খেতে খেতে ধর্মযাজক বললেন–এইবার শুনুন, কি জন্য আপনার কাছে এসেছি আমি।
কাদারুজ একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ধর্মযাজকের পাশে বসে বললো–বলুন।
ধর্মযাজক বললেন–এডমন্ড দান্তে বলে কোন লোককে আপনি চিনতেন কি?
–চিনতাম বৈকি! এডমন্ড আমার বিশেষ বন্ধু ছিল! সে কোথায় আছে এখন, বেঁচে আছে তো?
–না, সে মারা গেছে।
–মারা গেছে? কবে? কোথায়?
–অনেকদিন আগে, স্যাটু-দ্য-ইফ কারাগারে।
এই কথা শুনে কাদারুজের মুখখানা হঠাৎ যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বললো–বেচারা এডমন্ড! কোন অপরাধ না করেও কারাগারে মৃত্যু হলো তার, অথচ তার শত্রুরা আজ—
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ চুপ করে গেল সে।
ধর্মযাজক বললেন–’শত্রুরা’ কি বলছিলেন?
অতি কষ্টে আত্মদমন করে কাদারুজ বললো–ও কিছু না। যাই হোক! এডমন্ড সম্বন্ধে কি জানতে চান আমার কাছে?
–জানতে চাই অনেক কথাই। মৃত্যুকালে সে আমাকে একটা অনুরোধ করেছিল। মৃত্যুপথযাত্রীর সেই শেষ অনুরোধ রক্ষা করতেই আমি এসেছি।
–কি অনুরোধ করেছিল সে, জানতে পারি কি?
–নিশ্চয়ই পারেন। সে আমার হাতে একখানা দামি হীরে তুলে দিয়ে অনুরোধ করেছিল, ঐ হীরেখানা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা পাঁচজন লোকের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিতে হবে। এই পাঁচজনের মধ্যে আপনিও একজন।
কাদারুজ আশ্চর্য হয়ে বললো–হীরে! এডমন্ড হীরে কোথায় পেলো?
ধর্মযাজক হেসে বললেন–সে এক কাহিনী। এডমন্ড মারা যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিল সে কথা। সে বলেছিল যে ঐ হীরেখানা ধর্মযাজক ফারিয়া মরবার সময় তাকে দিয়ে যান।
–ধর্মযাজক ফারিয়া! জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ অধ্যাপক ফারিয়ার কথা বলছেন কি আপনি?
–হ্যাঁ, তিনিই। শুনেছেন, বোধ হয়, রাজদ্রোহের অপরাধে তাকে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হীরেখানা এডমন্ডের হাতে দিয়ে যান।
এই বলে পকেট থেকে ছোট একটা চামড়ার বাক্স বের করে সেটাকে খুলে ফেললেন তিনি।
কাদারুজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, বাক্সের মধ্যে বড় একখণ্ড মিছরির টুকরোর মত একখানা হীরে জ্বলজ্বল করছে।
অত বড় হীরে কাদারুজ জীবনেও দেখেনি, তাই সে বিস্ময়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো–কত দাম হবে হীরেখানার?
–তা পঞ্চাশ হাজার ফ্ৰাঁ তো বটেই!
–কি বললেন? প-ঞ্চা-শ-হা-জা-র-ফ্রাঁ!
ধর্মযাজক বললেন–তা তো হবেই, কিছু বেশিও হতে পারে। যাই হোক, এইবার শুনুন এডমন্ডের কথা।
কাদারুজের দৃষ্টি তখনও সেই হীরেখানার দিকে। অতি কষ্টে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে এনে সে বললো–বলুন!
ধর্মযাজক বলতে আরম্ভ করলেন–জেলখানার কয়েদীদের মৃত্যুর পূর্বে ধর্মযাজকের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। আমারই উপর পড়েছিল তার শেষ যাত্রার পথ সুগম করবার ভার! আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন তার মৃত্যুর আর বেশি দেরি ছিল না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বাইবেল পাঠ শেষ হয়ে গেলে সে আমাকে এই হীরেখানা দিয়ে অনুরোধ করলো–”এই হীরেখানা বিক্রি করে আমার পাঁচজন আত্মীয় বন্ধুর মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেবেন।” এই পাঁচজনের মধ্যে প্রথমেই ছিল লুই দান্তের নাম।
কাদারুজ বলে উঠলো, তিনি আজ আর বেঁচে নেই, শেষ সময়টা খুবই দুঃখকষ্টে কেটেছে তার।
–তার কি কোন অসুখ করেছিল?
ধর্মযাজকের এই প্রশ্নে ম্লান হেসে কাদারুজ বললো–অসুখ! হ্যাঁ, অসুখ একটা কিছু নিশ্চয়ই করেছিল। তবে আমি যতদুর জানি, তিনি না খেতে পেয়ে মারা গেছেন।
–কি বললেন! না খেতে পেয়ে মারা গেছেন তিনি!
ধর্মযাজকের কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন কান্নায় অবরুদ্ধ হয়ে এলো। তার হঠাৎ ঐ রকম ভাবান্তর দেখে কাদারুজ ব্যস্ত হয়ে বললো–না, মানে আমি ঠিক জানি না, তবে লোকে সেইরকমই বলতো বটে।
ধর্মযাজক তখন সহজ কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলেন– তাঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, দয়া করে খুলে বলুন আমাকে!
কাদারুজ বললো–কি আর বলবো ধর্মাত্মন! বৃদ্ধ ছিলেন খুবই ভাল লোক।
আমি তাকে ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। আমি তখন দরজির কাজ করি। এডমন্ড ধরা পড়বার পর থেকেই তিনি যেন কেমন হয়ে যান। কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না। কারও কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যও তিনি চাইতেন না। একমাত্র মঁসিয়ে মোরেলই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন। মঁসিয়ে মোরেল অবশ্য উপযাচক হয়েই সাহায্য করতেন। আর একটি মেয়ে তাঁকে সাহায্য করতো, তার নাম মার্সেদেস। এডমন্ড ধরা না পড়লে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত।
–কী বললেন? মার্সেদেস? হা, হ্যাঁ, তার নামও যে লেখা আছে আমার নোট বইতে! সে এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?
–পারি বৈ কি! সে এখন প্যারিসের একজন বিখ্যাত মহিলা কাউন্টেস-দ্য-মারকার্ফ।
–কাউন্টেস-দ্য-মারকা! কে এই কাউন্ট?
–আগে এর নাম ছিল ফার্নান্দ মন্ডেগু।
বললো–না, মানে আমি ঠিক জানি না, তবে লোকে সেইরকমই বলতো বটে।
ধর্মযাজক তখন সহজ কণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করলেন– তাঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, দয়া করে খুলে বলুন আমাকে!
কাদারুজ বললো–কি আর বলবো ধর্মাত্মন! বৃদ্ধ ছিলেন খুবই ভাল লোক।
আমি তাকে ছেলেবেলা থেকেই জানতাম। একই বাড়িতে আমরা থাকতাম। আমি তখন দরজির কাজ করি। এডমন্ড ধরা পড়বার পর থেকেই তিনি যেন কেমন হয়ে যান। কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেন না। কারও কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যও তিনি চাইতেন না। একমাত্র মঁসিয়ে মোরেলই তাঁকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন। মঁসিয়ে মোরেল অবশ্য উপযাচক হয়েই সাহায্য করতেন। আর একটি মেয়ে তাঁকে সাহায্য করতো, তার নাম মার্সেদেস। এডমন্ড ধরা না পড়লে ঐ মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হত।