সে তখন তাড়াতাড়ি সেই বস্তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে ভিতর থেকেই অতি কষ্টে সেলাই করে ফেললো বস্তার মুখটা।
প্রায় দুই ঘণ্টা বস্তাবন্দী হয়ে থাকবার পর দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো এডমন্ড। সে তখন মড়ার মত নিঃশব্দে পড়ে রইলো সেই বস্তার মধ্যে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যাতে কেউ শুনতে না পায় সেজন্য সে সাবধান হলো। তার বুকের মধ্যে তখন যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে।
একটু পরেই এডমন্ড বুঝতে পারলো যে, প্রহরীরা দড়ি দিয়ে বস্তাটাকে বেঁধে ফেলছে। সে তখন মনে মনে ভগবানের নাম স্মরণ করতে লাগলো। তার মনে হলো যে ঐ বাঁধন কাটতে না পারলে তার জীবন্ত সমাধি হবে সমুদ্রের অতল তলে।
বাঁধাহাদা শেষ হয়ে গেলে তাকে ধরে তুললো তিন-চার জনে মিলে। একজন আবার রসিকতা করে বললো–বুড়োটা কি ভারী দেখছো?
কিছুক্ষণ পরেই শীতল বাতাসের স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল এডমন্ডের। বুঝতে দেরি হলো না যে তাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরে এসে প্রহরীরা পাহাড়ের উপর উঠতে লাগলো তাকে কাঁধে নিয়ে। অনেকটা পথ চলবার পর হঠাৎ নামিয়ে রাখা হলো তাকে। এর কিছুক্ষণ পরেই এডমন্ডের মনে হলো তার পায়ের সঙ্গে কি যেন বাঁধা হচ্ছে। আসলে সেটা ছিল একগাছা সরু লম্বা দড়ি। সেই দড়ির আর এক প্রান্তে বাঁধা ছিল একখানা ভারী পাথর। মৃতদেহ যাতে ভেসে উঠতে না পারে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।
যে জায়গাটায় তাকে রাখা হয়েছিল সেটা ছিল একটা পাহাড়ের চূড়া। তার ঠিক নিচেই সমুদ্র। প্রহরীরা তখন তিন চার জন ধরে তার বস্তাবন্দী দেহটাকে তুলে নিয়ে বার কয়েক দোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল সমুদ্রের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন সেই দড়িতে বাঁধা পাথরখানাও ঠেলে ফেলে দিল।
ঝপাং করে একটা শব্দ তুলে এডমন্ডের বস্তাবন্দী দেহটা তলিয়ে যেতে লাগলো। পায়ের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা পাথরের টানে নিচে নেমে যেতে লাগলো সে। জলের চাপে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু ঐ অবস্থাতেও মনের বল হারালো না এডমন্ড। সে তাড়াতাড়ি সেই ভাঙা প্লেটের টুকরোটা দিয়ে বস্তার সেলাইটা কেটে ফেললো। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে সে কাটতে লাগলো পায়ে বাঁধা সেই দড়িগাছা।
মুহূর্তে মুহূর্তে নিচের দিকে নেমে চলেছে সে। দম আর থাকছে না। এখনই হয়তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে। সে তখন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়িগাছা কাটতে চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎ দড়িগাছা কেটে গেল এই সময়ে। দড়ি কেটে যেতেই সে ভেসে উঠতে লাগলো উপরের দিকে। সে তখন বহু কষ্টে বস্তার বাঁধনগুলো কেটে ফেলে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ভেসে উঠলো জলের উপর।
মুক্তি! ওঃ! কত কাল পরে বাইরের মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগলো এডমন্ডের।
উপরের দিকে তাকিয়ে এডমন্ড দেখতে পেলো যে প্রহরীরা তখনও যায়নি ওখান থেকে। তাদের লণ্ঠনের আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ার উপর।
এডমন্ড সাঁতার কেটে এগিয়ে চললো।
কিছুক্ষণ সাঁতার কাটবার পর হঠাৎ বিকট ঢং ঢং আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো সে। জেলখানায় ‘পাগলা ঘণ্টি’ বেজে উঠেছে।
.
১০.
মুক্তির আশায় প্রাণপণে সাঁতার দিয়ে এগোচ্ছিলো এডমন্ড, কিন্তু মানুষের শরীরে আর কত সহ্য হয়! তীরের দিকে যাবার উপায় নেই। তীরে উঠলেই আবার তাকে ধরা পড়তে হবে। তার তখন একমাত্র ভরসা, কোন জাহাজ যদি তাকে দেখতে পেয়ে তুলে নেয়। কিন্তু অন্ধকার সমুদ্রে কোন জাহাজের চিহ্নও সে দেখতে পেলো না। ক্রমে পুবের দিক ফর্সা হয়ে এলো। সারারাত সাঁতার কাটার ফলে হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো এডমন্ডের। দুর্লঙঘ্য সাগরের বুকে খালি হাতে কতক্ষণ সাঁতার কাটতে পারে মানুষ! মাথা ঘুরে উঠলো এডমন্ডের।
তারপর আর সে কিছু মনে করতে পারলো না। অজ্ঞান হয়ে ভেসে চললো সে সাগরের বুকে।
***
ভূমধ্যসাগরে সেই সময় বহু বোম্বেটে-জাহাজ চলাফেরা করতো। এই জাহাজের নাবিকদের চেহারা ভদ্রলোকের মত হলেও আসলে তাদের পেশা ছিল ডাকাতি করা।
এডমন্ডের সংজ্ঞাহীন দেহটি যখন সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে চলেছে, সেই সময় ঐ রকম একখানি জাহাজ চলেছিল তার পাশ দিয়ে। জাহাজের একজন নাবিক হঠাৎ দেখতে পায় যে জলের উপর একটি মানুষের দেহ ভেসে যাচ্ছে। সে তক্ষুণি খবরটা জানালো জাহাজের কাপ্তেনকে।
কাপ্তেন বললো–তুলে নাও ওকে।
জাহাজে তুলবার পর এডমন্ডের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল সবাই। একি সাংঘাতিক চেহারা রে বাবা! দেড় হাত লম্বা দাড়ি, মাথার চুল আড়াই হাত লম্বা, হাতের নখগুলো তিন চার ইঞ্চি করে! মানুষের এ রকম চেহারা আগে দেখেনি তারা।
কাপ্তেন বললো–এটা কোন দেশের লোক বলতে পারো?
নাবিকেরা সমস্বরে বললো–না, এ রকম মানুষ জীবনে দেখিনি আমরা।
একজন বললো–এটা কোন জন্তু নয় তো?
আর একজন বললো–দূর! জন্তু হবে কেন? দেখলে না, ঠিক মানুষের মত চেহারা!
আর একজন এই সময়ে বলে উঠলো–আরে আরে! এর গায়ে যে কয়েদীর পোশাক দেখছি। বোধ হয় জেল থেকে পালিয়েছে লোকটা।
কাপ্তেন বললো–তাই হবে। আচ্ছা দেখ তো লোকটা বেঁচে আছে কি না?
কাপ্তেনের আদেশে একজন লোক এডমন্ডের বুকের উপরের দাড়ির গোছা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের উপরে কান রাখলো। কিছুক্ষণ কান লাগিয়ে থেকে সে বলে উঠলো–না, মরেনি! বুক ধক ধক করছে এখনও।