দেখো, ক্যাসেল, বলল ও, ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু লক্ষণ দেখে আমার আর কোন সন্দেহ নেই–প্লেগই শুরু হয়েছে।
.
১.০৫
জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে, শহরের দিকে তাকিয়ে আছে রিও। মনে করার চেষ্টা করছে প্লেগ নিয়ে কখন কী পড়েছে। আস্তে আস্তে স্মৃতিতে ভেসে উঠল ইতিহাসের পাতা। ওগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে ও দেখল আজ পর্যন্ত তিরিশটা বড় বড় প্লেগ এসেছে পৃথিবীতে। মারা গেছে দশ কোটির মত মানুষ। মনে পড়ল কনস্টান্টিনোপল-এর। প্লেগের কথা; একদিনে দশ হাজার লোক মারা গিয়েছিল ওখানে।
সত্তর বছর আগে ক্যান্টনে দেখা দিয়েছিল প্লেগ। মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ার আগে মরেছিল চল্লিশ হাজার ইঁদুর।
লাশে ভরে গিয়েছিল এথেন্স নগরী, কাকপক্ষীরাও পালিয়েছিল শহর থেকে।
ফ্রান্সের মার্সাই শহরে বিরাট বিরাট গর্তে গলিত লাশ ছুঁড়ে মেরেছিল কয়েদীরা।
প্রঁভে শহরে গড়ে তোলা হয়েছিল বিশাল প্রাচীর, যেন প্লেগের দূষিত বাতাস ঢুকতে না পারে শহরের ভেতর।
কনস্ট্যান্টিনোপলে, আশ্রমগুলোর শতচ্ছিন্ন খড়ের গদির ওপর ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য গলিত শবদেহ। বিছানা থেকে আঁকশির, সাহায্যে টেনে তুলতে হয়েছিল ওগুলো।
ইতালির মিলানে ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম বিকৃত ঘটনা। একদিকে প্লেগের প্রকোপে মানুষ সন্ত্রস্ত, অন্যদিকে উদাসীন নর-নারী কবরস্থানে মিলিত হয়েছে সঙ্গমে।
লন্ডন দৈত্যপুরীর মত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় শুধু শোনা যেত শবদেহবাহী শকটের নিরন্তর ঘর্ঘর শব্দের প্রতিধ্বনি।
রাতের আঁধারে এথেন্স এর সমুদ্রতীরে জড়ো হয়েছিল অগণিত মানুষ। কাঁধে ওদের আত্মীয়-পরিজনের মৃতদেহ। সবাই চাইছিল শুকনো মাটিতে লাশগুলোকে কবর দিতে। কিন্তু স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। সবার হাতে ছিল মশাল। সেই মশাল দিয়ে তখন ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল ওদের ভেতর।
.
১.০৬
ঝি খবর দিল গ্রাঁদ এসেছে। গ্রাঁদ মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি হলেও পরিসংখ্যান দপ্তরে জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার। কাজ মাঝে মাঝে করতে হয় ওকে। সে কারণেই গত কয়েকদিন ধরে যেসব মৃত্যু ঘটছিল তার একটা হিসেব রাখার দায়িত্ব পড়েছিল ওর ওপর। কৃতজ্ঞতাবোধ ওর চরিত্রের বিশেষ একটা গুণ, সেজন্যেই স্বেচ্ছায় মৃতের সর্বশেষ সংখ্যা সংবলিত একটা রিপোর্ট সে নিয়ে এসেছে ডাক্তারের কাছে।
একখণ্ড কাগজ নাচাতে নাচাতে ঘরে ঢুকল গ্রাঁদ। প্রতিবেশী কটার্ডকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, ডাক্তার।গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় এগারো জন মারা গেছে।
কটার্ড-এর সঙ্গে করমর্দন করে রিও জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন আছেন?
আপনাকে ও ধন্যবাদ জানাতে এসেছে। আপনাকে অহেতুক ঝামেলায় ফেলার জন্যে বেচারি দুঃখিত, বলল গ্রাঁদ।
রিও ততক্ষণে চোখ বুলাতে শুরু করেছে রিপোর্টে। জ কুঁচকে উঠল ওর। না, আর দেরি নয়। রোগের নামটা ঘোষণা করতে হবে। আমি এখনি ল্যাবরেটরিতে যাব। আপনারা যাবেন আমার সঙ্গে?
ঠিক বলেছেন আপনি, রিও-র সঙ্গে নামতে নামতে বলল গ্রাঁদ। সত্য গোপন না রাখাই ভাল।
প্যালেস দ্য আর্মস-এর দিকে হাঁটা ধরল ওরা তিনজন। তখন সন্ধ্যা নামছে। মাফ করবেন, প্যালেসের কাছাকাছি পৌঁছে বলল গ্রাঁদ। আমাকে ফিরতে হবে। সন্ধেবেলাটা আমার কাছে বড় পবিত্র।
সত্যি কথা বলেছে ও, এতক্ষণে মুখ খুলল কটার্ড। সন্ধের পর কেউ ওকে ঘর থেকে বেরুতে দেবে না।
আপনাকে কি অফিসে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়? প্রশ্ন করল রিও।
না, না, তা নয়। আমার নিজের কিছু কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি, জানাল আঁদ।
তাই? তা কেমন চলছে কাজ?
একটানা কয়েক বছর হলো লেগে আছি। তাই কিছু করতে পারিনি বললে আশ্চর্য শোনাবে। কিন্তু কিছুই যে করতে পারিনি সেটাও সত্যি।
জানাতে আপত্তি না থাকলে বলবেন, কী করছেন?
গ্রাঁদ-এর কান দুটো বেখাপ্পা রকমের বড়, টুপির বাইরে বেরিয়ে থাকে। এক হাতে টুপিটা টেনে কান দুটো ঢেকে নিল ও। তারপর বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা মন্তব্য করল। রিও যেটুকু বুঝল তার অর্থ-কাজটা ব্যক্তিত্বের বিকাশ সংক্রান্ত।
দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল গ্রাঁদ। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট ডুমুর গাছের সারি। ছোট ঘোট পা ফেলে ফিরে চলল ও।
ল্যাবরেটরির দরজায় পৌঁছে কটার্ড, বলল, আমার একটা ব্যাপারে আপনার পরামর্শ প্রয়োজন। একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
পকেটের ভেতর গ্রাঁদ-এর দেয়া রিপোর্টটা নাড়াচাড়া করতে করতে কটার্ডকে রিও বলল, কাল যখন রোগী দেখতে বসব তখন আসুন। পরক্ষণে মত বদলে বলল, কাল আপনাদের ওদিকে রোগী দেখতে যাব আমি। ফেরার সময় আপনার ওখানে আসব।
কটার্ড চলে যাবার পর নিজের অজ্ঞাতেই গ্রাঁদকে নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করল রিও। লোকটা কেমন যেন রহস্যময়। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় রোগের আক্রমণ এড়িয়ে যেতে পারে, ও সেই শ্রেণীর মানুষ। দেখতে লম্বা। হ্যাংলা। মাপের চেয়ে এক সাইজ বড় পোশাক পরে। ওর ধারণা পোশাক ঢোলা হলে টেকে বেশি। ওপরের মাঢ়িতে একটাও দাঁত নেই লোকটার। হাসলে গুটিয়ে যায় ওপরের ঠোঁটখানা। মুখটাকে তখন মনে হয় একটা কালো ফোকর।
রাস্তায় ওকে হাঁটতে দেখলে মনে হয় একজন পাদ্রি হাঁটছে। পথ পেয়োয় দেয়াল ঘেঁষে। কোন্ ফাঁক দিয়ে কোথায় চলে যায় বোঝাই যায় না। মনে হয় ও একটা ইঁদুর। মাঝে মাঝে ওর গা থেকে ভেসে আসে তামাক আর সিঁড়ি-ঘরের গন্ধ। এক কথায় তাৎপর্যহীন একজন মানুষের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই লোকটার আছে।