–আপনি না জানালেও আমি তা জানতে পেরেছি। ফাদার বুসেনি আমাকে আপনার সম্বন্ধে সব কথাই বলেছেন। আপনি তো অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর?
–মেজর! তা হবে।
–তা ছাড়া আপনিই তো ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ক্যাভালকান্টি বংশের বর্তমান উত্তরাধিকারী..অর্থাৎ ক্যাভালকান্টি পরিবারের অতুল ঐশ্বর্যের মালিক, কেমন সত্যি কি না?
–এসব কথাও বুঝি ফাদার বুসেনি বলেছেন?
–তা ছাড়া আর কে বলবে? যাই হোক, আপনার কোন চিন্তা নেই। আপনার নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের সন্ধান আমার কাছ থেকেই পাবেন, তা ছাড়া ফাদার বুসেনির নির্দেশমত পাঁচ হাজার ফ্ৰাঁও আমি আজই দিয়ে দেব আপনাকে। সে যাই হোক, আপনার হাতে ফাদার বুসেনি কোন চিঠিপত্র দিয়েছেন কি?
মেজর ক্যাভালকান্টি বললেন–হ্যাঁ, দিয়েছেন।
এই বলে পকেট থেকে একখানা খামে বন্ধ চিঠি বের করে কাউন্টের হাতে দিয়ে বললেন–এই যে!
চিঠিখানা গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ে কাউন্ট বললেন– ফাদার বুসেনি টাকার বিষয়ে কিছু বলেছেন কি আপনাকে? কাউন্টের এই কথায় মেজর মহোদয় যেন বেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন।
তিনি বললেন–হ্যাঁ, মানে ফাদার আমাকে বলেছিলেন যে তিনি নাকি আপনার কাছে…
–কি বলেছিলেন বলুন!
–বলেছিলেন যে তিনি নাকি আপনার কাছে চল্লিশ হাজার ফ্ৰাঁ পান।
–হ্যাঁ, ঐ টাকা তিনি আপনাকে দিতে বলেছেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন; আমি চেক দিয়ে দিচ্ছি। আর ইতিমধ্যে আপনি ইচ্ছা করলে আপনার ছেলের সঙ্গেও দেখা করতে পারেন। সে পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছে।
–আমার ছেলে! মানে…
–হ্যাঁ, আপনার নিরুদ্দিষ্ট ছেলে এন্ট্রি ক্যাভালকান্টি। আমি সব খবরই শুনেছি ফাদার বুসেনির কাছে। আপনি যে গোপনে অলিভা কার্সিনারী নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই সার্টিফিকেট আর সারাজেভের মিউনিসিপ্যাল অফিসে আপনার ছেলে এন্ট্রির জন্ম রেজিস্ট্রির সার্টিফিকেটও আমার কাছে আছে, এই নিন।
এই বলে কাউন্ট পকেট থেকে একখানা লম্বা খাম বের করে মেজর ক্যাভালকান্টির হাতে দিলেন।
মেজর ক্যাভালকান্টি তখন খামখানা খুলে তার ভিতর থেকে সেই সার্টিফিকেট দু’খানা বের করে পড়ে দেখতে লাগলেন।
কাউন্ট বললেন–কেমন, ঠিক আছে তো?
-–ঠিক আছে বলেই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু…
–আর কোন কিন্তু নয় মেজর! আপনি আপনার হারানো ছেলে আর সঙ্গে চল্লিশ হাজার ফ্রঁ আজই পাবেন। এরপর আপনি প্যারীতে আপনার সামাজিক পদগৌরব নিয়ে বাস করবেন। আপনাদের যাতে কোন রকম অসুবিধা না হয়, তার জন্য একখানা বাড়ি ভাড়া করে রেখেছি আপনার জন্য। এইবার যান, আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা করুন গিয়ে।
–তা যাচ্ছি, কিন্তু…
–কিন্তু কি আবার?
–মানে–ঐ টাকাটা…
–ও, আচ্ছা দাঁড়ান, টাকাটা এখনই দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। এই বলে পকেট থেকে চেক বই বের করে ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কের উপরে চল্লিশ হাজার ফ্রাঁর একখানা চেক কেটে মেজর ক্যাভালকান্টির হাতে দিলেন কাউন্ট।
চেকখানা হাতে পেয়ে মেজর বললেন–আমি তাহলে…
–হ্যাঁ। ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন এবার।
মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কাউন্ট আবার তাকে ডাকলেন–হ্যাঁ শুনুন।
তাড়াতাড়ি ফিরে দাঁড়িয়ে মেজর বললেন–কি বলছেন। কাউন্ট?
–আপনি আপনার ব্যাঙ্কের হিসাব ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কেই খুলবেন।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
তিনি চলে যেতেই কাউন্টের ঠোঁটের কোণে যেন একটু দুষ্ট হাসি খেলে গেল বলে মনে হলো।
***
মেজর ক্যাভালকান্টি পাশের ঘরে ঢুকতেই একটি বিশ-একুশ বছরের ছেলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলো। মেজর ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে চললেন।
ছেলেটি বললো–আপনি?
–আমার নাম মেজর ক্যাভালকান্টি। বার্তোলোমিও ক্যাভালকান্টি।
–বাবা!
ছেলেটির মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনবার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মেজর দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–এন্ড্রি, বাপ আমার! এতদিন পরে তোমাকে তাহলে সত্যিই ফিরে পেলাম আমি!
এন্ড্রি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো–বাবা, আজ যে আমার কী সুখের দিন, তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত বলেই বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে সে আবার বললো–কিন্তু কেবলকান্ত মহাশয়! আমার বাবা সাজবার জন্য তুমি কত পেয়েছো বলো দিকিনি?
পুত্রের কথায় মেজর ক্যাভালকান্টি হঠাৎ তড়িতাহতের মতো চমকে উঠে বললেন–এ তুমি কি বলছ এন্ট্রি?
–ঠিকই বলছি বাবা মশাই। আমিও তোমারই মতো এখানে আমদানি হয়েছি। মোটা টাকা পেয়েছি তোমার ছেলে সাজবার জন্য।
এই সময় কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেজর সাহেব ফিসফিস করে বললেন–চুপ! কাউন্ট আসছে।
পিতা-পুত্রের এই মিলন দৃশ্য দেখে খুশি হয়ে কাউন্ট বললেন–তাহলে এন্ট্রি! পিতাকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়েছে নিশ্চয়ই? এন্ড্রি বললো খুশি বলে খুশি, এরকম ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা তো আমি ভাবতেই পারিনি!
কাউন্ট মৃদু হেসে বললেন–হয় বাপু হয়, দুনিয়ায় অনেক কিছুই হয়, যা তুমি বা আমি বুঝতেই পারি না। যাই হোক, তুমি এবার তোমার বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে চলে যাও। ওখানে সব ব্যবস্থাই করা আছে। তাছাড়া তোমরা যাতে ভালভাবে থাকতে পারো, তার জন্য বছরে বার লক্ষ ফ্রাঁর ব্যবস্থা করে রেখেছি আমি! ড্যাংলার কোম্পানির ব্যাঙ্কের চেক কাটলেই টাকা পাবে তোমরা।