- বইয়ের নামঃ কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো
- লেখকের নামঃ আলেকজান্ডার ডুমা
- প্রকাশনাঃ দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রচনাবলী
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো
০১-৫. মার্সেঈ বন্দর
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো – আলেকজাণ্ডার ডুমা
অনুবাদ : হেমেন্দ্রকুমার রায়
পৃথিবীতে অনেক কিছু আশ্চর্য জিনিস দেখা যায় কিন্তু পিতা ও পুত্র দুজনেই বড় সাহিত্যিক হয়ে উঠেছেন এটা বড় একটা শোনা যায় না। এ ঘটনারও ব্যতিক্রম দেখা যায় আলেকজাণ্ডার ডুমার জীবনে। তাদের দুজনের নামও এক। এখানে বাবার কথাই বলব। তিনিই ‘কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর’ বিখ্যাত ফরাসী লেখক।
১৮০২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জুলাই এই লেখকের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের চার বৎসর পরেই দুর্ভাগ্যবশত তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। কাজেই অতিশয় দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়েই তার বাল্যজীবন কাটে। কিন্তু এই দুঃখ কষ্টের অনুভূতি তার বাল্যকালেই সাহিত্যরচনার অনুপ্রেরণা যোগায়। প্রথম জীবনে তিনি নাটক রচনা করতে শুরু করেন, পরে উপন্যাস রচনায় হাত দেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার যুগান্তকারী রচনা ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ প্রকাশিত হয়।
ডুমা তার জীবদ্দশাতেই অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। লোকে তার লেখা পড়বার জন্য ব্যগ্র উৎসুক হয়ে থাকত। তিনি একবার এক ভ্রমণ কাহিনী লেখার বায়না হিসাবে এক কাগজওয়ালার কাছ থেকে বিস্তর টাকা আগাম নেন। স্থির হল তিনি সিসিলি যাবেন বেড়াতে এবং সেখান থেকেই যেমন যেমন দেখবেন, তেমনি তেমনি লিখে পাঠাবেন। কথা ছিল তার সঙ্গে তার শিল্পী বন্ধু জাদিন যাবেন।
আর যাবে জাদিনের নিত্য সঙ্গী কুকুর। কিন্তু কোন কারণে সেই বন্ধুর যাওয়া হল না। ডুমাকে একাই রওনা হতে হল। ডুমা পড়লেন মহা বিপদে। তিনি কাগজওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নিতেন শব্দের সংখ্যা হিসাবে। যত বাড়িয়ে লিখতে পারবেন ততই তাঁর লাভ। ডুমা আর কি করবেন, শিল্পী বন্ধুকে ও তাঁর কুকুরকে কল্পনা করেই তিনি দিনের পর দিন মনগড়া ভ্রমণ কাহিনী লিখে পাঠাতে লাগলেন।
সেই কাহিনী খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু এদিকে শিল্পী বন্ধু জাদিন পড়লেন মহা বিপদে। কেউ তাকে আর জাদিন বলে স্বীকার করে না। কারণ সবাই জানে জাদিন ডুমার সাথে সিসিলিতে আছেন।
এমন শক্তিশালী ছিল আলেকজাণ্ডার ডুমার রচনা। কল্পনাকে তিনি বাস্তবের চেয়েও সত্য করে তুলতেন লেখনীর গুণে।
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজাণ্ডার ডুমার মহাজীবনের অবসান ঘটে।
০৬-১০. নিকষকালো আঁধার
নিকষকালো আঁধার-ঘেরা রাত্রি।
দুই দিকে দুইজন বন্দুকধারী সৈনিক এডমন্ডের হাত ধরে একখানা ঘোড়ার গাড়ির ভিতর টেনে তুললো। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো।
এডমন্ড গাড়ির জানালার দিকে তাকালো। প্রত্যেক জানালায় লোহার গরাদে। কয়েদীবাহী গাড়ি। এই গাড়িতে উঠেও কিন্তু এডমন্ডের মনে হলো যে মাসিয়ে ভিলেফোর্ট তাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবেন। মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট দয়ালু। তিনি তো স্পষ্টই বলেছেন, আমাকে কেবল কয়েকদিনের জন্য পুলিশের হেপাজতে থাকতে হবে।
সমুদ্রের ধারে এসে গাড়িখানা থামলো।
এডমন্ড উঁকি মেরে দেখলো, সামনেই রয়েছে একদল সৈনিক। একজন সৈনিক বন্দুক কাঁধে করে গাড়ির সামনে এগিয়ে এসে বন্দীকে নামিয়ে আনতে বললো।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে এডমন্ড অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো–এত সৈন্য কেন এখানে?
সৈন্যেরা তাকে নিয়ে একটা জেটির ধারে গিয়ে পঁড়ালো। সেখানে একখানা নৌকো বাঁধা ছিল। সেই নৌকোয় তোলা হলো এডমন্ডকে। নৌকো ছেড়ে দিল। সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় এডমন্ডের তপ্ত মাথা খানিকটা ঠাণ্ডা হলো। কৌতূহলী হয়ে একজন রক্ষীকে সে জিজ্ঞাসা করলো–আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
–একটু পরেই দেখতে পাবে।
–তবু…
–উপরওয়ালার নিষেধ, তোমার সঙ্গে আমরা কথা কইতে পারবো না।
এরপর কিছুক্ষণ আর কারো মুখে কোন কথা নেই। নৌকো এগিয়ে চলেছে ধীর গতিতে। একটা বাতিঘর দেখা গেল। সেটাকে পিছনে রেখে নৌকো চলতে লাগলো।
আবার কৌতূহল জাগলো। এডমন্ড আবার জিজ্ঞাসা করলো –এখনি যা জানতে পারব তা একটু আগে আমাকে জানালে এমন কি ক্ষতি হবে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
এডমন্ডের এই প্রশ্নের উত্তরে রক্ষীদের ভিতর থেকে একজন বলে উঠলো–শুনেছি তুমি নাবিক। মার্সেঈ-এ থাকো। এখনো কি তুমি বুঝতে পারছ না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোমাকে?
–না।
–সে কি! তুমি কি অন্ধ নাকি? ভালো করে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি।
মিটমিটে তারকাকিরণে রহস্যময় নিশ্চন্দ্র আকাশ! খুব কাছেই অন্ধকারের মধ্যে সাগর-দানবের মত মাথা উঁচু করে পঁড়িয়ে একটা পর্বত-দুর্গ। স্যাতো-দ্য-ইফ। দুৰ্গটাকে এখন কারাগারে পরিবর্তিত করা হয়েছে। এডমন্ড জানতো যে ঐ কারাগারে যাদের রাখা হয়, তারা আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। বহু হতভাগ্যের বন্দী-জীবনের অবসান ঘটেছে ঐ কুখ্যাত কারাগারে।
মনে মনে শিউরে উঠে এডমন্ড বললো–স্যাতো-দ্য-ইফ! ওখানে আমায় নিয়ে যাচ্ছো কেন? আমি তো কোন অপরাধ করিনি।
রক্ষীরা মুখ টিপে হাসলো।
–এখানে কি আমার বিচার হবে? এখানে কি কোন বিচারক আছেন?
–না। এখানে আছে শুধু কারাধ্যক্ষ, প্রহরী ও তোমার মত কয়েদীর দল–আর আছে খুব চওড়া পাথরের প্রাচীর।
–আমাকে কি এখানে বন্দী করে রাখা হবে?
–তাই তো মনে হয়।
–সে কি কথা! আমাকে যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট আশা দিলেন…
–কে তোমাকে কি আশা দিয়েছে তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন নেমে পড় দেখি। নৌকো ঘাটে এসেছে!
অন্ধকারের ভিতর থেকে কয়েকটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো নৌকোর দিকে! তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলো– বন্দী কোথায়?
রক্ষীরা বললো–এই যে!
–ওকে নিয়ে এসো!
যন্ত্রচালিতের মত প্রহরীবেষ্টিত হয়ে এডমন্ড চলতে লাগলো কারাগারের দিকে। কিছুক্ষণ চলবার পর সেই লোকটা বললো–দাঁড়াও!
এডমন্ড সভয়ে লক্ষ্য করলো, তার সামনেই কারাগারের বিরাট লৌহকপাট।
সেই লোকটির আদেশে লৌহকপাট খুলে গেল। এডমন্ডকে ঠেলে ভিতর ঢুকিয়ে দিতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল সেই বিরাট কপাট। যেন একটা ভয়ংকর দানব গিলে ফেললো একটা ছোট্ট মানুষকে।
এডমন্ডের মাথাটা ঘুরে উঠলো।
তার মনে পড়লো বৃদ্ধ পিতার কথা–মার্সেদেসের কথা– বাড়ির কথা–মুক্ত আলো-হাওয়ার কথা।
দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার দুই গাল বেয়ে।
হঠাৎ একজন কারারক্ষী কর্কশস্বরে বলে উঠলো–এই কয়েদী! এগিয়ে আয়!
কয়েদী!
বিচার না হতেই কয়েদী হয়ে গেল সে! হায় ভগবান!
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বন্দী আদেশ পালন করছে না দেখে কারারক্ষী তাকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে চললো ভিতর দিকে। কিছুক্ষণ চলবার পর একটা ঘরের সামনে এনে পঁড় করানো হলো তাকে। কারারক্ষী তখন সেই ঘরের দরজা খুলে তাকে এক ধাক্কায় সেই ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করতে করতে বললো–এই তোর ঘর। আজ চললাম। কাল আবার দেখা হবে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
.
পরদিন সকালে কারারক্ষী এসে দরজা খুলে দেখে, কাল। রাত্রে এডমন্ড যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এখনও ঠিক সেইখানেই সে দাঁড়িয়ে আছে। এক রাত্রেই তার চেহারা হয়েছে পাগলের মত, চোখ দুটি হয়েছে লাল টকটকে জবাফুলের মত।
রক্ষী তার কাঁধের উপরে একখানা হাত রেখে সহানুভূতির স্বরে বললো–রাত্রে ঘুমোওনি নাকি?
–জানি না।
–তোমার ক্ষিদে পেয়েছে?
–জানি না।
–তুমি কি চাও?
–গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে।
–অসম্ভব।
–কেন?
–তা নিষিদ্ধ।
–তবে কি নিষিদ্ধ নয়?
–খেতে পারো, শুতে পারো, ঘুমুতে পারো।
–আমি খেতে, শুতে, ঘুমোতে চাই না। অনাহারে মারা যেতে চাই।
–অবুঝ হয়ো না। অপেক্ষা কর। হয়তো গভর্নরের সঙ্গে একদিন তোমার দেখা হয়ে যেতে পারে।
–কতদিন পরে?
–হয়তো এক মাস, হয়তো ছয় মাস, হয়তো বা এক বৎসর।
–অতকাল অপেক্ষা করতে পারব না। আমি তার সঙ্গে এখনই দেখা করতে চাই।
–বার বার এক কথা নিয়ে অত মাথা ঘামিও না। তাহলে হয়তো পাগল হয়ে যাবে।
–পাগল হয়ে যাবো?
–হ্যাঁ। এখানে ওরকম ব্যাপার এর আগেও হয়েছে। তুমি এখন যেখানে আছ, এই ঘরেই একটা লোক পাগল হয়ে গিয়েছিলো।
–পাগল হয়ে গিয়েছিলো! বলছো কি?
–ঠিকই বলছি। পাগল হবার পর লোকটার ধারণা হয়, সে নাকি অনেক টাকার মালিক। সে বলতো তাকে ছেড়ে দিলে গভর্নরকে সে লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবে।
–কতদিন আগে সে এখানে ছিলো?
–তা প্রায় দু’বছর হবে।
–এখন সে কোথায়?
–মাটির নিচের অন্ধ-কোঠায়।
–কী ভয়ানক! মাটির নিচের ঘরে মানুষ থাকতে পারে?
–পারে কিনা নিজেই বুঝতে পারবে।
–তার মানে?
–মানে, তোমাকেও শীগগিরিই সেখানে চালান করা হবে। এডমন্ড শিউরে উঠলো এই কথা শুনে।
***
মাটির নিচের অন্ধ-কোঠা।
আলো নেই, হাওয়া নেই, কেবল আছে অন্ধকার। এই নিরন্ধ্র অন্ধকারে আর ভয়াবহ নির্জনতাকে সঙ্গী করে দিন কাটাচ্ছে এডমন্ড।
দিনে একবার আর রাতে একবার রক্ষী তার খাবার দিয়ে যায়। এডমন্ড চেয়ে চেয়ে দেখে তার আসা-যাওয়া। মুক্ত সে। ইচ্ছা করলে বাইরের মুক্ত বাতাসের স্পর্শ সে পেতে পারে– কিন্তু এডমন্ড বন্দী, অসহায়। পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে জোর করে বঞ্চিত করা হয়েছে–বিনা অপরাধে।
রক্ষীটির সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে এডমন্ড। কিন্তু লোকটা যেন বোবা।
কোন কথাই বলে না,–উত্তর দেয় না তার কোন প্রশ্নেরই।
এইভাবে কত দিন, কত মাস, কত বৎসর যে কেটে গেছে সে জানে না। কালের মাপকাঠি সে হারিয়ে ফেলেছে।
সে যখন জেলখানায় ঢুকেছিল তখন তার মুখে সবে মাত্র। দাড়ি গজাতে আরম্ভ করেছে, আর এখন তার মুখে ছয় ইঞ্চি লম্বা দাড়ি। তার চুলও বেড়ে গিয়ে পিঠের নিচে পড়েছে।
প্রথম প্রথম সে বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখতো, কিন্তু এখন আর তার মনে আশা নেই।
মানুষের সমাজ থেকে টেনে এনে অমানুষ করে রাখা হয়েছে তাকে।
.
৭.
চুপ করে শুয়েছিল এডমন্ড। ঘুম তার চোখে ছিল না। তবুও সে চেষ্টা করলো ঘুমোতে। জেগে থাকলেই রাজ্যের চিন্তা এসে তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ভূগর্ভের কত নিচে যে সে আছে তা সে জানে না। মাটির নিচের ভয়াবহ নীরবতা প্রথম প্রথম অসহনীয় মনে হলেও ক্রমে সহ্য হয়ে আসছে। বাইরের কোন শব্দই তার কানে আসে না। সেই অখণ্ড নির্জনতায় মাঝে মাঝে নিজের কণ্ঠস্বর শুনলেও সে চমকে ওঠে। ঘরের মধ্যে চলে বেড়াবার সময় নিজের পায়ের শব্দও স্পষ্টভাবে শুনতে পায় সে।
হঠাৎ তার তন্দ্রা টুটে গেল। তার মনে হলো কোথায় যেন ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। অতি ক্ষীণ আওয়াজ। ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। দেয়ালে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো শব্দটা।
ঠুকঠুকঠুক ঠুক! কে যেন দেয়ালের গায়ে কোন শক্ত জিনিস দিয়ে আঘাত করছে। কিসের এ শব্দ? কোথা থেকে আসছে এই অদ্ভুত আওয়াজ?
এডমন্ড বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঐ শব্দ যে কি তা সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারে না। খানিকক্ষণ পরে শব্দটা আবার থেমে গেল।
পরদিন আবার সেই শব্দ।
তার পরদিন, আবার তার পরদিনও! এডমন্ড লক্ষ্য করলো, রক্ষী যখন বন্দীদের খাবার নিয়ে আসে শব্দটা থেমে যায় তার কিছুক্ষণ আগেই। তারপর আবার আরম্ভ হয় সে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই। এর অর্থ কি? এডমন্ড আরও লক্ষ্য করে যে, শব্দটা যেন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে দিনের পর দিন। আশ্চর্য হয়ে সে ভাবে–এটা তাহলে ভৌতিক ব্যাপার নাকি?
সেদিনও রোজকার মত শুয়ে ছিল এডমন্ড। মাথার ভিতর তখন তার অনেক চিন্তা।
মুক্তি কি পাব না কোনদিনই? বাবা এখন কি করছেন? তিনি কি বেঁচে আছেন এখনও? মার্সেদেস কি অন্য কাউকে বিয়ে… কিন্তু একি! দেয়ালের পাথরখানা সরে আসছে না! তাই তো!
ধড়মড় করে উঠে বসে এডমন্ড! সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে, দেয়াল থেকে একখানা বড় পাথরের স্ল্যাব আগা হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।
এডমন্ডের মনে হয় ওদিক থেকে কে যেন পাথরখানাকে ঠেলে দিচ্ছে। সে তখন লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে পাথরখানাকে ধরে টানতে লাগলো। কিছুক্ষণের চেষ্টায় পাথরখানা সম্পূর্ণভাবে ঘরের ভিতরে এসে পড়তেই এডমন্ড অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে সেই পাথরের পিছনে একটা সুড়ঙ্গ-পথের মুখে এক অদ্ভুত মূর্তি।
মুর্তিটি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। এডমন্ড দেখলে যে লোকটার দাড়ি কোমরের নিচে পর্যন্ত নেমেছে, মাথায় সাদা চুলে জট পাকিয়ে গেছে। পরনে কয়েদীর পোশাক। সেই লোকটাই কথা বললো প্রথমে। হতাশ স্বরে সে বললো–হ্যায় ভগবান! আমার এতদিনের সব চেষ্টা আজ বিফল হয়ে গেল।
এডমন্ড বললো–কে আপনি? কি বিফল হয়ে গেল?
লোকটা বললো–বিফল হলো আমার দীর্ঘ চার বছরের অমানুষিক চেষ্টা। আমি চেয়েছিলাম আমার ঘর থেকে সুড়ঙ্গ-পথ তৈরি করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বেরুবো। কিন্তু আজ দেখছি দিক ভুল করে উল্টো পথে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছি। আমি।
–আপনি কে দয়া করে বলবেন কি?
লোকটা হেসে বললো–তা জেনে তোমার কি সুবিধা হবে? আমিও তোমারই মত একজন বন্দী। তবে এককালে লোকে আমাকে ফারিয়া বলে ডাকতো।
–ফারিয়া! আপনিই সেই মহাজ্ঞানী অধ্যাপক ও ধর্মযাজক ফারিয়া?
–হ্যাঁ বিগত জীবনে তাই ছিলাম বটে, তবে বর্তমানে আমি একটি নম্বরে পরিণত হয়েছি। আমার নাম এখন ‘তেইশ নম্বর’। অবশ্য আরও একটি নতুন উপাধি আমি পেয়েছি, সেটি হচ্ছে ‘পাগলা’। যাই হোক আমার কথা পরে শুনলেও চলবে। এবার তোমার পরিচয়টা বল দেখি! নাম কি তোমার?
–আমার নাম এডমন্ড দান্তে! আমি ফারাওঁ জাহাজের দ্বিতীয় কর্মচারী ছিলাম।
–তোমার বয়স কত?
–জানি না। কারাগারে বন্ধ থেকে আমি বৎসর আর কালের মাপ হারিয়ে ফেলেছি। কেবল এইটুকু মনে আছে, ১৮১৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল উনিশ বৎসর।
ফারিয়া তখন মনে মনে কিছুক্ষণ হিসাব করে বললেন– তাহলে তোমার বয়স এখন ছাব্বিশ বৎসর।
–বলেন কি! সাত বছর আমি এখানে আছি!
–হ্যাঁ তাই। যাই হোক, কি অপরাধে তুমি বন্দী হয়েছ?
–বিনা অপরাধে। শুনবেন আমার জীবনের কাহিনী?
ফারিয়া বললেন–শুনবো বৈকি, এসো তোমার বিছানায় বসে তোমার সব কথা শুনি।
***
এডমন্ডের মুখে তার বিড়ম্বিত জীবনের সব কথা শুনে ফারিয়া বললেন তোমাদের কাপ্তেন যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে এ দ্বীপে যাবার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছিলেন, তখন সেখানে আর কোন লোক ছিল না?
–না, কামরার ভিতরে আমি আর কাপ্তেন ছাড়া আর কোন লোক ছিল না।
এই কথা বলে একটু চিন্তা করে এডমন্ড আবার বললো– তবে হ্যাঁ, ড্যাংলারকে কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম যেন।
–তাহলে জেনে রাখো, ঐ ড্যাংলারের চক্রান্তেই আজ তুমি এই কারাগারে।
–অসম্ভব! ড্যাংলার আমার বন্ধু।
–দুষ্ট লোকে বন্ধুত্ব মানে না। তোমার পদোন্নতি তার সহ্য হয়নি। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস তার দলে ফার্নান্দও ছিল।
–ফার্নান্দ! সে কেন শত্রুতা করবে আমার সঙ্গে? আমি তো তার কোন অপকারই করিনি!
এডমন্ডের এই কথায় ফারিয়া হেসে বললেন–তুমি দেখছি এখনও ছেলেমানুষ। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে পারছ না যে মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে।
–এই তুচ্ছ কারণে আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে তারা, এই কথা আপনি বলছেন?
–বলছি বৈকি! তা ছাড়া আরও একটা কথা জেনে রাখো যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্টও তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
–না না, তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি। আমার বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণ সেই চিঠিখানা আমার সামনেই তিনি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।
ফারিয়া বললেন–হ্যাঁ, তা ফেলেছিল বটে, তবে সেটা (তামাকে বাঁচাবার জন্য নয়। নিজের বাবাকে রাজরোষ থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যেই সেই চিঠিখানা সে পুড়িয়ে ফেলেছিল। তুমি হয়তো শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবে যে মঁসিয়ে নয়ের্তিয়ার হচ্ছেন তোমার ঐ সজ্জন ভিলেফোর্টের বাবা।
–আঁ! কি বলছেন আপনি?
–ঠিকই বলছি। তাকে আমি খুব ভাল ভাবেই চিনি। তিনি যে সম্রাট নেপোলিয়ানের দলের লোক তাও আমি জানি। মার্শাল বাট্রান্ডের সেই চিঠিখানার কথা ফাঁস হয়ে গেলে কেবল যে নয়েতিয়ারেরই বিপদ হত, তাই নয়, ভিলেফোর্টকেও হারাতে হত সরকারি চাকরির উচ্চাসন। এডমন্ড স্তম্ভিত হয়ে গেল এই কথা শুনে।
ফারিয়া তখন সস্নেহে তার মাথার উপর একখানি হাত রেখে বললেন–মানুষের হৃদয়হীনতা দেখে বিচলিত হয়ো না। আমিও তোমারই মত বিনা অপরাধে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি। একসময় লোকে আমাকে ভক্তি করতে, পণ্ডিত বলে শ্রদ্ধা করতো, কিন্তু মানুষের অমানুষিকতা আজ আমাকে ঠেলে দিয়েছে কারাগারের অন্ধকারে। পৃথিবীর আলো-হাওয়া আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে কয়েকজন স্বার্থপর জীবের –যারা মানুষ বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের ষড়যন্ত্রে। এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে ফারিয়া আবার বলতে আরম্ভ করলেন–কিন্তু তবুও আমি দুঃখ করি না। অভিযোগ জানাই না কারো কাছে। হয়তো এই শাস্তি আমার পাওনা ছিল। হয়তো এই অন্ধকার কারাকক্ষেই আমার সমাধি রচিত হবে। এই বোধ হয় ভগবানের ইচ্ছা। ভগবানের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
এই বলে একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন–আমি চেয়েছিলাম এই কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে। দীর্ঘকাল– দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর অমানুষিক পরিশ্রম করে আমি সুড়ঙ্গ তৈরি করে চলেছিলাম। আশা করেছিলাম, এই সুড়ঙ্গ-পথের শেষে দেখতে পাবো মুক্ত সমুদ্র। কিন্তু আমার সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তোমার এই ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমি ভুল পথে এসেছি। যাই হোক, ওসব কথা ভেবে আর লাভ কি? আমি আজ শত দুঃখ আর হতাশার মধ্যেও খুশি হয়েছি তোমাকে পেয়ে। তুমি আমার ছেলের বয়সী। আজ থেকে নিজের ছেলের মতই আমি তোমাকে দেখবো। বিদ্বান বলে আমার কিঞ্চিৎ খ্যাতি ছিল। আমি গ্রীক, ইটালিয়ান, ফরাসী, জার্মান, ইংরেজি আর (স্পনীয় ভাষা জানি। সেই সব ভাষায় তোমাকে আমি শিক্ষিত করে তুলবো।
এডমন্ড বললো–কারাগারের অন্ধকারেই যার জীবন শেষ হবে, শিক্ষিত হয়ে তার লাভ?
–তুমি দেখছি একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছো! হাল ছাড়তে নেই। তুমি যুবক। এখনও তোমার সামনে পড়ে আছে সুদীর্ঘ জীবন। হয়তো তুমি আবার অর্জন করবে অবাধ স্বাধীনতা; আবার দেখতে পাবে মুক্ত আকাশের নীলিমা–অনুভব করবে অনাহত বাতাসের স্নিগ্ধ স্পর্শ।
এডমন্ড নতজানু হয়ে ফারিয়ার পায়ের কাছে বসে পড়ে বললো–আজ থেকে আমি আপনার আদেশমতই চলবো! তারপর থেকেই শুরু হলো দুই বন্দীর অধ্যয়ন আর অধ্যাপনা। দেখতে দেখতে নানা ভাষায়, নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠলো এডমন্ড–মহাজ্ঞানী অধ্যাপক ফারিয়ার অধ্যাপনার কল্যাণে।
সকাল থেকে দুপুরের খাবার আসবার আগে পর্যন্ত আর দুপুরের পর থেকে রাত্রের খাবার আসবার আগে পর্যন্ত সময়টা এডমন্ড কাটাতো ফারিয়ার কক্ষে। রক্ষীরা ওদের তৈরি সেই সুড়ঙ্গ-পথের সন্ধান জানতো না। এমন সুকৌশলে সুড়ঙ্গের মুখে পাথর চাপা দিয়ে রাখতো ওরা, যার ফলে বাইরে থেকে কারো বুঝবার সাধ্য ছিল না যে, দেয়ালের গায়ে সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে।
.
৮.
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন অধ্যাপক ফারিয়া। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরের আহার শেষ করে এডমন্ড তাঁর ঘরে এসেছিল। এই সময়টা ফারিয়া তার চৌকির উপর বসে থাকতেন রোজই, কিন্তু সেদিন তাকে শুয়ে থাকতে দেখে এডমন্ড বিস্মিত হলো।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো–আপনার কি কোন অসুখ করেছে?
ফারিয়া কোন উত্তর দিলেন না এডমন্ডের প্রশ্নের। এডমন্ড বুঝতে পারলো যে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সে তখন তার শিয়রের কাছে বসে গায়ে মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলাতে লাগলো। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালো সে–ভগবান, এই মহাপ্রাণ মানুষটিকে তুমি ভাল করে দাও।
কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে চাইলেন ফারিয়া। তিনি উঠে বসবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ডান হাতখানা তুলতে চেষ্টা করলেন, তাও পারলেন না।
নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন–আজ থেকে আর আমি উঠে দাঁড়াতে পারবো না। পক্ষাঘাতে শরীরের ডান দিকটা অসাড় হয়ে গেছে আমার।
এই নিদারুণ সংবাদ শুনে এডমন্ডের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।
ফারিয়া বললেন–মনে দুঃখ করো না এডমন্ড। আমার যে এরকম হবে তা আমি আগেই জানতাম। এর আগেও আর একবার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি। আমি এও জানি যে, এই রোগেই আমার মৃত্যু হবে। এ রোগের তৃতীয়বার আক্রমণেই আমি মারা যাবো।
এডমন্ড বললো–অমন কথা বলবেন না গুরুদেব! আপনাকে হারাতে হবে এ কথা ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
–কিন্তু সত্য যা তাকে তো অস্বীকার করা যায় না এডমন্ড! আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তাই যাবার আগে তোমাকে আমি কিছু দিয়ে যেতে চাই।
–ওসব কথা এখন থাক গুরুদেব। আপনি এখন ভয়ানক দুর্বল। এ অবস্থায় বেশি কথা বলা ঠিক নয় আপনার।
–না না এডমন্ড, আমাকে তুমি বাধা দিও না। আজ না বললে হয়তো আর কোন দিন বলাই হবে না সে কথা। এতদিন যা আমি নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছি, সে কথা আজ আমি বলবো।
–কি কথা গুরুদেব?
–তোমাকে আমি বিপুল গুপ্তধনের সন্ধান দেব।
–গুপ্তধন!
–হ্যাঁ, গুপ্তধন। যার পরিমাণ যে কোন রাজার ঐশ্বর্যের চাইতে বেশি। ঐ অতুল ঐশ্বর্যরাশির মালিক আমিই হতাম, কিন্তু তার আগেই আমার হলো যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ।
এডমন্ডের মনে হলো, রোগের আক্রমণে হয়তো ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
ফারিয়া তার মনের ভাব অনুমান করে ম্লান হাসি হেসে বললেন–আমার কথায় সন্দেহ করো না এডমন্ডা মাথা আমার ঠিকই আছে। এখন মন দিয়ে শোনো আমার কথাগুলো।
এডমন্ড বললো–বলুন!
ফারিয়া বলতে আরম্ভ করলেন–আমি যে কাউন্ট স্পাডার সেক্রেটারি ছিলাম সে কথা তোমাকে আগেই বলেছি। এই স্পাডা বংশ একসময় ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বলে পরিচিত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রোমের কুখ্যাত পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দার আর দুরাত্মা সিজার বোর্জিয়া, কার্ডিনাল স্পাডাকে হত্যা করে তাঁর অতুল ঐশ্বর্য হস্তগত করবার জন্য গোপনে এক ষড়যন্ত্র করে। তাদের যড়যন্দ্রের কথা জানতে পেরে কার্ডিনাল স্পাডা তার যাবতীয় ধনসম্পত্তি কোন এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে আসেন। তার ইচ্ছা ছিল যে, ঐ গুপ্তধনের সন্ধান তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীকে জানাবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তিনি পান না। দুরাত্মা সিজার বোর্জিয়া তাকে রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে হত্যা করে। এডমন্ড বললো–তারপর?
–তারপর বোর্জিয়া পাড়া প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে। কিন্তু প্রাসাদে সামান্য কয়েক লক্ষ টাকা আর কিছু আসবাবপত্র ছাড়া বিশেষ কিছু পায় না সে। তারপর থেকেই স্পাডা পরিবার ‘অতুল ধনশালী” এই প্রবাদ নিয়েই ক্রমে ক্রমে দরিদ্র হয়ে পড়ে। এই পরিবারের সর্বশেষ উত্তরাধিকারীই ছিলেন কাউন্ট পাড়া। কাউট স্পাডার সম্পত্তির মধ্যে ছিল তার পৈতৃক প্রাসাদটি, কয়েকখানা প্রাচীন বই, কয়েক বান্ডিল দলিলপত্র আর রোমান ক্যাথলিক চার্চ সংক্রান্ত একখানি অতি প্রাচীন পুঁথি। ঐ পুঁথিখানিকে ভাড়া পরিবার অতি পবিত্র বলে মনে করতেন। পূর্বপুরুষদের নির্দেশ ছিল যে ঐ পবিত্র পুঁথিখানি পরিবারের কর্তা তার মৃত্যুর পুর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীর হাতে দিয়ে যাবেন।
–আমি যাঁর সেক্রেটারি ছিলাম, তিনিই ঐ গ্রন্থখানি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রেই। স্পাডা পরিবারের ঐশ্বর্যের প্রবাদ তিনিও জানতেন, তাই আমাকে তিনি আদেশ করেছিলেন প্রাসাদের প্রত্যেকটি জায়গা খুঁজে দেখতে এবং প্রত্যেকখানা দলিল পড়ে দেখতে।
মাসের পর মাস আমি স্পাডা পরিবারের পুরনো দলিলগুলো পড়ে দেখতে থাকি। কিন্তু কোথাও ধনরত্ন সম্বন্ধে কোনরকম উল্লেখ পাই না। শুনেছিলাম যে, আমার আগে স্পাডা বংশের কুড়িজন পূর্বপুরুষ আর তাদের কুড়িজন সেক্রেটারি আমারই মত পণ্ডশ্রম করে গেছেন।
এডমন্ড বললো–তারপর?
–তারপর আমার পূর্ববর্তীদের মত হতাশ হয়ে আমিও পুরনো কাগজ ঘাঁটার পণ্ডশ্রম বন্ধ করলাম। এর কিছুদিন পরেই কাউন্ট স্পডা হঠাৎ মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তিনি আমার হাতে স্পাডা পরিবারের শেষ সম্বল সেই জীর্ণ পুঁথিখানি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি, যা তখনও অবশিষ্ট ছিল, তুলে দিয়ে বললেন–আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মহিমান্বিত স্পাডা বংশ। তাই আমি আমাদের বংশের এই শেষ সম্পত্তি আপনার হাতেই তুলে দিয়ে গেলাম। আপনাকেই আমি করে গেলাম আমার উত্তরাধিকারী। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, কাউন্ট পাড়ার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না।
এডমন্ড বললো–তারপর?
–কাউন্টের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই আমি খবর পাই যে, আমাকে নাকি রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হবে। খবরটা পেয়ে আমার মনের অবস্থা যে খুব ভাল থাকতে পারে না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। ঐ রকম মানসিক অবস্থায় এক রাত্রে কি মনে করে আমি স্পাডা পরিবারের সেই পবিত্র পুঁথিখানি পড়তে আরম্ভ করি। পড়তে পড়তে হঠাৎ একখানা ভাজকরা কাগজ আমি দেখতে পাই তার মধ্যে। কাগজখানার ভাজ খুলে লক্ষ্য করলাম যে, তাতে কিছুই লেখা নেই। বাজে কাগজ মনে করে আমি সেখানাকে মোমবাতির শিষের উপর ধরি পুড়িয়ে ফেলবার উদ্দেশ্যে। আগুনের তাপ লাগতেই কাগজখানার উপর কতকগুলো অক্ষর ফুটে উঠে। আমি তখন তাড়াতাড়ি আগুন নিবিয়ে সেই লেখাগুলো পড়তে আরম্ভ করি। কিছুটা পড়েই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। ঐ কাগজখানাতেই লেখা ছিল স্পাডা বংশের সেই গুপ্তধনের সন্ধান।
এতক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলে হাঁফিয়ে উঠলেন ফারিয়া। এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–একটু জল! এডমন্ড তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে রাখা জলের কলসী থেকে একটি গ্লাসে জল গড়িয়ে এনে ফারিয়ার মুখের কাছে ধরলো।
ফারিয়া এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু জল পান করে ধীরে ধীরে বললেন–আমার বিছানার নিচে শিয়রের দিকে দুখানা ভাজকরা কাগজ আছে। কাগজ দুখানা বের করে আনো (তা!
এডমন্ড কাগজ দুখানা বের করে আনলে তিনি আবার বললেন–ওর মধ্যে সেই পোড়া কাগজখানা আর আমার হাতে লেখা একখানা নকল দেখতে পাবে তুমি। এইবার ঐ পোড়া কাগজখানা পড়ে, তাহলেই বুঝতে পারবে আমার কথা সত্যি কিনা।
এডমন্ড তখন সেই পোড়া কাগজখানার ভাজ খুলে ফেললো।
কাগজখানার কিছুটা অংশ মাত্র পুড়ে গিয়েছিল। যে অংশটুকু আস্ত ছিল, তাতে লেখা ছিল–
“পরস্বাপহারী ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্য আমাদের বংশের পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত দুই কোটি রোমান ক্রাউনের* চাইতেও বেশি মূল্যের ধনসম্পত্তি মন্টিক্রিস্টো দ্বীপে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এই ধনরত্ন যাতে স্পাডা বংশের বৈধ উত্তরাধিকারী ছাড়া অন্যের হাতে না পড়ে, এই উদ্দেশ্যে তার সন্ধান আমি এই পুঁথির মধ্যে রেখে যাচ্ছি।
পশ্চিম সমুদ্রতীর ঘেঁষে যে পাহাড়টা দায়ের মতো ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই পাহাড়ের নিচে দেখতে পাবে একটা ছোট পাহাড়ে নদী। ঐ নদীর উৎস-বরাবর এগিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের ভিতরে। যাবার পথে পাহাড়ের চুড়াগুলো গুনতি করে যাবে। কুড়ি নম্বর চুড়ার সামনে এসে একটু দক্ষিণ দিকে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে একটি গুহা। গুহার মুখটি পাথর চাপা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছি। ঐ পাথরখানা সরিয়ে ফেলে গুহার মধ্যে ঢুকলেই পাওয়া যাবে সেই ধনরত্নের সন্ধান।”
কাগজখানা পড়া হয়ে গেলে এডমন্ড বিস্মিত হয়ে ফারিয়ার দিকে তাকালো। ফারিয়া বললেন–আজ থেকে এই কাগজ তোমার। তোমাকেই আমি দান করলাম স্পাডা বংশের ঐ বিপুল ধনরাশি।
এডমন্ডের মাথা ঘুরতে লাগলো কাগজ দু’খানা হাতে পেয়ে।
——–
* দুই কোটি রোমান ক্রাউনের দাম স্টার্লিং-এর হিসাবে তের কোটি পাউন্ডের কাছাকাছি আর আমাদের দেশের টাকার হিসাবে একশ বিরাশি কোটি টাকার সমান।
.
৯.
এরপর থেকেই ফারিয়ার যাবতীয় ভার এসে পড়লো এডমন্ডের উপরে। বৃদ্ধের ডান হাত আর ডান পা অবশ হয়ে যাওয়ায় এডমন্ডই তাকে খাইয়ে দিতো রোজ এসে।
প্রহরী খাবার রেখে চলে যেতেই এডমন্ড সেই সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে ফারিয়ার ঘরে ঢুকতো। তারপর তাকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরতো খাবার জন্য।
কিছুদিন এইভাবে কাটবার পর আবার সেই মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন ফারিয়া। এবারকার আক্রমণ থেকে তিনি আর আত্মরক্ষা করতে পারলেন না। এডমন্ডের কোলে মাথা রেখে কারাগারের অন্ধকার গর্ভে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পৃথিবীর একজন মহাজ্ঞানী মানুষ।
.
বৃদ্ধের মৃত্যুতে এডমন্ড ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগলো। দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ে বুক ভেসে যেতে লাগলো তার।
এদিকে তখন প্রহরীর খাবার নিয়ে আসবার সময় হয়ে গিয়েছিল। ওখানে বসে থাকলে ধরা পড়তে হবে, আর ধরা পড়লে সুড়ঙ্গের কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে এই ভয়ে এডমন্ড তাড়াতাড়ি বৃদ্ধের মৃতদেহের উপরে কম্বল চাপা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে নিজের ঘরে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পরে।
এডমন্ড নিজের বিছানায় আপাদমস্তক কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে বৃদ্ধের কথাই চিন্তা করছিল, এই সময় খাবার নিয়ে প্রহরী ঘরে ঢুকলো।
এডমন্ডকে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে বললো– কি হে! ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?
এডমন্ড বললো–না। শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, তাই একটু শুয়ে আছি।
–শরীর খারাপ লাগছে! তাহলে তুমিও আবার ঐ পাগলা বুড়োটার মতো কেঁসে যাবে নাকি?
–কি বললে?
–ও, জানো না বুঝি? সেই যে পাগলা বুড়োটার কথা বলেছিলাম না! সেই বুড়োটা আজ মারা গেছে।
–কবর দেওয়া হয়েছে কি?
–কবর? হেসে উঠলো প্রহরী। বললো–এখানকার কোন কয়েদী মরলে আবার কবর দেওয়া হয় নাকি?
–কি করা হয় তাহলে?
–বস্তায় বন্ধ করে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়। একেবারে যাকে বলে সলিল সমাধি–হেঁ-হেঁ-হেঁ।
–কখন ফেলা হবে?
–রাত্রে।
এডমন্ড আর কোন কথা বললো না।
প্রহরী তখন তার খাবার নামিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
সেদিন আর খেতে ইচ্ছা হলো না এডমন্ডের। ফারিয়ার কথা মনে করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে,–আহা, এমন একজন জ্ঞানী মানুষকে কবর পর্যন্ত দেওয়া হবে না। বস্তায় বন্ধ করে…
হঠাৎ তার মাথায় একটা মতলব এসে যায়।
–তাই তো! ওর বদলে আমি যদি বস্তার মধ্যে ঢুকে থাকি তাহলে কেমন হয়? ওরা আমাকে মরা মনে করে সমুদ্রে ফেলে দেবে; তারপর আমি বস্তা কেটে বেরিয়ে পড়বো! ঠিক হয়েছে! এই উপায়েই আমি পালাতে চেষ্টা করবো!
উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। বিছানার উপরে উঠে বসে সে।
সন্ধ্যার পরে।
ফারিয়ার সেই কাগজ-দুখানাকে পকেটে নিয়ে এডমন্ড সেই সুড়ঙ্গ-পথের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ কি মনে করে একবার থমকে দাঁড়ালো সে! তারপর ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের মুখের পাথরখানা সরিয়ে ফেলে সে ঢুকে পড়লো সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে।
ফারিয়ার ঘরে গিয়ে সে দেখতে পেলো যে ঘরের মধ্যে একটা বস্তা পড়ে আছে। বস্তাটার দিকে তাকাতেই তার মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু এখন মন খারাপ করে সময় নষ্ট করা চলে না। সে বস্তাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো যে, ফারিয়ার মৃতদেহ তখন বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে বস্তার মুখটা সেলাই করে রাখা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে সেলাই করবার সুচ আর রশিও ছিল ওখানে। বোধ হয় প্রহরীরা ফেলে গেছে।
এডমন্ড তখন আর এক মুহর্ত সময় নষ্ট না করে বস্তার সেলাই খুলে মৃতদেহটা টেনে বের করে ফেললো। তারপর সেই মৃতদেহকে টেনে নিয়ে চললো সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে। সুড়ঙ্গের সরু পথে মৃতদেহ নিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হলো তার, কিন্তু কষ্টকে সে কষ্ট বলে মনে না করে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরে নিয়ে এলো। তারপর সেই মৃতদেহকে নিজের বিছানার উপর তুলে ভাল করে কম্বল চাপা দিয়ে সে আবার ফিরে চললো ফারিয়ার ঘরে। বলা বাহুল্য, যাবার সময় সুড়ঙ্গ-মুখের পাথরখানা ভাল করে টেনে বন্ধ করে দিল সে।
সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে কতকগুলি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন ফারিয়া। ঐ সব জিনিসপত্রের মধ্যে কয়েকখানা চিনেমাটির প্লেটের ভাঙা টুকরোও ছিল। এডমন্ড ওগুলোর ভিতর থেকে ধারালো দেখে একখানা টুকরো তুলে নিয়ে পকেটে রাখলো। তারপর ঢুকে পড়লো ফারিয়ার ঘরে।
সে তখন তাড়াতাড়ি সেই বস্তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ভিতর থেকেই অতি কষ্টে সেলাই করে ফেললো বস্তার মুখটা।
প্রায় দুই ঘণ্টা বস্তাবন্দী হয়ে থাকবার পর দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো এডমন্ড। সে তখন মড়ার মত নিঃশব্দে পড়ে রইলো সেই বস্তার মধ্যে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যাতে কেউ শুনতে না পায় সেজন্য সে সাবধান হলো। তার বুকের মধ্যে তখন যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে।
একটু পরেই এডমন্ড বুঝতে পারলো যে, প্রহরীরা দড়ি দিয়ে বস্তাটাকে বেঁধে ফেলছে। সে তখন মনে মনে ভগবানের নাম স্মরণ করতে লাগলো। তার মনে হলো যে ঐ বাঁধন কাটতে না পারলে তার জীবন্ত সমাধি হবে সমুদ্রের অতল তলে।
বাঁধাহাদা শেষ হয়ে গেলে তাকে ধরে তুললো তিন-চার জনে মিলে। একজন আবার রসিকতা করে বললো–বুড়োটা কি ভারী দেখছো?
কিছুক্ষণ পরেই শীতল বাতাসের স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল এডমন্ডের। বুঝতে দেরি হলো না যে তাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরে এসে প্রহরীরা পাহাড়ের উপর উঠতে লাগলো তাকে কাঁধে নিয়ে। অনেকটা পথ চলবার পর হঠাৎ নামিয়ে রাখা হলো তাকে। এর কিছুক্ষণ পরেই এডমন্ডের মনে হলো তার পায়ের সঙ্গে কি যেন বাঁধা হচ্ছে। আসলে সেটা ছিল একগাছা সরু লম্বা দড়ি। সেই দড়ির আর এক প্রান্তে বাঁধা ছিল একখানা ভারী পাথর। মৃতদেহ যাতে ভেসে উঠতে না পারে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।
যে জায়গাটায় তাকে রাখা হয়েছিল সেটা ছিল একটা পাহাড়ের চূড়া। তার ঠিক নিচেই সমুদ্র। প্রহরীরা তখন তিন চার জন ধরে তার বস্তাবন্দী দেহটাকে তুলে নিয়ে বার কয়েক দোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সমুদ্রের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন সেই দড়িতে বাঁধা পাথরখানাও ঠেলে ফেলে দিল।
ঝপাং করে একটা শব্দ তুলে এডমন্ডের বস্তাবন্দী দেহটা তলিয়ে যেতে লাগলো। পায়ের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা পাথরের টানে নিচে নেমে যেতে লাগলো সে। জলের চাপে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু ঐ অবস্থাতেও মনের বল হারালো না এডমন্ড। সে তাড়াতাড়ি সেই ভাঙা প্লেটের টুকরোটা দিয়ে বস্তার সেলাইটা কেটে ফেললো। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে সে কাটতে লাগলো পায়ে বাঁধা সেই দড়িগাছা।
মুহূর্তে মুহূর্তে নিচের দিকে নেমে চলেছে সে। দম আর থাকছে না। এখনই হয়তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে। সে তখন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়িগাছা কাটতে চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ দড়িগাছা কেটে গেল এই সময়ে। দড়ি কেটে যেতেই সে ভেসে উঠতে লাগলো উপরের দিকে। সে তখন বহু কষ্টে বস্তার বাঁধনগুলো কেটে ফেলে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ভেসে উঠলো জলের উপর।
মুক্তি! ওঃ! কত কাল পরে বাইরের মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগলো এডমন্ডের।
উপরের দিকে তাকিয়ে এডমন্ড দেখতে পেলো যে প্রহরীরা তখনও যায়নি ওখান থেকে। তাদের লণ্ঠনের আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার উপর।
এডমন্ড সাঁতার কেটে এগিয়ে চললো।
কিছুক্ষণ সাঁতার কাটবার পর হঠাৎ বিকট ঢং ঢং আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো সে। জেলখানায় ‘পাগলা ঘণ্টি’ বেজে উঠেছে।
.
১০.
মুক্তির আশায় প্রাণপণে সাঁতার দিয়ে এগোচ্ছিলো এডমন্ড, কিন্তু মানুষের শরীরে আর কত সহ্য হয়! তীরের দিকে যাবার উপায় নেই। তীরে উঠলেই আবার তাকে ধরা পড়তে হবে। তার তখন একমাত্র ভরসা, কোন জাহাজ যদি তাকে দেখতে পেয়ে তুলে নেয়। কিন্তু অন্ধকার সমুদ্রে কোন জাহাজের চিহ্নও সে দেখতে পেলো না। ক্রমে পুবের দিক ফর্সা হয়ে এলো। সারারাত সাঁতার কাটার ফলে হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো এডমন্ডের। দুর্লঙঘ্য সাগরের বুকে খালি হাতে কতক্ষণ সাঁতার কাটতে পারে মানুষ! মাথা ঘুরে উঠলো এডমন্ডের।
তারপর আর সে কিছু মনে করতে পারলো না। অজ্ঞান হয়ে ভেসে চললো সে সাগরের বুকে।
***
ভূমধ্যসাগরে সেই সময় বহু বোম্বেটে-জাহাজ চলাফেরা করতো। এই জাহাজের নাবিকদের চেহারা ভদ্রলোকের মত হলেও আসলে তাদের পেশা ছিল ডাকাতি করা।
এডমন্ডের সংজ্ঞাহীন দেহটি যখন সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে চলেছে, সেই সময় ঐ রকম একখানি জাহাজ চলেছিল তার পাশ দিয়ে। জাহাজের একজন নাবিক হঠাৎ দেখতে পায় যে জলের উপর একটি মানুষের দেহ ভেসে যাচ্ছে। সে তক্ষুণি খবরটা জানালো জাহাজের কাপ্তেনকে।
কাপ্তেন বললো–তুলে নাও ওকে।
জাহাজে তুলবার পর এডমন্ডের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল সবাই। একি সাংঘাতিক চেহারা রে বাবা! দেড় হাত লম্বা দাড়ি, মাথার চুল আড়াই হাত লম্বা, হাতের নখগুলো তিন চার ইঞ্চি করে! মানুষের এ রকম চেহারা আগে দেখেনি তারা।
কাপ্তেন বললো–এটা কোন দেশের লোক বলতে পারো?
নাবিকেরা সমস্বরে বললো–না, এ রকম মানুষ জীবনে দেখিনি আমরা।
একজন বললো–এটা কোন জন্তু নয় তো?
আর একজন বললো–দূর! জন্তু হবে কেন? দেখলে না, ঠিক মানুষের মত চেহারা!
আর একজন এই সময়ে বলে উঠলো–আরে আরে! এর গায়ে যে কয়েদীর পোশাক দেখছি। বোধ হয় জেল থেকে পালিয়েছে লোকটা।
কাপ্তেন বললো–তাই হবে। আচ্ছা দেখ তো লোকটা বেঁচে আছে কি না?
কাপ্তেনের আদেশে একজন লোক এডমন্ডের বুকের উপরের দাড়ির গোছা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের উপরে কান রাখলো। কিছুক্ষণ কান লাগিয়ে থেকে সে বলে উঠলো–না, মরেনি! বুক ধক ধক করছে এখনও।
কাপ্তেন বললো,–আচ্ছা, এবার তাহলে ওর পেট থেকে জলগুলো বের করবার ব্যবস্থা করো।
সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার জন লোক মিলে এডমন্ডের দেহটিকে উপুড় করে শুইয়ে তার হাত আর পা ধরে নানা-রকম প্রক্রিয়া শুরু করলো। কিছুক্ষণ ঐ ভাবে প্রক্রিয়া করবার পর এডমন্ডের পেট থেকে জল বের হয়ে গেল। কাপ্তেন তখন তাকে শুকনো পোশাক পরিয়ে গরম কাপড় দিয়ে সেঁকতে আদেশ দিলো। কিছুক্ষণ সেঁকবার পর চোখ মেলে চাইলো এডমন্ড।
সে চোখ মেলে তাকাতেই খানিকটা ব্র্যান্ডি খাইয়ে দেওয়া হলো তাকে।
ব্র্যান্ডি পেটে পড়তেই তার শরীরটা চাঙা হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে বললো–আমি কোথায়?
কাপ্তেন বললো–আমার জাহাজে।
–কোন দেশের জাহাজ এটা?
–ভয় নেই, আমরা তোমাকে ধরিয়ে দেব না! কিন্তু তুমি জেল থেকে পালালে কি করে?
–সে অনেক কথা। এখন বলতে পারবো না। একটু সুস্থ হলে সব কথাই বলবো আপনাকে। কিন্তু দোহাই আপনার, আমাকে ওদের হাতে ধরিয়ে দেবেন না যেন।
কাপ্তেন মৃদু হেসে বললো–না, সে ভয় নেই তোমার। তাছাড়া আমরাও খুব সাধু-সজ্জন নই। বোম্বেটে-জাহাজের নাম শুনেছ তো? এখানাও একখানা বোম্বেটে-জাহাজ।
এডমন্ড খুশি হলো এই কথা শুনে। খুশি হলো এই কারণে যে, বোম্বেটেরা তাকে নিশ্চয়ই ধরিয়ে দেবে না।
সে তখন উঠে বসবার চেষ্টা করতেই কাপ্তেন বললো– এখনই উঠে বসবার চেষ্টা করো না। আগে কিছু খেয়ে নাও, তারপরে উঠো।
কাপ্তেনের নির্দেশে তখনই এক প্লেট ডিম আর আলুসিদ্ধ এনে দেওয়া হলো তাকে।
দীর্ঘ চৌদ্দ বৎসর পরে ডিমসিদ্ধ মুখে দিল সে। কি ভালই যে লাগলো তার ঐ ডিম আর আলুসিদ্ধগুলি!
তাকে গোগ্রাসে গিলতে দেখে কাপ্তেন বললো–আর দেব?
এডমন্ড বললো–দিন।
কাপ্তেনের আদেশে আর এক প্লেট ডিমসিদ্ধ এনে দেওয়া হলো তাকে।
খাওয়ার পরে এডমন্ড বললো–আপনাদের জাহাজে কোন নাপিত আছে কি?
কাপ্তেন হেসে বললো–তা তো আছে, কিন্তু আমি ভাবছি তোমার এই জাদরেল চেহারাখানার একটা ছবি যদি রাখা যেত তাহলে বড় চমৎকার হত। এ রকম দেড় হাত লম্বা দাড়িওয়ালা মানুষ তো বড় একটা দেখা যায় না কি না!
হব্ব-জব্ব দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে এডমন্ড হেসে ফেললো এই কথা শুনে। হাসি থামলে সে বললো–আমার এই চেহারাখানা নিজেরই একবার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে যে!
কাপ্তেন বললো–বেশ তো। আমার ক্ষুর নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাও। ওখানে আয়না আছে। কামানোও হবে, চেহারাও দেখতে পাবে।
এই বলেই একজন লোককে সে আদেশ করলো–আমার ঘর থেকে কামাবার সরঞ্জামগুলো এনে দাও তো একে।
একটু বাদেই একখানা ক্ষুর আর একখানা কঁচি নিয়ে এসে লোকটা বললো–এসো আমার সঙ্গে, বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজের চেহারাখানা দেখেই ঘাবড়ে গেল এডমন্ড। একি সাংঘাতিক চেহারা রে বাবা!
এর পর কিছুক্ষণ আয়নায় সেই অপরূপ চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষুর দিয়ে দাড়ির গোছা চেঁছে ফেলে দিল সে। দাড়ি-গোঁফ কামানো হয়ে গেলে এডমন্ড আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো যে, তখনও তার চেহারায় যৌবনের দীপ্তি আছে।
এডমন্ড হিসাব করে দেখলো, তার বয়স তখন তেত্রিশ বছর। দাড়ি-গোঁফ কামানো হয়ে গেলে সে কঁচি দিয়ে মাথার চুলগুলোও ঘাড় পর্যন্ত হেঁটে ফেললো। এইভাবে চুল-দাড়ি কামানো হয়ে গেলে সে স্নান করতে বসলো। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে গা থেকে ময়লাগুলো যতদূর সম্ভব ঘষে তুলে সে (পাশাক পরে নিলো। পোশাক পরে আবার সে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। নাঃ! ভালই দেখাচ্ছে তাকে।
এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল যে হাত-পায়ের নখগুলো কাটা হয়নি। সে তখন কঁচি দিয়ে হাত-পায়ের নখগুলো কেটে ফেললো।
এর পর সে যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তাকে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। জাহাজের কাপ্তেন তার দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললো–বাঃ! তোমার চেহারাখানা তো বড় চমৎকার হে!
এই সময় হঠাৎ ফারিয়ার সেই কাগজ দুখানার কথা মনে পড়ে যায় এডমন্ডের। কাগজ দুখানা তার সেই কয়েদী জামার পকেটে ছিল।
ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে আমার জামা! আমার জামা কোথায় রেখেছেন?
নাবিকদের মধ্যে একজন হেসে বললো–তোমার সেই মহামূল্যবান জামাটার কথা বলছো তো? ভয় নেই, ও চীজ চুরি যাবে না। ঐ দেখ দড়িতে শুকোচ্ছে।
এডমন্ড ছুটে গেল সেই জামাটার কাছে! তারপর তার পকেটে হাত দিয়ে টেনে বের করলো সেই ভাঁজ-করা কাগজ দুখানা। বের করবার সময় সে নাবিকদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, উদ্দেশ্য–ওরা কেউ যাতে দেখতে না পায় জিনিসটা।
ভিজে একেবারে ন্যাতা হয়ে গিয়েছিল কাগজ দুখানা। এডমন্ড তাড়াতাড়ি কাগজ দুখানাকে পকেটে ফেলে জামাটাকে উল্টে দিতে লাগলো। এমন ভাব দেখালো যেন ঐ জামাটা শুকোতে দিতেই সে ওখানে গেছে।
সে ফিরে এলে কাপ্তেন বললো–ও জামাটির মায়া এবার (তামাকে ত্যাগ করতে হবে ভাই। ও চীজ তোমার কাছে দেখলেই পুলিশ তোমাকে ধরবে।
এডমন্ড বললো–ঠিকই বলেছেন। ওটাকে এখনই বিদেয়। করা উচিত। এই বলেই সে আবার এগিয়ে গেল সেই জামাটার কাছে। তারপর দড়ি থেকে জামাটা নামিয়ে নিয়ে ডেকের ধারে গিয়ে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটাকে।
১১-১৫. ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর
ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে বোম্বেটেদের “এমেলিয়া” জাহাজখানা। এডমন্ড ইতিমধ্যেই ভিড়ে গেছে তাদের দলে। তার জাহাজী-জ্ঞান ও জাহাজ চালাবার অভিজ্ঞতা দেখে বোম্বেটেরা খুশি হয়েছিল।
ওরা চলেছিল ফ্রান্সের সীমান্তে–জাহাজের বে-আইনী মালগুলো কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিতে। কয়েকদিন চলবার পর এডমন্ড একদিন দেখতে পেলো যে জাহাজখানা একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ওটা কোন দ্বীপ বুঝতে না পেরে জাহাজের কাপ্তেনকে সে জিজ্ঞাসা করলো–ওটা কোন দ্বীপ কাপ্তেন?
–মন্টিক্রিস্টো দ্বীপ।
–মন্টিক্রিস্টো দ্বীপ!
কাপ্তেনের মুখে এই কথা শুনেই এডমন্ডের বুকের ভিতর হঠাৎ যেন আলোড়ন আরম্ভ হয়ে গেল।
অতি কষ্টে মনের ভাব চেপে রেখে সে বললো–চলুন না, ওখানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম করে যাই!
কাপ্তেন হেসে বললো–খুব জায়গায় বিশ্রাম নেবার কথা বলেছো ভায়া! ওখানে কি মানুষ আছে নাকি?
–তার মানে?
–মানে, ঐ দ্বীপে আজ পর্যন্ত মানুষের বসতি হয়নি। তবে হ্যাঁ, শিকার যদি করতে চাও তাহলে যেতে পারি। প্রচুর শিকার পাওয়া যায় ওখানে।
জ্যাকোপো নামে ওদের মধ্যেকার একজন বোম্বেটে বলে উঠলো এইসময়–কথাটা মন্দ বলেননি। অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়নি; চলুন দ্বীপে নেমে কিছু শিকার করে নেওয়া যাক।
কাপ্তেন বাধা দিলো না এই সাধু প্রস্তাবে।
জাহাজের গতি পরিবর্তিত হলো মন্টিক্রিস্টো দ্বীপের দিকে।
তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙর ফেলা হলো। জল কম বলে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বোম্বেটেরা তখন একখানা বোটে করে চলতে লাগলো তীরের দিকে। বোটে উঠবার আগে তারা প্রয়োজনীয় গুলি, বারুদ, বন্দুক, কুড়ল, কাটারি, রান্না করবার বাসনপত্র আর মশলাপাতি তুলে নিলো বোটে। বলা বাহুল্য, এডমন্ড চললো তাদের সঙ্গে। তারপর তীরে নেমে কথা হতে লাগলো, কে শিকার করতে যাবে।
এডমন্ড বললো–আমি যাব।
জ্যাকোপো বললো–আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
এডমন্ডের ইচ্ছা ছিল, সে একাই যাবে, তাই জ্যাকোপো যেতে চাওয়ায় সে একটু বিরক্তই হলো মনে মনে। কিন্তু মনের বিরক্তি মুখে প্রকাশ না করে সে যেন খুব খুশি হয়েছে এই রকম ভাব দেখিয়ে জ্যাকোপোর সঙ্গে এগিয়ে চললো।
কিছুদূর যাবার পর একটা নধর পাঁঠা দেখতে পেয়ে এডমন্ড গুলি করে মেরে ফেললো সেটাকে। জ্যাকোপো মনের আনন্দে ছুটে গিয়ে পাঁঠাটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে বললো– চলো ভাই, আর শিকারের দরকার হবে না।
এডমন্ড বললো–না ভাই, তুমি বরং এটাকে নিয়ে গিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করো। আমি দেখি আরও দু’ একটা পাই কি না। খাওয়ার আগে আমি যদি না এসে পৌঁছাই তাহলে একটা ফাঁকা আওয়াজ করো। বন্দুকের আওয়াজ শুনলেই আমি চলে আসবো। জ্যাকোপোর তখন জিভ দিয়ে জল পড়ছে। কতক্ষণে পাঁঠাটাকে রোস্ট করা হবে, তার মনে তখন কেবল সেই চিন্তা। সে তাই আনন্দের সঙ্গেই রাজী হলো এডমন্ডের প্রস্তাবে।
জ্যাকোপো চলে যেতেই এডমন্ড চললো পুবের দিকে। পুবের ঐ পাহাড়টার উপরে যেতেই হবে তাকে। পাহাড়ের কাছে হাজির হয়ে এডমন্ড লক্ষ্য করলো যে, একটা শুকনো খাল এঁকে-বেঁকে চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। খালটি দেখে এডমুন্ডের মনে হলো যে একসময় হয়তো ওটা নদী ছিল। মহাকালের হস্তক্ষেপে আজ শুকিয়ে গেছে। নদীর ধার দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলতে লাগলো সে।
অনেকক্ষণ চলবার পর পাহাড়ের নিচে এসে গেল এডমন্ড। এইবার শুরু হলো চড়াই। কোথাও খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে, গাছের ডাল লতা গুল্ম ধরে, কোথাও বা হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলো সে। চড়াই শেষ হতেই আরম্ভ হলো উতরাই। এইভাবে বহু চড়াই-উতরাই ভেঙে পাহাড়ের চূড়াগুলি গুনতে গুনতে চলেছে সে। তার লক্ষ্য কুড়ি নম্বর চূড়ার দক্ষিণ দিকের সেই গুহাটি–যার মধ্যে সঞ্চিত আছে স্পাডা পরিবারের অতুল ঐশ্বর্যরাশি।
কিন্তু এখনও যে দশটি চূড়াও পার হয়নি সে! এইভাবে চললে কুড়ি নম্বর চূড়ায় পৌঁছাতে বেলা শেষ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই! ওদিকে তার দেরি দেখে তার সঙ্গীরা হয়তো খুঁজতে আসবে তাকে! তারা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্যের কথা তাহলে সব পণ্ড হবে।
এইসব কথা চিন্তা করে এডমন্ড ফিরে আসাই ঠিক করলো তখনকার মতো। সে ভাবলো সঙ্গীদের কোন রকমে এখান থেকে বিদায় করতে পারলে হয়।
যাবার সময় সে পথের দুই দিকে চিহ্ন রাখতে রাখতে চললো। কোথাও পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে, কোথাও গাছের ডাল কেটে পথে রেখে নিশানা ঠিক করে রাখতে লাগলো সে।
অনেকক্ষণ চলবার পর সমুদ্রের দিকের প্রথম চুড়াটার উপর উঠে সে দেখতে পেলো তার সঙ্গীদের। তারা তখন খাবার ব্যবস্থায় উন্মত্তপ্রায়। হঠাৎ জ্যাকোপো তার বন্দুকটা আকাশের পানে তুলে ধরে একটা আওয়াজ করলো। এডমন্ড বুঝতে পারলো, খাবার তৈরি হয়ে গেছে, তারই সংকেত করলো জ্যাকোপো। এডমন্ড পাহাড়ের উপর থেকে হাত তুলে ইশারায় উত্তর দিল–সে আসছে।
জ্যাকোপো দেখতে পেলো তাকে। সেও হাত তুলে ইশারা করলো।
এডমন্ড তখন লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগলো সেই চুড়া বেয়ে।
হঠাৎ তার সঙ্গীরা দেখলো যে এডমন্ড পড়ে গেল। হয়তো পা পিছলে পড়ে গেছে, হয়তো খুব আঘাত পেয়েছে সে–এই ভেবে চারজন লোক ছুটে আসতে লাগলো সেই পাহাড়ের দিকে।
কিছুক্ষণ পরেই এডমন্ডকে দেখতে পেলো তারা। পাহাড়ের উপরে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে ছিল সে।
ওরা তখন এডমন্ডের কাছে গিয়ে তাকে ধরে তুলবার চেষ্টা করতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো সে।
জ্যাকোপো বললো–খুব লেগেছে বুঝি?
যন্ত্রণাকাতর-কণ্ঠে এডমন্ড বললো–হ্যাঁ!
–যেতে পারবে না?
–না। আমার পাজরার হাড় বোধ হয় ভেঙে গেছে। আমাকে তোমরা ঐ গুহাটার ভিতরে নিয়ে চলো। এই বলে পাশের একটি গুহা দেখিয়ে দিল সে।
ওরা তখন এডমন্ডকে ধরাধরি করে সেই গুহার ভিতরে নিয়ে নামিয়ে রাখলো। যতক্ষণ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ততক্ষণই এডমন্ড চিৎকার করছিলো।
গুহার ভিতর নামিয়ে রাখতেই এডমন্ড বললো–আমার আর এখান থেকে নড়বার উপায় নেই ভাই।
তোমরা বরং আমার খাবার এখানেই এনে দাও। জ্যাকোপো বললে–কিন্তু ভাই আমাদের যে আজই রওনা হতে হবে। আজ রওনা না দিলে নির্দিষ্ট সময়ে জায়গামত পৌঁছাতে পারব না আমরা।
এডমন্ড বললো–তোমরা যাও ভাই। আমাকে বরং ফিরবার পথে তুলে নিয়ে যেও।
জ্যাকোপো বললো–তা কি করে হয়? তোমাকে একা এই দ্বীপে ফেলে রেখে আমরা যাই কি করে?
এডমন্ড বললো–কিন্তু উপায় তো নেই ভাই। কাপ্তেনকে বলে আমার জন্য কিছু বিস্কুট, এক কলসী জল, একটা কুড়ুল, একটা গাঁইতি আর কিছু গুলিবারুদ নিয়ে এসো। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো।
জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা তখন কাপ্তেনের কাছে ফিরে গিয়ে এডমন্ডের অবস্থার কথা বলতেই সে বললো–বেশ! তবে তাই হোক। না গিয়ে যখন উপায় নেই আমাদের, তখন এ ছাড়া আর উপায় কি?
কাপ্তেনের আদেশে তখন এডমন্ডের জন্য দিন সাতেকের মত খাবার, আর তার চাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে চললো জ্যাকোপো আর তিন-চারজন লোক। বলা বাহুল্য পাঁঠার রোস্টও নিয়ে যাওয়া হলো এডমন্ডের জন্য।
এডমন্ড জিনিসগুলো পেয়ে মনে মনে খুশি হলেও মুখে বললো–তাহলে এসো ভাই, তোমাদের আর আটকে রাখতে চাই না। আমি এইখানেই অপেক্ষা করবো তোমাদের জন্য। ফিরবার পথে আমাকে তুলে নিয়ে যেও কিন্তু।
জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা সাশ্রনয়নে বিদায় নিলো এডমন্ডের কাছ থেকে।
ঐদিনই ‘এমেলিয়া’ জাহাজখানা চলে গেল ওখান থেকে।
.
১২.
আসলে এডমন্ডের আঘাতটা সাংঘাতিক কিছু হয়নি। সঙ্গীদের ওখান থেকে বিদায় করবার জন্যই সে ঐভাবে অভিনয় করছিল। তাই জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা চলে যেতেই সে উঠে বসলো।
উঠে বসে মনের আনন্দে পেট ভরে পাঁঠার রোস্ট খেয়ে আবার সে শুয়ে পড়লো সেই গুহার মধ্যে। সে ভাবলো যে, আজ আর কিছু করা হবে না। জাহাজ চলে গেলে কাল যা হয় করা যাবে।
সে-রাত্রি ঐ গুহার মধ্যে শুয়েই কাটলো তার।
পরদিন সকালে উঠেই সে তৈরি হয়ে নিলো। বন্দুকটা এক কাঁধে ঝুলিয়ে, বারুদের থলেটাকে আর এক কাঁধে। তারপর কুড়ুল আর গাঁইতি হাতে নিয়ে এগিয়ে চললো সে।
আবার সেই মরা নদী। আর সেই পার্বত্য পথ।
গতকালের নিশানা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললো সে।
একে একে উনিশটি পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে কুড়ি নম্বর চুড়ার সামনে সে যখন এসে পৌঁছলে বেলা তখন প্রায় দুপুর। কুড়ি নম্বর চূড়ার কাছে এসে দক্ষিণ দিকে চললো সে। একটু যেতেই সে দেখতে পেলো পাহাড়ের গায়ে একখানা বিরাট পাথর আটকে আছে। পাথরখানা দেখে তার মনে হলো যে ওখানা কেউ টেনে এনে রেখেছে সেখানে, কারণ পাহাড়ের সঙ্গে ঐ পাথরখানার কোনো সম্বন্ধ নেই। ওখানা একখানা বিচ্ছিন্ন, পাথর। কিন্তু অতবড় একটা বিরাট পাথর কে টেনে আনলো ওখানে? এ যে একটা হাতির পক্ষেও সম্ভব নয়! সে তখন পাথরের অবস্থানটা ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলো। তার মনে হলো পাথরখানা উপর থেকে গড়িয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। হয়তো এখানে কোন কিছু দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে গড়ানো পাথরখানাকে আটকে ফেলা হয়েছিল।
নিশ্চয়ই তাই!
সে তখন পাথরখানার অবস্থান আর একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। তার মনে হলো যে পাথরখানাকে যদি কোন রকমে একটু সরানো যায় তাহলে নিশ্চয়ই ওখানা নিচে গড়িয়ে পড়বে।
এই কথা ভেবে সে নিকটস্থ একটা গাছ থেকে একখানা সরু অথচ মজবুত ডাল কেটে এনে সেই ডাল দিয়ে চাড় দিতে চেষ্টা করলো পাথরখানাকে।
কিন্তু মুস্কিল হলো এই যে, ডালখানা পাথরের নিচে ঢোকাতে পারা গেল না।
এডমন্ড তখন গাঁইতি দিয়ে পাথরের কিনারে কোপাতে আরম্ভ করলো। মিনিট কয়েক কোপাতেই গাঁইতিখানার মুখ হঠাৎ একটা ফাঁপা জায়গার মধ্যে ঢুকে গেছে বলে মনে হলো তার। এই ব্যাপার দেখে তার বুঝতে দেরি হলো না যে ঐ পাথরের নিচেই আছে সেই গুহার মুখ। সে তখন গাছের সেই ডালখানাকে সেই ছিদ্রপথে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে চাড় দিতে লাগলো। কিন্তু চাড় দিলে কি হবে, পাথরখানা একটুও নড়লো না।
শত শত বৎসর পাথরখানা ওখানে থাকার ফলে তার চারিদিকের মাটি এমন শক্তভাবে এঁটে ছিল পাথরখানার গায়ে যে এডমন্ডের পক্ষে সম্ভব হলো না ওখানাকে স্থানচ্যুত করতে।
এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়লো থলের বারুদের কথা। সে ভাবলো যে খানিকটা বারুদ পাথরের নিচে ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে হয়তো কাজ হবে।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।
সে তখন গাঁইতির সাহায্যে পাথরের নিচে একটা গর্ত তৈরি করে তার মধ্যে বারুদ ঢুকিয়ে ভাল করে চাপা দিল। তারপর থলে থেকে একগাছা দড়ি বের করে পলতের মত ঢুকিয়ে সেটাকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল।
একটু পরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো সেই পাথরের নিচে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরখানা নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
পাথরখানা সরে যেতেই এডমন্ড দেখলো যে একটা গুহার মুখ বেরিয়ে পড়েছে তার নিচে থেকে।
সে তখন এগিয়ে গেল সেই গুহার দিকে। কিন্তু কি সর্বনাশ! ওটা কি?
এডমন্ড দেখলো, একটি বিরাট অজগর সাপ এঁকে বেঁকে বেরিয়ে আসছে সেই গুহার ভিতর থেকে। এত বড় সাপ এডমন্ড জীবনেও দেখেনি। ভয়ে তার কপাল ঘেমে উঠলো। গুহার মধ্যে ঢুকতে সাহস হলো না তার।
তার আরও মনে হলো যে সাপ না থাকলেও এই তিন শ’ বছরের চাপা গুহার মধ্যে যে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে আছে, সেই গ্যাস নাকে ঢুকলে অবধারিত মৃত্যু।
এডমন্ড তখন অপেক্ষা করতে লাগলো ঐ গ্যাস বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। সে ভালো করেই জানতো যে বাতাসের স্পর্শ পেলেই গ্যাস উপরের দিকে উঠতে থাকে।
.
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে সে ভগবানের নাম নিয়ে ঢুকে পড়লো সেই গুহার মধ্যে!
গুহাটা খুব বড় নয়। সে দেখতে পেলো এক কোণে একটা কাঠের বাক্স তালা-চাবি দিয়ে বন্ধ করা রয়েছে।
সে তখন তার বন্দুকের নল দিয়ে তালাটার গায়ে আঘাত করতেই সেটা গুঁড়ো হয়ে গেল।
তালাটা গুঁড়ো হয়ে যেতেই সে বাক্সের ডালাটা খুলে ফেললো। বাক্সের ভিতরটা ছিল তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগে রাশীকৃত সোনার বাট, দ্বিতীয় ভাগে সোনার মোহর, আর তৃতীয় ভাগে হীরে চুনী পান্না প্রভৃতি মহামূল্য মণিমুক্তা।
ওরে বাপরে! এ যে রাজার ঐশ্বর্যের চেয়েও বেশি!
উত্তেজনায় এডমন্ডের কপাল দিয়ে টস টস করে ঘাম ঝরতে লাগলো।
এই বিপুল ঐশ্বর্য হাতে পেয়ে তার মাথা ঘুরে উঠলো। প্রথমেই তার মনে হলো কি উপায়ে এগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়।
অনেক চিন্তা করে সে দেখলো যে এখন বেশি কিছু নিতে গেলে বিপদ হবে। যদি তার সঙ্গীরা ঘুণাক্ষরেও এই গুপ্তধনের কথা জানতে পারে তাহলে বন্ধু বলে তারা তাকে রেহাই দেবে না। তাকে হত্যা করে ঐ ধনরত্ন কেড়ে নেবে তারা।
সে তখন দুই মুঠো ভরতি করে হীরে-জহরত তুলে তার বেল্টের সঙ্গে সংলগ্ন থলেয় ভরতি করে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো।
তারপর সে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তার সঙ্গীদের জন্য।
.
১৩.
ছয়দিনের দিন ‘এমিলিয়া’ জাহাজখানা আবার ফিরে এলো। এডমন্ডকে সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাপ্তেন বোট পাঠিয়ে দিল তাকে নিয়ে আসতে।
এডমন্ড জাহাজে উঠলে কাপ্তেন বললো–তোমাকে এখানে রেখে গিয়ে আমার মনটা খুব খারাপ লাগছিল। কেমন আছ এখন?
এডমন্ড বললো–ভাল।
এই সময় জ্যাকোপো কাপ্তেনকে বললো–কিন্তু কাপ্তেন, এবারের টাকার ভাগ তো আমাদের বন্ধুরও পাওয়া উচিত। কাপ্তেন বললো–ও যদি আমাদের সঙ্গে যেতো তাহলে পেতো বৈ কি।
কাপ্তেনের এই কথায় জ্যাকোপো বললো–কিন্তু ও তো এখানে নিজের ইচ্ছায় থাকেনি, তাই আমার ইচ্ছা, ওকেও সমান ভাগ দেওয়া হোক। তবে আপনি যদি নিতান্তই ভাগ দিতে রাজী না হন, তাহলে আমিই আমার ভাগের টাকার অর্ধেক ওকে দেবো।
কাপ্তেন হেসে বললো–তোমার ভাগের অর্ধেক আর দিতে হবে না। ওকে সমান অংশই দেওয়া হবে।
এই বলে পকেট থেকে এক গোছা নোট বের করে তা থেকে পঞ্চাশ পিয়েস্তা এডমন্ডকে দিয়ে সে বললো–এই নাও বন্ধু তোমার ভাগ।
এডমন্ড নিঃশব্দেই নোটগুলো নিয়ে পকেটে ফেললো। তারপর সে জিজ্ঞাসা করলো–এবার কোন দিকে যাওয়া হচ্ছে বন্ধু?
কাপ্তেন বললো–লেগহর্ন বন্দরে।
***
লেগহর্ন বন্দর।
জাহাজীদের ফুর্তির সব রকম ব্যবস্থাই এখানে আছে। অনেক দিন জাহাজে আটকে থেকে নাবিকরা সবাই উদ্দাম হয়ে উঠেছিল। কথা হলো, জাহাজ এখানে কিছুদিন থাকবে। সবাই নেমে পড়লো বন্দরে।
সবাই যে যার মত ছুটলো আনন্দের শিকার খুঁজতে। এডমন্ড বেরিয়ে পড়লো পথে। তার পকেটে তখন ছোটখাট রাজার দৌলত।
রাস্তায় এক ইহুদী মণিকারের দোকানে ঢুকে পড়লো সে। বুড়ো দোকানদার তার দিকে তাকিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাসা করলো–কি চাই মঁসিয়ে?
এডমন্ড বললো–দোকানের মালিকের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বৃদ্ধ বললো–কি কথা আছে বলুন? আমিই এই দোকানের মালিক।
এডমন্ড বললো–আমি কিছু হীরে বিক্রি করতে চাই। আমার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি।
বৃদ্ধ বললো–সঙ্গে আছে?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা ভিতরে আসুন।
এডমন্ড দোকানের ভিতরে যেতেই বৃদ্ধ তাকে সঙ্গে করে তার খাস কামরায় নিয়ে গেল।
খাস কামরায় গিয়ে এডমন্ড পকেট থেকে চারখানা হীরে বের করে বৃদ্ধের সামনে টেবিলের উপরে রেখে বললে–দেখুন তো, কি দাম পাওয়া যেতে পারে এর!
তার ভয় হতে লাগলো যে ইহুদী বুড়ো হয়তো তাকে জেরা করতে আরম্ভ করবে।
বৃদ্ধ কিন্তু জেরার ধারে কাছেও গেল না। সে হীরে ক’খানাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললো–এক এক খানার দাম পাঁচ হাজার ফ্রাঁ করে দিতে পারি আমি।
এডমন্ড আর দরকষাকষি না করে বিশ হাজার ফ্রাঁতেই* [বিশ হাজার ফ্রাঁ আমাদের দেশের প্রায় তিন লাখ টাকা] দিয়ে দিল হীরে চারখানা। ইহুদী বুড়োও এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য করলো না। কারণ সে জানতো যে ঐ হীরেগুলো বেচে কম করেও চার হাজার ফ্র লাভ করবে সে।
পরদিন জ্যাকোপোকে একান্তে ডেকে এডমন্ড বললো–তুমি যদি আমার হয়ে একটা কাজ করে দাও তাহলে বড় উপকার হয়।
–কি কাজ?
–মার্সেঈ বন্দরে গিয়ে এলিজ দ্য মিলান গ্রামের লুই দান্তে নামে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের খবর এনে দিতে হবে।
–আর?
–আর কাটালান গ্রামের মার্সেদেস নামে একটি মেয়ের খবর।
–আর কিছু।
–না।
–কিন্তু আমি যাব কি করে সেখানে?
–সে জন্য তোমাকে মোটেই ভাবতে হবে না। আমি একখানা স্টীমার ভাড়া করে দিচ্ছি তোমাকে, আর তোমার পারিশ্রমিক বাবদ এক শ’ ফ্ৰাঁ অগ্রিম দিচ্ছি।
এই বলেই পকেট থেকে এক গাদা নোট বের করে তা থেকে এক শ’ ফাঁর নোট জ্যাকোপোর হাতে দিল সে।
জ্যাকোপো আশ্চর্য হয়ে বললো–এত টাকা তোমার কাছে! কি ব্যাপার?
এডমন্ড মৃদু হেসে বললো–হ্যাঁ ভাই, আমি হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছি। এখানে আমার এক আত্মীয় থাকতেন। আমি ছাড়া তার আর কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় তিনি মারা যাবার সময় তার যা কিছু সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন। কাল সেখানে যেতেই আমি জানতে পারি এই খবর।
জ্যাকোপো অবিশ্বাস করলো না তার কথা। আর অবিশ্বাস করবেই বা কি করে! নিজের চোখেই তো দেখতে পেলো, যে এডমন্ডের পকেটে কমপক্ষে হাজার ফ্রাঁর নোট।
এর পর জ্যাকোপোকে সঙ্গে করে জাহাজঘাটে গিয়ে একখানা স্টীমার ভাড়া করে দিয়ে বললো–তুমি ফিরে এসে আমাকে দেখতে না পেলে জাহাজঘাটের কাছে ঐ হোটেলে অপেক্ষা করো, কেমন?
জ্যাকোপো বললো–তুমি এখন কি করবে বন্ধ?
–কিছুই ঠিক নেই, তবে ‘এমিলিয়া’ জাহাজে চাকরি করবো না যে, এটা ঠিক।
ঐ দিনই জ্যাকোপো রওনা হয়ে গেল মার্সেঈ-এর পথে।
এদিকে এডমন্ড জাহাজে গিয়ে তার হঠাৎ বড়লোক হওয়ার কথা বলে বিদায় চাইলো সবার কাছে। জাহাজ থেকে চলে আসার সময় প্রত্যেক লোককে সে এক শ’ ফ্রাঁ করে পুরস্কার দিয়ে এলো।
কাপ্তেনের কাছে বিদায় নিতে গেলে সে এডমন্ডের সঙ্গে করমর্দন করে বললো–দরকার হলে ‘এমিলিয়া’ জাহাজের এই গরীব কাপ্তেনকে ভুলো না বন্ধু।
.
এর দু’দিন পরে সমুদ্রে একখানা সুন্দর ছোট জাহাজ দেখে এডমন্ড খোঁজ নিয়ে জানলো যে ঐ জাহাজখানা একজন ইংরেজ ভদ্রলোক চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে কিনেছেন। জাহাজখানার গঠন ও সৌন্দর্য দেখে এডমন্ডের ইচ্ছা হলো ওখানা কিনে নিতে। সে তখন সেই জাহাজের মালিকের সঙ্গে দেখা করে ষাট হাজার ফ্ৰাঁ দরে কিনতে চাইলো জাহাজখানা। চল্লিশ হাজার ফ্রাতে জাহাজ কিনে দু’দিনেই বিশ হাজার ফ্রাঁ লাভ পেয়ে জাহাজের মালিক সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। এডমন্ড তখন এক বড় মণিকারের দোকানে গিয়ে আরও কয়েকখানা হীরে বিক্রি করে সেই দিনই জাহাজখানা কিনে ফেললো।
জাহাজ কেনা হয়ে গেলে সেই ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন– আপনার যদি ক্রু আর খালাসী দরকার হয় তাহলে আমার লোকদের রাখতে পারেন আপনি।
এডমন্ড বললো–তার দরকার হবে না। আমি একাই পারবো এই জাহাজ চালিয়ে যেতে। একা একা ইচ্ছামত সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবার জন্যই আমি জাহাজখানা কিনলাম।
ইংরাজ ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেলেন এডমন্ডের কথায়। শুধু তিনি কেন, লেগহর্নের বহু লোকই অবাক হয়ে গিয়েছিল, যখন তারা দেখলো যে জাহাজের মালিক কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেই চালিয়ে যাচ্ছেন তার জাহাজখানা। এখানে একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। কথাটা হচ্ছে এই যে জাহাজখানা কিনবার পরেই এডমন্ড তার নিজস্ব কেবিনে তিনটি খোপওয়ালা একটা বড় সিন্দুক তৈরি করে নিয়েছিল।
কয়েকদিন পরেই আবার ফিরে এলো এডমন্ড। এ ক’দিন সে জাহাজ নিয়ে কোথায় গিয়েছিল কেউই তা জানতে পারলো না।
বন্দরে এসে এডমন্ড দেখতে পেলো যে জ্যাকোপো ফিরে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
এডমন্ড তাকে জিজ্ঞাসা করলো–কি বন্ধ, খবর পেলে তাদের?
জ্যাকোপো বললো–বৃদ্ধের খবর পেয়েছি। তিনি মারা গেছেন।
–আর সেই মেয়েটি?
–তার কোন খোঁজ পেলাম না। ওখানকার কোন লোকই বলতে পারলো না তার কথা।
হঠাৎ চোখে জল এসে পড়লো এডমন্ডের।
জ্যাকোপো জিজ্ঞাসা করলো–কি হলো বন্ধু?
এডমন্ড বললো–কিছু না। তুমি যে খবরটা এনে দিলে এর জন্য আমার ধন্যবাদ নাও। আর সেই সঙ্গে বন্ধুর কাছ থেকে সামান্য কিছু প্রীতি উপহার…।
এই বলে পকেট থেকে এক শ’ ফাঁর নোট বের করে জ্যাকোপোর হাতে দিয়ে সে আবার বললো–বিদায় বন্ধ! জীবনে আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। কিন্তু তোমাকে আমি কোন দিনই ভুলবো না।
.
১৪.
টাকা থাকলে দুনিয়ায় অনেক কিছুই সম্ভব হয়; তাই এডমন্ড দান্তেও টাকার জোরে লর্ড উইলমোর হয়ে গেল। এই নামেই ‘পাসপোর্ট’ও বের করে নিল সে। কোথাকার লর্ড, কি তার বংশ-পরিচয়–এসব কোন প্রশ্নই বাধা হয়ে দাঁড়ালো না তার পাসপোর্ট যোগাড় করবার ব্যাপারে। সবাই ভাবলো–যাঁর পকেটে সব সময় কয়েক লাখ ফ্রাঁর নোট থাকে, তিনি লর্ড ছাড়া আর কি হবেন?
এইভাবে নিজেকে লর্ড তৈরি করে এডমন্ড ভাবলো যে লর্ডের মত চালে থাকতে হলে তার কিছু আয়ের পথ তৈরি করা দরকার। অন্তত লোক দেখানোর জন্যও তার এমন কোন সম্পত্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তগত করা দরকার যাতে কারো মনেই কোন রকম সন্দেহ আসতে না পারে। এই সব কথা চিন্তা করে এডমন্ড সোজা চলে গেল রোমে। এডমন্ড যখন ফারাওঁ জাহাজে চাকরি করত, সেই সময়েই সে জানতো যে রোমের বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান “মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির সঙ্গে “মোরেল” কোম্পানির লেনদেন আছে।
এই “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির নাম জানতো না, সে রকম লোক ইউরোপে তখন খুব কমই ছিল।
এডমন্ড সোজা গিয়ে সেই কোম্পানির মালিকের সঙ্গে দেখা করে কোম্পানিটা তাকে বিক্রি করে দিতে অনুরোধ জানালো। “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির মালিক একজন অপরিচিত লোকের মুখে এইরকম অভাবনীয় প্রস্তাব শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–”টমসন এন্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির সুনামের (Goodwill) দাম কি রকম হতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণা আছে কি?
এডমন্ড হেসে বললো–কিছু কিছু আছে বৈ কি? কিন্তু যে দামই আপনি চান, আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি, আর চান তো দামটা আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিতে প্রস্তুত।
মালিক তখন আগন্তুকের আর্থিক অবস্থা বুঝবার জন্য একটা অবিশ্বাস্য অঙ্ক দাবি করে বসলেন।
দাবির অঙ্কটা শুনে এডমন্ড কিন্তু মোটেই ঘাবড়ালো না। একটু হেসে সে বললো–টাকাটা কি এখনই চান?
–এখনই চাই! তার মানে? আপনি এত টাকা পকেটে করে নিয়ে এসেছেন নাকি?
এডমন্ড তখন তার হাতের ছোট্ট অ্যাটাচি কেসটা খুলতে খুলতে বললো–এই সামান্য টাকাও যদি সঙ্গে না থাকে, তাহলে কি “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির মত বিখ্যাত কোম্পানি কিনতে সাহসী হই?
এই বলে সত্যি সত্যিই সে এক গাদা নোট বের করে মালিকের টেবিলের উপর রেখে বললে–গুনে নিন।
ঐ দিনই লেখাপড়া হয়ে গেল। “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির নতুন মালিক হলেন লর্ড উইলমোর।
এর কয়েকদিন পরে এলিজ দ্য মিলান গ্রামের একখানা চারতলা বাড়ির দরজার সামনে একজন ইংরেজ ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
বাড়ির লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো–কাকে চান আপনি?
ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন–এই বাড়ির চারতলায় লুই দান্তে নামে একজন বৃদ্ধ থাকতেন; তার কোন খবর আপনারা জানেন কি?
–লুই দান্তে! না মশাই, ওরকম নামেরই কোন লোক এ বাড়িতে ছিলেন কিনা বলতে পারি না। আপনি বরং চারতলায় যে ভদ্রলোক আছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
ইংরেজ ভদ্রলোক তখন চারতলায় উঠে গিয়ে একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে কি ভাবলেন, তারপর ঘরের বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বললেন–ভিতরে কে আছেন, দয়া করে একটু বাইরে আসবেন কি?
একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বললেন–কি চাই আপনার?
–না, চাইনে কিছু, এই ঘরে অনেকদিন আগে আমার এক আত্মীয় থাকতেন কিনা!
–কি নাম আপনার আত্মীয়ের?
–লুই দান্তে।
–লুই দান্তে!
–হ্যাঁ, লুই দান্তে, তার কি হয়েছে বলতে পারেন কি?
–তা তো জানি না। আপনি বরং বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
–বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা আমি আগেই করেছিলাম। আপনি জেনে রাখুন, এ বাড়ির মালিক এখন আমিই।
–আপনি! আপনিই কি লর্ড উইলমোর?
–হ্যাঁ, লোকে ঐ নামেই আমাকে ডাকে বটে।
ভাড়াটে ভদ্রলোক তখন সঙ্কোচে জড়সড় হয়ে গেলেন লর্ড উইলমোরের সামনে। তিনি বললেন–আমার প্রতি কোন আদেশ আছে কি স্যর?
–আদেশ নয়, অনুরোধ। আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে আমার।
–কি অনুরোধ, বলুন?
–আপনাকে এই ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য এর পরিবর্তে আর একটা ফ্ল্যাট আপনাকে দিতে রাজী আছি আমি। আমার এই অনুরোধটা যদি আপনি রাখেন, তাহলে নতুন ফ্ল্যাটের দরুন আপনাকে কোন ভাড়া দিতে হবে না। এরকম লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, এরকম বেকুব ভাড়াটে দুনিয়ার কোথাও থাকতে পারে না। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন।
লর্ড বললেন–তাহলে আর দেরি করবার দরকার নেই, আজই আপনি তেতলার খালি ফ্ল্যাটটাতে চলে যেতে পারেন। আরামের দিক দিয়ে ঐ ফ্ল্যাটটি এর থেকে অনেক বেশি কাম্য।
ভাড়াটে ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জিনিসপত্র তেতলার ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত করে ফেললেন। লর্ড উইলমোর তখন চারতলার সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বালকের মত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন,–“বাবা! বাবা!”
.
১৫.
কয়েক দিন পরের কথা।
সেদিন কাদারুজ তার রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছিল, কোন খদ্দের আসে কি না।
সকাল থেকে একজন খদ্দেরও আসেনি সেদিন। আর আসবেই বা কেন? কী আছে কাদারুজের রেস্তোরাঁয়? ভাল ভাল খাবার ওখানে মোটেই তৈরি হয় না। তাছাড়া মদও বেশি থাকে না ওখানে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের কথাই চিন্তা করছিল সে। ভিতরের ঘর থেকে তার রুগণা স্ত্রীর খনখনে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–ওগো! কোথায় গেলে?
কাদারুজ উত্তর দিলো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার দিকে চেয়ে। তার দৃষ্টি তখন উদাস…করুণ।
এই সময় হঠাৎ তার নজরে পড়লো একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে তার রেস্তোরাঁর দিকে আসছে। লোকটিকে দেখে ধর্মযাজক বলে মনে হলো কাদারুজের।
একটু পরেই সেই ধর্মযাজক মহাশয় তার সামনে এসে ঘোড়াটাকে দাঁড় করালেন।
জিজ্ঞাসা করেন–কিছু খাবার পাওয়া যাবে কি এখানে?
কাদারুজ খুশি হয়ে উঠলো এই মহামান্য অতিথির আগমনে। মনে মনে ভাবলো, নাঃ! ভগবানের দয়া আছে। বলতে হবে।
মুখে বললো–নিশ্চয়ই, দয়া করে ভিতরে আসুন।
ধর্মযাজক ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তারপর ঘোড়াটাকে বেড়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে ভিতরে এলেন।
ধর্মযাজক ভিতরে ঢুকে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন–মঁসিয়ে কাদারুজ নামে কোন লোক এখানে থাকেন কি?
–আমারই নাম কাদারুজ।
এরপর একটু বিস্মিত হয়েই সে আবার বললো–কিন্তু আমার নাম আপনি জানলেন কি করে ধর্মাত্মন?
–অনেক খোঁজ করে আপনাকে আমি বের করেছি। যাই হোক, সেসব কথা পরে বলাও চলবে, আগে কিছু খাবার আর এক গ্লাস ভাল মদ এনে দিন তো! বড্ড খিদে পেয়ে গেছে আমার।
কাদারুজ ব্যস্ত হয়ে উঠলো ধর্মযাজকের এই কথায়! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে ঐদিনের যা কিছু ভাল খাবার ছিল প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। এক গ্লাস মদও নিয়ে এলো সে এই মান্যবর অতিথির জন্য।
খেতে খেতে ধর্মযাজক বললেন–এইবার শুনুন, কি জন্য আপনার কাছে এসেছি আমি।
কাদারুজ একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ধর্মযাজকের পাশে বসে বললো–বলুন।
ধর্মযাজক বললেন–এডমন্ড দান্তে বলে কোন লোককে আপনি চিনতেন কি?
–চিনতাম বৈকি! এডমন্ড আমার বিশেষ বন্ধু ছিল! সে কোথায় আছে এখন, বেঁচে আছে তো?
–না, সে মারা গেছে।
–মারা গেছে? কবে? কোথায়?
–অনেকদিন আগে, স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারে।
এই কথা শুনে কাদারুজের মুখখানা হঠাৎ যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বললো–বেচারা এডমন্ড! কোন অপরাধ না করেও কারাগারে মৃত্যু হলো তার, অথচ তার শত্রুরা আজ—
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ চুপ করে গেল সে।
ধর্মযাজক বললেন–’শত্রুরা’ কি বলছিলেন?
অতি কষ্টে আত্মদমন করে কাদারুজ বললো–ও কিছু না। যাই হোক! এডমন্ড সম্বন্ধে কি জানতে চান আমার কাছে?
–জানতে চাই অনেক কথাই। মৃত্যুকালে সে আমাকে একটা অনুরোধ করেছিল। মৃত্যুপথযাত্রীর সেই শেষ অনুরোধ রক্ষা করতেই আমি এসেছি।
–কি অনুরোধ করেছিল সে, জানতে পারি কি?
–নিশ্চয়ই পারেন। সে আমার হাতে একখানা দামি হীরে তুলে দিয়ে অনুরোধ করেছিল, ঐ হীরেখানা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা পাঁচজন লোকের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিতে হবে। এই পাঁচজনের মধ্যে আপনিও একজন।
কাদারুজ আশ্চর্য হয়ে বললো–হীরে! এডমন্ড হীরে কোথায় পেলো?
ধর্মযাজক হেসে বললেন–সে এক কাহিনী। এডমন্ড মারা যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিল সে কথা। সে বলেছিল যে ঐ হীরেখানা ধর্মযাজক ফারিয়া মরবার সময় তাকে দিয়ে যান।
–ধর্মযাজক ফারিয়া! জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ অধ্যাপক ফারিয়ার কথা বলছেন কি আপনি?
–হ্যাঁ, তিনিই। শুনেছেন, বোধ হয়, রাজদ্রোহের অপরাধে তাকে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হীরেখানা এডমন্ডের হাতে দিয়ে যান।
এই বলে পকেট থেকে ছোট একটা চামড়ার বাক্স বের করে সেটাকে খুলে ফেললেন তিনি।
কাদারুজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, বাক্সের মধ্যে বড় একখণ্ড মিছরির টুকরোর মত একখানা হীরে জ্বলজ্বল করছে।
অত বড় হীরে কাদারুজ জীবনেও দেখেনি, তাই সে বিস্ময়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো–কত দাম হবে হীরেখানার?
–তা পঞ্চাশ হাজার ফ্ৰাঁ তো বটেই!
–কি বললেন? প-ঞ্চা-শ-হা-জা-র-ফ্রাঁ!
ধর্মযাজক বললেন–তা তো হবেই, কিছু বেশিও হতে পারে। যাই হোক, এইবার শুনুন এডমন্ডের কথা।
কাদারুজের দৃষ্টি তখনও সেই হীরেখানার দিকে। অতি কষ্টে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে এনে সে বললো–বলুন!
ধর্মযাজক বলতে আরম্ভ করলেন–জেলখানার কয়েদীদের মৃত্যুর পূর্বে ধর্মযাজকের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। আমারই উপর পড়েছিল তার শেষ যাত্রার পথ সুগম করবার ভার! আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন তার মৃত্যুর আর বেশি দেরি ছিল না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বাইবেল পাঠ শেষ হয়ে গেলে সে আমাকে এই হীরেখানা দিয়ে অনুরোধ করলো–”এই হীরেখানা বিক্রি করে আমার পাঁচজন আত্মীয় বন্ধুর মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেবেন।” এই পাঁচজনের মধ্যে প্রথমেই ছিল লুই দান্তের নাম।
কাদারুজ বলে উঠলো, তিনি আজ আর বেঁচে নেই, শেষ সময়টা খুবই দুঃখকষ্টে কেটেছে তার।
–তার কি কোন অসুখ করেছিল?
ধর্মযাজকের এই প্রশ্নে ম্লান হেসে কাদারুজ বললো–অসুখ! হ্যাঁ, অসুখ একটা কিছু নিশ্চয়ই করেছিল। তবে আমি যতদুর জানি, তিনি না খেতে পেয়ে মারা গেছেন।
–কি বললেন! না খেতে পেয়ে মারা গেছেন তিনি!
ধর্মযাজকের কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন কান্নায় অবরুদ্ধ হয়ে এলো। তার হঠাৎ ঐ রকম ভাবান্তর দেখে কাদারুজ ব্যস্ত হয়ে বললো–না, মানে আমি ঠিক জানি না, তবে লোকে সেইরকমই বলতো বটে।
ধর্মযাজক তখন সহজ কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলেন– তাঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, দয়া করে খুলে বলুন আমাকে!
কাদারুজ বললো–কি আর বলবো ধর্মাত্মন! বৃদ্ধ ছিলেন খুবই ভাল লোক।
আমি তাকে ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। আমি তখন দরজির কাজ করি। এডমন্ড ধরা পড়বার পর থেকেই তিনি যেন কেমন হয়ে যান। কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না। কারও কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যও তিনি চাইতেন না। একমাত্র মঁসিয়ে মোরেলই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন। মঁসিয়ে মোরেল অবশ্য উপযাচক হয়েই সাহায্য করতেন। আর একটি মেয়ে তাঁকে সাহায্য করতো, তার নাম মার্সেদেস। এডমন্ড ধরা না পড়লে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত।
–কী বললেন? মার্সেদেস? হা, হ্যাঁ, তার নামও যে লেখা আছে আমার নোট বইতে! সে এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?
–পারি বৈ কি! সে এখন প্যারিসের একজন বিখ্যাত মহিলা কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ।
–কাউন্টেস-দ্য-মারকা! কে এই কাউন্ট?
–আগে এর নাম ছিল ফার্নান্দ মন্ডেগু।
বললো–না, মানে আমি ঠিক জানি না, তবে লোকে সেইরকমই বলতো বটে।
ধর্মযাজক তখন সহজ কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলেন– তাঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, দয়া করে খুলে বলুন আমাকে!
কাদারুজ বললো–কি আর বলবো ধর্মাত্মন! বৃদ্ধ ছিলেন খুবই ভাল লোক।
আমি তাকে ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। আমি তখন দরজির কাজ করি। এডমন্ড ধরা পড়বার পর থেকেই তিনি যেন কেমন হয়ে যান। কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না। কারও কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যও তিনি চাইতেন না। একমাত্র মঁসিয়ে মোরেলই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন। মঁসিয়ে মোরেল অবশ্য উপযাচক হয়েই সাহায্য করতেন। আর একটি মেয়ে তাঁকে সাহায্য করতো, তার নাম মার্সেদেস। এডমন্ড ধরা না পড়লে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত।
–কী বললেন? মার্সেদেস? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার নামও যে লেখা আছে আমার নোট বইতে! সে এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?
–পারি বৈ কি! সে এখন প্যারিসের একজন বিখ্যাত মহিলা কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ।
–কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ! কে এই কাউন্ট?
–আগে এর নাম ছিল ফার্নান্দ মন্ডেগু।
কাদারুজের এই কথায় ধর্মযাজক হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন। তারপর অতি কষ্টে মনের ভাব গোপন করে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন–এই কাউন্টের সঙ্গে মার্সেদেস-এর বিয়ের ইতিহাসটা দয়া করে বলবেন কি?
–বলবো বৈকি? আগেই বলেছি ঐ কাউন্টের নাম ছিল ফার্নান্দ। সে মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এডমন্ড বাইরে থাকতেই।
–তারপর?
–মার্সেদেস কিন্তু মোটেই আমল দিত না তাকে। সে মনেপ্রাণে এডমন্ডকেই ভালবাসতো।
কাদারুজের এই কথায় ধমর্যাজক হেসে উঠে বললেন–হ্যাঁ, মনেপ্রাণে ভালবাসার নমুনাই সে দেখিয়েছে বটে!
ধর্মযাজকের এই কথায় আহত হয়ে কাদারুজ বললো–এ কথা বলবেন না ধর্মাত্মন! আমি জানি এডমন্ডকে সে কতখানি ভালবাসতো! এডমন্ডের জেল হবার পর ফার্নান্দ তার কাছে বহুবার বিয়ের প্রস্তাব করে, কিন্তু প্রতিবারই সে ঘৃণার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রায় তিনটি বৎসর। সে অপেক্ষা করেছিল এডমন্ড ফিরে আসবে এই আশায়। কিন্তু শেষ যখন তার মৃত্যুসংবাদ এনে দেখায় ফার্নান্দ, তখন সে একেবারে ভেঙে পড়ে।
–মৃত্যুসংবাদ এনে দেখায়! কী ব্যাপার বলুন তো?
–ঠিকই বলছি। ফার্নান্দ তাকে প্রকিওরার-এর সইকরা একখানা চিঠি দেখায়। ঐ চিঠিতে লেখা ছিল যে এডমন্ড জেলখানায় মারা গেছে।
–তারপর?
–তারপরও ফার্নান্দকে বিয়ে করতে সে চায় না। কিন্তু ক্রমে তার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে ওঠে যে, নিতান্ত বেঁচে থাকবার প্রয়োজনেই সে ফার্নান্দকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
–কিন্তু ফার্নান্দ কাউন্ট হলো কি করে?
–সে এক লম্বা ইতিহাস। নেপোলিয়ান যখন এলবা থেকে ফিরে আসেন, সে তখন তাঁর সেনাদলে যোগ দেয়। তারপর ওয়াটারলুর যুদ্ধের কিছুদিন আগে সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার শত্রুপক্ষে যোগ দেয়, ফলে তার পদোন্নতি হয়। ফার্নান্দ জাতিতে ছিল স্পেনিস। স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যখন যুদ্ধ বাধে সেই সময় সে (স্পনের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করে। যে সেনাধ্যক্ষের অধীনে সে কাজ করতো, সে তখন জেনিনার সুলতান আলী পাশার সেনাপতি হয়ে জেনিনায় চলে যায়। ফার্নান্দও যায় তার সঙ্গে। সেখানে গিয়ে ফার্নান্দ ক্রমে সেনাপতির পদ পায়। তারপর গুপ্তঘাতকের হাতে আলী পাশা নিহত হবার পর ফার্নান্দ আবার ফ্রান্সে ফিরে আসে। সেনাপতির পদমর্যাদা এবং প্রচুর অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসার ফলে এখানেও সে রাজসম্মান লাভ করে। রাজা তাকে কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।
এই সময় ধর্মযাজক বললেন–কিন্তু এডমন্ডের ইচ্ছা অনুসারে এই ফার্নান্দকেও যে হীরে বিক্রির টাকা থেকে এক ভাগ দিতে হবে! তার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে ফার্নান্দও একজন, আর দুজনের মধ্যে একজন আপনি, আর একজনের নাম ড্যাংলার।
কাদারুজ বললো–কি বললেন! ফার্নান্দ আর ড্যাংলার এডমন্ডের বন্ধু! হায় ভগবান!
ধর্মযাজক আশ্চর্য হয়ে বললেন–আপনি কি তাহলে বলতে চান যে ওরা এডমন্ডের বন্ধু নয়?
কাদারুজ ম্লান হেসে বলে উঠলো–ওরা তার মহাশত্রু। বেচারা এডমন্ড যদি জানতো যে, ওরাই তাকে জেলে পাঠিয়েছিল, তাহলে বোধ হয় ঘৃণায় ওদের নামও সে মুখে আনতো না।
–ওরাই তাকে জেলে পাঠিয়েছিল! বলেন কি মঁসিয়ে কাদারুজ!
–ঠিকই বলছি। আমি ছাড়া আর কেউ জানে না সে কথা। হয়তো জানতোও আর কেউ যদি আপনি হঠাৎ তার খবর নিতে না এসে পড়তেন।
এই বলে কাদারুজ বর্ণনা করতে আরম্ভ করলো বহুদিন আগের সেই রেস্তোরাঁর ঘটনা। নিজের কথা গোপন রাখলো না, সে ধর্মযাজকের কাছে।
সব কথা বলা হয়ে গেলে সে বললো–এইবার বুঝলেন তো, কি রকম বন্ধু ওরা এডমন্ডের!
ধমর্যাজক এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলেন সেই জঘন্য চক্রান্তের কাহিনী। সব শুনে তিনি বললেন–ওরা তো বড় ভয়ানক লোক দেখছি। এ সব কথা জানবার পর আমি কিছুতেই এই হীরের অংশ ওদের দিতে পারি না। এ হীরে আমি আপনাকেই দান করলাম। আমার মনে হচ্ছে এডমন্ডের পরলোকগত আত্মা এতে সন্তুষ্টই হবে।
এই বলে তিনি হীরেখানা কাদারুজের সামনে ঠেলে দিলেন। কাদারুজ হীরের বাক্সটা টেনে নিল। আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
তার চোখে জল দেখে ধমর্যাজকের চোখেও জল এসে পড়লো। তিনি বললেন–আমি বুঝতে পারছি, মঁসিয়ে কাদারুজ, এডমন্ডকে আপনি খুবই ভালবাসতেন।
কাদারুজ চোখের জল মুছে বললো–অভাব আর সংসারের চাপে তাকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে সে মৃত্যুর সময়েও ভোলেনি। আমি পাষণ্ড, সব জেনেও আমি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করিনি; আমি…
কাদারুজের কথায় বাধা দিয়ে ধর্মযাজক বললেন–ও সব কথা তুলে দুঃখ পাবেন মঁসিয়ে। নিয়তির উপর কারো কোন হাত নেই। এই বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন–আচ্ছা, মঁসিয়ে মোরেলের খবর কিছু জানেন কি?
–মঁসিয়ে মোরেলের খবর? তা জানি বৈকি! তিনি আজ দেনায় ডুবতে বসেছেন। আগের দিনের সেই সম্মান ও প্রতিষ্ঠা আজ আর তার নেই। শুনতে পাই, এখানকার মেয়র নাকি অনেক টাকা পান তার কাছে। আমার মনে হয়, মেয়রের কাছে গেলেই তাঁর সম্বন্ধে সব খবর পেয়ে যাবেন।
ধর্মযাজক তখন কাদারুজকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লেন ওখান থেকে।
কাদারুজ দরজা পর্যন্ত এসে তাকে বিদায় দিলো।
১৬-২০. মার্সেঈ শহর
মার্সেঈ শহরের মেয়রের আফিস।
বড় একখানা টেবিলের পিছনে বসে মেয়র আফিসের কাগজপত্র সই করছেন, এই সময় আদালী একখানা কার্ড এনে তার হাতে দিলো।
কার্ডখানার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে মেয়র বললেন– সাবকো সেলাম দো।
একটু পরেই একজন সুবেশ ইংরেজ যুবক সেই কক্ষে প্রবেশ করে মেয়রকে অভিবাদন করলো।
মেয়র বললেন–বসুন। আপনিই এসেছেন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানি থেকে?
–হ্যাঁ।
–কি দরকার বলুন?
–আমি এসেছি এখানকার ‘মোরেল অ্যান্ড সন’ নামক জাহাজী কোম্পানি সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে। ঐ কোম্পানির দেনা-সংক্রান্ত সব দলিলপত্র আমরা কিনে নিতে চাই।
–মোরেল কোম্পানির মত দেউলে প্রতিষ্ঠানের দেনা কিনে কোন সুবিধে হবে আপনাদের?
–তা বলতে পারি না। আমার মনে হয় ব্যবসার ক্ষেত্র থেকে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করাবার উদ্দেশ্যেই এটা করা হচ্ছে। যাই হোক, আমরা খবর পেয়েছি যে, আপনার কাছে মঁসিয়ে মোরেল কিছু ধারেন। যদি ইচ্ছা করেন ঐ দেনার দলিলপত্র আমাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন আপনি। মেয়র খুশি হয়ে উঠলেন যুবকের কথা শুনে।
তিনি বললেন–কি দাম দিতে চান!
–দেনার পুরো টাকা, আর তার উপরে শতকরা ছ’ টাকা হারে সুদ।
–বেশ, আমি রাজী আছি। কবে দিতে পারেন টাকা?
–আজই। প্রয়োজন হলে এখুনি।
যুবকের এই কথায় মেয়র বললেন–বেশ, কিন্তু দলিলপত্রগুলো তো এখানে নেই। আপনি যদি দয়া করে বিকালের দিকে আমার বাড়িতে যান, তাহলে বড় ভাল হয়। যুবকটি তখন মেয়রের বাড়ির ঠিকানা লিখে নিয়ে আর একবার অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল।
.
ঐ দিনই বিকালে।
মেয়রের বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল, সেই যুবক আর মেয়রের মধ্যে। মেয়র তার দলিলখানা তখন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির নামে হস্তান্তরিত করে দিয়েছিলেন।
কথায় কথায় মেয়র বললেন–আপনারা আরও দলিলপত্র কিনতে চান কি?
যুবকটি আগ্রহের সঙ্গে বললো–নিশ্চয়ই। আমার উপর সেই রকম নির্দেশই দেওয়া আছে কোম্পানির।
–বেশ! আমি তাহলে আর একজন ভদ্রলোকের কাছে পাঠাচ্ছি আপনাকে। মোরেল কোম্পানির কাছে মোটা টাকা পান তিনি।
–কি নাম ভদ্রলোকের?
–মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইল। ইনি এখানকার কারাগারসমূহের ইনসপেক্টর-জেনারেল। যদি বলেন তো আমি একখানা চিঠিও লিখে দিতে পারি তার কাছে।
যুবকটি খুশি হয়ে বললো–তাহলে তো খুবই ভাল হয়।
মেয়র তখন ব্যক্তিগত ভাবে মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলকে একখানা চিঠি লিখে যুবকটির হাতে দিয়ে বললেন–এই চিঠিখানা তাঁকে দিলেই কাজ হবে।
যুবকটি মেয়রকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে চিঠিখানা নিয়ে চলে গেল।
পরদিন দুপুরের একটু আগেই যুবকটি মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের সঙ্গে দেখা করলো। বলা বাহুল্য, তাঁর আফিসেই সে গিয়েছিল।
মেয়রের চিঠি পড়ে আর যুবকটির মুখে মোরেল কোম্পানির দেনা কিনে নেবার প্রস্তাব শুনে মঁসিয়ে বোভাইল যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলেন। তিনি তখনই বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দিলেন দলিলগুলো নিয়ে আসতে। মোরেল কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায়ের আশা তিনি একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। টাকা বড় কম নয়, দু’ লাখ ফ্ৰাঁ। দু’ লাখ ফ্রাঁ ডুবে যাবার কথা চিন্তা করে তার মনে শান্তি ছিল না। তা ছাড়া তার মেয়ের বিয়েও ঠেকে যাচ্ছিলো টাকার অভাবে। এই সব কারণে যুবকটিকে তিনি ছাড়তে চাইলেন না। তার ইচ্ছা, ঐ দিনই দলিলগুলো হস্তান্তরিত করবেন, কারণ যুবকটি বলেছিল যে সুদ-সহ পুরো টাকা দিয়ে দলিলখানা কিনবার মত নগদ টাকা তার সঙ্গেই আছে।
দলিল আসতে দেরি হচ্ছে দেখে যুবকটি তাঁর সঙ্গে গল্প গুজব আরম্ভ করলো। কথায় কথায় সে বললো–আচ্ছা, স্যা-দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড আপনার এখানে আছে কি?
–নিশ্চয়ই আছে, কেন বলুন তো?
–না, মানে ফারিয়া নামে এক ধমর্যাজকের রেকর্ডটা দেখবার আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে।
–বেশ তো! দেখুন না। আমি এক্ষুণি আনিয়ে দিচ্ছি, স্যাটু দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড-বই।
এই বলেই একজন আর্দালী ডেকে স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড-বইখানা নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন তিনি।
আৰ্দালী বইখানা নিয়ে এলে সিয়ে-দ্য-বোভাইল বললেন– এই নিন স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারের রেকর্ড-বই। আপনি ইচ্ছামত দেখুন।
যুবকটি তখন সেই রেকর্ড-বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় এসে হঠাৎ থেমে গেল। সেই পৃষ্ঠার মাথায় লেখা ছিল–
“এডমন্ড দান্তে, অপরাধ রাজদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র!
নেপোলিয়ানের সঙ্গে গুপ্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ভূগর্ভস্থ নির্জন কারাকক্ষে রাখতে হবে একে।”
যুবকটি তাড়াতাড়ি পড়ে যেতে লাগলো সেই পৃষ্ঠার যাবতীয় লেখাগুলি। ঐ পৃষ্ঠার সঙ্গে পিন দিয়ে লাগানো কয়েকখানা আলগা কাগজও ছিল। সেই কাগজগুলি পড়ে যুবকটি জানতে পারলো যে, মঁসিয়ে মোরেল বহুবার ঐ বন্দীর মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছেন। নেপোলিয়ন যখন প্যারিসে ফিরে এসেছিলেন, সেই সময় তার কাছে একখানা আবেদনপত্রও পাঠিয়েছিলেন মঁসিয়ে মোরেল, কিন্তু সেখানা কোন অজ্ঞাত কারণে সম্রাটের কাছে পাঠানো হয়নি। সেখানার উপর মঁসিয়ে ভিলেফোর্টের “কিছুই করণীয় নেই” মন্তব্য সহ জেলখানার ইন্সপেক্টর-জেনারেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেই আবেদনপত্র পড়ে যুবকটির চোখ দুটি হঠাৎ যেন জ্বলে উঠলো।
এই সময় দলিল নিয়ে মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের বাড়ি থেকে লোক এসে পড়ায় যুবকটির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন– দেখা হলো আপনার?
যুবকটি তাড়াতাড়ি বইখানা বন্ধ করে বললো-হা, হয়েছে। দলিলখানা এসেছে কি?
এ মঁসিয়ে বোভাইল বললেন–হ্যাঁ, এই যে!
যুবকটি তখন দলিলখানা হাতে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললো–বেশ আপনি লিখে দিন যে, সুদসহ পুরো টাকার বিনিময়ে এই দলিল আপনি রোমের “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানিকে হস্তান্তরিত করলেন।
লেখা শেষ হলে যুবকটি তার ব্যাগ খুলে নগদ দুই লাখ ছয় হাজার ফ্রাঁর নোট মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলকে গুনে দলিলখানা নিয়ে বিদায় হলো।
.
১৭.
সুপ্রসিদ্ধ জাহাজী প্রতিষ্ঠান ‘মোরেল অ্যান্ড সন’-এর আফিস।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এখনও বেশ ভাল ভাবেই চলছে এঁদের ব্যবসা, কিন্তু আসলে ঠিক তার উল্টোটি। কোম্পানির পাঁচখানা জাহাজের মধ্যে একমাত্র ফারাওঁ জাহাজখানা ছাড়া বাকি চারখানাই ডুবে গেছে। চারখানা জাহাজ পর পর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মোরেল কোম্পানির যে বিরাট ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতিপূরণ করতে তাদের যাবতীয় রিজার্ভ ফান্ড নিঃশেষিত হয়ে যায়।
কিন্তু তাতেও দেনা শোধ হয় না। এখনও কমপক্ষে পাঁচ লাখ ফ্র দেনা এই কোম্পানির। এই রকম যখন কোম্পানির অবস্থা ঠিক সেই সময় আর এক অভাবনীয় বিপদ এসে উপস্থিত হলো। কয়েক দিন আগে রোমের ‘মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানি মঁসিয়ে মোরেলকে এখানা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, তারা মোরেল কোম্পানির যাবতীয় দেনা কিনে নিয়েছে। চিঠিতে এ-কথাও তারা লিখেছে যে, কোম্পানির পক্ষ থেকে ৬ই মে তারিখে একজন প্রতিনিধি যাবে তার কাছে–দেনার টাকা সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতে।
আজ সেই ৬ই মে।
মঁসিয়ে মোরেল চিন্তিতমুখে আফিসে বসে আছেন। বেলা তখন প্রায় এগারোটা। এই সময় ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির প্রতিনিধির কার্ড পেলেন তিনি।
কার্ডখানা হাতে পেয়েই তিনি নিয়ে আসতে বললেন। আগন্তুককে। একটু পরেই যে ইংরেজ যুবকটি সেই ঘরে এসে ঢুকলো, তাকে আপনারা এর আগে দু’বার দেখেছেন। একবার মেয়রের ঘরে, আর একবার মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের আফিসে।
যুবকটি এসেই সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানালো মাসিয়ে মোরেলকে।
মঁসিয়ে মোরেল বললেন–বসুন।
যুবকটি বসলে মঁসিয়ে মোরেল আবার বললেন–আপনিই এসেছেন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির তরফ থেকে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–আমাদের যাবতীয় দেনার দলিল আপনারা কিনে নিয়েছেন?
–সেই রকমই আমি শুনেছি।
যুবকের এই কথায় মঁসিয়ে মোরেল ম্লান হেসে বললেন– কিন্তু আমাদের কোম্পানির দেনাগুলো কিনে নেবার কারণটা দয়া করে জানাবেন কি?
–তা আমি ঠিক বলতে পারি না। একথা একমাত্র কর্তৃপক্ষই বলতে পারেন। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনার সঙ্গে দেখা করে কবে টাকাগুলো দিতে পারবেন, সেই তারিখটা জেনে নিতে। টাকাগুলো কি আজই দিতে পারবেন? দলিলপত্র আমার সঙ্গেই আছে।
মঁসিয়ে মোরেল ম্লান হেসে বললেন–ধন্যবাদ! কিন্তু আজ আমি টাকা দিতে পারবো না।
যুবকটি আশ্চর্য হয়ে বললো–বলেন কি মঁসিয়ে মোরেল! মোরেল কোম্পানির মত নামকরা প্রতিষ্ঠান দেনার টাকা দিতে দেরি করবে–এ যে বিশ্বাসেরও অযোগ্য!
যুবকের এই কথায় মঁসিয়ে মোরেল হাসবার চেষ্টা করে বললেন–বিশ্বাসের অযোগ্য হলেও এ কথা সত্যি। দেনার টাকা শোধ করবার ক্ষমতা আমার নেই। আমার এখন একমাত্র ভরসা–ফারাওঁ জাহাজ। আগস্টের শেষের দিকে জাহাজখানা ফিরে আসবার কথা আছে। জাহাজখানা যদি নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারে, তাহলেই আমি দেনা শোধ করতে পারবো, নইলে ‘মোরেল অ্যান্ড সনে’র নাম জাহাজী প্রতিষ্ঠানসমূহের রেকর্ড থেকে চিরদিনের মত লুপ্ত হয়ে যাবে। যুবকটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো–বেশ, আমি আপনাকে তিন মাসের সময় দিচ্ছি। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ৫ই তারিখে বেলা ঠিক এগারোটার সময় আমি আসবো আবার। ঐ দিন যেন আমাকে ফিরে যেতে না হয়, দয়া করে সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন।
পাওনাদারের কাছ থেকে তিন মাসের সময় পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন মঁসিয়ে মোরেল।
তিনি বললেন–কিন্তু এই সময় দেওয়াতে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নিশ্চয়ই?
যুবকটি হেসে বললো–তা একটু হবে বৈ কি! কিন্তু আপনার মত একজন সম্ভান্ত ও সৎ ব্যবসায়ীকে বিব্রত করতে আমি চাই না। আপনার সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট খবরাখবর নিয়েছি। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু জেনে রাখুন যে আপনার পাওনাদাররা পর্যন্ত আপনার জন্য দুঃখিত। আচ্ছা, আজ আমি উঠি। সেপ্টেম্বর মাসের ৫ই তারিখে ঠিক এই সময় আমি আবার আসবো।
যুবকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মঁসিয়ে মোরেল অনুচ্চকণ্ঠে বললেন–নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবো মহান যুবক। যদি না পারি তাহলে আমাকে আর জীবিত দেখবেন না আপনি।
.
মঁসিয়ে মোরেলের ঘর থেকে বের হতেই যুবকটি দেখতে পেলো যে একটি তরুণী চুপ করে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
যুবকটি তার পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে বলে উঠলো-বাবার সঙ্গে আপনার কথাগুলো আমি সব শুনেছি। আপনি আমার এবং আমার মায়ের তরফ থেকে ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।
যুবকটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটির সামনে। তার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল–জুলি! পরক্ষণেই তাড়াতাড়ি আত্মসংবরণ করে নিয়ে সে আবার বললো–আপনিই কি মাদমোয়াসেল জুলি?
–হ্যাঁ, আমারই নাম জুলি। আপনি আমার নাম জানেন দেখছি!
মেয়েটির কথার সোজা উত্তর না দিয়ে যুবকটি বললো– একদিন ‘সিন্দবাদ নাবিক’ এই নাম সই-করা একখানা চিঠি আপনি পাবেন। ঐ চিঠির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন আপনি। মনে রাখবেন, আপনার বাবার তাতে উপকার হবে। বলুন করবেন?
–করবো।
–প্রতিজ্ঞা করছেন?
–করছি।
–বেশ, আমি তাহলে যাচ্ছি। কথাটা দয়া করে গোপন রাখবেন আশা করি।
এই বলেই যুবকটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
.
১৮.
৫ই সেপ্টেম্বর।
সেই যুবকটি বিদায় নিয়ে যাবার পর ঠিক তিন মাস অতীত হয়েছে আজ। এগারোটার সময় আসবার কথা আছে তার।
মঁসিয়ে মোরেলের মনের অবস্থা আজ খুবই খারাপ। সকালে। ঘুম থেকে উঠে যথারীতি সবার সঙ্গে বসে প্রাতরাশ শেষ করেছেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেছেন শোবার ঘরের দিকে। শোবার ঘরে গিয়ে একটা আলমারি খুলতে গিয়ে দেখতে পেলেন আলমারিটা চাবি বন্ধ। তিনি জুলিকে ডাকেন।
জুলি এলে গম্ভীরভাবে তিনি বললেন–আলমারির চাবিটা দাও তো মা!
–কেন বাবা?
–দরকার আছে।
–কি দরকার আমাকে বলো না!
–তর্ক করো না জুলি। যা বলছি তাই কর।
বাবার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার এর আগে কখন পায়নি জুলি। তার চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। চাবিটা বাবার হাতে দিল সে।
চাবিটা হাতে পেয়ে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–তুমি এখন তোমার মায়ের কাছে যাও। আমি না ডাকলে এ ঘরে যেন কেউ না আসে।
–আমি তোমার কাছে থাকতে চাই বাবা। আজ আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না! না–না–কিছুতেই যাব না। মঁসিয়ে মোরেল স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন–ছেলেমানুষী করো না মা, যাও। তুমি তো আমার কথার অবাধ্য হওনি কোনদিন!
–আগে হইনি, কিন্তু আজ হবো। আমি বুঝতে পারছি, তুমি আজ একটা সাংঘাতিক কিছু করবার মতলব করছো! এমন সময় সৈনিকের বেশধারী একটি যুবক এসে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে। মঁসিয়ে মোরেল তাকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন
–ম্যাক্সিমিলান!
জুলি বললো–দাদা! দাদা এসে গেছে! তাহলে আর আমার কোন ভয় নেই। তুমি বাবার কাছে বসো দাদা। এখান থেকে এক মিনিটের জন্যও বাইরে যেয়ো না, বুঝলে!
–কি হয়েছে জুলি? ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো।
–তা ঠিক জানি না দাদা, কিন্তু আজ বাবাকে একলা ছেড়ে যেতে আমার ভয় করছে।
এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
জুলি চলে যেতেই ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো–কি হয়েছে বাবা?
মঁসিয়ে মোরেল তার প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে বললেন– হঠাৎ চলে এলে যে? ছুটি পেয়েছে নাকি?
–না, ছুটি নিয়ে এসেছি।
–ছুটি নিয়ে এসেছে! কেন বলো তো?
–তা ঠিক বলতে পারি না। মায়ের কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে এসেছি আমি।
কি হয়েছে বাবা?
মঁসিয়ে মোরেল গম্ভীর স্বরে বললেন–বসো, বলছি।
ম্যাক্সিমিলান বসলে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–ফারাওঁ ডুবে গেছে শুনেছো?
–ফারাওঁ ডুবে গেছে!
–হ্যাঁ বাবা, আজ আমরা সর্বস্বান্ত! মোরেল অ্যান্ড সন আজ তাদের দেনার টাকা দিতে অক্ষম।
এই কথা বলবার সময় মঁসিয়ে মোরেলের চোখ দুটি জলে ভরে এলো।
ম্যাক্সিমিলান বললো–আমাদের কত টাকা দেনা বাবা?
–পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।
–কত আছে আমাদের?
–সতের হাজারের বেশি নয়।
–মাত্র?
–হ্যাঁ বাবা, মাত্র সতের হাজার।
–আর কোথাও কিছু পাওনা নেই?
–না। আর থাকলেও তা পাওয়া যাবে না।
–আমাদের তো বহুদিনের ব্যবসা। এমন কোন শুভানুধ্যায়ীও কি নেই আমাদের, যাঁর কাছ থেকে ধার পাওয়া যায়?
ম্যাক্সিমিলানের এই কথায় ম্লান হেসে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–ব্যবসার জগতে শুভানুধ্যায়ী বলে কোন কথা নেই। এখানে সবাই চায় লাভ–মুনাফা।
এই সময় আফিসের তরুণ ম্যানেজার এমানুয়েল ছুটতে ছুটতে সেই ঘরে এসে বললো–চৰ্বিশ হাজার ফ্রাঁর একখানা ড্রাফট এসেছে এইমাত্র।
মঁসিয়ে মোরেল আশ্চর্য হয়ে বললেন কি বললে! চব্বিশ হাজার ফাঁর ড্রাফট! আচ্ছা, তুমি যাও।
এমানুয়েল চলে যেতেই ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো– এমানুয়েলের সঙ্গে জুলির বিয়ের কি হলো বাবা?
–হবে না।
–হবে না!
–না। একজন দেউলের মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
–দেউলের মেয়ে?
–হ্যাঁ ম্যাক্সিমিলান, দেউলের মেয়ে। তোমার বাবা আজ দেউল, ফাঁকিবাজ, পাওনাদারদের দেনা মেটাতে অক্ষম। এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন
–এ অবস্থায় আমার কি কর্তব্য বলতে পারো?
ম্যাক্সিমিলানের দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বেরুলো না।
এই সময় ঘড়িতে দশটা বাজার শব্দ হলো।
মঁসিয়ে মোরেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন–আর এক ঘণ্টা পরে টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির প্রতিনিধি আসবে আমার কাছে! ওরা আমার কাছে পাঁচ লাখ ফ্রাঁ পায়। যে প্রতিনিধি আসবে, তার মত ভদ্র যুবক আমি খুব কমই দেখেছি। আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগে সে আমার কাছে এসেছিল। আমি তখন বলেছিলাম যে ফারাওঁ’ ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি টাকা দিতে অক্ষম। এই কথা শুনে যুবক নিজের দায়িত্বে আমাকে তিন মাসের সময় দিয়ে গিয়েছিল। আজ বেলা এগারোটায় সেই তিন মাস উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। ঠিক এগারোটায় সে আসবে টাকা নিতে।
–তাকে কি বলা হবে বাবা?
–কিছুই বলা হবে না। রক্ত দিয়ে অক্ষমতার অসম্মানকে ধুয়ে দেব। আমি আত্মহত্যা করবো।
–আত্মহত্যা করবে?
–হ্যাঁ ম্যাক্সিমিলান। আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। জোচ্চোর নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে আমি চাই না। তুমি সৈনিক, আশা করি আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারছে।
মঁসিয়ে মোরেলের এই কথায় ম্যাক্সিমিলান একেবারে যেন পাথর হয়ে গেল। তার মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না। মঁসিয়ে মোরেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন আলমারির দিকে।
আলমারি খুলে একটা পিস্তল বের করে সেটাকে খুলে পরীক্ষা করলেন। হয়তো পিস্তলে গুলি ভরা আছে কিনা দেখে নিলেন। তারপর আবার সেটাকে বন্ধ করে পকেটে ফেলে যেমন ধীরে ধীরে গিয়েছিলেন ঠিক সেই রকম ধীরে ধীরেই ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–এইবার আমাকে আফিস ঘরে যেতে হবে। অনেক কাজ শেষ করে যেতে হবে মরবার আগে।
–আমি কি তোমার সঙ্গে আসতে পারি বাবা?
–ইচ্ছা করলে আসতে পার। আমি জানি তুমি আমাকে বাধা দেবে না।
এই বলেই মঁসিয়ে মোরেল দরজার দিকে চলতে লাগলেন। ম্যাক্সিমিলানও চলতে লাগলো তার সঙ্গে সঙ্গে।
***
ম্যাক্সিমিলানকে বাবার কাছে রেখে জুলি সেই ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির সামনে আসতেই বাড়ির একটা চাকর একখানা খামে ভর্তি চিঠি তার হাতে দিয়ে বললো–আপনার চিঠি।
–আমার চিঠি! কে দিয়েছে?
–তা জানি না, একজন লোক এইমাত্র চিঠিখানা আমার হাতে দিয়ে বললো–এক্ষুণি চিঠিখানা মাদমোয়াসেল জুলির হাতে দিয়ে এসো।
জুলি খামখানা ছিঁড়ে চিঠি বের করে পড়তে লাগলো। চিঠিতে লেখা ছিল—
“এই চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনি এলিজ-দ্য-মিলানে চলে যান। ওখানে ১৫নং বাড়ির চারতলার দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটে যাবেন আপনি। দরজার সামনে একজন দরোয়ানকে দেখতে পাবেন। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবেন। ঘরের এক কোণে একখানি রুমালে বাঁধা কিছু জিনিস দেখতে পাবেন। রুমালখানা নিয়ে এসে আপনার বাবার হাতে দেবেন। আপনি একা যাবেন। আপনার সঙ্গে অন্য কোন লোক থাকলে দারোয়ান আপনাকে চাবি দেবে । স্মরণ রাখবেন, রুমালখানা বেলা এগারোটার আগেই আপনার বাবার হাতে আসা দরকার। আপনি আমার কথা রাখবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। প্রতিজ্ঞাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ইতি–
সিন্দবাদ নাবিক।”
চিঠিখানা পড়ে জুলি কি করবে ঠিক করে উঠতে পারলো না প্রথমটায়। একবার তার মনে হলো–হয়তো কোন দুষ্ট লোক তাকে বিপদে ফেলবার জন্য এই রকম ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সেদিনের কথা। সেই যুবকটির কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘সিন্দবাদ নাবিক’ সই করা চিঠির নির্দেশমত কাজ করবে সে।
এই সব কথা যখন সে চিন্তা করছে এই সময় এমানুয়েলকে দেখতে পেলো সে। এমানুয়েল তার বাবার ঘরের দিকে ছুটছিল। তাকে সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এমানুয়েল বললো–তুমি একটু উঁড়াও লক্ষ্মীটি, আমি এক্ষুণি আসছি। এই বলে সে মঁসিয়ে মোরেলের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পরেই মঁসিয়ে মোরেলের ঘর থেকে ফিরে এলো এমানুয়েল। জুলির হাতের চিঠিখানা দেখে সে বললো–কার চিঠি ওখানা?
জুলি চিঠিখানা এমানুয়েলের হাতে দিয়ে বললো–পড়ে দেখ।
চিঠিখানা পড়ে এমানুয়েল বললো–বেশ তো! চলো না, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
জুলি বললো–কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে দরোয়ান চাবি দেবে না, সে কথা পড়েছো তো?
–তাতে কি হয়েছে? তুমি একাই যেও। আমি তোমার জন্যে রাস্তায় অপেক্ষা করবো। যদি তোমার দেরি দেখি তখন আমি যাব।
ব্যবস্থাটা জুলির ভালই মনে হলো। ওরা তখন আর দেরি না করে ছুটলো এলিজ-দ্য-মিলানের দিকে।
***
এগারোটা বাজতে পাঁচ। মঁসিয়ে মোরেল আর ম্যাক্সিমিলান মুখোমুখি অবস্থায় টেবিলের দুই দিকে বসে।
একজন আরদালী এসে খবর দিল–টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানি থেকে একজন লোক এসেছে হুজুর।
মঁসিয়ে মোরেল বললেন–আচ্ছা তুমি যাও | দশ মিনিট পরে পাঠিয়ে দিও তাঁকে।
আবদালী চলে যেতেই পকেট থেকে পিস্তলটা বের করলেন মাসিয়ে মোরেল।
ম্যাক্সিমিলানের দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার মা আর জুলিকে তুমি…
…বাবা! বাবা!! বাবা!!!
হঠাৎ ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে জুলি এসে ঢুকলো সেই ঘরে।
মঁসিয়ে মোরেলের হাতে তখন গুলি-ভরা পিস্তল।
জুলি চিৎকার করে বলে উঠলো-বাবা! আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি! আমাদের কোম্পানির আর কোন দেনা নেই।
–আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি! কোম্পানি রক্ষা পেয়ে গেছে! কি বলছো জুলি!
–ঠিকই বলছি বাবা। এই দ্যাখো!
এই বলে সে রুমালে বাঁধা একটা ছোট পোঁটলা মঁসিয়ে মোরেলের হাতে দিল।
মঁসিয়ে মোরেল রুমালখানা খুলতেই দেখলেন যে, তার মধ্যে একখানা ভাজ-করা কাগজ।
কাগজখানার ভাজ খুলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানি তাদের সম্পূর্ণ টাকা বুঝে পেয়ে রসিদ লিখে দিয়েছে। কাগজখানা সেই রসিদ।
রুমালের আর এক কোণে কি একটা জিনিস বাঁধা ছিল। উঁসিয়ে মোরেল কম্পিতহস্তে সে দিকটা খুলতেই দেখতে পেলেন, তার মধ্যে রয়েছে একখানা মহামূল্য হীরে আর একখানা ছোট কাগজ। কাগজখানায় লেখা—
“জুলির বিয়েতে যৌতুক।”
কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলেন না মঁসিয়ে মোরেল। কেবল রুমালখানা দেখে তার যেন মনে পড়তে লাগল যে, ওখানা একদিন তাঁরই ছিল।
কিছুই বুঝতে না পেরে জুলির দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–একি ব্যাপার জুলি? এ তুমি কোথায় পেলে?
জুলি তখন সিন্দবাদ নাবিকের লেখা সেই চিঠিখানা বাবার হাতে দিয়ে বললো–এই চিঠির নির্দিষ্ট স্থানে।
চিঠিখানা পড়ে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–তুমি কি একা গিয়েছিলে সেখানে?
–না। এমানুয়েল আমার সঙ্গে ছিল। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
ঠিক সেই সময় আফিসের হেড-ক্লার্ক হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে।
সে এসেই বললো–ফারাওঁ! ফারাওঁ ফিরে আসছে মঁসিয়ে!
–কি বললে! তুমি কি ক্ষেপে গেলে নাকি?
–না মঁসিয়ে। পোর্ট অফিস থেকে খবর পেলাম, ফারাওঁ ফিরে আসছে। এই দেখুন পোর্ট অফিসের চিঠি।
“একি আশ্চর্য কাণ্ড! যে জাহাজ ডুবে গেছে, যার নাবিকদের উদ্ধার করে এনেছে অন্য এক জাহাজ, সেখানা কি করে ফিরে আসছে আবার!”
মঁসিয়ে মোরেলের বিশ্বাস হয় না এই অসম্ভব কথা। কিন্তু বিশ্বাস না হলেও তিনি চললেন বন্দরের দিকে। তার সঙ্গে চললো ম্যাক্সিমিলান, জুলি, মাদাম মোরেল আর এমানুয়েল। মোরেল কোম্পানির আফিসের কর্মচারীরাও চললেন এই অভাবনীয় খবর শুনে।
বন্দরে ঢুকতেই ওঁরা দেখলেন যে ইতিমধ্যেই বন্দর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। ডুবে-যাওয়া জাহাজ আবার ফিরে আসছে–এই অসম্ভব কথা শুনে মার্সেঈ-এর আবালবৃদ্ধবনিতা ভেঙে পড়েছে বন্দরে।
মঁসিয়ে মোরেল সপরিবারে বন্দরের ধারে এসে দাঁড়াতেই দেখা গেল একখানা জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। জাহাজের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা–”ফা রা ওঁ”!
সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো–ফারাওঁ! ফারাও! ফারাওঁ ফিরে আসছে!
মঁসিয়ে মোরেল যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। এ কি অসম্ভব কাণ্ড!
জাহাজখানি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো জেটির দিকে।
কাপ্তেন দাঁড়িয়ে আছে ডেকের উপরে।
হঠাৎ ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠলো–”জ্যাকোপো! জ্যাকোপো! আমার আন্তরিক ধন্যবাদ নাও বন্ধু।”
কাপ্তেন হাসিমুখে হাত উঠিয়ে অভিনন্দন জানালো সেই অদৃশ্য বক্তার উদ্দেশে। কিন্তু কে সেই বক্তা তা কেউ জানতে পারলো না।
বক্তা তখন লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল মঁসিয়ে মোরেলের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে বললো–বিদায় মঁসিয়ে মোরেল! ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনি সুখী হোন। এই বলে একটু থেমে সে মনে মনে আবার বললো–সজ্জনদের প্রতি আমার কর্তব্য এখানেই শেষ! এর পর থেকেই আরম্ভ হবে দুর্জনের বিরুদ্ধে আমার অভিযান। ফার্নান্দ! ড্যাংলার! ভিলেফোর্ট! তোমাদের দর্প চূর্ণ করতে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। তোমাদের ধ্বংসই আজ থেকে আমার সংকল্প।
.
১৯.
মার্সেঈ-এর সেই ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। প্যারিস শহরে তখন কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো নামে একজন লোক রীতিমত আঁকিয়ে বসেছেন। তার চাল-চলন আর রাজা বাদশার মত খরচের বহর দেখে সারা প্যারিস বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেছে।
প্যারিসের অভিজাত সমাজের প্রত্যেকের মুখেই তখন কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর নাম। অভিজাত মহলের প্রত্যেকটি প্রীতিভোজেই হয় কাউন্টের নিমন্ত্রণ।
সেদিন মারকাফ প্রাসাদে এমনি এক প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন ভাইকাউন্ট আলবার্ট-দ্য-মারকার্ফ। বলা বাহুল্য কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোও নিমজ্জিত হয়েছিলেন সেই প্রীতিভোজে।
কাউন্ট আসতেই আলবার্ট তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে তাকে স্বাগত জানালেন।
কাউন্ট বললেন–দেরি করে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন ভাইকাউন্ট। পনের শ’মাইল দূর থেকে আসতে হয়েছে বলেই ঠিক সময়ে পৌঁছোতে পারিনি আমি।
আলবার্ট আশ্চর্য হয়ে বললেন–দেরি! কৈ, দেরি তো হয়নি! সাড়ে দশটায় আসবার কথা ছিল আপনার, এখন তো দশটা একত্রিশও হয়নি।
কাউন্ট হেসে বললেন–কয়েক সেকেন্ড দেরিকেও আমি দেরি বলেই মনে করি।
আলবার্ট তখন কাউন্টকে তার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে বললেন–তাহলে আর বিলম্ব করে লাভ কি? আসুন, খেতে বসা যাক।
ভোজ টেবিল।
নানারকম রসনা-তৃপ্তিকর খাদ্য আর ফরাসী দেশের বিখ্যাত মদ পরিবেশন করা হয়েছিল নিমন্ত্রিতদের।
খেতে খেতে গল্প চলতে লাগলো। কথায় কথায় কাউন্ট বললেন–আপনার বিয়ের নিমন্ত্রণে কবে আসছি বলুন! আলবার্ট হেসে বললেন–আরও কিছুদিন দেরি আছে ও ব্যাপারে, তবে আমার ভাবী বধু ইউজিনি আর তার পিতা ব্যারন ড্যাংলার-এর সঙ্গে আজই আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো আশা করছি। তাদের আজ আসবার কথা আছে আমাদের বাড়িতে।
–ব্যারন ড্যাংলার! ব্যাঙ্কার কি তিনি?
–হ্যাঁ, তিনি এখন প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানের মালিক। আপনি চেনেন নাকি তাকে?
–না, ঠিক চাক্ষুষ পরিচয় নেই, তবে তার ব্যাঙ্কের উপরেই লেটার-অব গ্যারান্টি দিয়েছে আমার রোমের ব্যাঙ্কার মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চা কিন্তু মঁসিয়ে ড্যাংলার ব্যারন হয়েছেন, তা আমি জানতাম না।
–না জানবারই কথা, কারণ ইনি খুব অল্পদিন হলো ব্যারন। উপাধি পেয়েছেন।
–দেশ সেবার পুরস্কার বুঝি?
–অনেকটা তাই! আমাদের সরকার যখন টাকার অভাবে দেউলে হবার মত হয়েছিল সেই সময় মঁসিয়ে ড্যাংলার ষাট লাখ ফ্ৰাঁ ধার দেন সরকারকে।
এই সময় কাউন্ট হঠাৎ অন্য কথার অবতারণা করে ব্যারন ড্যাংলারের প্রসঙ্গ চাপা দেন।
এরপর আরও নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে। লাগলো সেই ভোজসভায়। নিমন্ত্রিত ভদ্রমহোদয়রা সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন কাউন্টের জ্ঞানের গভীরতা দেখে। তিনি যেন জীবন্ত একখানি বিশ্বকোষ। এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারেন না।
গল্প-গুজবের মধ্যে ভোজপর্ব শেষ হলো। এর পর এলো বিদায় নেবার পালা। কাউন্টকে বিদায় সংবর্ধনা জানাবার জন্যে আলবার্ট যখন বাইরে বেরিয়ে এলেন, ঠিক সেই সময় একখানি সুদৃশ্য ল্যান্ডো এসে থামলো সেই বাড়ির ফটকে। কাউন্ট লক্ষ্য করলেন যে, ঐ গাড়ির ঘোড়ার মত সুন্দর ও আশ্চর্য রঙের ঘোড়া সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। ঘোড়াটির গায়ে জেব্রার মত ডোরা কাটা।
কাউন্ট বললেন–বাঃ! চমৎকার ঘোড়াটা তো!
আলবার্ট হেসে উত্তর দিলেন–ব্যারন ড্যাংলারের ঘোড়া। এই বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন ব্যারন ও ব্যারনেস ড্যাংলার, আর তাদের পিছনে মাদমোয়াসেল ইউজিনি।
আলবার্ট তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কাউন্টের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
কাউন্ট সসম্মানে ব্যারনেস ড্যাংলারের সামনে মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি ব্যারনেস!
ব্যারনেস তখন স্মিত হাস্যে করমর্দন করলেন তাঁর সঙ্গে।
এর পর ইউজিনির সঙ্গে করমর্দন করে কাউন্ট এগিয়ে গেলেন ব্যারন ড্যাংলারের কাছে। সাগ্রহে তার সঙ্গে করমর্দন করে কাউন্ট বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম ব্যারন। আশা করি আমাদের এই পরিচয় শীঘ্রই আরও ঘনিষ্ঠ হবে।
ব্যারন ড্যাংলার বললেন–আপনার নাম আমি আগেই শুনেছি কাউন্ট। আজ ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম।
কাউন্ট বললেন–আমিও খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে। আমার খুশি হবার আরও কারণ এই যে, আপনার ব্যাঙ্কের উপরই ‘লেটার অব গ্যারান্টি’ পাঠিয়েছেন আমার রোমের ব্যাঙ্কার মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ।
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। তারপর কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো বিদায় নিলেন।
***
পরদিন সকালে একজন সুবেশ ভদ্রলোক এসে দেখা করলেন ব্যারন ড্যাংলারের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আলাপ-পরিচয়ের পর সেই ভদ্রলোক একেবারে কাজের কথা পেড়ে বসলেন।
তিনি বললেন–আপনার ঘোড়াটা যদি বিক্রি করেন, তাহলে আমি খুব ভাল দামে বিক্রি করিয়ে দিতে পারি।
ব্যারন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন–আমি ঘোড়া বিক্রি করবো, একথা কে বলেছে আপনাকে?
–না, কেউ বলেনি, তবে আমি যাঁর কাছ থেকে এসেছি তিনি চান আপনার ঐ ঘোড়ার মত একটা ঘোড়া। তাতে যত দামই লাগে।
ব্যারন তখন কৌতুক করবার জন্য বললেন–ধরুন যদি পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দাম চাই আমি!
–আমি এখনই দিতে প্রস্তুত আছি ব্যারন। টাকা আমার সঙ্গেই আছে।
ব্যারন আশ্চর্য হয়ে গেলেন আগন্তুকের কথা শুনে। ভাবলেন–বলে কি লোকটা! পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে একটা ঘোড়া কিনতে চায়! পাগল নাকি?
ব্যারনকে চুপ করে থাকতে দেখে আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন –অত ভাবছেন কি ব্যারন? আপনি রাজী থাকলে আমি এখনই পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিতে পারি আপনাকে।
এই বলে সত্যি সত্যিই ভদ্রলোক পকেট থেকে একগাদা ব্যাঙ্ক নোট বের করে টেবিলের উপর রাখলেন!
নোটগুলো দেখে লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ব্যারনের চোখ। তিনি বললেন–বেশ! আমি রাজী আছি। আপনি কি আজই নিয়ে যেতে চান ঘোড়াটাকে?
ভদ্রলোক বললেন–আজই নয়, এখনই।
ব্যারন ড্যাংলার তখন পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর নোট গুনে নিয়ে রসিদ লিখে দিলেন ভদ্রলোককে।
একটু পরেই ব্যারনের ঘোড়াটা নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
***
এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পরে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর গাড়িখানা এসে ব্যারন ড্যাংলারের বাড়ির দরজায় থামলো। ব্যারন আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, কাউন্টের গাড়ি টানছে তার সেই ঘোড়া!
কাউন্ট গাড়ি থেকে নেমে সোজা ব্যারনের বসবার ঘরে এসে তার সঙ্গে দেখা করলেন। ব্যারন বললেন–আসুন কাউন্ট! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমি।
কাউন্ট হেসে বললেন–হ্যাঁ, বৈষয়িক ব্যাপারগুলো সেরে ফেলবার জন্য আজ আসবো বলে খবর পাঠিয়েছিলাম। তা, কাগজ-পত্রগুলো কি এখানেই দেখাবো, আপনার ব্যাঙ্কে নিয়ে যাবো?
–ওগুলো কি আপনার সঙ্গে আছে?
–হ্যাঁ, সঙ্গে নিয়েই এসেছি আমি।
–বেশ, দিন তাহলে, এখানেই দেখে নিই।
কাউন্ট তখন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির দেওয়া ‘লেটার অব গ্যারান্টি’খানা বের করে ব্যারন ড্যাংলারের হাতে দিলেন।
কাগজখানা পড়ে ব্যারনের ভ্রূ কুঁচকে উঠলো।
তিনি বললেন–এতে বোধ হয় একটু ভুল আছে। টাকার অঙ্ক লেখা নেই দেখছি।
কাউন্ট বললেন–ভুল আছে! কৈ দেখি!
এই বলে কাগজখানা ব্যারনের হাত থেকে নিয়ে তার উপর একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন–না, ভুল তত নেই।
–সে কি! এতে তো দেখছি লেখা আছে অপরিমিত টাকার ক্রেডিট আপনাকে দিতে। এরকম “লেটার অব গ্যারান্টি” তো এর আগে আর কখনও দেখিনি।
কাউন্ট হাসতে হাসতে বললেন–তাহলে আমি কি মনে করবো যে ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির এই গ্যারান্টিপত্র আপনি বিশ্বাস করছেন না, অথবা আমার প্রয়োজনীয় টাকা দেবার ক্ষমতা আপনার নেই?
কাউন্টের এই কথায় ব্যারন ড্যাংলারের মুখ লাল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন–আমার আর্থিক ক্ষমতার কথাই যখন তুললেন, তখন আমি নিশ্চয়ই আপনার হিসাব আমার ব্যাঙ্কে খুলবো। বলুন, কত টাকা দরকার হবে আপনার? দশ লাখ ফ্রাঁ!
–দশ লাখ ফ্রাঁ। কাউন্ট হেসে বললেন–দশ লাখ ফ্রাঁ তো আমার পকেটেই থাকে সব সময়। ঐ সামান্য টাকার জন্য আপনার ব্যাঙ্কে হিসাব খুলবার দরকারই হতো না।
এই বলেই কাউন্ট পকেট থেকে একটা মরক্কো চামড়ার সুদৃশ্য নোটকেস বের করে তা থেকে প্রায় পনের লাখ ফাঁর নোট ব্যারন ড্যাংলারের টেবিলের উপরে রাখলেন।
ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ব্যারন ড্যাংলার আমতা আমতা করে বললেন–বেশ। তাহলে কত টাকা আপনার দরকার বলুন?
কাউন্ট মনে মনে হিসেব করে বললেন–তা ধরুন ষাট লাখ ফ্রাঁ তো বটেই।
ব্যারন বললেন–বেশ। ষাট লাখ ফ্রাঁই আপনি পাবেন। ব্যাঙ্কে গিয়ে লেখাপড়াটা সেরে আসবেন সময়মত।
ব্যারন ড্যাংলারের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ব্যারনেস ড্যাংলার ঝড়ের মত বেগে সেই ঘরে ঢুকে পড়লেন।
কৈফিয়ৎ চাইবার সুরে ব্যারনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন –আমার ঘোড়া অন্যের গাড়িতে দেখছি কেন? তুমি কি ওটা বিক্রি করেছে নাকি?
এই সময় কাউন্ট দাঁড়িয়ে উঠে ব্যারনের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তাহলে আসি ব্যারন। সময়মত ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা করবো আপনার সঙ্গে।
এই কথা বলেই কাউন্ট বেরিয়ে গেলেন সেই ঘর থেকে।
***
ঘণ্টা দুই পরের কথা।
একজন পত্রবাহক ব্যারনেস ড্যাংলারের নামে চিঠি নিয়ে এলো। চিঠিখানি খুলে ব্যারনেস পড়লেন
মাননীয়াসু—
আপনার ঘোড়াটি আমি অজ্ঞাতসারে কিনে ফেলেছিলাম বলে দুঃখিত। পত্রবাহকের সঙ্গে ঘোড়াটি ফেরত পাঠালাম। এর দাম আপনাকে দিতে হবে না। এটা আমার উপহার বলে মনে করলে খুশি হবো। ইতি
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো।
চিঠিখানি পড়ে অবাক হয়ে গেলেন ব্যারনেস। পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর দাবি এক কথায় যে লোক ছেড়ে দিতে পারে, তার টাকার পরিমাণ কত?
.
২০.
কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টোর কার্যধারার কিছুটা বিশ্লেষণ করা দরকার হয়ে পড়েছে। আগের পরিচ্ছেদে আপনারা জানতে পেরেছেন যে, কাউন্ট প্যারীতে এসে ভাইকাউন্ট আলবার্টের প্রীতিভোজে যোগদান করেছেন এবং ব্যারন ড্যাংলারের ব্যাঙ্কে হিসাবে খুলবার উদ্দেশ্যে অপরিমিত টাকার ‘লেটার অব গ্যারান্টি’ দাখিল করেছেন। তাছাড়া ব্যারনেস ড্যাংলারের ঘোড়াটা বহু টাকায় কিনে আবার তাঁকেই উপহার দিয়েছেন।
এ সবের উদ্দেশ্য কী?
এ উদ্দেশ্য একটা অবশ্যই আছে, আর সেটি হচ্ছে প্রতিহিংসা। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো ওরফে এডমন্ড দান্তে ভাল করেই তার শত্রুদের সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়েছেন। ড্যাংলার, ফার্নান্দ ও ভিলেফোর্ট সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন যে, ওরা তিনজনেই এখন প্যারীর অভিজাত সমাজে বিখ্যাত তোক বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। জেলের ছেলে ফার্নান্দ এখন কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ আর জাহাজের কেরানী ড্যাংলার হয়েছে ব্যারন ড্যাংলার।
ফার্নান্দের সম্বন্ধে আরও যে সব খবর তিনি জানতে পেরেছেন, সেগুলি অত্যন্ত মারাত্মক! তিনি খবর পেয়েছেন যে, প্যারীতে আসবার আগে সে জেনিনায় আলী পাশার সৈন্যাধ্যক্ষ ছিল। তিনি আরও খবর পান যে, আলী পাশার মৃত্যুটাকে জেনিনার লোকেরা গুপ্তহত্যা বলে মনে করে।
আলী পাশার দুর্গ রক্ষার ভার ছিল ফার্নান্দের উপরে। পাশার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাও ঐ দুর্গেই ছিলেন তখন। কিন্তু আলী পাশার মৃত্যুর পর রহস্যজনকভাবে ঐ দুর্গটি শত্রুদের করায়ত্ত হয় এবং তার স্ত্রী কন্যার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
এই সব খবর যোগাড় করবার পরই কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো প্যারিতে চলে আসেন। তাঁর মনের মধ্যে তখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে প্রতিহিংসার আগুন। কিন্তু সে আগুন তিনি হাবভাবে বা চালচলনে একেবারেই প্রকাশ পেতে না দিয়ে স্থির মস্তিষ্কে বৈরনির্যাতনের কাজে লেগে যান। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মার্সেদেস তখন ঐ ফার্নান্দ ওরফে কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ-এর স্ত্রী, আর ভাইকাউন্ট আলবার্ট তার ছেলে আলবার্টের সঙ্গে ড্যাংলারের মেয়ে ইউজিনির বিয়ের সম্বন্ধের কথাও জানতে পান তিনি। এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, কাউন্ট আলী পাশার স্ত্রী-কন্যার খোঁজে জেনিনাতেও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কতকগুলো গোপন খবর যোগাড় করে তিনি দস্যু-দলপতি লুইগি ভাম্পার সঙ্গে দেখা করেন। তারপর তাকে সঙ্গে করে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে এসেছেন। লুইগি ভাম্পার সঙ্গে তার পরিচয় হয় ‘এমেলিয়া’ জাহাজের কাপ্তেনের মধ্যস্থতায়। লুইগি ভাম্পার সঙ্গে তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন বা কি কাজ করেছিলেন, সে সব কথা প্যারীর লোকেরা কিছুই জানতো না। তারা শুধু জানতো যে প্যারী শহরে কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো নামে একজন অসাধারণ লোকের আবির্ভাব হয়েছে–যে লোক ইচ্ছা করলে গোটা ফরাসী দেশটাই কিনে নিতে পারে।
প্যারীতে যে বাড়িখানা তিনি কিনেছিলেন, সেখানাকে লোকে আগে ভূতের বাড়ি বলতো। কিন্তু ঐ ভূতের বাড়িকেই তিনি যেন আলাদীনের দৈত্যের সাহায্যে রাজপ্রাসাদে পরিণত করে। ফেলেছেন।
আমরা যেদিনের কথা বলছি, ঐ বাড়িতে এক ইটালিয়ান মেজরের শুভাগমন হয়েছিল। মেজর মহাশয়ের নাম বার্তোলোমিও ক্যাভালকান্টি। ভদ্রলোক ফাদার বুসেনি নামে এক ধর্মযাজকের কাছ থেকে একখানা পরিচয়পত্র নিয়ে কাউন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
কাউন্টের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানালেন মেজর সাহেবকে। তিনি বললেন–স্বাগতম মেজর ক্যাভালকান্টি, আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
–সে কি! আমি যে আজ আসবো সে খবর আপনাকে আগে জানাইনি!
–আপনি না জানালেও আমি তা জানতে পেরেছি। ফাদার বুসেনি আমাকে আপনার সম্বন্ধে সব কথাই বলেছেন। আপনি তো অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর?
–মেজর! তা হবে।
–তা ছাড়া আপনিই তো ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ক্যাভালকান্টি বংশের বর্তমান উত্তরাধিকারী..অর্থাৎ ক্যাভালকান্টি পরিবারের অতুল ঐশ্বর্যের মালিক, কেমন সত্যি কি না?
–এসব কথাও বুঝি ফাদার বুসেনি বলেছেন?
–তা ছাড়া আর কে বলবে? যাই হোক, আপনার কোন চিন্তা নেই। আপনার নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের সন্ধান আমার কাছ থেকেই পাবেন, তা ছাড়া ফাদার বুসেনির নির্দেশমত পাঁচ হাজার ফ্ৰাঁও আমি আজই দিয়ে দেব আপনাকে। সে যাই হোক, আপনার হাতে ফাদার বুসেনি কোন চিঠিপত্র দিয়েছেন কি?
মেজর ক্যাভালকান্টি বললেন–হ্যাঁ, দিয়েছেন।
এই বলে পকেট থেকে একখানা খামে বন্ধ চিঠি বের করে কাউন্টের হাতে দিয়ে বললেন–এই যে!
চিঠিখানা গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ে কাউন্ট বললেন– ফাদার বুসেনি টাকার বিষয়ে কিছু বলেছেন কি আপনাকে? কাউন্টের এই কথায় মেজর মহোদয় যেন বেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন।
তিনি বললেন–হ্যাঁ, মানে ফাদার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি নাকি আপনার কাছে…
–কি বলেছিলেন বলুন!
–বলেছিলেন যে তিনি নাকি আপনার কাছে চল্লিশ হাজার ফ্ৰাঁ পান।
–হ্যাঁ, ঐ টাকা তিনি আপনাকে দিতে বলেছেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন; আমি চেক দিয়ে দিচ্ছি। আর ইতিমধ্যে আপনি ইচ্ছা করলে আপনার ছেলের সঙ্গেও দেখা করতে পারেন। সে পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছে।
–আমার ছেলে! মানে…
–হ্যাঁ, আপনার নিরুদ্দিষ্ট ছেলে এন্ট্রি ক্যাভালকান্টি। আমি সব খবরই শুনেছি ফাদার বুসেনির কাছে। আপনি যে গোপনে অলিভা কার্সিনারী নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই সার্টিফিকেট আর সারাজেভের মিউনিসিপ্যাল অফিসে আপনার ছেলে এন্ট্রির জন্ম রেজিস্ট্রির সার্টিফিকেটও আমার কাছে আছে, এই নিন।
এই বলে কাউন্ট পকেট থেকে একখানা লম্বা খাম বের করে মেজর ক্যাভালকান্টির হাতে দিলেন।
মেজর ক্যাভালকান্টি তখন খামখানা খুলে তার ভিতর থেকে সেই সার্টিফিকেট দু’খানা বের করে পড়ে দেখতে লাগলেন।
কাউন্ট বললেন–কেমন, ঠিক আছে তো?
-–ঠিক আছে বলেই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু…
–আর কোন কিন্তু নয় মেজর! আপনি আপনার হারানো ছেলে আর সঙ্গে চল্লিশ হাজার ফ্রঁ আজই পাবেন। এরপর আপনি প্যারীতে আপনার সামাজিক পদগৌরব নিয়ে বাস করবেন। আপনাদের যাতে কোন রকম অসুবিধা না হয়, তার জন্য একখানা বাড়ি ভাড়া করে রেখেছি আপনার জন্য। এইবার যান, আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা করুন গিয়ে।
–তা যাচ্ছি, কিন্তু…
–কিন্তু কি আবার?
–মানে–ঐ টাকাটা…
–ও, আচ্ছা দাঁড়ান, টাকাটা এখনই দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। এই বলে পকেট থেকে চেক বই বের করে ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কের উপরে চল্লিশ হাজার ফ্রাঁর একখানা চেক কেটে মেজর ক্যাভালকান্টির হাতে দিলেন কাউন্ট।
চেকখানা হাতে পেয়ে মেজর বললেন–আমি তাহলে…
–হ্যাঁ। ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন এবার।
মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার তাকে ডাকলেন–হ্যাঁ শুনুন।
তাড়াতাড়ি ফিরে দাঁড়িয়ে মেজর বললেন–কি বলছেন। কাউন্ট?
–আপনি আপনার ব্যাঙ্কের হিসাব ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কেই খুলবেন।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
তিনি চলে যেতেই কাউন্টের ঠোঁটের কোণে যেন একটু দুষ্ট হাসি খেলে গেল বলে মনে হলো।
***
মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরে ঢুকতেই একটি বিশ-একুশ বছরের ছেলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলো। মেজর ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে চললেন।
ছেলেটি বললো–আপনি?
–আমার নাম মেজর ক্যাভালকান্টি। বার্তোলোমিও ক্যাভালকান্টি।
–বাবা!
ছেলেটির মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনবার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মেজর দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–এন্ড্রি, বাপ আমার! এতদিন পরে তোমাকে তাহলে সত্যিই ফিরে পেলাম আমি!
এন্ড্রি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো–বাবা, আজ যে আমার কী সুখের দিন, তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত বলেই বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে সে আবার বললো–কিন্তু কেবলকান্ত মহাশয়! আমার বাবা সাজবার জন্য তুমি কত পেয়েছো বলো দিকিনি?
পুত্রের কথায় মেজর ক্যাভালকান্টি হঠাৎ তড়িতাহতের মতো চমকে উঠে বললেন–এ তুমি কি বলছ এন্ট্রি?
–ঠিকই বলছি বাবা মশাই। আমিও তোমারই মতো এখানে আমদানি হয়েছি। মোটা টাকা পেয়েছি তোমার ছেলে সাজবার জন্য।
এই সময় কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেজর সাহেব ফিসফিস করে বললেন–চুপ! কাউন্ট আসছে।
পিতা-পুত্রের এই মিলন দৃশ্য দেখে খুশি হয়ে কাউন্ট বললেন–তাহলে এন্ট্রি! পিতাকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়েছে নিশ্চয়ই? এন্ড্রি বললো খুশি বলে খুশি, এরকম ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা তো আমি ভাবতেই পারিনি!
কাউন্ট মৃদু হেসে বললেন–হয় বাপু হয়, দুনিয়ায় অনেক কিছুই হয়, যা তুমি বা আমি বুঝতেই পারি না। যাই হোক, তুমি এবার তোমার বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে চলে যাও। ওখানে সব ব্যবস্থাই করা আছে। তাছাড়া তোমরা যাতে ভালভাবে থাকতে পারো, তার জন্য বছরে বার লক্ষ ফ্রাঁর ব্যবস্থা করে রেখেছি আমি! ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কের চেক কাটলেই টাকা পাবে তোমরা।
বৃদ্ধ মেজর কিন্তু একেবারেই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন কাউন্টের কাণ্ডকারখানা দেখে। তার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হলো না।
কাউন্ট তখন বৃদ্ধের পিঠে মৃদু করাঘাত করে বললেন– আমি বুঝতে পারছি মেজর, বহুদিন পরে ছেলের দেখা পেয়ে আপনি খুবই বেসামাল হয়ে পড়েছেন। তা এ রকম হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক, এখন আপনারা আসুন, আমি একটু কাজে বের হব।
পিতা-পুত্র ততক্ষণ আলিঙ্গনমুক্ত হয়েছেন। ওঁরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার বললেন–হ্যাঁ, এখনকার মত যান, তবে আমি শীগগির আপনাদের সংবর্ধনার জন্য একটা প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করবো। প্যারীর অভিজাত সমাজের সঙ্গে আপনাদের পরিচয়ও হবে ঐ ভোজসভাতেই।
এই বলে কাউন্ট ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কাউন্ট চলে গেলে সপুত্র ক্যাভালকান্টিও ধীরে ধীরে বিদায় হলেন।
***
কয়েক দিন পরের কথা। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো তার পল্লীভবনে এক বিরাট প্রীতিভোজের আয়োজন করেছেন। এই পল্লীভবনটি বহুদিন খালি অবস্থায় পড়ে ছিল, কিন্তু কাউন্ট এটাকে কিনে নিয়ে একেবারে রাজপ্রাসাদে পরিণত করে ফেলেছেন।
কাউন্টের নিমন্ত্রণে প্যারীর অভিজাত মহলের প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ব্যারন ও ব্যারনেস ড্যাংলার, মঁসিয়ে ও মাদাম ভিলেফোর্ট, কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ, মেজর ক্যাভালকান্টি ও এন্ট্রি ক্যাভালকান্টিও ছিলেন।
যথাসময়ে খানা-পিনা শেষ হয়ে যাবার পর ব্যারনেস ড্যাংলারের দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বললেন–এই বাড়ির দোতলায় একখানা রহস্যময় ঘর আছে, দেখবেন?
কাউন্টের এই কথায় মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন–তার চেয়ে চলুন, বসে বসে গল্প করা যাক।
কাউন্ট বললেন–কিন্তু ঐ ঘরে আপনারা এমন কিছু দেখতে পাবেন যা এর আগে কখনও দেখেননি। আমি এই বাড়িখানা কিনবার পর যেদিন প্রথম ঐ ঘরে যাই, সেই দিনই কেন যেন আমার মনে হয়েছিল যে, ঐ ঘরে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার, অর্থাৎ একটা অমানুষিক পাপকার্যের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ঘরটাতে ঢুকলে এখনও যেন মনে হয় যে, ওখানে কোন হতভাগ্যের আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাই হোক, মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট যখন যেতে চাইছেন না, তাহলে বরং…
কাউন্টের কথায় বাধা দিয়ে মাদাম ভিলেফোর্ট বললেন– আমরা দেখতে চাই সে ঘর। চলুন।
ঘরখানি ছিল দোতলায় দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে নিয়ে কাউন্ট সেই ঘরের সামনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটি খুলে ফেললেন। দরজা খুলবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। যেন একটি সদ্যোজাত শিশু কেঁদে উঠলো কোথাও।
ভিতরে ঢুকে সবাই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, ঘরখানা অনেকটা সুতিকাঘরের মতো সাজানো। ঘরে কোন আলো নেই, জানালা-দরজায় লাল পর্দা ঝুলছে। মেঝের উপরে একখানি ছোট খাট, খাটের পাশে একখানা ছোট টেবিল ও তোয়ালে রাখবার স্ট্যান্ড স্ট্যান্ডের উপর একখানা তোয়ালে। মাদাম ভিলেফোর্ট বললেন–কি বিশ্রী!
তার কথার জের টেনে কাউন্ট বললেন–শুধু বিশ্রী নয় মাদাম, ভয়াবহ! এই ঘরে, হ্যাঁ, ঠিক এই ঘরে আজ থেকে বিশ বৎসর আগে একটা সাংঘাতিক অপরাধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
মাদাম ভিলেফোর্ট হেসে বললেন–সাবধান কাউন্ট, ‘প্রকিওরার দ্য রোয়া’, (রাজকীয় অভিযোক্তা) এখানে উপস্থিত আছেন, সে কথাটি ভুলে যাবেন না যেন!
কাউন্ট হেসে বললেন–না মাদাম, সে কথা আমি ভুলে যাইনি। তাছাড়া আমার মনে হয় মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট উপস্থিত থাকায় ভালই হয়েছে।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কি বলতে চাইছেন আপনি? কাউন্ট বললেন–আমি বলতে চাইছি যে, আজ থেকে বিশ বছর আগে এই ঘরে কোন মহিলা একটি সন্তান প্রসব করেন।
–আপনি কি আমাদের কোন রূপকথার গল্প শোনাতে চান নাকি কাউন্ট! বললেন মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট।
–মোটেই না। আমি বলতে চাই যে, এই ঘরে সেদিন যে ছেলেটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, তার পিতা…তার দুরাচার লম্পট জন্মদাতা, নিজ হাতে সেই শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে…
এই সময় হঠাৎ ব্যারনেস ড্যাংলার অস্ফুট আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কাউন্ট তাড়াতাড়ি একটি স্মেলিং সল্টের শিশি এনে ব্যারনেসের নাকের কাছে ধরে মাথায় হাওয়া দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।
জ্ঞান ফিরে আসতেই তিনি বললেন–আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। আমি বাইরে যেতে চাই।
কাউন্ট বললেন–তাহলে চলুন, এই ঘরের পেছনে যে গোপন সিঁড়ি আছে, সেই সিঁড়ি দিয়েই বাগানে যাওয়া যাবে।
এই বলেই কাউন্ট ঘরের অন্যদিকে গিয়ে একটা গুপ্ত দরজা খুলে ফেললেন।
নিমন্ত্রিতেরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, দরজার সামনেই একটা সরু সিঁড়ি, যার অস্তিত্ব বাইরে থেকে, এমনকি ঘরের ভিতর থেকেও বুঝতে পারা যায় না।
সিঁড়িটা দেখে মেজর ক্যাভালকান্টি বললেন–এটা যেন। গোপন সিঁড়ি বলে মনে হচ্ছে!
কাউন্ট বললেন–ঠিকই বলেছেন মেজর। এ সিঁড়ির অস্তিত্ব বাইরের কোন লোক জানতো না। এর অস্তিত্ব জানতো শুধু সেই লোক যে এটাকে তৈরি করিয়েছিল।
–তার মানে? এবারের প্রশ্ন এলো মাদাম ভিলেফোর্ট-এর মুখ থেকে।
–মানে, যে ভদ্রলোক এই সিঁড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন তিনিই ছিলেন সেই হতভাগ্য শিশুর অবৈধ পিতা। এই ঘরে থাকতেন সেই মহিলা, যিনি অবিবাহিতা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, আর তারই চিকিৎসা ও প্রসবের জন্য ডাক্তার আর নার্স এই গোপন সিঁড়ি দিয়ে আনাগোনা করতো।
এই পর্যন্ত কথা হতেই নিচের বাগানে এসে পড়লেন সবাই।
কাউন্ট কিন্তু তখনও বলে চলেছেন। তিনি বললেন–আর এই সিঁড়ি দিয়েই সেই হতভাগ্য শিশুটিকে নিয়ে আসে তার পিতা…এই কাউন্টের কথায় বাধা দিয়ে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কি সব যা তা বলছেন কাউন্ট! আপনি কি জানেন না যে, আপনার এই অভিযোগ কি রকম সাংঘাতিক!
–জানি বৈ কি মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট, কিন্তু আমি যা বলছি তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে আমার হাতে।
–প্রমাণ!
–হ্যাঁ, প্রমাণ। আমি জানি যে সেই দুরাচর লম্পট সেদিন সেই সদ্যোজাত শিশুটিকে এই সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে এসে ঐ জায়গায় (এই বলে আঙুল দিয়ে একটা কলাগাছের ঝাড়ের দিকে দেখিয়ে)–হ্যাঁ, ঠিক ঐ জায়গায় তাকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দিয়েছিল।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন মিথ্যা কথা! আপনি কি করে জানলেন এত কথা?
—উত্তেজিত হবে না মাঁসিয়ে প্রকিওরার, শুনে যান। আমার চাকররা ঐ জায়গায় গাছ লাগাবার উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ একটি শিশুর অবিকৃত কঙ্কাল আবিষ্কার করে।
—কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয় নাকি যে, শিশুটিকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়া হয়েছিল?
কাউন্ট মৃদু হেসে বললেন—আপনি বােধ হয় উচ্চাসনে বসে প্যারিসের সামাজিক নিয়মকানুনগুলো ভুলে গেছেন। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এই বাগানটি গােরস্থান নয়। তা ছাড়া সদ্যোজাত মৃত শিশুকে কবর দেবার আগে তার মাথাটা কেটে ফেলবার নিয়ম আছে, কিন্তু এখানে যে কঙ্কাল পাওয়া যায়, সেটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
এই কথা শুনে ব্যারনেস ড্যাংলার আর একবার আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
ব্যারনেস ড্যাংলারকে এইভাবে দু-দুবার অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন।
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো যেন খুবই দুঃখিত হয়েছেন, এই রকম ভাব দেখিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন ব্যারনেসের দিকে। তারপর স্মেলিং সল্ট এনে তাঁর নাকের কাছে ধরতেই তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলেন।
ব্যারনেস ড্যাংলারের জ্ঞান ফিরে আসতেই কাউন্ট অত্যন্ত আহতস্বরে বললেন—আমি খুবই দুঃখিত মাদাম। এ গল্প আপনার সামনে বলা আমার মোটেই উচিত হয়নি।
এই বলেই তিনি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মসিয়ে ভিলেফোর্টের দিকে তাকালেন। মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট তখন কাউকে কিছু না বলে ব্যারনেস ড্যাংলারকে ধরে নিয়ে তার গাড়ির দিকে চলতে লাগলেন।
***
এই ঘটনার কয়েক দিন পরে আর্লিন্স-এর এক ছোট্ট টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে একটি বিদেশী লোককে দেখা গেল। টেলিগ্রাফ অফিসটা ছিল একটা পাহাড়ের চূড়ার উপরে। যখনকার কথা হচ্ছে সেই সময় বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। তখন সংবাদের আদান-প্রদান চলতো পতাকা ও আলোর সাহায্যে। দিনের বেলায় পতাকা আন্দোলিত করে ও রাত্রিকালে আলোকসংকেত করে টেলিগ্রাফ করা হত তখন।
যে টেলিগ্রাফ অফিসটার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ছিল একজন মাত্র কেরানী। কেরানীটির বাসাও ছিল ঐ আফিসের সঙ্গেই লাগানো।
বিদেশী লোকটি মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন আফিসের মধ্যে!
তাকে দেখে কেরানী জিজ্ঞাসা করলো–কি চান আপনি?
লোকটি মৃদু হেসে বললেন–চাই না বিশেষ কিছু, শুধু একটু আলাপ করতে এলাম।
–আলাপ করতে এলেন! কী ব্যাপার বলুন তো?
–বললাম তো, ব্যাপার বিশেষ কিছু নয়। আমি এসেছি আপনাকে কিছু টাকা দিতে, এই ধরুন, পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।
–পাঁচ লাখ ফ্রাঁ। বলেন কি?
–ঠিকই বলছি। ইচ্ছা করলে এখনই নিতে পারেন ঐ টাকা। এই কথা বলেই তিনি তার হাতের অ্যাটাচি কেসটা খুলে কেরানীর সামনের টেবিলের উপর রাখলেন।
কেরানী সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে যে অ্যাটাচি কেসটা গাদা গাদা ব্যাঙ্ক নোটে ভর্তি।
লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চোখ দুটি। সে বললো– কিন্তু আমাকে এত টাকা কেন দেবেন আপনি!
আগন্তুক হেসে বললেন–হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্নের মত প্রশ্ন বটে! কথাটা কি জানেন, আপনাকে একটা টেলিগ্রাম করতে হবে। সামান্য কাজ। আর এই সামান্য কাজটা করবার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ লাখ ফ্রাঁ পেয়ে যাবেন আপনি।
–কি টেলিগ্রাম দেখি!
বিদেশী লোকটি তখন তার পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে কেরানীর হাতে দিলেন।
কাগজখানায় লেখা ছিল…
“স্পেনের নির্বাসিত রাজা ডন কালো বোর্জেস থেকে পালিয়েছেন। সংবাদ পাওয়া গেছে যে, তিনি ক্যাটালোনিয়া পার হয়ে স্পেনে ঢুকে পড়েছেন। আরও জানা গেল যে রাজা (স্পনের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অধিবাসীরা তার পক্ষে যুদ্ধযাত্রা করেছে।”
কাগজখানা পড়ে দেখে কেরানী বললো–কী সর্বনাশ! এই টেলিগ্রাম পাঠালে যে আমার চাকরি যাবে!
–তাতে কি হয়েছে? সারা জীবন চাকরি করেও আপনি পাঁচ লাখ ফ্রাঁ রোজগার করতে পারবেন না। তাছাড়া চাকরিই বা যাবে কেন? আজ বেশ কুয়াশা আছে। আপনি বলবেন যে কুয়াশায় টেলিগ্রামের সংকেত ঠিকমত বুঝতে না পেরেই এই রকম ভুল সংবাদ পাঠানো হয়েছে।
কেরানী আমতা আমতা করে বললো–তাহলেও চাকরি থাকবে না।
–তা না থাকলেই বা! আপনি এই পাঁচ লাখ ফ্রাঁ নিয়ে আপনার বাকি জীবনটা বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দেই কাটিয়ে দিতে পারবেন।
***
সেই দিনই সন্ধ্যায় সারা প্যারিসে রটে গেল খবরটা। প্রত্যেক লোকের মুখে শুধু ঐ কথা। খবরের কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ বেরিয়ে গেল স্পেনের নির্বাসিত রাজা ডন কালোর প্রত্যাবর্তনের খবর বড় বড় হরফে ছেপে।
এই খবর বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই স্পেনিস হুণ্ডীর দাম পড়ে যেতে লাগলো।
শহরময় হুড়োহুড়ি লেগে গেল ওগুলো বিক্রি করবার জন্য। সবাই বিক্রি করতে চায়, কেনবার লোক কেউ নেই।
ড্যাংলার কোম্পানির আফিসে খবরের পর খবর আসতে লাগলো। যার যত স্পেনিস হুণ্ডী ছিল, সেগুলোকে যে কোন দরে বিক্রি করে দিতে নির্দেশ আসতে লাগলো আমানতকারীদের পক্ষ থেকে।
ড্যাংলার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। মাত্র কয়েকদিন আগে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর দেখাদেখি তিনি তার আজীবনের সঞ্চয়ও, এমনকি, ব্যাঙ্কের গচ্ছিত টাকা থেকেও বহু লক্ষ ফ্রাঁ নিয়ে প্রায় সত্তর লক্ষ স্ট্রার (স্পনিস তৃণ্ডী কিনেছিলেন। তিনি তখন বাধ্য হয়ে কম দরে ঐ তৃণ্ডীগুলো বিক্রি করে
আমানতকারীদের টাকা জমা করে দিলেন। ফলে নিজস্ব নগদ টাকা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না তার।
এ এদিকে যুদ্ধের খবরটা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো দালাল লাগিয়ে বাজার থেকে সবগুলো (স্পনিস হুণ্ডী বেনামীতে কিনে ফেললেন।
***
এর পরদিনই এক সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো আগের দিনের খবরটাকে মিথ্যা ও ভুয়া খবর বলে ঘোষণা করে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো—”গতকল্য প্যারিসের সংবাদপত্রসমূহে স্পেনের নির্বাসিত রাজার সম্বন্ধে যে সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল, উহা একেবারেই ভিত্তিহীন। কুয়াশার জন্য কোন টেলিগ্রাফ অফিসের কেরানী একটা সাংকেতিক সংবাদ বুঝিতে ভুল করিবার জন্যই এইরূপ ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারিত হইয়াছিল।”
এই সরকারি প্রতিবাদ প্রকাশিত হবার ফলে (স্পনিস হুণ্ডীর দাম আবার বেড়ে যেতে লাগলো। অবস্থা এমন হয়ে উঠলো যে, আগে যে দাম ছিল তা থেকেও কিছু বেড়ে গেল স্পেনিস হুণ্ডীর দাম।
কিন্তু এই ব্যাপারে প্যারীর বিখ্যাত ব্যাঙ্কার ব্যারন ড্যাংলার একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন।
২১-২৩. স্পেনের বাজার পলায়ন
স্পেনের বাজার পলায়ন রহস্যের জের মিটবার আগেই আর এক দারুণ খবর প্রকাশিত হলো প্যারিসের এক বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায়।
খবরটির শিরোনাম ছিল–”আলী পাশার হত্যা রহস্য।”
সংবাদদাতা লিখেছিলেন–”জেনিনার সুলতান আলী পাশার মৃত্যু ও জেনিনার পতনের ইতিহাস এতকাল রহস্যাবৃত ছিল, কিন্তু সম্প্রতি এমন কতকগুলো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ আমাদের হস্তগত হয়েছে যা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পেরেছি যে, আলী পাশাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়। যে নরপশুর বিশ্বাসঘাতকতায় আলী পাশার মৃত্যু হয়, সে ছিল তারই একজন সেনাপতি। খবরাখবর নিয়ে আরও জানা গেছে যে, ঐ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি শুধু আলী পাশাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নাই, সে তাঁর প্রাসাদটিও অরক্ষিত অবস্থায় শত্রুদের হাতে তুলে দেয়। নাটকের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঐ বিশ্বাসঘাতক নরপশু আলী পাশার মহিষী ও তার একমাত্র কন্যা প্রিন্সেস হাইদীকে পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁর বিনিময়ে এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে।
গভীর লজ্জার এবং দুঃখের কথা এই যে, ঐ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি আজ প্যারিসের অভিজাত মহলে কাউন্ট খেতাব নিয়ে সগর্বে বিচরণ করছে।
জনসাধারণ ও সরকারের অবগতির জন্য লোকটির নামও আমরা প্রকাশ করছি। এর আগের নাম ছিল ‘ফার্নাল মন্ডেগু’, যে বর্তমানে কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ নামে পরিচিত।”
***
এই সাংঘাতিক সংবাদটি যখন খবরের কাগজে বের হলো, মহামান্য কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন শাসন-পরিষদের সভায় তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট।
ফ্রান্সের শাসন-সংক্রান্ত ব্যাপারে যে উচ্চতম পরিষদের সদস্যবৃন্দ রাজাকে সুপরামর্শ প্রদান করে থাকেন, কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ সেই সভার একজন মাননীয় সদস্য।
সভার কাজ তখন চলছে, এই সময় একজন সদস্যকে সংবাদপত্রের একখানি বিশেষ সংখ্যা হাতে নিয়ে রীতিমত উত্তেজিতভাবে সভাকক্ষে প্রবেশ করতে দেখা গেল। মাননীয় সদস্য সোজা সভাপতির কাছে গিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নকণ্ঠে কি সব বলে সেই কাগজখানা তার হাতে দিলেন।
সভাপতিও গভীর মনোযোগের সঙ্গে খবরের কাগজখানা পড়তে লাগলেন। কাগজখানা পড়বার সময় তার মুখের ভাব মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হতে লাগলো। উপস্থিত সদস্যরা কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে মাননীয় সভাপতির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
খবরটা পড়া হয়ে গেলে সভাপতি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে তার স্বভাবসুলভ গভীরকণ্ঠে বললেন–মাননীয় সদস্যবৃন্দ! এইমাত্র সংবাদপত্রে একটি অতি গুরুতর বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টা এতই গুরুতর এবং বিশেষ করে ঐ সংবাদের সঙ্গে আমাদের এই পরিষদের সম্মান এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে, আমি এ ব্যাপারটাকে আপনাদের গোচরে না এনে পারছি না।
এই পর্যন্ত বলেই তিনি খবরের কাগজে প্রকাশিত সেই সাংঘাতিক সংবাদটি উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনালেন সদস্যদের কাছে।
পড়া হয়ে গেলে, তিনি বললেন–মাননীয় কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ এখন এখানেই উপস্থিত আছেন। আমি তাকে অনুরোধ করছি, তিনি এই জঘন্য হীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদকে অস্বীকার করে সভার সামনে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করুন যে, সংবাদপত্রে যে সব কথা লেখা হয়েছে ওগুলো একেবারেই মিথ্যা।
সভাপতির এই কথায় উপস্থিত সভ্যবৃন্দ সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন–নিশ্চয়! নিশ্চয়!
কিন্তু কাউন্ট-দ্য-মারকাফের মুখ তখন মৃতের মতো পাণ্ডুর ও রক্তহীন হয়ে গেছে। তিনি কোন কথাই বললেন না।
তাকে নীরব দেখে সভাপতি আশ্চর্য হয়ে বললেন–সে কি কাউন্ট! আপনি চুপচাপ বসে কেন? আপনি যদি প্রকাশ্য সভায় এই সংবাদকে মিথ্যা বলে ঘোষণা না করেন তাহলে আমাকে বাধ্য হয়ে আপনাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে হবে! কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন শুষ্ককণ্ঠে বললেন–এ নিশ্চয়ই আমার কোন শত্রুর কাজ।
সভাপতি বললেন–শত্রুর কাজই হোক আর মিত্রের কাজই হোক, এই সংবাদের ভিত্তিতে আমি আপনাকে যদি অভিযুক্ত না করি, তাহলে রাজার কাছে এবং দেশের কাছে আমাকে কর্তব্যভ্রষ্ট হতে হবে। তবে আপনি যদি সংবাদটাকে মিথ্যা ঘোষণা করেন, তাহলে আপনাকে জামিনে খালাস দিতে পারি, এই পর্যন্ত।
কাউন্ট মারকার্ফ বললেন–এ সংবাদ মিথ্যা।
তখন সভাপতি বললেন–বেশ! আপনার ঘোষণার উপরে বিশ্বাস রেখে আপনাকে আমি জামিনে মুক্তি দিচ্ছি। আগামী পরশু এখানেই এই মামলার বিচার আরম্ভ হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের মত দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আপনি ঐ দিন অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন। খবরের কাগজের আফিসেও আমি সমন পাঠাচ্ছি। তাদের আফিসে যদি এই মামলার কোন সাক্ষী থাকে, তাকে পাঠাতে অনুরোধ করে ব্যক্তিগতভাবে একখানি চিঠিও আমি দিচ্ছি সম্পাদককে।
বিচার সভা। বারজন সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠিত হয়েছে এই অসামান্য চাঞ্চল্যকর মামলাটির বিচার করবার জন্য।
কাউন্ট-দ্য-মারকাকে দেখা গেল আসামীর কাঠগড়ার পাশে একখানা চেয়ারে বসে থাকতে। তার হাতে এক বান্ডিল কাগজ।
আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলো শেষ হতেই সভাপতি বললেন– আসামী ফার্নান্দ মন্ডেগু ওরফে কাউন্ট-দ্য-মারকা! আপনার বিরুদ্ধে যে সাংঘাতিক অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রতিলিপি আপনাকে আগেই দেওয়া হয়েছে। তবুও আর একবার অভিযোগগুলো আপনাকে শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বলে অভিযোগপত্রটি তুলে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করে তিনি বললেন–আসামী ফার্নান্দ মন্ডেণ্ড! আপনি দোষী না নির্দোষ? কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন–নির্দোষ।
–বেশ। তাহলে আমি আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি নির্দোষিতা প্রমাণ করতে। আশা করি, আপনি যে নির্দোষ একথা প্রমাণ করতে পারবেন।
–নিশ্চয়ই ধর্মাবতার, আমার কাছে যে দলিলপত্রাদি আছে তা থেকে আমি সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ করতে পারব যে আমি এ ব্যাপারে একেবারেই নির্দোষ। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার হাতের এই দলিলগুলো পড়ে শোনাতে পারি।
সভাপতি বললেন–পড়ুন।
কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন একে একে সেই দলিলগুলো বিচারকদের পড়ে শোনাতে লাগলেন।
দলিলগুলো থেকে জানা গেল যে, আলী পাশা তাঁকে এত বেশি বিশ্বাস করতেন যে, নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে রক্ষা করবার ভার পর্যন্ত তাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এমন কি আলী পাশার অন্তঃপুর অবধি তার ছিল অবাধ গতিবিধি। সভাপতি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন এই সময়–কিন্তু এ থেকে পাশার মৃত্যু বা তার স্ত্রী কন্যার নিরুদ্দেশের কোন খবরই তো জানা যাচ্ছে না।
কাউন্ট বললেন–তা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সেনা বিভাগের রিপোর্ট থেকে জানতে পারবেন যে আলী পাশার মৃত্যুর পর যখন প্রাসাদ আক্রান্ত হয়, আমি তখন পাশার পক্ষ থেকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শত্রুপক্ষের রাজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই বলে আলী পাশার স্বাক্ষরিত একখানি অনুজ্ঞাপত্র ও সেনা বিভাগের কোন পদস্থ অফিসারের স্বাক্ষরিত একখানি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করলেন তিনি।
সভাপতি যখন সেই দলিল দুখানা পড়ছেন, ঠিক সেই সময়ে একজন পত্রবাহক একখানা পত্র এনে তার হাতে দিল।
চিঠিখানা পড়ে সভাপতি আশ্চর্য হয়ে পত্রবাহককে বললেন–তাকে নিয়ে এসো।
একটু পরেই দেখা গেল একজন বোরখাবৃতা মহিলা একজন পরিচারিকার সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে আদালত কক্ষে প্রবেশ করছেন। মহিলা সভাপতির সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন–আপনিই লিখেছেন চিঠিখানা?
বীণানিন্দিত কণ্ঠে সেই বোরখার ভিতর থেকে উত্তর এলো—হ্যাঁ।
সভাপতি বললেন–বেশ! আমরা আপনার কথা শুনবো।
এই বলেই অন্যান্য বিচারকদের লক্ষ্য করে এবং আসামীকে শুনিয়ে তিনি বললেন–এই মহিলা বলছেন যে ইনি পরলোকগত আলী পাশার কন্যা। ইনি এই আদালতে নিজের ইচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে এসেছেন।
সভাপতির মুখ থেকে এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আদালত কক্ষে এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। বিচারকবৃন্দ, দর্শকদল এবং আসামী সবাই একসঙ্গে তাকালেন সেই বোরখাবৃতা মহিলাটির দিকে।
সভাপতি সেই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন–আপনার যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে, তাহলে আপনার মুখের আবরণটা সরিয়ে ফেলুন।
মহিলাটি তখন তার বোরখা খুলে ফেললেন আদালতে দাঁড়িয়েই।
সবাই বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, মহিলাটি অপূর্ব সুন্দরী।
সভাপতি তখন জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার নাম?
–পিতা বেঁচে থাকতে আমার নাম ছিল জেনিনার শাহজাদী হাইদী।
–”পিতা বেঁচে থাকতে” বলছেন কেন?
–কারণ পিতার মৃত্যুর পর আমাকে এবং আমার মাকে এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়।
এই সময় আসামী পক্ষের উকিল হঠাৎ প্রশ্ন করেন–কিন্তু আপনি যে স্বৰ্গত আলী পাশার কন্যা তার কোন প্রমাণ আছে?
প্রিন্সেস হাইদী মৃদু হেসে বললেন–আছে বৈ কি! এই দেখুন আমার জন্মের সার্টিফিকেট (Birth Certificate)। আর এই দেখুন আমার বাপ্তাইজ হবার সার্টিফিকেট।
এই বলে দুখানা সার্টিফিকেট সভাপতির টেবিলে রাখলেন তিনি।
আসামী পক্ষের উকিল সেই কাগজ দুখানি সভাপতির কাছ থেকে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে আবার জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু আপনার বাবা মুসলমান হয়েও আপনাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন–এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
–অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। আপনারা হয়তো জানেন যে, আমার বাবা মুসলমান হলেও আমার মা ছিলেন খ্রিষ্টান।
–কিন্তু এ থেকে কি করে বোঝা যায় যে, আপনিই প্রিন্সেস হাইদী?
–তা যায় না বটে, তবে যাতে জানা যায়, সে ব্যবস্থাও আমি করে এসেছি। আমার হাতের এই সর্বশেষ ও সর্বপ্রধান দলিলখানা পড়ে দেখলেই আপনারা জানতে পারবেন যে, কি সাংঘাতিক অন্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের উপরে। আমাকে আর আমার মাকে ক্রীতদাসীরূপে বিক্রি করা হয়েছিল অল কবীর নামে একজন দাস-ব্যবসায়ী মুসলমানের কাছে। পাঁচ লক্ষ ঐ দামে আমাদের দুজনকে বিক্রি করা হয়।
এই সময় কোন একজন দর্শক বলে উঠলেন–কী সাংঘাতিক!
দর্শকের সেই কথার জের টেনে প্রিন্সেস হাইদী বললেন–শুধু সাংঘাতিকই নয়, এ রকম অমানুষিক বিশ্বাসঘাতকতা সভ্যজগতে বোধ হয় আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি।
এই সময় সভাপতি বললেন–আপনার হাতের ঐ দলিলখানা দেবেন কি?
–নিশ্চয়ই দেব ধর্মাবতার, কিন্তু দেবার আগে দলিলখানা এই প্রকাশ্য আদালতে একবার পড়ে শোনাতে চাই আমি। এই বলেই দলিলখানা পড়তে আরম্ভ করলেন প্রিন্সেস হাইদী–
“আমি জেনিনার সৈন্যাধ্যক্ষ ফার্নান্দ মন্ডেগু সজ্ঞানে ও সুস্থ শরীরে নিহত আলী পাশার স্ত্রী ও কন্যাকে নগদ পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁর বিনিময়ে দাস-ব্যবসায়ী অল কবীরের নিকট বিক্রয় করিলাম।”
দলিলখানা পড়া শেষ হতেই কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ আর্তনাদ করে উঠলেন–মিথ্যা কথা! সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা! ও দলিল জাল।
প্রিন্সেস হেসে বললেন–একথা আমি আগেই জানতাম যে, এই দলিলকে জাল বলা হবে, তাই আমি অল কবীরকেও আদালতে নিয়ে এসেছি। মাননীয় বিচারপতির অনুমতি পেলেই তাকে এখানে হাজির করতে পারি।
সভাপতি বললেন–আসতে বলুন তাকে।
সভাপতির অনুমতি পেয়ে প্রিন্সেস হাইদী তাঁর সহচরীকে কি যেন ইঙ্গিত করলেন। সহচরী সঙ্গে সঙ্গে আদালত থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরেই একজন মধ্যবয়স্ক মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো সে। সভাপতি জিজ্ঞাসা করলেন– আপনার নাম?
–অল কবীর!
–এই মহিলাকে আপনি চেনেন?
–চিনি ধর্মাবতার।
–কি করে?
–ওঁকে এবং ওঁর মাকে আমার কাছে পাঁচ লক্ষ ফ্ৰাঁ মূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল।
–এঁর মা এখন কোথায়?
–তিনি মারা গেছেন।
–কে বিক্রি করেছিল এঁদের?
–জেনিনার একজন সেনাধ্যক্ষ। তার নাম ফার্নান্দ মন্ডেগু।
–দেখুন তো, এখানে সে লোক আছে কি না?
সভাপতির নির্দেশে আল কবীর আদালত কক্ষের চারদিকে দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললো–ঐ সেই লোক!
অল কবীর কাউন্ট-দ্য-মারকাকে সনাক্ত করবার সঙ্গে সঙ্গেই আদালত কক্ষে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সেই গুঞ্জনধ্বনির মধ্যে দুটি কথা স্পষ্টভাবে শোনা গেল—
“বিশ্বাসঘাতক!” “নরপশু!”
সভাপতি তখন আবার বললেন–দেখুন তো, প্রিন্সেস-এর হাতের ঐ দলিলখানা আসল দলিল কি না!
সভাপতির নির্দেশে প্রিন্সেস হাইদীর হাত থেকে দলিলখানা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে সে বললো–হ্যাঁ ধর্মাবতার, এই সেই দলিল!
এই সময় আসামী পক্ষের উকিল তাকে প্রশ্ন করলো–এ দলিল ঐ মহিলার হাতে কি করে গেল বলতে পারেন?
অল কবীর বললো–না, তা আমি বলতে পারি না। ঐ দলিল আমি কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে দিয়েছিলাম।
–কাউট অ মন্টিক্রিষ্টোকে দিয়েছিলেন! কেন বলুন তো?
–মোটা দাম পেয়ে। তিনি আমাকে আট লক্ষ ফ্রাঁ দিয়ে দলিলখানা সহ ঐ মহিলাকে কিনে নিয়েছিলেন।
এই সময় সভাপতি প্রিন্সেস হাইদীর দিকে তাকিয়ে বললেন –একথা কি সত্য?
–হ্যাঁ, ধর্মাবতার! সম্পূর্ণ সত্য। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোই আমার বর্তমান প্রভু।
সভাপতি তখন তীব্র দৃষ্টিতে কাউন্ট-দ্য-মারকার্যের দিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন–আপনার কিছু বলবার আছে?
কাউন্ট নীরব।
সভাপতি তখন বিচার-সভার অন্যান্য সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এইবার আপনাদের বলতে হবে, আসামী কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ ওরফে ফানা মন্ডেগু দোষী না নির্দোষ। সবাই একসঙ্গে উচ্চারণ করলেন–”দোষী”!
.
২২.
স্পানিশ হুণ্ডীর ব্যাপারে ব্যারন ড্যাংলার সর্বস্বান্ত হলেও বাইরে তিনি তা প্রকাশ হতে দেননি। তার ধারণা হয়েছিল যে, আবার তিনি সামলে নিতে পারবেন। তাই এদিকে যখন সারা প্যারিসে ফানা মন্ডের মামলা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, সেই অবসরে তিনি ইটালীর কোটিপতি মেজর ক্যাভালকান্টির পুত্র এন্ডি ক্যাভালকান্টির সঙ্গে তাঁর মেয়ে ইউজিনির বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন। খুব গোপনেই তিনি এই চালটি চেলেছিলেন, কারণ তার ধারণা হয়েছিল যে, এই বিয়ের ফলে মেজর ক্যাভালকান্টির অগাধ ঐশ্বর্য তার ব্যাঙ্কে এনে ফেলে ঐ অর্থের সাহায্যেই আবার অবস্থা ফেরাতে পারবেন। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
নির্ধারিত দিনে বর-কনে ও আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে গীর্জায় হাজির হলেন ড্যাংলার। অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেল।
পুরোহিত “বিবাহ সমাপ্ত হয়েছে” এই কথাটা ঘোষণা করবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ একদল পুলিশ সহ একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসে হানা দিলেন সেখানে।
ম্যাজিস্ট্রেট এন্ট্রি ক্যাভালকান্টিকে দেখিয়ে পুলিশদলকে হুকুম করলেন–গ্রেপ্তার করো ওকে!
হুকুমের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশদল এগিয়ে এসে বরবেশী এন্ট্রি ক্যাভালকান্টির হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
ব্যারন ড্যাংলার চিৎকার করে বলে উঠলেন–এ সব কি হচ্ছে জানতে পারি কি?
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন–নিশ্চয়ই! পলাতক খুনী আসামী বেনডেটোকে গ্রেপ্তার করা হলো।
–বেনডেটো! পলাতক খুনী আসামী! কি বলছেন আপনি?
–ঠিকই বলেছি ব্যারন। এন্ট্রি ক্যাভলকান্টি ছদ্মনামে যে লোকটি এখানে উপস্থিত আছে, সে একজন জেলখাটা দাগী এবং পলাতক খুনী আসামী।
এই বলে একটু হেসে ম্যাজিস্ট্রেট আবার বললেন–আমি খুবই দুঃখিত ব্যারন, কিন্তু কি করবো, কর্তব্যের খাতিরে আমি একে গ্রেপ্তার না করে পারি না।
এন্ড্রিকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইউজিনি অস্ফুট আর্তনাদ করে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়লো, আর ব্যারন ড্যাংলার দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন সেখানে।
এই সময় হঠাৎ কাউন্ট অল্ মন্টিক্রিষ্টো সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যে, বহুদিন আগে মার্সেঈ-এর গীর্জায় এক বিবাহ সভাতেও ঠিক এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা ক্ষীণ হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনের ভাব গোপন করে তিনি ইউজিনির কাছে ছুটে গেলেন।
তিনি দেখলেন–ইউজিনি অজ্ঞান হয়ে গেছে।
.
এ ইউজিনির বিয়ের এই মুখরোচক খবরটা পরদিন সকালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার ফলে ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কে ‘রান’ আরম্ভ হয়ে গেল।
ড্যাংলার যখন বুঝতে পারলেন যে আর রক্ষা নেই, তখন তিনি তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর নোট পকেটস্থ করে পিছনের গুপ্ত দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। পালিয়ে যাবার আগে স্ত্রী কন্যার কথা একবার তার মনে হলেও, “আপনি বাঁচলে বাপের নাম” এই প্রবাদবাক্যটি স্মরণ করে, তাদের ফেলে রেখেই পালিয়ে গেলেন তিনি।
***
ইউজিনির বিবাহ সভা থেকে বাড়িতে ফিরতেই কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো খবর পেলেন যে ভাইকাউন্ট আলবার্ট তার জন্য বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন।
এই খবর শুনে কাউন্ট বৈঠকখানায় গিয়ে আলবার্টকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন কি খবর ভাইকাউন্ট! আপনি হঠাৎ?
আলবার্ট বললো–ভদ্রতার মামুলি বুলি কপচে দরকার নেই কাউন্ট, আমি আপনার কাছে কৈফিয়ৎ চাই।
–কৈফিয়ৎ!
–হ্যাঁ, কৈফিয়ৎ। আমার বাবাকে লোকচক্ষে হেয় করে আমাদের বংশের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন আপনি। এ অপমানের প্রতিশোধ আমি নেব। আমি আপনাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি।
–বেশ! তাই হবে। আমি সর্বদাই প্রস্তুত।
–ভাল, কাল সকালেই আমাদের দেখা হচ্ছে তাহলে!
সেই রাত্রেই।
কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো অন্যমনস্কভাবে একখানা তলোয়ার হাতে নিয়ে তার ধার পরীক্ষা করছিলেন, এই সময় এক অবগুণ্ঠিতা মহিলার আবির্ভাব হলো সেই ঘরে।
মহিলাটির দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বললেন–আপনি কে মাদাম?
অপরিচিতা মহিলাটি হঠাৎ তার মুখের উপরের অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন–আমি তোমার কাছে আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে এসেছি এডমন্ড।
–আপনি! কাউন্টেস্-দ্য-মারকা! আপনি এখানে?
–কাউন্টেন্স-দ্য-মারকার্ফ নই এডমন্ড। আমি মার্সেদেস।
–মার্সেদেস! না না, সে নেই, সে বহুদিন আগে মারা গেছে। তাছাড়া, আমাকে আপনি এডমন্ড নামেই বা ডাকছেন কেন? কাউন্টের এই কথায় মার্সেদেস তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে তুমি ক্ষমা করো এডমন্ড। তুমি যদি জানতে যে কতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে বিয়ে করেছে ফার্নান্দ… কিন্তু থাক সে কথা, আমি শুধু তোমার কাছে আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে এসেছি আজ।
তুমি তাহলে জানতে যে আমিই এডমন্ড দান্তে।
–হ্যাঁ, এডমন্ড! তোমাকে যেদিন প্রথম আমাদের বাড়িতে দেখি, সেই দিনই আমি তোমাকে চিনতে পারি; কিন্তু সে কথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। তোমার সামনে সেদিন আমি বেরও হইনি। ইচ্ছা করেই বের হইনি। এডমন্ড! তুমি যদি জানতে…
–সবই আমি জানি মার্সেদেস। যাইহোক, আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমার ছেলে জয়ী হয়ে বাড়িতে ফিরবে। আমিই কাল তার হাতে প্রাণ দেব।
–না, তোমাকে আমি মরতে দেব না!
–সে কি! আমি না মরলে আলবার্ট কি করে জয়ী হবে?
–তোমাদের মধ্যে যুদ্ধ হবে না। আমি তা হতে দেব না। (তামার সঙ্গে আমার ছেলের দ্বন্দ্বযুদ্ধ…এ কিছুতেই হতে পারে না; না–না–না।
এই বলেই মার্সেদেস ছুটে বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে। কাউন্ট ধীরে ধীরে হাত থেকে তলোয়ারখানা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলেন।
***
পরদিন সকালেই আলবার্ট এসে দেখা করলো কাউন্টের সঙ্গে। কাউন্টকে একা একটা ঘরে ডেকে নিয়ে সে তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে আপনি ক্ষমা করুন কাউন্ট! কাল রাত্রে মায়ের কাছে আমি সব কথা শুনেছি।
কাউন্ট আলবার্টের হাত ধরে তুলে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন! তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হলো না।
কাউন্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে যেতেই মার্সেদেস তাকে বললো–তৈরি হয়ে নাও আলবার্ট, আমাদের এখনই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাস্তায় গাড়ি অপেক্ষা করছে। যাবার সময় আলবার্ট ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকালো একবার। তারপর নিঃশব্দে মায়ের সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
ওদের গাড়িখানা ফটক পার হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ফার্নান্দ পকেট থেকে পিস্তল বের করে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে গুলি করলো।
সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণহীন দেহটি লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপরে।
.
২৩.
এদিকে এন্ট্রি ক্যাভালকান্টির বিচার-সভায় আর এক চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। বিচারক যখন তার বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে নিঃসঙ্কোচে প্রকিওরার-দ্য-রোয়া আঁসিয়ে ভিলেফোর্টের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–উনিই আমার বাবা।
এরপর আরও যে সবচাঞ্চল্যকর বিবরণ আদালতে প্রকাশ করলো সে, তাতে জানা গেল যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট একজন দুশ্চরিত্র, লম্পট, জালিয়াং এবং নরহত্যাকারী। ব্যারনেস ড্যাংলারের সঙ্গে তার অবৈধ প্রণয়ের কথাটাও ফাঁস হয়ে গেল আদালতে।
এইসব ব্যাপারে সেদিন কোর্ট থেকে পাগলের মত ছুটে এসে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করলেন, তারপর দুটো দিন পার হয়ে গেলেও সে দরজা তিনি খুললেন না।
ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে বাড়ির লোকেরা যখন দরজা ভেঙে সেই ঘরে ঢুকলো, তখন দেখা গেল, মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট মেঝের উপর দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ছেন। তিনি তখন রীতিমত উন্মাদ।
.
এইভাবে এডমন্ডের দুজন শত্রু নিপাত হবার পর বাকি থাকলো শুধু ড্যাংলার। এডমন্ড জানতে পেরেছিল (এখন থেকে আমরা কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে এডমন্ড বলেই অভিহিত করবো) যে ড্যাংলার ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।
সে তখন গোপনে দস্যু-দলপতি লুইগি ভাম্পার সঙ্গে দেখা করে ড্যাংলারকে খুঁজে বের করতে অনুরোধ করলো। লুইগি ভাম্পাকে এডমন্ড বহুবার বন্ধুভাবে সাহায্য করেছিল বলে সে এডমন্ডের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল, তাই এডমন্ডের অনুরোধে সে ভিয়েনার পথ থেকে ড্যাংলারকে ধরে এনে কয়েদ করে রাখলো।
চার দিন নির্জলা উপবাসে রাখবার পর ড্যাংলারের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ আদায় করে এক প্লেট খাবার দিলে লুইগি ভাম্পা।
পাঁচ দিনের মাথায় এডমন্ড এসে তার সঙ্গে দেখা করলো। তাকে দেখে ড্যাংলার অবাক হয়ে বললেন–একি! আপনি এখানে!
এডমন্ড বললো–হ্যাঁ! লুইগি ভাম্পা আমার বিশেষ বন্ধ কি না! তাই দেখা করতে এসেছি তার সঙ্গে।
এডমন্ডের কথা শুনে ড্যাংলার যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল। সে বললো–দেখুন দেখি, দস্যুরা আমাকে অকারণে বন্দী করে রেখেছে। আমার সব টাকা কেড়ে নিয়ে আমাকে এরা না খাইয়ে রেখেছে।
এডমন্ড বললো–আপনার তাহলে খুব খিদে পেয়েছে, কেমন?
–হ্যাঁ কাউন্ট, ভয়ানক খিদে পেয়েছে।
–খুব কষ্ট হচ্ছে, না?
–খুব।
–তাহলে কষ্ট কাকে বলে বুঝতে পারছো কিছু কিছু? বন্দীজীবনে না খেয়ে থাকলে মনের অবস্থা কেমন হয় তাও কিছু কিছু বুঝেছো, তাই না?
কাউন্টের মুখে এই রকম বেসুরো কথা শুনে ড্যাংলার যেন হকচকিয়ে গেল। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বের হলো না। এডমন্ড বলে চললো–মনে করে দেখ ড্যাংলার, তুমি একজন নির্দোষ যুবকের কী সর্বনাশ করেছিলে! জাল চিঠি পাঠিয়ে তাকে তুমি বিয়ের দিনে গ্রেপ্তার করিয়েছিলে, মনে আছে সে কথা? ভাবতে পারো কি যে, তোমার ষড়যন্ত্রের ফলে সেই হতভাগ্য যুবক কারাগারে বসে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, তিলে তিলে মৃত্যুর জন্য দিন গুনেছে। আর এদিকে তুমি ব্যারন সেজে সমাজের বুকের উপর বসে অত্যাচারের রথ চালিয়ে দিয়েছো! তুমি, তোমার বন্ধু ফার্নান্দ মন্ডেগু আর তোমাদের পাপ কাজের সহায়ক ভিলেফোর্ট এই তিন শয়তান একটি নির্দোষ হতভাগ্য যুবকের সর্বনাশ করে কেউ কাউন্ট, কেউ ব্যারন আর কেউ সরকারী প্রকিওরার সেজে ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলেছিলে… মনে পড়ে সে সব কথা?
–আপনি!…..কে আপনি…?
–এখনও চিনতে পারছো না আমাকে শয়তান! আমি সেই, যাকে তুমি বিবাহ-সভা থেকে ধরিয়ে দিয়েছিলে, আমি সেই, যার বাগদত্তা বধূকে তোমার কুকর্মের সহায়ক ফার্নান্দ মন্ডেগু বিশ্বাসঘাতকতা করে বিবাহ করেছিল; আমি সেই, যাকে তোমার বন্ধু ভিলেফোর্ট কারাগারে পাঠিয়েছিল তার বাবার যড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে; আমি সেই, যে ফার্নান্দের কীর্তি-কাহিনী প্রকাশ করে দিয়ে তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। আমি সেই, যে তোমার প্রাণের বন্ধু ভিলেফোর্টের মুখোশ খুলে দেওয়ায় সে আজ উন্মাদ…আমি সেই এডমন্ড দান্তে!
এডমন্ডের মুখে তার নাম শুনে ড্যাংলারের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে তখন তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠলো–এডমন্ড! আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
ড্যাংলারের এই কথায় হা-হা করে হেসে উঠে এডমন্ড বললো
–ক্ষমা! হ্যাঁ, আমি তোমাকে ক্ষমাই করবো!
এই বলে লুইগি ভাম্পার দিকে তাকিয়ে সে বললো আমার এই উপকারী বন্ধুটির আরামের দিকে দৃষ্টি রেখো। কাল সকালে আমি আবার এসে এর সম্বন্ধে যা হয় ব্যবস্থা করবো।
.
পরদিন সকালে এডমন্ড এসে আবার যখন দেখা করলো ড্যাংলারের সঙ্গে তখন ড্যাংলারের মাথার সবগুলো চুল সাদা হয়ে গেছে। এক রাত্রের মধ্যেই তার বয়স যেন ত্রিশ বৎসর বেড়ে গেছে। এডমন্ড তখন তার হাতে পাঁচটি ফ্ৰাঁ তুলে দিয়ে বললো–নাও, এই পাঁচ ফ্রাঁ নিয়ে আবার মানুষের সর্বনাশ করে বেড়াও গে। তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম।
-: সমাপ্ত :-