মঁসিয়ে মোরেলের এই কথায় ম্যাক্সিমিলান একেবারে যেন পাথর হয়ে গেল। তার মুখ থেকে কোন কথাই বের হলো না। মঁসিয়ে মোরেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন আলমারির দিকে।
আলমারি খুলে একটা পিস্তল বের করে সেটাকে খুলে পরীক্ষা করলেন। হয়তো পিস্তলে গুলি ভরা আছে কিনা দেখে নিলেন। তারপর আবার সেটাকে বন্ধ করে পকেটে ফেলে যেমন ধীরে ধীরে গিয়েছিলেন ঠিক সেই রকম ধীরে ধীরেই ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–এইবার আমাকে আফিস ঘরে যেতে হবে। অনেক কাজ শেষ করে যেতে হবে মরবার আগে।
–আমি কি তোমার সঙ্গে আসতে পারি বাবা?
–ইচ্ছা করলে আসতে পার। আমি জানি তুমি আমাকে বাধা দেবে না।
এই বলেই মঁসিয়ে মোরেল দরজার দিকে চলতে লাগলেন। ম্যাক্সিমিলানও চলতে লাগলো তার সঙ্গে সঙ্গে।
***
ম্যাক্সিমিলানকে বাবার কাছে রেখে জুলি সেই ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ির সামনে আসতেই বাড়ির একটা চাকর একখানা খামে ভর্তি চিঠি তার হাতে দিয়ে বললো–আপনার চিঠি।
–আমার চিঠি! কে দিয়েছে?
–তা জানি না, একজন লোক এইমাত্র চিঠিখানা আমার হাতে দিয়ে বললো–এক্ষুণি চিঠিখানা মাদমোয়াসেল জুলির হাতে দিয়ে এসো।
জুলি খামখানা ছিঁড়ে চিঠি বের করে পড়তে লাগলো। চিঠিতে লেখা ছিল—
“এই চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনি এলিজ-দ্য-মিলানে চলে যান। ওখানে ১৫নং বাড়ির চারতলার দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটে যাবেন আপনি। দরজার সামনে একজন দরোয়ানকে দেখতে পাবেন। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবেন। ঘরের এক কোণে একখানি রুমালে বাঁধা কিছু জিনিস দেখতে পাবেন। রুমালখানা নিয়ে এসে আপনার বাবার হাতে দেবেন। আপনি একা যাবেন। আপনার সঙ্গে অন্য কোন লোক থাকলে দারোয়ান আপনাকে চাবি দেবে । স্মরণ রাখবেন, রুমালখানা বেলা এগারোটার আগেই আপনার বাবার হাতে আসা দরকার। আপনি আমার কথা রাখবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। প্রতিজ্ঞাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ইতি–
সিন্দবাদ নাবিক।”
চিঠিখানা পড়ে জুলি কি করবে ঠিক করে উঠতে পারলো না প্রথমটায়। একবার তার মনে হলো–হয়তো কোন দুষ্ট লোক তাকে বিপদে ফেলবার জন্য এই রকম ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সেদিনের কথা। সেই যুবকটির কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘সিন্দবাদ নাবিক’ সই করা চিঠির নির্দেশমত কাজ করবে সে।
এই সব কথা যখন সে চিন্তা করছে এই সময় এমানুয়েলকে দেখতে পেলো সে। এমানুয়েল তার বাবার ঘরের দিকে ছুটছিল। তাকে সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এমানুয়েল বললো–তুমি একটু উঁড়াও লক্ষ্মীটি, আমি এক্ষুণি আসছি। এই বলে সে মঁসিয়ে মোরেলের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পরেই মঁসিয়ে মোরেলের ঘর থেকে ফিরে এলো এমানুয়েল। জুলির হাতের চিঠিখানা দেখে সে বললো–কার চিঠি ওখানা?
জুলি চিঠিখানা এমানুয়েলের হাতে দিয়ে বললো–পড়ে দেখ।
চিঠিখানা পড়ে এমানুয়েল বললো–বেশ তো! চলো না, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
জুলি বললো–কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে দরোয়ান চাবি দেবে না, সে কথা পড়েছো তো?
–তাতে কি হয়েছে? তুমি একাই যেও। আমি তোমার জন্যে রাস্তায় অপেক্ষা করবো। যদি তোমার দেরি দেখি তখন আমি যাব।
ব্যবস্থাটা জুলির ভালই মনে হলো। ওরা তখন আর দেরি না করে ছুটলো এলিজ-দ্য-মিলানের দিকে।
***
এগারোটা বাজতে পাঁচ। মঁসিয়ে মোরেল আর ম্যাক্সিমিলান মুখোমুখি অবস্থায় টেবিলের দুই দিকে বসে।
একজন আরদালী এসে খবর দিল–টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানি থেকে একজন লোক এসেছে হুজুর।
মঁসিয়ে মোরেল বললেন–আচ্ছা তুমি যাও | দশ মিনিট পরে পাঠিয়ে দিও তাঁকে।
আবদালী চলে যেতেই পকেট থেকে পিস্তলটা বের করলেন মাসিয়ে মোরেল।
ম্যাক্সিমিলানের দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার মা আর জুলিকে তুমি…
…বাবা! বাবা!! বাবা!!!
হঠাৎ ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে জুলি এসে ঢুকলো সেই ঘরে।
মঁসিয়ে মোরেলের হাতে তখন গুলি-ভরা পিস্তল।
জুলি চিৎকার করে বলে উঠলো-বাবা! আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি! আমাদের কোম্পানির আর কোন দেনা নেই।
–আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি! কোম্পানি রক্ষা পেয়ে গেছে! কি বলছো জুলি!
–ঠিকই বলছি বাবা। এই দ্যাখো!
এই বলে সে রুমালে বাঁধা একটা ছোট পোঁটলা মঁসিয়ে মোরেলের হাতে দিল।
মঁসিয়ে মোরেল রুমালখানা খুলতেই দেখলেন যে, তার মধ্যে একখানা ভাজ-করা কাগজ।
কাগজখানার ভাজ খুলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানি তাদের সম্পূর্ণ টাকা বুঝে পেয়ে রসিদ লিখে দিয়েছে। কাগজখানা সেই রসিদ।
রুমালের আর এক কোণে কি একটা জিনিস বাঁধা ছিল। উঁসিয়ে মোরেল কম্পিতহস্তে সে দিকটা খুলতেই দেখতে পেলেন, তার মধ্যে রয়েছে একখানা মহামূল্য হীরে আর একখানা ছোট কাগজ। কাগজখানায় লেখা—
“জুলির বিয়েতে যৌতুক।”
কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলেন না মঁসিয়ে মোরেল। কেবল রুমালখানা দেখে তার যেন মনে পড়তে লাগল যে, ওখানা একদিন তাঁরই ছিল।
কিছুই বুঝতে না পেরে জুলির দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–একি ব্যাপার জুলি? এ তুমি কোথায় পেলে?
জুলি তখন সিন্দবাদ নাবিকের লেখা সেই চিঠিখানা বাবার হাতে দিয়ে বললো–এই চিঠির নির্দিষ্ট স্থানে।