ঠুকঠুকঠুক ঠুক! কে যেন দেয়ালের গায়ে কোন শক্ত জিনিস দিয়ে আঘাত করছে। কিসের এ শব্দ? কোথা থেকে আসছে এই অদ্ভুত আওয়াজ?
এডমন্ড বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঐ শব্দ যে কি তা সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারে না। খানিকক্ষণ পরে শব্দটা আবার থেমে গেল।
পরদিন আবার সেই শব্দ।
তার পরদিন, আবার তার পরদিনও! এডমন্ড লক্ষ্য করলো, রক্ষী যখন বন্দীদের খাবার নিয়ে আসে শব্দটা থেমে যায় তার কিছুক্ষণ আগেই। তারপর আবার আরম্ভ হয় সে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই। এর অর্থ কি? এডমন্ড আরও লক্ষ্য করে যে, শব্দটা যেন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে দিনের পর দিন। আশ্চর্য হয়ে সে ভাবে–এটা তাহলে ভৌতিক ব্যাপার নাকি?
সেদিনও রোজকার মত শুয়ে ছিল এডমন্ড। মাথার ভিতর তখন তার অনেক চিন্তা।
মুক্তি কি পাব না কোনদিনই? বাবা এখন কি করছেন? তিনি কি বেঁচে আছেন এখনও? মার্সেদেস কি অন্য কাউকে বিয়ে… কিন্তু একি! দেয়ালের পাথরখানা সরে আসছে না! তাই তো!
ধড়মড় করে উঠে বসে এডমন্ড! সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে, দেয়াল থেকে একখানা বড় পাথরের স্ল্যাব আগা হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।
এডমন্ডের মনে হয় ওদিক থেকে কে যেন পাথরখানাকে ঠেলে দিচ্ছে। সে তখন লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে পাথরখানাকে ধরে টানতে লাগলো। কিছুক্ষণের চেষ্টায় পাথরখানা সম্পূর্ণভাবে ঘরের ভিতরে এসে পড়তেই এডমন্ড অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে সেই পাথরের পিছনে একটা সুড়ঙ্গ-পথের মুখে এক অদ্ভুত মূর্তি।
মুর্তিটি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। এডমন্ড দেখলে যে লোকটার দাড়ি কোমরের নিচে পর্যন্ত নেমেছে, মাথায় সাদা চুলে জট পাকিয়ে গেছে। পরনে কয়েদীর পোশাক। সেই লোকটাই কথা বললো প্রথমে। হতাশ স্বরে সে বললো–হ্যায় ভগবান! আমার এতদিনের সব চেষ্টা আজ বিফল হয়ে গেল।
এডমন্ড বললো–কে আপনি? কি বিফল হয়ে গেল?
লোকটা বললো–বিফল হলো আমার দীর্ঘ চার বছরের অমানুষিক চেষ্টা। আমি চেয়েছিলাম আমার ঘর থেকে সুড়ঙ্গ-পথ তৈরি করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বেরুবো। কিন্তু আজ দেখছি দিক ভুল করে উল্টো পথে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছি। আমি।
–আপনি কে দয়া করে বলবেন কি?
লোকটা হেসে বললো–তা জেনে তোমার কি সুবিধা হবে? আমিও তোমারই মত একজন বন্দী। তবে এককালে লোকে আমাকে ফারিয়া বলে ডাকতো।
–ফারিয়া! আপনিই সেই মহাজ্ঞানী অধ্যাপক ও ধর্মযাজক ফারিয়া?
–হ্যাঁ বিগত জীবনে তাই ছিলাম বটে, তবে বর্তমানে আমি একটি নম্বরে পরিণত হয়েছি। আমার নাম এখন ‘তেইশ নম্বর’। অবশ্য আরও একটি নতুন উপাধি আমি পেয়েছি, সেটি হচ্ছে ‘পাগলা’। যাই হোক আমার কথা পরে শুনলেও চলবে। এবার তোমার পরিচয়টা বল দেখি! নাম কি তোমার?
–আমার নাম এডমন্ড দান্তে! আমি ফারাওঁ জাহাজের দ্বিতীয় কর্মচারী ছিলাম।
–তোমার বয়স কত?
–জানি না। কারাগারে বন্ধ থেকে আমি বৎসর আর কালের মাপ হারিয়ে ফেলেছি। কেবল এইটুকু মনে আছে, ১৮১৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল উনিশ বৎসর।
ফারিয়া তখন মনে মনে কিছুক্ষণ হিসাব করে বললেন– তাহলে তোমার বয়স এখন ছাব্বিশ বৎসর।
–বলেন কি! সাত বছর আমি এখানে আছি!
–হ্যাঁ তাই। যাই হোক, কি অপরাধে তুমি বন্দী হয়েছ?
–বিনা অপরাধে। শুনবেন আমার জীবনের কাহিনী?
ফারিয়া বললেন–শুনবো বৈকি, এসো তোমার বিছানায় বসে তোমার সব কথা শুনি।
***
এডমন্ডের মুখে তার বিড়ম্বিত জীবনের সব কথা শুনে ফারিয়া বললেন তোমাদের কাপ্তেন যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে এ দ্বীপে যাবার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছিলেন, তখন সেখানে আর কোন লোক ছিল না?
–না, কামরার ভিতরে আমি আর কাপ্তেন ছাড়া আর কোন লোক ছিল না।
এই কথা বলে একটু চিন্তা করে এডমন্ড আবার বললো– তবে হ্যাঁ, ড্যাংলারকে কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম যেন।
–তাহলে জেনে রাখো, ঐ ড্যাংলারের চক্রান্তেই আজ তুমি এই কারাগারে।
–অসম্ভব! ড্যাংলার আমার বন্ধু।
–দুষ্ট লোকে বন্ধুত্ব মানে না। তোমার পদোন্নতি তার সহ্য হয়নি। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস তার দলে ফার্নান্দও ছিল।
–ফার্নান্দ! সে কেন শত্রুতা করবে আমার সঙ্গে? আমি তো তার কোন অপকারই করিনি!
এডমন্ডের এই কথায় ফারিয়া হেসে বললেন–তুমি দেখছি এখনও ছেলেমানুষ। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে পারছ না যে মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে।
–এই তুচ্ছ কারণে আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে তারা, এই কথা আপনি বলছেন?
–বলছি বৈকি! তা ছাড়া আরও একটা কথা জেনে রাখো যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্টও তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
–না না, তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি। আমার বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণ সেই চিঠিখানা আমার সামনেই তিনি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।
ফারিয়া বললেন–হ্যাঁ, তা ফেলেছিল বটে, তবে সেটা (তামাকে বাঁচাবার জন্য নয়। নিজের বাবাকে রাজরোষ থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যেই সেই চিঠিখানা সে পুড়িয়ে ফেলেছিল। তুমি হয়তো শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবে যে মঁসিয়ে নয়ের্তিয়ার হচ্ছেন তোমার ঐ সজ্জন ভিলেফোর্টের বাবা।
–আঁ! কি বলছেন আপনি?
–ঠিকই বলছি। তাকে আমি খুব ভাল ভাবেই চিনি। তিনি যে সম্রাট নেপোলিয়ানের দলের লোক তাও আমি জানি। মার্শাল বাট্রান্ডের সেই চিঠিখানার কথা ফাঁস হয়ে গেলে কেবল যে নয়েতিয়ারেরই বিপদ হত, তাই নয়, ভিলেফোর্টকেও হারাতে হত সরকারি চাকরির উচ্চাসন। এডমন্ড স্তম্ভিত হয়ে গেল এই কথা শুনে।