–আমাকে কি এখানে বন্দী করে রাখা হবে?
–তাই তো মনে হয়।
–সে কি কথা! আমাকে যে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট আশা দিলেন…
–কে তোমাকে কি আশা দিয়েছে তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন নেমে পড় দেখি। নৌকো ঘাটে এসেছে!
অন্ধকারের ভিতর থেকে কয়েকটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো নৌকোর দিকে! তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করলো– বন্দী কোথায়?
রক্ষীরা বললো–এই যে!
–ওকে নিয়ে এসো!
যন্ত্রচালিতের মত প্রহরীবেষ্টিত হয়ে এডমন্ড চলতে লাগলো কারাগারের দিকে। কিছুক্ষণ চলবার পর সেই লোকটা বললো–দাঁড়াও!
এডমন্ড সভয়ে লক্ষ্য করলো, তার সামনেই কারাগারের বিরাট লৌহকপাট।
সেই লোকটির আদেশে লৌহকপাট খুলে গেল। এডমন্ডকে ঠেলে ভিতর ঢুকিয়ে দিতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল সেই বিরাট কপাট। যেন একটা ভয়ংকর দানব গিলে ফেললো একটা ছোট্ট মানুষকে।
এডমন্ডের মাথাটা ঘুরে উঠলো।
তার মনে পড়লো বৃদ্ধ পিতার কথা–মার্সেদেসের কথা– বাড়ির কথা–মুক্ত আলো-হাওয়ার কথা।
দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার দুই গাল বেয়ে।
হঠাৎ একজন কারারক্ষী কর্কশস্বরে বলে উঠলো–এই কয়েদী! এগিয়ে আয়!
কয়েদী!
বিচার না হতেই কয়েদী হয়ে গেল সে! হায় ভগবান!
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
বন্দী আদেশ পালন করছে না দেখে কারারক্ষী তাকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে চললো ভিতর দিকে। কিছুক্ষণ চলবার পর একটা ঘরের সামনে এনে পঁড় করানো হলো তাকে। কারারক্ষী তখন সেই ঘরের দরজা খুলে তাকে এক ধাক্কায় সেই ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করতে করতে বললো–এই তোর ঘর। আজ চললাম। কাল আবার দেখা হবে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
.
পরদিন সকালে কারারক্ষী এসে দরজা খুলে দেখে, কাল। রাত্রে এডমন্ড যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এখনও ঠিক সেইখানেই সে দাঁড়িয়ে আছে। এক রাত্রেই তার চেহারা হয়েছে পাগলের মত, চোখ দুটি হয়েছে লাল টকটকে জবাফুলের মত।
রক্ষী তার কাঁধের উপরে একখানা হাত রেখে সহানুভূতির স্বরে বললো–রাত্রে ঘুমোওনি নাকি?
–জানি না।
–তোমার ক্ষিদে পেয়েছে?
–জানি না।
–তুমি কি চাও?
–গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে।
–অসম্ভব।
–কেন?
–তা নিষিদ্ধ।
–তবে কি নিষিদ্ধ নয়?
–খেতে পারো, শুতে পারো, ঘুমুতে পারো।
–আমি খেতে, শুতে, ঘুমোতে চাই না। অনাহারে মারা যেতে চাই।
–অবুঝ হয়ো না। অপেক্ষা কর। হয়তো গভর্নরের সঙ্গে একদিন তোমার দেখা হয়ে যেতে পারে।
–কতদিন পরে?
–হয়তো এক মাস, হয়তো ছয় মাস, হয়তো বা এক বৎসর।
–অতকাল অপেক্ষা করতে পারব না। আমি তার সঙ্গে এখনই দেখা করতে চাই।
–বার বার এক কথা নিয়ে অত মাথা ঘামিও না। তাহলে হয়তো পাগল হয়ে যাবে।
–পাগল হয়ে যাবো?
–হ্যাঁ। এখানে ওরকম ব্যাপার এর আগেও হয়েছে। তুমি এখন যেখানে আছ, এই ঘরেই একটা লোক পাগল হয়ে গিয়েছিলো।
–পাগল হয়ে গিয়েছিলো! বলছো কি?
–ঠিকই বলছি। পাগল হবার পর লোকটার ধারণা হয়, সে নাকি অনেক টাকার মালিক। সে বলতো তাকে ছেড়ে দিলে গভর্নরকে সে লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবে।
–কতদিন আগে সে এখানে ছিলো?
–তা প্রায় দু’বছর হবে।
–এখন সে কোথায়?
–মাটির নিচের অন্ধ-কোঠায়।
–কী ভয়ানক! মাটির নিচের ঘরে মানুষ থাকতে পারে?
–পারে কিনা নিজেই বুঝতে পারবে।
–তার মানে?
–মানে, তোমাকেও শীগগিরিই সেখানে চালান করা হবে। এডমন্ড শিউরে উঠলো এই কথা শুনে।
***
মাটির নিচের অন্ধ-কোঠা।
আলো নেই, হাওয়া নেই, কেবল আছে অন্ধকার। এই নিরন্ধ্র অন্ধকারে আর ভয়াবহ নির্জনতাকে সঙ্গী করে দিন কাটাচ্ছে এডমন্ড।
দিনে একবার আর রাতে একবার রক্ষী তার খাবার দিয়ে যায়। এডমন্ড চেয়ে চেয়ে দেখে তার আসা-যাওয়া। মুক্ত সে। ইচ্ছা করলে বাইরের মুক্ত বাতাসের স্পর্শ সে পেতে পারে– কিন্তু এডমন্ড বন্দী, অসহায়। পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে জোর করে বঞ্চিত করা হয়েছে–বিনা অপরাধে।
রক্ষীটির সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে এডমন্ড। কিন্তু লোকটা যেন বোবা।
কোন কথাই বলে না,–উত্তর দেয় না তার কোন প্রশ্নেরই।
এইভাবে কত দিন, কত মাস, কত বৎসর যে কেটে গেছে সে জানে না। কালের মাপকাঠি সে হারিয়ে ফেলেছে।
সে যখন জেলখানায় ঢুকেছিল তখন তার মুখে সবে মাত্র। দাড়ি গজাতে আরম্ভ করেছে, আর এখন তার মুখে ছয় ইঞ্চি লম্বা দাড়ি। তার চুলও বেড়ে গিয়ে পিঠের নিচে পড়েছে।
প্রথম প্রথম সে বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখতো, কিন্তু এখন আর তার মনে আশা নেই।
মানুষের সমাজ থেকে টেনে এনে অমানুষ করে রাখা হয়েছে তাকে।
.
৭.
চুপ করে শুয়েছিল এডমন্ড। ঘুম তার চোখে ছিল না। তবুও সে চেষ্টা করলো ঘুমোতে। জেগে থাকলেই রাজ্যের চিন্তা এসে তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ভূগর্ভের কত নিচে যে সে আছে তা সে জানে না। মাটির নিচের ভয়াবহ নীরবতা প্রথম প্রথম অসহনীয় মনে হলেও ক্রমে সহ্য হয়ে আসছে। বাইরের কোন শব্দই তার কানে আসে না। সেই অখণ্ড নির্জনতায় মাঝে মাঝে নিজের কণ্ঠস্বর শুনলেও সে চমকে ওঠে। ঘরের মধ্যে চলে বেড়াবার সময় নিজের পায়ের শব্দও স্পষ্টভাবে শুনতে পায় সে।
হঠাৎ তার তন্দ্রা টুটে গেল। তার মনে হলো কোথায় যেন ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। অতি ক্ষীণ আওয়াজ। ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। দেয়ালে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো শব্দটা।