চিঠিখানা পড়ে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–তুমি কি একা গিয়েছিলে সেখানে?
–না। এমানুয়েল আমার সঙ্গে ছিল। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
ঠিক সেই সময় আফিসের হেড-ক্লার্ক হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে।
সে এসেই বললো–ফারাওঁ! ফারাওঁ ফিরে আসছে মঁসিয়ে!
–কি বললে! তুমি কি ক্ষেপে গেলে নাকি?
–না মঁসিয়ে। পোর্ট অফিস থেকে খবর পেলাম, ফারাওঁ ফিরে আসছে। এই দেখুন পোর্ট অফিসের চিঠি।
“একি আশ্চর্য কাণ্ড! যে জাহাজ ডুবে গেছে, যার নাবিকদের উদ্ধার করে এনেছে অন্য এক জাহাজ, সেখানা কি করে ফিরে আসছে আবার!”
মঁসিয়ে মোরেলের বিশ্বাস হয় না এই অসম্ভব কথা। কিন্তু বিশ্বাস না হলেও তিনি চললেন বন্দরের দিকে। তার সঙ্গে চললো ম্যাক্সিমিলান, জুলি, মাদাম মোরেল আর এমানুয়েল। মোরেল কোম্পানির আফিসের কর্মচারীরাও চললেন এই অভাবনীয় খবর শুনে।
বন্দরে ঢুকতেই ওঁরা দেখলেন যে ইতিমধ্যেই বন্দর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। ডুবে-যাওয়া জাহাজ আবার ফিরে আসছে–এই অসম্ভব কথা শুনে মার্সেঈ-এর আবালবৃদ্ধবনিতা ভেঙে পড়েছে বন্দরে।
মঁসিয়ে মোরেল সপরিবারে বন্দরের ধারে এসে দাঁড়াতেই দেখা গেল একখানা জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। জাহাজের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা–”ফা রা ওঁ”!
সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো–ফারাওঁ! ফারাও! ফারাওঁ ফিরে আসছে!
মঁসিয়ে মোরেল যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। এ কি অসম্ভব কাণ্ড!
জাহাজখানি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো জেটির দিকে।
কাপ্তেন দাঁড়িয়ে আছে ডেকের উপরে।
হঠাৎ ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠলো–”জ্যাকোপো! জ্যাকোপো! আমার আন্তরিক ধন্যবাদ নাও বন্ধু।”
কাপ্তেন হাসিমুখে হাত উঠিয়ে অভিনন্দন জানালো সেই অদৃশ্য বক্তার উদ্দেশে। কিন্তু কে সেই বক্তা তা কেউ জানতে পারলো না।
বক্তা তখন লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল মঁসিয়ে মোরেলের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে বললো–বিদায় মঁসিয়ে মোরেল! ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনি সুখী হোন। এই বলে একটু থেমে সে মনে মনে আবার বললো–সজ্জনদের প্রতি আমার কর্তব্য এখানেই শেষ! এর পর থেকেই আরম্ভ হবে দুর্জনের বিরুদ্ধে আমার অভিযান। ফার্নান্দ! ড্যাংলার! ভিলেফোর্ট! তোমাদের দর্প চূর্ণ করতে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। তোমাদের ধ্বংসই আজ থেকে আমার সংকল্প।
.
১৯.
মার্সেঈ-এর সেই ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। প্যারিস শহরে তখন কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো নামে একজন লোক রীতিমত আঁকিয়ে বসেছেন। তার চাল-চলন আর রাজা বাদশার মত খরচের বহর দেখে সারা প্যারিস বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেছে।
প্যারিসের অভিজাত সমাজের প্রত্যেকের মুখেই তখন কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর নাম। অভিজাত মহলের প্রত্যেকটি প্রীতিভোজেই হয় কাউন্টের নিমন্ত্রণ।
সেদিন মারকাফ প্রাসাদে এমনি এক প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন ভাইকাউন্ট আলবার্ট-দ্য-মারকার্ফ। বলা বাহুল্য কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোও নিমজ্জিত হয়েছিলেন সেই প্রীতিভোজে।
কাউন্ট আসতেই আলবার্ট তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে তাকে স্বাগত জানালেন।
কাউন্ট বললেন–দেরি করে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন ভাইকাউন্ট। পনের শ’মাইল দূর থেকে আসতে হয়েছে বলেই ঠিক সময়ে পৌঁছোতে পারিনি আমি।
আলবার্ট আশ্চর্য হয়ে বললেন–দেরি! কৈ, দেরি তো হয়নি! সাড়ে দশটায় আসবার কথা ছিল আপনার, এখন তো দশটা একত্রিশও হয়নি।
কাউন্ট হেসে বললেন–কয়েক সেকেন্ড দেরিকেও আমি দেরি বলেই মনে করি।
আলবার্ট তখন কাউন্টকে তার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে বললেন–তাহলে আর বিলম্ব করে লাভ কি? আসুন, খেতে বসা যাক।
ভোজ টেবিল।
নানারকম রসনা-তৃপ্তিকর খাদ্য আর ফরাসী দেশের বিখ্যাত মদ পরিবেশন করা হয়েছিল নিমন্ত্রিতদের।
খেতে খেতে গল্প চলতে লাগলো। কথায় কথায় কাউন্ট বললেন–আপনার বিয়ের নিমন্ত্রণে কবে আসছি বলুন! আলবার্ট হেসে বললেন–আরও কিছুদিন দেরি আছে ও ব্যাপারে, তবে আমার ভাবী বধু ইউজিনি আর তার পিতা ব্যারন ড্যাংলার-এর সঙ্গে আজই আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো আশা করছি। তাদের আজ আসবার কথা আছে আমাদের বাড়িতে।
–ব্যারন ড্যাংলার! ব্যাঙ্কার কি তিনি?
–হ্যাঁ, তিনি এখন প্যারিসের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানের মালিক। আপনি চেনেন নাকি তাকে?
–না, ঠিক চাক্ষুষ পরিচয় নেই, তবে তার ব্যাঙ্কের উপরেই লেটার-অব গ্যারান্টি দিয়েছে আমার রোমের ব্যাঙ্কার মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চা কিন্তু মঁসিয়ে ড্যাংলার ব্যারন হয়েছেন, তা আমি জানতাম না।
–না জানবারই কথা, কারণ ইনি খুব অল্পদিন হলো ব্যারন। উপাধি পেয়েছেন।
–দেশ সেবার পুরস্কার বুঝি?
–অনেকটা তাই! আমাদের সরকার যখন টাকার অভাবে দেউলে হবার মত হয়েছিল সেই সময় মঁসিয়ে ড্যাংলার ষাট লাখ ফ্ৰাঁ ধার দেন সরকারকে।
এই সময় কাউন্ট হঠাৎ অন্য কথার অবতারণা করে ব্যারন ড্যাংলারের প্রসঙ্গ চাপা দেন।
এরপর আরও নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে। লাগলো সেই ভোজসভায়। নিমন্ত্রিত ভদ্রমহোদয়রা সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন কাউন্টের জ্ঞানের গভীরতা দেখে। তিনি যেন জীবন্ত একখানি বিশ্বকোষ। এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারেন না।