এগুলো শহরে ইঁদুর মরা শুরু হওয়ার আগের ঘটনা। যখন ইঁদুর মরা আরম্ভ হলো সে-সময় জাঁ তারিউ লিখেছে:
আজ ব্যালকনির বুড়োর চেহারায় কেমন হতাশার ভাব। গলির ছায়ায় বেড়ালগুলোকে দেখতে পাচ্ছি না। রাস্তায় মরা ইঁদুর দেখে হয়তো শিকারী স্বভাব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ওদের। ভীষণ মনমরা হয়ে আছেন বুড়ো। চুল আঁচড়াননি। সৈনিকের ভাবভঙ্গি নেই। মনে মনে বেশ উদ্বিগ্ন।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ঘরে ফিরে গেলেন তিনি। ফেরার আগে থুতু ছিটালেন রাস্তায়। কিন্তু আজ থুতুর দলা পড়ল শূন্য রাস্তার মাঝখানে।
তারিউ-এর ডাইরির এক জায়গায় লেখা ছি। আজ একটা ট্রামকে রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ থেমে পড়তে দেখলাম। ট্রাম থামতেই তড়িঘড়ি নেমে পড়ল তিনজন তরুণী। পরে শুনেছিলাম, ট্রামের ভেতর একটা মরা ইঁদুর পাওয়া গিয়েছিল।
তারিউ যে হোটেলে থাকত তার পাহারাদার সম্পর্কে ও লিখেছে: একদিন পাহারাদার আমাকে বলল, এভাবে দলে দলে ইঁদুর বেরিয়ে আসার অর্থ সামনে বিপদ আসছে। কী ধরনের বিপদ? আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম। তা কেমন করে বলব? তবে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হলেও অবাক হব না। উত্তর দিল ও।
এক পরিবারের কথা লিখেছে তারিউ। আমাদের হোটেলে খেতে। আসে। দেখতে অদ্ভুত লাগে ওদের। কর্তা রোগা, দীর্ঘদেহী। পরনে কালো কোট-প্যান্ট। এই রঙের কোন বদল হয় না। কড়া ইস্ত্রি করা শার্টের কলার কড়কড়ে। মাথায় বিশাল টাক। ছোট ঘোট চোখ। ছুঁচালো নাক। মুখটা প্যাচার মত। নাম মশিয়ে অথন। পুলিস ম্যাজিস্ট্রেট। হোটেলের দরজায় প্রথমে তাকেই দেখতে পাই। কিন্তু তারপর একটু পাশে সরে দাঁড়ান তিনি। হোটেলে প্রথমে ঢোকেন তাঁর স্ত্রী।
ভদ্রমহিলা ক্ষীণাঙ্গী। দেখতে অনেকটা কালো ইঁদুরের মত। স্ত্রীর পর ঢোকেন_মশিয়ে অথন। এরপর, তাদের অনুসরণ করতে করতে ঢোকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। দেখলে মনে হয় এক জোড়া পুতুল।
খাবার টেবিলের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন মশিয়ে অথন। প্রথমে বসেন তাঁর স্ত্রী। তারপর বসে বাচ্চা দুটো। সবার শেষে মশিয়ে অথন।
আজ দেখলাম, ইঁদুর মরার ব্যাপার নিয়ে কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ছেলেটা। এ সম্পর্কে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু ধমকে উঠলেন মশিয়ে অথন। ফিলিপস, তোমার বোঝা উচিত, খাবার টেবিলে কেউ ইঁদুর নিয়ে কথা বলে না। তোমার বাবার কথাই ঠিক। প্যাঁচা-স্বামীকে সমর্থন করলেন ইঁদুর-পত্নী। খুদে পুতুল দুটো এরপর যতদূর সম্ভব ওদের খাবার প্লেটের ওপর ঝুঁকে পড়ে নিজেদের মুখ আড়াল করে রাখল।
ওর হোটেলের ম্যানেজারের কথাও লিখেছে তারিউ। আজকাল ওকে ইঁদুর ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখি না। ওর তিন-তারা হোটেলে মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে, এ জন্যে মনে মনে। ভীষণ ক্ষুব্ধ ও।
সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ওকে একদিন বললাম, আমরা সবাই এখন একই নৌকার যাত্রী। ঠিক বলেছেন। বেশ খুশি মনে হলো। ম্যানেজারকে।
ওর মুখ থেকেই প্রথম আমি এক ধরনের জ্বরের কথা শুনলাম। জানাল, ওর হোটেলের একজন পরিচারিকাকে ওই রোগ ধরেছে। তারপর আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ও বলল, আমার বিশ্বাস
রোগটা ছোঁয়াচে নয়। আমি বললাম, তাতে আমার নিজের কিছু যায় আসে না। শুনে বেশ জোর দিয়ে ও বলল, আপনিও দেখছি। আমার মতই ভাগ্যে বিশ্বাস করেন। আমি অদৃষ্টবাদী নই, ওকে জানালাম।
.
১.০৪
মিশেল-এর লাশটা আলাদা ওয়ার্ডে রাখার বন্দোবস্ত করে ডাক্তার রিচার্ডকে টেলিফোন করল রিও।
এই রোগ সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? রিচার্ড-এর কাছে জানতে চাইল ও।
না, এখনও কিছু আন্দাজ করতে পারিনি, নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করল রিচার্ড। আমার হাতে মারা গেছে দুজন। একজন; আটচল্লিশ ঘণ্টা পর। অপরজন তিনদিন পর।
এ ধরনের রোগী পেলে দয়া করে আমাকে একটু জানিয়ো, ওকে অনুরোধ করল রিও।
আরও দুজন সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করল সে। ওদের কাছ থেকে জানতে পেল, ইতিমধ্যে বিশজনের মত মারা গেছে। আবার রিচার্ডকে টেলিফোন করল ও। রিচার্ড মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। ওকে অনুরোধ করল রিও, এ ধরনের নতুন রোগীদের যেন আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হয়।
দুঃখিত, বলল রিচার্ড। জেলা কর্তৃপক্ষের হুকুম ছাড়া তা করা যাবে না। কিন্তু রোগটা কী ছোঁয়াচে?
তেমন লক্ষণ আমি এখনও পাইনি। তবে অবস্থা আশঙ্কাজনক, উত্তর দিল রিও। রিচার্ড ওকে আশ্বাস দিল, ব্যাপারটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবে।
এ-দিকে ক্রমশ খারাপ হয়ে উঠছে শহরের আবহাওয়া। মিশেল মরার পরের দিন, গোটা আকাশ ছেয়ে গেল মেঘে মেঘে। পরপর কয়েকবার মুষলধারে বৃষ্টি হলো। কিন্তু বৃষ্টির কয়েক ঘণ্টা পর আবহাওয়া আবার হয়ে উঠল গরম, ভ্যাপসা।
শুধু রিও-র হাঁপানি রোগীর কাছে আবহাওয়াটা মনে হচ্ছিল অন্য রকম। মনে-প্রাণে যেন এরকমই চাইছিল বুড়ো। মনে হচ্ছে, শরীরের ভেতরটা সেদ্ধ করে ফেলছে, বিড়বিড় করে বলল সে। তবে হাঁপানি রোগীর জন্য এমন আবহাওয়াই দরকার।
আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনাটা তদন্তের ব্যাপারে কটার্ড-এর ফ্ল্যাটে এল রিও। পুলিস অফিসার তখনও আসেনি। ওঠার সময় সিঁড়িতে দেখা হলো গ্রাঁদ-এর সঙ্গে। গ্রাঁদ রিওকে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে ঢুকল। দুটি মাত্র ঘর। তেমন আসবাবপত্র নেই। তবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত দুটি জিনিস আছে। একটা বইয়ের শেলফ, অভিধানে ঠাসা। অন্যটা ব্ল্যাক বোর্ড।