ভীষণ লাজুক গ্ৰাঁদ। কখনও প্রতিবাদ করতে পারে না। তাছাড়া, নিজের মনোভাব প্রকাশের উপযুক্ত ভাষাও খুঁজে পায় না সে, সব সময় হাতড়াতে থাকে শব্দ।
ডাক্তার সাহেব, আপনি যদি বুঝতেন, প্রায়ই ওকে বলে গ্রাঁদ, নিজের মনোভাব কিভাবে প্রকাশ করা যায় তা শেখার জন্যে আমার প্রাণে কী যে আকুলতা!
গ্রাঁদকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রিও-র মনে হলো, নিশ্চয় ও বই বা তেমন কিছু একটা লেখার কাজে ব্যস্ত।
.
১.০৭
পরের দিন, কর্তৃপক্ষকে রোগের ব্যাপারটা ভাল করে বোঝাল রিও। প্রিফেক্ট-এর অফিসে স্বাস্থ্য কমিটির সভায় বসতে রাজি হলো সবাই।
আসার পথে ডাক্তার ক্যাসেলকে নিজের গাড়িতে তুলে নিল রিও। শুনেছ, ক্যাসেল বলল, সারা জেলায় নাকি এক গ্রাম সিরামও নেই।
হ্যাঁ, জানি। ডিপোতে টেলিফোন করেছিলাম। আমার কথা শুনে চমকে উঠেছিল ডিরেক্টর। সিরাম এখন প্যারিস থেকে আনতে হবে। কাল টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি।
ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন প্রিফেক্ট। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হলো না, চাপা ক্রোধে জ্বলছেন তিনি। আসুন কাজ শুরু করি, ডাক্তারদের লক্ষ করে বললেন প্রিফেক্ট, আশা করি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।
না, তার দরকার হবে না, বলল ডাক্তার রিচার্ড। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থায় কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত…
না, আমাদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে রিচার্ডকে বাধা দিয়ে বলল ক্যাসেল, রোগটা সত্যি প্লেগ কিনা তা জানা।
এ কথার প্রতিবাদ করল দুতিনজন ডাক্তার। ইতস্তত করল অন্যরা। একটু চমকে উঠলেন প্রিফেক্ট।
এই মুহূর্তে সবার উচিত আতঙ্ক না ছড়ানো। তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বলল রিচার্ড।
রোগটা প্লেগ নয়, এ-কথা বললে আপনাদের যদি দুশ্চিন্তা হালকা হয় তাহলে তা বলতে আমি রাজি আছি, বলল ক্যাসেল।
আপনার কথা যুক্তিসঙ্গত হচ্ছে না, বললেন প্রিফেক্ট। মেজাজ বিগড়ে গেছে তাঁর।
রিওকে ওর মতামত জানানোর জন্যে অনুরোধ করা হলো। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি সে।
এ পর্যন্ত যত রোগী পেয়েছি, বলল রিও, তাদের জ্বরটা টাইফয়েডের মত। সঙ্গে বমি, গ্রন্থিস্ফীতি। পুঁজ পরীক্ষা করে দেখেছি ওতে প্লেগের জীবাণু পাওয়া গেছে, কিন্তু জীবাণুর মধ্যে এমন কিছু আছে যা প্লেগের সঙ্গে মেলে না।
তাহলে আমাদের কাজ হবে আরও কিছুদিন লক্ষ করা, বলল, রিচার্ড।
না। দিন দিন এই সংক্রমণ বাড়ছে। এখুনি ব্যবস্থা নেয়া না হলে দুমাসের মধ্যে শহরের অর্ধেক মানুষ মারা যাবে।
এ ধরনের বিভীষিকার চিত্র কল্পনা করা আমাদের ভুল হচ্ছে। তাছাড়া রোগটা যে সংক্রামক তার কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। রোগীর পাশে থেকেও অনেকে সুস্থ আছে।
এর উল্টো প্রমাণও আছে। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়, প্রশ্ন হচ্ছে রোগ প্রতিরোধের কী ব্যবস্থা নেয়া যায়?
সংক্রমণ আপনাআপনি বন্ধ না হলে তখন প্রতিষেধক ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সরকারিভাবে ঘোষণা করতে হবে প্লেগ দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে সব ক্ষমতা প্রিফেক্টকে দেয়া আছে।
ক্ষমতা অবশ্যই আমার আছে, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন প্রিফেক্ট। সেক্ষেত্রে পেশাদার ডাক্তারদের আগে ঘোষণা করতে হবে যে রোগটা প্লেগ।
কিন্তু আমরা, ডাক্তাররা, যদি একমত না হতে পারি, তাহলে একটা ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিতে হবে আপনাদের। হয়তো দেখা যাবে। শহরের অর্ধেক মানুষ মরা গেছে, বলল রিও।
আমার সহকর্মী পুরোপুরি বিশ্বাস করেন, রোগটা প্লেগই। ওর কথা থেকেও তাই মনে হচ্ছে, বলল রিচার্ড।
আমি যা দেখেছি তাই বলেছি। আমি এখন জানতে চাই আমার সহকর্মী কি এমন কথা বলতে রাজি আছেন যে কোনরকম প্রতিষেধক ছাড়াই এই রোগ ভাল হয়ে যাবে?
এবার ইতস্তত করল রিচার্ড। তুমি বিশ্বাস করো রোগটা প্লেগ?
রোগের নাম আমি কী বলি না বলি সেটা বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে সময়ের।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বললেন প্রিফেক্ট, আপনার অভিমত হচ্ছে রোগটা প্লেগ না হলেও তারই প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনি নিতে হবে। হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন, বলল রিও।
নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করল ডাক্তাররা। রিচার্ডকে ওদের মুখপাত্র নির্বাচন করা হলো উঠল প্রতিবাদের ঝড়। দেখানো হলো নানারকম ভয়। কমিটি-কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল রিও।
কয়েক মিনিট পর। শহরতলির দিকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে রিও। চারদিকে মাছ ভাজা আর পেচ্ছাপের ঝাঁঝাল গন্ধ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে ওর গাড়ির সামনে দাঁড়াল এক স্ত্রী লোক। যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে; উরু বেয়ে নামছে রক্তের ধারা।
.
১.০৮
মীটিং-এর পরের দিন রোগের কামড়ানি আরও কিছুটা বাড়ল। এই প্রথম মানুষ মরার খবর বেরুল দৈনিক কাগজগুলোয়। একদিন পর, রিও লক্ষ করল শহরের বেশকিছু জায়গায় টানানো হয়েছে সরকারি নোটিস। মানুষের ভেতর যাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখে খুব সাবধানে সাজানো হয়েছে এর ভাষা।
ওরাওঁ শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এক ধরনের সাংঘাতিক রোগের খবর পাওয়া গেছে; রোগটা সংক্রামক কিনা তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না; কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন, প্রতিটি নাগরিক মাথা ঠাণ্ডা রেখে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে।
কর্তৃপক্ষ কী কী ব্যবস্থা নেবেন তার একটা খসড়া দেয়া হয়েছে নোটিসে। তাতে বলা হয়েছে: নালা নর্দমায় বিষাক্ত গ্যাস ঢেলে খতম করা হবে ইঁদুর; পানি যাতে দূষিত না হয় সেদিকে রাখা হবে কঠোর দৃষ্টি; অসুস্থ মানুষের জন্যে হাসপাতালে ভোলা হয়েছে বিশেষ ওয়ার্ড।