যন্ত্রণাকাতর-কণ্ঠে এডমন্ড বললো–হ্যাঁ!
–যেতে পারবে না?
–না। আমার পাজরার হাড় বোধ হয় ভেঙে গেছে। আমাকে তোমরা ঐ গুহাটার ভিতরে নিয়ে চলো। এই বলে পাশের একটি গুহা দেখিয়ে দিল সে।
ওরা তখন এডমন্ডকে ধরাধরি করে সেই গুহার ভিতরে নিয়ে নামিয়ে রাখলো। যতক্ষণ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ততক্ষণই এডমন্ড চিৎকার করছিলো।
গুহার ভিতর নামিয়ে রাখতেই এডমন্ড বললো–আমার আর এখান থেকে নড়বার উপায় নেই ভাই।
তোমরা বরং আমার খাবার এখানেই এনে দাও। জ্যাকোপো বললে–কিন্তু ভাই আমাদের যে আজই রওনা হতে হবে। আজ রওনা না দিলে নির্দিষ্ট সময়ে জায়গামত পৌঁছাতে পারব না আমরা।
এডমন্ড বললো–তোমরা যাও ভাই। আমাকে বরং ফিরবার পথে তুলে নিয়ে যেও।
জ্যাকোপো বললো–তা কি করে হয়? তোমাকে একা এই দ্বীপে ফেলে রেখে আমরা যাই কি করে?
এডমন্ড বললো–কিন্তু উপায় তো নেই ভাই। কাপ্তেনকে বলে আমার জন্য কিছু বিস্কুট, এক কলসী জল, একটা কুড়ুল, একটা গাঁইতি আর কিছু গুলিবারুদ নিয়ে এসো। তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো।
জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা তখন কাপ্তেনের কাছে ফিরে গিয়ে এডমন্ডের অবস্থার কথা বলতেই সে বললো–বেশ! তবে তাই হোক। না গিয়ে যখন উপায় নেই আমাদের, তখন এ ছাড়া আর উপায় কি?
কাপ্তেনের আদেশে তখন এডমন্ডের জন্য দিন সাতেকের মত খাবার, আর তার চাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে চললো জ্যাকোপো আর তিন-চারজন লোক। বলা বাহুল্য পাঁঠার রোস্টও নিয়ে যাওয়া হলো এডমন্ডের জন্য।
এডমন্ড জিনিসগুলো পেয়ে মনে মনে খুশি হলেও মুখে বললো–তাহলে এসো ভাই, তোমাদের আর আটকে রাখতে চাই না। আমি এইখানেই অপেক্ষা করবো তোমাদের জন্য। ফিরবার পথে আমাকে তুলে নিয়ে যেও কিন্তু।
জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা সাশ্রনয়নে বিদায় নিলো এডমন্ডের কাছ থেকে।
ঐদিনই ‘এমেলিয়া’ জাহাজখানা চলে গেল ওখান থেকে।
.
১২.
আসলে এডমন্ডের আঘাতটা সাংঘাতিক কিছু হয়নি। সঙ্গীদের ওখান থেকে বিদায় করবার জন্যই সে ঐভাবে অভিনয় করছিল। তাই জ্যাকোপো আর তার সঙ্গীরা চলে যেতেই সে উঠে বসলো।
উঠে বসে মনের আনন্দে পেট ভরে পাঁঠার রোস্ট খেয়ে আবার সে শুয়ে পড়লো সেই গুহার মধ্যে। সে ভাবলো যে, আজ আর কিছু করা হবে না। জাহাজ চলে গেলে কাল যা হয় করা যাবে।
সে-রাত্রি ঐ গুহার মধ্যে শুয়েই কাটলো তার।
পরদিন সকালে উঠেই সে তৈরি হয়ে নিলো। বন্দুকটা এক কাঁধে ঝুলিয়ে, বারুদের থলেটাকে আর এক কাঁধে। তারপর কুড়ুল আর গাঁইতি হাতে নিয়ে এগিয়ে চললো সে।
আবার সেই মরা নদী। আর সেই পার্বত্য পথ।
গতকালের নিশানা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললো সে।
একে একে উনিশটি পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে কুড়ি নম্বর চুড়ার সামনে সে যখন এসে পৌঁছলে বেলা তখন প্রায় দুপুর। কুড়ি নম্বর চূড়ার কাছে এসে দক্ষিণ দিকে চললো সে। একটু যেতেই সে দেখতে পেলো পাহাড়ের গায়ে একখানা বিরাট পাথর আটকে আছে। পাথরখানা দেখে তার মনে হলো যে ওখানা কেউ টেনে এনে রেখেছে সেখানে, কারণ পাহাড়ের সঙ্গে ঐ পাথরখানার কোনো সম্বন্ধ নেই। ওখানা একখানা বিচ্ছিন্ন, পাথর। কিন্তু অতবড় একটা বিরাট পাথর কে টেনে আনলো ওখানে? এ যে একটা হাতির পক্ষেও সম্ভব নয়! সে তখন পাথরের অবস্থানটা ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলো। তার মনে হলো পাথরখানা উপর থেকে গড়িয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। হয়তো এখানে কোন কিছু দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে গড়ানো পাথরখানাকে আটকে ফেলা হয়েছিল।
নিশ্চয়ই তাই!
সে তখন পাথরখানার অবস্থান আর একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। তার মনে হলো যে পাথরখানাকে যদি কোন রকমে একটু সরানো যায় তাহলে নিশ্চয়ই ওখানা নিচে গড়িয়ে পড়বে।
এই কথা ভেবে সে নিকটস্থ একটা গাছ থেকে একখানা সরু অথচ মজবুত ডাল কেটে এনে সেই ডাল দিয়ে চাড় দিতে চেষ্টা করলো পাথরখানাকে।
কিন্তু মুস্কিল হলো এই যে, ডালখানা পাথরের নিচে ঢোকাতে পারা গেল না।
এডমন্ড তখন গাঁইতি দিয়ে পাথরের কিনারে কোপাতে আরম্ভ করলো। মিনিট কয়েক কোপাতেই গাঁইতিখানার মুখ হঠাৎ একটা ফাঁপা জায়গার মধ্যে ঢুকে গেছে বলে মনে হলো তার। এই ব্যাপার দেখে তার বুঝতে দেরি হলো না যে ঐ পাথরের নিচেই আছে সেই গুহার মুখ। সে তখন গাছের সেই ডালখানাকে সেই ছিদ্রপথে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে চাড় দিতে লাগলো। কিন্তু চাড় দিলে কি হবে, পাথরখানা একটুও নড়লো না।
শত শত বৎসর পাথরখানা ওখানে থাকার ফলে তার চারিদিকের মাটি এমন শক্তভাবে এঁটে ছিল পাথরখানার গায়ে যে এডমন্ডের পক্ষে সম্ভব হলো না ওখানাকে স্থানচ্যুত করতে।
এই সময় হঠাৎ তার মনে পড়লো থলের বারুদের কথা। সে ভাবলো যে খানিকটা বারুদ পাথরের নিচে ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে হয়তো কাজ হবে।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।
সে তখন গাঁইতির সাহায্যে পাথরের নিচে একটা গর্ত তৈরি করে তার মধ্যে বারুদ ঢুকিয়ে ভাল করে চাপা দিল। তারপর থলে থেকে একগাছা দড়ি বের করে পলতের মত ঢুকিয়ে সেটাকে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল।
একটু পরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো সেই পাথরের নিচে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরখানা নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
পাথরখানা সরে যেতেই এডমন্ড দেখলো যে একটা গুহার মুখ বেরিয়ে পড়েছে তার নিচে থেকে।