–সে জন্য তোমাকে মোটেই ভাবতে হবে না। আমি একখানা স্টীমার ভাড়া করে দিচ্ছি তোমাকে, আর তোমার পারিশ্রমিক বাবদ এক শ’ ফ্ৰাঁ অগ্রিম দিচ্ছি।
এই বলেই পকেট থেকে এক গাদা নোট বের করে তা থেকে এক শ’ ফাঁর নোট জ্যাকোপোর হাতে দিল সে।
জ্যাকোপো আশ্চর্য হয়ে বললো–এত টাকা তোমার কাছে! কি ব্যাপার?
এডমন্ড মৃদু হেসে বললো–হ্যাঁ ভাই, আমি হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছি। এখানে আমার এক আত্মীয় থাকতেন। আমি ছাড়া তার আর কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় তিনি মারা যাবার সময় তার যা কিছু সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন। কাল সেখানে যেতেই আমি জানতে পারি এই খবর।
জ্যাকোপো অবিশ্বাস করলো না তার কথা। আর অবিশ্বাস করবেই বা কি করে! নিজের চোখেই তো দেখতে পেলো, যে এডমন্ডের পকেটে কমপক্ষে হাজার ফ্রাঁর নোট।
এর পর জ্যাকোপোকে সঙ্গে করে জাহাজঘাটে গিয়ে একখানা স্টীমার ভাড়া করে দিয়ে বললো–তুমি ফিরে এসে আমাকে দেখতে না পেলে জাহাজঘাটের কাছে ঐ হোটেলে অপেক্ষা করো, কেমন?
জ্যাকোপো বললো–তুমি এখন কি করবে বন্ধ?
–কিছুই ঠিক নেই, তবে ‘এমিলিয়া’ জাহাজে চাকরি করবো না যে, এটা ঠিক।
ঐ দিনই জ্যাকোপো রওনা হয়ে গেল মার্সেঈ-এর পথে।
এদিকে এডমন্ড জাহাজে গিয়ে তার হঠাৎ বড়লোক হওয়ার কথা বলে বিদায় চাইলো সবার কাছে। জাহাজ থেকে চলে আসার সময় প্রত্যেক লোককে সে এক শ’ ফ্রাঁ করে পুরস্কার দিয়ে এলো।
কাপ্তেনের কাছে বিদায় নিতে গেলে সে এডমন্ডের সঙ্গে করমর্দন করে বললো–দরকার হলে ‘এমিলিয়া’ জাহাজের এই গরীব কাপ্তেনকে ভুলো না বন্ধু।
.
এর দু’দিন পরে সমুদ্রে একখানা সুন্দর ছোট জাহাজ দেখে এডমন্ড খোঁজ নিয়ে জানলো যে ঐ জাহাজখানা একজন ইংরেজ ভদ্রলোক চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে কিনেছেন। জাহাজখানার গঠন ও সৌন্দর্য দেখে এডমন্ডের ইচ্ছা হলো ওখানা কিনে নিতে। সে তখন সেই জাহাজের মালিকের সঙ্গে দেখা করে ষাট হাজার ফ্ৰাঁ দরে কিনতে চাইলো জাহাজখানা। চল্লিশ হাজার ফ্রাতে জাহাজ কিনে দু’দিনেই বিশ হাজার ফ্রাঁ লাভ পেয়ে জাহাজের মালিক সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। এডমন্ড তখন এক বড় মণিকারের দোকানে গিয়ে আরও কয়েকখানা হীরে বিক্রি করে সেই দিনই জাহাজখানা কিনে ফেললো।
জাহাজ কেনা হয়ে গেলে সেই ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন– আপনার যদি ক্রু আর খালাসী দরকার হয় তাহলে আমার লোকদের রাখতে পারেন আপনি।
এডমন্ড বললো–তার দরকার হবে না। আমি একাই পারবো এই জাহাজ চালিয়ে যেতে। একা একা ইচ্ছামত সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবার জন্যই আমি জাহাজখানা কিনলাম।
ইংরাজ ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেলেন এডমন্ডের কথায়। শুধু তিনি কেন, লেগহর্নের বহু লোকই অবাক হয়ে গিয়েছিল, যখন তারা দেখলো যে জাহাজের মালিক কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেই চালিয়ে যাচ্ছেন তার জাহাজখানা। এখানে একটি কথা বলতে ভুলে গেছি। কথাটা হচ্ছে এই যে জাহাজখানা কিনবার পরেই এডমন্ড তার নিজস্ব কেবিনে তিনটি খোপওয়ালা একটা বড় সিন্দুক তৈরি করে নিয়েছিল।
কয়েকদিন পরেই আবার ফিরে এলো এডমন্ড। এ ক’দিন সে জাহাজ নিয়ে কোথায় গিয়েছিল কেউই তা জানতে পারলো না।
বন্দরে এসে এডমন্ড দেখতে পেলো যে জ্যাকোপো ফিরে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
এডমন্ড তাকে জিজ্ঞাসা করলো–কি বন্ধ, খবর পেলে তাদের?
জ্যাকোপো বললো–বৃদ্ধের খবর পেয়েছি। তিনি মারা গেছেন।
–আর সেই মেয়েটি?
–তার কোন খোঁজ পেলাম না। ওখানকার কোন লোকই বলতে পারলো না তার কথা।
হঠাৎ চোখে জল এসে পড়লো এডমন্ডের।
জ্যাকোপো জিজ্ঞাসা করলো–কি হলো বন্ধু?
এডমন্ড বললো–কিছু না। তুমি যে খবরটা এনে দিলে এর জন্য আমার ধন্যবাদ নাও। আর সেই সঙ্গে বন্ধুর কাছ থেকে সামান্য কিছু প্রীতি উপহার…।
এই বলে পকেট থেকে এক শ’ ফাঁর নোট বের করে জ্যাকোপোর হাতে দিয়ে সে আবার বললো–বিদায় বন্ধ! জীবনে আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। কিন্তু তোমাকে আমি কোন দিনই ভুলবো না।
.
১৪.
টাকা থাকলে দুনিয়ায় অনেক কিছুই সম্ভব হয়; তাই এডমন্ড দান্তেও টাকার জোরে লর্ড উইলমোর হয়ে গেল। এই নামেই ‘পাসপোর্ট’ও বের করে নিল সে। কোথাকার লর্ড, কি তার বংশ-পরিচয়–এসব কোন প্রশ্নই বাধা হয়ে দাঁড়ালো না তার পাসপোর্ট যোগাড় করবার ব্যাপারে। সবাই ভাবলো–যাঁর পকেটে সব সময় কয়েক লাখ ফ্রাঁর নোট থাকে, তিনি লর্ড ছাড়া আর কি হবেন?
এইভাবে নিজেকে লর্ড তৈরি করে এডমন্ড ভাবলো যে লর্ডের মত চালে থাকতে হলে তার কিছু আয়ের পথ তৈরি করা দরকার। অন্তত লোক দেখানোর জন্যও তার এমন কোন সম্পত্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তগত করা দরকার যাতে কারো মনেই কোন রকম সন্দেহ আসতে না পারে। এই সব কথা চিন্তা করে এডমন্ড সোজা চলে গেল রোমে। এডমন্ড যখন ফারাওঁ জাহাজে চাকরি করত, সেই সময়েই সে জানতো যে রোমের বিখ্যাত ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান “মেসার্স টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির সঙ্গে “মোরেল” কোম্পানির লেনদেন আছে।
এই “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির নাম জানতো না, সে রকম লোক ইউরোপে তখন খুব কমই ছিল।
এডমন্ড সোজা গিয়ে সেই কোম্পানির মালিকের সঙ্গে দেখা করে কোম্পানিটা তাকে বিক্রি করে দিতে অনুরোধ জানালো। “টমসন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির মালিক একজন অপরিচিত লোকের মুখে এইরকম অভাবনীয় প্রস্তাব শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–”টমসন এন্ড ফ্রেঞ্চ” কোম্পানির সুনামের (Goodwill) দাম কি রকম হতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণা আছে কি?