এই পর্যন্ত কথা হতেই নিচের বাগানে এসে পড়লেন সবাই।
কাউন্ট কিন্তু তখনও বলে চলেছেন। তিনি বললেন–আর এই সিঁড়ি দিয়েই সেই হতভাগ্য শিশুটিকে নিয়ে আসে তার পিতা…এই কাউন্টের কথায় বাধা দিয়ে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কি সব যা তা বলছেন কাউন্ট! আপনি কি জানেন না যে, আপনার এই অভিযোগ কি রকম সাংঘাতিক!
–জানি বৈ কি মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট, কিন্তু আমি যা বলছি তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে আমার হাতে।
–প্রমাণ!
–হ্যাঁ, প্রমাণ। আমি জানি যে সেই দুরাচর লম্পট সেদিন সেই সদ্যোজাত শিশুটিকে এই সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে এসে ঐ জায়গায় (এই বলে আঙুল দিয়ে একটা কলাগাছের ঝাড়ের দিকে দেখিয়ে)–হ্যাঁ, ঠিক ঐ জায়গায় তাকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দিয়েছিল।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন মিথ্যা কথা! আপনি কি করে জানলেন এত কথা?
—উত্তেজিত হবে না মাঁসিয়ে প্রকিওরার, শুনে যান। আমার চাকররা ঐ জায়গায় গাছ লাগাবার উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ একটি শিশুর অবিকৃত কঙ্কাল আবিষ্কার করে।
—কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয় নাকি যে, শিশুটিকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়া হয়েছিল?
কাউন্ট মৃদু হেসে বললেন—আপনি বােধ হয় উচ্চাসনে বসে প্যারিসের সামাজিক নিয়মকানুনগুলো ভুলে গেছেন। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, এই বাগানটি গােরস্থান নয়। তা ছাড়া সদ্যোজাত মৃত শিশুকে কবর দেবার আগে তার মাথাটা কেটে ফেলবার নিয়ম আছে, কিন্তু এখানে যে কঙ্কাল পাওয়া যায়, সেটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
এই কথা শুনে ব্যারনেস ড্যাংলার আর একবার আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
ব্যারনেস ড্যাংলারকে এইভাবে দু-দুবার অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন।
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো যেন খুবই দুঃখিত হয়েছেন, এই রকম ভাব দেখিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন ব্যারনেসের দিকে। তারপর স্মেলিং সল্ট এনে তাঁর নাকের কাছে ধরতেই তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলেন।
ব্যারনেস ড্যাংলারের জ্ঞান ফিরে আসতেই কাউন্ট অত্যন্ত আহতস্বরে বললেন—আমি খুবই দুঃখিত মাদাম। এ গল্প আপনার সামনে বলা আমার মোটেই উচিত হয়নি।
এই বলেই তিনি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মসিয়ে ভিলেফোর্টের দিকে তাকালেন। মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট তখন কাউকে কিছু না বলে ব্যারনেস ড্যাংলারকে ধরে নিয়ে তার গাড়ির দিকে চলতে লাগলেন।
***
এই ঘটনার কয়েক দিন পরে আর্লিন্স-এর এক ছোট্ট টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে একটি বিদেশী লোককে দেখা গেল। টেলিগ্রাফ অফিসটা ছিল একটা পাহাড়ের চূড়ার উপরে। যখনকার কথা হচ্ছে সেই সময় বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। তখন সংবাদের আদান-প্রদান চলতো পতাকা ও আলোর সাহায্যে। দিনের বেলায় পতাকা আন্দোলিত করে ও রাত্রিকালে আলোকসংকেত করে টেলিগ্রাফ করা হত তখন।
যে টেলিগ্রাফ অফিসটার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ছিল একজন মাত্র কেরানী। কেরানীটির বাসাও ছিল ঐ আফিসের সঙ্গেই লাগানো।
বিদেশী লোকটি মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন আফিসের মধ্যে!
তাকে দেখে কেরানী জিজ্ঞাসা করলো–কি চান আপনি?
লোকটি মৃদু হেসে বললেন–চাই না বিশেষ কিছু, শুধু একটু আলাপ করতে এলাম।
–আলাপ করতে এলেন! কী ব্যাপার বলুন তো?
–বললাম তো, ব্যাপার বিশেষ কিছু নয়। আমি এসেছি আপনাকে কিছু টাকা দিতে, এই ধরুন, পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।
–পাঁচ লাখ ফ্রাঁ। বলেন কি?
–ঠিকই বলছি। ইচ্ছা করলে এখনই নিতে পারেন ঐ টাকা। এই কথা বলেই তিনি তার হাতের অ্যাটাচি কেসটা খুলে কেরানীর সামনের টেবিলের উপর রাখলেন।
কেরানী সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে যে অ্যাটাচি কেসটা গাদা গাদা ব্যাঙ্ক নোটে ভর্তি।
লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চোখ দুটি। সে বললো– কিন্তু আমাকে এত টাকা কেন দেবেন আপনি!
আগন্তুক হেসে বললেন–হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্নের মত প্রশ্ন বটে! কথাটা কি জানেন, আপনাকে একটা টেলিগ্রাম করতে হবে। সামান্য কাজ। আর এই সামান্য কাজটা করবার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ লাখ ফ্রাঁ পেয়ে যাবেন আপনি।
–কি টেলিগ্রাম দেখি!
বিদেশী লোকটি তখন তার পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে কেরানীর হাতে দিলেন।
কাগজখানায় লেখা ছিল…
“স্পেনের নির্বাসিত রাজা ডন কালো বোর্জেস থেকে পালিয়েছেন। সংবাদ পাওয়া গেছে যে, তিনি ক্যাটালোনিয়া পার হয়ে স্পেনে ঢুকে পড়েছেন। আরও জানা গেল যে রাজা (স্পনের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অধিবাসীরা তার পক্ষে যুদ্ধযাত্রা করেছে।”
কাগজখানা পড়ে দেখে কেরানী বললো–কী সর্বনাশ! এই টেলিগ্রাম পাঠালে যে আমার চাকরি যাবে!
–তাতে কি হয়েছে? সারা জীবন চাকরি করেও আপনি পাঁচ লাখ ফ্রাঁ রোজগার করতে পারবেন না। তাছাড়া চাকরিই বা যাবে কেন? আজ বেশ কুয়াশা আছে। আপনি বলবেন যে কুয়াশায় টেলিগ্রামের সংকেত ঠিকমত বুঝতে না পেরেই এই রকম ভুল সংবাদ পাঠানো হয়েছে।
কেরানী আমতা আমতা করে বললো–তাহলেও চাকরি থাকবে না।
–তা না থাকলেই বা! আপনি এই পাঁচ লাখ ফ্রাঁ নিয়ে আপনার বাকি জীবনটা বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দেই কাটিয়ে দিতে পারবেন।
***
সেই দিনই সন্ধ্যায় সারা প্যারিসে রটে গেল খবরটা। প্রত্যেক লোকের মুখে শুধু ঐ কথা। খবরের কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ বেরিয়ে গেল স্পেনের নির্বাসিত রাজা ডন কালোর প্রত্যাবর্তনের খবর বড় বড় হরফে ছেপে।