ওদের গাড়িখানা ফটক পার হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ফার্নান্দ পকেট থেকে পিস্তল বের করে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে গুলি করলো।
সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণহীন দেহটি লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপরে।
.
২৩.
এদিকে এন্ট্রি ক্যাভালকান্টির বিচার-সভায় আর এক চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। বিচারক যখন তার বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে নিঃসঙ্কোচে প্রকিওরার-দ্য-রোয়া আঁসিয়ে ভিলেফোর্টের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–উনিই আমার বাবা।
এরপর আরও যে সবচাঞ্চল্যকর বিবরণ আদালতে প্রকাশ করলো সে, তাতে জানা গেল যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট একজন দুশ্চরিত্র, লম্পট, জালিয়াং এবং নরহত্যাকারী। ব্যারনেস ড্যাংলারের সঙ্গে তার অবৈধ প্রণয়ের কথাটাও ফাঁস হয়ে গেল আদালতে।
এইসব ব্যাপারে সেদিন কোর্ট থেকে পাগলের মত ছুটে এসে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করলেন, তারপর দুটো দিন পার হয়ে গেলেও সে দরজা তিনি খুললেন না।
ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে বাড়ির লোকেরা যখন দরজা ভেঙে সেই ঘরে ঢুকলো, তখন দেখা গেল, মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট মেঝের উপর দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ছেন। তিনি তখন রীতিমত উন্মাদ।
.
এইভাবে এডমন্ডের দুজন শত্রু নিপাত হবার পর বাকি থাকলো শুধু ড্যাংলার। এডমন্ড জানতে পেরেছিল (এখন থেকে আমরা কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে এডমন্ড বলেই অভিহিত করবো) যে ড্যাংলার ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।
সে তখন গোপনে দস্যু-দলপতি লুইগি ভাম্পার সঙ্গে দেখা করে ড্যাংলারকে খুঁজে বের করতে অনুরোধ করলো। লুইগি ভাম্পাকে এডমন্ড বহুবার বন্ধুভাবে সাহায্য করেছিল বলে সে এডমন্ডের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল, তাই এডমন্ডের অনুরোধে সে ভিয়েনার পথ থেকে ড্যাংলারকে ধরে এনে কয়েদ করে রাখলো।
চার দিন নির্জলা উপবাসে রাখবার পর ড্যাংলারের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ আদায় করে এক প্লেট খাবার দিলে লুইগি ভাম্পা।
পাঁচ দিনের মাথায় এডমন্ড এসে তার সঙ্গে দেখা করলো। তাকে দেখে ড্যাংলার অবাক হয়ে বললেন–একি! আপনি এখানে!
এডমন্ড বললো–হ্যাঁ! লুইগি ভাম্পা আমার বিশেষ বন্ধ কি না! তাই দেখা করতে এসেছি তার সঙ্গে।
এডমন্ডের কথা শুনে ড্যাংলার যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল। সে বললো–দেখুন দেখি, দস্যুরা আমাকে অকারণে বন্দী করে রেখেছে। আমার সব টাকা কেড়ে নিয়ে আমাকে এরা না খাইয়ে রেখেছে।
এডমন্ড বললো–আপনার তাহলে খুব খিদে পেয়েছে, কেমন?
–হ্যাঁ কাউন্ট, ভয়ানক খিদে পেয়েছে।
–খুব কষ্ট হচ্ছে, না?
–খুব।
–তাহলে কষ্ট কাকে বলে বুঝতে পারছো কিছু কিছু? বন্দীজীবনে না খেয়ে থাকলে মনের অবস্থা কেমন হয় তাও কিছু কিছু বুঝেছো, তাই না?
কাউন্টের মুখে এই রকম বেসুরো কথা শুনে ড্যাংলার যেন হকচকিয়ে গেল। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বের হলো না। এডমন্ড বলে চললো–মনে করে দেখ ড্যাংলার, তুমি একজন নির্দোষ যুবকের কী সর্বনাশ করেছিলে! জাল চিঠি পাঠিয়ে তাকে তুমি বিয়ের দিনে গ্রেপ্তার করিয়েছিলে, মনে আছে সে কথা? ভাবতে পারো কি যে, তোমার ষড়যন্ত্রের ফলে সেই হতভাগ্য যুবক কারাগারে বসে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, তিলে তিলে মৃত্যুর জন্য দিন গুনেছে। আর এদিকে তুমি ব্যারন সেজে সমাজের বুকের উপর বসে অত্যাচারের রথ চালিয়ে দিয়েছো! তুমি, তোমার বন্ধু ফার্নান্দ মন্ডেগু আর তোমাদের পাপ কাজের সহায়ক ভিলেফোর্ট এই তিন শয়তান একটি নির্দোষ হতভাগ্য যুবকের সর্বনাশ করে কেউ কাউন্ট, কেউ ব্যারন আর কেউ সরকারী প্রকিওরার সেজে ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলেছিলে… মনে পড়ে সে সব কথা?
–আপনি!…..কে আপনি…?
–এখনও চিনতে পারছো না আমাকে শয়তান! আমি সেই, যাকে তুমি বিবাহ-সভা থেকে ধরিয়ে দিয়েছিলে, আমি সেই, যার বাগদত্তা বধূকে তোমার কুকর্মের সহায়ক ফার্নান্দ মন্ডেগু বিশ্বাসঘাতকতা করে বিবাহ করেছিল; আমি সেই, যাকে তোমার বন্ধু ভিলেফোর্ট কারাগারে পাঠিয়েছিল তার বাবার যড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে; আমি সেই, যে ফার্নান্দের কীর্তি-কাহিনী প্রকাশ করে দিয়ে তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। আমি সেই, যে তোমার প্রাণের বন্ধু ভিলেফোর্টের মুখোশ খুলে দেওয়ায় সে আজ উন্মাদ…আমি সেই এডমন্ড দান্তে!
এডমন্ডের মুখে তার নাম শুনে ড্যাংলারের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে তখন তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠলো–এডমন্ড! আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
ড্যাংলারের এই কথায় হা-হা করে হেসে উঠে এডমন্ড বললো
–ক্ষমা! হ্যাঁ, আমি তোমাকে ক্ষমাই করবো!
এই বলে লুইগি ভাম্পার দিকে তাকিয়ে সে বললো আমার এই উপকারী বন্ধুটির আরামের দিকে দৃষ্টি রেখো। কাল সকালে আমি আবার এসে এর সম্বন্ধে যা হয় ব্যবস্থা করবো।
.
পরদিন সকালে এডমন্ড এসে আবার যখন দেখা করলো ড্যাংলারের সঙ্গে তখন ড্যাংলারের মাথার সবগুলো চুল সাদা হয়ে গেছে। এক রাত্রের মধ্যেই তার বয়স যেন ত্রিশ বৎসর বেড়ে গেছে। এডমন্ড তখন তার হাতে পাঁচটি ফ্ৰাঁ তুলে দিয়ে বললো–নাও, এই পাঁচ ফ্রাঁ নিয়ে আবার মানুষের সর্বনাশ করে বেড়াও গে। তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম।
-: সমাপ্ত :-