এই বলে দুখানা সার্টিফিকেট সভাপতির টেবিলে রাখলেন তিনি।
আসামী পক্ষের উকিল সেই কাগজ দুখানি সভাপতির কাছ থেকে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে আবার জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু আপনার বাবা মুসলমান হয়েও আপনাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন–এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
–অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। আপনারা হয়তো জানেন যে, আমার বাবা মুসলমান হলেও আমার মা ছিলেন খ্রিষ্টান।
–কিন্তু এ থেকে কি করে বোঝা যায় যে, আপনিই প্রিন্সেস হাইদী?
–তা যায় না বটে, তবে যাতে জানা যায়, সে ব্যবস্থাও আমি করে এসেছি। আমার হাতের এই সর্বশেষ ও সর্বপ্রধান দলিলখানা পড়ে দেখলেই আপনারা জানতে পারবেন যে, কি সাংঘাতিক অন্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের উপরে। আমাকে আর আমার মাকে ক্রীতদাসীরূপে বিক্রি করা হয়েছিল অল কবীর নামে একজন দাস-ব্যবসায়ী মুসলমানের কাছে। পাঁচ লক্ষ ঐ দামে আমাদের দুজনকে বিক্রি করা হয়।
এই সময় কোন একজন দর্শক বলে উঠলেন–কী সাংঘাতিক!
দর্শকের সেই কথার জের টেনে প্রিন্সেস হাইদী বললেন–শুধু সাংঘাতিকই নয়, এ রকম অমানুষিক বিশ্বাসঘাতকতা সভ্যজগতে বোধ হয় আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি।
এই সময় সভাপতি বললেন–আপনার হাতের ঐ দলিলখানা দেবেন কি?
–নিশ্চয়ই দেব ধর্মাবতার, কিন্তু দেবার আগে দলিলখানা এই প্রকাশ্য আদালতে একবার পড়ে শোনাতে চাই আমি। এই বলেই দলিলখানা পড়তে আরম্ভ করলেন প্রিন্সেস হাইদী–
“আমি জেনিনার সৈন্যাধ্যক্ষ ফার্নান্দ মন্ডেগু সজ্ঞানে ও সুস্থ শরীরে নিহত আলী পাশার স্ত্রী ও কন্যাকে নগদ পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁর বিনিময়ে দাস-ব্যবসায়ী অল কবীরের নিকট বিক্রয় করিলাম।”
দলিলখানা পড়া শেষ হতেই কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ আর্তনাদ করে উঠলেন–মিথ্যা কথা! সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা! ও দলিল জাল।
প্রিন্সেস হেসে বললেন–একথা আমি আগেই জানতাম যে, এই দলিলকে জাল বলা হবে, তাই আমি অল কবীরকেও আদালতে নিয়ে এসেছি। মাননীয় বিচারপতির অনুমতি পেলেই তাকে এখানে হাজির করতে পারি।
সভাপতি বললেন–আসতে বলুন তাকে।
সভাপতির অনুমতি পেয়ে প্রিন্সেস হাইদী তাঁর সহচরীকে কি যেন ইঙ্গিত করলেন। সহচরী সঙ্গে সঙ্গে আদালত থেকে বের হয়ে গেল। একটু পরেই একজন মধ্যবয়স্ক মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো সে। সভাপতি জিজ্ঞাসা করলেন– আপনার নাম?
–অল কবীর!
–এই মহিলাকে আপনি চেনেন?
–চিনি ধর্মাবতার।
–কি করে?
–ওঁকে এবং ওঁর মাকে আমার কাছে পাঁচ লক্ষ ফ্ৰাঁ মূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল।
–এঁর মা এখন কোথায়?
–তিনি মারা গেছেন।
–কে বিক্রি করেছিল এঁদের?
–জেনিনার একজন সেনাধ্যক্ষ। তার নাম ফার্নান্দ মন্ডেগু।
–দেখুন তো, এখানে সে লোক আছে কি না?
সভাপতির নির্দেশে আল কবীর আদালত কক্ষের চারদিকে দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললো–ঐ সেই লোক!
অল কবীর কাউন্ট-দ্য-মারকাকে সনাক্ত করবার সঙ্গে সঙ্গেই আদালত কক্ষে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সেই গুঞ্জনধ্বনির মধ্যে দুটি কথা স্পষ্টভাবে শোনা গেল—
“বিশ্বাসঘাতক!” “নরপশু!”
সভাপতি তখন আবার বললেন–দেখুন তো, প্রিন্সেস-এর হাতের ঐ দলিলখানা আসল দলিল কি না!
সভাপতির নির্দেশে প্রিন্সেস হাইদীর হাত থেকে দলিলখানা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে সে বললো–হ্যাঁ ধর্মাবতার, এই সেই দলিল!
এই সময় আসামী পক্ষের উকিল তাকে প্রশ্ন করলো–এ দলিল ঐ মহিলার হাতে কি করে গেল বলতে পারেন?
অল কবীর বললো–না, তা আমি বলতে পারি না। ঐ দলিল আমি কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে দিয়েছিলাম।
–কাউট অ মন্টিক্রিষ্টোকে দিয়েছিলেন! কেন বলুন তো?
–মোটা দাম পেয়ে। তিনি আমাকে আট লক্ষ ফ্রাঁ দিয়ে দলিলখানা সহ ঐ মহিলাকে কিনে নিয়েছিলেন।
এই সময় সভাপতি প্রিন্সেস হাইদীর দিকে তাকিয়ে বললেন –একথা কি সত্য?
–হ্যাঁ, ধর্মাবতার! সম্পূর্ণ সত্য। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোই আমার বর্তমান প্রভু।
সভাপতি তখন তীব্র দৃষ্টিতে কাউন্ট-দ্য-মারকার্যের দিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন–আপনার কিছু বলবার আছে?
কাউন্ট নীরব।
সভাপতি তখন বিচার-সভার অন্যান্য সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এইবার আপনাদের বলতে হবে, আসামী কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ ওরফে ফানা মন্ডেগু দোষী না নির্দোষ। সবাই একসঙ্গে উচ্চারণ করলেন–”দোষী”!
.
২২.
স্পানিশ হুণ্ডীর ব্যাপারে ব্যারন ড্যাংলার সর্বস্বান্ত হলেও বাইরে তিনি তা প্রকাশ হতে দেননি। তার ধারণা হয়েছিল যে, আবার তিনি সামলে নিতে পারবেন। তাই এদিকে যখন সারা প্যারিসে ফানা মন্ডের মামলা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, সেই অবসরে তিনি ইটালীর কোটিপতি মেজর ক্যাভালকান্টির পুত্র এন্ডি ক্যাভালকান্টির সঙ্গে তাঁর মেয়ে ইউজিনির বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন। খুব গোপনেই তিনি এই চালটি চেলেছিলেন, কারণ তার ধারণা হয়েছিল যে, এই বিয়ের ফলে মেজর ক্যাভালকান্টির অগাধ ঐশ্বর্য তার ব্যাঙ্কে এনে ফেলে ঐ অর্থের সাহায্যেই আবার অবস্থা ফেরাতে পারবেন। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
নির্ধারিত দিনে বর-কনে ও আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে গীর্জায় হাজির হলেন ড্যাংলার। অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেল।
পুরোহিত “বিবাহ সমাপ্ত হয়েছে” এই কথাটা ঘোষণা করবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ একদল পুলিশ সহ একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসে হানা দিলেন সেখানে।