গ্রাঁদ বলল, কার্ড সকাল থেকে মাথায় খুব যন্ত্রণা অনুভব করছে।
গ্রাঁদকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তাছাড়া উত্তেজিত মনে হলো ওকে। সারাক্ষণ পায়চারি করছে ঘরের ভেতর। টেবিলের ওপর একটা থলে আর একটা ব্যাগ পড়ে আছে। বারবার ওগুলো খুলছে আর বন্ধ করছে।
কথার ফাঁকে গ্রাঁদ রিওকে জানাল, কটার্ড-এর ব্যাপারে বেশি কিছু ও জানে না। সিঁড়িতে দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময় হত, এই পর্যন্তই। তবে লোকটা অদ্ভুত প্রকৃতির। আমার সঙ্গে মাত্র দুবার কথা হয়েছে। কয়েক দিন আগে এক প্যাকেট রঙিন চক কিনে আমি ঘরে ফিরছিলাম। সিঁড়িতে প্যাকেটটা হাত থেকে পড়ে চকগুলো ছড়িয়ে যায়। লাল এবং নীল রঙের চক ছিল ওখানে। কুটা ওর। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওগুলো তুলতে সাহায্য করে আমাকে। সে সময় ও প্রশ্ন করেছিল, রঙিন চক দিয়ে আপনি কী করবেন? আমি উত্তর দিলাম, আমি ল্যাটিন ভাষা চর্চা করি। শুনে বেশ আগ্রহ দেখাল ও, এবং আমার কাছে একটা চক চাইল। আমি এতে আশ্চর্য হলেও ওকে একটা চক দিয়েছিলাম, কথা শেষ করল। গ্রাঁদ।
আর অন্যবার কী কথা হয়েছিল? ওর কাছে জানতে চাইল রিও।
গ্রাঁদ উত্তর দেয়ার আগেই একজন কেরানিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল পুলিস অফিসার। বলল, আমি প্রথমে মশিয়ে গ্ৰাঁদ-এর বক্তব্য শুনব।
রিও লক্ষ করল, কটার্ড-এর কথা বলতে গিয়ে গ্রাঁদ কয়েকবার উচ্চারণ করল এই হতভাগ্য লোকটা এবং ওর দুর্জয় সংকল্প।
আত্মহত্যা করতে চাইবার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে? প্রশ্ন। করল অফিসার।
উত্তর দিতে গিয়ে গ্রাঁদ উপযুক্ত ভাষা খুঁজতে বেশ সময় নিল। শেষে বলল, কোন গোপন বেদনা!
কোন গোপন বেদনা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
এক রাতে আমার দরজায় টোকা দেয় কটার্ড। আমি দরজা খুললে আমার কাছে একটা ম্যাচের কাঠি চায়। আমি ওকে একটা গোটা বাক্স দিয়ে দিই।
ওর আচরণে অস্বাভাবিক কিছু ছিল কী?
হাবভাবে বুঝতাম আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু ও জানত আমার কাজ নিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত।
এবার অফিসার রিওকে বলল, আমি এখন অসুস্থ লোকটাকে দেখতে চাই।
কট্টার্ডকে কিছু ধাতস্ত হতে সময় দেয়ার জন্যে প্রথমে ওর ঘরে একাই কল রিও। খাটের ওপর বসে আছে কটার্ড। গায়ে ধূসর একটা শার্ট। চোখে-মুখে আতঙ্ক। উৎকণ্ঠা নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ও।
পুলিস এসেছে, তাই না? রিওকে দেখে জানতে চাইল কটার্ড।
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করেই চলে যাবে, ওকে অভয় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিও, পিছন থেকে ডাকল কার্ড। রিও কাছে যেতেই ওর হাত চেপে ধরল ও।
অসুস্থ লোককে নিশ্চয় ওরা বিবৃক্ত করে না, ওর কণ্ঠে ঝরে পড়ল মিনতি।
এমন ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না, আবার ওকে অভয় দিল রিও। কথাগুলো শুনে সুস্থ বোধ করল কটার্ড। অফিসারকে আনতে বেরিয়ে গেল রিও।
গ্রাঁদ যা যা বলেছিল পড়ে শোনানো হলো কটার্ডকে। এরপর অফিসার আরম্ভ করল জেরা।
আত্মহত্যা করতে চাইছিলেন কেন?
গ্রাঁদ-এর কথাই ঠিক। কোন গোপন বেদনার কারণে।
ভবিষ্যতেও এমন করার ইচ্ছা আছে নাকি? ধমক দিল অফিসার।
না, নিশ্চয় না। আমি একটু শান্তি চাই।
শুনুন, কড়া গলায় বলল অফিসার, আপনি সবার শান্তি নষ্ট করেছেন। চোখের ইশারায় অফিসারকে থামতে বলল রিও। বিদায় নেয়ার সময় অফিসার ওর কাছে জানতে চাইল, ডাক্তার সাহেব, যেভাবে লোক মারা যাচ্ছে তাতে শহরে কোন বিপদের আশঙ্কা আছে কী?
স্পষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।
হয়তো আবহাওয়ার জন্যেই এমন হচ্ছে, মন্তব্য করল অফিসার।
সত্যি, দিনদিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে আবহাওয়া। যত বেলা বাড়ে। কোনকিছুতে হাত দিলে মনে হয় কেমন যেন আঠা আঠা লাগছে।
এক একজন রোগী দেখে বাসায় ফেরে রিও, আর বাড়ে ওর উদ্বেগ। সেদিন সন্ধ্যায়, শহরতলিতে হঠাৎ একজন শুরু করল বমি। প্রচণ্ড জ্বরে ছটফট করতে করতে পুরুষাঙ্গ চেপে ধরে অবিরাম প্রলাপ বকতে লাগল লোকটা। একটা গ্ল্যান্ড টসটস করছিল পুঁজে; দেখতে দেখতে পাকা ফলের মত ফেটে গেল ওটা।
শহরের সবগুলো এলাকা থেকেই ঘন ঘন ডাক আসতে লাগল রিও-র। গ্ল্যান্ডগুলোর ওপর আড়াআড়িভাবে দুটো টান দেয় ও। অমনি পুঁজ আর রক্ত একসাথে ঠেলে বের হতে থাকে। হাত-পা ছড়িয়ে নেতিয়ে পড়ে রোগী। পা এবং পেটের বিভিন্ন জায়গায় ফুটে ওঠে কালো কালো চাকা। রোগী মারা যায়।
শহরে, ইঁদুরের মত দলে দলে মরতে আরম্ভ করল মানুষ। ইঁদুর মরেছে প্রকাশ্যে, রাস্তাঘাটে। মানুষ মরছে আড়ালে, বাড়ির ভেতর। এজন্যেই সাংবাদিকরা ব্যাপারটার ভয়াবহতা অতখানি বুঝতে পারল। না। শুধু জানল ডাক্তাররা। ওরা বুঝতে পারল মহামারী শুরু হয়েছে।
একদিন রিও-র সঙ্গে দেখা করতে এলেন ডাক্তার ক্যাসেল। বয়সে তিনি রিও-র চেয়ে অনেক বড়, এবং অভিজ্ঞ।
রিও রোগটা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছ তুমি?
মৃতদেহ পরীক্ষার ফলাফলের রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছি।
রিপোর্টে কী পাওয়া যাবে তা আমি আগেই জানি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বহু আগেই তো, পশ্চিম ইওরোপ থেকে এ-রোগ উধাও হয়েছিল। রোগটা তুমিও নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছ।
চিন্তায় ডুবে গেল রিও। চোখ মেলে দিল জানালার বাইরে। দূর দিগন্তকে ঘিরে আছে উঁচু উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। নিষ্প্রভ হয়ে আসছে আকাশের আলো।