সে তখন এগিয়ে গেল সেই গুহার দিকে। কিন্তু কি সর্বনাশ! ওটা কি?
এডমন্ড দেখলো, একটি বিরাট অজগর সাপ এঁকে বেঁকে বেরিয়ে আসছে সেই গুহার ভিতর থেকে। এত বড় সাপ এডমন্ড জীবনেও দেখেনি। ভয়ে তার কপাল ঘেমে উঠলো। গুহার মধ্যে ঢুকতে সাহস হলো না তার।
তার আরও মনে হলো যে সাপ না থাকলেও এই তিন শ’ বছরের চাপা গুহার মধ্যে যে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়ে আছে, সেই গ্যাস নাকে ঢুকলে অবধারিত মৃত্যু।
এডমন্ড তখন অপেক্ষা করতে লাগলো ঐ গ্যাস বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। সে ভালো করেই জানতো যে বাতাসের স্পর্শ পেলেই গ্যাস উপরের দিকে উঠতে থাকে।
.
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে সে ভগবানের নাম নিয়ে ঢুকে পড়লো সেই গুহার মধ্যে!
গুহাটা খুব বড় নয়। সে দেখতে পেলো এক কোণে একটা কাঠের বাক্স তালা-চাবি দিয়ে বন্ধ করা রয়েছে।
সে তখন তার বন্দুকের নল দিয়ে তালাটার গায়ে আঘাত করতেই সেটা গুঁড়ো হয়ে গেল।
তালাটা গুঁড়ো হয়ে যেতেই সে বাক্সের ডালাটা খুলে ফেললো। বাক্সের ভিতরটা ছিল তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগে রাশীকৃত সোনার বাট, দ্বিতীয় ভাগে সোনার মোহর, আর তৃতীয় ভাগে হীরে চুনী পান্না প্রভৃতি মহামূল্য মণিমুক্তা।
ওরে বাপরে! এ যে রাজার ঐশ্বর্যের চেয়েও বেশি!
উত্তেজনায় এডমন্ডের কপাল দিয়ে টস টস করে ঘাম ঝরতে লাগলো।
এই বিপুল ঐশ্বর্য হাতে পেয়ে তার মাথা ঘুরে উঠলো। প্রথমেই তার মনে হলো কি উপায়ে এগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়।
অনেক চিন্তা করে সে দেখলো যে এখন বেশি কিছু নিতে গেলে বিপদ হবে। যদি তার সঙ্গীরা ঘুণাক্ষরেও এই গুপ্তধনের কথা জানতে পারে তাহলে বন্ধু বলে তারা তাকে রেহাই দেবে না। তাকে হত্যা করে ঐ ধনরত্ন কেড়ে নেবে তারা।
সে তখন দুই মুঠো ভরতি করে হীরে-জহরত তুলে তার বেল্টের সঙ্গে সংলগ্ন থলেয় ভরতি করে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো।
তারপর সে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তার সঙ্গীদের জন্য।
.
১৩.
ছয়দিনের দিন ‘এমিলিয়া’ জাহাজখানা আবার ফিরে এলো। এডমন্ডকে সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাপ্তেন বোট পাঠিয়ে দিল তাকে নিয়ে আসতে।
এডমন্ড জাহাজে উঠলে কাপ্তেন বললো–তোমাকে এখানে রেখে গিয়ে আমার মনটা খুব খারাপ লাগছিল। কেমন আছ এখন?
এডমন্ড বললো–ভাল।
এই সময় জ্যাকোপো কাপ্তেনকে বললো–কিন্তু কাপ্তেন, এবারের টাকার ভাগ তো আমাদের বন্ধুরও পাওয়া উচিত। কাপ্তেন বললো–ও যদি আমাদের সঙ্গে যেতো তাহলে পেতো বৈ কি।
কাপ্তেনের এই কথায় জ্যাকোপো বললো–কিন্তু ও তো এখানে নিজের ইচ্ছায় থাকেনি, তাই আমার ইচ্ছা, ওকেও সমান ভাগ দেওয়া হোক। তবে আপনি যদি নিতান্তই ভাগ দিতে রাজী না হন, তাহলে আমিই আমার ভাগের টাকার অর্ধেক ওকে দেবো।
কাপ্তেন হেসে বললো–তোমার ভাগের অর্ধেক আর দিতে হবে না। ওকে সমান অংশই দেওয়া হবে।
এই বলে পকেট থেকে এক গোছা নোট বের করে তা থেকে পঞ্চাশ পিয়েস্তা এডমন্ডকে দিয়ে সে বললো–এই নাও বন্ধু তোমার ভাগ।
এডমন্ড নিঃশব্দেই নোটগুলো নিয়ে পকেটে ফেললো। তারপর সে জিজ্ঞাসা করলো–এবার কোন দিকে যাওয়া হচ্ছে বন্ধু?
কাপ্তেন বললো–লেগহর্ন বন্দরে।
***
লেগহর্ন বন্দর।
জাহাজীদের ফুর্তির সব রকম ব্যবস্থাই এখানে আছে। অনেক দিন জাহাজে আটকে থেকে নাবিকরা সবাই উদ্দাম হয়ে উঠেছিল। কথা হলো, জাহাজ এখানে কিছুদিন থাকবে। সবাই নেমে পড়লো বন্দরে।
সবাই যে যার মত ছুটলো আনন্দের শিকার খুঁজতে। এডমন্ড বেরিয়ে পড়লো পথে। তার পকেটে তখন ছোটখাট রাজার দৌলত।
রাস্তায় এক ইহুদী মণিকারের দোকানে ঢুকে পড়লো সে। বুড়ো দোকানদার তার দিকে তাকিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাসা করলো–কি চাই মঁসিয়ে?
এডমন্ড বললো–দোকানের মালিকের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বৃদ্ধ বললো–কি কথা আছে বলুন? আমিই এই দোকানের মালিক।
এডমন্ড বললো–আমি কিছু হীরে বিক্রি করতে চাই। আমার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি।
বৃদ্ধ বললো–সঙ্গে আছে?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা ভিতরে আসুন।
এডমন্ড দোকানের ভিতরে যেতেই বৃদ্ধ তাকে সঙ্গে করে তার খাস কামরায় নিয়ে গেল।
খাস কামরায় গিয়ে এডমন্ড পকেট থেকে চারখানা হীরে বের করে বৃদ্ধের সামনে টেবিলের উপরে রেখে বললে–দেখুন তো, কি দাম পাওয়া যেতে পারে এর!
তার ভয় হতে লাগলো যে ইহুদী বুড়ো হয়তো তাকে জেরা করতে আরম্ভ করবে।
বৃদ্ধ কিন্তু জেরার ধারে কাছেও গেল না। সে হীরে ক’খানাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললো–এক এক খানার দাম পাঁচ হাজার ফ্রাঁ করে দিতে পারি আমি।
এডমন্ড আর দরকষাকষি না করে বিশ হাজার ফ্রাঁতেই* [বিশ হাজার ফ্রাঁ আমাদের দেশের প্রায় তিন লাখ টাকা] দিয়ে দিল হীরে চারখানা। ইহুদী বুড়োও এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য করলো না। কারণ সে জানতো যে ঐ হীরেগুলো বেচে কম করেও চার হাজার ফ্র লাভ করবে সে।
পরদিন জ্যাকোপোকে একান্তে ডেকে এডমন্ড বললো–তুমি যদি আমার হয়ে একটা কাজ করে দাও তাহলে বড় উপকার হয়।
–কি কাজ?
–মার্সেঈ বন্দরে গিয়ে এলিজ দ্য মিলান গ্রামের লুই দান্তে নামে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের খবর এনে দিতে হবে।
–আর?
–আর কাটালান গ্রামের মার্সেদেস নামে একটি মেয়ের খবর।
–আর কিছু।
–না।
–কিন্তু আমি যাব কি করে সেখানে?