- বইয়ের নামঃ চাঁদের পাহাড়
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প
চাঁদের পাহাড়
০১.
রাস্তা জুড়ে দাঁড়াল বিশাল হাতিটা।
খাড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে ছেলেদের মনে হলো মেঘে ঢেকে দিয়েছে সূর্য।
মুখ তুলে দেখল ওরা, আকাশ মেঘে ঢাকেনি। ঢেকেছে শুড়ওয়ালা এক চারপেয়ে কালো দানব। এতবড় হাতি আর দেখেনি ওরা।
হাতিটাও ওদের মতই অবাক হয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে কুতকুতে চোখে তাকাল ওদের দিকে। গুমগুম শব্দ বেরোল গলার গভীর থেকে। রেগে গেছে। শুড়টা বাড়িয়ে দিল সামনে, ওদের গন্ধ নেয়ার জন্যে।
কাঁধের সঙ্গে ভাজ করে লেপ্টে ফেলেছিল কান দুটো। ঝটকা দিয়ে ছড়িয়ে দিল ছাতার মত। এতটাই বড়, কিশোর অনুমান করল, ওই সাইজের ডাইনিং টেবিল বানালে একেকটাতে আটজন করে লোক খেতে বসতে পারবে। রোদে ঝকঝক করছে ওটার ছয় ফুট লম্বা সাদা দাঁত।
কিশোরের মত স্থির থাকতে পারল না ওর বন্ধু মুসা। বলল, চলো, পালাই।
কোথায়? দুই ধারে ঘন ঝোঁপঝাড়ের দেয়াল হয়ে আছে।
যেদিক থেকে এলাম, মুসা বলল।
দৌড় দিয়ে লাভ হবে না। তাড়া করবে। হাতির সঙ্গে পারা যাবে না। ধরে। ফেলবে। ছয়-সাত টন ওজনের হাতির এক পায়ের পাড়াই যথেষ্ট, ভর্তা হয়ে যাব।
তাহলে কিছু একটা করো! এ সব যুক্তি তো আর প্রাণ বাঁচাবে না।
সামনের দিকে তঁড়টাকে ছুঁড়ে দিয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল দানব। রক্ত হিম করা চিৎকার। কলরব করে ছুটে পালাতে শুরু করল বানর আর পাখির দল।
পেছনে তাকাল কিশোর। ওদের ভাড়া করে আনা নিগ্রো কুলির দল আতঙ্কিত হয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে, একজন বাদে। তার নাম আকামি। ওদের গাইড এবং ট্র্যাকার। সে দাঁড়িয়ে আছে ওর একেবারে পাশেই। হাতে একটা হাতি মারার রাইফেল। সেটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল সে।
মাথা নাড়ল কিশোর। জ্যান্ত ধরার চেষ্টা করব।
মুচকি হাসল আকামি। নিজে সে দুঃসাহসী লোক, সাহসী মানুষদের পছন্দ করে। কিন্তু হাতি ধরার কথা সে-ও কল্পনা করতে পারে না।
সামনে এগোনোর সাহস নেই, পিছিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে, দু-ধারে মাউন্টেইনস অভ দা মুন, অর্থাৎ চন্দ্ৰপাহাড়ের কুখ্যাত ঘন ঝোঁপঝাড়ের দেয়াল। সময় থাকলে হয়তো কুপিয়ে কেটে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করতে পারত, কিন্তু হাতিটা ওদেরকে সে-সময় দেবে বলে মনে হলো না।
মাটিতে গর্ত থাকলে নির্ধিধায় তাতে ঢুকে যেত এখন, তাও নেই।
একটা মাত্র পথ খোলা আছে, ওপর দিকে। কিন্তু সেদিক দিয়ে পালাতে হলে ডানা দরকার, উড়ে যেতে হবে। তার মানে, পালানোর পথ নেই।
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। তাকিয়ে আছে ওপর দিকে।
লিয়ানা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। মাথার ওপরে বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝুলছে ওই লতা। জাহাজ বাঁধার দড়ির মত শক্ত।
ধরব কি করে? কি করতে হবে বুঝে গেছে মুসা।
আমার কাঁধে ওঠ, কিশোর বলল।
কিশোরের কাঁধে উঠল মুসা। হাত বাড়িয়ে একটা লতা ধরে দোল দিয়ে উঠে। যেতে শুরু করল ওপরে।
এ আবার কি হচ্ছে!-অবাক হয়ে ভাবছে যেন হাতিটা। তাকিয়ে রয়েছে আজব ওই দড়াবাজিকরের দিকে।
আকামিকে নির্দেশ দিল কিশোর, যাও, ওঠো, জলদি!
কিশোরকে ছেড়ে আগে ওঠার ইচ্ছে ছিল না আকামির। কিন্তু তর্ক করে নষ্ট করার সময় এখন নেই। রাইফেলটা স্ট্র্যাপে ঝুলিয়ে, কিশোরকে মই বানিয়ে মুসার মতই উঠে যেতে শুরু করল সে-ও।
বিকট হস্তীনিনাদ করে দুলকি চালে এগোতে লাগল হাতি। লিয়ানার ডগায় ফঁসের মত গিঁট বেঁধে থাকে। সে-রকম একটা গিঁটে পা ঢুকিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ল আকামি। হাত বাড়াল কিশোরকে ধরার জন্যে।
বাড়ানো হাতটা ধরে ফেলল কিশোর। টেনে তাকে তুলে নিতে লাগল আকামি।
কিন্তু সার্কাসের এই খেলা মোটেও পছন্দ হলো না হাতির। ধরার জন্যে ছুটে এল সে। কিশোরের নিচে দাঁড়িয়ে আরেকবার হাঁক ছাড়ল। ওঁড়ের ফুটো থেকে বেরোনো গরম নিঃশ্বাসের ঝাপটা লাগল পায়ে। কিশোরের গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরল শুডুটা।
আকামি টানছে ওপর দিকে, হাতি টানছে নিচে। ঘাবড়ে গেছে কিশোর। ভয়ঙ্কর এক মুহূর্ত। এই টানাটানি বন্ধ না হলে ছিঁড়ে দুই টুকরো হয়ে যাবে সে। আকামি তাকে ছেড়ে দিলেও বিপদ। নিচে পড়বে। পায়ের তলায় পিষে মারবে তখন দানবটা।
চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এল কুলিরা। টিন বাজিয়ে, নানা রকম শব্দ করে হাতির দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল।
ওদের দিকে ফিরে ভয় দেখানোর জন্যে চিৎকার করে উঠল হাতি।
আওয়াজটা অদ্ভুত। ভয়াবহ সন্দেহ নেই, তবে বাঘ-সিংহের গর্জনের মত নয় শব্দটা, বরং অনেকটা মেয়েমানুষের চিৎকারের মত; অনেক গুণ জোরাল, গায়ের রক্ত জমিয়ে দেয়।
কুলিদের হট্টগোলের জবাবটা দিয়েই আবার কিশোরের দিকে নজর ফেরাল সে। যেন বলতে চাইল-দাঁড়াও, তোমাদেরও ধরব, আগে হাতের কাজটা শেষ করে নিই!
আবার টান দিল কিশোরের পা ধরে।
ওপরে হড়াৎ করে পিছলে গেল কিছু। এই সম্ভাবনাটার কথা ভাবেনি কিশোর। লতাটা বোধহয় খুলে আসছে ডাল থেকে। নতুন বিপদ। লতা ছিঁড়ে গেলে শুধু সে-ই না, আকামিও পড়বে-দুজনেই মরবে তখন।
ছাড়ো! আমাকে ছেড়ে দাও! মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে।
কিন্তু ছাড়ল না আকামি। কিশোরের কব্জিতে আরও চেপে বসল আঙুলগুলো।