ফারিয়া তখন সস্নেহে তার মাথার উপর একখানি হাত রেখে বললেন–মানুষের হৃদয়হীনতা দেখে বিচলিত হয়ো না। আমিও তোমারই মত বিনা অপরাধে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি। একসময় লোকে আমাকে ভক্তি করতে, পণ্ডিত বলে শ্রদ্ধা করতো, কিন্তু মানুষের অমানুষিকতা আজ আমাকে ঠেলে দিয়েছে কারাগারের অন্ধকারে। পৃথিবীর আলো-হাওয়া আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে কয়েকজন স্বার্থপর জীবের –যারা মানুষ বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের ষড়যন্ত্রে। এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে ফারিয়া আবার বলতে আরম্ভ করলেন–কিন্তু তবুও আমি দুঃখ করি না। অভিযোগ জানাই না কারো কাছে। হয়তো এই শাস্তি আমার পাওনা ছিল। হয়তো এই অন্ধকার কারাকক্ষেই আমার সমাধি রচিত হবে। এই বোধ হয় ভগবানের ইচ্ছা। ভগবানের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
এই বলে একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন–আমি চেয়েছিলাম এই কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে। দীর্ঘকাল– দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর অমানুষিক পরিশ্রম করে আমি সুড়ঙ্গ তৈরি করে চলেছিলাম। আশা করেছিলাম, এই সুড়ঙ্গ-পথের শেষে দেখতে পাবো মুক্ত সমুদ্র। কিন্তু আমার সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তোমার এই ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমি ভুল পথে এসেছি। যাই হোক, ওসব কথা ভেবে আর লাভ কি? আমি আজ শত দুঃখ আর হতাশার মধ্যেও খুশি হয়েছি তোমাকে পেয়ে। তুমি আমার ছেলের বয়সী। আজ থেকে নিজের ছেলের মতই আমি তোমাকে দেখবো। বিদ্বান বলে আমার কিঞ্চিৎ খ্যাতি ছিল। আমি গ্রীক, ইটালিয়ান, ফরাসী, জার্মান, ইংরেজি আর (স্পনীয় ভাষা জানি। সেই সব ভাষায় তোমাকে আমি শিক্ষিত করে তুলবো।
এডমন্ড বললো–কারাগারের অন্ধকারেই যার জীবন শেষ হবে, শিক্ষিত হয়ে তার লাভ?
–তুমি দেখছি একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছো! হাল ছাড়তে নেই। তুমি যুবক। এখনও তোমার সামনে পড়ে আছে সুদীর্ঘ জীবন। হয়তো তুমি আবার অর্জন করবে অবাধ স্বাধীনতা; আবার দেখতে পাবে মুক্ত আকাশের নীলিমা–অনুভব করবে অনাহত বাতাসের স্নিগ্ধ স্পর্শ।
এডমন্ড নতজানু হয়ে ফারিয়ার পায়ের কাছে বসে পড়ে বললো–আজ থেকে আমি আপনার আদেশমতই চলবো! তারপর থেকেই শুরু হলো দুই বন্দীর অধ্যয়ন আর অধ্যাপনা। দেখতে দেখতে নানা ভাষায়, নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠলো এডমন্ড–মহাজ্ঞানী অধ্যাপক ফারিয়ার অধ্যাপনার কল্যাণে।
সকাল থেকে দুপুরের খাবার আসবার আগে পর্যন্ত আর দুপুরের পর থেকে রাত্রের খাবার আসবার আগে পর্যন্ত সময়টা এডমন্ড কাটাতো ফারিয়ার কক্ষে। রক্ষীরা ওদের তৈরি সেই সুড়ঙ্গ-পথের সন্ধান জানতো না। এমন সুকৌশলে সুড়ঙ্গের মুখে পাথর চাপা দিয়ে রাখতো ওরা, যার ফলে বাইরে থেকে কারো বুঝবার সাধ্য ছিল না যে, দেয়ালের গায়ে সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে।
.
৮.
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন অধ্যাপক ফারিয়া। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরের আহার শেষ করে এডমন্ড তাঁর ঘরে এসেছিল। এই সময়টা ফারিয়া তার চৌকির উপর বসে থাকতেন রোজই, কিন্তু সেদিন তাকে শুয়ে থাকতে দেখে এডমন্ড বিস্মিত হলো।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো–আপনার কি কোন অসুখ করেছে?
ফারিয়া কোন উত্তর দিলেন না এডমন্ডের প্রশ্নের। এডমন্ড বুঝতে পারলো যে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সে তখন তার শিয়রের কাছে বসে গায়ে মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলাতে লাগলো। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালো সে–ভগবান, এই মহাপ্রাণ মানুষটিকে তুমি ভাল করে দাও।
কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে চাইলেন ফারিয়া। তিনি উঠে বসবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ডান হাতখানা তুলতে চেষ্টা করলেন, তাও পারলেন না।
নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন–আজ থেকে আর আমি উঠে দাঁড়াতে পারবো না। পক্ষাঘাতে শরীরের ডান দিকটা অসাড় হয়ে গেছে আমার।
এই নিদারুণ সংবাদ শুনে এডমন্ডের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।
ফারিয়া বললেন–মনে দুঃখ করো না এডমন্ড। আমার যে এরকম হবে তা আমি আগেই জানতাম। এর আগেও আর একবার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি। আমি এও জানি যে, এই রোগেই আমার মৃত্যু হবে। এ রোগের তৃতীয়বার আক্রমণেই আমি মারা যাবো।
এডমন্ড বললো–অমন কথা বলবেন না গুরুদেব! আপনাকে হারাতে হবে এ কথা ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
–কিন্তু সত্য যা তাকে তো অস্বীকার করা যায় না এডমন্ড! আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তাই যাবার আগে তোমাকে আমি কিছু দিয়ে যেতে চাই।
–ওসব কথা এখন থাক গুরুদেব। আপনি এখন ভয়ানক দুর্বল। এ অবস্থায় বেশি কথা বলা ঠিক নয় আপনার।
–না না এডমন্ড, আমাকে তুমি বাধা দিও না। আজ না বললে হয়তো আর কোন দিন বলাই হবে না সে কথা। এতদিন যা আমি নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছি, সে কথা আজ আমি বলবো।
–কি কথা গুরুদেব?
–তোমাকে আমি বিপুল গুপ্তধনের সন্ধান দেব।
–গুপ্তধন!
–হ্যাঁ, গুপ্তধন। যার পরিমাণ যে কোন রাজার ঐশ্বর্যের চাইতে বেশি। ঐ অতুল ঐশ্বর্যরাশির মালিক আমিই হতাম, কিন্তু তার আগেই আমার হলো যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ।
এডমন্ডের মনে হলো, রোগের আক্রমণে হয়তো ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।