ম্যাজিস্ট্রেট এন্ট্রি ক্যাভালকান্টিকে দেখিয়ে পুলিশদলকে হুকুম করলেন–গ্রেপ্তার করো ওকে!
হুকুমের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশদল এগিয়ে এসে বরবেশী এন্ট্রি ক্যাভালকান্টির হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
ব্যারন ড্যাংলার চিৎকার করে বলে উঠলেন–এ সব কি হচ্ছে জানতে পারি কি?
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন–নিশ্চয়ই! পলাতক খুনী আসামী বেনডেটোকে গ্রেপ্তার করা হলো।
–বেনডেটো! পলাতক খুনী আসামী! কি বলছেন আপনি?
–ঠিকই বলেছি ব্যারন। এন্ট্রি ক্যাভলকান্টি ছদ্মনামে যে লোকটি এখানে উপস্থিত আছে, সে একজন জেলখাটা দাগী এবং পলাতক খুনী আসামী।
এই বলে একটু হেসে ম্যাজিস্ট্রেট আবার বললেন–আমি খুবই দুঃখিত ব্যারন, কিন্তু কি করবো, কর্তব্যের খাতিরে আমি একে গ্রেপ্তার না করে পারি না।
এন্ড্রিকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইউজিনি অস্ফুট আর্তনাদ করে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়লো, আর ব্যারন ড্যাংলার দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন সেখানে।
এই সময় হঠাৎ কাউন্ট অল্ মন্টিক্রিষ্টো সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যে, বহুদিন আগে মার্সেঈ-এর গীর্জায় এক বিবাহ সভাতেও ঠিক এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা ক্ষীণ হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনের ভাব গোপন করে তিনি ইউজিনির কাছে ছুটে গেলেন।
তিনি দেখলেন–ইউজিনি অজ্ঞান হয়ে গেছে।
.
এ ইউজিনির বিয়ের এই মুখরোচক খবরটা পরদিন সকালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার ফলে ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কে ‘রান’ আরম্ভ হয়ে গেল।
ড্যাংলার যখন বুঝতে পারলেন যে আর রক্ষা নেই, তখন তিনি তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর নোট পকেটস্থ করে পিছনের গুপ্ত দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। পালিয়ে যাবার আগে স্ত্রী কন্যার কথা একবার তার মনে হলেও, “আপনি বাঁচলে বাপের নাম” এই প্রবাদবাক্যটি স্মরণ করে, তাদের ফেলে রেখেই পালিয়ে গেলেন তিনি।
***
ইউজিনির বিবাহ সভা থেকে বাড়িতে ফিরতেই কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো খবর পেলেন যে ভাইকাউন্ট আলবার্ট তার জন্য বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন।
এই খবর শুনে কাউন্ট বৈঠকখানায় গিয়ে আলবার্টকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন কি খবর ভাইকাউন্ট! আপনি হঠাৎ?
আলবার্ট বললো–ভদ্রতার মামুলি বুলি কপচে দরকার নেই কাউন্ট, আমি আপনার কাছে কৈফিয়ৎ চাই।
–কৈফিয়ৎ!
–হ্যাঁ, কৈফিয়ৎ। আমার বাবাকে লোকচক্ষে হেয় করে আমাদের বংশের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন আপনি। এ অপমানের প্রতিশোধ আমি নেব। আমি আপনাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি।
–বেশ! তাই হবে। আমি সর্বদাই প্রস্তুত।
–ভাল, কাল সকালেই আমাদের দেখা হচ্ছে তাহলে!
সেই রাত্রেই।
কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো অন্যমনস্কভাবে একখানা তলোয়ার হাতে নিয়ে তার ধার পরীক্ষা করছিলেন, এই সময় এক অবগুণ্ঠিতা মহিলার আবির্ভাব হলো সেই ঘরে।
মহিলাটির দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বললেন–আপনি কে মাদাম?
অপরিচিতা মহিলাটি হঠাৎ তার মুখের উপরের অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলে দিয়ে বললেন–আমি তোমার কাছে আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে এসেছি এডমন্ড।
–আপনি! কাউন্টেস্-দ্য-মারকা! আপনি এখানে?
–কাউন্টেন্স-দ্য-মারকার্ফ নই এডমন্ড। আমি মার্সেদেস।
–মার্সেদেস! না না, সে নেই, সে বহুদিন আগে মারা গেছে। তাছাড়া, আমাকে আপনি এডমন্ড নামেই বা ডাকছেন কেন? কাউন্টের এই কথায় মার্সেদেস তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে তুমি ক্ষমা করো এডমন্ড। তুমি যদি জানতে যে কতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে বিয়ে করেছে ফার্নান্দ… কিন্তু থাক সে কথা, আমি শুধু তোমার কাছে আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে এসেছি আজ।
তুমি তাহলে জানতে যে আমিই এডমন্ড দান্তে।
–হ্যাঁ, এডমন্ড! তোমাকে যেদিন প্রথম আমাদের বাড়িতে দেখি, সেই দিনই আমি তোমাকে চিনতে পারি; কিন্তু সে কথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। তোমার সামনে সেদিন আমি বেরও হইনি। ইচ্ছা করেই বের হইনি। এডমন্ড! তুমি যদি জানতে…
–সবই আমি জানি মার্সেদেস। যাইহোক, আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমার ছেলে জয়ী হয়ে বাড়িতে ফিরবে। আমিই কাল তার হাতে প্রাণ দেব।
–না, তোমাকে আমি মরতে দেব না!
–সে কি! আমি না মরলে আলবার্ট কি করে জয়ী হবে?
–তোমাদের মধ্যে যুদ্ধ হবে না। আমি তা হতে দেব না। (তামার সঙ্গে আমার ছেলের দ্বন্দ্বযুদ্ধ…এ কিছুতেই হতে পারে না; না–না–না।
এই বলেই মার্সেদেস ছুটে বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে। কাউন্ট ধীরে ধীরে হাত থেকে তলোয়ারখানা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলেন।
***
পরদিন সকালেই আলবার্ট এসে দেখা করলো কাউন্টের সঙ্গে। কাউন্টকে একা একটা ঘরে ডেকে নিয়ে সে তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে আপনি ক্ষমা করুন কাউন্ট! কাল রাত্রে মায়ের কাছে আমি সব কথা শুনেছি।
কাউন্ট আলবার্টের হাত ধরে তুলে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন! তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হলো না।
কাউন্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে যেতেই মার্সেদেস তাকে বললো–তৈরি হয়ে নাও আলবার্ট, আমাদের এখনই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাস্তায় গাড়ি অপেক্ষা করছে। যাবার সময় আলবার্ট ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকালো একবার। তারপর নিঃশব্দে মায়ের সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।