ফারিয়া তার মনের ভাব অনুমান করে ম্লান হাসি হেসে বললেন–আমার কথায় সন্দেহ করো না এডমন্ডা মাথা আমার ঠিকই আছে। এখন মন দিয়ে শোনো আমার কথাগুলো।
এডমন্ড বললো–বলুন!
ফারিয়া বলতে আরম্ভ করলেন–আমি যে কাউন্ট স্পাডার সেক্রেটারি ছিলাম সে কথা তোমাকে আগেই বলেছি। এই স্পাডা বংশ একসময় ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বলে পরিচিত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রোমের কুখ্যাত পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্দার আর দুরাত্মা সিজার বোর্জিয়া, কার্ডিনাল স্পাডাকে হত্যা করে তাঁর অতুল ঐশ্বর্য হস্তগত করবার জন্য গোপনে এক ষড়যন্ত্র করে। তাদের যড়যন্দ্রের কথা জানতে পেরে কার্ডিনাল স্পাডা তার যাবতীয় ধনসম্পত্তি কোন এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে আসেন। তার ইচ্ছা ছিল যে, ঐ গুপ্তধনের সন্ধান তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীকে জানাবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তিনি পান না। দুরাত্মা সিজার বোর্জিয়া তাকে রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে হত্যা করে। এডমন্ড বললো–তারপর?
–তারপর বোর্জিয়া পাড়া প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খোঁজ করে। কিন্তু প্রাসাদে সামান্য কয়েক লক্ষ টাকা আর কিছু আসবাবপত্র ছাড়া বিশেষ কিছু পায় না সে। তারপর থেকেই স্পাডা পরিবার ‘অতুল ধনশালী” এই প্রবাদ নিয়েই ক্রমে ক্রমে দরিদ্র হয়ে পড়ে। এই পরিবারের সর্বশেষ উত্তরাধিকারীই ছিলেন কাউন্ট পাড়া। কাউট স্পাডার সম্পত্তির মধ্যে ছিল তার পৈতৃক প্রাসাদটি, কয়েকখানা প্রাচীন বই, কয়েক বান্ডিল দলিলপত্র আর রোমান ক্যাথলিক চার্চ সংক্রান্ত একখানি অতি প্রাচীন পুঁথি। ঐ পুঁথিখানিকে ভাড়া পরিবার অতি পবিত্র বলে মনে করতেন। পূর্বপুরুষদের নির্দেশ ছিল যে ঐ পবিত্র পুঁথিখানি পরিবারের কর্তা তার মৃত্যুর পুর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীর হাতে দিয়ে যাবেন।
–আমি যাঁর সেক্রেটারি ছিলাম, তিনিই ঐ গ্রন্থখানি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রেই। স্পাডা পরিবারের ঐশ্বর্যের প্রবাদ তিনিও জানতেন, তাই আমাকে তিনি আদেশ করেছিলেন প্রাসাদের প্রত্যেকটি জায়গা খুঁজে দেখতে এবং প্রত্যেকখানা দলিল পড়ে দেখতে।
মাসের পর মাস আমি স্পাডা পরিবারের পুরনো দলিলগুলো পড়ে দেখতে থাকি। কিন্তু কোথাও ধনরত্ন সম্বন্ধে কোনরকম উল্লেখ পাই না। শুনেছিলাম যে, আমার আগে স্পাডা বংশের কুড়িজন পূর্বপুরুষ আর তাদের কুড়িজন সেক্রেটারি আমারই মত পণ্ডশ্রম করে গেছেন।
এডমন্ড বললো–তারপর?
–তারপর আমার পূর্ববর্তীদের মত হতাশ হয়ে আমিও পুরনো কাগজ ঘাঁটার পণ্ডশ্রম বন্ধ করলাম। এর কিছুদিন পরেই কাউন্ট স্পডা হঠাৎ মারা গেলেন। মৃত্যুকালে তিনি আমার হাতে স্পাডা পরিবারের শেষ সম্বল সেই জীর্ণ পুঁথিখানি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি, যা তখনও অবশিষ্ট ছিল, তুলে দিয়ে বললেন–আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মহিমান্বিত স্পাডা বংশ। তাই আমি আমাদের বংশের এই শেষ সম্পত্তি আপনার হাতেই তুলে দিয়ে গেলাম। আপনাকেই আমি করে গেলাম আমার উত্তরাধিকারী। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, কাউন্ট পাড়ার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না।
এডমন্ড বললো–তারপর?
–কাউন্টের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই আমি খবর পাই যে, আমাকে নাকি রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হবে। খবরটা পেয়ে আমার মনের অবস্থা যে খুব ভাল থাকতে পারে না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। ঐ রকম মানসিক অবস্থায় এক রাত্রে কি মনে করে আমি স্পাডা পরিবারের সেই পবিত্র পুঁথিখানি পড়তে আরম্ভ করি। পড়তে পড়তে হঠাৎ একখানা ভাজকরা কাগজ আমি দেখতে পাই তার মধ্যে। কাগজখানার ভাজ খুলে লক্ষ্য করলাম যে, তাতে কিছুই লেখা নেই। বাজে কাগজ মনে করে আমি সেখানাকে মোমবাতির শিষের উপর ধরি পুড়িয়ে ফেলবার উদ্দেশ্যে। আগুনের তাপ লাগতেই কাগজখানার উপর কতকগুলো অক্ষর ফুটে উঠে। আমি তখন তাড়াতাড়ি আগুন নিবিয়ে সেই লেখাগুলো পড়তে আরম্ভ করি। কিছুটা পড়েই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। ঐ কাগজখানাতেই লেখা ছিল স্পাডা বংশের সেই গুপ্তধনের সন্ধান।
এতক্ষণ একনাগাড়ে কথা বলে হাঁফিয়ে উঠলেন ফারিয়া। এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–একটু জল! এডমন্ড তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে রাখা জলের কলসী থেকে একটি গ্লাসে জল গড়িয়ে এনে ফারিয়ার মুখের কাছে ধরলো।
ফারিয়া এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু জল পান করে ধীরে ধীরে বললেন–আমার বিছানার নিচে শিয়রের দিকে দুখানা ভাজকরা কাগজ আছে। কাগজ দুখানা বের করে আনো (তা!
এডমন্ড কাগজ দুখানা বের করে আনলে তিনি আবার বললেন–ওর মধ্যে সেই পোড়া কাগজখানা আর আমার হাতে লেখা একখানা নকল দেখতে পাবে তুমি। এইবার ঐ পোড়া কাগজখানা পড়ে, তাহলেই বুঝতে পারবে আমার কথা সত্যি কিনা।
এডমন্ড তখন সেই পোড়া কাগজখানার ভাজ খুলে ফেললো।
কাগজখানার কিছুটা অংশ মাত্র পুড়ে গিয়েছিল। যে অংশটুকু আস্ত ছিল, তাতে লেখা ছিল–
“পরস্বাপহারী ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্য আমাদের বংশের পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত দুই কোটি রোমান ক্রাউনের* চাইতেও বেশি মূল্যের ধনসম্পত্তি মন্টিক্রিস্টো দ্বীপে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এই ধনরত্ন যাতে স্পাডা বংশের বৈধ উত্তরাধিকারী ছাড়া অন্যের হাতে না পড়ে, এই উদ্দেশ্যে তার সন্ধান আমি এই পুঁথির মধ্যে রেখে যাচ্ছি।