গল্প-গুজবের মধ্যে ভোজপর্ব শেষ হলো। এর পর এলো বিদায় নেবার পালা। কাউন্টকে বিদায় সংবর্ধনা জানাবার জন্যে আলবার্ট যখন বাইরে বেরিয়ে এলেন, ঠিক সেই সময় একখানি সুদৃশ্য ল্যান্ডো এসে থামলো সেই বাড়ির ফটকে। কাউন্ট লক্ষ্য করলেন যে, ঐ গাড়ির ঘোড়ার মত সুন্দর ও আশ্চর্য রঙের ঘোড়া সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। ঘোড়াটির গায়ে জেব্রার মত ডোরা কাটা।
কাউন্ট বললেন–বাঃ! চমৎকার ঘোড়াটা তো!
আলবার্ট হেসে উত্তর দিলেন–ব্যারন ড্যাংলারের ঘোড়া। এই বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন ব্যারন ও ব্যারনেস ড্যাংলার, আর তাদের পিছনে মাদমোয়াসেল ইউজিনি।
আলবার্ট তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কাউন্টের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
কাউন্ট সসম্মানে ব্যারনেস ড্যাংলারের সামনে মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি ব্যারনেস!
ব্যারনেস তখন স্মিত হাস্যে করমর্দন করলেন তাঁর সঙ্গে।
এর পর ইউজিনির সঙ্গে করমর্দন করে কাউন্ট এগিয়ে গেলেন ব্যারন ড্যাংলারের কাছে। সাগ্রহে তার সঙ্গে করমর্দন করে কাউন্ট বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম ব্যারন। আশা করি আমাদের এই পরিচয় শীঘ্রই আরও ঘনিষ্ঠ হবে।
ব্যারন ড্যাংলার বললেন–আপনার নাম আমি আগেই শুনেছি কাউন্ট। আজ ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম।
কাউন্ট বললেন–আমিও খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে। আমার খুশি হবার আরও কারণ এই যে, আপনার ব্যাঙ্কের উপরই ‘লেটার অব গ্যারান্টি’ পাঠিয়েছেন আমার রোমের ব্যাঙ্কার মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ।
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। তারপর কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো বিদায় নিলেন।
***
পরদিন সকালে একজন সুবেশ ভদ্রলোক এসে দেখা করলেন ব্যারন ড্যাংলারের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আলাপ-পরিচয়ের পর সেই ভদ্রলোক একেবারে কাজের কথা পেড়ে বসলেন।
তিনি বললেন–আপনার ঘোড়াটা যদি বিক্রি করেন, তাহলে আমি খুব ভাল দামে বিক্রি করিয়ে দিতে পারি।
ব্যারন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন–আমি ঘোড়া বিক্রি করবো, একথা কে বলেছে আপনাকে?
–না, কেউ বলেনি, তবে আমি যাঁর কাছ থেকে এসেছি তিনি চান আপনার ঐ ঘোড়ার মত একটা ঘোড়া। তাতে যত দামই লাগে।
ব্যারন তখন কৌতুক করবার জন্য বললেন–ধরুন যদি পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দাম চাই আমি!
–আমি এখনই দিতে প্রস্তুত আছি ব্যারন। টাকা আমার সঙ্গেই আছে।
ব্যারন আশ্চর্য হয়ে গেলেন আগন্তুকের কথা শুনে। ভাবলেন–বলে কি লোকটা! পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে একটা ঘোড়া কিনতে চায়! পাগল নাকি?
ব্যারনকে চুপ করে থাকতে দেখে আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন –অত ভাবছেন কি ব্যারন? আপনি রাজী থাকলে আমি এখনই পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিতে পারি আপনাকে।
এই বলে সত্যি সত্যিই ভদ্রলোক পকেট থেকে একগাদা ব্যাঙ্ক নোট বের করে টেবিলের উপর রাখলেন!
নোটগুলো দেখে লোভে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ব্যারনের চোখ। তিনি বললেন–বেশ! আমি রাজী আছি। আপনি কি আজই নিয়ে যেতে চান ঘোড়াটাকে?
ভদ্রলোক বললেন–আজই নয়, এখনই।
ব্যারন ড্যাংলার তখন পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর নোট গুনে নিয়ে রসিদ লিখে দিলেন ভদ্রলোককে।
একটু পরেই ব্যারনের ঘোড়াটা নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
***
এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পরে কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর গাড়িখানা এসে ব্যারন ড্যাংলারের বাড়ির দরজায় থামলো। ব্যারন আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, কাউন্টের গাড়ি টানছে তার সেই ঘোড়া!
কাউন্ট গাড়ি থেকে নেমে সোজা ব্যারনের বসবার ঘরে এসে তার সঙ্গে দেখা করলেন। ব্যারন বললেন–আসুন কাউন্ট! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমি।
কাউন্ট হেসে বললেন–হ্যাঁ, বৈষয়িক ব্যাপারগুলো সেরে ফেলবার জন্য আজ আসবো বলে খবর পাঠিয়েছিলাম। তা, কাগজ-পত্রগুলো কি এখানেই দেখাবো, আপনার ব্যাঙ্কে নিয়ে যাবো?
–ওগুলো কি আপনার সঙ্গে আছে?
–হ্যাঁ, সঙ্গে নিয়েই এসেছি আমি।
–বেশ, দিন তাহলে, এখানেই দেখে নিই।
কাউন্ট তখন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির দেওয়া ‘লেটার অব গ্যারান্টি’খানা বের করে ব্যারন ড্যাংলারের হাতে দিলেন।
কাগজখানা পড়ে ব্যারনের ভ্রূ কুঁচকে উঠলো।
তিনি বললেন–এতে বোধ হয় একটু ভুল আছে। টাকার অঙ্ক লেখা নেই দেখছি।
কাউন্ট বললেন–ভুল আছে! কৈ দেখি!
এই বলে কাগজখানা ব্যারনের হাত থেকে নিয়ে তার উপর একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন–না, ভুল তত নেই।
–সে কি! এতে তো দেখছি লেখা আছে অপরিমিত টাকার ক্রেডিট আপনাকে দিতে। এরকম “লেটার অব গ্যারান্টি” তো এর আগে আর কখনও দেখিনি।
কাউন্ট হাসতে হাসতে বললেন–তাহলে আমি কি মনে করবো যে ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির এই গ্যারান্টিপত্র আপনি বিশ্বাস করছেন না, অথবা আমার প্রয়োজনীয় টাকা দেবার ক্ষমতা আপনার নেই?
কাউন্টের এই কথায় ব্যারন ড্যাংলারের মুখ লাল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন–আমার আর্থিক ক্ষমতার কথাই যখন তুললেন, তখন আমি নিশ্চয়ই আপনার হিসাব আমার ব্যাঙ্কে খুলবো। বলুন, কত টাকা দরকার হবে আপনার? দশ লাখ ফ্রাঁ!
–দশ লাখ ফ্রাঁ। কাউন্ট হেসে বললেন–দশ লাখ ফ্রাঁ তো আমার পকেটেই থাকে সব সময়। ঐ সামান্য টাকার জন্য আপনার ব্যাঙ্কে হিসাব খুলবার দরকারই হতো না।