এডমন্ড হেসে বললো–কিছু কিছু আছে বৈ কি? কিন্তু যে দামই আপনি চান, আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি, আর চান তো দামটা আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিতে প্রস্তুত।
মালিক তখন আগন্তুকের আর্থিক অবস্থা বুঝবার জন্য একটা অবিশ্বাস্য অঙ্ক দাবি করে বসলেন।
দাবির অঙ্কটা শুনে এডমন্ড কিন্তু মোটেই ঘাবড়ালো না। একটু হেসে সে বললো–টাকাটা কি এখনই চান?
–এখনই চাই! তার মানে? আপনি এত টাকা পকেটে করে নিয়ে এসেছেন নাকি?
এডমন্ড তখন তার হাতের ছোট্ট অ্যাটাচি কেসটা খুলতে খুলতে বললো–এই সামান্য টাকাও যদি সঙ্গে না থাকে, তাহলে কি “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির মত বিখ্যাত কোম্পানি কিনতে সাহসী হই?
এই বলে সত্যি সত্যিই সে এক গাদা নোট বের করে মালিকের টেবিলের উপর রেখে বললে–গুনে নিন।
ঐ দিনই লেখাপড়া হয়ে গেল। “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির নতুন মালিক হলেন লর্ড উইলমোর।
এর কয়েকদিন পরে এলিজ দ্য মিলান গ্রামের একখানা চারতলা বাড়ির দরজার সামনে একজন ইংরেজ ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
বাড়ির লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো–কাকে চান আপনি?
ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন–এই বাড়ির চারতলায় লুই দান্তে নামে একজন বৃদ্ধ থাকতেন; তার কোন খবর আপনারা জানেন কি?
–লুই দান্তে! না মশাই, ওরকম নামেরই কোন লোক এ বাড়িতে ছিলেন কিনা বলতে পারি না। আপনি বরং চারতলায় যে ভদ্রলোক আছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
ইংরেজ ভদ্রলোক তখন চারতলায় উঠে গিয়ে একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে কি ভাবলেন, তারপর ঘরের বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বললেন–ভিতরে কে আছেন, দয়া করে একটু বাইরে আসবেন কি?
একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বললেন–কি চাই আপনার?
–না, চাইনে কিছু, এই ঘরে অনেকদিন আগে আমার এক আত্মীয় থাকতেন কিনা!
–কি নাম আপনার আত্মীয়ের?
–লুই দান্তে।
–লুই দান্তে!
–হ্যাঁ, লুই দান্তে, তার কি হয়েছে বলতে পারেন কি?
–তা তো জানি না। আপনি বরং বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
–বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা আমি আগেই করেছিলাম। আপনি জেনে রাখুন, এ বাড়ির মালিক এখন আমিই।
–আপনি! আপনিই কি লর্ড উইলমোর?
–হ্যাঁ, লোকে ঐ নামেই আমাকে ডাকে বটে।
ভাড়াটে ভদ্রলোক তখন সঙ্কোচে জড়সড় হয়ে গেলেন লর্ড উইলমোরের সামনে। তিনি বললেন–আমার প্রতি কোন আদেশ আছে কি স্যর?
–আদেশ নয়, অনুরোধ। আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে আমার।
–কি অনুরোধ, বলুন?
–আপনাকে এই ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য এর পরিবর্তে আর একটা ফ্ল্যাট আপনাকে দিতে রাজী আছি আমি। আমার এই অনুরোধটা যদি আপনি রাখেন, তাহলে নতুন ফ্ল্যাটের দরুন আপনাকে কোন ভাড়া দিতে হবে না। এরকম লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, এরকম বেকুব ভাড়াটে দুনিয়ার কোথাও থাকতে পারে না। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন।
লর্ড বললেন–তাহলে আর দেরি করবার দরকার নেই, আজই আপনি তেতলার খালি ফ্ল্যাটটাতে চলে যেতে পারেন। আরামের দিক দিয়ে ঐ ফ্ল্যাটটি এর থেকে অনেক বেশি কাম্য।
ভাড়াটে ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জিনিসপত্র তেতলার ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত করে ফেললেন। লর্ড উইলমোর তখন চারতলার সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বালকের মত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন,–“বাবা! বাবা!”
.
১৫.
কয়েক দিন পরের কথা।
সেদিন কাদারুজ তার রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছিল, কোন খদ্দের আসে কি না।
সকাল থেকে একজন খদ্দেরও আসেনি সেদিন। আর আসবেই বা কেন? কী আছে কাদারুজের রেস্তোরাঁয়? ভাল ভাল খাবার ওখানে মোটেই তৈরি হয় না। তাছাড়া মদও বেশি থাকে না ওখানে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের কথাই চিন্তা করছিল সে। ভিতরের ঘর থেকে তার রুগণা স্ত্রীর খনখনে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–ওগো! কোথায় গেলে?
কাদারুজ উত্তর দিলো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার দিকে চেয়ে। তার দৃষ্টি তখন উদাস…করুণ।
এই সময় হঠাৎ তার নজরে পড়লো একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে তার রেস্তোরাঁর দিকে আসছে। লোকটিকে দেখে ধর্মযাজক বলে মনে হলো কাদারুজের।
একটু পরেই সেই ধর্মযাজক মহাশয় তার সামনে এসে ঘোড়াটাকে দাঁড় করালেন।
জিজ্ঞাসা করেন–কিছু খাবার পাওয়া যাবে কি এখানে?
কাদারুজ খুশি হয়ে উঠলো এই মহামান্য অতিথির আগমনে। মনে মনে ভাবলো, নাঃ! ভগবানের দয়া আছে। বলতে হবে।
মুখে বললো–নিশ্চয়ই, দয়া করে ভিতরে আসুন।
ধর্মযাজক ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তারপর ঘোড়াটাকে বেড়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে ভিতরে এলেন।
ধর্মযাজক ভিতরে ঢুকে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন–মঁসিয়ে কাদারুজ নামে কোন লোক এখানে থাকেন কি?
–আমারই নাম কাদারুজ।
এরপর একটু বিস্মিত হয়েই সে আবার বললো–কিন্তু আমার নাম আপনি জানলেন কি করে ধর্মাত্মন?
–অনেক খোঁজ করে আপনাকে আমি বের করেছি। যাই হোক, সেসব কথা পরে বলাও চলবে, আগে কিছু খাবার আর এক গ্লাস ভাল মদ এনে দিন তো! বড্ড খিদে পেয়ে গেছে আমার।
কাদারুজ ব্যস্ত হয়ে উঠলো ধর্মযাজকের এই কথায়! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে ঐদিনের যা কিছু ভাল খাবার ছিল প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। এক গ্লাস মদও নিয়ে এলো সে এই মান্যবর অতিথির জন্য।