পশ্চিম সমুদ্রতীর ঘেঁষে যে পাহাড়টা দায়ের মতো ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই পাহাড়ের নিচে দেখতে পাবে একটা ছোট পাহাড়ে নদী। ঐ নদীর উৎস-বরাবর এগিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের ভিতরে। যাবার পথে পাহাড়ের চুড়াগুলো গুনতি করে যাবে। কুড়ি নম্বর চুড়ার সামনে এসে একটু দক্ষিণ দিকে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে একটি গুহা। গুহার মুখটি পাথর চাপা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছি। ঐ পাথরখানা সরিয়ে ফেলে গুহার মধ্যে ঢুকলেই পাওয়া যাবে সেই ধনরত্নের সন্ধান।”
কাগজখানা পড়া হয়ে গেলে এডমন্ড বিস্মিত হয়ে ফারিয়ার দিকে তাকালো। ফারিয়া বললেন–আজ থেকে এই কাগজ তোমার। তোমাকেই আমি দান করলাম স্পাডা বংশের ঐ বিপুল ধনরাশি।
এডমন্ডের মাথা ঘুরতে লাগলো কাগজ দু’খানা হাতে পেয়ে।
——–
* দুই কোটি রোমান ক্রাউনের দাম স্টার্লিং-এর হিসাবে তের কোটি পাউন্ডের কাছাকাছি আর আমাদের দেশের টাকার হিসাবে একশ বিরাশি কোটি টাকার সমান।
.
৯.
এরপর থেকেই ফারিয়ার যাবতীয় ভার এসে পড়লো এডমন্ডের উপরে। বৃদ্ধের ডান হাত আর ডান পা অবশ হয়ে যাওয়ায় এডমন্ডই তাকে খাইয়ে দিতো রোজ এসে।
প্রহরী খাবার রেখে চলে যেতেই এডমন্ড সেই সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে ফারিয়ার ঘরে ঢুকতো। তারপর তাকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরতো খাবার জন্য।
কিছুদিন এইভাবে কাটবার পর আবার সেই মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন ফারিয়া। এবারকার আক্রমণ থেকে তিনি আর আত্মরক্ষা করতে পারলেন না। এডমন্ডের কোলে মাথা রেখে কারাগারের অন্ধকার গর্ভে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পৃথিবীর একজন মহাজ্ঞানী মানুষ।
.
বৃদ্ধের মৃত্যুতে এডমন্ড ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগলো। দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ে বুক ভেসে যেতে লাগলো তার।
এদিকে তখন প্রহরীর খাবার নিয়ে আসবার সময় হয়ে গিয়েছিল। ওখানে বসে থাকলে ধরা পড়তে হবে, আর ধরা পড়লে সুড়ঙ্গের কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে এই ভয়ে এডমন্ড তাড়াতাড়ি বৃদ্ধের মৃতদেহের উপরে কম্বল চাপা দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে নিজের ঘরে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পরে।
এডমন্ড নিজের বিছানায় আপাদমস্তক কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে বৃদ্ধের কথাই চিন্তা করছিল, এই সময় খাবার নিয়ে প্রহরী ঘরে ঢুকলো।
এডমন্ডকে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে বললো– কি হে! ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?
এডমন্ড বললো–না। শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, তাই একটু শুয়ে আছি।
–শরীর খারাপ লাগছে! তাহলে তুমিও আবার ঐ পাগলা বুড়োটার মতো কেঁসে যাবে নাকি?
–কি বললে?
–ও, জানো না বুঝি? সেই যে পাগলা বুড়োটার কথা বলেছিলাম না! সেই বুড়োটা আজ মারা গেছে।
–কবর দেওয়া হয়েছে কি?
–কবর? হেসে উঠলো প্রহরী। বললো–এখানকার কোন কয়েদী মরলে আবার কবর দেওয়া হয় নাকি?
–কি করা হয় তাহলে?
–বস্তায় বন্ধ করে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়। একেবারে যাকে বলে সলিল সমাধি–হেঁ-হেঁ-হেঁ।
–কখন ফেলা হবে?
–রাত্রে।
এডমন্ড আর কোন কথা বললো না।
প্রহরী তখন তার খাবার নামিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
সেদিন আর খেতে ইচ্ছা হলো না এডমন্ডের। ফারিয়ার কথা মনে করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে,–আহা, এমন একজন জ্ঞানী মানুষকে কবর পর্যন্ত দেওয়া হবে না। বস্তায় বন্ধ করে…
হঠাৎ তার মাথায় একটা মতলব এসে যায়।
–তাই তো! ওর বদলে আমি যদি বস্তার মধ্যে ঢুকে থাকি তাহলে কেমন হয়? ওরা আমাকে মরা মনে করে সমুদ্রে ফেলে দেবে; তারপর আমি বস্তা কেটে বেরিয়ে পড়বো! ঠিক হয়েছে! এই উপায়েই আমি পালাতে চেষ্টা করবো!
উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। বিছানার উপরে উঠে বসে সে।
সন্ধ্যার পরে।
ফারিয়ার সেই কাগজ-দুখানাকে পকেটে নিয়ে এডমন্ড সেই সুড়ঙ্গ-পথের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ কি মনে করে একবার থমকে দাঁড়ালো সে! তারপর ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের মুখের পাথরখানা সরিয়ে ফেলে সে ঢুকে পড়লো সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে।
ফারিয়ার ঘরে গিয়ে সে দেখতে পেলো যে ঘরের মধ্যে একটা বস্তা পড়ে আছে। বস্তাটার দিকে তাকাতেই তার মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু এখন মন খারাপ করে সময় নষ্ট করা চলে না। সে বস্তাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো যে, ফারিয়ার মৃতদেহ তখন বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে বস্তার মুখটা সেলাই করে রাখা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে সেলাই করবার সুচ আর রশিও ছিল ওখানে। বোধ হয় প্রহরীরা ফেলে গেছে।
এডমন্ড তখন আর এক মুহর্ত সময় নষ্ট না করে বস্তার সেলাই খুলে মৃতদেহটা টেনে বের করে ফেললো। তারপর সেই মৃতদেহকে টেনে নিয়ে চললো সুড়ঙ্গ-পথ দিয়ে। সুড়ঙ্গের সরু পথে মৃতদেহ নিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হলো তার, কিন্তু কষ্টকে সে কষ্ট বলে মনে না করে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরে নিয়ে এলো। তারপর সেই মৃতদেহকে নিজের বিছানার উপর তুলে ভাল করে কম্বল চাপা দিয়ে সে আবার ফিরে চললো ফারিয়ার ঘরে। বলা বাহুল্য, যাবার সময় সুড়ঙ্গ-মুখের পাথরখানা ভাল করে টেনে বন্ধ করে দিল সে।
সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে কতকগুলি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন ফারিয়া। ঐ সব জিনিসপত্রের মধ্যে কয়েকখানা চিনেমাটির প্লেটের ভাঙা টুকরোও ছিল। এডমন্ড ওগুলোর ভিতর থেকে ধারালো দেখে একখানা টুকরো তুলে নিয়ে পকেটে রাখলো। তারপর ঢুকে পড়লো ফারিয়ার ঘরে।