- বইয়ের নামঃ টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার
- লেখকের নামঃ আলেকজান্ডার ডুমা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার
১. রাজধানীর সেন্ট আনোর রাজপথ
টুয়েনটি ইয়ার্স আফটার
০১.
রাজধানীর সেন্ট আনোর রাজপথ ধরে বিদ্যুৎবেগে ঘোড়া ছুটে চলেছে, দুই অশ্বারোহী, দুই বীরযোদ্ধা। তাদের নাম, দ্যার্তেগা এবং পোর্থস, ভিনসেন দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছে রাজবন্দি ডিউক অফ বোফর্ট। তাকে ধরে আনার জন্যই ছুটছে এই দুই বীরযোদ্ধা। অবশ্য এদের পিছনে বড়সড় একদল অশ্বারোহী সৈন্য আছে, কিন্তু অনেক পিছিয়ে পড়েছে তারা। তাতেই বোঝা যায় সৈন্যদের উপর এরা মোটেই নির্ভরশীল নয়।
রাজপথের শেষ মাথায় পৌঁছাতেই সামনে এক গ্রাম। তার শেষ প্রান্তে এক বড় বনের শেষ প্রান্তে ছোট এক পাহাড়। সেই পাহাড়ের চূড়ো থেকে দেখা যায় একটা পানিশূন্য লেকের ওপারে ভিনসেন দুর্গের মাথা আকাশ ছুঁয়েছে। লেকের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে ঘোড়া, পাশেই সেন্টমোর গ্রাম। ডিউক অফ বোফর্ট ঐ দুর্গের একটি মাথা থেকে দড়ি ঝুলিয়ে সেন্ট মোরের অন্য প্রান্তে নেমে পালিয়ে গেছেন। সেখানটায় এখনও জটলা করছে দুর্গের পাহারাদাররা। জটলার কাছে পৌঁছে প্রশ্ন করল দ্যার্তেগা ‘ডিউকের কোনো সাহায্যকারী ছিল?’
উত্তর দিল সৈন্যরা চারজন ছিল, আমরা দুর্গের দেয়ালের উপর দেখেছি তাদের। কিন্তু গুলি ছুঁড়েও কিছু করতে পারিনি বন্দুকের নাগালের বাইরে থাকায়। মাত্র চারজন। পোর্থাসের উদ্দেশ্যে বলল দ্যার্তেগা, ভাবখানা-চারজন কোনো ব্যাপার হল? অন্তত যোদ্ধা হলে না হয় দ্যার্তেগা আর পোর্থসের মতো দুই যোদ্ধাকে বাধা দিতে সক্ষম হত।
দ্যার্তেগা আবার জিজ্ঞাসা করল–‘কতক্ষণ আগে পালিয়েছে ওরা।‘
‘সোয়া দুই ঘণ্টা হবে।’ জবাব দিল পাহারারত সৈন্যরা।
‘মাত্র!’ পোর্থসের দিকে ফিরল দ্যার্তেগা। বোফর্ট কোথায় পাবে এত তেজি ঘোড়া আমাদের মতো। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে ওদের ঠিকই ধরে ফেলব আমরা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পোর্থস। বেয়ার্ড আর ভলকান নামের এই দুই ঘোড়ার মালিক সে। সবে ঝড়ের বেগে দুই ঘণ্টা ছুটে এসেছে। আবারও যদি পাঁচ ছয় ঘণ্টা এই বেগে ছুটতে হয় তাহলে ও দুটোর শেষ পরিণতি কী হবে ভেবে শঙ্কা জাগছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তা নিয়ে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। শুরু যখন হয়েছে কাজটা শেষ করতে হবে। পলাতকদের ধরতেই হবে, তবেই মিলবে দ্যার্তেগার জন্য ক্যাপ্টেন এবং নিজের জন্য ব্যারন পদবী। এই আশ্বাস এসেছে ফ্রান্সের মহামন্ত্রী স্বয়ং ম্যাজারিনের কাছ থেকে।
বিশ বছর, হ্যাঁ সুদীর্ঘ বিশ বছর ধরে দ্যতেঁগা মাস্কেটিয়ার বাহিনীর লেফটেন্যান্ট, কিন্তু ক্যাপ্টেনের পদে উন্নতির কোনো আশা নেই, কারণ ট্রিভাইন এখন জীবিত। কাজেই তিনি মারা না গেলে ক্যাপ্টেনের পদ খালি হবে না, আর দ্যার্তেগার তার মৃত্যু কামনাও করতে পারে না, তিনি দ্যার্তেগা বিশেষ উপকারী। রানী অ্যান এর জন্য অনেক কিছুই করেছে দ্যার্তেগা তাকে চরম অবমাননার হাত থেকে রক্ষা করেছে একদিন। এজন্যই রানীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সমস্ত জীবন। ফরাসি দেশের পরিচালিকা এখন সেই রানী। রাজা চতুর্দশ লুই নাবালক তাও অভিভাবক হিসেবে রানী অ্যান দেশ শাসন করছেন। তিনি ইচ্ছে করলে দ্যার্তেগাকে মার্শাল পদে বসাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। না করার কারণ তিনি নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছুই করেন না। মহামন্ত্রী কার্ডিনা ম্যাজিরিনের হাতের পুতুল রানী, বাজারে জনশ্রুতি আছে বিধবা হওয়ার পর অ্যান এই ইতালীয় ভাগ্যান্বেষীকে গোপনে বিবাহ করেছেন।
ম্যাজারিন নিজেও চরম লোভী ও স্বার্থপর। যেখানে নিজের কোনো লাভ নেই, এমন কোনো কাজ সে নিজেও করবে না। রানীকেও করতে দেবে না।
সুতরাং রানী দ্যার্তেগার জন্য কিছুই করতে পারেনি এবং যেখানে উপকারীর উপকার করার সম্ভাবনা নেই, সেখানে উপকারীর কথা মনে রাখলেই শুধু বেদনা থাকে বলেই রানী ইচ্ছে করেই ভুলেছেন দ্যার্তেগাকে। যদিও দুজনই একই প্রাসাদে থাকেন, রানী ভেতরে, দ্যার্তেগা প্রাসাদের পাহারায়।
হ্যাঁ বিশ বছর দ্যার্তেগা প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে কিন্তু রানী তাকে মনে রাখেননি। অবশেষে একদিন ম্যাজারিনই বাধ্য হলেন দ্যার্তেগাকে খুঁজে বের করতে। গরিব প্রজাদের উপর নতুন কর বসিয়েছেন ম্যাজারিন অথচ যে বিশাল পরিমাণ অর্থ এই সব কর থেকে আসে তা রাজকোষে জমা হয় না, হয় ম্যাজারিনের নিজের তহবিলে। সিন্দুক ভরা হীরে, মুক্তো ম্যাজারিনের অথচ রাজা চতুর্দশ লুইকে থাকতে হয় রীবি হালে।
স্বভাবতই প্রজারা এতে অসন্তুষ্ট যে কোনো অভিজাত, প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রজাদের পক্ষে কথা বলেছেন তক্ষুণি তাকে আটকে বন্দি করেছেন ব্যাস্তিল কারাগারে। ম্যাজারিনের নির্দেশে রানী অ্যান ব্যামাসপিয়ার ব্যাস্তিল কারাগারেই মারা গিয়েছেন, বোফর্ট ভিনসেন থেকে পালিয়েছেন পাঁচ বছর কারাবাসের পর। বোফর্টকে মুক্ত করার জন্য তার আত্মীয় বন্ধু জমিদারেরা গোপনে চেষ্টা করছেন, একথা গুপ্তচরেরা আগেই জানিয়েছেন ম্যাজারিনকে, এদিকে রাজধানী প্যারির জনগণ যে এসব নিয়ে প্রায় বিদ্রোহের পর্যায়ে। পৌঁছেছেন সেকথাও। ম্যাজারিন যেদিকে তাকান, সেখানেই শুধু শত্রু আর শত্রু। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ কেউ গোপনে। চিন্তিত হয়ে মহামন্ত্রী ভাবতে লাগলেন কমপক্ষে দুই চারজন ঘনিষ্ট বন্ধুও যদি তার থাকত।
এই সময়ে একজন তাঁকে চার বীরের কথা বলল, চারজনই সৈনিক তারা, কিছুদিন আগে দেশের তদানীন্তন পরাক্রমশালী কার্ডিনান রিশনকে পরাজিত করেছিল, তাদের একজনের নাম লেফটেনান্ট দ্যার্তেগা।
ম্যাজারিন উফুল্ল হয়ে উঠলেন। তখনই ডেকে পাঠালেন দ্যার্তেগাকে। একটা চুক্তি হলো তাদের মধ্যে। চুক্তিটা হলো এই যে, আসন্ন প্রজা বিদ্রোহে দ্যাগো তার আগের তিন বন্ধুকে নিয়ে সমর্থন ও সাহায্য করবে ম্যাজারিনকে বদলে ম্যাজারিন দ্যার্তেগাকে দেবেন ক্যাপ্টেন পদ এবং বন্ধুদের যে যা চাইবে তাকে তা দেবেন।
দ্যাগে বিশ বছর কোনো খবর রাখে না বন্ধুদের। ম্যাজারিনের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে, সে তাদের খুঁজতে বের হলো, কে কোথায় আছে। বেশি খুঁজতে হলো না সহজেই সন্ধান মিলল তাদের, কিন্তু কেউ রাজী হলো
ম্যাজারিনের প্রস্তাবে। অ্যারামিস আর অ্যাথোস সোজা বলে দিল রাজা ছাড়া আর কারও জন্যে তারা অস্ত্র ধরবে না। ম্যাজারিন যতই রাজার মন্ত্রী হোক, আসলে সে রাজার শত্রু, শত্রু এই জন্যে যে রাজার নাবালকত্বের সুযোগ নিয়ে দেশটাকে শোষণ করছে, প্রজাদের করে তুলেছে রাজার উপর অসন্তুষ্ট। সুতরাং অ্যারোমিস ও অ্যাথোসের মতে, ম্যাজারিনের সাহায্য করা মানেই হলো আসলে রাজার ক্ষতি করা।
একমাত্র পোর্থস রাজী হলো। সহজ সরল বুদ্ধির মানুষ পোর্থস। সে রাজনীতি বোঝে না, রাজার স্বার্থ আর মন্ত্রীর স্বার্থ যে ভিন্ন হতে পারে এমন চিন্তাই নেই তার। ম্যাজারিন যদি তাকে ব্যারন উপাধি দেয়, তা হলে সে ম্যাজারিনকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। কারণ, প্রচুর অর্থ এবং তিনটি জমিদারির মালিক হওয়ার পরেও শুধুমাত্র একটা উপাধির অভাবে সে অভিজাত সমাজে স্বীকৃতি পাচ্ছে না।
একমাত্র পোর্থসকে নিয়েই দ্যার্তেগা পারিতে ফিরছে। পোর্থসের লম্বা চওড়া গঠন দেখে খুশী হয়েছেন ম্যাজারিন। রাজী হয়েছেন তাকে ব্যারন উপাধি দিতে। কথাবার্তা পাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খবর এসেছে, ভিনসেন দুর্গ থেকে বোফট পালিয়েছেন। কাজেই দ্যার্তেগা এবং পোর্থসের প্রথম কর্তব্য বোফর্টকে ধরে আনা, কারণ বোফর্ট যদি বিদ্রোহী প্রজাদের নেতা হওয়ার সুযোগ পায়, তবে সে বিদ্রোহ দমন করা অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে ম্যাজারিনের বিশ্বাস।
.
ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে বেয়ার্ড আর ভলকান। সারাদিন চলেছে দ্যার্তেগা আর পোর্থর্সকে নিয়ে, এক মুহূর্তের জন্যে বিশ্রাম পায়নি ঘোড়া দুটো। শেষ পর্যন্ত আর পারল না, একই সময়ে একযোগে আছড়ে পড়ল ওদুটো এবং পড়ার সাথে সাথে মারা গেল।
অশ্বারোহী দুজনই ঘোড়া পড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেড়ে সময়মতো নেমে পড়েছে।
এরপর?
সঙ্গের সৈনিকেরা পিছিয়ে পড়েছে সেই সকাল বেলাতেই পোর্থসের চাকর মাস্কেটনও আছে তাদের মধ্যে। পিছনে আছে, কিন্তু তার ঘোড়াও দুর্বল।
বোফর্টকে এখন ধরা যায়নি, বেয়ার্ড ভলকানের মতো তেজী ঘোড়া
ববস্থা করেছেন, নির্দিষ্ট আস্তানায় ঘোড়া রাখা আছে, বোফক্ট আসছেন, ক্লান্ত ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নতুন ঘোড়ায় উঠে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ভেন্ডেসের উদ্দেশে এই ভেন্ডেসে প্রদেশের ডিউক বোফট। দ্যার্তেগা পোর্থসের ঘোড়া খতম। তার মানে কি এই অভিযানের এখানেই সমাপ্তি কি হবে একজনের ক্যাপ্টেনের অন্যজনের ব্যারণ পদের! সবই কি স্বপ্নই থেকে যাবে?
কিন্তু ওই ঘোড়ার ডাক শোনা যায়। তাড়াতাড়ি দুই বন্ধু ঐ ডাক লক্ষ্য করে ছুটল, তখন সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। পথের দুই পাশে জঙ্গল সেই জঙ্গলের ভেতরে আলো দেখা যায়, আবার ঘোড়ার ডাকও শোনা গেল, সেই আলোর কাছ থেকেই। দ্রুত এবং সংগোপনে বড় বড় গাছের আড়ালে দুই বন্ধু আলো লক্ষ্য করে ছুটছে, আলোর কাছে দেখতে পেল, চারটি বড় ঘোড়া রয়েছে। সহিসেরা দলাইমলাই করে খেতে দিয়েছে তাদের।
দ্যার্তেগা ও পোৰ্থস সহিসদের সামনে গিয়ে বলল, ‘ঘোড়াগুলো আমরা কিনতে চাই। সহিস প্রথমে অবাক হলো তারপর রেগে গেল, কিনব! কিনব বললেই কেনা যায় নাকি? এ ঘোড়ার মালিক কে জান? মন্টবেজনের ডিউক। তিনি ঘোড়া বিক্রি করবেন ভেবেছ?
‘না বিক্রি করলে এমনি নিয়ে নেব। রাজার দরকার। মন্টবেজনই হোক বা অন্য যে হোক, রাজার প্রয়োজনের কাছ সবাইকে মাথা নোয়াতে হবে।‘
সহিসেরা শেষ চেষ্টা করল, ‘মাত্র আধঘণ্টা আগে ঘোড়াগুলো অনেকদূর থেকে ছুটে এসেছে, বিশ্রামের দরকার ওদের।‘
‘আধ ঘণ্টা বিশ্রাম যথেষ্ট।’ বলে ঘোড়াগুলোকে খুলে নিল দ্যার্তেগা। ‘রাজার কোষাগার থেকে মন্টবেজনকে ঘোড়ার দাম পাঠিয়ে দেয়া হবে। একটার পিঠে দ্যার্তেগা অন্য একটাতে পোৰ্থস চড়ে অন্য দুটোকে সামনে তাড়িয়ে নিয়ে চলল, একটা তো মস্কেটনের এখনই দরকার হবে। মরিয়া হয়ে সহিসেরা বন্দুক বার করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল দ্যার্তেগাকে লক্ষ করে। সহিসের গুলি সৈনিকের গায়ে লাগে না।’ হেসে উঠল পোর্থস। জোরে ঘোড়া চালিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেল তারা।
রাজপথে উঠতেই মাস্কটনের সঙ্গে দেখা হলো। তার ঘোড়াও পড়ে গিয়েছে। নতুন একটা ঘোড়া দেয়া হলো তাকে। দ্যার্তেগা বলল, ‘ঘোড়াগুলো আধঘণ্টা আগে বহুদূর থেকে ছুটে এসেছে। অর্থাৎ বোফর্টই এসেছেন এই ঘোড়ায়। মন্টবেজনের ডিউক বোফর্টের আত্মীয়। বোফর্টের ঘোড়াতেই বোফর্টকে ধরতে চলেছি আমরা, মজা মন্দ নয়।’ বলে হেসে উঠল পোর্থস। কিছুটা সামনে এগুতেই বহু ঘোড়ার খুঁড়ের শব্দ শোনা গেল।
‘আমরা শুনেছি বোফর্টের সঙ্গে মাত্র চার জন সঙ্গী আছে।’
‘কিন্তু এত অনেক ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’ বলে পোর্থ।
‘চার হোক আর চল্লিশ হোক–ধরব বলে বেরিয়েছি যখন, তখন ধরবই। বোফর্টকে দ্যার্তেগার ওয়াদা মিথ্যে হবে না। আরো জোরে ঘোড়া ছোটাল দ্যার্তেগা। রাজপথে ঘোর অন্ধকার। অন্ধকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এল দুটো জমাট অন্ধকারের স্তূপ। সেই স্তূপ থেকে কর্কশ আওয়াজ এল-’ কে যায়, থামো।
‘যে যার সে রাজার নামে যায়। সরে যাও, নতুবা মরো।’ হুংকার দিয়ে উঠে দ্যার্তেগা।
পরমুহূর্তেই এদিকে দ্যার্তেগা আর পোর্থস, অন্যদিকে সেই দুই জমাট কালো মূর্তির মধ্যে শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ।
পোর্থসের তরোয়ালের আঘাতে তার প্রতিপক্ষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দ্যার্তেগার পিস্তলের গুলিতে ঢলে পড়ল দ্বিতীয় জন।
‘চলো চলো’ বলে ঘোড়া ছোটাল। বিজয়ী দুজন। কার্ডন্ট সামনেই কোথাও আছে বিশ গজ না যেতেই আবার দুটো অন্ধকারের স্তূপ আলাদা হয়ে এল রাজপথের অন্ধকার থেকে।
‘আর এক পা এগুলেই মরবে’ শাসিয়ে ওঠে সেই স্তূপকৃত অন্ধকার।
‘মরবে রাজদ্রোহীরা’ গুলি চালাল দ্যার্তেগা আর পোর্থস একসাথে। গুলি আসে ও পক্ষ থেকেও একদিকে মারা পড়ে দার্তেগার ঘোড়া, ওদিকে বিদ্রোহীরা। একটা বাড়তি ঘোড়া সঙ্গে আছে, চোখের পলকেই তার পিঠে উঠে বসে দ্যার্তেগা, চলো কোথায় যাবে বোফক্ট? ধরেছি তাকে, এবার নির্ভয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলে দ্যার্তেগা আর পোর্থস।
‘থামো’ আবারও আসে কঠোর নির্দেশ। সামনের পথ আটকে দিয়েছে তৃতীয় একজোড়া অন্ধকার মূর্তি।
দ্যার্তেগা, পোর্থস উত্তর দেয় পিস্তলের মুখে, ওদিকের যোদ্ধারা ঘোড়াকে দাঁড়া করায় পিছনের পায়ের উপর। ফলে গুলি দুটোই বেঁধে যায় ঘোড়ার গলায়। দুটো ঘোড়াই উল্টে পড়ে যায় মাটিতে।
চোখের পলকে আরোহীরা লাফিয়ে নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। একজন কৌতুক করে বলে উঠে ‘ঘোড়ার পর ঘোড়া খুন করে আর কত বীরত্ব দেখাবেন? হিম্মত থাকে তো তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসুন।’
পোর্থস জবাব দেয় ‘তরোয়াল? তা পেলে আর কিছুই চাই না।‘
পোর্থস আর দ্যার্তেগা ঘোড়া থেকে নেমে তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসে।
একদিকে দুইজনে, ওদিকেও দুইজন।
দ্যার্তেগার নিয়ম হলো বিদ্যুতের বেগে তরোয়াল খাপমুক্ত করেই ঝড়ের বেগে আক্রমণ। তার সে আক্রমণ সহ্য করতে পারে এমন যোদ্ধা ফ্রান্সে আছে বলে সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজ তার প্রচণ্ড আঘাতই ব্যর্থ হলো, প্রতিপক্ষ ব্যর্থ করে দিয়েছে তার আঘাত ‘জাহান্নাম’ গর্জে উঠে দ্যার্তেগা সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আঘাত হানে জাহান্নাম! দ্যার্তেগার এই বিশেষ শপথ বাক্যটি এবং সে উচ্চারণের বিশেষ ভঙ্গীটি যে প্রতিপক্ষ ওই যোদ্ধার একান্ত পরিচিত। আঘাতের উত্তরে প্রত্যাঘাতের চেষ্টা না করে সে যোদ্ধা এক লাফে তিন হাত পিছিয়ে গিয়েছে এবং সেই খান থেকে কুঁজো হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। অন্ধকারের জড়তা ভেদ করেও দ্যার্তেগার মুখ তার দেখা চাই।
ওদিকে পোর্থস আর তার প্রতিযোদ্ধা দুইজনের তরোয়াল ভেঙে গিয়েছে যুদ্ধ করতে গিয়ে। তারা এখন গুলি চালাচ্ছে। যে সামান্য ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে গুলি বেরোবার সময় তাতেই ক্ষনিকের জন্য দ্যার্তেগার মুখ আবছা ফুটে উঠল, অমনি দ্যার্তেগার প্রতিপক্ষের কণ্ঠ থেকে আর্তনাদ বের হলো ‘দ্যার্তেগা? অ্যারামিস। গুলি বন্ধ কর। গুলি বন্ধ কর’।
এ কণ্ঠস্বর ভুল হওয়ার নয়, দ্যার্তেগারও চিনতে কষ্ট হলো না, সেও প্রায় একই রকম তীক্ষ্ণস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ‘অ্যাথোস?
পোর্থস বলে উঠল, ‘অ্যারামিস’।
অ্যারামিস বলে উঠল, ‘পোর্থস।‘
কী করুণ পরিস্থিতি! একদিন যারা ছিল এক আত্মার বন্ধু তারা আজ প্রাণের শত্রু। কে ধারণা করতে পেরেছিল যে দ্যার্তেগার সঙ্গে অ্যাথোস একদিন যুদ্ধে লিপ্ত হবে, কোন পাগলের মাথায় এ কল্পনা এসেছিল যে পোর্থস আর অ্যারামিস পরস্পরের টুটি ছিঁড়ে নেবার জন্য ক্ষেপে উঠবে একদিন?
‘ভবিতব্য।’ বলে কপালে চাপড় দিল দ্যার্তেগা, ‘সারা ফ্রান্সে একটি মাত্র মানুষ ছিল যে আমার তরোয়ালের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। আজ কিনা সেই মানুষটিই আমার তরোয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল, আমার মর্যাদাকে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে?’
অ্যাথোসের প্রাণের বন্ধু দ্যার্তেগা। তার এই কাতর আর্তি অ্যাথোসের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে তুলল, সে এগিয়ে এসে দ্যার্তেগার সামনে দাঁড়াল তরোয়াল খাপে পুরে বলল ‘বন্ধু’ তোমার মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কাজ আমি করতে পারি না। তুমি তোমার তরোয়াল আমার বুকে গেঁথে দাও। কারণ জীবন থাকতে আমি বোফটকে ত্যাগ করতে পারব না।
‘তোমরা বোফক্টের পক্ষে সে কথা আগে বলনি কেন?’ দ্যার্তেগার গলায় তিক্ত অভিযোগ।
‘আমিও তোমার আর অ্যারামিসের কাছে গিয়েছিলাম? তখন কেন তোমাদের ইচ্ছা প্রকাশ করোনি।’
অ্যাথোস হঠাৎ এ অভিযোগের কোনো উত্তর দিতে পারল না। বলল, ‘এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আলোচনা করব। কাল পারি তো সাক্ষাত করব আমরা। তোমাদের সঙ্গে বড় ধরনের একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তা হোক, কিন্তু এতে আমাদের সারা জীবনের বন্ধুত্ব যাতে বিনষ্ট না হয়, তা আমাদের করতেই হবে।’
বেশি কথার সময় হলো না, প্রায় পঞ্চাশ জন ঘোড়া সওয়ারী নিয়ে বোফর্ট নিজে এসে পড়েছেন। তিনি অনেকটা এগিয়ে ছিলেন অ্যাথোস আর অ্যারামিসের দেরি দেখে তাদের খোঁজ নিতে ফিরে এসেছেন।
পঞ্চাশজন ঘোড়া সওয়ার এসে ঘিরে ফেলেছেন দ্যার্তেগা আর। পোর্থর্সকে ‘আপনারা আমার বন্দি, অস্ত্রসমর্পন করুন’ আদেশ দিলেন বোফক্ট।
‘জীবন থাকতে নয়।’ স্পষ্ট জবাব দ্যার্তেগার।
অ্যাথোস এগিয়ে গিয়ে বোফটকে কানে কানে কিছু বলল,
‘তখন আপনাকে আমার অদেয় কিছু নেই,’ এই বলে ডিউক সঙ্গীদের নিয়ে ভেন্ডোমের পথে অগ্রসর হলেন।
অ্যাথোস আর অ্যারামিসকেও তার সঙ্গী হতে হলো, কিন্তু যাওয়ার আগে অ্যাথোস বুকে জড়িয়ে ধরল দ্যার্তেগা ও পোর্থসকে বলল, ‘কাল নিশ্চয়ই দেখা করব। জীবন থাকতে আমাদের বন্ধুত্বকে ক্ষুণ্ণ হতে দেব না।’
সে আশ্বাসের মূল্য এখন কি মর্মান্তিক দ্যার্তেগার কাছে? জীবনে এতবড় পরাজয় তার ভাগ্যে আর কখনও ঘটেনি।
.
২.
যেমন সীমান্ত যুদ্ধ চলছে কিছুদিন থেকে। রবরয় বিজয়ী প্রিন্স কন্ডি সেখানে ফরাসি সৈন্য পরিচালনা করছে, গ্রামন্ট আর শ্যাট্রিলনের দুই ডিউক সহকারী হিসাবে রয়েছেন তার সঙ্গে। গ্রামান্টের একমাত্র পুত্র, কাউন্ট গিচে, তার বয়স ষোলো কি সতেরো। প্যারিস থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিয়েছে। পিতার সঙ্গে থেকে সে যুদ্ধবিদ্যা শিখবে। সঙ্গে আছেন তার পৌঢ় শিক্ষক এবং দুই সশস্ত্র চাকর। এদের সবাই ঘোড়ার পিঠেই ভ্রমণ করছেন।
পথে পড়ল খরস্রোতা অয়সি নদী, পারাপারের জন্য আছে নৌকা, এত চওড়া আর মজবুত নৌকা যে, ঘোড়া সহই তার উপরে উঠে যায় গিচেও সবাই মিলে উঠেছে। নৌকা প্রায় মাঝ নদীতে।
হঠাৎ কেন জানি গিচের ঘোড়াটা ভয় পেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল গিচকে পিঠে নিয়ে, হায় হায় করতে করতে লাফিয়ে পড়লের গিচের বৃদ্ধ শিক্ষকও কারণ তিনি জানেন গিচ সাঁতার জানে না।
গিচ ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছে, তলিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক উজান ঠেলে তার কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। নৌকায় অন্য যাত্রী যারা আছেন, তারা বোকার মতো তাকিয়ে আছে, নদীতে লাফ দিয়ে পড়ার মতো সাহস তাদের কারোরই হচ্ছে না।
গিচে তলিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক বেচারী সাঁতার দিতে দিতে করুণ আর্তনাদ করে চলেছেন বাঁচাও, বাঁচাও।
বাঁচাবার কি কেউ নেই?
আছে পনেরো বছরের একটা ছেলে লাফিয়ে পড়েছে জলে, নৌকা থেকে নয়, সে পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল পরবর্তী খেয়ার অপেক্ষায়। সেই নদীর পাড় থেকেই সে ঝাঁপ দিয়েছে।
সাঁতারে অসাধারণ পটু এই কিশোর আর তার সুবিধে এই, স্রোতের পক্ষেই সে আসছে। দেখতে দেখতে সে এসে পড়ল, গিচে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এমন সময় কিশোর এসে তার চুল ধরে টেনে তুলল, টেনে নিয়ে তাকে ধরিয়ে দিল তারই ঘোড়ার কেশর, তারপর গিচের দিকে লক্ষ্য রেখে ঘোড়াটাকেই চালিয়ে নিতে লাগল পাড়ের দিকে।
তীরে পৌঁছে গিচেকে সুস্থ করে তুলতে বেশি সময় লাগল না, গিচের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, শিক্ষক এই অপরিচিত কিশোরকে নিয়ে মেতে উঠলেন এক বারে। গিচে বলে উঠল, ‘আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে, সারা জীবনের মতো অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমি কাউন্ট গিচে, ডিউক গ্রামন্ট আমার বাবা। তার সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
পরিচয় পেলেই পাল্টা পরিচয় দিতে হয়, কিশোর বলল, আমি রাওল, ভাই কাউন্ট ব্রাগোলেন। কাউন্ট ড্যা-লা-ফেয়ারই প্যারিসের মাস্কেটিয়ারও রাজনৈতিকদের সমাজে অ্যাথোস নামে পরিচিত।
রাওলও যুদ্ধেই চলেছে, প্রিন্স কন্ডির কাছে যাচ্ছে, তারই বোনের সুপারিশ নিয়ে।
প্রথম বয়সের বন্ধুত্ব, দেখতে দেখতে তা গম্ভীর হয়ে উঠে। বিশেষত যেখানে শিক্ষা দীক্ষা মনের মিল থাকে, এখানেও তাই হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই গিচে আর রাওল সমপ্রাণ বন্ধুতে পরিণত হলো। এক সঙ্গে ভ্রমণ করবে, এক হোটেলে থাকবে, এক টেবিলে খাবে, একই রুমে ঘুমাবে।
প্রথম দিন নির্ঞ্ঝাটে কাটল, মনের আনন্দে পথ চলছে দুই বন্ধু। রাওলের মনে শুধু একটাই চিন্তা গ্রিমড এসে পৌঁছেছে কিনা।
গ্রিমড ছিল ডিউক বোফর্টের সঙ্গে। আসলে গ্রিমডের সাহায্যেই বোর্টের ভিনসেন দুর্গ থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিল।
রাওলকে বিদায় দেয়ার সময় অ্যাথোস বলে দিয়েছে–প্যারিস গিয়েই সেখান থেকে তিনি গ্রিমডকে পাঠাবেন রাওলের সঙ্গী হওয়ার জন্য, গ্রিমড সঙ্গে থাকলে রাওলের সম্পর্কে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। ও হবে সহকারী ও অভিভাবক। গ্রিমড যাতে রাওলকে খুঁজে পায়, তার জন্যই প্রতি হোটেলে রাওল হোটেলের মালিককে বলে যাচ্ছে গ্রিমডের নাম–এখানে এলেই তাকে ওখানে যেতে বলবেন দেরি না করেই।
দ্বিতীয় দিনে গিচে রাওলের দলটি বেথুন শহরের কাছে এসে পড়ল, প্রিন্স কন্ডিকে এখানেই পাবার আসা করেছিল তারা, কিন্তু এখানে খবর পেলে কন্ডি বেথুন ত্যাগ করে কাম্পিয়ার পিছু হঠেছেন।
তাহলে ওদের আর বেথুনের দিকে যাওয়ার কোনো কারণ থাকে না।
নদীর ধারে ছোট ছোট ঝোঁপ ঝাড়। এক একটা এমন ঘন যে বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না তার ভেতরের চেহারা। এর একটার পাশ দিয়ে ওরা যখন ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে, হঠাৎ শোনা গেল পরপর কয়েকটা বন্দুকের শব্দ।
সবাই ওরা কানখাড়া করে ফেলল ঘোড়া থামিয়ে। কাছেই শত্রু সৈন্য রয়েছে, তা হলে কন্ডি বেথুনে ত্যাগ করতেন না, সেই শত্রু সৈন্যের কোনো ছোট দল কাছে থাকা অসম্ভব নয়। সঠিক সন্ধান না নিয়ে আর অগ্রসর হওয়া উচিত নয়।
গুলির শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে এগিয়ে গেল ও। রাওলদের দলটা যা খুঁজছিল তা সহজেই পাওয়া গেল অন্য একটা ঝোঁপের আড়ালে এক ভয়াবহ কান্ড হচ্ছে।
দুটো লোক রক্তাক্ত মাটিতে পড়ে আছে, অন্য দুটো লোক তাদের জামা কাপড় হাতড়াচ্ছে। অনায়াসে বোঝা যায়, এরা সৈন্য দলের অংশ হলেও সময় বিশেষে ডাকাতিতে পিছপাও নয়। স্পেনীয় সৈন্যদের এরকম দুর্নাম চিরদিনই আছে।
রাওলদের দলটাকে দেখতে পেয়েই এই ডাকাত দুটো বুন্দুক তুলে গুলি করল, একজনের গুলিতে রাওলের ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে গেল রাওলকে নিয়ে। আততায়ী ছুটে এলো রাওলকে হত্যা করার জন্য।
কিন্তু অন্য আততায়ীর গুলি ব্যর্থ হয়েছে এবং গিচেকে নিজের দিকে এগোতে দেখে সে দ্রুত অদৃশ্য হয়েছে ঝোঁপের আড়ালে, গিচে গিয়ে উদ্ধার করল রাওলকে এবং বন্দি করল তার আততায়ীকে।
এবার আহত লোক দুটিকে পরীক্ষা করে তারা দেখতে পেল যে, একজন মারা গিয়েছে, অন্যজনও সাংঘাতিক আহত, গুলিতে তার উরুর হাড় ভেঙে গুড়ো হয়ে গিয়েছে। রাওলদের প্রাথমিক চিকিৎসায় একটুখানি প্রকৃতিস্থ হয়েই এই আহত লোকটি অতি কাতরভাবে ত দর বলল, ‘ভাই আপনারা আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য বৃথা চেষ্টা করবেন না, বাঁচাবার কোনো সম্ভাবনা আমার নেই, বরং যদি আমার আত্মাকে বাঁচাবার জন্য একটু কষ্ট স্বীকার করেন তাতেই আমার উপকার হবে অনেক বেশি।’
‘আত্মাকে বাঁচানো’? গিচে আর রাওল জিজ্ঞেস করে, ‘কী করতে পারি, বলুন। আপনারাতো খ্রিস্টান! জানেন না কি যে প্রত্যেক খ্রিস্টানেরই উচিত মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কোনো ধর্ম যাজকের কাছে সারা জীবনের পাপ স্বীকার করা? অকপটে পাপ স্বীকার করলে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে ধর্মযাজক তাকে পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন, অনুতপ্ত পাপী নরক থেকে রক্ষা পায়।’
‘আপনি কোনো ধর্মযাজকের কাছে পাপ স্বীকার করতে চান?’ জিজ্ঞেস করে দুই তরুণ।
‘একান্তভাবে চাই, না করলে অনন্ত নরকবাস অনিবার্য। আমরা একটা ঘোরতর পাপ করেছিলাম বহুদিন আগে। বিবেকের কাছে তার জন্য দায়ী হয়ে আছি। তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে যদি মরতে হয় তবে আমার আত্মা মুক্তি পাবে না। আপনারা যান, একজন যাজক এনে দিন আমার কাছে।’
‘কোথায় পাওয়া যাবে যাজক বলতে পারেন?
‘তা পারি। এই পথ ধরেই আধমাইল গেলে একটা সরাইখানা পাবেন। গ্রামটার নাম ঘোনি, ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে সন্ন্যাসিদের মঠে আছে একটা। মঠে খবর দিলে সন্নাসীরাই কেউ আসবেন।’
তখন রাওলেরা গাছের ডাল কেটে মাচা বেঁধে চাকরদের দ্বারা আহত লোকটিকে ওই সরাইখানায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করল। রাওল আর গিচে ততক্ষণে চলে যাবে ওই মঠে এবং সন্ন্যাসীদের কাউকে সরাইখানায় আসতে অনুরোধ করবে। মঠ থেকে তারা নিজেদের পথে এগিয়ে যাবে, সরাইখানায় আর ফিরবে না, কারণ সময় নেই তাদের। যে কোনো সময় যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যেতে পারে এবং যুদ্ধের আগেই তারা কন্ডির কাছে উপস্থিত হয়ে চায়। রাওল আর গিচে ঘোড়া ছুটিয়ে গ্ৰেনির দিকে চলে গেল। শিক্ষক চাকরের সাহায্যে আহত লোকটিকে নিয়ে আসছেন, তাকে আপাতত সরাইখানায় এনে তোলা হবে, সেখানেই ডাক্তার এবং যাজক ডেকে আনা হবে তার। জন্য।
সরাইখানার সামনে দিয়ে রাস্তা। সেখানে ঢুকে সরাইওয়ালাকে জানানো হলো একজন আহত লোককে তার হোটেলে নিয়ে আসা হচ্ছে। একে আশ্রয় দানের জন্য পাওনা যা হবে, তা সে শিক্ষকের কাছ থেকে পাবে, সে ততক্ষণে একখানা ঘর ঠিক করে রাখুক। তারপরই তারা ছুটল গ্রামের শেষে মঠের অভিমুখে, সেখান থেকে একজন যাজককে এক্ষুণি পাঠানো চাই।
ভাগ্য ভালো মঠ পর্যন্ত যেতে হলো না, নির্জন গ্রামের রাস্তা দিয়ে একটা গাধা আসছে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে। তার পিঠে এক আরোহী। পোষাক দেখে তাকে সন্ন্যাসী শ্রেণীর ধর্মযাজক বলেই মনে হবে। দুই বন্ধু উৎফুল্ল, তাদের কাজ সহজ হয়ে এল।
তাড়াতাড়ি গাধার মুখোমুখি দাঁড়াল তারা যাজকের দিকে এক পলক তাকিয়ে। কিন্তু কী রকম যেন লাগল তাদের। লোকটির বয়স কুড়ি বাইশের না, তবু বিভীষিকার একটা আবহাওয়া যেন ঘিরে রেখেছে ওকে। যাজক দেখলে যে সমবোধ মনে আসার কথা তা মোটেই আসছে না এদের মনে।
তা না আসুক, একে এখন প্রয়োজন, সুতরাং কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল একং নম্র করে রাওল বলল–‘গুরুদেব, একটি আহত লোককে শেষ সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আপনার কাছে কি আমরা অনুরোধ জানাতে পারি? সে কাছেই আছে।’
আশ্চর্য যাজকটি রাওলের কথা যে শুনতে পেয়েছে তাতে তিল মাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায় কেন?
পাশ কাটিয়ে সত্যিই চলে যাচ্ছে লোকটা।
গিচে এ ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারল না, ঘোড়ার মুখ ঘুড়িয়ে দিয়ে রাস্তা বন্ধ করল গাধার তারপর কঠিন স্বরে বলে উঠল, ‘এ আপনার কি রকম ব্যবহার যাজকভাই? প্রশ্ন শুনলে তার জবাব দিতে হয়, সেটা সাধারণ ভদ্রতা। আপনাকে যে অনুরোধ করা হয়েছে, সেটার সঙ্গে তো আপনার পোষাকের কোনো বিরোধ নেই।’
‘কথার উত্তর দেয়া না দেয়া আমার ইচ্ছে।’ নিচু গলায় অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল যাজক।
‘ইচ্ছে?’ গর্জে উঠল গিচে। আমরা সে শ্রেণির লোক নই, যাদের কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়া যায়।
রাওল দেখল যে কলহ বাধলে মৃত প্রায় লোকটির কাছে যাজককে নিয়ে যেতে ব্যাঘাতই সৃষ্টি হবে, সে শান্তভাবে কথা বলল রাগী যাজককে ঠাণ্ডা করার জন্য, তার প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলল এবং আবার অনুরোধ করল–যাজক যাতে অবিলম্বে সরাইখানায় গিয়ে ধর্মীয় সান্তনা দেন মুহুর্মুকে। গিচের কিন্তু রাগ কমে না। সে আবারও ধমকে উঠল, আপনি যদি না যান, আপনাকে বাধ্য করতে আমরা জানি।
এবার যাজক চোখ তুলে তাকাল। দুই চোখের দৃষ্টি যেন ছুরি হয়ে ঢুকে যায় একবারে মনের মধ্যে।
‘আমি যাচ্ছি’ আস্তে উত্তর দেয় সে।
রাওলই তাকে বুঝিয়ে বলে–‘সরাইখানায় গেলেই আহত লোকটিকে পাবেন। আঘাত খুবই সাংঘাতিক তার। ডাক্তার যদি পাওয়া যায়ও তাহলেও কোনো উপকার হবে না। উপকার যদি হয়, আপনার দ্বারাই হবে, আপনি এগিয়ে যান, আমরা আপনার সঙ্গে যেতে পারছি না। কারণ আমাদের তাড়া আছে। ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছি আমরা।’
গিচেও তার কথা বলে–‘আমরা অন্যদিকে যাচ্ছি সত্যি, কিন্তু এই পথেই ফিরব। তখন যদি শুনতে পাই যে আপনি যাননি বা কর্তব্যে অবহেলা করেছেন, তা হলে আপনি যেখানেই থাকুন, আপনাকে খুঁজে বার করে সে অবহেলার সাজা দেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। তা জেনে রাখুন।’
আবার সেই ছুরি ঝলসে উঠল যাজকের চোখে। কিন্তু চোখ নামিয়ে সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল–‘আমি তো যাচ্ছিই।’
তারপর যাজক তার খচ্চর চালাল গ্রামের দিকে, আর গিচে রাওলও ঘোড়া ছোটাল ক্যাম্বিন শিবিরের দিকে, কন্ডি সেখানে আছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যদি তার কাছে হাজির না হওয়া যায়, এত তাড়াতাড়ি করে ছুটে আসা একান্তই বৃথা যাবে।
যাজক এসে যখন সরাইখানায় পৌঁছাল, আহত লোকটি তখন ঘরের ভেতরে। একটু আগেই গিচের শিক্ষক তাকে এখানে এনে তুলেছেন।
মুমূর্ষকে যখন ঘরে ঢোকানো হচ্ছে, সরাইওয়ালা আর তার স্ত্রী তখন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুজনেই তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে এবং কি আশ্চর্য! দুজনে একই সঙ্গে চমকে, শিউরে উঠেছিল।
সরাইওয়ালা তার স্ত্রীকে বলল, ‘চিনতে পারলে?’
‘পারিনি আবার! আমাদের ভাগ্যে যে কি আছে, কে জানে।’ স্ত্রী কপালে আঘাত করে বলল–‘ভাগ্যে আছে ঘোরতর বিপদ, তা নইলে বেথুনের ঘাতক আমাদের ঘরে এসে উঠবে কেন?’ ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই যাজক ‘বেথুন ঘাতক’ কথাটি তার কানে প্রবেশ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে গেল।
.
প্রায় আধঘণ্টা পরে। গিচের শিক্ষক চাকরদের নিয়ে সরাই থেকে চলে গিয়েছে, গিচের সাথে যোগ দিতে হবে তাকে।
এদিকে যাজক ঢুকেছে মুমূর্ষের রুমে, সে রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কারণ মৃত্যুপথযাত্রী যখন যাজককের কাছে পাপ স্বীকার করে যাজক ভিন্ন অন্য কারো তা শোনা নিষেধ।
‘হ্যাঁ, আধঘণ্টা কেটে গিয়েছে, নতুন একজন পথচারী এসে সরাইতে ঢুকল, এ মিড, যার জন্য রাওল সারা পথে হোটেলে ঠিকানা রেখে যাচ্ছে।’
গ্রিমড এসেই জিজ্ঞেস করল—’এ পথে ষোলো বছর বয়স্ক কোনো তরুণ যোদ্ধা গিয়েছে কি?’
সরাইওয়ালা বলে উঠল–‘গিয়েছে বইকি? মাত্র আধঘণ্টা আগে তিনি এখানেই ছিলেন, ভাইকাউন্ট ব্যাগোলন? তিনি আজ রাতে ক্যাম্বিনে থাকবেন। সেখানে গিয়েই ধরতে পারবেন তাকে।’
যাক নিশ্চিন্তা গ্রিমড হাফ ছেড়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। কিছু খাবার আনার জন্য বলল সরাইওয়ালাকে।
খাবার আসতে দেরি হলো না, গ্রিমড খেতে শুরু করেছে–
এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।
সবাই চমকে উঠল! কার আর্তনাদ! কোথা থেকে?
ভেতরের ঘর থেকে, সেখানে আছে ওই আহত ব্যক্তি আর যাজক।
কে সেই আহত, গ্রিমড উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসার উত্তরে সবে বলতে শুরু করেছে সরাইওয়ালাও, এমন সময়ে আবার আবার একটা আর্তচিৎকার, এবার আর তত তীক্ষ্ণ চিৎকার নয়, অনেকটা যেন কাতরানির মতো।
গ্রিমড আর নির্লিপ্ত থাকতে পারল না, ছুটল আর্তনাদ লক্ষ্য করে, ছুটল সরাইওয়ালাও। আহতের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, এদিক থেকে সজোরে, ধাক্কা দিল গ্রিমড। কেউ দরজা খোলে না, কোনো সাড়াও দেয় না, কিন্তু কাতর আর্তনাদ সমানভাবে শোনা যাচ্ছে, না সমানভাবে নয়, স্বরটা যেন ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে।
‘দরজা ভাঙতে হবে,’ বলে গ্রিমড।
সরাইওয়ালা সায় দিলে, দরজা ভাঙতেই এক বীভৎস দৃশ্য দেখে দুজনেই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল। বিছানার উপর সেই আহত লোকটি পড়ে আছে, তার বুকে একটি লম্বা ছোরা, ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তের স্রোতে।
মুহূর্তে ভয় এবং আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রিমড এগিয়ে গেল ঘরের ভেতর, এ লোকটাকে ছোরা মারল কে? শুধুমাত্র যাজক ছিল এই ঘরে, সে কোথায় গেল? কোথাও নেই সে, জানালা অবশ্য ভোলা রয়েছে। ওই পথ দিয়ে পালিয়ে গেছে সে।
সরাইওয়ালা ছুটে বেরিয়ে গেল, যাজককে ধরার জন্য এবং ডাক্তারকে ডাকার জন্যও। গ্রিমড গিয়ে ঝুঁকে পড়ল বিছানার উপর। লোকটা এখানো মরেনি।
মরেনি এবং তাকে দেখেই গ্রিমড আবার এক পা পিছিয়ে এল ভয়ে, বিস্ময়ে তার মুখ থকে বেরিয়ে এল একটা অর্ধস্ফুট শব্দ–‘বেথুনের সেই ঘাতক!’
.
৩.
মনে ব্যথা নিয়ে ফিরে এসেছে দ্যার্তেগা আর পোর্থস, অ্যাথোস আর অ্যারামিস ছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তারা আজ শত্রুপক্ষে।
আজ যারা শত্রুপক্ষে, কাল তারা শত্রু হয়ে দাঁড়াতে কতক্ষণ? আজ বোফোর্টের জন্য যারা তরোয়াল তুলেছে দ্যার্তেগা-পোর্থসের মাথার উপর, কাল যে তারা নিজেদের স্বার্থের খাতিরে সেই তরোয়াল তুলবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?
কিন্তু বিদায়ের সময় অ্যাথোস বলে দিয়েছে–প্যারিসে এসে তারা এ সম্বন্ধে আলোচনা করবে। আজই রাত দশটার সময় তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা, হোটেল রোহানের পাশে একটা ছোট পার্ক আছে, অত রাত্রে সেখানে জনপ্রাণী থাকবে না, আলোচনা হবে সেখানে।
‘আলোচনা, না যুদ্ধ’ দ্যার্তেগা বাকা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে পোর্থর্সকে। বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছে, এখন বিশ্বাসঘাতকতা।
পোৰ্থস সাদাসিধে, সে বলে–‘যুদ্ধ হয়–হতে কতক্ষণ? হোক, আমরা তাতে পিছপা নই, কারণ ওরা পঞ্চাশ জন ছিল, আজ আমরাও দুজন, ওরাও দুজন। দেখে নেব।’
রাত নটাতেই ওরা প্রস্তুত হয়ে রওনা হল, লম্বা আলখেল্লার নিচে লুকিয়ে রাখল লম্বা তরোয়াল, প্রস্তুত থাকা ভালো, কি জানি যদি যুদ্ধই করতে হয়।
অ্যাথোস আর অ্যারামিসও দেরি করল না। অস্ত্র নিয়ে তারাও এসেছে। অ্যাথোস অবশ্য আসতে চায়নি, আসতে বাধ্য হয়েছে অ্যারামিসের জন্য। অ্যারামিস বিশ্বাস করে না এদেরকে, বিশেষ করে দ্যার্তেগাকে। পার্কের গেট তালা বন্ধ, চাবি থাকে রোহান হোটেলে, অ্যারামিস সবাইকে চেনে, সে গিয়ে চাবি নিয়ে এল সেখান থেকে, চারজন গিয়ে বসল এক গাছের নিচে, অন্ধকারে।
অভিযোগ, অনুযোগ, অসন্তোষ, আক্ষেপ, রাগারাগি থেকে ক্রমশ আক্রমণের পর্যায়ে। বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই, ক্রোধে, উত্তেজনায় আলখেল্লার নিচে তরোয়ালের বাট ধরেছে শক্ত করে।
একই নালিশ উভয় পক্ষের মুখে–সরলতার অভাব তোমাদের, আগে কেন বললে না যে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ। এ ঠিক যেন পিছন থেকে ছুরি মারা।
অবশেষে সমস্ত ঝগড়ার উপর শান্তিজল ছিটিয়ে দিল অ্যাথোস। নিজের তরোয়াল হাঁটুর চাপে দুই টুকরো করে ভেঙে ফেলে দিল বুক চিতিয়ে দাঁড়াল দ্যার্তেগার সামনে–‘ইচ্ছে হয় তোমার তরোয়াল বসিয়ে দাও আমার বুকে, আমি কখনও বন্ধুকে আঘাত করতে পারব না।’
এ মহৎ দৃষ্টান্ত কি অন্তর স্পর্শ না করে পারে? যারা অস্ত্র কোষ মুক্ত করেছিল, তারা কোষবদ্ধ করল আবার, আগের দিনের সাহচর্যের মধুর স্মৃতি তাদের হৃদয় করে তুলল সিক্ত, আপ্লুত পোৰ্থস আর অ্যারামিস পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল বুকে, দ্যার্তেগা অ্যাথোসের বুকের উপর পড়ে চোখের জল ফেলতে লাগল।
তারপর সবাই একটু শান্ত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হলো আবার, এবার আলোচনায় অতীত নেই, আছে ভবিষ্যৎ একটা নীতি স্থির করতে হবে, একটা কর্মসূচী চাই।
অ্যাথোস বলল–‘বোফোর্টও আমার কেউ নয়, দ্যার্তেগারও কেউ নয় ম্যাজারিন, সাময়িক প্রয়োজনে আমরা যে যার দলে যোগ দেই না কেন, আসলে আমরা চারজনে এক দল, যে দল চিরদিন এক থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। বিরোধী দলে আমরা কাজ করতে পারি, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ আমরা প্রাণ গেলেও করব না, যুদ্ধ ক্ষেত্রে, শত্রু শিবিরে যখন যেখানে আমাদের সাক্ষাৎ হবে, আমরা যেন সেখানেই পরস্পরের সংকটকে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারি। যে কোনো প্রয়োজনে চারবন্ধু যেন একান্ন হয়ে চেষ্টা করতে পারি। ঠিক সেই বিশ বছর আগের মতো।’
এই শপথকে হৃদয় দিয়ে মেনে নিল চারবন্ধু, তাদের নীতি হল, বীরে সমাজে বন্ধুত্বের আদর্শ স্থাপন। একের জন্য চার। চারের জন্য এক।
রাত্রি অনেক হয়েছে। আজকের মতো আলোচনা শেষ করতে হয়, কিন্তু কাল আবার মিলিত হবে। ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগার এ আনন্দকে এত সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না। ঠিক হলো একটা নির্দিষ্ট হোটেলে পরদিন সন্ধ্যা বেলা চার বন্ধু আবার এক হবে এবং রাতের খাবার খাবে।
অ্যাথোস জানে, খাবার টেবিলে মনের উদারতা বেড়ে যায়, হৃদয় হয় নরম। অতীতের অনেক ভুলই শ্যাম্পেনের গ্লাসে ডুবে যায়।
.
পরের দিন সন্ধ্যায় খাবারের টেবিলে বিশ বছর আগের সুবাতাস বইছে, পোর্থসের হাসিতে ভরে উঠছে সারা হোটেল। অ্যারামিস আর দ্যার্তেগা পরস্পরকে হানছে রসিকতার তীক্ষ্ণ ছুরি, সাথে অ্যাথোস বড় ভাই সুলভ হাসিতে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে তিনজনকে।
হঠাৎ অপ্রতাশিত ভাবেই সেখানে ঢুকল গ্রিমড। অ্যাথোস চমকে উঠল। তবে কি কোনো বিপদ ঘটল প্রিয় রাওলের? কী সর্বনাশ! রাওল যে একমাত্র অবলম্বন অ্যাথোসের জীবনে। ঈশ্বর কী কেড়ে নেবেন সেই সম্বলকে।
কিন্তু অ্যাথোসের সুস্পষ্ট আদেশ ছিল গ্রিমড রাওলের সঙ্গে থাকবে যুদ্ধক্ষেত্রে। গুরুতর কারণ না ঘটলে গ্রিমড অ্যাথোসের সামান্য আদেশ ফেলত না।
‘রাওল বেঁচে আছে তো’ সরাসরি প্রশ্ন করে অ্যাথোস।
‘না, না, ভাইকাউন্টের কিছু হয়নি মালিক, সামান্য বিপদও নয়, সে জন্য আপনি ভাববেন না।’
‘ওঃ বড় ভাবিয়ে তুলেছিল, যাক রাওল যখন বেঁচে আছে, তখন কোনো কিছুতেই আমি বিচলিত হব না।’
‘কিন্তু এমন খবর এনেছি, যাতে মলিক নিশ্চয়ই বিচলিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। বেথুনের সেই ঘাতক। তাকে মনে আছে? মালিক অথবা মালিকের মাননীয় বন্ধুগণের?’
বেথুনের ঘাতক! অ্যাথোসের ঠিকই মনে আছে, মনে আছে দ্যাগো, পোর্থস ও অ্যারামিসেরও। সে সেই নারীপিচাশী সিন্যাকির মাথা কেটে ছিল লয়ার নদীর পাড়ে বিশ বছর আগের এক অন্ধকার রাতে। হ্যাঁ মরে আছে বই কি। সে ঘটনা ভুলার নয়।
অ্যাথোস উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে–‘কী হয়েছে সেই বেথুনের ঘাতকের?’
‘সে মারা গেছে কাল রাত্রে।’
‘তাই? মরে থাকলে তো ভালই হয়েছে, বিবেকের দংশনের হাত থেকে বেচেছে লোকটা। তুমি জানলে কী করে? প্রশ্নটা অবান্তর বলে মনে হয়।’
‘বেথুনের কাছাকাছিই তো যুদ্ধ হচ্ছে।’
‘তা সত্য, কিন্তু কীভাবে মারা গেল বেথুনের ঘাতক?’
‘আততায়ীর ছোরার আঘাতে।
আবার একটা চমক খেল সবাই, ঘাতককে কে করবে ছোরার আঘাত? তার কে এমন শত্রু থাকতে পারে?
‘ছিল একজন।’ বলতে গিয়ে গ্রিমড যেন শিউরে ওঠে–‘একজন ছিল তার দারুণ শত্রু। মিল্যাডি।’
সে নাম শুনে শিউরে উঠলেও মুখে সবাই একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করল—’মিল্যাডি মারা গিয়েছে কবে।’
‘কিন্তু মিল্যাডির ছেলে বেঁচে আছে।’ নিয়তির মতো নির্মম শোনায় গ্রিমডের কথা।
‘ছেলে? মিল্যাডির ছেলে ছিল নাকি?’ ভূতে পাওয়া লোকের মতো দেখায় চার বন্ধুকে।
‘ছিল তো বটেই। সে এখন বাইশ বছরের যুবক, মায়ের হত্যার বদলা নিতে সে ফ্রান্সে এসে হানা দিয়েছে, তার প্রথম শিকার ওই বেথুনের ঘাতক।’
‘লোকটার–ছেলেটার নাম কী?’
‘বেথুনের ঘাতক বলেছিল মর্ডন্ট ওই ছেলেটার নাম।’
‘ওই মর্ডন্ট রাওলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি তো?’
‘হয়েছে বইকি, তা নইলে আর নিয়তির খেলা বলছিলেন ব্যাপারটাকে?’ ভাইকাউন্ট রাওলই যাজকবেশী মর্ডন্টকে পৌঁছে দেন আহত ঘাতকের শেষ শয্যার কাছে।
অ্যাথোস কপাল চাপড়ে বললেন ‘সত্যিই নিয়তি’।
এবার গ্রিমডও সমস্ত কাহিনী খুলে বলল। সেটা এরকম :
গ্ৰেনির সরাইখানায় খেতে খেতে পরপর দুটো আর্তনাদ শুনতে পায় গ্রিমড। খাওয়া ফেলে সে ছুটে যায় স্বর লক্ষ্য করে। কাতরানি শোনা যাচ্ছিল একটা ঘরের ভেতর থেকে। তার দরজা বন্ধ। দরজা ভেঙে সে দেখতে পেল একটা লোক বিছানায় পড়ে আছে। তার বুকে একটা ছোরা গাঁথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা।
আহত লোকটিকে দেখেই চিনল সে, লোকটি সেই বিশ বছর আগের দেখা বেথুনের ঘাতক।
একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় চার বন্ধুর মুখ থেকে। ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ সেই আওয়াজে।
গ্রিমড বলে চলে তার গল্প।
বেথুনের ঘাতক তখনো মারা যায়নি। অতি কষ্টে তার মুখ থেকে কাহিনীটি শুনেছে গ্রিমড। যাজককে আনা হয়েছিল শেষ স্বীকারোক্তি শোনাবার জন্য। সেই কারণে আত্মপরিচয় দিতে হয় তাকে। পরিচয় শুনেই হলদে মুখ লাল হয়ে যায় যাজকের।
প্রশ্ন করে বিশ বছর আগের সেই দুযযার্গের রাতেও বীভৎস কাহিনী সে। সবই শুনে নিল, মিল্যাডির বিচার ও মাথা কাটার কাহিনী। প্রশ্নের ভঙ্গী থেকে ঘাতকের মনে হয়েছিল এ কাহিনীর কিছু অংশ তার আগে থেকেই জানা।
মিল্যাডির কথা বলতে বলতে একসময় ঘাতক উল্লেখ করে মিল্যাডির আগের নাম ছিল অ্যান নই। ব্যস, এই নামটি শুনেই যাজকের চেহারা পাগলের মতো হয়ে গেল। ‘তুমি অ্যান ব্রুনইকে হত্যা করেছিলে?’ বলেই ছুটে এসে ছোরা বসিয়ে দিল ঘাতকের বুকে, তারপর ‘আমি অ্যান ব্রুইনের পুত্র’ এই কথাটি ঘাতকের নাকের কাছে মুখ এনে বলল। সে তো মানুষের কথা নয়, যেন সাপের হিসহিসানি। ওটাই ছিল যাজকের শেষ কথা। তারপর সে জানালা খুলে পিছন দিক দিয়ে লাফিয়ে পড়ল বাইরে।
শেষে গ্রিমড জানাল–সরাইওলা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যাজক বা তার গাধার সন্ধান পায়নি।
‘কিন্তু সে কোথায় গিয়েছে, তা আমি জানি?’–জোর দিয়ে বলে উঠে গ্রিমড–‘সে এসেছে এই প্যারিসে। শত্রু তার ছয়জন, ছয়জনের মধ্যে একজন গেল–বাকি আরও পাঁচ। পাঁচের চারজন আপনারা আর একজন বোধহয়—’
‘লর্ড উইন্টার’ কথা যুগিয়ে দেয় অ্যাথোস।
‘নিশ্চয়, গ্রিমড বলে জানি না তিনি এখনও বেঁচে আছেন কি না। কিন্তু আপনারা জীবিত। মিল্যাডির ছেলে এখন ছোরা শানাচ্ছে আপনাদের রক্তপাতের জন্য। আপনারা সতর্ক হোন, সে হয়তো খুঁজছে আপনাদের। হয়তো এই মুহূর্তে রাজপথ থেকে এই ঘরের জানালার দিকে লক্ষ্য রেখেছে সে।’
অ্যারামিস তাড়াতাড়ি জানালার পর্দা টেনে দিল, পোর্থস বুকের উপর আঁকল ক্রশের চিহ্ন।
কিন্তু দ্যার্তেগা হাসল–‘আমরা কি চারটা জোয়ান বীর পুরুষ, না দাঁত হীন বুড়ী? একটা মাত্র বালক তা সে যত শক্তিশালী দুবৃত্তই হোক, আমাদের পিছু নিয়েছে বলে আমরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকব?’
অ্যাথোস ধীরে ধীরে গম্ভীর স্বরে জবাব দিল–‘না আমরা থাকব না, যে অবস্থাতেই পড়ি, বীরের যোগ্য আচরণ আমরা করব বই কি! তবে এটা ঠিক যে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ওই একটিমাত্র বালকই আমাদের চারজন বীরপুরুষের সঙ্গে সমানে-সমানে মোকাবিলা করার শক্তি রাখে।’
‘বলো কি। এমন মানুষ দুনিয়ায় আছে বলে বিশ্বাস করি না, বলে ওঠে দ্যার্তেগা।
‘ও মানুষ নয় বন্ধু, ও মানুষ রুপের পিশাচ।
অ্যাথোসের ভাগ্য ভালো, তার সমস্ত দুঃখ ঘুচিয়ে দেয়ার জন্য রাওল হঠাৎ এসে পড়ল। সুসংবাদ নিয়ে এসেছে সে, রাজা ও রানীমার কাছে সুসংবাদের বাহক হয়ে এসেছে। প্রিন্স কন্ডির সুনজরে সে পড়ে গিয়েছে এর মধ্যে। তাই কন্ডি তাকেই বেছে নিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের খবর রাজধানীতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। লেনস এর যুদ্ধে স্পেনীয় বাহিনীকে শেষ করেছেন কন্ডি। ফরাসি সীমান্ত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন শত্রুকে।
রাওল রাজ সভা থেকে এসেই অ্যাথোসের সঙ্গে দেখা করল এবং রাত্রিটা তার কাছে কাটিয়ে সকাল বেলাতেই রওনা হয়ে গেল ব্রাগোলেন দুর্গের দিকে, ব্লয় নগরীর কাছেই ব্রাগোলন অ্যাথোসের বাড়ি। সেখানকার বন্ধু বান্ধবীদের জন্য রাওল খুব উৎকণ্ঠা বোধ করছে।
অ্যাথোস দুঃখ পেল একটু। সংসারে রাওল ছাড়া আর তার অন্য কোনো অবলম্বন নেই, সে এখনও সংসারে রয়েছে, সে শুধু এই রাওলের মুখ চেয়ে। সেই রাওল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসে এক রাতের বেশি অ্যাথোসের কাছে থাকতে পারছে না, সংসার এমনই বিচিত্র জায়গা।
কিন্তু অ্যাথোসের এ দুঃখ অল্প সময়ের জন্য। পরের দিনই সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিল যে রাওল সেই মুহূর্তে তার কাছে ছিল না, কিন্তু সে কথায় পরে আসছি।
.
রাজা, রানীমা ও মহামন্ত্রী ম্যাজারিন থাকেন প্যালেই–রয়েল নামক নামের প্রাসাদে, আগের দিনের স্যুভর প্রাসাদ এখন বাতিল বললেই হয়। সেখানের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা রানী হেলরিয়েটা।
এই রানী হেলরিয়েটা ইংল্যান্ডের রাজা চার্লসের স্ত্রী, ফ্রান্সের রাজকন্যা। বর্তমান রাজার দাদা (পিতামহ) যে চতুর্থ হেনরি, তারই কন্যা। ইংল্যান্ডে প্রজা বিদ্রোহ চলেছে ভয়ানক ভাবে। যুদ্ধে রাজা চার্লস পরাজিত হয়েছেন প্রজাদের হাতে নিরাপত্তার জন্য রানীকে এবং বেশির ভাগ ছেলে মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বিদেশে। প্রথম পুত্র গিয়েছে হল্যান্ডে। রানী একটি কন্যাকে নিয়ে এসেছেন বাপের বাড়ি ফ্রান্সে।
এখানে তিনি আশ্রয় পেয়েছেন, আর কিছু পাননি, কৃপন ম্যাজারিন রাজা লুইকে ঘেঁড়া বিছানায় শুতে বাধ্য করেন, আর তিনি অন্য দেশের রানী, নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত রানীর আরামের কী ব্যবস্থা করবেন? অতিকষ্টেই কাটে হেলরিয়েটার, শীতকালে ঘরে আগুন জ্বালাবার টাকা জোটে না তার। সারাদিন বিছানাতেই শুয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে আত্মরক্ষার কারণ। একটি চাকরও নেই। বাইরের লোক এলে রাজকুমারীকেই গিয়ে দরজা খুলে দিতে হয়।
এমনি সময় ইংল্যান্ড থেকে দূত এল তার কাছে দ্রুত। আর কেউ নয় লর্ড উইন্টার। রাজা চার্লসকে ইংল্যান্ডের সমস্ত লর্ডেরাই ত্যাগ করেছেন, ত্যাগ করেননি শুধু উইন্টার। আজ তিনি চালর্সের চিঠি নিয়ে এসেছেন হেনরিয়েটার কাছে, একটি অতি প্রয়োজনীয় চিঠি।
রাজা চালর্স এই চিঠিতে জানতে চেয়েছেন, শেষ যুদ্ধে যদি তিনি ক্রমওয়েলের (অতি সাধারণ ঘরে জন্ম, কিন্তু প্রজা বিদ্রোহের ইনিই ছিলেন নেতা, চার্লসকে পরাজিত ও নিহত করার পর ইনিই ইংল্যান্ডের শাসক হন) হাতে পরাজিত হন, ফ্রান্স কি তাকে আশ্রয় দেবে?
রানী হেনরিয়েটা এ প্রশ্নের জবাব দেবেন কেমন করে? তাকে তাহলে ম্যাজারিনের কাছে যেতে হবে।
ম্যাজারিনের কাছে? লর্ড উইন্টারের ভালো লাগে না এ কথা। যেতে যদি হয়ই রানী হেনরিয়েটার যাওয়া উচিত রানী অ্যানের কাছে, উনিও রানী, উনিও রানী, তার উপর দুই রানীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, অ্যানের কাছে গিয়ে যদি ব্যর্থ হয়ে ফিরতেও হয় তবু তাতে অপমান নেই। কিন্তু ম্যাজারিন? সেদিন পর্যন্ত যে এক ফরাসি যাজকের চাকর ছিল, তার কাছে ইংল্যান্ডের রানীর যাওয়া উচিত নয়। আর গেলেও আবেদন সফল হওয়ার নিশ্চয়তা কি? ইতালী কি বুঝবে? কিন্তু হেনরিয়েটা জেদ করে ম্যাজারিনের কাছেই গেলেন।
ক্রমওয়েলও চিঠি লিখেছেন ফ্রান্সে, তার দূত একটু আগেই চিঠি এনে দিয়েছে ম্যাজারিনের হাতে, সে দূত আর কেউ নয় হত্যাকারী মর্ডন্ট হেনরিয়েটা আসছেন সংবাদ পেয়েই ম্যাজারিন পিছনের সিঁড়ি দিয়ে মর্ডন্টকে প্রাসাদ থেকে বার করে দিয়েছেন। হেনরিয়েটা ঢুকেছেন সামনের দরজা দিয়ে, মর্ডন্ট বেরুচ্ছে গুপ্তদ্বার দিয়ে।
শেষ পর্যন্ত হেনরিয়েটাকে খালি হাতেই ফিরতে হলো, ম্যাজারিনকে তিনি কোনো মতেই রাজী করাতে পারলেন না, পরাজিত রাজা চার্লস যদি ইংল্যান্ড থেকে পালাতে পারেন, ফ্রান্সে তার ঠাই হবে না, তাকে আশ্রয় নিতে হবে স্পেন বা হল্যান্ডে। কারণ? আছে বই কি? অন্য দেশের যুদ্ধে নাক গলাতে ইচ্ছুক নন ম্যাজারিন। নিজের অশান্তিরই শেষ নেই তার, এখানেও প্রজারা বিদ্রোহী হয়েই আছে বলা যায়। ক্রমওয়েল যদি উসকানি দেন চ্যানেলের ওপার থেকে, এখানেও রক্তনদী বয়ে যাবে দেখতে দেখতে, না ক্রমওয়েলকে শত্রু করতে পারেন না ম্যাজারিন। মহান চতুর্থ হেনরি কন্যার জন্যও না।
হেনরিয়েটার মুখে খবর শুনে বড়ই মুষড়ে পড়লেন লর্ড উইন্টার। কোনো আশ্বাস না নিয়েই তিনি চার্লসের কাছে ফিরে যাবেন?
না, তা কিছুতেই হবে না, ফরাসি রাজশক্তির কাছে সাহায্য না পান, ফরাসি জনসাধারণের সাহায্য পাওয়ার একটা চেষ্টা তাকে করতেই হবে। কিন্তু জনগণ এখন নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। ম্যাজারিনের শোষণ ও কুশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছে যারা রাজপক্ষ তাদের ব্যঙ্গ করে ‘ফ্রন্ডি’ নাম দিয়েছে। ফ্রন্ডি বলতে সেই সব নিষ্কর্মা রাস্তার ছেলেদের বুঝায় যারা ঢিল মেরে ব্যাঙ মারে রাস্তার নর্দমায়, আর পুলিশ দেখলেই ছুটে পালায়, রাজার দল ব্যঙ্গ করে ফ্রন্ডি নাম দিয়েছে তাদের, তারা সে নাম গৌরবে মাথায় তুলে নিয়েছে। ফ্রন্ডির ভয়ে ম্যাজারিন এখন তটস্থ।
তাহলে রাজা প্রজা কোনো দিকই থেকেই কোনো সাহায্যের আশা নেই। না, আছে। হঠাৎ উইন্টারের মনে পড়ে গেল বিশ বছর আগের কথা দ্যার্তেগা, অ্যাথোস, পোর্থস আর অ্যারামিসের কথা সেই অদ্ভুত করিতকর্মা সৈনিক চারজন এখন কোথায়? তাদের যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, রাজা চার্লসের বন্ধুহীন অবস্থার কথা বুঝিয়ে হেনরিয়েটা যদি সেই উদারচেতা বীর পুরুষদের অনুকম্পা জাগিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে ওই চারটি তরবারি অন্তত ইংল্যান্ডের রাজার সেবায় আন্তরিকভাবেই নিয়োজিত হবে এবং পূর্ব অভিজ্ঞা থেকে উইন্টার ভালই জানেন যে পুরো একটি সৈন্যবাহিনীর চাইতে ওই চারজন সৈনিকের অনুগত্যের মূল্য অনেক বেশি।
চেষ্টা থাকলে উপায় হয়ই, অপ্রত্যাশিতভাবে কাউন্ট দ্য ল ফেয়ারের ঠিকানা পেয়ে গেলেন উইন্টার। রানী হেনরিয়েটার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল রাওল, তার মুখ থেকেই, সেদিনই উইন্টার সাক্ষাৎ করলেন কাউন্টের। অর্থাৎ অ্যাথোসের হোটেলে গিয়ে, তাকে এবং অ্যারামিসকে নিয়ে এলেন রানীর বাসস্থানে।
রানী বাসস্থানের গরীবি দশা দেখে ওরা দুজনই রেগে আগুন। ফরাসি সরকার এমনই নীচ যে মহান চতুর্থ হেনরীর কন্যাকে তারা উপযুক্ত আতিথেয়েতা দিতে নারাজ।
হেনরিয়েটার দুর্দশা দেখেই বিচলিত হয়েছে অ্যাথোস ও অ্যারামিস এখন হেনরিয়েটার মুখ থেকে কাতর আবেদন শুনেই দুজনে সমস্বরে প্রতিজ্ঞা করল যে ইংল্যান্ডে গিয়ে রাজা চার্লসের সেবায় তারা প্রাণ দেবে।
উইন্টার প্রশ্ন তুললেন দ্যার্তেগা আর পোর্থসের সম্পর্কে, তাদের কেন পাওয়া যাবে না?
অ্যাথোসই বুঝিয়ে দিল, ওরা ম্যাজারিনের পক্ষে এবং ম্যাজারিন ক্রমওয়েলের পক্ষে। কাজেই দ্যার্তেগা আর পোর্থসের সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
‘কী করে এটা সম্ভব হলো?’ জিজ্ঞাসা করেন উইন্টার। ওই নীচ ম্যাজারিনের আদেশ মানবে দ্যার্তেগা বা পোর্থসের মতো মহাপ্রাণ বীর প্ররুষ! এ যে কল্পনা করাও যায় না।
নিশ্বাস ফেলে অ্যাথোস বলল–‘ঘটনা চক্র ছাড়া আর কিছুই না, দ্যার্তেগা তো রাজকর্মচারী। যে যখন শাসনতন্ত্রের কাণ্ডারী, তারই আদেশ মানতে হবে সৈনিককে। আর পোর্থ? তার প্রয়োজন একটা উপাধি–ব্যারণ বা ডিউক। সে উপাধি ম্যাজারিন ছাড়া কেউ দিতে পারে না।’
রানী হেনরিয়েটা বিষণ্ণ ভাবে বললেন, ‘পারতাম আমি। একবার ইংল্যান্ডের প্রজা বিদ্রোহ দমন করে দিন আপনারা, সাহায্যকারী প্রত্যেককে আমি ডিউক উপাধি দেব, দেব ডিউকের মর্যাদা অনুযায়ী জমিদার। কিন্তু পোর্থস কথা দিয়েছে ম্যাজারিনের কথার খেলাপ করে না, এখন হেনরিয়টের প্রস্তাব নিয়ে পোর্থসের কাছে গেলে অপমানই করা হবে তার।’
ঠিক হলো দ্যার্তেগা আর পোর্থসের আশা ত্যাগ করে অ্যাথোস আর অ্যারামিস যাবেন উইন্টারের সঙ্গে, কোথায় তারা যাচ্ছেন, তা জানার দরকারও নেই বন্ধুদের বিদায় জানালেন, বন্ধুরা বিদেশে যাচ্ছে শুনে দ্যাগে তাদের পাঠিয়ে দিল সব পিস্তল, পোর্থসকে পাঠালে দুইশো লুই সমান ভাগ করে নেবে দুজনে।
দ্যার্তেগার কাছে আর একটি অনুরোধ ছিল অ্যাথোসের, রাওলের দেখাশুনা যেন করে সে, যখন সৈন্যবাহিনীতে সে ফিরে যাবে, তখন আর অভিভাবকত্বের প্রশ্ন উঠে না, যতক্ষণ রাজধানীর অশান্তির পরিবেশে সে থাকবে, ততক্ষণই তার অভিভাবকের প্রয়োজন, সে দায়িত্ব নেবার পক্ষে দ্যার্তেগার চেয়ে যোগ্যতর কে আছে? বীরত্বে, মর্যাদায়, দূরদর্শিতায়, দ্যার্তেগা অতুলনীয়। তার চেয়ে বড় কথা, সে রাওলকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে।
গেনম এর যুদ্ধে প্রিন্স কন্ডি জয় লাভ করেছেন, ফ্রান্সের গৌরব সূর্য আজ মধ্য আকাশে। শেষ হয়ে আসা রাজশক্তির মর্যাদা এতে অনেকখানি বেড়ে গেল। এই আনন্দের দিনে বড় একটা উৎসবের অনুষ্ঠান হলো সারাদেশে। রাজা ও রাজমাতা এলেন নোতরদাম গির্জায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেবার জন্য। জাঁকজমকের শেষ নেই, শহর ভেঙে পড়েছে নোতরদামের রাস্তায়।
প্রজারা এদিকে রাজার জয়ধ্বনি করে আকাশ ফাটিয়ে ফেলছে, রাজার পক্ষ থেকে রানী অ্যান ওদিকে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্রুসেলকে ধরে এসে ব্যাস্টিলে আটকে রাখার জন্য।
কে ব্রুসেল? জননায়ক। প্যারিসের জনগণের মুখপাত্র। কাজ শেষ হবে বলে আশা করলেও তা হলো না। জনগণ টের পেয়ে গেল, ব্রুসেলকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে রাজসৈন্যরা, কাতারে কাতারে মানুষ এসে পড়ল চারদিক থেকে। দাঙ্গা বেধে গেল। গাড়ি ঘিরে রেখেছে বিশজন সৈন্য। তাদের ঘিরে ধরেছে দুই হাজার দাঙ্গাবাজ।
অসম যুদ্ধে রাজসৈন্যরা কচুকাটা হয়ে যেতে বসেছে এমন সময়ে একটি তরুণ যোদ্ধা এসে সৈন্যদলের শক্তি বৃদ্ধি করল। বয়সে সে নবীন কিন্তু তরোয়াল চালাচ্ছে প্রবীণ সৈনিকের মতো। তার তরোয়ালের নাগালের ভেতরে যে আসছে, সে আর রক্ষা পাচ্ছে না।
এ হচ্ছে রাওল ব্রাগেলোন থেকে ফিরে এসে সবে প্যারিসে প্রবেশ করেছে।
কিন্তু জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রাওলের তরোয়াল তাদের বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারল না। তাদের সম্মিলিত আক্রোশ এসে পড়ল রাওলের উপর। জীবন সংশয় হয়ে দাঁড়াল রাওলের।
হঠাৎ লম্বা তরোয়ালের আঘাতে ঘন জনতার ভেতর দিয়ে রাস্তা করে নিতে নিতে রাওলের কাছে এসে পড়ল দুজন সৈনিক। তারা দ্যার্তেগা আর পোর্থস।
দ্যার্তেগারা এসে পড়ায় শুধু রাওলের যে জীবন রক্ষা হলো তা নয়, ব্রুসলকেও ব্যাস্টিলে পাঠানো সম্ভব হলো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দ্যার্তেগা বা পোর্থসের অস্ত্রের সামনে দাঁড়াবে জীবনের প্রতি এত বিতৃষ্ণা কারো নেই।
দ্যার্তেগা সেই দিনই রাওলকে সৈন্য শিবিরে পাঠিয়ে দিল, সেখানে সে, নিরাপদে থাকবে, প্যারিসে অনেক নাগরিক তাকে চিনে ফেলেছে, রাস্তায় বেরুনোই আর নিরাপদ নয় তার পক্ষে।
স্বয়ং অ্যাথোস দ্যার্তেগাকে অভিভাবক হিসেবে রেখে দিয়েছেন রাওলের। রাওল দ্যার্তেগার নির্দেশ অমান্য করতে পারল না।
রাওল প্যারিসে থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভালোই করল। আর একটা দিন দেরি হলে সে আর বেরুতে পারত না। কারণ এক রাতের মধ্যে রাজধানীতে বিরাট একটা পরিবর্তন এসে গেল। সকাল বেলায় লোকজন ঘরের বাইরে এসে দেখে রাস্তা আর রাস্তা নেই। ইট পাথর খুড়ে তুলে। কোথায় পুকুর তৈরি করা হয়েছে, কোথায় হয়তো পাহাড় বানিয়েছে। সৈন্যদের চলতে বাধা দেবার জন্য। শুধু কি ইট আর পাথর? উল্টানো গাড়ি, খালি পিপে, বিছানার খাট, বসার সোফা সব এনে এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে রাজপথে, অশ্বারোহী সৈন্যের এক পা চলার উপায় নেই।
প্যালেই রয়েলে বসে রাজমাতা অ্যান শুনলেন সব ঘটনা। তিনি কন্ডিকে ডেকে পরামর্শ করতে বসলেন কী ভাবে এই বিদ্রোহী প্রজাদের শায়েস্তা করা যায়। সব ঘটনা শুনলেন ম্যাজারিনও। তার গোপন স্বর্ণ ভাণ্ডার রাজপ্রসাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে যে কোথায় লুকিয়ে ফেললেন, তা কেউ জানল না, কর্তির পরামর্শ অনুসারে চলাই স্থির করলেন অ্যানি, পালিয়ে যাবেন তিনি বালক রাজাকে নিয়ে। যাবেন সেইন্ট জামেইন শহরে। রাজার। একটা ক্ষুদ্ৰবাড়ি আছে সেখানে, সেটিই আপাতত রাজ প্রাসাদের কাজ করবে। রানী রীতিমতো উত্তেজিত। প্রজাদের জব্দ করার সুন্দর একটা মতলব এঁটেছে কন্ডি, প্যারিসের বিদ্রোহী ফ্রন্ডিরা মজা বুঝবে এবার। রাজা যদি না থাকেন, না থাকে ম্যাজারিও, শহরে তারা শৃঙ্খলা রক্ষা করবে কেমন করে? শহর অরাজক হয়ে যাবে যে!
তাই যাক, কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক দুর্বিনীত প্যারিসবাসী। রানী যাবেন পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে। এমনভাবে শহর ত্যাগ করবেন, যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে যে ওরা যাচ্ছে না সন্দেহ হলে আর যাওয়া হবে না, কারণ পথে পথে হাজার জনতা দিনরাত হল্লা করছে, তাদের ভেতর দিয়ে রাজা ও রাজা মাতার যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
অসম্ভব? নিশ্চয়ই তাই।
কিন্তু অসম্ভব সম্ভব করতে পারে, এমন লোক রানী দেখেছেন। সে, আজ বিশ বছর আগের কথা। প্যারিস থেকে লন্ডন পর্যন্ত রাজপথের দুই ধারে সৈন্যবাহিনী সাজিয়ে রেখেছিলেন। বিশাল সেই সৈন্য থেকে বের হয়ে যাওয়া যে কোনো যুগের যে কোনো বীরের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তবু সে অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো লোক পাওয়া গিয়েছেল তখন, এখন কি যাবে না? সেই দ্যার্তেগা তো রয়েছে। এই প্রাসাদের সীমানার মধ্যেই রয়েছে, আজ বিশ বছর ধরেই তো সে রানীকে পাহারা দিচ্ছে ও খানে বসে! আজ যদি তাকে ডাকা যায়–ডাকতেই হলো। ডাকলেন রানী, বিশ বছর পরে দ্বিতীয় বার ডেকে পাঠালেন দ্যাগোকে। দ্যার্তেগা প্রবেশ-করল দুরু দুরু বুকে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখে কেউ তার অন্তরের চাঞ্চল্য অনুমান করতে পারবে না কখনও। অভিবাদন করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল রানীর আদেশের প্রতিক্ষায়।
অনেক ভণিতা করে তারপর রানী প্রকাশ করলেন তার বক্তব্য, একদিন তার মস্ত উপকার করেছিল দ্যার্তেগা। তার দরুণ যতখানি কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করার অধিকার ছিল দ্যার্তেগার তা সে হয়তো পায়নি, কিন্তু সেই অভিযোগ অন্তরে পুষে রেখে আজ কি সে রানীর দ্বিতীয় অনুরোধ প্রত্যাখান করবে? যদি সত্যিই কোনো দ্বিতীয় অনুরোধ আজ আসে এই বিশ বছর পরে?
দ্যার্তেগা অবিচলিত স্বরে বলল–‘না কখনই প্রত্যাখান করব না। কৃতজ্ঞতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সৈনিকের তরবারি রাজা ও রাজমাতার যে কোনো প্রয়োজনে উন্মোচিত হওয়ার জন্যই তো রয়েছে। আদেশ করতে যেটুকু দেরি। উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা পালিত হবে।’
‘উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই?’ রানী অ্যান সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যদি কোনো অসম্ভব আদেশই করে বসি?’
‘অসম্ভব হলেও তা পালিত হবে। আর অসম্ভব যদি না হবে, তবে মহারানী দ্যার্তেগাকে কেন স্মরণ করবেন?’
রানী মনে মনে বলেন–লোকটার শক্তি আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে দম্ভও আছে প্রচুর।
কিন্তু মনের ভাবনা এখন মনেই থাকুক। বৃথা সময় নষ্ট করা চলে না বাজে কথা বলে। নিজের প্রয়োজনটা সংক্ষেপেই ব্যক্ত করলেন অ্যান ‘বিদ্রোহীদের ফাঁকি দিয়ে আমি যদি গোপনে রাজধানীর বাইরে যেতে চাই, সেটা কি সম্ভব?’
‘অবশ্যই সম্ভব।’
‘অবশ্য রাজাকে নিয়ে সেটা বুঝতে পারছ তো?’
‘রাজাকে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব।’
‘কী করে সম্ভব? রাজপথে গিজগিজ করছে বিদ্রোহীরা। পরীক্ষা না করে মাছিটাকেও তারা শহর থেকে বেরুতে দিচ্ছে না।’
‘তা না দিক, সেজন্য মহারানীর চিন্তা করতে হবে না, দুটি মাত্র শপথ করতে হবে রানীর, একটি হলো–এই পলায়নের কথা সবার কাছে গোপন রাখতে হবে। দুই এ ব্যাপারে সমস্ত ভার সম্পূর্ণভাবে আমার উপরে ছেড়ে দেবেন। একমাত্র তা হলেই আমি পারব একাজ সম্পূর্ণ করতে।’
রানী বললেন, ‘তাতে আমার আপত্তি নেই।’
‘রাত এারোটায় আমি মহারানীর সঙ্গে দেখা করব।’
রানীর রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই দ্যার্তেগার কোর্টের পিছনে টান পড়ল। ফিরে তাকাতেই দেখে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বেইন। বেইন প্রধানমন্ত্রী ম্যাজারিনের খাস চাকর।
‘মহামন্ত্রী ডেকেছেন আপনাকে’–বেইন জানাল।
‘জানতাম, ডাকতেই হবে।’
দ্যার্তেগা এসে সালাম জানাতেই ম্যাজারিন উচ্ছ্বসিত ভাবে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন–‘আরে এসো এসো। তোমাকেই আমার সবেচেয়ে বেশি দরকার। তোমাকে এবং তোমার সেই বন্ধু মঁসিয়ে ভ্যালোনকে তিনি এখনও ব্যারণ উপাধিটা পেতে চান তো?’
উত্তর দেয় দ্যার্তেগা—’চাইবেন না কেন? আপনি তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
‘আর তুমি কি? তুমিও তো পেতে চাও ক্যাপটেন পদ?’
‘ক্যার্ডিনাল, উত্তর ওই একটাই।’
‘বেশ ও দুটো আনার জন্য তোমাদের দুজনকে একবার লন্ডন যেতে হবে।’ এমনভাবে ম্যাজারিন কথা বলছেন, যেন দুই বন্ধুকে তিনি খাবার ঘরটা একবার ঘুরে আসার জন্য অনুরোধ করছেন। দ্যার্তেগা মনে মনে যতই বিরক্ত হোক, মুখে বিন্দু মাত্র ভাব দেখাল না। শুধু বলল–আমরা প্রস্তুত কিন্তু যেতে হবে কখন?’
‘হায় ঈশ্বর এটা একটা প্রশ্ন হলো? যেতে হবে এখুনি।’
‘বেশ আমি এই মুহূর্তে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা যে যাচ্ছি এটা আপনি একবার মহারনীকে জানিয়ে এলে ভালো হয়।’
‘এসব সামান্য ব্যাপার মহারানীকে? সে কী? কেন?’
‘ব্যাপারটা মহারানীও সামান্য মনে করবেন, তার নিশ্চয়তা কী? আমাকে যদি যেতেই হয় মহারানীকে সেকথা আগে জানানো ছাড়া উপায় নেই, কার্ডিনাল।’
ম্যাজারিন ক্রুদ্ধ, বিরক্ত এবং ভীত হলেন, আড়ালে আড়ালে রানীর সঙ্গে একটা কিছু বন্দোবস্ত এদের হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই, কী সে বন্দোবস্ত? সেটা ম্যাজারিনের পক্ষে ক্ষতিকর নয়তো?
একবার মনে হয়েছিল, এরকম সাধারণ বিষয় নিয়ে রানীর কাছে যাওয়া তার পক্ষে মর্যাদা হানির ব্যাপার হবে, কিন্তু কৌতূহলের তাড়নায় তাকে যেতে হলো, রাণীর সঙ্গে এদের বোঝাপড়াটা কী রকম, একান্তভাবে জানা দরকার, সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন ম্যাজারিন, এসেই হেসে বললেন—’তুমি ঠিকই বলেছিলে লেফটেনান্ট, রানীকে না জানিয়ে যাওয়া তোমার উচিত হত না, তুমি একটা কাজের ভার পেয়েছ রানীর কাছ থেকে।’
‘যে কাজ আমি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না’ মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল দ্যার্তেগা।
মুহূর্তের জন্য লোকটার আত্ম অহংকার হতবাক করে দিল ম্যাজারিনকে, অনেক চেষ্টায় নিজেকে ঠিক করে বললেন—’রানী কি রাত এগারটায় বেরুচ্ছেন?’
‘আপনি রানীর মুখ থেকেই সে কথা শুনেছেন।’
‘তা শুনেছি, কিন্তু তুমি আমার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা করতে চাও, সে কথা শুনিনি। অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলা ম্যাজারিনের।
‘আপনার সম্পর্কে?’ আকাশ থেকে পড়ে দ্যার্তেগা।
‘বাঃ রানী চলে যাবেন, রাজা চলে যাবেন, আমি এখানে পড়ে থাকব কি বিদ্রোহীর হাতে চুচকাটা হওয়ার জন্য?’
‘কিন্তু যাবেন কি করে?’
‘রানীর গাড়িতে।’
‘অসম্ভব, জায়গা হবে না। বরং রানীকে পৌঁছে দিয়ে এসে তারপর আপনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি।’
‘রানীকে পৌঁছে দিয়ে এসে, তারপর? বলি তারপর যদি তোমার প্যারিসে আসার আর প্রয়োজন না থাকে? অর্থাৎ তোমার ক্যাপটেন পদ এবং তোমার বন্ধুর উপাধি যদি রানী ওখান থেকেই দিয়ে দেন? তারপরও এই গরীব বিদেশীর কথা তোমাদের মনে থাকার এতখানি আশা করতে পারি না মঁসিয়ে দ্যার্তেগা।’
দ্যার্তেগা বেশ গম্ভীর ভাবে চিন্তা করছে কথাটা, তারপর বলল ‘আপনার ইচ্ছে কি?’
‘ইচ্ছে এই যে, রানীর সঙ্গে যদি যাওয়া না হয় আমার তা হলে রানীর আগেই আমি যাব, উনি যাবেন রাত এগারটায়। আমায় তুমি রাত দশটায় সেন্ট জার্মেইন শহরে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
দ্যার্তেগা অতিকষ্টে হাসি থামায়। কী চালাক এই ইতালিয়ান যাজকটা!
‘সেটা অসম্ভব নাও হতে পারে, এখন তাহলে বলুন রাত দশটার সময় আপনাকে সেন্ট জার্মেইন নিয়ে যাওয়ার দরুণ আমাদের পাওনা কি হবে। বুঝতেই তো পারছেন অন্য লোকের পক্ষে যে কাজ অসম্ভব সেই কাজই যখন করতে হচ্ছে আমাকে, তখন মজুরিটাও লোভনীয় হওয়া দরকার।’
টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করতে ম্যাজারিনের চিরদিনই অনীহা, তাই মহা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কিন্তু রানীকে নিয়ে যাবার জন্য সেখানে টাকার কোনো কথা হয়নি বোধহয়।
আকাশ থেকে পড়ে দ্যার্তেগা রানী বা রাজা–এদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা, রাজার বা রানীর প্রজা বা সৈনিকদের জীবনের উপর দাবি রয়েছে একটা। ইচ্ছা করলেই তারা বলতে পারেন–তোমার জীবনটা আমাকে দিয়ে দাও, ওটা আমার দরকার হয়েছে, কিন্তু সে কথা অন্যদের ব্যাপারে খাটে না।
‘অন্যের বেলায় পারিশ্রমিকের দরকার হয়।’ বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ম্যাজারিন। ম্যাজারিনের হাতে একটা হীরের আংটির দিকে বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে দ্যার্তেগা। আংটি তার পরিচিত। বিশ বছর আগে এ আংটিটি তারই ছিল, তাকে ওটা রানী দিয়েছিলেন, তারপর ওটা দ্যাগো বেচে দিয়েছিল। রানীর প্রয়োজনে। টাকা দরকার হওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত কি জানি কেমন করে আংটিটি এই লোভী ম্যাজারিনের হাতে এসেছে।
তা যেভাবেই এসে থাকুক, দ্যার্তেগা ওই আংটি মজুরী হিসাবে না পেলে কিছুতেই শহরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে না ম্যাজারিনকে।
দ্যার্তেগার অর্থপূর্ণ চাহনির মানে বুঝতে না পারার মতো বোকা নন ম্যাজারিন।
এখন যেহেতু দর কষাকষির সময় নেই, সেটা বুঝেই ধীরে ধীরে, দ্যার্তেগার হাতে আংটিটি তুলে দিলেন এবং আংটি দেয়ার সাথে যেন আলোচনার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, এমনভাবে বললেন, আমি তাহলে রাত দশটার সময় তৈরি থাকব।
‘থাকবেন, আমি ঠিক সময়েই চলে আসব।’
‘কিন্তু গাড়ি? কোর গাড়িতে যাব আমি?’ জানতে চাইল ম্যাজারিন।
‘গাড়ি আমি নিয়ে আসব, আপনার মাথা ঘামাতে হবে না ও নিয়ে।’
.
পোর্থসের গাড়ি রাত ঠিক দশটার সময় প্রাসাদের পিছনে এসে দাঁড়াল, গাড়ির পিছনে পোর্থস।
মাস্কেটিয়ারের পোষাকেই একটা ছোট দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন ম্যাজারিন দরজার তলায় চাবি ঢোকাতে পারছেন না, হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। চাবি চেয়ে নিলেন দ্যার্তেগা ম্যাজারিনের কাছ থেকে। চাবি নিয়ে তালা বন্ধ করল দ্যার্তেগা। কিন্তু চাবি ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের পকেটে রাখল। আর একবার আসতে হবে এই দরজা দিয়ে তাকে এক ঘণ্টা পরে।
গাড়িতে উঠে বসলেন ম্যাজারিন, পোর্থস আর দ্যার্তেগা দুপাশে, আগেই কোচম্যানকে বলে দেয়া ছিল, মাঝারি কদমে গাড়ি এগিয়ে চলল সেন্ট আনোর গেটের দিকে, তখন রাজপথে জনতায় পূর্ণ। একটু পরপরই চেঁচিয়ে উঠছে তারা ‘ম্যাজারিন নিপাত যাক।’ মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মুখ বের করে দ্যার্তেগাও চিৎকার করছে, ‘নিপাত যাক ম্যাজারিন।’ ম্যাজারিন যতটা সম্ভব পিছনে সঙ্কুচিত হয়ে বসেছেন, এপাশে পোর্থস, ওদিকে দ্যার্তেগা মাঝখানে পুরোপুরি আড়ালে পড়ে গেছেন ম্যাজারিন, বিদ্রোহী জনতা মধ্যে মধ্যে উঁকি দিচ্ছে গাড়ির জানালা দিয়ে। দ্যার্তেগার ‘নিপাত যাক ম্যাজারিন’ চিৎকার শুনে খুশি হয়ে চলে যাচ্ছে।
একদল অস্ত্রধারী জনতা এসে গাড়ির পথ আটকাল, ‘কে যায় গাড়িতে?’
‘যায় ম্যাজারিন।’ হেসে জবাব দিল দ্যার্তেগা।
ভয়ে সজারুর কাঁটার মতো মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল ম্যাজারিনের। জনতা সত্য কথাটা তামাশা মনে করে রাস্তা ছেড়ে দিল।
গাড়ি প্রায় সেন্ট আনোর গেটের কাছে নিয়ে পৌঁছেছে, এই সময় আবার একদল জনতা এসে পথ আটকে দাঁড়াল, গাড়ি দেখব, দরজা খোল।
দ্যার্তেগা মুখ বের করে দেখল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার এক সময়ের চাকর প্ল্যাঞ্চেট, যে এখন শহরের একজন নামকরা মিষ্টির ব্যবসায়ী, একটা দোকান এবং একটা বাড়ির মালিক, দ্যার্তেগা তার সব খবর রাখে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দ্যার্তেগা। আরে প্ল্যাঞ্চেট যে, আমাদের একটু তাড়াতাড়ি এগিয়ে দাও তো ভাই। পোর্থস ভীষণ আহত।
‘বলেন কি? মঁসিয়ে ড্যানস, আহত।’
‘ভাই প্ল্যাঞ্চেট এবার বোধহয় আর বাঁচব না, গুলিটা কাঁধের ভেতর দিয়ে পাজরায় ঢুকেছে,’ টেনে টেনে কাতরায় পোর্থস।
‘আহ্হা, এ অবস্থায় ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?’
তাড়াতাড়ি উত্তর দিল দ্যার্তেগা। নিয়ে যাচ্ছি পোর্থসের ব্রাশিওজের জমিদারীতে, নিজের বাড়িতে গিয়ে মরার জন্য জেদ করল, আর, লোকের শেষ ইচ্ছায় বাঁধা দেয়া উচিত নয়, আহা পোর্থসরে তুই না বাঁচলে আমি কি সেই শোক সইতে পারব।
প্ল্যাঞ্চেট হুকুম দিল—’এরা বন্ধু, গেট খুলে দাও।’
সেন্ট জার্মানের পথে গড় গড় করে চলে গেল সেন্ট আলোর গেট পেরিয়ে ম্যাজারিনের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল দ্যার্তেগা, এখানে আগে থেকে তোক দিয়ে নিজেরও পোর্থসের ঘোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিল, একটু পরেই সেই ঘোড়া খুঁজে পাওয়া গেল, দ্যার্তেগা উঠল নিজের ঘোড়ায়। এবার সে রানীকে আনতে যাবে।
দ্যার্তেগাকে বিদায় দিয়ে ম্যাজারিন নিজের মনেই বলল, মাত্র একটা হীরের আংটি দিয়েছি ওকে, কিন্তু এ উপকারের প্রতিদানে হীরে দিয়ে ওজন করে সব হীরে দিয়ে দিলেও শোধ হয় না।
.
ম্যাজারিনের গার্ড হিসেবে যেতে হয়েছে পোর্থসকে, দ্যার্তেগা একাই ফিরছে রাজধানীতে। সে সেন্ট আলো দিয়ে ফিরল না, সন্দেহ হতে পারে লোকের। অন্য দরজা দিয়ে ঢুকে নোতরদামের কাছাকাছি আসতেই দেখল রাস্তার উপর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়িটা তার চেনা, গাড়ির মালিক কেচ অ্যাডজুটর গন্ডি, এই গন্ডি হলো নোতরদামের ভারপ্রাপ্ত মহাযাজক, আর্কবিশপের ভাইয়ের ছেলে, নিজে কার্ডিনাল পদবির প্রত্যাশী, রাজনীতির ক্ষেত্রে ম্যাজারিনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।
যেহেতু সে ম্যাজারিনের প্রতিদ্বন্দ্বী সেই কারণেই জনতার একান্ত আপনজন আসলে প্যারিসের এই প্রজাবিদ্রোহের মূলে যাদের ইন্ধন আছে। তাদের মধ্যে প্রধান হলো গন্ডি।
রাস্তার মাঝখানে গন্ডির গাড়ি দেখে একটা বুদ্ধি এল দ্যার্তেগার মাথায়। একটু আগেও জানত না দ্যাগো কীভাবে বালক রাজা আর রানীকে প্যারিসের বাইরে নিয়ে যাবে এত বিদ্রোহীদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে। এখন সে খুশি হয়ে উঠল, উপায় একটা পেয়ে গেছে।
গাড়ির মাথায় কোচয়ান বসে বসে ঢুলছে, পিছন দিকে সহিসেরা নেই। হয়তো মালিকের অনুপস্থিতের সুযোগ নিয়ে কোনো হোটেলে খাবার খেতে গিয়েছে এই সুযোগে।
নিঃশব্দে গাড়ির ভেতর ঢুকল দ্যার্তেগা একটা দড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে কাঠের দেয়াল ফুটো করে। গাড়ি থেকে দড়ির একমাথা ঝুলছে। কোচয়ানের হাতের আঙুলে বাধা অন্য মাথা, এই দড়ি টান দিলেই ভেতর থেকে কোচয়ানের মনযোগ আকর্ষণ করা যাবে।
দড়ি টানল দ্যার্তেগা এবং হেঁকে বলল–‘প্যালেই রয়্যাল।
ধড়মড় করে উঠে বসল কোচয়ান দড়িবাধা আঙুল টান পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে তার কানে এল–‘প্যালেই রয়েল।’ হুকুম যে তার মনিবের মুখে থেকে আসেনি সেটা বেচারার মাথায় এক মুহূর্তের জন্যেও আসেনি, সদ্য ঘুম। ভেঙেছে তার। গলার আওয়াজের পার্থক্য তার বুঝার কথা নয়।
প্যালেই রয়্যাল অর্থাৎ রাজপ্রাসাদে যাবে তার মালিক–এটাই সম্ভব। তিনিই তো প্রজা বিদ্রোহের নেতা। কোচয়ান গাড়ি হাঁকিয়ে দিল।
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে সে যখন সিঁড়ির নিচে থামল, তখনই লক্ষ্য করল গাড়ির পিছনে সহিসেরা নেই, তবে? তবে আর কি, মালিক তাদের কোনো কজে পাঠিয়ে দিয়ে থাকবেন। সুতরাং কোচওয়ান নিজেই লাফিয়ে নেমে এল গাড়ির দরজা খুলে দিতে।
আর দরজা খুলতেই গাড়ির ভেতর থেকে একটি লোক নেমে এসে দুই হাতে সজোরে গলা টিপে ধরল কোচওয়ানের। তারপর সে ডাকল দুইজন মস্কেটিয়ারকে, যারা তখন প্রাসাদে পাহারায় আছে।
তাদের হাতে কোচওয়ানকে ছেড়ে দিল দ্যার্তেগা–একে প্রাসাদের ভেতর কোনো নির্জন ঘরে নিয়ে আটকে রাখো। মুখ বেঁধে হাতে, পায়ে শিকল পরিয়ে, আর পোষাকটা খুলে আমাকে দাও। আমি যতক্ষণ একে ছেড়ে দিতে না বলছি, ছাড়বে না।
কোচওয়ানকে নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে চলেছেন মাস্কেটিয়াররা, দ্যাগো নিজে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গেল প্রাসাদের পিছন দিকের দরজায়। এ দরজার চাবি সে ম্যাজারিনের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিল, দরজা খুলে সে সোজা উঠে গেল রানীর মহলে। রাত তখন ঠিক এগারটা।
‘রানী তারই অপেক্ষায় আছেন।’
কোন বিদ্রোহী আটকাবে কো-অ্যাডজুন্ট গন্ডির গাড়ি? গাড়ি চালিয়ে প্যারিস থেকে নিরাপদে বেরিয়ে গেল একেবারে সেন্ট জার্মেইন, কোচওয়ানবেশে দ্যার্তেগা। সেখানে রাজার ছোট একটা বাড়ি আছে।
দ্যার্তেগার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য আজ আবার নতুন করে রানীর অন্তর শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে উঠল, রাজার কানে কানে বললেন–লেফটেন্যান্টকে একটা ধন্যবাদ দাও। ওই লোকটিই আজ আমাদের রক্ষা করেছে।
আস্তে আস্তে ফ্রান্সের রাজভক্ত অভিজাতেরা একে একে সেন্ট জার্মেইন এসে পৌঁছতে লাগলেন, প্রিন্স এবং ডিউকেরা বাদ রইলেন না কেউ, রানী তাদের আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।
এলেন তো সবাই। কিন্তু ঘুমাবেন কোথায়? শীতের রাত্রি, সেন্ট জার্মেইনের ছোট সরকারী বাড়িটিতে বিছানা মাত্র তিনটি, একটিতে রানী, একটাতে রাজা এবং অন্যটাতে রাজার চাচা প্রিন্স অব অর্ণিয়।
দ্যার্তেগা আগে থাকতেই অনুমান করেছিল যে বিছানার অভাবে আজ এই অভিজাত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের না ঘুমিয়ে বসে বসে রাত কাটাতে হবে, তাদের এই দুর্যোগ থেকে নিজের জন্য কিছু সুযোগ করে নেয়ার চেষ্ট সে করবে না কেন? পোর্থসকে নিয়ে সমস্ত শহর একবার টহল দিয়ে এসেছে এবং শহরের সমস্ত খড় কিনে এনেছে রেখেছে মস্কেটনের কাছে–এক আটির দাম এক স্বর্ণ মুদ্রা। যে কিনতে আসবে, ওই দামই দিতে হবে তাকে।
তারপর প্রিন্স আর ডিউকদের সামনে বসে নিজের জন্য একটি খড়ের বিছানা তৈরি করতে বসল, প্রিন্স ডিউক এবং তাদের স্ত্রীরা তখন বসে হি হি করে কাঁপছেন শীতে, কোথায় পেলেন খড়? কোথায় পেলেন? জিজ্ঞেস করল সবাই। সেই রাত্রে খড় বিক্রি করে চারশো লুই লাভ করল দ্যার্তেগা আর পোর্থস। মস্কেটন দশ বিশ লুই চুরি করেছিল, সেটা বাদ দিয়েই।
৫. খড়ের বিছানা
৫.
দ্যার্তেগা সবেমাত্র নিজের জন্য তৈরি করা এক হাত পুরু খড়ের বিছানায় শুয়ে গায়ের উপর চাদর টেনে দিয়েছে এমনি সময় পোর্থস মুখ কাচু মাচু করে এসে হাজির। ‘ও ভাই দ্যার্তেগা আমি এখন কোথায় শুই?’
দ্যার্তেগা কানের উপর চাদর টেনে নিয়ে ঘুম ঘুম ভাব করে জবাব দিল–‘কেন? মস্কেটন তোমার জন্য খড় রাখেনি?’
পোর্থস গর্জে ওঠে–‘হতভাগা শয়তানটা পয়সার লোভে সব খড় বেচে দিয়েছে আমার জন্য এক আঁটিও রাখেনি। আমাকে তোমার অর্ধেক খড় দাও।’
‘বিছানা তৈরি করার আগে যদি বলতে, তাহলে নিশ্চয়ই দিতাম, এখন এই তৈরি বিছানা ভাঙব কি করে? অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি।’
দ্যার্তেগাও বিছানা ভেঙে তা থেকে খড় দিতে রাজী হয় না, আর পোর্থস এরকম অবস্থা মেনে নিতে রাজী নয় যে দ্যার্তেগা আরামে নাক ডেকে ঘুমাবে আর সে বসে বসে শীতে হি হি করে কাঁপবে। শেষে একটা মীমাংসা হলো। পোর্থস দুই লুই দেবে দ্যাৰ্তেৰ্গাকে বদলে পোর্থসকে নিজের বিছানায় শুতে দেবে দ্যার্তেগা।
পোর্থসকে নগদ দুই লুই গুনে দিতে হলো।
তারপর দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আবার চোখ বুজেছে, এমন সময় এক সৈনিক কর্মচারী এসে ডাকল—’লেফটেনান্ট দ্যার্তেগা এখানে আছেন?’
দ্যার্তেগা কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু পোর্থস লাফিয়ে উঠল, চটপট জবাব দিল—’এই যে এখানে শুয়ে আছে।’
‘ও এখানে শুয়ে আছে, লেফটেনান্ট আপনাকে এক্ষুণি ডাকছেন কার্ডিনাল ম্যাজারিন শিগগির আসুন।’
লাফিয়ে উঠল দ্যার্তেগা। নিশ্চয়ই এত রাত্রে ডেকে তাকে ক্যাপটেন পদ এবং পোর্থসকে ব্যারণ উপাধি দেবে না, ম্যাজারিনের কৃতজ্ঞতা নেই এমন কথা কে বলবে?
কোমরের বেল্টে তরোয়াল ঝোলাতে ঝোলাতে দ্রুতপায়ে হাঁটছে দ্যার্তেগা, এদিকে বিছানার মাঝখানে এসে আরাম করে হাত পা ছাড়িয়ে শুয়ে পড়ল পোর্থস।
দ্যার্তেগা গিয়ে সালাম দিতেই ম্যাজারিন একখানি খাম এগিয়ে দিলেন। তার দিকে-এই মুহূর্তে লন্ডন যাত্রা করতে হবে তোমাকে। বোলম বন্দরে মর্ডন্ট নামে এক যুবকের সঙ্গে দেখা করো। চিঠিটা তার হাতে দেবে এবং সে যেভাবে যা করতে বলে সেভাবেই সে কাজ করবে।
দ্যার্তেগা বেশ তিক্ততার সাথে প্রশ্ন করে, ‘আমাকে ক্যাপটেনের পদ আর আমার বন্ধুর ব্যারণ উপাধী’?
এসব হাঙ্গামা না হলে আজই ওটা হয়ে যেতে পাত, কিন্তু বুঝতে পারছ তো, রানীর মেজাজ এখন কীরকম? ধরে নাও ও তোমাদের হয়েই আছে, তোমরা ফিরে এলেই-হ্যাঁ তোমার বন্ধু ভ্যালনকে নিতে ভুলো না, তার উপর আমার অনেক ভরসা
দ্যার্তেগা এরপর প্রশ্ন করে, কিন্তু লন্ডনে যেতে হলে টাকার দরকার? খড় বিক্রির লাভের টাকা ম্যাজারিনের কাজে খরচ করতে দ্যার্তেগা রাজী নয়।
বাধ্য হয়ে ম্যাজারিনকে এক থলি স্বর্ণমুদ্রা বের করে দিতে হলো, তিনি মনে মনে মহা বিরক্ত। ওরা কাজ করছে বটে কিন্তু প্রতি কাজেই রক্ত শুষে নিচ্ছে, ম্যাজারিনের কাছে টাকাই হলো রক্ত।
থলেটা পকেটে নিয়ে দ্যার্তেগা বাইরে এল, বাইরে তখনও অপেক্ষা করছে সেই সৈনিক কর্মচারী, দ্যার্তেগা বলল–‘আমার বিছানায় মঁসিয়ে ভ্যালন শুয়ে আছেন, তাকে ডেকে দিন,’ দ্যার্তেগার সাথে আস্তাবলে দেখা করতে বলবেন।
বাতাসের বেগে দৌড়ে গেল সৈনিক। পোর্থসকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আস্তাবলে পাঠাতে বেশ পরিশ্রম করতে হলো তাকে কিন্তু কাজটা করার পর সৈনিক আর ম্যাজারিনের আদেশ শোনার জন্য তার কাছে ফিরে গেল না দ্যার্তেগা পোর্থসের ছেড়ে যাওয়া বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
সেন্ট জার্মেইনের রাজবাড়িতে সে রাত্রে একজন মাত্র লোক, যার কপালে বিনা পয়সায় বিছানা জুটেছে, না বললেও চলে, সে ঘুমালো খুব আরামে এবং আনন্দে।
দ্যার্তেগা পোর্থসের কথা বাদ দিয়ে এবার দেখা যাক কোথায় আছে অ্যাথোস আর অ্যারামিস।
পাহাড়ি এলাকা স্কটল্যান্ডের ছোট শহর সাজেল নিউক্যাসল। অবশ্য শহর ছোট হলেও এতে একটা দুর্গ আছে এবং দুদিন আগেও সেই দুর্গের মাথায় উড়ছিল ইংল্যান্ডের রাজার বিজয় পতাকা।
রাজার পতাকা কাল থেকে নেমে গেছে, সেখানে উড়ছে বিদ্রোহী ক্রমওয়েলের পতাকা, বাধ্য হয়ে রাজা দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে এসেছে খোলা জায়গায় কয়েকজন সেনৗ এখনও সঙ্গে আছে, তারা আশ্বাস দিয়েছে, পরের যুদ্ধেই তারা শেষ করে দিতে পারবে ক্রমওয়েলের শক্তি, কারণ পাহাড়ি এলাকা থেকে রাজার সামন্তেরা সদল বলে আসছে রাজার সেবা করার পবিত্র দায়িত্ব মাথায় তুলে নেয়ার জন্য।
শহরের নিচে সরু এক নদী, তার এপারে উঁচু নিচু একটি জায়গা, সেখানে অল্প কয়েকটি তাবু। সবচেয়ে বড় যে তাবুটা সেখানে এই শেষ রাত্রেও একটা প্রচণ্ড ঝগড়া ঝাটি বলছে, সেখানে উপস্থিত আছেন সীমান্ত অঞ্চলের সব সামন্ত সর্দার। সভাপতির আসনে আছেন লর্ড লেভেন, কারণ রাজার সৈন্যের তিনিই সেনাপতি।
তাবুটার আশেপাশে পাহারা রয়েছে, যাতে বাইরের কেউ এসে এই বাদানুবাদের একটি কথাও শুনতে না পায়, কিন্তু পাহারাদারদের চোখে ফাঁকি দিয়ে একটি লোক তাবুর বাইরে শুয়ে আছে, একেবারে তাবুর কাপড়ের সাথে শরীর মিশিয়ে। ভেতরে যেসব কথা হচ্ছে, তার কান এড়িয়ে যাচ্ছে না কোনো কিছুই।
লর্ড লেভেন বলে উঠলেন, ‘এই তাহলে ঠিক হল?’
‘নিশ্চয়ই’–সমস্বরে বলে উঠল সমবেত সামন্তেরা।
আর অপেক্ষা করল না, বাইরে আত্মগোপনকারী ব্যাক্তি, হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে গেল, এভাবে তাকে অনেক দূর আসতে হলো, অবশেষে একটা উঁচু ঢিবি পাওয়া গেল, একজন সৈনিক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে তার আড়ালে ঢিবির সাথে গা মিশিয়ে। এবার উঠে দাঁড়াল হামাগুড়ি দেয়া লোকটিও। তারপর আস্তে আস্তে কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে তারা এগিয়ে গেল অন্য দিকে। সেখানে রাজার শিবির ঘিরে রয়েছে অল্প কয়েকজন ইংরেজ সৈনিক।
গুপ্তচর দুজন ঢুকে পড়ল রাজার তাবুর পাশের তাবুতে। সেখানে তখনও পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে লর্ড উইন্টার, তার চোখে ঘুম নেই, এই গুপ্তচর দুজন যে অ্যাথোস ও অ্যারামিস তা নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পারছেন,–‘লর্ড উইন্টার, এই মুহূর্তে রাজার সাথে আমাদের দেখা হওয়া দরকার, অ্যাথোস জানাল।’
দুঃখের সাথে জানালেন উইন্টার রাজা বিশ্রাম নিচ্ছেন। ‘এখন তাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? এ মুহূর্তে রাজাকে না তুললে আর জীবিত অবস্থায় হয়তো তোলা যাবে না।’ বলল অ্যাথোস।
একথা শুনে তবে চুলুন–‘বলে দুজনকে তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন।’
রাজার তাবুতে যাওয়ার একটা পথ উইন্টারের তাবুর ভেতর দিয়েই, ঢাকা এবং সুরক্ষিত। তিনজনে আধা মিনিটের ভেতর রাজার শোবার ঘরে উপস্থিত হলেন। ঘরে কোনো আসবাব নেই। ইংল্যান্ডেরা রাজা চার্লস শুয়ে আছেন, একটা সরু খাঁটিয়ার উপরে। দুটি মাত্র মোমবাতির আলোতে তাবুর ভেতরের অন্ধকার দূর হয়েছে সামান্যই।
শোবার আগে রাজা পোষাক পর্যন্ত খোলেননি, যুদ্ধের পোষাক পরেই সারা দিনের পর শুয়েছেন। ঘুমে ঢলে পড়েছে শ্রান্ত শরীর। কিন্তু শান্তি পায়নি মন, মাথার বালিশে দুই ফোঁটা চোখের জলই যে তার সাক্ষি বন্ধ দু চোখের কোনো থেকে আস্তে আস্তে জেগে উঠলেন রাজা নিজেই।
রাজা আস্তে আস্তে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলেন। শান্ত স্বরে বললেন–‘প্রিয় উইন্টার আরো প্রিয় আমার নতুন বিদেশী বন্ধুদ্বয়। বিপদ নিশ্চয়ই আগের চাইতে গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে?–তা নইলে তোমরা এই শেষ রাতে আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত করতে ছুটে আসতে না।’
মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে অ্যাথোস বলল—’মহারাজ, বিপদ সত্যিই গুরুতর। এই মুহূর্তে না পালালে পালাবার পথও বন্ধ হয়ে যাবে।’
রাজা অবাক হয়ে বললেন–‘পালাব কেন? এখানে আমার সৈন্যবল অল্প হলেও আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সাহায্য আসবে, সেনাপতি লেভেন আমাকে কথা দিয়েছেন যে–’
‘আপনাকে লর্ড লেভেন যে কথা দিয়েছেন রাজা, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এইমাত্র তারই সভাপতিত্বে এক সভায় সৈনিক এবং সামন্তেরা স্থির করেছেন যে—’
‘কী, কী স্থির করেছে তারা?’–ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলেন রাজা, অ্যাথোসকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে।
অ্যাথোস সরাসরি উত্তর দিতে পারল না ঘুরিয়ে জানতে চাইল—’স্কচ সৈনিকদের বেতন কি কিছু বাকী আছে রাজা?’
‘তা আছে। গত দুই বছর আমার সাহসী সৈন্যরা রক্তের বিনিময়ে গৌরব ছাড়া আর কিছুই পায়নি।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাজা।
অ্যাথোস মাথা নেড়ে বলল–‘সেজন্যই, তাদের পাওনা আছে চার লক্ষ পাউন্ড। দুই লক্ষ পাউন্ড তারা আজই আদায় করবে-অর্থাৎ ক্রমওয়েলের কাছ থেকে পুরুস্কার পাবে।’
‘পুরস্কার পাবে? মানে?’ রাজা যেন বিভীষিকা দেখছেন?
‘পুরস্কার পাবে আপনাকে ক্রমওয়েলের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে। সোজা কথা দুই লক্ষ পাউন্ড মূল্যে ওরা রাজাকে বিক্রি করেছে শত্রুর কাছে।’
এক মুহূর্ত নীরব রাজা, চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছেন না, অবশেষে তিনি থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন–‘কাউন্ট। এ খবরে কোনো ভুল নেই তো?’
‘আমি নিজের কানে শুনেছি প্রত্যেকটি কথা, নিজের চোখে দেখেছি প্রতিটি রাজদ্রোহী সৈনিককে।’
‘উইন্টার। তোমার অল্প ইংরেজ সেন্য তারা—’
‘তাদের বিশ্বস্ততার জন্য আমি জামিন, রাজা।
‘তাহলে চলো, সেই কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে আমরা স্কটল্যান্ডের ভেতরে যাই। যেখানে রাজদ্রোহ এখনও ব্যাপকভাবে দেখা দেয়নি। সেখানে যদি নতুন সৈন্যদল গড়তে পারি তো ভালোই, যদি না পারি স্কটল্যান্ড পার হয়ে, সমুদ্র পার হয়ে নরওয়েতে চলে যাব–যেখানে বন্ধু মন্টরোজকে আগেই আশ্রয় নিতে হয়েছে।’
রাজা তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ পোশাক পড়ে নিলেন, তারপর উইন্টার, অ্যাথোস ও অ্যারামিসকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাবু থেকে।
উইন্টার চলে গেল তার ইংরেজ সেন্যদের দলটিকে নিয়ে আসার জন্য। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে, রাজা উত্তর পশ্চিম দিকে তাকালেন, ওই দিকেই হাইল্যান্ডে যাওয়ার রাস্তা। ওই রাস্তাই তাকে ধরতে হবে, একটা জমাট কালো বিস্তৃত পদার্থ। কী ওটা? সারা উত্তর পশ্চিম দিকটাকেই আটকে রেখেছে? কুয়াশা?
অ্যাথোস ও অ্যারামিস লক্ষ্য করল কালো রেখাটাকে। অ্যাথোন চারদিকে তাকাল না, কুয়াশা তো অন্য কোথাও নেই! সে কাঁপা গলায় বলল—’মজারাজা আমাদের আর পালানো হলো না।’
‘হলো না? কেন?–রাজার মনেও যে একই সন্দেহ জেগেছে তা তার কণ্ঠের সুরেই ধরা পড়ে গেল।
‘হলো না কারণ, ওই কালো রেখাঁটি হচ্ছে ক্রমওয়েলের সৈন্যের দল আমাদের একমাত্র পালাবার পথ ওরা আটকে রেখেছে।’
নিজের মনের সন্দেহ অ্যাথোসের মুখ থেকে এভাবে মিলে যেতে দেখে রাজা বোধহয় ক্ষোভে রোষে মরিয়া হয়েই স্কচ সৈন্য শিবিরের দিকে ছুটলেন, বাধ্য হয়েই অ্যাথোস ও অ্যারামিসকেও ছুটতে হল তার সঙ্গে।
পথে তারা বারবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছেন, মহারাজা?’
‘আমি শুধু একটা মুখোমুখি বোঝাপড়া করতে চাই লেভেনের সঙ্গে।’
রাজাকে আটকানো গেল না, তখনও সেই চক্রান্তকারী সৈন্য সামন্তরা জটলা করছে লেভেনের তাবুতে। রাজাকে হঠাৎ তাবুর মধ্যে উপস্থিত হতে দেখে কয়েকজন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাজা, রাজা’।
লর্ড লেভেন সচকিত হয়ে উঠলেন, ‘রাজা? এ সময়ে রাজা এখানে?’
রাজা ততক্ষণে একেবারে তাবুর মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, তিক্তস্বরে তিনি বললেন–‘হ্যাঁ, রাজা। যে রাজাকে তোমরা দুই লক্ষ পাউন্ডে ক্রমওয়েলের কাছে বিক্রি করেছ, সেই রাজাই বটে আমি।’
আকাশ থেকে পড়লেন লেভেন–এ খবর রাজার কানে এর মধ্যে পৌঁছে গেল কীভাবে ভেবে পেলেন না কিছুতেই, ঢোক গিলে আমতা আমতা করে কোনো মতে বললেন, কি যে বলেন, মহারাজা। আমরা যে প্রত্যেকে রাজার জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত, তার যে কোনো প্রমাণ আমরা দিতে পারি।
রাজা বললেন, আমি একটাই মাত্র প্রমাণ চাই লেভেন, এই মুহূর্তে ক্রমওয়েলের সৈন্যকে আক্রমণ কর। তাতেই তোমার কথার সত্যতা প্রমাণ হবে, লেভেন মাথা নিচু করে বলেন–‘রাজা জানেন যে সেটা অসম্ভব। কারণ ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ বিরতির চুক্তি রয়েছে।’
‘কিন্তু ওদের সৈন্য আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তাকে কি চুক্তির বরখেলাপ হয়নি?’
‘কে বলল যে ওরা ক্রমওয়েলের সৈন্য?’
‘কাউকে বলতে হয়নি, আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি, রাত্রি জেগে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ব্যস্ত না থাকলে তোমরাও দেখতে পেতে।’
আর কথা যোগাল না লেভেনের মুখে।
তখন সামনে এগিয়ে এল কয়েকজন দুঃসাহসী পাহাড়ি সামন্ত, নীচ লোকদের স্বভাবই এই যে তাদের নিচুতা যখন ধরা পড়ে যায়, তখন তারা লজ্জা ঢাকতে যায় ঔদ্ধাত্ব এবং স্পর্ধার দ্বারা। এরাও তাই করল—’হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র করেছি, করব না কেন? অত্যাচারী শোষণকারী চার্লস স্টুয়ার্টের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছি। আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে। আর তোমাকে তাবুর বাইরে যেতে হবে না। চার্লস স্টুয়ার্ট, তোমাকে আমরা বন্দি করলাম।’
এই বলে সত্যি সত্যি দুই দুবৃত্ত দুই দিক থেকে হাত বাড়াল রাজার দুই হাত ধরার জন্য। অমনি বিদ্যুতের ঝলকের মতো বেরিয়ে এল দুটি তরবারি, আর আমূল ঢুকে গেল তাদের বুকে। অ্যাথোস আর অ্যারামিস অকারণে আসেনি রাজার সঙ্গে।
অপ্রত্যাশিতভাবে দুজন অপরিচিত যোদ্ধাকে হঠাৎ রাজার সাহায্যে উপস্থিত হতে দেখে রাজদ্রোহীরা ভয় পেয়ে গেল। অপরিচিত যোদ্ধারা বেপরোয়া এবং মরিয়া। বিনা বাক্য ব্যয়ে দুই জনকে তারা পরলোকে পাঠিয়েছে চোখের পলকে। পরের বার যারা রাজাকে বন্দি করতে যাবে তারাও হয়তো একই পথের পথিক হবে। এ অবস্থায় হঠাৎ আর কেউ এগিয়ে এল না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আক্রমণের একটা ধারা আগে স্থির করে নিতে চায়। এদিকে অ্যাথোস আর অ্যারামিস দাঁড়িয়ে নেই। রাজাকে মাঝখানে নিয়ে তারা দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে, তাবু থেকে বেরিয়ে পড়তে আর কতক্ষণ লাগবে তাদের? অচিরেই খোলা মাঠে এসে পড়ল তারা রাজাকে নিয়ে।
রাজদ্রোহীরা পিছু ধাওয়া করেনি। লেখেন তাদের বুঝিয়েছে, যাক না রাজা কোথায় যাবে, চারিদিকের পথঘাট বন্ধ। তোমরা সজ্জিত হয়ে নাও। সুশৃঙ্খল ভাবে সামনে এগোও। ক্রমওয়েল যেন আমাদের এলোমেলো হাটুরও জনতা বলে ভুল না করে।
উইন্টার এখনও আসছে না, একজন তার খোঁজ করতে যাবে কিনা ভাবছে। এমন সময় অ্যাথোসের দৃষ্টি পড়ল–শীর্ণ নদীটির ওপারে পিলার উপর সৈন্য পরিবেষ্টিত একজন বেঁটে মোটা লোক চোখে দূরবীন তুলে তাদের তিন জনকে দেখছে, রাজাকে সে জিজ্ঞেস করল–‘রাজা কি ওই লোকটাকে চেনেন?’
‘চিনার কথা তো, ওই হলো ক্রমওয়েল’, একটু হেসে রাজা বললেন। পিছনে একটি ছোট সৈন্যদল নিয়ে উইন্টার এসে পড়লেন। ছোট হলেও এই চারশো অশ্বারোহী যদি তাদের কর্তব্য ঠিকমতো করে, তাহলে এখনও আশা আছে।
এতক্ষণে স্কট সৈন্যরাও জোট বেধে মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে, উইন্টার ইংরেজ সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে দেখে তাদের অনেকের লজ্জা হলো, তবে তারা কেউ নেতা নয়, ঘটনার গতি পালটে দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই তারা শুধু লাইন ছেড়ে বেড়িয়ে এল। আর হাঁটুতে চাপ দিয়ে যার যার তরোয়াল দু টুকরো করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এ দৃশ্য দেখে রাজার বিষন্দু মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। উইন্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘সবাই ওরা বিশ্বাসঘাতক নয়, দেখছ? সময়ের চাপে পড়ে ওদের রাজদ্রোহীদের দলে মিশতে হয়েছে, যাই হোক আর দেরি করার প্রয়োজন নেই। উইন্টার তোমার সৈনিকেরা সামনে এগোক। এবার আমাদের ওই ফরাসি বন্ধুদের সম্মানে ফরাসি জাতির জয়ধ্বনিই আমরা উচ্চারণ করি এসো-মন্টজয় এবং সেন্ট ডেনিস, ইংল্যান্ডের জাতীয় জয়ধ্বনি ‘সেন্ট জর্জ ফর ইংল্যান্ড’ তো এখন বিদ্রোহীদের গলায় উচ্চারিত হচ্ছে।’
উইন্টার আদেশ দিলেন–‘খোলা তরোয়াল, মন্টজয়ে এন্ড ডেনিস, মন্টজয় এন্ড সেন্ট ডেনিস।’ ধ্বনিত হল চারশো কণ্ঠে, চারশো তরবারি ঝিলিক দিয়ে উঠল ভোরের সূর্যের আলোয়।
‘সামনে এগোও’–দ্বিতীয় আদেশ এল।
কিন্তু কোথায়? অশ্বারোহী সৈন্য দল পাথরের মসর্তির মতো অচল।
অ্যারামিসের কানে কানে অ্যাথোস বলল–‘ওই দেখ বিশ্বাসঘাতকতা কাকে বলে,’ ততক্ষণে রাজা চমকে ফিরে দাঁড়িয়েছেন, উইন্টার ক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ স্বরে গর্জন করে উঠেছেন–‘যারা ভগবানকে ভালবাস দেশকে ভালোবাস, রাজাকে যারা ঈশ্বরের এবং পিতৃভূমির জীবন্ত প্রতিনিধি বলে মানো, এগিয়ে যাও তারা।’
এবারে তারা এগিয়ে গেল, কিন্তু সারি বেধে না, একদিকেও না, যে। যেভাবে খুশি ঘোড়া ছুটিয়ে এক একজন বিস্তীর্ণ মাঠের এক একদিকে হাওয়ার মতো উধাও হলো, সেনাপতির আদেশ যাতে আর কানে না যেতে পারে সেইজন্য।
উইন্টারের পায়ের নিচে থেকে মাটি যেন সরে গেল, ‘বেঈমান’ একটা চাপা গর্জন ছাড়া তার মুখ থেকে আর কোনো কথাই বেরুলো না। অ্যাথোস লক্ষ্য করল–মাত্র পনেরোজন অশ্বারোহী তখনও উইন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজা তরোয়াল ঘুরিয়ে চিৎকার করে বললেন–‘কিছু যায় আসে না। সংখ্যা যত কম হবে, গৌরব তত বেশি হবে, ওই আসছে ক্রমওয়েলের সৈন্য, বন্ধুগণ ওই সৈন্যদের ভিতর দিয়ে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে।’
তখন অ্যাথোস, অ্যারামিস আর উইন্টারের অনুসারী ১৫ জন বিশ্বস্ত সৈনিক, মোট আঠারজন যোদ্ধা রাজা চার্লসকে চারদিক থেকে ঘিরে দাঁড়াল এবং উইন্টারের আদেশে আঠারজন অশ্বারোহীর সেই দল একটা সুচের মতো ছুটে গেল শত্রু সৈন্যের উদ্দেশ্যে। তীব্রগতি, প্রচণ্ড আঘাত, ঘোড়ার
ডাক, রক্তমাখা তরোয়ালের ঝলকানি, একটা গুলি এসে লাগল উইন্টারের বুকে, একটা হাসির শব্দ শোনা গেল শত্রুসৈন্যের পিছন থেকে।
উইন্টার ঘোড়া থেকে পড়তে পড়তেও লক্ষ্য করলেন তার আততায়ী সেই মর্ডন্ট, মিল্যাডির ছেলে।
একদিকে সতেরোজন যোদ্ধা অন্যদিকে সতেরো শত। একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ড চলছে রাজার চারপাশে, অ্যাথোস আর অ্যারামিসকে ধরাশায়ী করার জন্য তরবারি উঠছে অনেক, কিন্তু রাজার গায়ে কেউ আঘাতের চেষ্টা করছে না, রাজা বুঝলেন ওরা তাকে বন্দি করতে চায়, কিন্তু তা তিনি হতে দেবেন না, মৃত্যুকেই বরং বেছে নেবেন, যেমন করে বেছে নিয়েছেন তার শেষ ইংরেজ বন্ধু উইন্টার। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে একবার এ সৈনিকের কাছে আবার ঘোড়া ছুটিয়ে ও সৈনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লাগলেন হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে, কিন্তু না, কেউ তার সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, প্রত্যেকেই সরে যাচ্ছে তার সামনে থেকে।
কিন্তু অন্যরকম অবস্থা অ্যাথোস আর অ্যারামিসের। প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়েও এই দুই যোদ্ধা আর বুঝি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। মৃত্যু তাদের এগিয়ে আসছে। ওই শত্রুর তরবারি নামছে।
হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে দুটো প্রকাণ্ড ঘোড়া শত্রু সৈন্যের পিছন থেকে সামনে ছুটে এলো নিজের দলের সৈন্যদের চাপা দিয়ে। অ্যাথোস ও অ্যারামিসকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে হটিয়ে দিল, তারপর একজনে অ্যাথোসকে, হামলাকারীদের অ্যারামিসের ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল ‘আত্মসমর্পণ কর। আত্মসমর্পণ কর। নিচু গলায় বলল–‘আমায় চিনতে পারছ না?
হুশ ফিরে পেয়ে অ্যাথোস সবিস্ময়ে বলল–‘দ্যার্তেগা!’
অ্যারামিস বলল–‘পোর্থস!’
তারা দুজনেই শুধু বলল–‘চুপ আমরা তোমাদের অপরিচিত।’
.
৬.
দুই ঘণ্টা পরে।
নিউক্যাসল দুর্গের একটি রুমে ক্রমওয়েল বসে যুদ্ধের বিবরণ শুনছেন। বিবরণ দিচ্ছে সেই মর্ডন্ট।
আক্রমণের আদেশ দিয়ে ক্রমওয়েল অন্য কাজে চলে যেতে বাধ্য। হয়েছিলেন, যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। রাজা হয় বন্দি হবেন না হলে মারা যাবেন এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন তিনি। কাজেই নিজে যুদ্ধের শেষ দেখার জন্য উপস্থিত থাকার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি।
তাই মর্ডন্ট সব কথা তাকে শোনাচ্ছে।
‘রাজা আত্মসমর্পণ করেছেন।’
‘কার হাতে তরোয়াল তুলে দিলেন?’ প্রশ্ন ক্রমওয়েলের।
‘কারও হাতেই না, হাঁটুতে রেখে ভেঙে ফেলে দিলেন।’
‘তা খারাপ করেননি, তবে না ভেঙে ওটা নিজের উপকারে লাগাতে পারতেন। আর সেটি করলেই সকলের পক্ষে ভালো হত।’
মর্ডন্ট বলল—’আপনি বলতে চাইছেন–রাজা নিজের বুকে বসিয়ে দিতে পারতেন ওটা।’
এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ক্রমওয়েল জিজ্ঞাসা করলেন–‘আর কোনো বিশেষ ব্যক্তি মারা গেছেন?’
‘লর্ড উইন্টার।’
‘লর্ড উইন্টার? তোমার কাকা?’ ও মর্ডন্টের এই বলে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন ক্রমওয়েল-দিকে।
‘আমার চাচা বলেও তাকে আমি রেহাই দিতে পারি না, সে যখন পার্লামেন্টের শত্রু।’
‘তা তো বটেই।’ মাথা নাড়েন ক্রমওয়েল।
মর্ডন্ট হঠাৎ বলে—’মালিকের কাছে একটা প্রার্থনা আছে আমার। চার্লস স্টুয়ার্টের দলে শেষ সময়ে দুজন ফরাসি নাইট এসে যোগ দিয়েছিল। আমার কাকা এনেছিল তাঁদের ফ্রান্স থেকে, তারা আজকের যুদ্ধে বন্দি হয়েছে। ওই বন্দি দুজনকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, এই প্রার্থনা—’
‘কে তাদের বন্দি করল?’ ক্রমওয়েল একটু আপত্তি তুললেন। যে বন্দি করবে তার অধিকার থাকবে বন্দির ওপর, এ পুরান নিয়ম আমি পালটাই কী করে?
‘আপনার কাছে বিশেষ অনুগ্রহ চাইছি আমার এতদিনের সেবার বিনিময়ে।’
‘ওরা খুব ধনী বুঝি? মোটা রকম মুক্তিপণ পাবার আশা করছ?’ ক্রমওয়েলের মুখে পরিহাসের হাসি।
‘ঠিক ধরেছেন–আমি যে গরীব তা তো জানেনই।’
‘বিশেষ অনুগ্রহ হিসাবে এইটিই যখন তুমি প্রার্থনা করছ এও সত্য যে তুমি কখনও কিছু চাওনি-বেশ, নিতে পার তুমি বন্দি দুজনকে যা ইচ্ছা করতে পার তাদের নিয়ে।’
‘যা ইচ্ছা করতে পার’–কথাটার ওপর একটি বেশি জোর দিয়ে রহস্যপূর্ণ চোখে ক্রমওয়েল একবার চাইলেন মর্ডন্টের দিকে, কি সে করতে চায় তা অনুমান করতে পেরেছেন তিনি। মর্ডন্ট ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।
আসল কথা হলো প্যারিসে যখন সে ছিল, উইন্টারের চলাফেরার ওপর তীক্ষ্ণ চোখ সে রেখেছিল। উইন্টারের সঙ্গে দেখেছে অ্যাথোসকে, খোঁজ নিয়ে নামও জেনেছে তার।
আবার তার আগে বেথুনের ঘাতকের স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে জেনেছে তার মায়ের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে উদ্যোক্তা ছিল অ্যাথোস, পোর্থস, অ্যারমিস ও দ্যার্তেগা নামের চার ফরাসি সৈনিক।
এখন সেই অ্যাথোসকে সে দেখেছে তারই অধীনে দ্যার্তেগার বন্দিরূপে। চিনেছে অ্যাথোসকে। মায়ের হত্যাকারী বলেই চিনেছে, প্রতিহিংসা নেবার এই সুযোগ, তারই জন্য বন্দিদের নিজের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসার এই প্রয়াস।
অ্যারামিস, পোর্থস বা দ্যার্তেগাকে প্যারিসে দেখেনি–তাদের নামও জানে না এখন পর্যন্ত, ম্যাজরিন যখন দ্যার্তেগা আর পোর্থকে ক্রমওয়েলের সেবা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন মর্ডন্টের কাছে, দ্যার্তেগাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে জটিলতা এড়িয়ে চলার পথ খোলা রাখার জন্য ছদ্ম নামে নিজের ও পোর্থসের পরিচয় দিয়েছে।
কাজেই মর্ডন্ট মায়ের হত্যাকারী বলে নিঃসন্দেহে চিনেছে এবং অ্যাথোসকেই তার সঙ্গী বন্দি হয়তো পোর্থর্স বা অ্যারামিস বা দ্যার্তেগা হতেও পারে। কাজেই সঠিক চিনতে না পেরেও তাকে অ্যাথোসের সঙ্গে যমালয়ে পাঠাতে সে রাজী, কিন্তু দ্যার্তেগা ভাবে পোর্থসকে সে সন্দেহ করে না, ওরা যে মিল্যাডির হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, এমন কথা তার মাথায় খেলেনি।
আটজন সৈন্য নিয়েই সে বেরুলো, দ্যার্তেগা পোর্থসের জন্য নিউক্যাসেল শহরে একটি বাসস্থান দিয়েছেন ক্রমওয়েল। এটা শুধু ম্যাজারিনের দূতকে সম্মান দেখানোর জন্য।
এই বাসস্থানেই তারা বন্দি অ্যাথোস আর অ্যারামিসকে এনে তুলেছে, ঘরের ভেতর বসে চার বন্ধুতে আলোচনা হচ্ছে। অ্যাথোস বলছে, রানী হেনরিয়াটার অনুরোধে কীভাবে তাকে ও অ্যারামিসকে চলে আসতে হয়েছিল লর্ড উইন্টারের সঙ্গে, রাজা চার্লসের বিপদের দিনে তার সাহায্যের জন্যে, এদিকে দ্যার্তেগা জানাচ্ছে ম্যাজারিন কীভাবে ক্রমওয়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ঘনিষ্ট করে তুলার জন্য তাকে ও পোর্থসকে পাঠিয়েছিলেন মর্ডন্টের কাছে, বিশেষ রাজদূতের মর্যাদা দিয়ে। অ্যাথোস জিজ্ঞাসা করে ‘তোমাদেরকে মর্ডন্ট চেনে?’
‘বোধহয় না, কিন্তু আমরা তাকে চিনি, মর্ডন্টের নাম আমাদেরকে গ্রিমড জানিয়েছে। উত্তর দিল দ্যার্তেগা।
পোর্থস ক্ষোভের সঙ্গে জানাল–‘লোকটাকে দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে, গলাটা চেপে ধরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে, অথচ ভাগ্যের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে এই মর্ডন্ট হয়েছে কর্নেল, আর আমরা যেহেতু অলস হয়ে বসে না থেকে যুদ্ধ করতে চেয়েছি, কাজেই আমরা কর্নেল মর্ডন্টের অধীনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। এ জানলে যুদ্ধ করার কথা মুখেও আনতাম না।’
ঠাট্টা করে অ্যারামিস বলল–‘আরে ভাই, যুদ্ধ করতে চেয়েছিলে বলে আমাদের প্রাণটা বাঁচাতে পারলে, বিশেষ রাজদূত সেজে চেয়ারে বসে থাকলে আমরা এতক্ষণে…’ খটাখট, খটাখট, অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দে কথা থেমে গেল তার।
লাফিয়ে উঠে দরজার বাইরে চলে দ্যার্তেগা।
ঘোড়া থেকে নামছে মর্ডন্ট, বেশ খুশী দ্যার্তেগা–‘আরে কর্নেল, ডিনারটা কি দয়া নামী দামি লোক,’ একটু হেসে গলা নামিয়ে দ্যার্তেগা আবার বলে, ‘মোটা দাও মিলে গেছে কর্নেল, এক একজন এক এক হাজার। পাউন্ড মুক্তিপণ তো দেবেই।‘
বিরক্ত ভরে মর্ডন্ট বলল–‘কিন্তু ক্রমওয়েল আমাকে ওই বন্দি দুজনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই পাঠালেন।’
এটা গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিল দ্যার্তেগা, তবে সে জানে, ক্রমওয়েলের কোনো আগ্রহ এই বন্দিদের সম্পর্কে থাকতে পারে না, আগ্রহ থাকতে পারে এবং প্রবলভাবে রয়েছে ওই মর্ডন্টেরই, এখন সে যেন আকাশ থেকে পড়ল মর্ডন্টের কথা শুনে বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য? সে কি? ওরা তো আমাদের বন্দি, সব সভ্যদেশে এই নিয়ম যে যাকে বন্দি করেছে সেই বন্দির মালিক হবে। মহান ক্রমওয়েল, যার মতো বিজ্ঞ শাসক বা দক্ষ যোদ্ধা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই, তিনি কখনও ফরাসি দেশের বিশেষ রাজদূতদের ওপর এরকম অন্যায় আদেশ দিতে পারেন না।
‘অন্যায় আদেশ কিসে হলো?’ রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলেই তিনি এদের নিজের হেফাজতের ভেতরে এনে নিরাপদে রাখতে চাইছেন।
‘তা অবশ্য খুব স্বাভাবিক। মিষ্টি স্বরে বলে দ্যার্তেগা। কিন্তু কর্নেল আপনি তো বিবেচক লোক, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের পাপ্য টাকাটা না পেলে আমরা কি করে বাঁচি? সৈনিক বৃত্তি গৌরব বৃত্তি হলেও সৈনিকদের আর্থিক দুরবস্থাও আপনার অজানা নেই, কারণ আপনি নিজে একজন বিখ্যাত সেনাপতি, আমাদের বন্দি দুজনকে আপনি নিয়ে যান তাতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু মুক্তিপণ দু’হাজার পাউন্ড আমরা পেতে চাই।’
‘বেশ পাবেন দু’হাজার পাউন্ড। আমি কথা দিচ্ছি, এখন লোক দুটোকে এনে দিন।’ মর্ডন্ট আর রাগ চেপে রাখতে পারে না।
‘আচ্ছা, কর্নেল এখনও তো মহান ক্রমওয়েলের লিখিত আদেশ পত্রটা দেখালেন না।’
‘লিখিত আদেশ?’–এবার সত্যি সংযম হারায় মর্ডন্ট—’আপনি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছেন?’
জিভ কামড়ে সবেগে বারবার মাথা নাড়াতে লাগল দ্যার্তেগা এমন পাপ আমি করতে পারি? সব কাজেরই একটা রীতি পদ্ধতি আছে, এই বন্দিদের নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে–আপনিই তো বলছেন–সেক্ষেত্রে এদের যে আমরা আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি, মহান ক্রমওয়েলের আদেশ মতো তারও একটা দলিল থাকা চাই, না থাকলে, ভবিষ্যতে আমরা বেচারীরা শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়ে যেতে পারি। না, না, লিখিত আদেশ পত্র না পেলে আমরা বন্দিদের ছাড়তে পারি না।’
ক্রোধে গর্জন করে মর্ডন্ট বলে–‘আমি কেড়ে নিয়ে যাব ওদের, দেখছেন আমার সঙ্গে আটজন সৈনিক?’
‘এ হে হে হে।’ দ্যার্তেগা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ে–‘আপনি কেন যে এমন অবুঝ হচ্ছেন, আদেশ পত্রটা নিয়ে আসেননি, নিয়ে আসুন গিয়ে, কতক্ষণের ব্যাপার আপনার জুলুমবাজি প্রতিরোধ করতে বাধ্য হব, লড়াই হবে, আপনারা নয়জন আছেন, আমরা মাত্র দুজন, সুতরাং আমরা মারা পড়ব সন্দেহ নেই। কিন্তু ফরাসি দেশ যে দেশের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করার জন্য আপনাকে যেতে হয়েছিল, প্যারিসে তার বন্ধুত্বের প্রতিদান আপনি যদি এভাবে দেন ফ্রান্সের রাজদূতের মস্থক কেটে ফেলে সেটা কি ম্যাজারিনই ভালো চোখে দেখবে–বোকা সে মোটেই নয়, দ্যার্তেগার কথায় সে মনে মনে স্বীকার করল, ঠাণ্ডা মেজাজে বলল–তাহলে এখানে আমার সৈনিকেরা রইল, আমি যাচ্ছি। আধঘন্টার ভেতরেই নিয়ে আসি আদেশ পত্র।’
যোগ করে দেয়, দ্যার্তেগা। আর তার সঙ্গে দু হাজার পাউন্ড।
সে কথার উত্তর দেয় না মর্ডন্ট, দুর্গের দিকে সে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় দ্যার্তেগা, সারাবাড়িটা ঘিরে বসে থাকে আট জন সৈনিক, সতর্ক প্রহরায়।
ভেতরে বসেই, অ্যাথোস কান পেতে শুনেছে।
অ্যারামিস বলে, ‘মর্ডন্টের মতলবটা পরিষ্কার, বেথুনের ঘাতকের কাছেই আমাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
অ্যাথোস জিজ্ঞাসা করে দ্যার্তেগাকে–‘পালাবার উপায় কিছু আছে নাকি?’
‘আছে বইকি? বজ্জাতি বুদ্ধি মর্ডন্টের একচেটিয়া নয়। দ্যার্তেগাও শিশু নয়, আমি একবার আস্তাবল ঘুরেয়ে আসছি।’
আস্তাবলে গিয়ে চাকরদের ডাক দিল দ্যার্তেগা, মস্কটন আর তার পোর্থসের সঙ্গেই এসেছিল, মিড আর ব্রেইসিরস ছিল অ্যাথোসের সঙ্গে রাজ শিবিরে যুদ্ধের পরে তারা এখানে এসে অ্যাথোসের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
প্রহরী সৈনিকদের শুনিয়ে শুনিয়ে জোর গলায়, দ্যার্তেগা বলতে থাকে। মাস্কেটন। গ্রিমড। ব্রেইসিরস! খুব ভালোই হয়েছে। বন্দিদের বাড়ি থেকে কবে মুক্তিপন আসত, কিছু ঠিক ছিল না, এখন আর তার জন্য আমাদের হাঁ করে বসে থাকতে হবে না, কর্নেল মর্ডন্ট নিজে আমাদের দুই হাজার পাউন্ড দিয়ে দিচ্ছেন, তিনি এখনি টাকাটা এনে দিবেন, টাকাটা পাওয়া মাত্র আমরা নিজের দেশের পথ ধরব। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে এক্ষুণি সাজিয়ে নিয়ে এস বাইরে। বন্দিদের ঘোড়া দুটোও আনো। কারণ তারাও যাবেন কর্নেল মর্ডন্টের সঙ্গে, একসাথে বেরুবো সবাই।
তারপর দ্যার্তেগা আবার ঘরের ভেতর এল, চুপি চুপি বলল–‘এক্ষুণি ঘোড়া নিয়ে চাকরেরা বাইরের দরজায় আসবে, তোমরা তৈরি হয়ে থাক, অ্যাথোস আর অ্যারামিস আবার তরোয়াল বেঁধে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি, যখন শুনবে আমি ‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছি, তখন তোমরা একসাধে ছুটে বেরুবে।’
আবার আস্তাবলে ঢুকল দ্যার্তেগা, প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল, আর দেরি করা চলে না। কর্মচারীরা প্রস্তুত। দ্যার্তেগার ইশারায় তারা ছয়টা ঘোড়া সাজিয়ে নিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। তিনটিতে তারা চড়ে রয়েছে। অন্য তিনটির লাগাম হাতে ধরা। আস্তাবলে শুধু দ্যার্তেগা আর তার নিজের ঘোড়াটি, প্রহরী সৈনিকদের ঘোড়াগুলোকেও তারা এখানে অবশ্য বেঁধে রেখেছে।
এক কোণে কর্মচারীরা আগুন জ্বালিয়ে ছিল, সেখান থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা তুলে তারে জড়িয়ে নিল দ্যার্তেগা, তারপর তার সহ কয়লার টুকরা হাতে নিয়ে সে ঘোড়ার লাগাম ধরে বাইরে এলো, গেটের সামনে প্রহরীরা জমায়েত হয়ে আছে আটজন, আর একটু সামনে গ্রিমড, মাস্কেটন প্রস্তুত রয়েছে নিজেদের ঘোড়া নিয়ে।
দ্যার্তেগা প্রহরীদের সামনে আবার আগেই ঘোড়ায় উঠে পড়ল, তারপর সকলের অজান্তে হাতের সেই জ্বলন্ত কয়লা ঢুকিয়ে দিল নিজের ঘোড়ার কানের ভেতর, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ঘোড়াটা, আর পেছনের পায়ে খাড়া হলো। একবারে দ্যার্তেগার মতো দক্ষ আরোহী না হলে সে অবস্থায় কেউ ঘোড়ার পিঠে ঠিকমতো বসে থাকতে পারে না। দ্যার্তেগা পায়ের প্রবল চাপ এবং হাতের তেমনি শক্তিশালী চাপ দিয়ে তাকে আবার চার পা মাটিতে নামাতে বাধ্য করল বটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এমন কৌশলে জুতোর স্লাম দিয়ে তার পেটে গুতো দিল যে ঘোড়াটা পাগলের মতো ঘুরপাক খেতে খেতে প্রহরীদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। এই হঠাৎ উৎপাতে যেন আহত হতে না হয়, এজন্য প্রহরীরা তাড়াতাড়ি পিছু সরে গেল, এমন সময় দ্যার্তেগা যেন ঘোড়ার কাণ্ড কারখানায় ভয় পেয়েই আর্তনাদ করে উঠল–‘ঈশ্বর রক্ষা কর’ বলে। ঘোড়ার কানের ভেতর তখনও আগুন জ্বলছে, ঘোড়াটা তখনও পিছনের পা তুলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সে যদি কারও গায়ের উপর দিয়ে পড়ে এই ভয়ে প্রহরীরা ক্রমশ আরও পিছনে সরে যাচ্ছে, এমন সময়ে ঘরের ভেতর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো—’পোর্থস, অ্যাথোস এবং অ্যারামিস।’
প্রহরীদের চোখ তখনও দ্যার্তেগার ঘোড়ার দিকে, বন্দিরা পালাচ্ছে এটা তারা লক্ষ্য করার আগেই পোর্থর্সরা প্রায় দ্যার্তেগার কাছে চলে এসেছে। তখন প্রহরীরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল, ‘বন্দিরা পালাচ্ছে, ধর ধর’ এবং এক সাথে ছুটে এসে পথ আটকে দাঁড়াবার চেষ্টা, কিন্তু সামনে বাধা হয়ে আছে দ্যার্তেগা, এখন তার ঘোড়া আর লাফাচ্ছে না, কারণ কাউকে না দেখিয়েই দ্যার্তেগা আগুনটা বের করে ফেলেছে তার সহ, ঘোড়া লাফাচ্ছে না এবং দ্যার্তেগার দুই হাতে দুই পিস্তল, প্রহরীরা পিস্তল নিয়ে আসেনি, সুতরাং যে এগুবে, তার নিশ্চিত মৃত্যু।
পোর্থস, অ্যাথোস, অ্যারামিস ছুটে এগিয়ে গিয়েছে, উঠেছে গিয়ে নিজের নিজের ঘোড়ায়। এবার দ্যার্তেগা নিজের ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল, তখন প্রহরীরাও ছুটে এল, কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চড়া ছুটন্ত পলাতকদের পিছু ধাওয়া পায়ে হেঁটে যায় না। তারা ছুটল আস্তাবলে, ঘোড়া নিয়ে আসার জন্য। ঘোড়া আনবে তাতে উঠবে, তারপর পিছু নেবে, সে এখন অনেক দূর। এদিকে দ্যার্তেগারা বাতাসের বেগে ছুটছে।
.
৭.
এই তো জীবন–এই তো আনন্দ। এই তো ফুর্তি।
নিজের স্বাধীনতা নিজের হাতে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি, পিছনে পড়ে আছে নিষ্ঠুর খুনী, সামনে খোলা পৃথিবী আর স্বাধীনতা।
সাতটা ঘোড়ার বেগে ছুটছে নিউক্যাসল থেকে এসে। এদের মাথায় এখনও আসছে না রাস্তায় কোনো লোকজন নেই, যদিও সর্বসাধারণ এ পথ ব্যবহার করে না, যুদ্ধের ভয়ে পালিয়েছে লোকজন? হয়তো তাই হবে।
অনুসরণ করেনি মর্ডন্ট। টিলার মাথায় উঠে মাঝে মাঝে ওরা পিছন ফিরে দেখেছে। নিউ ক্যাসল পর্যন্ত উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো পথের কোথাও শত্রুর কোনো চিহ্ন নেই। এরই বা মানে কি?
ঘোড়ার রশি আলগা দিল ওরা। শত্রুর দেশ এই স্কটল্যান্ড, তবু কি সুন্দর। যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন যদি ভুলে যাওয়া যেত। সত্যি কথা, চার বন্ধু পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে ঠিক বিশ বছর আগের মতো, কেমন যেন বিস্ময় লাগে, মাঝে এতগুলো দিন তাদের রোজকার সমস্যা নিয়ে এসেছে, গিয়েছে এ যেন বিশ্বাস করাই কঠিন মনে হয়।
বিকাল নাগাদ ওরা একটা বনভূমিতে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলো ঘাস খেতে লেগে গেল। তাই দেখে পোর্থস পোর্টের উপর হাত দিয়ে একটা চড় মেরে বলল, তাই তো, এখন আমরা খাই কি? ডিনারের বেলা যে যায়।
অ্যারামিস প্রতিবাদ করে ‘ডিনারের আবার বেলা অবেলা কী, যখন জুটবে তখনই বেলা। এখন যখন জোটেনি, তখন এটা অবেলা।’
মন্তব্য করে দ্যার্তেগা ‘এটা খুব জ্ঞানের কথা, সুতরাং ডিনারে যাওয়ার কথা নিয়ে বাজে আলোচনা না করে, এসো কাজের কথা বলি, সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর কত দূরে হতে পারে, সে ধারণা কারও আছে?’
না সে ধারণা কারও নেই।
অ্যাথোস শুধু বলে–‘সমুদ্র বন্দরের কথা তুলছ, তোমরা কি তাহলে ফ্রান্সে ফিরে যেতে চাইছ?’
আকাশ থেকে পড়ল দ্যার্তেগা–‘আমরা না তোমরা? ফ্রান্সে ফিরে যেতে চাইছ সেটা ঠিক। কারণ ফ্রান্স ছাড়া আর কোথায় যেতে চাইব? যেতে চাইছি ঠিকই, কিন্তু যাওয়াটাই তো শক্ত।’
তাহলে বিদায় বন্ধু দ্যার্তেগা, বন্ধু পোর্থস এবং ধন্যবাদ তোমরা যে উপকার করেছ, তা তোমরা ছাড়া আর কেউ করতে পারত না, যুদ্ধে আমার আর অ্যারামিসের প্রাণ যাওয়া অনিবার্যই ছিল, সে প্রাণ বাঁচিয়েছ তোমরা। এখন আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকা আমাদের কোনো লাভ তো নেই, তোমরাও পদে পদে অসুবিধায় পড়বে আমরা সঙ্গে থাকলে, সুতরাং যা বলেছি বিদায়।
‘দ্যার্তেগা আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। অ্যাথোস এসব কি পাগলামি করছ? তোমরা কি একেবারে দেশ ত্যাগ করে এসেছ নাকি?’
‘অ্যাথোসের ঠোঁটে একটু করুণ হাসি খেলে যায়–না দেশ ত্যাগ করে আসিনি এবং ত্যাগ করব না কোনো দিনও। কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করে দেশ থেকে বেরিয়েছি, সে প্রতিজ্ঞা পালন না করেও ফিরতে পারি না।’
‘প্রতিজ্ঞা? মানে রাজা চার্লস এর সাহায্য? অন্ধকার হয়ে আসে দ্যার্তেগার মুখ–সে প্রতিজ্ঞা রাখার জন্য তোমরা কি যথাসাধ্য চেষ্টা করনি? বারবার নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছ ওই রাজার সেবা করতে গিয়ে, তিনি এখন তোমাদের সেবার বাইরে চলে গিয়েছে, তোমরা আর কি করতে পার শুনি?’
আপন মনেই যেন স্বগতোক্তি করে অ্যাথোস–‘রাজাকে উদ্ধার করতে পারি।’ চমকে উঠে দ্যার্তেগা! পোর্থসও ওঠে। অ্যারামিসও। যুক্তি বুদ্ধির ধার না ধেরে সম্ভব অসম্ভব বিবেচনা না করে। নিছক ভাবাবেগের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়া যে কত বড় ঝকমারি, তা অ্যাথোসের সহকর্মী বন্ধুরা আগে বহুবারই অনুভব করেছে, কিন্তু পুরো বিশ বছর কেটে যাওয়ার পরও অ্যাথোসের মনোবৃত্তি সেই ডন কুইক্সেটের এক গুয়ে গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এমনটা দেখাবার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না।
কয়েক মিনিট নীরব থাকার পরে দ্যার্তেগা কষ্টের হাসি হাসে খানিকটা। রাজাকে একটা পুরো রেজিমেন্ট ঘিরে রেখেছে। সেই ঘেরাওর মধ্যে দিয়ে রাজাকে উদ্ধার করে আনা…
‘হয়তো সত্যিই অসম্ভব। দ্যার্তেগার কথা শেষ করে অ্যাথোস। বিশ বছর আগে হয়তো অসম্ভব ছিল না, কারণ তখন আমরা চারজন ছিলাম, এখন মাত্র দুইজন।’
দ্যার্তেগার মুখে চাবুকের মতো এসে লাগল ওই তিরস্কার। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না, কিন্তু পোর্থ সরল উদার পোর্থস হাত বাড়িয়ে অ্যাথোসের হাত চেপে ধরল—’কে বলে দুজন?’
‘আমরা চিরদিন চারজন ছিলাম, এখনও চারজন, মনে নেই আমাদের যৌবনের সেই মিলন মন্ত্র একে চার চারে একই’ ম্যাজারিন বা আমাদেরকে আর ক্রমওয়েলেই বা আমাদেরকে। তবে অ্যাথোস যদি আমাদের ডাকে তবে… পৃথিবীর হাতে এমন কোনো প্রলোভন নেই, যা দিয়ে সে আমাদের পিছু টেনে রাখতে পারে।
দ্যার্তেগা এগিয়ে এসে অন্য হাত ধরল অ্যাথোসের। পোর্থর্স ঠিকই বলেছে সারা পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যার আকর্ষণ আমাদের অ্যাথোসের থেকে দূরে টেনে রাখতে পারে। ওই মিলন মন্ত্র যেমন বিশ বছর আগে সত্য ছিল, আজও তেমনি আছে, একে চার চারে এক।
তখন সে কি কোলাকুলি গলাগলি, চার বন্ধুতে মিলে, অ্যাথোস আবেগ জড়িত স্বরে বলে ‘বন্ধুগণ! আমি জানি একাজ আমার পক্ষে অমার্জনীয় স্বার্থপরতা হচ্ছে নিজের নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার নিজস্ব ব্যাপারে তোমাদের সকলকে টেনে নিয়ে যাওয়া, তোমাদের উপর দাবি আছে বলেই তা করতে পারছি, কেন করছি তা বলা উচিত। আমি ভুলতে পারি না, রানী হেনরিয়েটার সেই কাতর অনুরোধ তার স্বামী এরকম মারাত্মক সংকটে উপস্থিত হতে পারে আশংকা করেই তিনি আমাদের সাহায্য ভিক্ষা চেয়েছিলেন। আমি আর অ্যারামিস মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলাম যে সাহায্য আমরা করব।’
‘স্বীকার করছিলাম বই কী?’ দৃঢ় স্বরে সায় দিল অ্যারমিস।
অ্যাথোস কৃতজ্ঞভাবে তার দিকে মাথা নেড়ে আবার বলতে থাকে, দ্যার্তেগা পোর্থস কে সম্বোধন করে। আজ সেই সময় এসেছে, রানী হেনরিয়েটার সবচেয়ে মর্মান্তিক আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। রাজা চার্লস বন্দি, তার জীবন শত্রুর হাতে বিপন্ন। একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর উইন্টার মৃত। এই সময়ে বন্ধুহীন বন্দি রাজাকে ত্যাগ করে দেশে চলে যাওয়া কি মানুষের কাজ? আমি যদি সে কাজ করি, হেনরিয়েটাকে গিয়ে কি বলব আমি? আমি আর অ্যারামিস? এই কথাই কি বলব যে রাজা বন্দি হওয়ার পর আমাদের আর করার কিছু ছিল না বলেই আমরা চলে এসেছি, এটা জানা কথা এখন তারা রাজাকে হত্যা করবে, আর তা দাঁড়িয়ে দেখার জন্য আমরা লন্ডনে বসে থেকে করব কি?
দ্যার্তেগা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—’না বন্ধু, ঠিকই বলেছ তুমি, পরে গিয়ে হেনরিয়েটাকে ‘পারলাম না কিছু করতে’ বলার সময় এখনও আসেনি, এখনও চেষ্টা করার অনেক কিছু আছে। কাজ কীভাবে শুরু করা যায়, সেটা সবাই মিলে ভেবে দেখি।’ পোর্থস তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কাজ আরম্ভ করা উচিত ডিনার দিয়ে। সকালের খাবারটা মারা গেল ওই মর্ডন্টের উৎপাতে, তৈরি খাবার খেয়ে আসা গেল না, লাঞ্চের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ লাঞ্চের সময়টা ঘোড়ার পিঠেই কেটেছে, কিন্তু ডিনার? এখন তো আর পালাচ্ছি না। সুতরাং খেয়ে নিতে অসুবিধা কি?
দ্যার্তেগা জবাব দেয় বিমর্ষভাবে, ‘অসুবিধা সামান্যই, কিন্তু মারাত্মক। সেটা এই যে ডিনারের কিছুই সঙ্গে নেই, পালাবার তাড়ায় আমরা খাবার আনতে পারিনি কিছুই।’
একথা হঠাৎ কেউ বিশ্বাস করতে রাজী হয় না, মাস্কেটন এবং গ্রিমডের মতো এক জোড়া পোড় খাওয়া পুরাতন চাকর সঙ্গে থাকতেও তারা পালাবার সময় কিছুমাত্র খাবার সঙ্গে আনেনি। এটা যেন বিশ্বাসের অযোগ্য মনে হয়। কিন্তু প্রত্যেকের কাছে যাচাই করে যখন জানা গেল যে দ্যার্তেগার সন্দেহ ষোলো আনা সৎ। তখন হতাশ ভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিল ওরা যে খাবারের খোঁজে তাহলে বন ছেড়ে বের হওয়া দরকার।
বনের বাইরে একটা মাঠ, মাঠের ওপারে আবার বন। সেই বনের আড়ালে যে একটা সাদা বাড়ি আছে, এটা মস্কেটন আবিস্কার করল।
বাড়ি যখন আছে, সেখানে মানুষও আছে এবং খাবারও আছে, সুতরাং কষ্ট করে এই মাঠটুকু পেরুতেই যা দেরি। তারপরই তো ডিনারের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে।
চার বন্ধু তিন চাকর এবং সাতটা ঘোড়া-এই চৌদ্দটি ক্ষুধার্ত প্রাণী বাড়িটার দিকে ছুটে চলল—সেই সাদা ছোট বাড়িটার দিকে।
মাঠ পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে বাড়ি।
বাড়িটার এটা পিছন দিক। ওরা ঘুরে সামনের দিক দিয়েই ঢুকবে স্থির করল। কারণ পিছন দিক দিয়ে যারা ঢোকে, তাদের চট করে চোর ডাকাতের পর্যায়ে ফেলে দেবার একটা বদ অভ্যাস সাধারণত মানুষের থাকে।
কী কাণ্ড, বাড়ির সামনেই যে চওড়া রাস্তা, এ দেখে অ্যাথস মন্তব্য করে এই তাহলে লন্ডন-নিউক্যাসল রাজপথ। নিজেদেরকে যতটা নিরাপদ ভাবা যাচ্ছিল ততটা আমরা নই তাহলে।
দ্যার্তেগা রাস্তার ধুলোর দিকে তাকাচ্ছিল, দেখে বলল–আপাতত বোধহয় নিরাপদ আমরা। বিপদ যাদের দিক থেকে আসতে পারত তারা কিছুক্ষণ আগেই লন্ডনের দিকে যাত্রা করেছে। এই দেখ অসংখ্য ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন। সব লন্ডনের দিকে।
অ্যাথোসের মুখে নীরব জিজ্ঞাসা ‘তবে কি?’
তাই নিশ্চয়ই। এ হলো হ্যারিসনের সৈন্যদল। শুনেছিলাম যে, ‘হ্যারিসন রাজাকে লন্ডনে নিয়ে যাবে।’
‘রাজাও তাহলে?’ অ্যাথোসের প্রশ্ন একটা আর্তনাদের মতো শোনায়। ‘হ্যাঁ রাজাও আছেন এদের সাথে। আমরাও ভিড়ে যাই ওই সৈন্যদলে। রাজার কাছাকাছি থাকতে তো পরবই তাছাড়া আরও এক লাভ আছে। মর্ডন্ট আজ হোক কাল হোক আমাদের সন্ধান করবেই, কিন্তু সে যতই চালাক হোক, এটা তার মগজে কখনই ঢুকবে না যে পলাতকরা পালিয়ে যায়নি। হ্যারিসনেরই বাহিনীর সঙ্গে মিলে মিশে লন্ডনের দিকে ধীরে সুস্থে সামনে এগুচ্ছে।’
‘কিন্তু বাড়িটার ভেতরে একবার গিয়ে ডিনারের একটা চেষ্টা করার কথা ছিল না? পেটের মধ্যে যে আগুন জ্বলে।’ এ বক্তব্য পোর্থসের। অ্যারামিস টিটকারী দিল–‘চল ঘুরে আসি একবার বাড়িটার ভেতরে। কিন্তু যে পথ দিয়ে একটা সৈন্যদল গিয়েছে, সে পথের পাশে কোনো বাড়িতে এক বিন্দু খাবার পড়ে থাকে, এমনটা আমি আগে কখনও দেখিনি।’
তবু অ্যারামিসই আগে বাড়ির ভেতর ঢুকল। দরজা খোলা, এটা সন্দেহজনক বাড়িতে লোক থাকলে দরজা বন্ধ থাকত।
যা হোক, খোলা দরজা দিয়ে ওরা একটা ছোট হল ঘরে ঢুকল। লোকজন নেই, যদিও অনেক লোক এখানে একটু আগে বসে ছিল, খেয়েছিল, তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে, হল পেরিয়ে ওরা আরও ভেতরে ঢুকল। এবার একজন লোক দেখতে পাওয়া গেল। সে দাঁড়িয়েও নেই বসেও নেই রুমের মেঝেতে শুয়ে আছে।
আর মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তের ঢেউতে।
লোকটা বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ, বেঁচে থাকলেও জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছে, নিস্পন্দন তার দেহ।
গ্রিমড এসে তার বুকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল, আছে। বেঁচে আছে। এখনও, জল পাওয়া গেল একটু খুঁজতেই। চোখে মুখে দিতেই সে চোখ মেলল।
লোকটার মাথা দুফাঁক হয়ে গিয়েছে, কোনো একটা ভারী জিনিসের আঘাত লেগেছিল বলে মনে হয়।
এরা সবাই মোটামুটি প্রাথমিক চিকিৎসা জানে, আহত লোকটির মাথায় পট্টি বেঁধে রক্ত মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের কথা বলল–রাজার ব্যক্তিগত ভৃত্য প্যারী আমার ভাই। এ বাড়ি আমার। রাজাকে বন্দি করে নিয়ে সেনাপতি হ্যারিসন এই পথ দিয়েই লন্ডনের দিকে গেল। প্যারী আছে রাজার সঙ্গে।
চোর ডাকাতের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এ বাড়িতে একটা গুপ্ত কুঠরি আমি তৈরি করেছিলাম। ওর ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে দুরবর্তী বনভূমিতে গিয়ে পৌঁছান যায়। প্যারী তা জানত। ওরই সুযোগ নিয়ে রাজকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা সে করতে চেয়েছিল। এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাব যার সময় প্যারী সেনাপতিকে অনুনয় করে বলে, এখান থেকে রাজাকে এক পেয়ালা কফি খাইয়ে নিতে চাই।
হ্যারিসন আপত্তি করল না। কারণ তার নিজেরও খাওয়ার দরকার ছিল, ভেতরে ঢুকেই প্যারী আমায় ইশারা করল। আমি সে ইশারা বুঝলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য প্যারীর ইশারা যে হ্যারিসনের চোখ এড়ায়নি, তা আমি বুঝতে পারিনি। হাত মুখ ধোয়ার অজুহাতে আমি রাজাকে পিছনের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ইচ্ছা ছিল ওখান থেকে রাজাকে গুপ্ত কুঠুরিতে ঢোকাব, আর এক মিনিট সময় পেলে ঠিকই ঢোকাতে পারতাম। কিন্তু সে সময় আর পেলাম না।
একটা ভয়ানক শক্তিশালী লোক পিছন থেকে আমাকে এমন এক ঘুষি মারল যে আমার মাথার তালু দু’ফাঁক হয়ে রক্তের স্রোত বেরুল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম জবাই করা পশুর মতো। বাড়ির মধ্যে যেন প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়েছে, জ্ঞান হারাতে হারাতে আমি টের গেলাম।
বিফল হয়েছে রাজাকে উদ্ধার করার প্রথম চেষ্টা। এক গরীব প্রজা চেষ্টা করেছিল রাজাকে উদ্ধার করার, সে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছেন কোনো রকমে। অথবা শেষ পর্যন্ত বাঁচবে কিনা, বলাও যায় না। সেবা করার কেউ রইল না।
বাড়িতে খাবার বলে কোনো বস্তু নেই। যা কিছু ছিল হ্যারিসর নিয়ে গিয়েছে। পোর্থসের ডিনারের আশা মিলিয়ে গেল।
আহত লোকটাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিয়ে খালি পেটেই দ্যার্তেগারা বিদায় নিল। ঘোড়া ছুঁটিয়ে গেলে বোধহয় সন্ধ্যার পরেই হ্যারিসনের সঙ্গে মিলিত হওয়া যাবে। অন্য সব বড় কারণ বাদ দিলেও মিলিত হওয়ার আসল কারণ হলো এটা যে, হ্যারিসনের বাবুচি খানা ছাড়া খাবার পাওয়া যাবে না এ পথে কোথাও। সৈন্যদল যে পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, সে পথের দু’পাশের যা খাবার, তারা ঝেটিয়ে তুলে নিয়ে যায়, এতো সবাই জানে।
হ্যারিসনের সঙ্গে তারা সত্যই সন্ধ্যার পরে মিলিত হল। দ্যার্তেগা পোর্থসকে দেখেছেন হ্যারিসন ক্রমওয়েলের দরবারে এবং মর্ডন্টের আশেপাশে তারা যে এখন এই সৈন্যদলের সঙ্গে মিলে লন্ডনের দিকে যেতে চাইবে, এটাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেই মনে হলো হ্যারিসনের ‘পিছিয়ে পড়ছিলে কেন? শুধু একবার মাত্র জিজ্ঞাসা করলেন।
দ্যার্তেগা উত্তর দিল, আর বলেন কেন? আমাদের এই বন্দি দুজনের জন্য। ওরা একবার আশা দিয়েছিল নিউক্যাসল থেকেই মুক্তিপনের ব্যবস্থা করে নিজেরাও মুক্তি নেবে। আমাদেরও মুক্তি দেবে। শেষ পর্যন্ত সে ব্যবস্থা আকাশ কুসুমে পরিণত হলো। তাই ওদের লেজে বেঁধে রওনা হতে হলো। মাঝখান থেকে দামী সময়ের অপব্যয়। কিন্তু আসার সময় এক বাড়িতে আপনাদের হাতের কিছু কাজ দেখে এলাম, একটা লোক খেতে বসেছেন হ্যারিসনের চোট বড় কয়েকটা টেবিল জুড়ে, বন্দি সহ দ্যার্তেগারাও বসেছে একটা ছোট টেবিলে। সবার থেকে একটু দূরে আর একটা ছোট টেবিলে খেতে বসেছেন রাজা একা। তাকে পরিবেশন করছে তারই ব্যক্তিগত চাকর প্যারী। সেই প্যারীকে শোনাবার জন্যই গলাটা অস্বাভাবিক উঁচু করল দ্যার্তেগা ‘একটা লোক মাথা দু’ফাঁক হয়ে পড়ে আছে। আঘাতটা যার হাত থেকে এসেছে, সে লোক বাহাদুর সেনাপতি। মানুষটা আর একটু হলেই শেষ হয়ে যেত।’
হ্যারিসনের টেবিল থেকেই একটা ষণ্ডা লোক বলে উঠল, ‘শেষ হয়ে যেত? তাহলে শেষ হয়নি, অ্যাঁ? আমি তো ভেবেছিলাম’…
সান্ত্বনার সুরে দ্যার্তেগা বলল, তার জন্য আফসোস করবেন না ভাই, শেষ যে হয়ে যায়নি, সে শুধু তার বরাত জোরে। আপনার দিক থেকে ত্রুটি কিছু ছিল না, তা আমরা দেখেই বুঝতে পেরেছি। সত্যি অদ্ভুত কব্জির জোর দেখিয়েছেন আপনি। খালি হাতে ওরকম মাথা ফাটিয়ে দেয়া না, না অসাধারণ বাহাদুরি আপনার। একসঙ্গে যখন চলেছি, আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ করব আপনার সঙ্গে। শক্তিশালী লোক দেখলেই আনন্দ হয় একটা।
শক্তিশালী লোকটার নাম গ্ৰসলো। হ্যারিসনই আলাপ করিয়ে দিলেন। আলাপের সুত্রে প্রকাশ পেল প্যারিসে গ্রসলো বেশ কিছুদিন ছিল, অল্প স্বল্প ফরাসি ভাষাটা বলতে পারে।
দ্যার্তেগাকে আর পায়কে, সে গ্রসলোকে জানাল, লেফটেন্যান্ট গ্রসলো, কী চমৎকার জ্ঞান আপনার ফরাসি ভাষাতে। এমন সুন্দর ফরাসি অনেক সময় খাস ফরাসিরাও বলতে পারে না। তা আপনার সময়ে বেশ আনন্দে কাটছে তো? আমি আর আমার বন্ধু ভ্যালন, আমরা ভাই ভারী অসুবিধায় পড়েছি, আমরা ভাই আমুদে লোক সন্ধ্যাবেলা একহাত তাস খেলতে না পারলে আমাদের ডিনার হজম হয় না। এখানে তো… এই বলেই মুখ দিয়ে একটা আফসোসের আওয়াজ বার করল দ্যার্তেগা।
কথাটা লুফে নিল এসলো, আর বলবেন না ভাই। আমারও ওই একই সমস্যা। তাস আমার ধ্যান, তাস আমার জ্ঞান, যে দিন তাসে অন্তত পাঁচটা পাউন্ড জিততে না পারি, সেদিনটা আমার বৃথা গেল মনে হয়। যুদ্ধের সময়ও অবাধে খেলা চলেছে। কেল্লায় ক্যাম্পে খেলার সাথীর অভাব কোথাও হয় না, কিন্তু ইদানীং পড়েছি ঝকমারীতে। রাজার পাহারার ভার আমার উপরেই পড়ে প্রতি রাত্রে না পারি নিজে বাইরে যেতে, না পারি বাইরের লোক ভেতরে আনতে। খেলতে না পেরে আমার পেট ফুলে ওঠার অবস্থা। গ্রসলোর মনোভাব যখন এরকম, দ্যার্তেগার তখন তার সুযোগ নিতে দেরি হবে কেন?
সে দিন ডাবি শহরে রাতের বিশ্রাম ঠিক হয়েছে। আজ গ্রসলোকে পাহারা দিতে হবে না। গ্ৰসলোকে নিজের ঘরে ডেকে আনল দ্যার্তেগা। এক বন্ধুকে নিয়ে গ্রসলো এলো। একদিকে গ্রসলো আর তার বন্ধু অন্যদিকে দ্যার্তেগা আর পেপার্থস। কুড়ি পাউন্ড হেরে ঘসলোরা বিদায় নিল।
কাল রাত কাটার কথা রিষ্টন শহরে। শোধ নেব ওখানে, গ্রসলো বিদায় নেবার সময় বলে বসলো।
‘কালও বুঝি তোমার পাহারা নেই।’
‘আছে, আছে, পাহারা দিতে দিতেই খেলব। আজ আমরা এলাম তোমাদের ঘরে, কাল তোমরা যাবে আমাদের ঘরে। অর্থাৎ স্টুয়ার্টের ঘরে। রাজাকে এখন ওরা আর রাজা বলে না,’ চার্লস স্টুয়ার্ট বলে।
দ্যার্তেগা সব খুঁটিয়ে জেনে নিল। যেদিন যেখানে রাজার রাতের থাকার ব্যবস্থা হয়, জোড়া কামরাতে রাখা হয় তাকে। প্যারীকে নিয়ে রাজা ভেতরের কামরায় থাকেন আর আটজন প্রহরী নিয়ে গ্রসলো থাকে দ্বিতীয় কামরায়। দুই কামরার ভেতর খোলা দরজা, সেই দরজার উপর বসে থাকে প্রহরীরা, যাতে এক মুহূর্তের জন্যও রাজা চোখের বাইরে না থাকেন।
সব ব্যবস্থা বুঝিয়ে দিয়ে গ্রসলো বলে বাইরের ঘরে বসে আমরা খেলব, ভেতরে শুয়ে থাকবে স্টুয়ার্ট তাতে অসুবিধা কি?
চিন্তিতভাবে দ্যার্তেগা বলে–‘অসুবিধা আর কিছু নয়, অসুবিধা শুধু আমাদের বন্দি দুজনকে নিয়ে, ওদের রেখে এলে ওরা পালাতে পারে। আমাদের চাকরেরা বিশ্বাসী ঠিকই, কিন্তু তারাও অস্ত্র ধরতে জানে না, অথচ বন্দিরা ওস্তাদ তরোয়ালবাজ, না, ওদের রেখে এনে নগদ চার হাজার পাউন্ড মারা যাবার আশঙ্কা রয়েছে বন্ধু, এক একজনের মুক্তিপণ ঠিক হয়েছে দুই হাজার, ফ্রান্সে পৌঁছেই ওরা দেবে বলেছে—’
‘দূর এসব চিন্তা বাদ দাও’–রেগে গ্রসলো বলে, ‘বন্দি দুটোকে না হয় সঙ্গেই নিয়ে এসো। বাইরের ঘরে আটজন প্রহরীর মাঝে ওরা নিরাপদ থাকবে।’
‘দ্যার্তেগার এখন কাজ হলো সব কথা প্যারীকে জানানো। কাল রিষ্টন শহরে গভীর রাতে রাজাকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা করা হবে, রাজা যেন সতর্ক থাকেন। সংকেত শব্দ হলো ‘এবার তাহলে—’’
দ্যার্তেগার মুখে থেকে ওই সংকেত বেরুনো মাত্র বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বাইরের দিকে ছুটবেন, পোষাক পরেই তাকে কাল শুতে হবে। চাকরেরা নিজেদের সাতটা ঘোড়া ছাড়াও অতিরিক্ত আরও দুটো ঘোড়া সাজিয়ে নেবে হ্যারিসনের আস্তাবল থেকে, এ সব ঘোড়া নিয়ে তারা শিবিরের বাইরে অপেক্ষা করবে, কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না, কারণ অশ্বারোহীরা সারা রাত দলে দলে আসছে, দলে দলে বেরুচ্ছে, ঘোড়ার আনাগোনা, কার ঘোড়া কোথায়, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
অ্যাথোস আর অ্যারামিস বন্দি, কাজেই তরোয়াল থাকবে না ওদের, থাকবে জামার ভেতরে পিস্তল আর ভোজালি, তারই সাহায্যে পাহারাওয়ালা সৈনিকদের ঘায়েল করে তরোয়াল যোগাড় করে নেবে ওরা।
পরের দিন সন্ধ্যে বেলা, সবাইকে আর এক দফা তালিম দিয়ে নিল দ্যার্তেগা ডিনারের পর। চাকরেরা ঘোড়া নিয়ে ঠিক কোনখানে অপেক্ষা করবে, তা দিনের বেলাতেই তাদের দেখিয়ে এনেছে। এখন তাদের কাছে প্রশ্ন—’ঘোড়াগুলোকে নিয়ে ভালো করে খাওয়ান হয়েছে তো? ওদের জিন লাগাম রেকাব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে তো? ওদের জুতোর নাল সব ঠিক আছে তো? ঘোড়ার পায়ের নালের একটা পেরেক খুলে গেলে একটা লড়াই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বার বার সে কথা দ্যার্তেগা স্মরণ করিয়ে দেয়। পোৰ্থস মাঝে মাঝে মাথা নাড়ে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। দ্যার্তেগা তার কাঁধে হাত রেখে বলে কিছু টাকা গ্রসলোকে পেতে দিও, বন্ধু। জিতলে ও জেতার নেশাতেই মেতে থাকবে, অন্য কোনো দিকে তাকাবে না।’
অ্যাথোস আর অ্যারামিস অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে দ্যার্তেগাকে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে তারা, জামার ভেতরে গুলি ভরা। পিস্তল আর ভোজালি নিয়েছে, এক একজনকে দুটো শত্রু নিপাত করতে হবে। কারণ এরা চারজন আর গ্রসলোরা আটজন। তা হয়ে যাবে এখন। সবাই রাত নয়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ল, রাজার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে পাশাপাশি ঘর। একটি ঘর রাজার জন্য, আর একটি প্রহরীদের জন্য। দ্যার্তেগারা গিয়ে দেখে রাজা বিছানায় শুয়ে পড়েছেন, গায়ের চাদরের তলায় তার দিনের বেলার পোষাক দেখা যাচ্ছে, তার পায়ের কাছে বসে বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছেন তাকে। রাজা আধবোজা চোখে শুয়ে শুয়েও শুনছেন, আর মাঝে মাঝে বলছেন, তারপর?
দ্যার্তেগাকে সোল্লাসে অভ্যর্থনা করল গ্রসলো।
গ্ৰসলো প্রহরীদের আগে থাকতেই বলে রেখেছিলেন। তারা বেশ আগ্রহ দেখাতে লাগল খেলার ব্যাপারটাতে। জুয়া খেলার উপর আসক্তি সৈনিকদের যেন মজ্জাগত।
টেবিলের চারকোণে বসল দ্যার্তেগা আর পোর্থস, গ্রসলো আর তার সহকারী প্রহরীদের কাছেই বসল অ্যাথোস আর অ্যারামিস, সংকেত উচ্চারণের সাথে সাথেই যাতে চোখের পলকে চারজন শত্রু খতম করা যায়, এমনি ভাবে কায়দা করে বসেছে চারজন। তারপর? তারপর ওরাও চারজন, ওরাও চারজন, মুখোমুখি লড়াইয়ে দ্যার্তেগার সঙ্গে সমানে সমানে লড়বে, এমন যোদ্ধা ইংল্যান্ডে কে আছে?
খেলার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের ভেতরে যেখানে রাজা শুয়ে আছেন, সে দিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে দ্যার্তেগা। প্রহরীদের চোখ আর রাজার উপর নেই, খেলার টেবিলের দিকেই তাকিয়ে আছে তারা।
খেলা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সেখানে, যার হাতে রাজা মার্কা তাস এসে পড়বে, জিতবে সেই। পোর্থস তাস তুলল না রাজা নয়, গ্রসলে তুলল না দ্যাগো তুলল–ঈশ্বর এই তো রাত গ্লাসে চেঁচি… উঠল–‘এবার তা হলে ঘরের ভেতর বিছানার উপর রাজা নড়ে উঠলেন। প্যারী বাইবেল রেখে উঠে দাঁড়াল। অ্যাথোস আর অ্যারামিস জামার ভেতরে হাত দিয়ে পিস্তল ধরেছে, দ্যার্তেগা আর পোর্থস লাফিয়ে উঠে হাত দিয়েছে কোমরের তরবারিতে–এমনি সময়ে বন্ধ দরজা হঠাৎ করে খুলে গেল, একটা ব্যস্ত মুখ দেখা গেল দরজায়, সে মুখ কর্নেল হ্যারিসনের।
বাজ পড়ল গ্রসলোর মাথায়, এ সময়ে এখানে কর্নেল আসবেন, মশগুল অবস্থায় জুয়া খেলা হাতেনাতে ধরে ফেলবেন তাকে, এ স্বপ্নেরও বাইরে, কিন্তু গ্রসলার দিকে কর্নেলের চোখ নয়, তিনি সোজা চলে গেলেন ভেতরের ঘরে, আর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘চার্লস স্টুয়ার্ট! তোমার ভাগ্যে আর রাতের বিশ্রাম নেই, এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে লন্ডনে রওনা হতে হবে, এই বার্তা নিয়ে এসেছেন, জেনারেলের বিশেষ দূত।’
সে দূত আর অন্য কেউ নয়, মর্ডন্ট।
দ্যার্তেগাদেরও মাথায় বাজ। ইংল্যান্ডের ইতিহাস অন্যরকম লিখতে পারত তারা–আর মাত্র দুমিনিট সময় পেলে। তা তারা পেল না। একা হ্যারিসন হলেও বা এ জুয়া খেলার একটা কৈফিয়ত দেয় সম্ভব ছিল, কিন্তু হ্যারিসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শনি মর্ডন্ট। এক পলকের মধ্যে জীবন মরণ কোনটা ঘটে যায়, কিছু বলা যায় না।
রাজার দিকেই প্রথমটায় তাকিয়ে ছিল মর্ডন্ট, কিন্তু পরক্ষণেই চোখ পড়ল দ্যার্তেগার উপর। সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত উল্লাসে ঝকমক করে উঠল তার চোখ আর মুখ। সে চেঁচিয়ে বলল–‘ওই সেই পলাতক ফরাসিরা! আটকাও মারো শেষ করে দাও।’
কিন্তু ততক্ষণে পলাতক ফরাসিরা আর ঘরের ভেতরে নেই, তরোয়াল খুলে দ্যার্তেগা পোর্থর্স ছুটে বেরিয়েছে, তাদের পায়ে পায়ে অ্যাথোস আর অ্যারামিস পিস্তল হাতে, রাজা উদ্ধার হলো না। এখন সবচেয়ে বড় দরকার আত্মরক্ষার। ছুট, ছুট ঘোড়া নিয়ে গ্রিমডেরা তৈরি আছে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে রিস্টন পেরিয়ে দূরে-বহুদুরে
একটা শুকনো নদী, তার উপরে পুল, দ্যার্তেগা ঘোড়া নিয়ে সেই নদীর খাদের ভেতর নামল, সঙ্গে অন্য সবাইও। পুলে থামের তলায় আত্মগোপন করল তারা, কয়েক মিনিটের ভেতরই একদল সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেল সেই পুলের উপর দিয়ে। ওরা পিছু নিয়েছে পলাতকদের। নদীর খাদ থেকে উঠে এসে আর রাজপথ ধরল না পলাতকেরা, মাঠ ভেঙে পাহাড় পেরিয়ে অনেক কষ্ট ভোগ করে তিন দিন পর এসে পৌঁছালো লন্ডনে।
৮. মাঠ পাহাড় পেরিয়ে
৮.
দ্যার্তেগারা সোজা মাঠ পাহাড় পেরিয়ে আসার জন্য দূরত্ব কিছুটা কমেছে। সন্দেহ নাই, কিন্তু তেমনি আবার বলে জঙ্গলে লুকিয়েও থাকতে হয়েছে অনেক সময়, ফলে মর্ডন্ট আর তার শত্রুরা প্রায় একই সাথে রাজধানীতে ঢুকল।
যে সৈন্যদল রাজাকে লন্ডন নিয়ে এসেছে, মর্ডন্ট তার অধিনায়ক। রাজাকে সোজা তার প্রাসাদের নিয়ে যাওয়া হলো। টাওয়ার বা কোনো কারাগারে নয়, একেবারে হোয়াইট হলে। কড়া পাহারায় সেখানেই তাকে রাখা হবে, যতক্ষণ না বিচার হচ্ছে এবং বিচার অনুযায়ী দণ্ড।
দণ্ড যে হবেই, তা ওয়াকিবহাল সবাই জানে, কারণ বিচার করবে পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট রাজার অনুরক্ত সদস্য ছিল বেশি, তাদের সব বিদায় করা হয়েছে ক্রমওয়েলর হুকুমে। এখন যারা আছেন, তারা রাজদ্রোহীও বটেই, তারা জনে জনে রাজার ব্যক্তিগত শত্রু।
বিচার প্রহসনের আয়োজন করতে থাকুক ক্রমওয়েলের আজ্ঞাবাহীরা। আমরা ততক্ষণে চার নিঃস্বার্থ ফরাসি বীরের কাজ কারবার দেখি।
.
লন্ডনে এসেই অ্যাথোসের পূর্ব পরিচিত এক হোটেলে গিয়ে উঠল। অতি সাধারণ হোটেল, দামও সস্তা, তবে খাবার দেয় ভালোই, সবচেয়ে বড় কথা। এখানে খরিদ্দারের রুচি অনুযায়ী খাবার মেলে।
খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা যখন হয়ে গেল, পরবর্তী কাজ হলো প্রত্যেকের জন্য এক প্রস্থ করে পোষাক তৈরি করানো, আগেই বেশভূষা। পাল্টানো দরকার, নইলে মর্ডন্টের চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে না।
সাধারণ পোষাকই বেছে নিল ওরা, এক একজনে এক এক রকম। সবই অসামরিক পোষাক, কেউ সাজল ব্যবসায়ী, কেউ চাষী, কেউ দালাল, কেউ মহাজন।
বিভিন্ন রকমের পোষাক পরে চার বন্ধু রাজার বিচার দেখার জন্য অবশেষে বেরুল। হোয়াইট হলের অনেকটা দূরে সুরক্ষিত আদালত ঘরে বিচার সভা বসেছে। ।
পার্লামেন্টের সদস্যরা যেখানে আসন গ্রহণ করেছেন, তাদের সামনে রাজাকে হাজির করা হয়েছে।
ক্রমওয়েলের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি মর্ডন্ট হাজির আছে। রাজাকে বসতে দেয়া হয়েছে। তিনি তাতে বসে হাতের ছড়ি দিয়ে পায়ের জুতোর উপর আঘাত করছেন।
একটা অভিযোগের ফিরিস্তি বলে গেল, কাগজপত্র দেখে আদালতের একজন কর্মচারী শোষণ, কুশাসন, ধর্মদ্রোহ, প্রজাপীড়ন এসব অভিযোগসহ প্রধান বিচার সভার সভাপতি বললেন–‘চার্লস স্টুয়াট, তোমার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ সম্বন্ধে তোমার কিছু বলার আছে?’
রাজা উত্তর দিলেন–‘আগে তোমরা বলো যে আমার বিচার করার ক্ষমতা তোমরা পেলে কোথায়, তার পরে আমি যা বলার তা বলব।’
সভাপতি উত্তর দিলেন—’সব অধিকারেরই উৎস হলো জনসাধারণ। যেজন সাধারণ তোমার বিচার করতে চাইছে।’
অকস্মাৎ একটা বাজ পড়ল যেন সভাঘরে। দর্শকদের বেঞ্চের উপরে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল একটা মামুলি পোশাক পড়া আধবয়সী লোক, আর চেঁচিয়ে উঠল–‘মিথ্যা কথা! ঘোর মিথ্যা কথা, ইংরেজ অধিকাংশই রাজভক্ত। প্রমাণ দেখতে চাও? পার্লামেন্টের অর্ধেকর বেশি সদস্য পার্লামেন্ট ত্যাগ করে গিয়েছেন এই বিচার প্রহসনের প্রতিবাদে।’
‘বন্দি কর, বন্দি কর। এরা সেই পলাতক–ফরাসিরা।’ চিৎকার করে উঠল মর্ডন্ট, প্রহরীরা ছুটে এলো দর্শকের দিকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ভিড় ঠেলে আসা সহজ নয়। তারা এসে পৌঁছার আগেই অ্যাথোস (ওই প্রতিবাদকারী অ্যাথোস ছাড়া কেউ নয়) এবং তার বন্ধুরা ছুটে বেরিয়ে পড়েছে বিচার কক্ষ থেকে।
বাইরে জনারণ্যে মিশে গিয়ে তারা তখনকার মতো নিরাপদ হলো সন্দেহ নেই, কিন্তু এভাবে আত্মসংযম হারালে আবার বিপদে পড়তে কতক্ষণ? দ্যার্তেগা বোঝাতে লাগল–‘রাজার জন্য কীভাবে কখন কী করা যায়, তার সম্পূর্ণ ভার কি তোমরা আমার উপর দিতে পারছ না? এভাবে আবেগে পরিচালিত হলে কাজ উদ্ধার তো হবেই না, উল্টো আমরাই বন্দি হয়ে পড়ব।’
সভার অধিবেশন বেশিক্ষণ চলল না, কিছুক্ষণ পরেই প্রহরী ঘেরা রাজাকে দেখা গেল বিচারালয়ের বাইরে–সেখানে কি ভিড়! রাজার অনুরাগীরা আত্মপ্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে না, রাজদ্রোহীদেরই প্রচণ্ড দাপট সেই ভিড়ের ভেতর। চারদিক থেকে তারা রুখে পড়েছে, উঁচু গলায় বাজে কথা বলছে, প্রহরীরা অতিকষ্টে রাস্তা করে নিয়ে চলেছে রাজাকে। একটা লোক সামনে এগিয়ে এসে রাজার মুখে থুথু দিল।
অ্যাথোস গর্জে উঠল। যেন তার বুকের ভেতর তরোয়াল বিধিয়ে দিয়েছে, তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি দ্যার্তেগা, পোর্থস টেনে নিয়ে গেল অ্যাথোসকে।
চোখের বাইরে যেতে দিচ্ছে না ওই লোকটাকে দ্যার্তেগা, হালকা হচ্ছে। ভিড়। আরও দুই তিনজনের সঙ্গে মিলে ওই জানোয়ারটা হেলে দুলে দুজনে চলছে নদীর দিকে। মেজাজ তার খুব ভালো। নিজের বাহাদুরীর তারিফ নিচ্ছে অন্য সবার কাছে। তার পিছনেই যে চারজন অনুসরণ করছে সে তার কিছুই জানে না।
নির্বিকার, উদাসীন, টেমস নদী বয়ে চলেছে এক রাজার পতন হলো, তার কিছুই এসে যাচ্ছে না। আবার একদিন যদি এই ক্রমওয়েলের পতন হয়, সেদিনও তার কিছুই যাবে আসবে না। সময়ের উপর যদিও বা মানুষ দাগ রেখে যেতে পারে কিন্তু জল প্রবাহের উপর কোনোভাবেই পারে না।
সঙ্গে আরও তিনটে নোক নিয়ে আনন্দে পায়চারী করছে ওই জানোয়ারটা যে রাজার মুখে থুথু ছিটিয়ে ছিল।
দ্যার্তেগার চারজন কাছে এসে দাঁড়াল। গ্রিমডের তিনজন একটু দূরে। হঠাৎ চারজন চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল।
অ্যারামিস ভোজালি বের করল।
‘না, ভদ্রলোকের জন্য ইস্পাতের আঘাত, এটা জানোয়ার, এর জন্য অন্য ব্যবস্থা।’ দ্যার্তেগা দুই হাত বাড়িয়ে ঘাড় ধরল লোকটার। সে আউ করে উঠল। প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল হাত ছাড়াবার। তার সঙ্গীরা দেখলেন এই আততায়ীরা সশস্ত্র হিংস্র, ভাবছে পালাবে কি না?
দ্যার্তেগা বলে উঠল, ‘পোর্থস, এক ঘুষিতে এই লোকটার মাথা নিশ্চয়ই গুড়ো করে দিতে পারো তুমি।’
পোর্থসের হাতটি উবু হয়ে উঠল, যম দণ্ডের মতো। একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়ল ওর ব্রহ্ম তালুর উপর। একখানা কাগজ যেন ছিঁড়ে গেলো ফাত করে। মাথাটা ছাতু হয়ে গিয়েছে একবারে, গলগল করে রক্ত বেরুলো। দ্যার্তেগা ছেড়ে দিতেই শরীরটা ধড়াস করে মাটিতে পড়ে গেল। ওর সঙ্গের লোক তিনটা ছুটে পালাল। তা যাক–যাকে শাস্তি দেয়ার দরকার ছিল। তাকে দেয়া হয়েছে।
অ্যাথোস এসে দ্যার্তেগা হাত ধরল। ‘তোমার কাছে রাজার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভার দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।’
.
রাজা একজন পাদ্রী চেয়েছেন। যিনি তাকে ধর্মোপদেশ দিতে পারবেন। আর্চ বিশপের উপর ভর দিয়েছেন পার্লামেন্ট। রাত দশটার সময় একজন ধর্ম যাজক রাজার কাছে যাবেন, বলে জানিয়েছেন আর্চ বিশপ।
প্রহরীদের দলপতির কাছে ঠিক রাত দশটার সময় হোয়াইট হলে এল একজন পাদ্রী, অভিজ্ঞান দেখাল আর্কবিশপের। দলপতি পাদ্রীকে সম্মান দেখিয়ে পৌঁছে দিল রাজার রুমে। বিশ্বস্ত সহকারী আর্চ বিশপের। পাদ্রী জ্যাকসন।
বিছানায় শুয়েছিলে রাজা, বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছিল তাকে প্যারী পাদ্রীর ঘরে ঢুকতেই প্যারী উঠে দাঁড়াল, রাজা উঠে বসলেন।
‘মহারাজ আমি গির্জার সান্ত্বনার বানী নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।’ রাজার কাছে কণ্ঠস্বরটি কি পরিচিত মনে হলো? তা না হলে তিনি চমকে উঠে পাদ্রীর মুখের দিকে চাইলেন কেন?
লম্বা কালো দাড়ি পাদ্রীর মুখে, এক মুহূর্তের জন্য সেই দাড়ি সরে গেল। রাজা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, ‘শিভালিয়ার দ্যা হারবেন?’
ঠিকমত দাড়ি লাগিয়ে অ্যারামিস বলল–‘না-পাদ্রী জ্যাকসন। আমরা এখনও আশা ত্যাগ করিনি মহারাজ, আপনার আশে পাশেই আমরা আছি। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব।’
করুন হাসলেন রাজা–‘আপনার এবং কাউনস্ট দ্য-লা ফেয়ার এর বন্ধুত্বের তুলনা হয় না। বন্ধুত্ব আর উদারতাই বলুন এ এক স্বর্গীয় বস্তু, আমি আপনাদের কেউ নই অথচ এই নিঃসম্পর্কীয় অপরিচিত, বিদেশী। ভাগ্যহীন রাজার জন্য বারবার আপনারা যেভাবে নিজেদের প্রাণকে বিপন্ন করছেন।’
‘আমরা আপনার স্ত্রী ও কন্যার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’ রাজা উত্তর দেয় অ্যারামিস ‘সে কথা যাক, কাল বিচারালয়ে ওরা কি আদেশ দেয়। তাই দেখে আমরা কাজ স্থির করব এবং কাল রাত্রে এভাবে এসে আপনাকে জানাব।’
‘প্রতিদিন একবার করে এভাবে জীবন বিপন্ন করা–একটা সত্যিকারের বিপদ ঘটে যেতে কতক্ষণ শিভালিয়ার?’ মৃদু কণ্ঠে রাজা প্রতিবাদ করেন।
কথা আজ আর বাড়াতে পারল না। প্রহরীর দলপতি এসে জানাল নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। রাজা নিচু হয়ে অ্যারামিসের হাতের ক্রুশ চুম্বন করলেন, অ্যারামিস মার্জিত ল্যাটিনে আশাবাণী উচ্চারণ করল। তারপর প্রহরীর সঙ্গে চলে গেল।
রাজা বিছানার পাশে নতজানু হয়ে বসলেন উপসনার জন্য। পার্লামেন্ট পরের দিন ঘোষণা করল–রাজা চালর্স এর প্রাণদণ্ড হবে প্রজাদ্রোহের অপরাধে এবং এই দণ্ড কার্যকর হবে ঠিক পরের দিন বেলা দশটাতে হোয়াইট হলে রাজার শয়ন কক্ষের বাইরে।
রাজা শোবার ঘরে ঠিক রাত দশটার সময় অ্যারামিস আবার দেখা করল। রাজার সঙ্গে। আজ শেষ রাত রাজার জীবনের, কাজেই বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি পেয়েছে সে। অ্যারমিস করল–‘এখনও হতাশ হবেন না মহারাজ।’
রাজা হেসে বললেন ‘আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এখনো আশা করার মতো অবশিষ্ট কিছু আছে কি? কাল বেলা দশটাতেই ঘাতকের কুঠার আমার শিরচ্ছেদ করবে।’
‘কিন্তু সে ঘাতক নিখোঁজ হয়েছে মহারাজ, কাল দশটার সময় তাকে কোথাও পাওয়া যাবে না,’ জানাল অ্যারামিস।
‘সেকি!’
‘বন্ধু দ্যার্তেগার অসাধ্য কিছু নেই, ঘাতককে ঘুষ দিয়ে সে বশ করেছে, আমরা তাকে পাঁচশো পাউন্ড দিয়েছি, তার নিজেরও রাজ হত্যায় বিতৃষ্ণা ছিল। তারপর এরকম একটা মওকা পেয়ে গেল, সে একভাবে মদ খাচ্ছে আমাদের হোটেলের রুমে বসে। এ ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আর বেরুবে না।’
রাজার প্রশ্ন ‘সে না বেরুক, ওরা কি আর ঘাতক পাবে না?’
‘ওই একমাত্র ঘাতক লন্ডন শহরে। আর এটা নিশ্চয়ই তো শখ করে কেউ আসবে না এই ঘৃণিত কাজ করার জন্যে, কাজেই অন্য শহর থেকে একজন ব্যবসাদার ঘাতক আনতে হবে ওদের। সেটা কালকে সম্ভব নয়।’
‘কালকে না হোক পরশু সম্ভব হতে পারে।’
‘তা পারে। তবে আমাদের কাজ একটা রাত্রি পেলেই হয়ে যাবে, আমরা আপনাকে কাল রাতে উদ্ধার করব।‘’
অবাক হয়ে যান রাজা, সমস্ত পরিকল্পনা তাকে খুলে বলে অ্যারামিস, ওরা বধ্যমঞ্চ বানিয়েছে ঠিক রাজার জানালার সামনে, যে ঠিকাদারের উপর এই মঞ্চ বানাবর ভার পড়েছে, সে লোকের অভাবে অসুবিধায় পড়েছিল, কাল কোনো মিস্ত্রি রাজী হয়নি রাজাকে হত্যা করার জন্য মঞ্চ বানাতে, শেষ মুহূর্তে খুব সস্তাতেই সে দুজন মিস্ত্রি পেয়েছে, সে দুজন মিস্ত্রি হলো অ্যাথোস আর পোর্থস।
রাজা চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, অ্যারামিস তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর বলে চলল তার পরিকল্পনা, ‘এক্ষুণি তারা মঞ্চ বানাতে শুরু করবে, কাঠের মাচাটা হয়ে গেলেই ওরা তার উপর থেকে একটা সুরঙ্গ খুড়বে আপনার প্রাসাদের দেয়ালে। ঠিক জানালার নিচে কাঠের আবরণের নিচে চাপা থাকবে সুরঙ্গের মুখ, আর সেই সুরঙ্গ দিয়ে অ্যাথোস এসে ঢুকবে আপনার এই রুমে। নিচের ঘরে। সে ঘর খালি আছে। অন্য কোনো লোক আপনার নাগালের মধ্যে থাকতে দেবে না বলে।’
‘এখন অ্যাথোস নিচে থেকে এই ঘরের মেঝে খুঁড়ে ফেলবে, তিন চার খানা টালি খুলতে পারলেই আপনি সেই গর্ত দিয়ে গলে নিচের ঘরে নামতে পারবেন, সেখান থেকে সুরঙ্গ পথে মঞ্চের ভেতর, সেখানে কোনো মিস্ত্রি বা মজুরের কাপড় পড়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন। একটি ছোট জাহাজ ভাড়া করা রয়েছে গ্রীণউইচে, সমুদ্রের ধারে, আপনি তাতে উঠলেই জাহাজ ফরাসি উপকূলের উদ্দেশ্যে ছুটে চলবে।’
এই রোমাঞ্চকর পরিকল্পনা রাজা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন।
এরা মানুষ, না মহামানুষ এই ফরাসিরা।
.
পরের দিন, বেলা দশটার আগেই বধ্যমঞ্চ তৈরি করা হয়ে গিয়েছে, যাতে সমবেত জনগন সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে পায়, তাই মঞ্চটি দোতালা করে তৈরি করা হয়েছে, হত্যা কাণ্ডটি ঘটবে দোতালায়, রাজাকে কোনো কষ্ট করতে হবে না, জানালা পথ দিয়ে সোজা একবারে মঞ্চে উপস্থিত হতে পারবেন।
মঞ্চের নিচে মোটা কালো কাপড়ে ঢাকা। বাঁশ, খুটির কদর্য কাঠামোটা লোকের চোখে যাতে বিশ্রী না দেখায় সেজন্য এরই আড়ালে অ্যাথোস সুরঙ্গ খুঁড়ছে, রাজার ঘরের ঠিক নিচে যখন অ্যাথোস পৌঁছুল একটি খাটো মই নিয়ে, তখন বেলা আন্দাজ নয়টা। সব কাজ প্রায় শেষ, এখন রাজার ঘরের মেঝে থেকে কয়েকটা টালি খুলে নেয়া শুধু বাকি।
এখনও তার সময় হয়নি, আজ যে প্রাণদণ্ড হতে পারে না, যে সেটা আজ মুলতবি রইল-এই আদেশটি প্রচারিত হোক আগে। এখনও যে আদেশ জারি হয়নি, কারণ ঘাতক যে নিরুদ্দেশ, কর্মকর্তারা তা এখনও জানেন না, জানবেন, যখন বেলা দশটায় তার খোঁজ পড়বে তখন।
বাইরে লোকে লোকারণ্য। এখন অসংখ্য লোক রান্নার ঘরে। পাদ্রী এবং প্রহরী অ্যারামিস রাজাকে ফিস্ ফিস্ করে সাহস দিচ্ছে।
‘অ্যাথোস ঠিক আপনার পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, এখানকার ভিড় একটু হালকা হলে আমি এখান থেকে সংকেত দেব, আর যেই টালি ফাঁক করবে, তারপর আরকি! গ্রীন উইচের মুক্তি।’
.
অধীর আগ্রহে অ্যাথোস প্রতীক্ষা করছে, উপরের ঘর খালি হলেই সংকেত দেবে অ্যারামিস, রুমের মেঝেতে পর পর তিনবার পায়ের আওয়াজ করে, সেই সংকেত পাওয়া মাত্র টালি আলগা করতে শুরু করবে অ্যাথোস। কাজ আর কতক্ষণ? তারপর ধৈর্য্য ধরে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করা। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসলেই রাজা নেমে যাবেন সুরঙ্গ পথ দিয়ে মজুরের ছদ্মবেশে বধ্যমঞ্চ থেকে বেরিয়ে।
কিন্তু কই অ্যারামিস তো সংকেত দেয় না। অথচ মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না উপরের ঘরে, মানুষের পায়ের শব্দও পাওয়া যায় না, ঘরটা নিস্তব্দ, অথচ কেন নীরব অ্যারামিস?
ওদিক একটা গমগম আওয়াজ উঠছে প্রাসাদের বাইরে যেখানে একত্র হয়েছে লক্ষ লক্ষ লোক, তারা নিঃশব্দ নিস্পন্দ থাকলেও সেখানে ওই রকম একটা শব্দ উঠবেই, কিন্তু অ্যাথোস বুঝতে পারছে না–ওখানে এখনও লক্ষ লোক থাকবে কেন? অনেকক্ষণ হলো দশটা বেজে গিয়েছে, এতক্ষণে নিঃশব্দ ঘোষণা হয়ে গেছে যে, ঘাতকের অনুপস্থিতির জন্য রাজার দণ্ড আজকের মতো মুলতবি রইল। তবে লোকগুলো ওখানে কি করছে? বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছে অ্যাথোসের। সে কোনো মতেই আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না, সুরঙ্গ পথ বেয়ে বেরিয়ে এল বধ্য মঞ্চের নিচের তলায়, মোটা কাপড়ের পর্দা দিয়ে যে জায়গাটা ঘেরা আছে, সেই পর্দার এক কোনো ফাঁক করে সে যে দৃশ্য দেখতে পেল, তাতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, মানুষ, মানুষ, আরো মানুষ, কাতারে কাতারে আছে চোখ বিস্ফোরিত করে, স্থানটি হলো ঠিক মাথার উপরের স্থানটি, অর্থাৎ যেখানে রাজার শিরোচ্ছেদ হওয়ার কথা। সেখানটিতে।
তবে কি সেই বিভীষিকার দৃশ্য ঘটতে যাচ্ছে যা চাচ্ছে এই রাজদ্রোহী প্রজারা। অ্যাথোস কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তার চোখের আড়ালে রাজবলির শেষ দৃশ্য কি এক্ষুণি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? তবে কি ঘাতকটা গুপ্ত স্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে কোনো রকমে? অসম্ভব, তার পাহারায় রয়েছে গ্রিমড, তার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসবে ওই ঘাতক, এটা অসম্ভব, তবে কি অন্য ঘাতক পেয়েছে ওরা? নিশ্চয়ই তাই, কিন্তু লন্ডনে তো আর ঘাতক নেই।
হঠাৎ একটা অতি মৃদুস্বর উপরের কাঠের পাটাতন ভেদ করে এসে অ্যাথোসের কানে প্রবেশ করল, শিউরে উঠল অ্যাথোসের সমস্ত শরীর, এ স্বর চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। এ কণ্ঠস্বর রাজার। রাজা শুয়ে কথা বলছেন। নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে ঘাততের কুঠার তার মাথার উপরে উদ্যত রয়েছে, মুখোশ পড়ে এসেছে ঘাতক। শুধু একটা কালো দড়ির ডগা দেখা যাচ্ছে মুখোশের নীচ থেকে। রাজা শেষ শোয়ার আগে তাকে বলেছেন ‘হঠাৎ আমাকে আঘাত করো না, আমি যখন বলব ‘মনে রেখো তখনই আঘাত করবে। কুঠারের এক আঘাতেই শেষ করতে পারবে তো?’
ঘাতক শুকনো গলায় উত্তর দিল ‘চেষ্টা করব।’
এখন শুয়ে শুয়ে রাজা অতি মৃদুস্বরে বলছেন–‘কাউন্ট-দ্যা-লা ফেয়ার আপনি কি নিচে আছেন?’
অ্যাথোসের কানে এল একটা উত্তর ‘আছি।’ সে উত্তর যে অ্যাথোসের নিজেরই তা তার বিশ্বাস হতে চায় না যেন, এ স্বর তার স্বর নয়। এ উত্তর তার গলা থেকে বেরুল কখন? সে তো টের পায়নি।
উপর থেকে আবার শোনা গেল, ‘যা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি আপনি করেছেন, আপনি এবং আপনার তিন বন্ধু। ঈশ্বর আপানদের মঙ্গল করবেন। আমার স্ত্রী কন্যাকে খবর দেবেন, সাহসে বুক। বাধতে বলবেন। এ অন্যায়ের প্রতিকার একদিন হবেই, আমার বড় ছেলে হল্যান্ডে আছে, তার জন্য দশ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা লুকনো রইল। নিউক্যাসল দুর্গের মাটির নিচের যে ঘর আপনাকে আমি দেখিয়েছিলাম, সেই কক্ষে, ঈশান কোনো ভিত্তির নিচে রাখা আছে, আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না এই স্বর্ণ মুদ্রার কথা।’
দৃঢ়স্বরে বলে অ্যাথোস ‘এ অর্থ যুবরাজ পাবেন।’
এবার রাজার গলার স্বর সুস্পষ্ট হলো। উঁচু হলো। তিনি ভরাট গলায় বললেন, ‘মনে রেখো।’
রাজদ্রোহী লক্ষ্য দর্শকের মনে হলো এটা তাদের মাথার উপর মৃত্যুপথ যাত্রী রাজার শেষ অভিশাপ, তারা আঁতকে উঠল, একমাত্র জানল–এ সতর্কবানী তাকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত হয়েছে, যাতে প্রিন্স অব ওয়েলেস এর জন্য রাখা শেষ মিলিয়টির কথা সে ভুলে না যায়। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আঘাতে মাথার উপরের কাঠের পাটাতন দুলে উঠল, আর কী যেন এক ফোঁটা গরম জিনিস এসে পড়ল অ্যাথোসের কপালে, সে কেঁপে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
ফোঁটা পরে স্রোত হয়ে ঝরতে লাগল অ্যাথোসের পায়ের কাছটিতে। তাজা গরম টকটকে লাল রক্ত, অ্যাথোস পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ে সেই রক্ত ভালো করে মাখল রুমালে তার রাজার শেষ চিহ্ন।
কীভাবে সেই নরক থেকে বেরিয়ে কোন পথে অ্যাথোস হোটেলে এসে পৌঁছল তা তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে বলতে পারত না।
মাস্কেটনের সঙ্গে প্রথমেই দেখা, সে তখন পাহারা দিচ্ছে বন্দি ঘাতককে। না, লোকটি পালায়নি। আজকের কাজটি যার হাত দিয়েই হয়ে থাকুক, সে যেই হোক না কেন, লন্ডনের সরকারী ঘাতক যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘লোকটাকে ছেড়ে যাও মাস্কেটন,’ অ্যাথোস বলল।
অ্যারামিস এল, পোর্থস এল, অনেক পরে এল দ্যার্তেগা, এসেই বন্ধুদের বলল, ‘কে জানে এই হত্যাকারী? সেই মর্ডন্ট।’
‘মর্ডন্ট-আর একবার নতুন করে সকলের শিউরে উঠার পালা, এই নররাক্ষস, এই পিশাচ কি তাদের সকলকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এসেছে এই পৃথিবীতে? উইন্টার গেলেন, রাজা গেলেন, এবার কি এই চার বন্ধুর পালা?’
কিন্তু দ্যার্তেগা ভাবার সময় দিল না। সবাইকে তাড়া দিয়ে নিয়ে গেল শহরের বাইরে এক নির্জন স্থানে, সেখনে একটা ছোট বাড়িতে মর্ডন্ট ঢুকেছে, দ্যার্তেগা জানে, কারণ বধ্যভুমি থেকে মর্ডন্টকে অনুসরণ করে সে এই বাড়ি পর্যন্ত এসেছিল। মর্ডন্ট বাড়ির ভিতর ঢুকার পরে বাড়ির পিছনে গ্রিমডকে এবং বাড়ির বাইরে অন্য এক অনুগত ব্যক্তিকে পাহারায় রেখে সে গিয়েছিল বন্ধুদের ডাকতে। এই অনুগত লোকটি হলো প্যারীর ভাই, যাকে ওরা শুশ্রষা করে বাঁচিয়ে তুলেছিল সেদিন।
তখন দুজন অনেক কথা বলছে ঘরের ভেতর। একজন মর্ডন্ট অন্যজন স্বয়ং ক্রমওয়েল। ক্রমওয়েলেরই এই বাড়ি। এরকম বাড়ি অনেকগুলি আছে। তার লন্ডন শহরে, এক এক স্থানে এক একটি। পরপর দুইদিন এক বাড়িতে থাকেন না তিনি। অনেক সময় সকালে এক বাড়িতে বিকালে অন্য বাড়িতে।
ক্রমওয়েল বলছেন—’আমি জানি না কে এসে ঘাতকের কাজটি করে দিয়ে গেল, জানতেও চাই না, এক কাজের জন্য পুরস্কার হোক, সাজা হোক যা পাওয়ার সে তার ঈশ্বরের কাছ থেকে পাবে। আমার কিছু বলার নেই তাকে।’
‘কিন্তু রাজাকে হত্যা করার দরকার ছিল। আপনার কাজই তো সে করেছে। ঠিক সময়ে সে যদি হাজির না হত।’
আবেগের সঙ্গে বলে উঠে ক্রমওয়েল ‘বড়ই ভালোই হত, মর্ডন্ট।’
‘ভালো হত? ও যদি হাজির না হত, হত্যা কাণ্ডটা আজ হতে পারত না। এবং রাত্রে চার্লস স্টুয়াট পালাতে পারত।
‘পালাতে পারত! মর্ডন্ট যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।’
‘নিশ্চয়ই পারত পালাতে, হোয়াইট হলের ভেতর চারজন ফরাসি সুরঙ্গ কেটেছে মিস্ত্রির ছদ্মবেশে। আজ রাতে চার্লস স্টুয়াট ওই পথে পালাত। আজ তিন দিন থেকে গ্রীন উইচ সমুদ্র কুলে চালর্স এর জন্য ছোট একটা জাহাজ ভাড়া করে রাখা হয়েছে। সেই জাহাজে ওই ফরাসিরা আজ রাতেই চার্লসকে নিয়ে পালাত। আমি মুক্তি পেতাম রাজহত্যার অপবাদ থেকে।’
মর্ডন্ট তিক্তস্বরে বলে ওঠে–‘অপবাদ থেকে মুক্তি হয়তো পেতেন, কিন্তু অত বড় শত্রু জীবিত অবস্থায় যদি ফ্রান্স গিয়ে উঠতে পারত।’
‘তা পারত না।’ শান্তস্বরে বলেন ক্রমওয়েল–‘কারণ যে জাহাজে তারা যাবে, তার খোলের ভেতর পাঁচ পিপে বারুদ বোঝাই করা আছে। ক্যাপ্টেন আমার হাতের লোক। গভীর রাতে বারুদে জ্বলন্ত পলতে সংযোগ করে দিয়ে সে তার নাবিকদের নিয়ে নৌকায় চড়ে পালাত। রাজার মৃত্যুর জন্য পৃথিবীর লোক ক্রমওয়েলকে আর দায়ী করত না। দায়ী করত তার ভাগ্যকে।’
মর্ডন্ট, নিজেকে যে পৃথিবীর সেরা ধূর্ত বলে মেন করে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল তার মালিকের এই চরম ধূর্ততার পরিচয় পেয়ে, তাকে বিব্রত ভাব থেকে মুক্ত করলেন ক্রমওয়েলই–‘আমার কাছে কিছু তোমার বলার আছে?’
মর্ডন্ট তার কথা লুফে নিল—’হ্যাঁ মালিক, আমার একটা প্রার্থনা আছে, আমাদের হাতে একসময় দুজন ফরাসি বন্দি হয়েছিল। মালিক তখন সেই দুবন্দিকে আমাকে দিয়েছিলেন। আমি তখন তাদের ধরতে পারিনি, কারণ অন্য দুই ফরাসির সাহায্যে পালাতে পেরেছিল তারা। আজ আমার প্রার্থনা, মালিককে যদি আমার একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে খুশি করতে পারে তা হলে ওই চারজন ফরাসিকেই আমার হাতে দিন।’
‘নিতে পার এবং ওই যে জাহাজখানার কথা বলছিলাম, সেখানেও তুমি দুই একদিনের জন্য নিজের কাজে ব্যবহার করতে পার।’
এই বলে ক্রমওয়েল উঠলেন, ‘তোমার সঙ্গে বোধহয় দেহরক্ষী নেই?’ জিজ্ঞেস করলেন মর্ডন্টকে।
‘জ্বি না।’
‘তা হলে তুমি আমার সঙ্গেই চলল।’
‘না মালিক, এখানে আমি একটু সময় থাকব। একটু নিরিবিলি জায়গা দরকার আমার চিন্তা করার জন্য।’
ক্রমওয়েল রুমের দেয়ালের একটি বিশেষ স্থানে হাত দিয়ে চাপ দিলেন একটু। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ার সরে গিয়ে সেখানে বেরিয়ে এল একটি গুপ্ত দরজা। তারই ভেতর দিয়ে নিচে সুরঙ্গ পথে অদৃশ্য হলেন তিনি।
ঠিক তারপরেই রুমের জানালা দিয়ে উঁকি দিল দ্যার্তেগা। মর্ডন্ট গভীর চিন্তায় মগ্ন, কীভাবে নির্যাতর করে মার হত্যাকারী চারজন ফরাসিকে মৃত্যুকে মৃত্যুদ্বারে পাঠাবে তারই উপায় নিয়ে সে ভাবছে। সে ধ্যান তার যখন ভাঙল তখন একের পর একজন ফরাসি লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে।
মর্ডন্ট চমকে লাফিয়ে উঠল, তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে, যাদের বারুদে উড়িয়ে দেবার জন্য বুদ্ধি ঠিক করে এখুনি কাজে নামবে বলে ভাবছিল খারাপ ভাগ্যের একটি মাত্র আঙ্গুলের ইশারায় তাদের কবলে পড়ে গেল মর্ডন্ট। এরা যে কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে এভাবে ঘিরে ধরেনি, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে নেই।
কিন্তু মর্ডন্ট অস্থির হলো না। ঠাণ্ডা মাথায় তখনও চিন্তা করার শক্তি তার আছে। এই অপ্রত্যাশিত সংকট থেকে সে কিভবে মুক্তি পেতে পারে।
দ্যার্তেগাই প্রথম কথা বলল–‘তাহলে আবার দেখা হলো মিস্টার মর্ডন্ট।’
‘এই দেখাই হয়তো শেষ দেখা। ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে মর্ডন্ট বলে। কারণ এ সাক্ষাৎকার থেকে জীবিত বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ যে আমার হবে না তা আমি বুঝতে পারছি। আমার অভাগিনী মাকে যেভাবে সেভাবেই আমাকে আজ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার মতলব তোমাদের।’
উত্তর দিল দ্যার্তেগা—’রাজার হত্যাকারী নরাধমকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার অধিকার যে কোনো সৎ লোকেরই আছে। কিন্তু আমরা তোমাকে হত্যা করব না। তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি দ্বন্দ্ব যুদ্ধে বীরের মৃত্যুবরণ করার। আমাদের চার বন্ধুদের মধ্যে যার সঙ্গে ইচ্ছে তুমি যুদ্ধ করতে পার।’
আমার আবার ইচ্ছে—’অনিচ্ছা কী? যে কোনো একজন লড়তে পার আমার সঙ্গে, কিন্তু যুদ্ধে যদি আমি জিতি, তা হলে আমি মুক্তি পাব তো? না আবার দ্বিতীয় একজনের সঙ্গে লড়তে হবে নতুন করে?’
‘না, তা হবে না। একজনের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে পারলেই তুমি মুক্তি পাবে।’
এরপর দ্যার্তেগার সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হলো মর্ডন্টের। সে শুধু আত্মরক্ষা করে যাচ্ছে, আর ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে, সরতে সরতে সেই বিশেষ স্থানটিতে তার পৌঁছনোর মতলব যেখান থেকে গুপ্ত দরজা পথে একটু আগেই ক্রমওয়েল ভূগর্ভের সুরঙ্গে নেমে গিয়েছেন।
দ্যার্তেগা সে গুপ্ত দরজার কথা জানে না। কাজেই মর্ডন্টের ক্রমাগত স্থান পরিবর্তনের উপর কোনো গুরুত্ব সে দিচ্ছে না।
মর্ডন্টের উদ্দেশ্য কিন্তু হাসিল হতে বসেছে। দ্যাগের আক্রমণ সহ্য করবার শক্তি তার প্রায় শেষ। ঠিক এমন সময়ে সে গিয়ে সেই বিশেষ জায়গায় পৌঁছাল। দ্যার্তেগা তাকে দেয়ালের সঙ্গে গেঁথে ফেলার জন্য তরোয়াল হাকিয়েছে। এমন সময়ে মর্ডন্টের দেহের চাপে গুপ্ত দরজা খুলে গেল এবং চোখের পলকে মর্ডন্ট অদৃশ্য হয়ে গেল।
দ্যার্তেগা ছুটে আসার আগেই গোপন দরজা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমনভাবে মিলিয়ে গেছে যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার অবস্থানটা এরা বের করতে পারল না। ওদিকে মর্ডন্ট হাসছে। দেয়ালের পিছনে হাসির উচ্চস্বর ক্রমশ কমতে কমতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল।
চার বন্ধু সব দেয়ালে আঘাত করতে লাগল, তবুও গুপ্ত দরজা খুঁজে পেল না, কিন্তু না, এখন সময় নষ্ট করা বোকার কাজ। তাদের জন্য গ্রীন উইচ বন্দরে জাহাজ অপেক্ষা করছে, এখনও হয়তো পালানো যেতে পারে। দেরি করলে আবার কতই না বিপদ এসে হাজির হতে পারে। এখানে মর্ডন্ট সর্বশক্তিমান।
ওরা ছুটল হোটেলে। এখনই গ্রীন উইচ রওনা হওয়া চাই ভাড়া টাড়া মিটিয়ে। গ্রীন উইচ পর্যন্ত ঘোড়াতেই যাবে, সঙ্গে প্যারীর ভাই যাচ্ছে। সে ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসবে। তারপর সে আর তার ভাই প্যারী ঘোড়াগুলো বেচে টাকাটা ভাগ করে নেবে।
.
লাইনিং বিদ্যুৎ জাহাজের নাম। ক্যাপ্টেন রিচার্ডস। অ্যাথোসের কথা হয়েছিল এই রিচার্ডস এর সঙ্গেই।
কিন্তু রিচার্ডস তখন জাহাজে নেই। অ্যাথোস যখন তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সমুদ্রকূলে পৌঁছল তখন। অসুস্থ হয়ে সে নিজের বাড়ি চলে গিয়েছে। তার বদলে যে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে, তাকে রাতের অন্ধকারে চিনতে পারল অ্যাথোসেরা, এই সেই গ্ৰসলো। তাকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে সৈন্যদের দায়িত্বশীল পদ থেকে, কর্তব্যে অবহেলার জন্য, সে ভার পেয়েছে আপাতত রিচার্ডস এর জায়গায় জাহাজ চালাবার জন্য। যদি এ কাজটি ভালয় ভালয় করে দিতে পারে, তাহলে আবার পুরনো পদে ফিরে যেতে পারবে, এমনি একটা ক্ষীণ আশ্বাস সে পেয়েছে।
অ্যাথোসদের প্রথমে রিচার্ডস নেই দেখে সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু তখন তাদের সঙ্গীন অবস্থা, বেশি সতর্ক হওয়ার সুযোগ নাই, জাহাজ রয়েছে, জাহারে ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এখনই জাহাজ নিয়ে রওনা হতে প্রস্তুত। এটাই কি তাদের পক্ষে বেশি নয়?
তর্ক না করে চার বন্ধু আর তিন চাকর জাহাজে বসল। প্যারীর ভাই ঘোড়াগুলোকে লন্ডনের পথে ফিরিয়ে নিয়ে চলল। তখুনি জাহাজ ছেড়ে দিল।
রাত গভীর। অ্যাথোসদের উপরের ডেক সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে তারা গভীর ঘুমে অচেতন। নিচের তলায় গ্রিমড, ম্যাস্কেটন আর ব্লেইগিয়স ঘুমের তোড়জোড় করছে। কিন্তু অসুবিধা হয়েছে একটা। বিলাসী পোর্থসের মতোই বিলাসী চাকর মাস্কেটন। একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার দীর্ঘদিন ধরে, রাতে ঘুমের আগে এক গ্লাস সুস্বাদু মদ খেতে না পারলে ঘুম আসে না। তাড়াতাড়ি লন্ডন থেকে আসার সময় মদ সে সঙ্গে করে আনতে আছে। গ্রিমড বলল।
গ্রিমড সেরকমই শুনেছে, জাহাজে উঠেই দ্যার্তেগা একবার উপর নীচ সব পরীক্ষা করে দেখেছিল। খোলর ভেতর পাঁচটা পিপাও দেখেছিল। জিজ্ঞাসা করাতে পিপেগুলোতে পোর্ট মদ আছে বলে জানিয়েছিল ছদ্মবেশী গ্রসলো।
এই খবরটাই মাস্কেটনকে জানিয়ে দিল গ্রিমড, আহা এক গ্লাস মদের অভাবে ঘুম আসছে না বন্ধুর? যাক না, নিয়ে আসুক গিয়ে। সত্যিই মাস্কেটন পোর্ট আনতে গেল, এক গ্লাস নয়, এক মগ আনবে। একা সে পেটি খাবে না। সে স্বার্থপর নয়। সে এক গ্লাস গ্রিমডকে দেবে, ব্রেইসিয়মকেও দেবে এক গ্লাস।
মগ ভর্তি করে খানিক পরেই সে ছুটে এল। উত্তেজনায় তার চোখ দুটো বেরিয়ে যেতে চাইছে। এটা কি জাতীয় পোর্ট হে গ্রিমড? গ্রিমডের সামনে মগ রেখে সে জিজ্ঞেস করল।
গ্রিমড অবাক হয়ে দেখল, তরল সোনার রং এর বদলে কালো এক রকম গুড়ো পদার্থে মগ ভর্তি রয়েছে। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে সে লাফিয়ে উঠল-এতো বারুদ! সব কয়টা পিপেই এই দিয়ে ভর্তি নাকি?
‘সব কয়টাই।’
গ্রিমড মগ হাতে নিয়ে ছুটল কর্তাদের কাছে। জানাল দ্যার্তেগাকে। দ্যার্তেগা নিজের চোখে একবার পরীক্ষা করে এলো পিপেগুলো। তারপর বন্ধুদের জানিয়ে বলল—’এই মুহূর্তে জাহাজ ছাড়তে হবে। মর্ডন্ট বা ক্রমওয়েল যেই হোক আমাদেরকে জাহাজ সুদ্ধ উড়িয়ে দেবার মতলব করছে।’
তারা নৌকা নামাতে গেল চুপি চুপি। যাতে নাবিক বা ক্যাপ্টেন টের না পায়। এদিকে নিজেদের ব্যবহার করার জন্য গ্রসরো নৌকা জলে নামিয়ে রেখেছে। জানা নেই, কতক্ষণ বা কয়দিন নৌকায় থাকতে হবে। সেই জন্য। কিছু খাঁচার এবং কয়েক বোতল পানীয়ও সে সাবধানে নৌকায় গুছিয়ে রেখেছে।
মর্ডন্ট ঠিক রাত বারোটার সময় জাহাজে আগুন দেয়ার কথা। সে ক্যাপ্টেনের কেবিনে লুকিয়ে আছে। সে এবং এসলো নিজের বিছানায় নাবিকদের জানায়নি নৌকা নামাবার আসল উদ্দেশ্য। কড়া নিষেধ আছে মর্ডন্টের।
জলে নৌকা ভাসছে। জাহাজের সঙ্গে রশি দিয়ে বাধা, চাকরদের নিয়ে চার বন্ধু সাবধানে উঠে বসল নৌকায়। তারপর রশি কেটে দিয়ে জাহাজ থেকে অনেক দূরে চলে গেল, নৌকা বেয়ে বেয়ে। মর্ডন্ট ঠিক বারোটায় গ্রসলোকে বলল–‘আমি বারুদের পিপের গায়ে পলতে বেধে রেখে এসেছি, দ্বিতীয় মুখ এই সেই পলতের। এখানে আমি এখন আগুন লাগিয়ে দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পলতে জ্বলতে জ্বলতে পিপের গায়ে পৌঁছাবে। আমি আসছি। নাবিকদের এর মধ্যে তুমি নৌকায় তোলা। ফরাসিগুলোকে একঘরে তালা বন্ধ রেখে আসছি। যাতে কেউ জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে।’
‘চটপট নৌকায় উঠে পড়ো’–গ্ৰসলো নাবিকদের আদেশ দিলেন। আশ্চর্য। নাকিবেরা রশি ধরে টানতেই রশি সড়সড় করে উপরে উঠে এল।
‘নৌকা কোথায় রশির মাথায়?’
‘নৌকা তো নেই, ক্যাপ্টেন।’
নৌকা নেই? মাথার চুল সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল গ্রসলোর। পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল সে। নৌকা নেই, নিশ্চয়ই নৌকা চুরি করে পালিয়েছে ফরাসিরা। সে মর্ডন্টের কাছে পাগলের মতো ছুটল। সে যাতে পলতের মুখে আগুন না দেয়, বা দিয়ে থাকলেও এক্ষুণি নিভিয়ে ফেলে। মর্ডন্টের সাথে মাথা ঠোকাঠুকি লাগল দুপা না যেতেই। জ্বলন্ত একটা মশাল তার হাতে। এই মশাল দিয়ে সে পাঁচ মিনিট আগে পলতের মুখে আগুন জ্বালিয়েছে। তারপর ফরাসিদের ঘরের বাইরে একটা তালা ঝুলিয়ে–
ভূতে ধরা মূর্তি গ্রসলোর–‘নৌকা নেই, আগুন নেবাও।’
‘নৌকা নেই’–আর্তনাদ করে উঠল মর্ডন্ট।
পাল্টা আর্তনাদ গ্রসলোর–‘না, এক্ষুণি আগুন নেবাও।’
‘নেভানোর এখন আর সময় নেই, আগুন এতক্ষণে পিপে ছুঁয়েছে,’-এই বলে হাতের মশাল ফেলে দিয়ে, মর্ডন্ট সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিল। আর
অপার্থিব আওয়াজে, তারপরই আগুনের হলকা আকাশ ভেদ করে। গ্ৰসলো আর তার নাবিকেরা জলে ঝাঁপ দেবারও সময় পেল না।
সেই ভয়ানক দৃশ্যের দিকে তাকিযে সবই ভুলে গেল নৌকায় বসা পলাতকরা হত্যাকারীরা নিজেদের ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু এ যে বড় মর্মান্তিক মৃত্যু। ওরা ঈশ্বরকে স্মরণ করারও সময় পেল না।
কিন্তু বেশিক্ষণ ওদের চিন্তা করবে—দ্যার্তেগারাও তেমন নিরাপদ নয়। ওদের জীবন শেষ হয়েছে আগুনে। এদেরও যে কোনো মুহূর্তে জীবন্ত ডুবে মৃত্যু হতে পারে। দিকচিহ্নহীন অন্ধকার সমুদ্র। জাহাজ ডুবির ঢেউ-এর আঘাতে উথাল পাথাল ছোট নৌকা। তাতে আশ্রয় নিয়ে এই সাতটি মানুষ আর কতখানি নিশ্চিন্ত হতে পারে। নৌকা চলে যায়। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার সেই সমুদ্রের বুক চিরে ‘বাচাও বাঁচাও। কে ডাকে? এ নিশ্চয়ই সেই মর্ডন্ট। কণ্ঠস্বর ভুল হওয়ার কথা নয়।’
‘ও তাহলে মরেনি’–বলে দ্যার্তেগা। দ্বিগুণ জোরে দাঁড় টানে গ্রিমড।
‘কাউন্ট দ্যা লা ফেয়ার। উদার, মহানুভব কাউন্ট। আমায় বাঁচান।’ আকুল আহ্বান ভেসে আসে আবার। বিশেষ করে অ্যাথোসকে সম্বোধন করেই বার বার আবেদন জানায় ধূর্ত। অ্যাথোসের হৃদয় যে কতখানি কোমল তার জানতে বাকি নেই।
সত্যিই অ্যাথোসের মনে দাগ কাটে এই আর্ত আবেদন, স্পষ্টই দেখা যায় অ্যাথোস চঞ্চল হয়ে উঠছে।
মর্ডন্ট আবারও চিৎকার করে উঠে আমাকে কি সত্যি মারতে চাচ্ছেন কাউন্ট। ভেবে দেখুন, বয়সে কত তরুণ আমি। আপনার যদি পুত্র থাকে, তবে তার বয়স হয়ত আমার মতো হবে। মনে করুণ, আপনার সেই পুত্রই জীবন ভিক্ষা চাইছে আপনার কাছে।
আর সহ্য করতে পারে না দয়ালু অ্যাথোস। চিৎকার করে ডেকে বলে ‘তুমি একটু চেষ্টা করে এদিকে ভেসে আস, আমরা তোমায় নৌকায় তুলে নেব।’
‘অ্যাথোস বলে কী?’ এক সঙ্গে তিন বন্ধু চমকে উঠল।
অ্যাথোস অনুরোধ করে বলে, একটি বালক মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে তোমাদের কাছে আশ্রয় চাইছে, কি বলে তোমরা তাকে ফিরিয়ে দেবে?
তীক্ষ্ণ স্বরে দ্যার্তেগা বলে–‘বালক? এই বালক তোমার চোখের সামনে গুলি করে লর্ড উইন্টারকে মেরেছে। এই বালকই মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করে রাজহত্যা পর্যন্ত করেছে। এরই মধ্যে তা ভুলে গেছ তুমি?’
পোর্থস তরোয়াল খুলে উঁচু করে তুলে ধরে—’সে এসে যদি নৌকা স্পর্শ করে, তার হাত আমি কেটে ফেলব।’
কিন্তু মর্ডন্ট যখন সত্যসত্যই এসে নৌকা ধরল তখন তরোয়াল হাকাতে পারল না পোর্থস। তাকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল অ্যাথোস—’এই যে আমার হাত ধর তুমি। তারপর আমার কাঁধ ধরে নৌকায় উঠে পড়।’
একটু ঝুঁকে পড়ে নৌকা থেকে নিজের কাধ বড়িয়ে দিল অ্যাথোস। মর্ডন্ট এসে জাপটে ধরল সেই কাধ। কেমন করে অ্যাথোসকে বাধা দেবে তা পোর্থস বা অন্য কেউ ভেবে পেল না।
কিন্তু হঠাৎ একটা পিশাচের হাসিতে সমুদ্র আকাশ শিউরে উঠল। সে হাসি মর্ডন্টের–‘মাগো মা। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার চার শত্রুকেই শেষ করে শাস্তি দেব তোমার আত্মাকে। তা আর হলো না। তবু একজনকে শেষ করছি। নাও তাকে। চারজনের মধ্যে যে ছিল সেরা শত্রু তোমার। তাকেই উৎসর্গ করছি তোমার কাছে।’
নৌকার কিনারে ঝুঁকে পড়েছিল অ্যাথোস। প্রবল শক্তিতে তাকে জলে ফেলে দিল মর্ডন্ট। অ্যাথোস এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। ছিল না অন্য কেউ, চোখের সামনে সমুদ্রজলে অ্যাথোস মিলিয়ে গেল। তারা কেউ কিছুই করতে পারল না।
অ্যাথোস ডুবেছে, মর্ডন্ট ডুবেছে, জলে ঢেউ উঠেছিল, ঢেউ থেমে গিয়ে বুদ্বুদ উঠেছিল, এখন সব শান্ত। কালো জলের দিকে ছয়জোড়া চোখ পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। তারা কেউ ভাবতে পারেনি, অ্যাথোসকে এভাবে ছেড়ে যেতে হবে।
প্রায় দুই মিনিট। তারপর হঠাৎ আবার জলে বুদ্বুদ দেখা গেল, ছোট একটা ঢেউ উঠল, তারপর জলের উপর ভেসে উঠল একটা মাথা। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল ছয়টা কণ্ঠ—’ছয়জোড়া হাত ধরাধরি করে নৌকায় তুলে ফেলল অ্যাথোসকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নৌকার পাশে ভেসে উঠল মর্ডন্টের দেহটা। অ্যাথোসের ছোরা তার বুকে গাঁধা। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, অ্যাথোস, ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করুন। আমার ছেলে আছে, তার কথা মনে করেই ওকে আমি হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি।’
.
৯.
অ্যাথোসের জ্ঞান নেই, এমন কোনো জিনিস পৃথিবীতে কমই আছে। নৌবিদ্যাও তার ভালোই জানা ছিল এক সময়ে, নাবিকের শিক্ষাই সে পেয়েছিল তরুণ বয়সে।
সে শিক্ষার সাহায্যে নৌকাটিকে সে নিরাপতে ভাসিয়ে রাখল এবং ক্রমশ ফরাসি উপকূলের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল, অন্য সবাই সারা দিনরাত্রি চরম উত্তেজনার পর নৌকার খোলের ভেতর শুয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনেক বেলায় তারা উঠল অনেক ক্ষুধা নিয়ে। ওদের ভাগ্য ভালো কিছু খাবার এবং পানীয় গ্ৰসলো মজুদ রেখেছিল নৌকায়। সেগুলি ব্যবহার করে শরীরকে তাজা করে তুলল।
অবশেষে একটা জাহাজ পাওয়া গেল। সেটা বোলো বন্দরে যাচ্ছে। মাথাপিছু এক স্বর্ণমুদ্রা ভাড়া দিয়ে, ওরা সেই জাহাজে উঠে পড়ল। বিকেলবেলা বোলো বন্দরে নামল।
নেমেই পোর্থস কোনো ভালো হোটেলে যেতে চাইছিল। দ্যার্তেগা তাতে বাধা দিল। বন্দরের ডানদিকে সমুদ্র পারে ঝাপির সারিতে ভর্তি, ও সবাইকে সেদিকে টেনে নিয়ে চলল। বন্দর থেকে কিছু খাবার কিনেও নিল।
বেশ কিছুদূর দিয়ে একটা বালিয়ারির আড়ালে সবাই বসল, খাওয়া দাওয়া সেরে নিল চটপট, তারপর দ্যার্তেগা বলল-বন্ধুগণ শোন, এবার আমাদের আলাদা আলাদা পথে যেতে হবে। আমি আর পোর্থ একদিকে, অ্যাথোস আর অ্যারামিস অন্যদিকে।
সবাই বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? আলাদা পথে কেন?’
‘ভুলে গেলে? তোমরা কন্ডির দলে। এই দুই দলের ভেতর মেলা মেলা দেখলে দুই দলের নেতারাই সন্দেহ করবে।’
দ্যার্তেগাকে বিদায় দিতে ইচ্ছা নেই অ্যাথোসের, ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বিপদের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিমান সেনাপতির মতো সে অদ্ভুত কৌশলে সবাইকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে। তার স্মৃতি দ্যার্তেগার প্রতি আগের চাইতেও বেশি আকর্ষণ করেছে। সে শুধুই বলে–‘সবাই একসাথে থাকাই নিরাপদ। আর এ এলাকায় রানীর দলের শক্তি বেশি। রানী মানেই ম্যাজারিন। সুতরাং ম্যাজারিনের দলের দ্যার্তেগা অনায়াসে আমাদের রক্ষা করতে পারবে। আমরা একপাও সামনে যেতে পারব না ও সঙ্গে না থাকলে। রাজ সৈন্যের হাতে বন্দি হয়ে যাব।’
‘তোমরা ভেন্ডোমার ভেতর দিয়ে প্যারিসের দিকে চলে যাও। ওটা বোফোর্টের জমিদারী। তোমাদের ফ্রন্ডিদেরই অধিকার ওখানে। আমরা। নিবার্ডির পথে যাচ্ছি। প্যারিসে দেখা হবে।’
সবাইকে পরাজয় মেনে নিতে হলো দ্যার্তেগার জিদের কাছে। অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে অ্যাথোস আর অ্যারামিস বিদায় নিল দ্যার্তেগা আর পোর্থসের কাছে। গ্রিমড, ব্রেইয়িইস আর মাস্কেটন সবাইকে অ্যাথোসের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল দ্যার্তেগা। চাকর একটাও সঙ্গে থাকবে না। পোর্থস একবার বিদ্রোহ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু কনুই দিয়ে দ্যার্তেগা তাকে এমন গুতো দিল যে, সে। আর আপত্তি করতে সাহস পেল না।
বিদায় নেয়ার পর দুইদল দুই দিকে রওনা হলো। সবারই মন খারাপ। ইংল্যান্ডে চরম বিপদের দিনেও মন তাদের এমন মুষড়ে পড়েনি কোনো দিন, কারণ তখন এক সঙ্গে চার বন্ধু ছিল। আজ কেন এ ছাড়াছাড়ি, কে তা বলে দেবে? এ ছাড়াছাড়ি কি চিরদিনের?
কিছুদূর গিয়ে পোর্থস হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠল–তুমি কিন্তু এটা অন্যায় করছ দ্যার্তেগা। অ্যাথোসকে বিপদের মুখে ছেড়ে দিয়ে আমরা দুইজনে তোফা নিরাপদে পথ চলেছি। এরকম স্বার্থপরতা তোমার ভেতর দেখতে পাব এ আমি কোনোদিন ভাবিনি।
দ্যার্তেগা এক মুহূর্ত নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তার ঠোঁটের কোণে করুণ হাসি ফুটে উঠল। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল—’সরল, মহৎ পোর্থস। অ্যাথেসেরা বিপদে নয়। বিপদে আছি আমরাই। আমাদের সঙ্গে থাকলেই ওদের বিপদের সম্ভাবনা ছিল। ভেণ্ডোমের পথে ফ্ৰণ্ডিরা নিরাপদ। আমি বা তুমি কোথাও নিরাপদ নই।’
‘কেন? কেন? আমরাও ম্যাজারিনের দলে। এ অঞ্চল ম্যাজারিনের অধীনে।’
‘আমরা ম্যাজারিনের দলেই ছিলাম। কিন্তু দলদ্রোহী হয়ে পড়েছি। ম্যাজারিন আমাদের ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ক্রমওয়েলকে সাহায্য করার জন্য। মর্ডন্টের অধীন হয়ে থাকার জন্য। তা না করে আমরা রাজা চার্লসকে উদ্ধার করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করেছি। ভাগ্য খারাপ না হলে উদ্ধার করতেও পারতাম। আর মর্ডন্ট, তাকেও আমরা হত্যাই করেছি। ম্যাজারিন এর মধ্যেই সব খবর পেয়ে গেছে। এ আমি শপথ করে তোমায় বলতে পারি। কাজেই যারা তার হুকুমের বিরুদ্ধে উল্টো কাজ করেছে, যারা তাকে ক্রমওয়েলের বিরাগভাজন করেছে তাদের উপর ম্যাজারিনের দলের প্রতিক্রিয়া কি রূপ হবে, অনুমান করতে পারছ?’
‘ও ব্যাটার মনের ভাব সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না বন্ধু, তবে ওর আগের কার্ডিনাল যে রিশশু, তার মনের ভাব এরকম অবস্থায় কী রকম দাঁড়াত, তা বলতে পারি। রিশলু আমাদের খতম করার জন্য প্রতি রাস্তার মোড়ে গুণ্ডা রাখত।’
‘এ তার চেয়ে কম কিছু করবে না ঠিক জেনো।’
‘আমার ব্যারণ উপাধিটা তা হলে আকাশ কুসুমই থেকে গেল, আহা’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে পোর্থ বলল।
‘মোটেই না।’ দ্যার্তেগা মনে মনে যতই দমে যাক, বন্ধুকে দমতে দেবে না, ‘বলল, তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখো। ওই ম্যাজারিনের কাছ থেকে তোমার ব্যারণ উপাধি আমি আদায় করে দেবই।’
ভেন্ডমের ভেতর দিয়ে নিরাপদে প্যারিসে পৌঁছাল অ্যাথোস আর অ্যারামিস। সেখানে গিয়ে প্রধান কর্তব্য রানী হেনরিয়েটাকে দুঃসংবাদ দেয়া। কিন্তু কর্তব্য কর্তব্যই। অ্যাথোস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছে রাজার শেষ সংবাদ রানীকে দেবার জন্য। শোকবার্তা বলে সে কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
ধূর্ত ম্যাজারিন–পাষণ্ড ম্যাজারিন।
লুভর প্রাসাদে গিয়ে অ্যাথোস আর অ্যারামিস দেখে, রানী হেনরিয়েটা খুশি মেনে প্রায় হাসি হাসি মুখে আলাপ করছেন দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। এরা ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণীর গণ্যমান্য লোক। অ্যাথোস অ্যারামিস দুজনেরই পরিচিত। এদের একজন শ্যাটিলনের ডিউক, বিখ্যাত সেনাপতি।
অ্যাথোসদের দেখে রানী খুশি হয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন ‘আসুন, আমার স্বামীর কুশল সংবাদ দিতে আপনারাও এসেছে দেখছি। কিন্তু দেখেছেন তো রানী অ্যান দেরি না করে নিজের দূত পাঠিয়েছেন আমাকে আনন্দ সংবাদ দিতে।’
আনন্দ সংবাদই? কি আনন্দ সংবাদ? আর্তনাদের মতো শোনায় অ্যাথোসের স্বর। রানী হেনরিয়েটা চমকে উঠেন তার কণ্ঠস্বরে। কে যেন প্রচণ্ড হাতুড়ির আঘাত হানে তার বুকের ভেতর। তিনি প্রায় ককিয়ে উঠেন—’কেন? রানী অ্যানের দূতেরা বলছেন আমার স্বামীকে তারা বধ্যমঞ্চে নিয়ে এসেছিল, সেই সময় তাকে উদ্ধার করেছে তার অনুরক্ত প্রজারা। তিনি আবার একটা সৈন্যদল পরিচালনা করছেন। সিংহাসন উদ্ধারের আশা খুবই বেশি। তার ওই মুহূর্তে আপনারাতো ইংল্যান্ডেই ছিলেন তার কাছে। আপনাদের এসব স্বচক্ষে দেখার কথা এসব। এরা যা বলছে তার কি সত্য নয়?’
শ্যাটল অ্যাথোসকে চুপি চুপি উত্তর দেয়—’মিথ্যা চিরদিনই ঘৃণার। তার প্রচারক যেই হোন না কেন। দুঃখিনী চার্লসের রানী। আমার দুর্ভাগ্য যে এই দুঃসংবাদ আমায় দিতে হল। আপনার মহলে স্বামীর শেষ আদেশ আপনাকে না জানিয়ে আমার উপায় নেই বলেই আমি এখানে এসেছি। মহারানী, মিথ্যাবাদীর ছলনায় ভুল আশা করবে না। আপনার স্বামী আর পৃথিবীতে নেই। তার স্বাক্ষী এই রুমাল।’ রাজার রক্তে ভেজা রুমালটি অ্যাথোস নিজের বুকের ভেতর থেকে বের করে রানীর সামনে রাখাল। অভাগিনী রানী। তিনি তখন অজ্ঞান।
সেদিন সন্ধ্যায় রানী অ্যানের দূত সেনাপতি শ্যাটিলনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে শেষ করল অ্যারামিস। দুর্ভাগিনী হেনরিয়েটার দুর্ভাগ্য নিয়ে পরিহাস করার জন্য এই সাজা।
কিছুদিন প্যারিসে ঘোরাফেরা করেই অ্যাথোস আর অ্যারামিস বুঝতে পারল যে ফন্ডির বিদ্রোহে জয়ী হওয়ার কোনো আশা নেই। কারণ বিদ্রোহের নায়কেরা সবাই গোপনে গোপনে ম্যাজারিনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে। কেউ পাবে জমিদারী, কেউ উচ্চপদ, কেউ অনেক নগদ টাকা। গরীব জনগণের দুঃদুর্দশার দিকে তাকিয়ে স্বার্থহানি করবে এমন মহান ব্যক্তি একজনও নেই বিদ্রোহী দলপতিদের ভেতর।
তারপর আছে দুঃশ্চিন্তা, এখনও এসে পৌঁছায়নি দ্যার্তেগারা। বারবার দ্যার্তেগার বাসায় গিয়েছে অ্যাথোস। দ্যার্তেগা আসেনি, আর কোনো খবরও পাওয়া যায়নি। দ্যার্তেগা আর পোর্থস–দুইজনেই নিরুদ্দেশ। বন্ধুদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা না জেনে নিশ্চিন্ত থাকা অ্যাথোস বা অ্যারামিসের পক্ষে সম্ভব নয়। বোর্নোতে ফিরে এসে সেখান থেকে পিকার্ডির পথে যাওয়ার কথা দ্যার্তেগাদের। ওরাও পিকার্ডির পথ ধরল। অনুসন্ধান শুরু করল। প্রতি শহরে যেখানে খাবারের বা রাতে থাকার জন্য দ্যার্তেগাদের অপেক্ষা করার সম্ভাবনা ছিল, সাবধানে জিজ্ঞাসা করে ওরা। না, কোথাও কোনো খবর পাওয়া গেল না।
অবশেষে মনট্রিল শহরের এক হোটেলে খেতে বসেছে অ্যাথোস আর অ্যারামিস। অন্যমনস্কভাবে টেবিলের পর্দার উপর হাত রেখেছে, অ্যাথোসের মনে হলো-চাদরের নিচে কাঠ ঠিক মসৃণ লাগছে না। কৌতূহলের বসে চাদর তুলে একটা নিশানা সে দেখতে পেল।
দেখল, টেবিলের কাঠের ছুরির ফলা দিয়ে লেখা আছে-পোর্থস-দাত রোফেব্রু চমৎকার এখানে তাহলে তারা এসেছিল। রাতটা এখানে কাটাব ভেবেছিলাম। তা আর হবে না, চল এখনই রওনা হই।
অ্যারামিস বলে–‘এখানে এত খোঁজাখুজি করার কোনো দরকার নেই। দ্যার্তেগা হোটেলে বসে আরাম করার পাত্র নয়। কোনো হোটেলে যা হোক কিছু খেয়ে নিয়ে সে রওনা হয়ে গিয়েছে সামনের দিকে। সুতরাং সামনে চল।
আবার তারা পথে নামল। শহরের দরজায় দরজায় একটু খবরের জন্য চেষ্টা, সে যে কী বিরক্তিকর ব্যাপার। কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধন আছে। আছে কৃতজ্ঞতা, আছে আত্ম মর্যাদার প্রশ্ন-কষ্ট বা বিরক্তি কাছে পরাজয় স্বীকার করার পাত্র নয় ওরা।
এবার ওরা কম্পিয়ে শহরের দিকে ছুটল। শহরের গেটের পাশেই একটা সাদা দেয়াল একটা। তার উপর কয়লা দিয়ে কালো ছবি আঁকা। অতি আনাড়ী হাতের আঁকা, তবু স্পষ্ট বোঝা যায়–দুজন ঘোড়ার পিঠে মানুষের ছবি। নিচে লেখা–‘ওরা পিছু নিয়েছে।’
উৎসাহে অ্যাথোস বলে উঠে, আর সন্দেহ নেই, এ দ্যার্তেগা আর পোর্থস, পিছু নিয়েছে, কে?-তা যেই হোক খুব কাছাকাছি পৌঁছুতে পারেনি। শত্রু কাছে থাকলে, দ্যার্তেগা পাঁচ মিনিট ধরে ছবি আঁকতে পারত না।
অ্যারামিস বলে—’কাছে যদি পৌঁছতে না পেরে থাকে, তাহলে হয়তো দ্যার্তেগাদের ধরতেও পারেনি। একটু একটু আশা হচ্ছে।’
‘আমার আশা হচ্ছে না। বন্দি না হলে তারা এরকম অদৃশ্য হবে কেন?’
কী চিন্তা! কি ভাবনা! বিপদের নিশ্চিন্ত খবর পেলেও এতখানি অস্বস্তি ভোগ করতে হত না। অ্যাথোসের হে প্রবণ মন বন্ধুদের অমঙ্গলের আশঙ্কায় অধীর। আবেগ সর্বস্ব অ্যারামিস রশিটানা ঘোড়ার মতো ছটফটিয়ে উঠছে একটু পরপর। তারা ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল ঘণ্টা দুই তিন। হঠাৎ রাস্তার এককোণে দেখতে পেল, কে যেন বড় একখণ্ড পাথর এনে রেখে দিয়েছে। যাতায়াত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই।
মাস্কেটনকে সঙ্গে আনা হয়নি–সে প্যারিসে রয়েছে যদি দ্যার্তেগা বা পোর্থর্স এসে পড়ে সেজন্য। সঙ্গে আছে গ্রিমড আর সেই পিয়ন। তাদের সাহায্যে পাথরখানা উলটে ফেলতেই তারা দেখতে পেল তার তলার দিকে লেখা রয়েছে পীকক হোটেলে আমরা উঠব। হোটেলওয়ালা আমাদের বন্ধু।
‘তবু একটা সঠিক খবর পেলাম, চল পিককে যাই।’
কিন্তু ঘোড়াদের না খাইয়ে আর একপাও চালানো যায় না। ঐখানে। তাদের তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে হল।
তারপর পিককে পৌঁছাতে আরও ছয়ঘণ্টা লাগল। হোটেলওয়ালাকে প্রশ্ন করতেই সে এক টুকরো ভাঙা তরোয়াল নিয়ে এল–এটা চিনতে পারছেন? এক নজর দেখেই অ্যাথোস বলল–দ্যার্তেগার তরোয়াল।
‘দু’জনের ভেতর যিনি বিশেষ লম্বা চওড়া তার এটা? না-যিনি ছোটখাট তার?’
‘ছোটখাট জনের।’
তাহলে বুঝতে পারছি, আপনারা সত্যিই ওদের বন্ধু—’শুনুন, এখানে এসে ওরাও ঢুকল। পিছনে ঢুকল আটজন সৈন্য। কিন্তু আটজনেও কিছু করতে পারত না। এই শহরে একদল রাজসৈন্য আছে, সংখ্যায় বিশজন, পেরে উঠলেন না।’
‘কিন্তু তাদের কি অপরাধে ধরা হয়েছে? কিছু শুনেছেন?’
‘না, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার সময় পাইনি, তারা চলে গেলে দেখি গোটা তিনেক লাশ পড়ে আছে। ঘোড়াসওয়ার সৈন্যের লাশ, আর ছয়জন আহত হয়ে পড়ে আছে। তাদের সরিয়ে ফেলতে গিয়ে এই তরোয়ালের টুকরো পেলাম।’
‘কোথায় নিয়ে গেল কিছু জানেন?’
‘ভরে শহরের দিকে–তাছাড়া আর কিছু জানি না।’
ছোট শহর ভরে। সেখানে একটি মাত্র হোটেল। এই হোটেলের মদ বিখ্যাত। ঘোড়াসওয়ারীরা কি এই বিখ্যাত মদ এক গ্লাস না খেয়েই চলে যাবে এখান থেকে? এত বড় লড়াইয়ের পর। এখানে যদি তারা থেমে থাকে নিশ্চয়ই কোনো চিহ্ন রেখে গিয়েছে দ্যার্তেগা।
হোটেলে ঢুকে দুই গ্লাস মদের অর্ডার দিল অ্যাথোস আর অ্যারামিস এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে লাগল। ঢাকনা হিসাবে একটা চওড়া রূপা এবং দস্তার তৈরি পাত রয়েছে কাউন্টারের উপর। তার উপরে কতগুলো আলপিনের আঁচড়। অক্ষর আকারে আঁচড়গুলো—’এলোমেলো নয়। স্পষ্ট লেখা আছে, রুইন-ডি’।
‘তাহলে ওরা রুইনে গিয়েছে?’
‘সেন্ট জার্মেইনের পাশ হল রুইন। রানী অ্যান আছেন সেন্ট জার্মেইনে, ম্যাজারিন আছে রুইনে।’
‘কার্ডিনাল রিম রুইনে একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সে বাড়ির নিচে একটা কবরস্থান আছে বলে শোনা যায়। কিছু কবরে মৃতদেহ আছে। কিছু এখনও খালি।’
‘ম্যাজারিন এবার হয়তো খালিগুলি ভর্তি করার মতলবে আছে। দ্যার্তেগার মতো দুর্ধর্ষ লোককে হাতে পেয়ে সে আর ছাড়বে না। সাপের লেজে পা দিয়ে কোনো বুদ্ধিমান লোক তাকে ছেড়ে দেয় না।’
ঘোড়া ছুটছে আর দুই বন্ধু এরকম বলছে, সেন্ট জার্মেইনে আসতে আসতে মন ঠিক করে ফেলেছে তারা। সোজা রানীর কাছে যাবে অ্যাথোস, স্মরণ করিয়ে দেবে পুরান দিনের কথা এবং রানীর কাছে দ্যার্তেগার মুক্তি চাইবে। দ্যার্তেগার এবং পোর্থসের। এমনও হতে পারে রানী হয়তো জানেনই না ম্যাজারিনের-এ কাজের কথা।
সন্দেহ নিয়ে মাথা নাড়ে অ্যারামিস। অ্যাথোসের মতো সরল নয় সে। রানীর সঙ্গে দেখা করে অ্যাথোস কোনো কাজই আদায় করতে পারবে না বলে অ্যারামিসের বিশ্বাস, উল্টো সে নিজেই বন্দি হয়ে পড়বে।
সুতরাং সাবধানী অ্যারামিস বলল—’তুমি রানীর কাছে যেত চাও যাও। আমি যাই মহা যাজক ফ্ৰণ্ডির কাছে। ফ্ৰণ্ডির দলের কিছু লোক চেয়ে নেই তার কাছে। কাজে লাগবে হয়ত।’
‘বোকার মতো কোনো কাজ করো না’–বলে বিদায় নিল অ্যায়োস।
রানীর দরবার। নানা লোক এসেছে দেখা করতে। কাউন্ট দ্য-লা ফেয়ারের নাম সাক্ষাৎ প্রার্থীর তালিকায় দেখেই রানীর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। দ্যা-লা-ফেয়ারের মানে সেই অ্যাথোস তো? বাকিংহামের ব্যাপারে যে চার সৈনিক রানীর মর্যাদা রক্ষা করেছিল, তাদেরই একজন। প্রত্যেকের জীবনে অনেক সময় আসে যখন আগের দিনের উপকারীর নাম শুনলে রাগ। হয়ে যায়।
কিন্তু কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ার ফরাসি দেশের অভিজাত শ্রেণীর অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি। তিনি দেখা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব। সেটা সমস্ত প্রিন্স এবং ডিউকদের আঘাত করার মতো হবে। বর্তমান সংকটের সময় সে কাজ করার সাহস রানীর নেই।
সুতরাং রানীকে অ্যাথোসের কথা শুনতে হলো। মন না চাইলেও, কথা ধৈৰ্য্য ধরে শুনতে হলো।
অ্যাথোস বলছে,–‘মহারানীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়, লেফটেন্যান্ট দ্যার্তেগা আর তার বন্ধু পোর্থস ওরফে মঁসিয়ে দ্য ভ্যালের নাম। এটাও রানী বিশ্বাস করতে পারেন যে, এই বিশ বছরে রানীর প্রতি তাদের ভক্তি এক তিলও কমে যায়নি।’ রানীর চোখে মুখে মৃদু ব্যাঙের হাসি ফুটে উঠল।–’যাক, ওদের ভক্তি অটুট আছে জেনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আজকাল তো বিশ্বস্ত প্রজা পাওয়াই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘দোষটা অবশ্য প্রজাদের, তাতে সন্দেহ নেই,’–সবিনয়ে উত্তর দেয় অ্যাথোস। ‘তবে রাজশক্তির কাছে সুবিচার যখন দুষ্প্রাপ্য হয়, তখন ভক্তি স্বভাবতই কমে আসে বইকি।’
তীক্ষ্ণস্বরে রানী মন্তব্য করেন, ‘সুবিচার দুষ্প্রাপ্য?’
‘বর্তমান ক্ষেত্রেই দেখুন।’ দৃঢ়কণ্ঠে নিবেদন করে অ্যাথোস।
‘মহামন্ত্রী ম্যাজারিনের আদেশে লন্ডনে যেতে হয়েছিল দ্যার্তেগা আর ভ্যালোকে। সেখানে যথা সম্ভব সাহায্য তারা ক্রমওয়েলকে করেছেন। আর তার প্রতিদানে ফ্রান্সে ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই তার বন্দি হয়েছেন রাজসৈন্যের হাতে।‘
রানীর যেন বিশ্বাস হয় না কথাটা—’আপনি কি এমন কোনো প্রমাণ পেয়েছেন যাতে নিঃসন্দেহে বলতে পারেন যে—’
‘মহারানী আমি তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি এবং এও বলতে পারি যে এই মুহূর্তে তারা মহামন্ত্রীর রুইন প্রাসাদে, সম্ভবত সে প্রাসাদের মাটির নিচে কবরখানায় আটক আছে দ্যার্তেগা এবং ভ্যালো।’
রানী এক মুহূর্ত নীরব রইলেন–তারপর বললেন–‘আপনি পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন। আমি মঁসিয়ে ম্যাজারিনকে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করে তারপর আপনাকে জানাচ্ছি যে, আপনার ধারণা কতদূর সত্যি এবং সত্যি হলে এ ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি।’ অ্যাথোসকে বাধ্য হয়েই পাশের ঘরে যেতে হলো। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। গার্ড সেনার লেফটেন্যান্ট কাসি বললেন–‘কাউন্ট আপনার তরবারি খানা আমায় দিন। রানী আপনাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছেন।’
অ্যাথোস জানালা খুলে ফেলল। নিচের চত্বরে ভিরের মধ্যে অ্যারামিস দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাথোস ডেকে বলল—’অ্যারামিস আমি বন্দি হয়েছি।’
‘তা আমি আগেই জানতাম’–অ্যারামিস বলল।
.
১০.
আজ তিনদিন দ্যার্তেগা আর পোৰ্থস রুইন প্রাসাদে বন্দি হয়ে আছে। মাটির নিচে কবরখানায় নয়। ম্যাজারিন এখনও অতটা সাহস করে উঠতে পারেনি। কারণ ফ্রন্ডির নায়ক অ্যাথোস ও অ্যারামিস এখনও বাইরে আছে। দ্যার্তেগা পোর্থসের অপঘাতে মৃত্যু হলে, তাই নিয়ে একটা চাল চালবে ফ্রন্ডির দল। ম্যাজারিন যে মিটমাটের চেষ্টায় আপ্রাণ পরিশ্রম করে যাচ্ছে সেটা একটা দারুণ হোঁচট খাবে।
কাজেই এখনও জীবিত দ্যার্তেগা এবং পোর্থস। তবে যতক্ষণ না ফ্রন্ডি সন্ধি করছে ততক্ষণই তাদের জীবনের মেয়াদ।
বন্দিশালার জানালায় সন্ধ্যার সময়ে এসে কমিঞ্জে দেখা দিল। নমস্কার লেফটেন্যান্ট। নমস্কার দ্যা ভ্যালো।
কমিঞ্জে রীতিমতো শ্রদ্ধা করে দ্যার্তেগাকে। বীরের মর্যাদা বীরই বোঝেন। তাছাড়া দ্যার্তেগার সাহায্যে কমিঞ্জের জীবন একদিন বেঁচে গিয়েছিল। এই ফ্রন্ডির যুদ্ধে বাধাবার পরেই ব্রুসেলকে বন্দি করার সময়। কমিঞ্জকে প্রতি নমস্কার জানিয়ে দ্যার্তেগা বলল–খবর কি লেফটেন্যান্ট?
‘খবর এই যে আপনাদের বন্ধু কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ারও বন্দি হয়ে এসেছেন। তার অনুরোধেই খবরটা আপনাকে দিতে এলাম।
‘অ্যাথোস বন্দি? এখানে?’–দ্যার্তেগা বিমর্ষ না হয়ে উফুল্ল হয়ে উঠল। তার ধারণা দুইজনকে যদিও বন্দি করে রাখতে পেরেছে ম্যাজারিন, তিনজনকে পারবে না। হ্যাঁ, এই প্রাসাদের অন্য অংশে।’ এই বলে কমিঞ্জ বিদায় নিল। ম্যাজারিনের অজান্তে বন্দিদের সঙ্গে বেশি কথা বলার সাহস তার নেই।
দুইদিন এই প্রাসাদে কাটিয়েছে দ্যার্তেগা। চক্ষু বুজে দিন কাটায়নি। লক্ষ করেছে প্রতি সন্ধ্যায় দুইজন প্রহরী এসে টহল দেয় এই বন্দিশালার সামনে। আর ম্যাজারিন বন্দিশালার সামনে দিয়ে রোজ একবার বাগানের দিকে বেড়াতে যায়। ফিরে আসে আধঘণ্টা পরে।
সেদিন সন্ধ্যায় দুই বন্ধু পরিপাটি করে ডিনার খেলো। তারপর দ্যাগো বলল, ‘পোর্থস, তোমার গায়ের জোর কমে যায়নি তো।
‘কমবে’–অবাক পোর্থস দুই হাতের মাংস পেশী দুলিয়ে দেখাল বন্ধুকে ‘কি মনে হয়?
‘মনে হয় যে এই জানালার মোটা মোটা লোহার শিকল তুমি বাঁকিয়ে ফেলতে পার ইচ্ছে করলে।
‘ফেলব নাকি?’–বলেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল পোর্থস। তারপর দ্যার্তেগা আপত্তি করছে না দেখে জানালার একটা শিক দুই হাতে ধরে এমন টান দিল যে মাঝখানে ধনুকের মতো বেঁকে গেল শিকলটা এবং দুই মাথা সিমেন্টের খাজ থেকে চড়চড় করে উঠে বেরিয়ে এল পোর্থসেনরের হাতে।’
‘ঠিক আছে। এখন দেখি ওই ফাঁক দিয়ে তুমি বেরুতে পার কিনা? চেষ্টা করে দেখে পোর্থস বলল–পারি তবে ছাল-চামড়া খানিক উঠে যাবে বোধ হয়।—প্রাণ বাঁচার জন্য ছাল চামড়া কিছু যদি দিতে হয় দিও। এখন শোনো দুজনে চুপে চুপে বেশ কিছুক্ষণ পরামর্শ হলো। অবশ্য এক তরফা পরামর্শ ‘দ্যার্তেগা বলে যায়। পোর্থর্স মাথা নাড়ে।
একটু পরেই বন্দিশালার সামনে দুইজন প্রহরী দেখা গেল। একজন ডানে দেখতে দেখতে চলে গেল। আর একজন বাঁ দিয়ে যায়, জানালার সামনে দিয়ে ‘নমস্কার সাথী, বড় শীত বটে, উত্তর দেয় প্রহরী। দ্যার্তেগার পরিচয় মেজাজে ভদ্রতা বজায় রেখে উত্তর দেয়াতে সে কোনো ক্ষতি দেখল না।
‘কার্ডিনাল একটা ভালো মদ পাঠিয়েছিলেন। দুজনে আর কত খাব? একটা আস্ত বোতলই রয়েছে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস খেয়ে যান না–শীতটা কমবে।
‘বলছেন যখন, তা দিন, ধন্যবাদ।’
দ্যার্তেগা মদ ঢালছে গ্লাসে, পোর্থস জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, জানালার কাছে প্রহরি আসতেই পোর্থস দুই হাত বাড়িয়ে তার গলা টিপে ধরল। সে শক্ত মুঠির চাপে দম বন্ধ বেচারীর। চোখের পলকে দুই হাতে তাকে উঁচু করেছে পোর্থস আর শিকের ফাঁক দিয়ে তাকে টেনে এনেছে ভেতরে।
একটা কাপড় মুখে গুঁজে দেয়া। পিছনে হাত বাঁধা এবং পোশাক খুলে বিছানায় কম্বল চাপা দিয়ে রাখা কয়েক সেকেণ্ডের কাজ। পোর্থসই পোষাকটা পরে নিল চটপট। হতে পায়ে ছোট হলো এবং সেলাইগুলো পটপট করে ছিঁড়ে গেল দু’এক জায়গায়। কিন্তু তাতে কি? দূর থেকে দেখে কে বুঝবে?
সুইস গার্ডের পোষাক পরে পোর্থস বাইরে এসে দাঁড়াল জানালা গলে। ডান দিক থেকে টহল দিয়ে অন্য প্রহরীও এসে পড়ল। জানালার কাছাকাছি এসে সে জিজ্ঞাসা করল–‘দাঁড়িয়ে করছ কি?
সে কথার উত্তর পেল না। পোর্থস শক্ত মুঠি তারও গলা টিপে ধরল। তারপর তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের ভেতর তুলে ফেলল দ্যাগো আর পার্থস মিলে। তারও পোষাক খুলে নিয়ে বেঁধে কম্বল চাপা দিতে আর ক’সেকেন্ডের কাজ। সে পোষাকটি পড়ল দ্যার্তেগা।
এবার দুইজনে জানালা দিয়ে বাইরে চলে এল। একজনে ডানে, অন্যজন বামে টহল দিতে লাগল মনোযোগের সঙ্গে।
কিছুক্ষণ পরে ম্যাজারিন মূল প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে তার খাস চাকর বেদুঈন। ম্যাজারিন আদেশ দিল–‘আমি একবার বাগানটা ঘুরে আসি। তুমি কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ারকে বলল আমি আধঘণ্টা পরে তার ঘরে গিয়ে তার কথা শুনব। তার ঘরের চাবিটা আমায় দাও।
বেদুঈন চাবি দিয়ে চলে গেল।
হাতে একটি লণ্ঠন নিয়ে ম্যাজারিন ধীরে ধীরে চলেছেন। সুই প্রহরীদের বলছেন সঙ্গে আসতে হবে না। এখানে অপেক্ষা কর। কাউন্ট দ্যা-লা ফেয়ারের ঘরে যাওয়ার সময় তোমাদের সঙ্গে নেব। কোনো বন্দির ঘরে একা একা ঢুকতে নেই। কারণ সাধারণত বন্দিরা মরিয়া হয়।
দ্যার্তেগা সংক্ষেপে উত্তর দিল–‘জা জা’–অর্থাৎ হা হা। ম্যাজারিন চলেছেন, রাস্তার মাথায় লতার ঝোঁপ–তার ভেতর কমলালেবুর বড় বড় টব। ম্যাজারিন সতর্কভাবে চারিদিকে তাকিয়ে একটি বিশেষ টবের পাশে লণ্ঠনটি রাখলেন। প্রহরীদেরও চোখে পড়ল না। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বিশেষ একটা টবের গায়ে একটা কল ঘুরিয়ে দিলেন। সাথে সাথে গাছসহ টবটা ঘুরতে ঘুরতে অনেকখানি সরে গেল। আর ম্যাজারিন মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। টব আবার আগের জায়গায় ফিরে এল।
প্রহরীদের ম্যাজারিন দেখতে পাননি। কিন্তু তারা কাছেই ছিল। ওই টবের আড়ালে তারা লুকিয়েছিল। ঘুরন্ত টবের নিচে সিঁড়ি এবং সিঁড়ি বেয়ে ম্যাজারিনের মাটির নিচে যাওয়া কিছুরই নজরে এড়ায়নি তাদের।
এখন এগিয়ে গেল তারা। আবার কল ঘুরিয়ে টব সরাল–তারপর সেই সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে একটা ছোট ঘরে এসে দাঁড়াল। ম্যাজারিন সেখানেই রয়েছে, কিন্তু এদের দিকে পিছন ফিরে দেখতে পেলো না অবাঞ্চিত অতিথিদের। আর অন্য দিকে চোখ ফেরায় কীভাবে? সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য। সারি সারি সিন্দুক সাজানো দেয়ালের পাশে। সবগুলোরই ঢাকনি খোলা, ওগুলো থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে উজ্জ্বল আলো। লণ্ঠনটা বাইরেই আছে। কিন্তু এখানে ঢুকে ম্যাজারিন জ্বেলে দিয়েছে কয়েকটি মোমবাতি। তার আলোতে প্রতিটি সিন্দুকের হীরে জহরতগুলো এমনি আলো ছড়াচ্ছে।
দ্যার্তেগা কানে কানে বলল পোর্থসকে ম্যাজারিন এখন কোষাগার তৈরি করেছেন রিশলুর কবরখানায়। সমস্ত ফরাসি দেশ লুট করে এনে দরিদ্রের মুখের খাবার জমা করা হচ্ছে এই ঘরে।
বলে উঠল পোর্থস–‘ওকে এখানেই গলা টিপে শেষ করে দেই।’
‘পাগল! তা যদি করি, অ্যাথোসকে মুক্ত করব কেমন করে?’
আর দেরি না করে দ্যার্তেগা আর পোর্থস পা টিপে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। এসে টব আবার আগের জায়গায় রেখে টহল দিতে লাগল বন্দিশালার সামনে। সেখানে ঘরের ভেতর মুখবাঁধা সুইস গার্ড দুইজন নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে।
ম্যাজারিন একটু পরেই উঠে এলেন। রোজ সন্ধ্যায় একবার ধনরত্নগুলো না দেখলে রাতে তার ঘুম হয় না।
প্রহরীদের কাছে এসে ম্যাজারিন তাদের ডাক দিলেন–এসো আমার সঙ্গে। দ্যার্তেগা উত্তর দিল–জা জা।
সামনে ম্যাজারিন, পিছনে দুই সুইস গার্ড। অনেকেই লক্ষ্য করল এদের যেতে, কেউ কোনো কথা বলার দরকার মনে করল না, ম্যাজারিন এর সাথে অযথা কি কথা বলবে।
অনেক আঁকাবাঁকা বারান্দা পার হয়ে, চাবি দিয়ে একটি ঘরের তালা খুলে ফেললেন ম্যাজারিন। তিনি ঢুকলেন, পিছন পিছন সুইস দুইজনও ঢুকল।
ম্যাজারিন বললেন–‘নমস্কার কাউন্ট। আপনার সঙ্গে নির্জনে আলাপের সুযোগ পেয়ে আমি অনেক খুশী। আমি ইংল্যান্ডের ঘটনা সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করব। আপনি মন খুলে সত্য উত্তর দেবেন–এই আমার অনুরোধ।
অ্যাথোস কোনো উত্তর দেয়ার আগেই পরিষ্কার বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় দ্যার্তেগা বলে উঠল–হ্যাঁ, আপনি স্বচ্ছন্দে মন খুলে কথা বলতে পরেন কাউন্ট। কারণ এই সুইস গার্ড দুটো ফরাসি ভাষা একদম বোঝে না।’ ঘরের মধ্যে যদি বাজও পড়ত তাতেও মনে হয় ম্যাজারিন এত বেশি চমকাতেন না। ঘরের দরজার ভেতর থেকে বন্ধ করে তাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে পোস।
অ্যাথোস এসে দ্যার্তেগার হাত ধরল–‘তুমি?
ম্যাজারিন বিচলিত ভাবটা গোপন রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘মঁসিয়ে। আপনারা দান উলটে দিয়েছেন বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু সে আপনাদের ভুল। আমার হাতের এই বাঁশিতে ফুঁ দিলেই কমিঞ্জে এসে পড়বে তার বিশজন সৈন্য নিয়ে।
দ্যার্তেগা বলল–ভুল আমাদের নয়। ভুল আপনার কার্ডিনাল, বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার তরবারি আপনার বুকে প্রবেশ করবে সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? আমরা মরিয়া লোক, বেপরোয়া, জীবন-মরণ আমাদের কাছে খেলার বস্তু, তা কি আপনি আজও বুঝতে পারেননি? ম্যাজারিন যেন বোবা, অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক করে শেষ পর্যন্ত বললেন ‘আপনারা কি চান, তাই বলুন না হয়।
‘চাই? আবার কি চাইব? মুক্তি চাই। অকারণে অন্যায়ভাবে আমাদের তিনজনকে বন্দি করেছেন আপনি, আমাদের প্রথম দাবি হলো মুক্তি। সেটা না পেলে পরে অন্য সব কথা হবে।’
‘মুক্তি?–বেশ যান, আপনারা মুক্ত, দরজা খুলে যেখানে খুশী চলে যান কেউ আপনাদের বাধা দেবে না।’
‘অনেক ধন্যবাদ কার্ডিনাল। এতই যদি দয়া করলেন। আর একটু দয়া করে আপনার বাগানের পিছন দিক দিয়ে বের হবার রাস্তাটা আমাদের দেখিয়ে দিন।
চোখে সন্দেহ নিয়ে বলে উঠল ম্যাজারিন, কে বলল যে বাগানের পিছন দিক দিয়ে বের হবার একটা রাস্তা আছে?
‘কে আর বলবে? আমরা নিজের চোখে দেখেছি, দেখেছি যে কমলালেবুর টবটা ঘুরিয়ে দিলেই তার নিচে বেরিয়ে পড়ে পাকা সিঁড়ি এবং সেই সিঁড়ি দিয়ে নামলেই চোখে পড়ে বিশাল ধনভাণ্ডার। আপনি কি দয়া করে আমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন। যদি না দেন, তবে অবশ্য আপনাকে রেখে আমরা যাব। জীবিত নয় মৃত। জীবিত শত্ৰু পিছনে রেখে যাওয়ার মতো বোকা আমরা নই। তা আপনার বোঝা উচিত।’
জীবনের ভয়ে মোটেই ভীত নয় ম্যাজারিন। যতটা ভয় তার ধনসম্পত্তির কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে। সুতরাং এদেরকে বর্তমানে তোয়াজ করতে তিনি বাধ্য।
ম্যাজারিন তাড়াতাড়ি বললেন–‘চল যাচ্ছি।’
ঘরের দরজা খুলে সবার আগে ম্যাজারিন বেরুলেন। তার সামান্য পিছনে ডাইনে বায়ে দ্যার্তেগা ও পোর্থস, দুইনেরই হাতে গুলি ভরা পিস্তল। দ্যার্তেগা ম্যাজারিনের কানে কানে বলছে–‘চালাকির বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে দুইদিক থেকে দুটো গুলি আপনার পিছনে ঢুকবে, সুতরাং সাবধানে।
ইঙ্গিত বোঝেন ম্যাজারিন–ধীরে ধীরে পায়চারি করতেই যেন বাগানের দিকে চলেছেন। সঙ্গে দুইজন সশস্ত্র সুইস গার্ড এবং আর একজন বেসামরিক নিরস্ত্র ভদ্রলোক। অনেকেই দেখল, কিন্তু কেউ কোনো কিছু সন্দেহ করতে পারল না।
বাগানে এসে পৌঁছালেন ম্যাজারিন। ওই যে দেয়াল দেখা যায়। লাফিয়ে চলে যান, এদিকে কোনো প্রহরী নেই।
‘কই-এ অন্ধকানে দেয়াল তো চোখে পড়ছে না। আপনি দয়া করে আর একটু কষ্ট করুন প্রভু। দেয়াল পর্যন্তই পৌঁছে দিন আমাদের।’
ম্যাজারিনের পাঁজরায় কি যেন ঠেকছে। তার মানে হলো একটা পিস্তলের নল। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে বাগান পেরিয়ে চললেন
দ্যার্তেগা বলল–‘পোর্থসের কাঁধে উঠে অ্যাথোস দেয়াল পার হও, লাফিয়ে ওপরে নাম।
অ্যাথোস ওপারে লাফিয়ে পড়ল।
তারপর দ্যার্তেগা উঠল পোর্থসের কাঁধে–‘কার্ডিনালের পাঁজর থেকে পিস্তল সরিও না পোর্থস।
দ্যার্তেগা দেয়ালের মাথায় শক্ত হয়ে বসে বলল–এবার কার্ডিনালকে তুলে ধরে আমার কাছে দাও পোর্থস। কার্ডিনাল আমি কিন্তু উপর থেকে পিস্তল ধরে আছি। আপনি টু শব্দটি করলেই গুলি করতে বাধ্য হব।
ম্যাজারিন টু শব্দটিও করলেন না। নিঃশব্দে উঠে গেলেন দেয়ালে, দ্যার্তেগা হাত বাড়িয়ে তুলল তাকে।
এবার দ্যার্তেগা কার্ডিনালকে ধরে,তাকে নামিয়ে দিল দেয়ালের ওপাশে অ্যাথোস রয়েছে ওখানে, সে ম্যাজারিনকে ধরে নামিয়ে নিল।
তারপর নিজের বেল্ট খুলে সেটা ঝুলিয়ে দিল দ্যার্তেগা। ওটা ধরে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল পোর্থস। দেয়াল কাঁপছে থর থর করে। বুঝি ভেঙে পড়ে। কিন্তু টিকে গেল কোনো রকমে। পোর্থর্স উঠে বসল দেয়ালের উপর। এবং ওপাশে লাফিয়ে পড়ল। তারপর লাফিয়ে পড়ল দ্যাগো।
ওদিকে ছুটে আসছে ওরা কারা? গ্রিমড, গ্রিমডের পর অ্যারামিস, অ্যারামিসের পিছনে রাওল। প্রত্যেকে প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরল। এদিকে ঘোড়া তৈরি। তৈরি ষাটজন দেহরক্ষী এবং ফ্রন্ডিওয়ালা। কন্ডি এদের ধার দিয়েছেন অ্যারামিসের সাহায্যের জন্যে।
ম্যাজারিন আশা করছিলেন, ওরা তাকে এবার ছেড়ে দেবে। কিন্তু সে বৃথা আশা। দ্যার্তেগা তাকে ঘোড়ায় চড়তে বাধা দিল। ঘোড়াগুলো পোর্থসের জমিদারি ব্রাসিওজ দুর্গের দিকে ছুটল।
রানীর কাছে, সেন্ট জার্মেইনে পরদিন দ্যার্তেগা ফিরে এল।
রানী অবাক। তিনি জানেন রুইল প্রাসাদে দ্যার্তেগা বন্দি হয়ে আছে।
‘আমি বন্দি নই, রানী-বন্দি এখন কার্ডিনাল ম্যাজারিন।
ম্যাজারিন বন্দি? এটা ঠিক বেরুলুইন গোপন সংবাদ দিয়ে গিয়েছে রানীকে যে কার্ডিনাল নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
সে নিরুদ্দেশের অর্থ যে, কার্ডিনাল ব্রামিওজ দুর্গে বন্দি, একথা রানী স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
তিনি গর্জন করে বললেন–দুঃসাহসী সৈনিক। তুমি কার্ডিনাল ম্যাজারিনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার স্পর্ধা কর?
দ্যার্তেগা বিনীতভাবে বলে,–‘আমি চিরদিনই দুঃসাহসী, মহারানী। ম্যাজারিনের আগে রিশলুর সঙ্গেও পাঞ্জা লড়েছিলাম এক সময়। মহারানীর অবশ্য তা মনে থাকার কথা নয়।
রানী অ্যান মনে লজ্জা পেলেন একটু,–এই সেই দ্যার্তেগা যার দুঃসাহসের কারণে একসময় তিরি চরম অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
কিন্তু মনের লজ্জা মুখে প্রকাশ করার লোক রানী নয়। তিনি ভয় দেখিয়ে বললেন–‘সব সময় দুঃসাহস ভালো হয় না। আমি এখনই সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারা ব্রাসিওজ দুর্গ মাটির সাথে মিটিয়ে দিয়ে কার্ডিনালকে উদ্ধার করে আনবে।’
‘ব্রাসিওজ দুর্গ শেষ করা আপনার পক্ষে অবশ্য অতি সহজ কাজ রানী। কিন্তু কার্ডিনালকে জীবিত আনা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দূত গিরি যদি সফল না হয়, আমি যদি আজকের মধ্যে নিরাপদে ব্রাসিওজে না ফিরি বা আবার ফিরে যাওয়ার আগে যদি রাজসৈন্য ও পথে যাত্রা করে, তাহলে কার্ডিনাল ম্যাজারিনের জীবনের মূল্য এক ফ্রাঙ্কও নয়। আমরা সব মরিয়া এবং বেপরোয়া। জীবন মৃত্যু আমাদের কাছে খেলার বস্তু মহারানী–এটা স্মরণ রাখলে ভালো করবেন।’
রানী চিন্তা করে দেখলেন, বুঝতে পারলেন দ্যার্তেগার প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই তার। তিনি প্রশ্ন করলেন, কি তোমাদের দাবি?
দাবির একটা লিস্ট করেই এনেছে দ্যার্তেগা। ফণ্ডিওয়ালের সব দাবির পরও দ্যার্তেগাদের ব্যক্তিগত দাবিগুলোও এতে আছে। প্রথম দ্যার্তেগাকে ক্যাপ্টেনের পদ ও লক্ষ ফ্রাঙ্ক পুরষ্কার দিতে হবে। পোর্থসের জন্য মঞ্জুর করতে হবে ব্যারণ উপাধি। অ্যারামিস চায় তার বন্ধু লাংভিলের ডিউকের জন্য নামত্তির শাসন কতৃত্ত্ব এবং পাঁচ লক্ষ ডলার এবং অ্যাথোস–অ্যাথোস কিছুই চায়নি। দিলেও সে নেবে না।
রানী অবাক হয়ে বলেন, ‘যে কিছুই চায় না, এমন লোকও আছে?’
দ্যার্তেগা উত্তর দেয়-’ওই একজনই আছে–অ্যাথোস।’
রানী সন্ধিপত্রে সই করে তারপর বললেন—’রাজা যেদিন প্যারিসে পুনঃপ্রবেশ করছেন সেদিন তার দেহরক্ষা করবে কে?’
তরবারি খাপ থেকে খুলে দ্যার্তেগা বলল—’সেদিন এবং সারাজীবন রাজার দেহরক্ষার ভার রইল-এই অধম সৈনিকের উপর-ঈশ্বর সাক্ষী করে বলছি, দ্যার্তেগার দেহে প্রাণ থাকতে শত্ৰু কখনও রাজার ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে পারবে না।’