এই খবর বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই স্পেনিস হুণ্ডীর দাম পড়ে যেতে লাগলো।
শহরময় হুড়োহুড়ি লেগে গেল ওগুলো বিক্রি করবার জন্য। সবাই বিক্রি করতে চায়, কেনবার লোক কেউ নেই।
ড্যাংলার কোম্পানির আফিসে খবরের পর খবর আসতে লাগলো। যার যত স্পেনিস হুণ্ডী ছিল, সেগুলোকে যে কোন দরে বিক্রি করে দিতে নির্দেশ আসতে লাগলো আমানতকারীদের পক্ষ থেকে।
ড্যাংলার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। মাত্র কয়েকদিন আগে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর দেখাদেখি তিনি তার আজীবনের সঞ্চয়ও, এমনকি, ব্যাঙ্কের গচ্ছিত টাকা থেকেও বহু লক্ষ ফ্রাঁ নিয়ে প্রায় সত্তর লক্ষ স্ট্রার (স্পনিস তৃণ্ডী কিনেছিলেন। তিনি তখন বাধ্য হয়ে কম দরে ঐ তৃণ্ডীগুলো বিক্রি করে
আমানতকারীদের টাকা জমা করে দিলেন। ফলে নিজস্ব নগদ টাকা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না তার।
এ এদিকে যুদ্ধের খবরটা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো দালাল লাগিয়ে বাজার থেকে সবগুলো (স্পনিস হুণ্ডী বেনামীতে কিনে ফেললেন।
***
এর পরদিনই এক সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো আগের দিনের খবরটাকে মিথ্যা ও ভুয়া খবর বলে ঘোষণা করে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো—”গতকল্য প্যারিসের সংবাদপত্রসমূহে স্পেনের নির্বাসিত রাজার সম্বন্ধে যে সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল, উহা একেবারেই ভিত্তিহীন। কুয়াশার জন্য কোন টেলিগ্রাফ অফিসের কেরানী একটা সাংকেতিক সংবাদ বুঝিতে ভুল করিবার জন্যই এইরূপ ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারিত হইয়াছিল।”
এই সরকারি প্রতিবাদ প্রকাশিত হবার ফলে (স্পনিস হুণ্ডীর দাম আবার বেড়ে যেতে লাগলো। অবস্থা এমন হয়ে উঠলো যে, আগে যে দাম ছিল তা থেকেও কিছু বেড়ে গেল স্পেনিস হুণ্ডীর দাম।
কিন্তু এই ব্যাপারে প্যারীর বিখ্যাত ব্যাঙ্কার ব্যারন ড্যাংলার একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন।
২১-২৩. স্পেনের বাজার পলায়ন
স্পেনের বাজার পলায়ন রহস্যের জের মিটবার আগেই আর এক দারুণ খবর প্রকাশিত হলো প্যারিসের এক বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকায়।
খবরটির শিরোনাম ছিল–”আলী পাশার হত্যা রহস্য।”
সংবাদদাতা লিখেছিলেন–”জেনিনার সুলতান আলী পাশার মৃত্যু ও জেনিনার পতনের ইতিহাস এতকাল রহস্যাবৃত ছিল, কিন্তু সম্প্রতি এমন কতকগুলো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ আমাদের হস্তগত হয়েছে যা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পেরেছি যে, আলী পাশাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়। যে নরপশুর বিশ্বাসঘাতকতায় আলী পাশার মৃত্যু হয়, সে ছিল তারই একজন সেনাপতি। খবরাখবর নিয়ে আরও জানা গেছে যে, ঐ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি শুধু আলী পাশাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নাই, সে তাঁর প্রাসাদটিও অরক্ষিত অবস্থায় শত্রুদের হাতে তুলে দেয়। নাটকের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঐ বিশ্বাসঘাতক নরপশু আলী পাশার মহিষী ও তার একমাত্র কন্যা প্রিন্সেস হাইদীকে পাঁচ লক্ষ ফ্রাঁর বিনিময়ে এক দাস-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে।
গভীর লজ্জার এবং দুঃখের কথা এই যে, ঐ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি আজ প্যারিসের অভিজাত মহলে কাউন্ট খেতাব নিয়ে সগর্বে বিচরণ করছে।
জনসাধারণ ও সরকারের অবগতির জন্য লোকটির নামও আমরা প্রকাশ করছি। এর আগের নাম ছিল ‘ফার্নাল মন্ডেগু’, যে বর্তমানে কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ নামে পরিচিত।”
***
এই সাংঘাতিক সংবাদটি যখন খবরের কাগজে বের হলো, মহামান্য কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ তখন শাসন-পরিষদের সভায় তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট।
ফ্রান্সের শাসন-সংক্রান্ত ব্যাপারে যে উচ্চতম পরিষদের সদস্যবৃন্দ রাজাকে সুপরামর্শ প্রদান করে থাকেন, কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ সেই সভার একজন মাননীয় সদস্য।
সভার কাজ তখন চলছে, এই সময় একজন সদস্যকে সংবাদপত্রের একখানি বিশেষ সংখ্যা হাতে নিয়ে রীতিমত উত্তেজিতভাবে সভাকক্ষে প্রবেশ করতে দেখা গেল। মাননীয় সদস্য সোজা সভাপতির কাছে গিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নকণ্ঠে কি সব বলে সেই কাগজখানা তার হাতে দিলেন।
সভাপতিও গভীর মনোযোগের সঙ্গে খবরের কাগজখানা পড়তে লাগলেন। কাগজখানা পড়বার সময় তার মুখের ভাব মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হতে লাগলো। উপস্থিত সদস্যরা কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে মাননীয় সভাপতির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
খবরটা পড়া হয়ে গেলে সভাপতি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে তার স্বভাবসুলভ গভীরকণ্ঠে বললেন–মাননীয় সদস্যবৃন্দ! এইমাত্র সংবাদপত্রে একটি অতি গুরুতর বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টা এতই গুরুতর এবং বিশেষ করে ঐ সংবাদের সঙ্গে আমাদের এই পরিষদের সম্মান এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে, আমি এ ব্যাপারটাকে আপনাদের গোচরে না এনে পারছি না।
এই পর্যন্ত বলেই তিনি খবরের কাগজে প্রকাশিত সেই সাংঘাতিক সংবাদটি উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনালেন সদস্যদের কাছে।
পড়া হয়ে গেলে, তিনি বললেন–মাননীয় কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ এখন এখানেই উপস্থিত আছেন। আমি তাকে অনুরোধ করছি, তিনি এই জঘন্য হীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদকে অস্বীকার করে সভার সামনে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করুন যে, সংবাদপত্রে যে সব কথা লেখা হয়েছে ওগুলো একেবারেই মিথ্যা।
সভাপতির এই কথায় উপস্থিত সভ্যবৃন্দ সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন–নিশ্চয়! নিশ্চয়!