ও তো কটার্ড, উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল গ্রাঁদ। কটার্ড শেষ। পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল।
রাস্তার ওপর চিত হয়ে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল কটার্ড। সজোরে লাথি মারল একজন পুলিস। ভিড় ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে গেল জনতার একটা ক্ষুদ্র অংশ। সরে দাঁড়ান, গর্জে উঠল পুলিসের লোকটা।
একে একে রিও-র পাশ দিয়ে চলে গেল কটার্ড, পুলিস, জনতা। চোখ ফিরিয়ে রাখল ও।
অবশেষে হাঁটতে আরম্ভ করল রিও। তখন রাত নামছে। এই অঞ্চলটা বরাবর নির্জন থাকে। কিন্তু কার্ড-এর ঘটনার পর রাস্তায় ভিড় জমে উঠেছে। বাসার দরজায় পৌঁছে ওকে শুভরাত্রি জানাল গ্রাঁদ। বলল, এখন থেকে আবার সন্ধ্যার কাজ শুরু করব। এরপর সিঁড়িতে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল ও। বলল, জেনিকে চিঠি লিখেছি। মনটা এখন আগের চেয়ে অনেক হালকা লাগে। সেই কথাটা আবার নতুন করে লেখায় হাত দিয়েছি। এবার বিশেষণগুলো রাখব না। চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। মাথা থেকে টুপি খুলে ধীরে ধীরে অভিবাদনের ভঙ্গিতে নামিয়ে আনল টুপিসুদ্ধ হাতটা। হাঁপানি রোগীর বাসার দিকে পা বাড়াল রিও। বুড়ো তখন তার অভ্যাসমত এক পাত্র থেকে আর এক পাত্রে গুনে গুনে রাখছে মটর দানা।
এখন এই যে সবাই আনন্দ ফুর্তি করছে, মনে হয় ঠিকই করছে ওরা, বলল বুড়ো। তারপর জানতে চাইল, আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব, তারিউ-এর খবর কী?
মারা গেছে। মনোযোগ দিয়ে বুড়োর বুকের ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে লাগল রিও।
সত্যি? বেশ বিব্রত বোধ করল হাঁপানি বুড়ো।
হ্যাঁ। প্লেগে।
এক মিনিট নীরব থাকার পর বুড়ো বলল, পৃথিবীতে দেখি যারা ভাল মানুষ তারাই তাড়াতাড়ি মারা যায়। খুব কাজের মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক।
হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন? স্টেথোটা গুছিয়ে নিল রিও।
বাজে কথা পছন্দ করতেন না একদম। আমার খুব ভাল লেগেছিল তাকে। লোকে এখন বলাবলি করছে শহরে প্লেগ এসেছিল। এমন ভাব করছে যেন এজন্যে ওদের মেডেল পাওয়া উচিত। কিন্তু আমার কথা, প্লেগ জিনিসটা আসলে কী জীবনেরই একটা অংশ-এর বেশি কিছু নয়।
ফুসফুসের যে ওষুধটা দিয়েছি সেটা নিয়মিত টানবেন।
ডাক্তার সাহেব, আমাকে নিয়ে অত চিন্তা করবেন না। কিভাবে বাঁচতে হয়, আমি জানি।
ঘর থেকে বেরুবার সময় হঠাৎ মাঝপথে থমকে দাঁড়াল রিও। বলল, আপনার ছাদে একটু যেতে চাই, কিছু মনে করবেন না নিশ্চয়।
অবশ্যই না। আচ্ছা, শুনছি যারা প্লেগে মারা গেছে তাদের জন্যে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে। সত্যি?
কাগজে তো তাই লিখেছে।
এমন কিছু একটা হবে সেটা আমি আগেই জানতাম। নিশ্চয় সেখানে বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থাও হবে? বক্তৃতায় কী বলা হবে সেটা আমি এখনই শুনতে পাচ্ছি: আমাদের প্রিয়জনদের মৃত্যুর.. । তারপর যে যার ঘরে ফিরে আরাম করে খাবে-দাবে, তাই না?
রিও তখন সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক পথ উপরে উঠেছে। মাথার ওপর ঝলমল করছে শান্ত সুদূর আকাশ। দূরে পাহাড়ের ওপর ছিটকে পড়ছে নক্ষত্রের আলো। প্লেগের কথা ভুলে থাকার জন্যে সেদিন রাতে ছাদে উঠে যেমন দেখেছিল আজকের রাতেও চারপাশের পরিবেশটা তেমনি। কেবল আজ রাতে সমুদ্রের ঢেউগুলো আরও প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে। আবহাওয়া আরও স্বচ্ছ, শান্ত। বাতাসে নেই সমুদ্রের সেই লোনা গন্ধ। শহরে কোলাহল উপলসৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মত শোনা যাচ্ছে এখনও, তবে আজ রাতে বিদ্রোহের কথা বলছে না ওগুলো, বলছে মুক্তির কথা। দূর-আকাশে, মূল শহরের মাথার ওপর ঝুলে আছে। লাল একটা আভা। আজকের এই সদ্যোজাত স্বাধীনতার রাতে আকাক্ষা বাধা মানছে না কোন, আর এরই নিনাদ পৌঁছুল রিও-র কানে।
রাতে, মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ আতসবাজি পোড়ানোর আয়োজন করেছিলেন। অন্ধকার বন্দর থেকে তারই প্রথম ফানুস নিক্ষেপ করা হলো আকাশে। শহরবাসীরা উল্লাসের ভেতর দিয়ে স্বাগত জানাল তাকে।
চারদিক থেকে তুমুল হর্ষধ্বনির এক একটা বিরাট তরঙ্গ উত্তাল ঊর্মিমালার মত ছুটে এসে আঘাত করছে ছাদে, বারান্দায়, দেয়ালে। গর্জে ফুলে ফুলে, উঠছে সেই ঢেউ। বিশাল থেকে। বিশালতর হচ্ছে ওগুলোর আকার। আর উঁচু পর্বতের শীর্ষ থেকে উজ্জ্বল আলো জলপ্রপাতের মত অজস্র ধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে শূন্য অন্ধকারের ভেতর।
দূর শহর থেকে ভেসে আসা তুমুল হর্ষধ্বনি শুনতে শুনতে রিও ভাবল, মানুষের এই বিজয় উল্লাস যে-কোন দিন আবার হয়তো বিপন্ন হবে। সেটাই হয়তো নিয়ম। কেননা প্লেগের জীবাণু কখনোই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না, অদৃশ্যও হয় না চিরতরে বছরের পর বছর এই জীবাণু সুপ্ত থাকে আসবাবপত্রের মাঝে, কাপড়চোপড়ের বাক্সের ভেতর; ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে, বড় বড় ট্রাংক, বইয়ের শেলফে; তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশ এবং শিক্ষার জন্যে আবার তার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্যে, এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ওদেরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোন শহরে।
***