–কী বললেন? মার্সেদেস? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার নামও যে লেখা আছে আমার নোট বইতে! সে এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?
–পারি বৈ কি! সে এখন প্যারিসের একজন বিখ্যাত মহিলা কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ।
–কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ! কে এই কাউন্ট?
–আগে এর নাম ছিল ফার্নান্দ মন্ডেগু।
কাদারুজের এই কথায় ধর্মযাজক হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন। তারপর অতি কষ্টে মনের ভাব গোপন করে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন–এই কাউন্টের সঙ্গে মার্সেদেস-এর বিয়ের ইতিহাসটা দয়া করে বলবেন কি?
–বলবো বৈকি? আগেই বলেছি ঐ কাউন্টের নাম ছিল ফার্নান্দ। সে মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এডমন্ড বাইরে থাকতেই।
–তারপর?
–মার্সেদেস কিন্তু মোটেই আমল দিত না তাকে। সে মনেপ্রাণে এডমন্ডকেই ভালবাসতো।
কাদারুজের এই কথায় ধমর্যাজক হেসে উঠে বললেন–হ্যাঁ, মনেপ্রাণে ভালবাসার নমুনাই সে দেখিয়েছে বটে!
ধর্মযাজকের এই কথায় আহত হয়ে কাদারুজ বললো–এ কথা বলবেন না ধর্মাত্মন! আমি জানি এডমন্ডকে সে কতখানি ভালবাসতো! এডমন্ডের জেল হবার পর ফার্নান্দ তার কাছে বহুবার বিয়ের প্রস্তাব করে, কিন্তু প্রতিবারই সে ঘৃণার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রায় তিনটি বৎসর। সে অপেক্ষা করেছিল এডমন্ড ফিরে আসবে এই আশায়। কিন্তু শেষ যখন তার মৃত্যুসংবাদ এনে দেখায় ফার্নান্দ, তখন সে একেবারে ভেঙে পড়ে।
–মৃত্যুসংবাদ এনে দেখায়! কী ব্যাপার বলুন তো?
–ঠিকই বলছি। ফার্নান্দ তাকে প্রকিওরার-এর সইকরা একখানা চিঠি দেখায়। ঐ চিঠিতে লেখা ছিল যে এডমন্ড জেলখানায় মারা গেছে।
–তারপর?
–তারপরও ফার্নান্দকে বিয়ে করতে সে চায় না। কিন্তু ক্রমে তার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে ওঠে যে, নিতান্ত বেঁচে থাকবার প্রয়োজনেই সে ফার্নান্দকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
–কিন্তু ফার্নান্দ কাউন্ট হলো কি করে?
–সে এক লম্বা ইতিহাস। নেপোলিয়ান যখন এলবা থেকে ফিরে আসেন, সে তখন তাঁর সেনাদলে যোগ দেয়। তারপর ওয়াটারলুর যুদ্ধের কিছুদিন আগে সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার শত্রুপক্ষে যোগ দেয়, ফলে তার পদোন্নতি হয়। ফার্নান্দ জাতিতে ছিল স্পেনিস। স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যখন যুদ্ধ বাধে সেই সময় সে (স্পনের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করে। যে সেনাধ্যক্ষের অধীনে সে কাজ করতো, সে তখন জেনিনার সুলতান আলী পাশার সেনাপতি হয়ে জেনিনায় চলে যায়। ফার্নান্দও যায় তার সঙ্গে। সেখানে গিয়ে ফার্নান্দ ক্রমে সেনাপতির পদ পায়। তারপর গুপ্তঘাতকের হাতে আলী পাশা নিহত হবার পর ফার্নান্দ আবার ফ্রান্সে ফিরে আসে। সেনাপতির পদমর্যাদা এবং প্রচুর অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসার ফলে এখানেও সে রাজসম্মান লাভ করে। রাজা তাকে কাউন্ট-দ্য-মারকার্ফ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।
এই সময় ধর্মযাজক বললেন–কিন্তু এডমন্ডের ইচ্ছা অনুসারে এই ফার্নান্দকেও যে হীরে বিক্রির টাকা থেকে এক ভাগ দিতে হবে! তার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে ফার্নান্দও একজন, আর দুজনের মধ্যে একজন আপনি, আর একজনের নাম ড্যাংলার।
কাদারুজ বললো–কি বললেন! ফার্নান্দ আর ড্যাংলার এডমন্ডের বন্ধু! হায় ভগবান!
ধর্মযাজক আশ্চর্য হয়ে বললেন–আপনি কি তাহলে বলতে চান যে ওরা এডমন্ডের বন্ধু নয়?
কাদারুজ ম্লান হেসে বলে উঠলো–ওরা তার মহাশত্রু। বেচারা এডমন্ড যদি জানতো যে, ওরাই তাকে জেলে পাঠিয়েছিল, তাহলে বোধ হয় ঘৃণায় ওদের নামও সে মুখে আনতো না।
–ওরাই তাকে জেলে পাঠিয়েছিল! বলেন কি মঁসিয়ে কাদারুজ!
–ঠিকই বলছি। আমি ছাড়া আর কেউ জানে না সে কথা। হয়তো জানতোও আর কেউ যদি আপনি হঠাৎ তার খবর নিতে না এসে পড়তেন।
এই বলে কাদারুজ বর্ণনা করতে আরম্ভ করলো বহুদিন আগের সেই রেস্তোরাঁর ঘটনা। নিজের কথা গোপন রাখলো না, সে ধর্মযাজকের কাছে।
সব কথা বলা হয়ে গেলে সে বললো–এইবার বুঝলেন তো, কি রকম বন্ধু ওরা এডমন্ডের!
ধমর্যাজক এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলেন সেই জঘন্য চক্রান্তের কাহিনী। সব শুনে তিনি বললেন–ওরা তো বড় ভয়ানক লোক দেখছি। এ সব কথা জানবার পর আমি কিছুতেই এই হীরের অংশ ওদের দিতে পারি না। এ হীরে আমি আপনাকেই দান করলাম। আমার মনে হচ্ছে এডমন্ডের পরলোকগত আত্মা এতে সন্তুষ্টই হবে।
এই বলে তিনি হীরেখানা কাদারুজের সামনে ঠেলে দিলেন। কাদারুজ হীরের বাক্সটা টেনে নিল। আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
তার চোখে জল দেখে ধমর্যাজকের চোখেও জল এসে পড়লো। তিনি বললেন–আমি বুঝতে পারছি, মঁসিয়ে কাদারুজ, এডমন্ডকে আপনি খুবই ভালবাসতেন।
কাদারুজ চোখের জল মুছে বললো–অভাব আর সংসারের চাপে তাকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে সে মৃত্যুর সময়েও ভোলেনি। আমি পাষণ্ড, সব জেনেও আমি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করিনি; আমি…
কাদারুজের কথায় বাধা দিয়ে ধর্মযাজক বললেন–ও সব কথা তুলে দুঃখ পাবেন মঁসিয়ে। নিয়তির উপর কারো কোন হাত নেই। এই বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন–আচ্ছা, মঁসিয়ে মোরেলের খবর কিছু জানেন কি?
–মঁসিয়ে মোরেলের খবর? তা জানি বৈকি! তিনি আজ দেনায় ডুবতে বসেছেন। আগের দিনের সেই সম্মান ও প্রতিষ্ঠা আজ আর তার নেই। শুনতে পাই, এখানকার মেয়র নাকি অনেক টাকা পান তার কাছে। আমার মনে হয়, মেয়রের কাছে গেলেই তাঁর সম্বন্ধে সব খবর পেয়ে যাবেন।