–হ্যাঁ, আমারই নাম জুলি। আপনি আমার নাম জানেন দেখছি!
মেয়েটির কথার সোজা উত্তর না দিয়ে যুবকটি বললো– একদিন ‘সিন্দবাদ নাবিক’ এই নাম সই-করা একখানা চিঠি আপনি পাবেন। ঐ চিঠির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন আপনি। মনে রাখবেন, আপনার বাবার তাতে উপকার হবে। বলুন করবেন?
–করবো।
–প্রতিজ্ঞা করছেন?
–করছি।
–বেশ, আমি তাহলে যাচ্ছি। কথাটা দয়া করে গোপন রাখবেন আশা করি।
এই বলেই যুবকটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
.
১৮.
৫ই সেপ্টেম্বর।
সেই যুবকটি বিদায় নিয়ে যাবার পর ঠিক তিন মাস অতীত হয়েছে আজ। এগারোটার সময় আসবার কথা আছে তার।
মঁসিয়ে মোরেলের মনের অবস্থা আজ খুবই খারাপ। সকালে। ঘুম থেকে উঠে যথারীতি সবার সঙ্গে বসে প্রাতরাশ শেষ করেছেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেছেন শোবার ঘরের দিকে। শোবার ঘরে গিয়ে একটা আলমারি খুলতে গিয়ে দেখতে পেলেন আলমারিটা চাবি বন্ধ। তিনি জুলিকে ডাকেন।
জুলি এলে গম্ভীরভাবে তিনি বললেন–আলমারির চাবিটা দাও তো মা!
–কেন বাবা?
–দরকার আছে।
–কি দরকার আমাকে বলো না!
–তর্ক করো না জুলি। যা বলছি তাই কর।
বাবার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার এর আগে কখন পায়নি জুলি। তার চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। চাবিটা বাবার হাতে দিল সে।
চাবিটা হাতে পেয়ে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–তুমি এখন তোমার মায়ের কাছে যাও। আমি না ডাকলে এ ঘরে যেন কেউ না আসে।
–আমি তোমার কাছে থাকতে চাই বাবা। আজ আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না! না–না–কিছুতেই যাব না। মঁসিয়ে মোরেল স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন–ছেলেমানুষী করো না মা, যাও। তুমি তো আমার কথার অবাধ্য হওনি কোনদিন!
–আগে হইনি, কিন্তু আজ হবো। আমি বুঝতে পারছি, তুমি আজ একটা সাংঘাতিক কিছু করবার মতলব করছো! এমন সময় সৈনিকের বেশধারী একটি যুবক এসে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে। মঁসিয়ে মোরেল তাকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন
–ম্যাক্সিমিলান!
জুলি বললো–দাদা! দাদা এসে গেছে! তাহলে আর আমার কোন ভয় নেই। তুমি বাবার কাছে বসো দাদা। এখান থেকে এক মিনিটের জন্যও বাইরে যেয়ো না, বুঝলে!
–কি হয়েছে জুলি? ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো।
–তা ঠিক জানি না দাদা, কিন্তু আজ বাবাকে একলা ছেড়ে যেতে আমার ভয় করছে।
এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
জুলি চলে যেতেই ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো–কি হয়েছে বাবা?
মঁসিয়ে মোরেল তার প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে বললেন– হঠাৎ চলে এলে যে? ছুটি পেয়েছে নাকি?
–না, ছুটি নিয়ে এসেছি।
–ছুটি নিয়ে এসেছে! কেন বলো তো?
–তা ঠিক বলতে পারি না। মায়ের কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে এসেছি আমি।
কি হয়েছে বাবা?
মঁসিয়ে মোরেল গম্ভীর স্বরে বললেন–বসো, বলছি।
ম্যাক্সিমিলান বসলে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–ফারাওঁ ডুবে গেছে শুনেছো?
–ফারাওঁ ডুবে গেছে!
–হ্যাঁ বাবা, আজ আমরা সর্বস্বান্ত! মোরেল অ্যান্ড সন আজ তাদের দেনার টাকা দিতে অক্ষম।
এই কথা বলবার সময় মঁসিয়ে মোরেলের চোখ দুটি জলে ভরে এলো।
ম্যাক্সিমিলান বললো–আমাদের কত টাকা দেনা বাবা?
–পাঁচ লাখ ফ্রাঁ।
–কত আছে আমাদের?
–সতের হাজারের বেশি নয়।
–মাত্র?
–হ্যাঁ বাবা, মাত্র সতের হাজার।
–আর কোথাও কিছু পাওনা নেই?
–না। আর থাকলেও তা পাওয়া যাবে না।
–আমাদের তো বহুদিনের ব্যবসা। এমন কোন শুভানুধ্যায়ীও কি নেই আমাদের, যাঁর কাছ থেকে ধার পাওয়া যায়?
ম্যাক্সিমিলানের এই কথায় ম্লান হেসে মঁসিয়ে মোরেল বললেন–ব্যবসার জগতে শুভানুধ্যায়ী বলে কোন কথা নেই। এখানে সবাই চায় লাভ–মুনাফা।
এই সময় আফিসের তরুণ ম্যানেজার এমানুয়েল ছুটতে ছুটতে সেই ঘরে এসে বললো–চৰ্বিশ হাজার ফ্রাঁর একখানা ড্রাফট এসেছে এইমাত্র।
মঁসিয়ে মোরেল আশ্চর্য হয়ে বললেন কি বললে! চব্বিশ হাজার ফাঁর ড্রাফট! আচ্ছা, তুমি যাও।
এমানুয়েল চলে যেতেই ম্যাক্সিমিলান জিজ্ঞাসা করলো– এমানুয়েলের সঙ্গে জুলির বিয়ের কি হলো বাবা?
–হবে না।
–হবে না!
–না। একজন দেউলের মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
–দেউলের মেয়ে?
–হ্যাঁ ম্যাক্সিমিলান, দেউলের মেয়ে। তোমার বাবা আজ দেউল, ফাঁকিবাজ, পাওনাদারদের দেনা মেটাতে অক্ষম। এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন
–এ অবস্থায় আমার কি কর্তব্য বলতে পারো?
ম্যাক্সিমিলানের দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বেরুলো না।
এই সময় ঘড়িতে দশটা বাজার শব্দ হলো।
মঁসিয়ে মোরেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন–আর এক ঘণ্টা পরে টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির প্রতিনিধি আসবে আমার কাছে! ওরা আমার কাছে পাঁচ লাখ ফ্রাঁ পায়। যে প্রতিনিধি আসবে, তার মত ভদ্র যুবক আমি খুব কমই দেখেছি। আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগে সে আমার কাছে এসেছিল। আমি তখন বলেছিলাম যে ফারাওঁ’ ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি টাকা দিতে অক্ষম। এই কথা শুনে যুবক নিজের দায়িত্বে আমাকে তিন মাসের সময় দিয়ে গিয়েছিল। আজ বেলা এগারোটায় সেই তিন মাস উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। ঠিক এগারোটায় সে আসবে টাকা নিতে।
–তাকে কি বলা হবে বাবা?
–কিছুই বলা হবে না। রক্ত দিয়ে অক্ষমতার অসম্মানকে ধুয়ে দেব। আমি আত্মহত্যা করবো।
–আত্মহত্যা করবে?
–হ্যাঁ ম্যাক্সিমিলান। আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। জোচ্চোর নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে আমি চাই না। তুমি সৈনিক, আশা করি আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারছে।