এই বলেই কাউন্ট পকেট থেকে একটা মরক্কো চামড়ার সুদৃশ্য নোটকেস বের করে তা থেকে প্রায় পনের লাখ ফাঁর নোট ব্যারন ড্যাংলারের টেবিলের উপরে রাখলেন।
ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ব্যারন ড্যাংলার আমতা আমতা করে বললেন–বেশ। তাহলে কত টাকা আপনার দরকার বলুন?
কাউন্ট মনে মনে হিসেব করে বললেন–তা ধরুন ষাট লাখ ফ্রাঁ তো বটেই।
ব্যারন বললেন–বেশ। ষাট লাখ ফ্রাঁই আপনি পাবেন। ব্যাঙ্কে গিয়ে লেখাপড়াটা সেরে আসবেন সময়মত।
ব্যারন ড্যাংলারের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ব্যারনেস ড্যাংলার ঝড়ের মত বেগে সেই ঘরে ঢুকে পড়লেন।
কৈফিয়ৎ চাইবার সুরে ব্যারনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন –আমার ঘোড়া অন্যের গাড়িতে দেখছি কেন? তুমি কি ওটা বিক্রি করেছে নাকি?
এই সময় কাউন্ট দাঁড়িয়ে উঠে ব্যারনের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তাহলে আসি ব্যারন। সময়মত ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা করবো আপনার সঙ্গে।
এই কথা বলেই কাউন্ট বেরিয়ে গেলেন সেই ঘর থেকে।
***
ঘণ্টা দুই পরের কথা।
একজন পত্রবাহক ব্যারনেস ড্যাংলারের নামে চিঠি নিয়ে এলো। চিঠিখানি খুলে ব্যারনেস পড়লেন
মাননীয়াসু—
আপনার ঘোড়াটি আমি অজ্ঞাতসারে কিনে ফেলেছিলাম বলে দুঃখিত। পত্রবাহকের সঙ্গে ঘোড়াটি ফেরত পাঠালাম। এর দাম আপনাকে দিতে হবে না। এটা আমার উপহার বলে মনে করলে খুশি হবো। ইতি
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো।
চিঠিখানি পড়ে অবাক হয়ে গেলেন ব্যারনেস। পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর দাবি এক কথায় যে লোক ছেড়ে দিতে পারে, তার টাকার পরিমাণ কত?
.
২০.
কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টোর কার্যধারার কিছুটা বিশ্লেষণ করা দরকার হয়ে পড়েছে। আগের পরিচ্ছেদে আপনারা জানতে পেরেছেন যে, কাউন্ট প্যারীতে এসে ভাইকাউন্ট আলবার্টের প্রীতিভোজে যোগদান করেছেন এবং ব্যারন ড্যাংলারের ব্যাঙ্কে হিসাবে খুলবার উদ্দেশ্যে অপরিমিত টাকার ‘লেটার অব গ্যারান্টি’ দাখিল করেছেন। তাছাড়া ব্যারনেস ড্যাংলারের ঘোড়াটা বহু টাকায় কিনে আবার তাঁকেই উপহার দিয়েছেন।
এ সবের উদ্দেশ্য কী?
এ উদ্দেশ্য একটা অবশ্যই আছে, আর সেটি হচ্ছে প্রতিহিংসা। কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো ওরফে এডমন্ড দান্তে ভাল করেই তার শত্রুদের সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়েছেন। ড্যাংলার, ফার্নান্দ ও ভিলেফোর্ট সম্বন্ধে খবরাখবর নিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন যে, ওরা তিনজনেই এখন প্যারীর অভিজাত সমাজে বিখ্যাত তোক বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। জেলের ছেলে ফার্নান্দ এখন কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ আর জাহাজের কেরানী ড্যাংলার হয়েছে ব্যারন ড্যাংলার।
ফার্নান্দের সম্বন্ধে আরও যে সব খবর তিনি জানতে পেরেছেন, সেগুলি অত্যন্ত মারাত্মক! তিনি খবর পেয়েছেন যে, প্যারীতে আসবার আগে সে জেনিনায় আলী পাশার সৈন্যাধ্যক্ষ ছিল। তিনি আরও খবর পান যে, আলী পাশার মৃত্যুটাকে জেনিনার লোকেরা গুপ্তহত্যা বলে মনে করে।
আলী পাশার দুর্গ রক্ষার ভার ছিল ফার্নান্দের উপরে। পাশার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাও ঐ দুর্গেই ছিলেন তখন। কিন্তু আলী পাশার মৃত্যুর পর রহস্যজনকভাবে ঐ দুর্গটি শত্রুদের করায়ত্ত হয় এবং তার স্ত্রী কন্যার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
এই সব খবর যোগাড় করবার পরই কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো প্যারিতে চলে আসেন। তাঁর মনের মধ্যে তখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে প্রতিহিংসার আগুন। কিন্তু সে আগুন তিনি হাবভাবে বা চালচলনে একেবারেই প্রকাশ পেতে না দিয়ে স্থির মস্তিষ্কে বৈরনির্যাতনের কাজে লেগে যান। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মার্সেদেস তখন ঐ ফার্নান্দ ওরফে কাউন্ট-দ্য মারকার্ফ-এর স্ত্রী, আর ভাইকাউন্ট আলবার্ট তার ছেলে আলবার্টের সঙ্গে ড্যাংলারের মেয়ে ইউজিনির বিয়ের সম্বন্ধের কথাও জানতে পান তিনি। এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, কাউন্ট আলী পাশার স্ত্রী-কন্যার খোঁজে জেনিনাতেও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কতকগুলো গোপন খবর যোগাড় করে তিনি দস্যু-দলপতি লুইগি ভাম্পার সঙ্গে দেখা করেন। তারপর তাকে সঙ্গে করে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে এসেছেন। লুইগি ভাম্পার সঙ্গে তার পরিচয় হয় ‘এমেলিয়া’ জাহাজের কাপ্তেনের মধ্যস্থতায়। লুইগি ভাম্পার সঙ্গে তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন বা কি কাজ করেছিলেন, সে সব কথা প্যারীর লোকেরা কিছুই জানতো না। তারা শুধু জানতো যে প্যারী শহরে কাউন্ট অব্ মন্টিক্রিষ্টো নামে একজন অসাধারণ লোকের আবির্ভাব হয়েছে–যে লোক ইচ্ছা করলে গোটা ফরাসী দেশটাই কিনে নিতে পারে।
প্যারীতে যে বাড়িখানা তিনি কিনেছিলেন, সেখানাকে লোকে আগে ভূতের বাড়ি বলতো। কিন্তু ঐ ভূতের বাড়িকেই তিনি যেন আলাদীনের দৈত্যের সাহায্যে রাজপ্রাসাদে পরিণত করে। ফেলেছেন।
আমরা যেদিনের কথা বলছি, ঐ বাড়িতে এক ইটালিয়ান মেজরের শুভাগমন হয়েছিল। মেজর মহাশয়ের নাম বার্তোলোমিও ক্যাভালকান্টি। ভদ্রলোক ফাদার বুসেনি নামে এক ধর্মযাজকের কাছ থেকে একখানা পরিচয়পত্র নিয়ে কাউন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
কাউন্টের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানালেন মেজর সাহেবকে। তিনি বললেন–স্বাগতম মেজর ক্যাভালকান্টি, আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
–সে কি! আমি যে আজ আসবো সে খবর আপনাকে আগে জানাইনি!