- বইয়ের নামঃ গরমের ছুটি
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রোমাঞ্চকর গল্প
গরমের ছুটি
০১.
বিশাল এক জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা। জমিদার বাড়ি। কুমিল্লা থেকে এসে ময়নামতি ছাড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল এগোলে পথের বাঁ পাশে পড়বে বিশাল এক বটগাছ। সেটার কাছে নেমে একটা ইট বসানো সরু রাস্তা ধরে আরও কিছুদূর গেলে সেই জঙ্গল, হীরামতির বাগ, অর্থাৎ বাগিচা। গরমের এই ছুটিতে সেটাই আমাদের গন্তব্য। হ্যাঁ, আমি রবিন বলছি। আবার এসেছি বাংলাদেশে বেড়াতে, আমরা তিন বন্ধু-আমি, কিশোর পাশা, এবং মুসা আমান।
অন্যান্যবারের মত এবারেও কিশোরের মামা রিটায়ার্ড ডিআইজি আরিফ চৌধুরী সাহেবের ঢাকার বাসাতেই উঠেছিলাম আমরা। একটা দিন ওখানে কাটিয়ে পরদিনই রওনা হলাম কুমিল্লার উদ্দেশে। গন্তব্য হীরামতির বাগ। নামটা শুনলে কেমন লাগে, তাই না? মনে হয়, প্রচুর হীরা-মতি পাওয়া যায় বুঝি ওই জঙ্গলে। আসলে তা নয়, হীরা আর মতি নামে দুই ভাইবোন ছিল, জমিদারের সন্তান। বিশাল এক দীঘি কাটিয়েছিলেন জমিদার আইন উদ্দিন সরকার, সেই দীঘিতে ডুবে মারা গিয়েছিল ছেলেমেয়ে দুটি। তখন থেকেই সেই দীঘির নাম হয়ে গেল হীরামতির দীঘি। কালক্রমে দীঘির চারপাশের বাগান সংস্কারের অভাবে জঙ্গল হয়ে গেল, দীঘির নামেই নাম হয়ে গেল সেই জঙ্গলেরও।
এই কাহিনী শুনেছি আমরা কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার মুখে। তিনিই আমাদের এখানে আসতে অনুরোধ করেছেন। জঙ্গলের মধ্যে যে পূরানো জমিদার বাড়ি আছে, তার মালিক এখন রেহান উদ্দিন সরকার, রাশেদ পাশার দূর সম্পর্কের ফুফা। আইন উদ্দিন সরকারের শেষ বংশধর। আমেরিকায় বসেই শুনেছেন রাশেদ পাশা, তার ফুফুর খুবই দুরবস্থা চলছে এখন। তাই আমাদেরকে এখানে এসে নিজের চোখে সব দেখে খোঁজখবর করে যেতে বলেছেন রাশেদ আংকেল। সম্ভব হলে তখন সাহায্য করবেন।
ঢাকা থেকে কুমিল্লার বাসে চড়েছি আমরা। ময়নামতিতে নেমে স্কুটার নিয়েছি।
বটগাছের গোড়ায় কয়েকটা ছোট ছোট দোকান-মুদি, চা-পান-বিড়ি, এ সবের। ওগুলোর কাছে এসে ড্রাইভারকে থামতে বলল কিশোর। এগিয়ে এল কয়েকজন নোক, কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল আমাদের। জমিদার বাড়িটা কোনদিকে জিজ্ঞেস করতে সবাই হাত তুলে দেখিয়ে দিল ইট বিছানো রাস্তাটা।
সেই পথ ধরে এগোল আমাদের স্কুটার। অনেক পুরানো রাস্তা, জমিদারী আমলে সরকারদের কোনও একজন তৈরি করেছিলেন নিজের খরচে। এখন অনেক জায়গারই ইট নেই, ক্ষতের মত হয়ে আছে, জায়গায় জায়গায় গর্ত। মেরামত হয় না কত বছর কে জানে।
বেশ গরম পড়েছে। ঘেমে যাচ্ছি। পথের দুপাশে মাইলের পর মাইল কেবল খেত আর খেত। তরমুজ-বাঙ্গী ফলে আছে। এলোমেলো মাতাল হাওয়ায় ধুলোর। ঘূর্ণি উড়ছে। চাষীদের বাড়িঘর চোখে পড়ে কচি-কদাচিৎ। ওরা এই ভোলা মাঠে বাস করে না, থাকে দূরে, খেতের সীমানায় ওই যে ওই গ্রাম চোখে পড়ছে, সেখানে।
অবশেষে দেখতে পেলাম জঙ্গলটা। তিন পাশ ঘিরে খেত, একধারে নদী। কিছুদূর খোলা জায়গা ধরে এগিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল পথটা। ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েকশো গজ এগোতে দেখতে পেলাম জমিদার বাড়ির চৌহদ্দি। জঙ্গলটা আগে জঙ্গল ছিল না, বাড়ির আশপাশে বিশাল সব বাগান ছিল, আস্তে আস্তে সেই বাগান জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বিরাট সিংহদরজার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই আর এখন, কেবল দু-পাশের দুটো স্তম্ভ বাদে। একটা স্তম্ভের গোড়ায় একপাশে এখনও থাবা উঁচিয়ে বসে আছে শ্বেতপাথরের এক মস্ত সিংহ।
খোয়াবিছানো লম্বা গাড়িপথ পার হয়ে বিশাল এক প্রাসাদের সামনের গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল স্কুটার। রোদে ঝকঝক করছে ছড়ানো উঠান। সেখানে দানা খুঁটছিল একঝাঁক পায়রা আর ঘুঘু। স্কুটারের শব্দে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল একসঙ্গে। কয়েকটা পায়রা গিয়ে বসল বাড়ির কার্নিসে, বাকবাকুম জুড়ে দিল।
খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা, কি সুন্দর জায়গা!
স্কুটার থেকে নেমে আমিও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই অসাধারণ! জঙ্গলের মাঝে এমন একটা বাড়ি থাকতে পারে, না দেখলে ভাবাই যায় না। অনেক পুরানো বাড়ি। সংস্কারের অভাবে এখানে ওখানে বেরিয়ে পড়েছে লাল ইট, জানালার শাসিগুলো অপরিষ্কার, আনাচে কানাচে লতাগুল্ম আর শ্যাওলার রাজত্ব। পলকে একটা দিবাস্বপ্ন দেখে ফেললাম-এককালে আমাদেরই মত কত কিশোরের আনাগোনা ছিল এখানে, খেলে বেড়াত তারা, হই-চই করত, আজ একেবারে নীরব।
ওই যে, দাদী। বলে উঠল কিশোর।
উঁচু বারান্দার ওপরের বড় দরজাটা খুলে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধা। বয়েস ষাটের বেশি, কিন্তু এখনও মনে হয় চল্লিশের কোঠায়। অপরূপ সুন্দরী ছিলেন এককালে, বোঝা যায়। হবেনই, অত সুন্দরী না হলে কি আর জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়।
আমাদের আসার খবর চিঠিতে আগেই জানিয়েছেন রাশেদ আংকেল। সুতরাং আমাদের পরিচয় দিতে হলো না তাকে। হাসিমুখে সাবলীল ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে লাগলেন আমাদের দিকে। শুধু বললেন, এসেছিস। তোদের অপেক্ষাই করছি।
কোন রকম দ্বিধা নেই, জড়তা নেই, প্রথমেই আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে আদর করলেন। আমি যে বিদেশী, অন্য ধর্মের মানুষ, বাঙালী মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়েও তার পরোয়াই করলেন না তিনি। মুহর্তে পছন্দ করে। ফেললাম তাকে, মনে হলো তিনি আমার নিজের দাদী। তারপর মুসাকে চুমু খেলেন তিনি, আমার পেছনেই ছিল সে। সবশেষে কিশোরকে, স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উঠে আসতে দেরি করে ফেলেছিল সে।