কিন্তু কাউন্ট-দ্য-মারকাফের মুখ তখন মৃতের মতো পাণ্ডুর ও রক্তহীন হয়ে গেছে। তিনি কোন কথাই বললেন না।
তাকে নীরব দেখে সভাপতি আশ্চর্য হয়ে বললেন–সে কি কাউন্ট! আপনি চুপচাপ বসে কেন? আপনি যদি প্রকাশ্য সভায় এই সংবাদকে মিথ্যা বলে ঘোষণা না করেন তাহলে আমাকে বাধ্য হয়ে আপনাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে হবে! কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন শুষ্ককণ্ঠে বললেন–এ নিশ্চয়ই আমার কোন শত্রুর কাজ।
সভাপতি বললেন–শত্রুর কাজই হোক আর মিত্রের কাজই হোক, এই সংবাদের ভিত্তিতে আমি আপনাকে যদি অভিযুক্ত না করি, তাহলে রাজার কাছে এবং দেশের কাছে আমাকে কর্তব্যভ্রষ্ট হতে হবে। তবে আপনি যদি সংবাদটাকে মিথ্যা ঘোষণা করেন, তাহলে আপনাকে জামিনে খালাস দিতে পারি, এই পর্যন্ত।
কাউন্ট মারকার্ফ বললেন–এ সংবাদ মিথ্যা।
তখন সভাপতি বললেন–বেশ! আপনার ঘোষণার উপরে বিশ্বাস রেখে আপনাকে আমি জামিনে মুক্তি দিচ্ছি। আগামী পরশু এখানেই এই মামলার বিচার আরম্ভ হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের মত দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আপনি ঐ দিন অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন। খবরের কাগজের আফিসেও আমি সমন পাঠাচ্ছি। তাদের আফিসে যদি এই মামলার কোন সাক্ষী থাকে, তাকে পাঠাতে অনুরোধ করে ব্যক্তিগতভাবে একখানি চিঠিও আমি দিচ্ছি সম্পাদককে।
বিচার সভা। বারজন সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠিত হয়েছে এই অসামান্য চাঞ্চল্যকর মামলাটির বিচার করবার জন্য।
কাউন্ট-দ্য-মারকাকে দেখা গেল আসামীর কাঠগড়ার পাশে একখানা চেয়ারে বসে থাকতে। তার হাতে এক বান্ডিল কাগজ।
আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলো শেষ হতেই সভাপতি বললেন– আসামী ফার্নান্দ মন্ডেগু ওরফে কাউন্ট-দ্য-মারকা! আপনার বিরুদ্ধে যে সাংঘাতিক অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রতিলিপি আপনাকে আগেই দেওয়া হয়েছে। তবুও আর একবার অভিযোগগুলো আপনাকে শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বলে অভিযোগপত্রটি তুলে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করে তিনি বললেন–আসামী ফার্নান্দ মন্ডেণ্ড! আপনি দোষী না নির্দোষ? কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন–নির্দোষ।
–বেশ। তাহলে আমি আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি নির্দোষিতা প্রমাণ করতে। আশা করি, আপনি যে নির্দোষ একথা প্রমাণ করতে পারবেন।
–নিশ্চয়ই ধর্মাবতার, আমার কাছে যে দলিলপত্রাদি আছে তা থেকে আমি সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণ করতে পারব যে আমি এ ব্যাপারে একেবারেই নির্দোষ। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার হাতের এই দলিলগুলো পড়ে শোনাতে পারি।
সভাপতি বললেন–পড়ুন।
কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন একে একে সেই দলিলগুলো বিচারকদের পড়ে শোনাতে লাগলেন।
দলিলগুলো থেকে জানা গেল যে, আলী পাশা তাঁকে এত বেশি বিশ্বাস করতেন যে, নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে রক্ষা করবার ভার পর্যন্ত তাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এমন কি আলী পাশার অন্তঃপুর অবধি তার ছিল অবাধ গতিবিধি। সভাপতি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন এই সময়–কিন্তু এ থেকে পাশার মৃত্যু বা তার স্ত্রী কন্যার নিরুদ্দেশের কোন খবরই তো জানা যাচ্ছে না।
কাউন্ট বললেন–তা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সেনা বিভাগের রিপোর্ট থেকে জানতে পারবেন যে আলী পাশার মৃত্যুর পর যখন প্রাসাদ আক্রান্ত হয়, আমি তখন পাশার পক্ষ থেকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে শত্রুপক্ষের রাজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই বলে আলী পাশার স্বাক্ষরিত একখানি অনুজ্ঞাপত্র ও সেনা বিভাগের কোন পদস্থ অফিসারের স্বাক্ষরিত একখানি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করলেন তিনি।
সভাপতি যখন সেই দলিল দুখানা পড়ছেন, ঠিক সেই সময়ে একজন পত্রবাহক একখানা পত্র এনে তার হাতে দিল।
চিঠিখানা পড়ে সভাপতি আশ্চর্য হয়ে পত্রবাহককে বললেন–তাকে নিয়ে এসো।
একটু পরেই দেখা গেল একজন বোরখাবৃতা মহিলা একজন পরিচারিকার সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে আদালত কক্ষে প্রবেশ করছেন। মহিলা সভাপতির সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন–আপনিই লিখেছেন চিঠিখানা?
বীণানিন্দিত কণ্ঠে সেই বোরখার ভিতর থেকে উত্তর এলো—হ্যাঁ।
সভাপতি বললেন–বেশ! আমরা আপনার কথা শুনবো।
এই বলেই অন্যান্য বিচারকদের লক্ষ্য করে এবং আসামীকে শুনিয়ে তিনি বললেন–এই মহিলা বলছেন যে ইনি পরলোকগত আলী পাশার কন্যা। ইনি এই আদালতে নিজের ইচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে এসেছেন।
সভাপতির মুখ থেকে এই কথা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আদালত কক্ষে এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। বিচারকবৃন্দ, দর্শকদল এবং আসামী সবাই একসঙ্গে তাকালেন সেই বোরখাবৃতা মহিলাটির দিকে।
সভাপতি সেই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন–আপনার যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে, তাহলে আপনার মুখের আবরণটা সরিয়ে ফেলুন।
মহিলাটি তখন তার বোরখা খুলে ফেললেন আদালতে দাঁড়িয়েই।
সবাই বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, মহিলাটি অপূর্ব সুন্দরী।
সভাপতি তখন জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার নাম?
–পিতা বেঁচে থাকতে আমার নাম ছিল জেনিনার শাহজাদী হাইদী।
–”পিতা বেঁচে থাকতে” বলছেন কেন?
–কারণ পিতার মৃত্যুর পর আমাকে এবং আমার মাকে এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়।
এই সময় আসামী পক্ষের উকিল হঠাৎ প্রশ্ন করেন–কিন্তু আপনি যে স্বৰ্গত আলী পাশার কন্যা তার কোন প্রমাণ আছে?
প্রিন্সেস হাইদী মৃদু হেসে বললেন–আছে বৈ কি! এই দেখুন আমার জন্মের সার্টিফিকেট (Birth Certificate)। আর এই দেখুন আমার বাপ্তাইজ হবার সার্টিফিকেট।