বৃদ্ধ মেজর কিন্তু একেবারেই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন কাউন্টের কাণ্ডকারখানা দেখে। তার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হলো না।
কাউন্ট তখন বৃদ্ধের পিঠে মৃদু করাঘাত করে বললেন– আমি বুঝতে পারছি মেজর, বহুদিন পরে ছেলের দেখা পেয়ে আপনি খুবই বেসামাল হয়ে পড়েছেন। তা এ রকম হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক, এখন আপনারা আসুন, আমি একটু কাজে বের হব।
পিতা-পুত্র ততক্ষণ আলিঙ্গনমুক্ত হয়েছেন। ওঁরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার বললেন–হ্যাঁ, এখনকার মত যান, তবে আমি শীগগির আপনাদের সংবর্ধনার জন্য একটা প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করবো। প্যারীর অভিজাত সমাজের সঙ্গে আপনাদের পরিচয়ও হবে ঐ ভোজসভাতেই।
এই বলে কাউন্ট ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কাউন্ট চলে গেলে সপুত্র ক্যাভালকান্টিও ধীরে ধীরে বিদায় হলেন।
***
কয়েক দিন পরের কথা। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো তার পল্লীভবনে এক বিরাট প্রীতিভোজের আয়োজন করেছেন। এই পল্লীভবনটি বহুদিন খালি অবস্থায় পড়ে ছিল, কিন্তু কাউন্ট এটাকে কিনে নিয়ে একেবারে রাজপ্রাসাদে পরিণত করে ফেলেছেন।
কাউন্টের নিমন্ত্রণে প্যারীর অভিজাত মহলের প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ব্যারন ও ব্যারনেস ড্যাংলার, মঁসিয়ে ও মাদাম ভিলেফোর্ট, কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ, মেজর ক্যাভালকান্টি ও এন্ট্রি ক্যাভালকান্টিও ছিলেন।
যথাসময়ে খানা-পিনা শেষ হয়ে যাবার পর ব্যারনেস ড্যাংলারের দিকে তাকিয়ে কাউন্ট বললেন–এই বাড়ির দোতলায় একখানা রহস্যময় ঘর আছে, দেখবেন?
কাউন্টের এই কথায় মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন–তার চেয়ে চলুন, বসে বসে গল্প করা যাক।
কাউন্ট বললেন–কিন্তু ঐ ঘরে আপনারা এমন কিছু দেখতে পাবেন যা এর আগে কখনও দেখেননি। আমি এই বাড়িখানা কিনবার পর যেদিন প্রথম ঐ ঘরে যাই, সেই দিনই কেন যেন আমার মনে হয়েছিল যে, ঐ ঘরে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার, অর্থাৎ একটা অমানুষিক পাপকার্যের অনুষ্ঠান হয়েছিল। ঘরটাতে ঢুকলে এখনও যেন মনে হয় যে, ওখানে কোন হতভাগ্যের আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাই হোক, মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট যখন যেতে চাইছেন না, তাহলে বরং…
কাউন্টের কথায় বাধা দিয়ে মাদাম ভিলেফোর্ট বললেন– আমরা দেখতে চাই সে ঘর। চলুন।
ঘরখানি ছিল দোতলায় দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে নিয়ে কাউন্ট সেই ঘরের সামনে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটি খুলে ফেললেন। দরজা খুলবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। যেন একটি সদ্যোজাত শিশু কেঁদে উঠলো কোথাও।
ভিতরে ঢুকে সবাই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, ঘরখানা অনেকটা সুতিকাঘরের মতো সাজানো। ঘরে কোন আলো নেই, জানালা-দরজায় লাল পর্দা ঝুলছে। মেঝের উপরে একখানি ছোট খাট, খাটের পাশে একখানা ছোট টেবিল ও তোয়ালে রাখবার স্ট্যান্ড স্ট্যান্ডের উপর একখানা তোয়ালে। মাদাম ভিলেফোর্ট বললেন–কি বিশ্রী!
তার কথার জের টেনে কাউন্ট বললেন–শুধু বিশ্রী নয় মাদাম, ভয়াবহ! এই ঘরে, হ্যাঁ, ঠিক এই ঘরে আজ থেকে বিশ বৎসর আগে একটা সাংঘাতিক অপরাধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
মাদাম ভিলেফোর্ট হেসে বললেন–সাবধান কাউন্ট, ‘প্রকিওরার দ্য রোয়া’, (রাজকীয় অভিযোক্তা) এখানে উপস্থিত আছেন, সে কথাটি ভুলে যাবেন না যেন!
কাউন্ট হেসে বললেন–না মাদাম, সে কথা আমি ভুলে যাইনি। তাছাড়া আমার মনে হয় মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট উপস্থিত থাকায় ভালই হয়েছে।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কি বলতে চাইছেন আপনি? কাউন্ট বললেন–আমি বলতে চাইছি যে, আজ থেকে বিশ বছর আগে এই ঘরে কোন মহিলা একটি সন্তান প্রসব করেন।
–আপনি কি আমাদের কোন রূপকথার গল্প শোনাতে চান নাকি কাউন্ট! বললেন মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট।
–মোটেই না। আমি বলতে চাই যে, এই ঘরে সেদিন যে ছেলেটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, তার পিতা…তার দুরাচার লম্পট জন্মদাতা, নিজ হাতে সেই শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে…
এই সময় হঠাৎ ব্যারনেস ড্যাংলার অস্ফুট আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কাউন্ট তাড়াতাড়ি একটি স্মেলিং সল্টের শিশি এনে ব্যারনেসের নাকের কাছে ধরে মাথায় হাওয়া দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।
জ্ঞান ফিরে আসতেই তিনি বললেন–আমি আর এখানে থাকতে পারছি না। আমি বাইরে যেতে চাই।
কাউন্ট বললেন–তাহলে চলুন, এই ঘরের পেছনে যে গোপন সিঁড়ি আছে, সেই সিঁড়ি দিয়েই বাগানে যাওয়া যাবে।
এই বলেই কাউন্ট ঘরের অন্যদিকে গিয়ে একটা গুপ্ত দরজা খুলে ফেললেন।
নিমন্ত্রিতেরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, দরজার সামনেই একটা সরু সিঁড়ি, যার অস্তিত্ব বাইরে থেকে, এমনকি ঘরের ভিতর থেকেও বুঝতে পারা যায় না।
সিঁড়িটা দেখে মেজর ক্যাভালকান্টি বললেন–এটা যেন। গোপন সিঁড়ি বলে মনে হচ্ছে!
কাউন্ট বললেন–ঠিকই বলেছেন মেজর। এ সিঁড়ির অস্তিত্ব বাইরের কোন লোক জানতো না। এর অস্তিত্ব জানতো শুধু সেই লোক যে এটাকে তৈরি করিয়েছিল।
–তার মানে? এবারের প্রশ্ন এলো মাদাম ভিলেফোর্ট-এর মুখ থেকে।
–মানে, যে ভদ্রলোক এই সিঁড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন তিনিই ছিলেন সেই হতভাগ্য শিশুর অবৈধ পিতা। এই ঘরে থাকতেন সেই মহিলা, যিনি অবিবাহিতা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, আর তারই চিকিৎসা ও প্রসবের জন্য ডাক্তার আর নার্স এই গোপন সিঁড়ি দিয়ে আনাগোনা করতো।