সে ভয় নেই তোমার। তাছাড়া আমরাও খুব সাধু-সজ্জন নই। বোম্বেটে-জাহাজের নাম শুনেছ তো? এখানাও একখানা বোম্বেটে-জাহাজ।
এডমন্ড খুশি হলো এই কথা শুনে। খুশি হলো এই কারণে যে, বোম্বেটেরা তাকে নিশ্চয়ই ধরিয়ে দেবে না।
সে তখন উঠে বসবার চেষ্টা করতেই কাপ্তেন বললো– এখনই উঠে বসবার চেষ্টা করো না। আগে কিছু খেয়ে নাও, তারপরে উঠো।
কাপ্তেনের নির্দেশে তখনই এক প্লেট ডিম আর আলুসিদ্ধ এনে দেওয়া হলো তাকে।
দীর্ঘ চৌদ্দ বৎসর পরে ডিমসিদ্ধ মুখে দিল সে। কি ভালই যে লাগলো তার ঐ ডিম আর আলুসিদ্ধগুলি!
তাকে গোগ্রাসে গিলতে দেখে কাপ্তেন বললো–আর দেব?
এডমন্ড বললো–দিন।
কাপ্তেনের আদেশে আর এক প্লেট ডিমসিদ্ধ এনে দেওয়া হলো তাকে।
খাওয়ার পরে এডমন্ড বললো–আপনাদের জাহাজে কোন নাপিত আছে কি?
কাপ্তেন হেসে বললো–তা তো আছে, কিন্তু আমি ভাবছি তোমার এই জাদরেল চেহারাখানার একটা ছবি যদি রাখা যেত তাহলে বড় চমৎকার হত। এ রকম দেড় হাত লম্বা দাড়িওয়ালা মানুষ তো বড় একটা দেখা যায় না কি না!
হব্ব-জব্ব দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে এডমন্ড হেসে ফেললো এই কথা শুনে। হাসি থামলে সে বললো–আমার এই চেহারাখানা নিজেরই একবার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে যে!
কাপ্তেন বললো–বেশ তো। আমার ক্ষুর নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাও। ওখানে আয়না আছে। কামানোও হবে, চেহারাও দেখতে পাবে।
এই বলেই একজন লোককে সে আদেশ করলো–আমার ঘর থেকে কামাবার সরঞ্জামগুলো এনে দাও তো একে।
একটু বাদেই একখানা ক্ষুর আর একখানা কঁচি নিয়ে এসে লোকটা বললো–এসো আমার সঙ্গে, বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজের চেহারাখানা দেখেই ঘাবড়ে গেল এডমন্ড। একি সাংঘাতিক চেহারা রে বাবা!
এর পর কিছুক্ষণ আয়নায় সেই অপরূপ চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষুর দিয়ে দাড়ির গোছা চেঁছে ফেলে দিল সে। দাড়ি-গোঁফ কামানো হয়ে গেলে এডমন্ড আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো যে, তখনও তার চেহারায় যৌবনের দীপ্তি আছে।
এডমন্ড হিসাব করে দেখলো, তার বয়স তখন তেত্রিশ বছর। দাড়ি-গোঁফ কামানো হয়ে গেলে সে কঁচি দিয়ে মাথার চুলগুলোও ঘাড় পর্যন্ত হেঁটে ফেললো। এইভাবে চুল-দাড়ি কামানো হয়ে গেলে সে স্নান করতে বসলো। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে গা থেকে ময়লাগুলো যতদূর সম্ভব ঘষে তুলে সে (পাশাক পরে নিলো। পোশাক পরে আবার সে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। নাঃ! ভালই দেখাচ্ছে তাকে।
এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল যে হাত-পায়ের নখগুলো কাটা হয়নি। সে তখন কঁচি দিয়ে হাত-পায়ের নখগুলো কেটে ফেললো।
এর পর সে যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তাকে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। জাহাজের কাপ্তেন তার দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললো–বাঃ! তোমার চেহারাখানা তো বড় চমৎকার হে!
এই সময় হঠাৎ ফারিয়ার সেই কাগজ দুখানার কথা মনে পড়ে যায় এডমন্ডের। কাগজ দুখানা তার সেই কয়েদী জামার পকেটে ছিল।
ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে আমার জামা! আমার জামা কোথায় রেখেছেন?
নাবিকদের মধ্যে একজন হেসে বললো–তোমার সেই মহামূল্যবান জামাটার কথা বলছো তো? ভয় নেই, ও চীজ চুরি যাবে না। ঐ দেখ দড়িতে শুকোচ্ছে।
এডমন্ড ছুটে গেল সেই জামাটার কাছে! তারপর তার পকেটে হাত দিয়ে টেনে বের করলো সেই ভাঁজ-করা কাগজ দুখানা। বের করবার সময় সে নাবিকদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, উদ্দেশ্য–ওরা কেউ যাতে দেখতে না পায় জিনিসটা।
ভিজে একেবারে ন্যাতা হয়ে গিয়েছিল কাগজ দুখানা। এডমন্ড তাড়াতাড়ি কাগজ দুখানাকে পকেটে ফেলে জামাটাকে উল্টে দিতে লাগলো। এমন ভাব দেখালো যেন ঐ জামাটা শুকোতে দিতেই সে ওখানে গেছে।
সে ফিরে এলে কাপ্তেন বললো–ও জামাটির মায়া এবার (তামাকে ত্যাগ করতে হবে ভাই। ও চীজ তোমার কাছে দেখলেই পুলিশ তোমাকে ধরবে।
এডমন্ড বললো–ঠিকই বলেছেন। ওটাকে এখনই বিদেয়। করা উচিত। এই বলেই সে আবার এগিয়ে গেল সেই জামাটার কাছে। তারপর দড়ি থেকে জামাটা নামিয়ে নিয়ে ডেকের ধারে গিয়ে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটাকে।
১১-১৫. ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর
ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে বোম্বেটেদের “এমেলিয়া” জাহাজখানা। এডমন্ড ইতিমধ্যেই ভিড়ে গেছে তাদের দলে। তার জাহাজী-জ্ঞান ও জাহাজ চালাবার অভিজ্ঞতা দেখে বোম্বেটেরা খুশি হয়েছিল।