সেই আবেদনপত্র পড়ে যুবকটির চোখ দুটি হঠাৎ যেন জ্বলে উঠলো।
এই সময় দলিল নিয়ে মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের বাড়ি থেকে লোক এসে পড়ায় যুবকটির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন– দেখা হলো আপনার?
যুবকটি তাড়াতাড়ি বইখানা বন্ধ করে বললো-হা, হয়েছে। দলিলখানা এসেছে কি?
এ মঁসিয়ে বোভাইল বললেন–হ্যাঁ, এই যে!
যুবকটি তখন দলিলখানা হাতে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললো–বেশ আপনি লিখে দিন যে, সুদসহ পুরো টাকার বিনিময়ে এই দলিল আপনি রোমের “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানিকে হস্তান্তরিত করলেন।
লেখা শেষ হলে যুবকটি তার ব্যাগ খুলে নগদ দুই লাখ ছয় হাজার ফ্রাঁর নোট মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলকে গুনে দলিলখানা নিয়ে বিদায় হলো।
.
১৭.
সুপ্রসিদ্ধ জাহাজী প্রতিষ্ঠান ‘মোরেল অ্যান্ড সন’-এর আফিস।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এখনও বেশ ভাল ভাবেই চলছে এঁদের ব্যবসা, কিন্তু আসলে ঠিক তার উল্টোটি। কোম্পানির পাঁচখানা জাহাজের মধ্যে একমাত্র ফারাওঁ জাহাজখানা ছাড়া বাকি চারখানাই ডুবে গেছে। চারখানা জাহাজ পর পর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মোরেল কোম্পানির যে বিরাট ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতিপূরণ করতে তাদের যাবতীয় রিজার্ভ ফান্ড নিঃশেষিত হয়ে যায়।
কিন্তু তাতেও দেনা শোধ হয় না। এখনও কমপক্ষে পাঁচ লাখ ফ্র দেনা এই কোম্পানির। এই রকম যখন কোম্পানির অবস্থা ঠিক সেই সময় আর এক অভাবনীয় বিপদ এসে উপস্থিত হলো। কয়েক দিন আগে রোমের ‘মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানি মঁসিয়ে মোরেলকে এখানা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, তারা মোরেল কোম্পানির যাবতীয় দেনা কিনে নিয়েছে। চিঠিতে এ-কথাও তারা লিখেছে যে, কোম্পানির পক্ষ থেকে ৬ই মে তারিখে একজন প্রতিনিধি যাবে তার কাছে–দেনার টাকা সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতে।
আজ সেই ৬ই মে।
মঁসিয়ে মোরেল চিন্তিতমুখে আফিসে বসে আছেন। বেলা তখন প্রায় এগারোটা। এই সময় ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ’ কোম্পানির প্রতিনিধির কার্ড পেলেন তিনি।
কার্ডখানা হাতে পেয়েই তিনি নিয়ে আসতে বললেন। আগন্তুককে। একটু পরেই যে ইংরেজ যুবকটি সেই ঘরে এসে ঢুকলো, তাকে আপনারা এর আগে দু’বার দেখেছেন। একবার মেয়রের ঘরে, আর একবার মঁসিয়ে-দ্য-বোভাইলের আফিসে।
যুবকটি এসেই সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানালো মাসিয়ে মোরেলকে।
মঁসিয়ে মোরেল বললেন–বসুন।
যুবকটি বসলে মঁসিয়ে মোরেল আবার বললেন–আপনিই এসেছেন ‘টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ কোম্পানির তরফ থেকে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–আমাদের যাবতীয় দেনার দলিল আপনারা কিনে নিয়েছেন?
–সেই রকমই আমি শুনেছি।
যুবকের এই কথায় মঁসিয়ে মোরেল ম্লান হেসে বললেন– কিন্তু আমাদের কোম্পানির দেনাগুলো কিনে নেবার কারণটা দয়া করে জানাবেন কি?
–তা আমি ঠিক বলতে পারি না। একথা একমাত্র কর্তৃপক্ষই বলতে পারেন। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনার সঙ্গে দেখা করে কবে টাকাগুলো দিতে পারবেন, সেই তারিখটা জেনে নিতে। টাকাগুলো কি আজই দিতে পারবেন? দলিলপত্র আমার সঙ্গেই আছে।
মঁসিয়ে মোরেল ম্লান হেসে বললেন–ধন্যবাদ! কিন্তু আজ আমি টাকা দিতে পারবো না।
যুবকটি আশ্চর্য হয়ে বললো–বলেন কি মঁসিয়ে মোরেল! মোরেল কোম্পানির মত নামকরা প্রতিষ্ঠান দেনার টাকা দিতে দেরি করবে–এ যে বিশ্বাসেরও অযোগ্য!
যুবকের এই কথায় মঁসিয়ে মোরেল হাসবার চেষ্টা করে বললেন–বিশ্বাসের অযোগ্য হলেও এ কথা সত্যি। দেনার টাকা শোধ করবার ক্ষমতা আমার নেই। আমার এখন একমাত্র ভরসা–ফারাওঁ জাহাজ। আগস্টের শেষের দিকে জাহাজখানা ফিরে আসবার কথা আছে। জাহাজখানা যদি নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারে, তাহলেই আমি দেনা শোধ করতে পারবো, নইলে ‘মোরেল অ্যান্ড সনে’র নাম জাহাজী প্রতিষ্ঠানসমূহের রেকর্ড থেকে চিরদিনের মত লুপ্ত হয়ে যাবে। যুবকটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো–বেশ, আমি আপনাকে তিন মাসের সময় দিচ্ছি। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ৫ই তারিখে বেলা ঠিক এগারোটার সময় আমি আসবো আবার। ঐ দিন যেন আমাকে ফিরে যেতে না হয়, দয়া করে সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখবেন।
পাওনাদারের কাছ থেকে তিন মাসের সময় পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন মঁসিয়ে মোরেল।
তিনি বললেন–কিন্তু এই সময় দেওয়াতে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নিশ্চয়ই?
যুবকটি হেসে বললো–তা একটু হবে বৈ কি! কিন্তু আপনার মত একজন সম্ভান্ত ও সৎ ব্যবসায়ীকে বিব্রত করতে আমি চাই না। আপনার সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট খবরাখবর নিয়েছি। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু জেনে রাখুন যে আপনার পাওনাদাররা পর্যন্ত আপনার জন্য দুঃখিত। আচ্ছা, আজ আমি উঠি। সেপ্টেম্বর মাসের ৫ই তারিখে ঠিক এই সময় আমি আবার আসবো।
যুবকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মঁসিয়ে মোরেল অনুচ্চকণ্ঠে বললেন–নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবো মহান যুবক। যদি না পারি তাহলে আমাকে আর জীবিত দেখবেন না আপনি।
.
মঁসিয়ে মোরেলের ঘর থেকে বের হতেই যুবকটি দেখতে পেলো যে একটি তরুণী চুপ করে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
যুবকটি তার পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে বলে উঠলো-বাবার সঙ্গে আপনার কথাগুলো আমি সব শুনেছি। আপনি আমার এবং আমার মায়ের তরফ থেকে ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।
যুবকটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটির সামনে। তার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল–জুলি! পরক্ষণেই তাড়াতাড়ি আত্মসংবরণ করে নিয়ে সে আবার বললো–আপনিই কি মাদমোয়াসেল জুলি?