গির্জার ঘণ্টা, বন্দুকের গর্জন, বাজনার সুমধুর ছন্দ, কানে তালা লাগানো বহু কণ্ঠের চিৎকার ইত্যাদির মিলিত গর্জনের ভেতর দিয়ে সেদিন পড়ন্ত বেলায় সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় শহরের উপকণ্ঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল রিও। আলোকিত হয়ে উঠেছে শহর, ভেসে আসছে কাবাব, আর মদের গন্ধ। ওর চারপাশে উফুল্ল জনতা তাকিয়ে দেখছে উজ্জ্বল আকাশ। আলিঙ্গনরত নারীপুরুষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে কামনার অস্ফুট শীৎকার।
হেঁটে চলল রিও। যতই সামনে এগোচ্ছে ততই বাড়ছে ভিড়। আর সেই সাথে শোরগোল। ওর মনে হলো গন্তব্য ওর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এ সময় বিচিত্র এক অনুভূতি জেগে উঠল ওর ভেতর। ওই কলকণ্ঠ উন্মত্ত জনতার মাঝে মিশে যাবার একটা দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করল ও।
গ্রাঁদ এবং কটার্ড যেখানে থাকে সে রাস্তাটার মোড় ঘুরতেই রিও উপলব্ধি করল যাদের কামনা ব্যক্তি-মানুষ আর তার ভালবাসাকে পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সবসময়ের জন্যে না হলেও মাঝে মাঝে তাদের সেই বাসনা পূরণ হওয়া উচিত।
.
৫.০৫
পাঁচ গ্রাঁদ এবং কটার্ড-এর বাসায় যাওয়ার রাস্তাটায় ঢুকতেই রিও দেখল পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে একদল পুলিস। দূর থেকে ভেসে আসছে আনন্দ ফুর্তির উল্লাসধ্বনি। সে কারণে এই শান্ত অঞ্চলটাকে আরও শান্ত মনে হচ্ছে।
মাফ করবেন, ডাক্তার সাহেব, বলল একজন পুলিস, আপনাকে ওদিকে যেতে দিতে পারব না। একজন পাগল বন্দুক নিয়ে যাকে দেখছে তাকেই গুলি করছে। আপনি এখানেই থাকুন। আপনার সাহায্যের দরকার হতে পারে।
রিও দেখল ওর দিকে এগিয়ে আসছে গ্রাঁদ। কী ঘটেছে সে। সম্পর্কে গ্রাঁদ কিছুই জানে না। পুলিস ওকেও সামনে যেতে দেয়নি। ওরা ওকে জানিয়েছে গুলি ওর বাসার দিক থেকেই আসছে।
সামনে যে পুলিসের দল ওদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের থেকে কিছু দূরে আর একদল পুলিস ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা নির্জন। জনশূন্য মোড়ের ওপর পড়ে আছে একটা টুপি আর এক টুকরো নোংরা ছেঁড়া কাপড়। রিভলভার হাতে বাড়ির দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বেশ কিছু পুলিস। তিনতলার একটা জানালা ছাড়া বাড়ির অন্যান্য জানালা বন্ধ।
মনে হচ্ছে জানালার পাল্লাটা আলগাভাবে ঝুলছে একটা কজার ওপর।
হঠাৎ ওরা শুনতে পেল দুটো রিভলভারের আওয়াজ। গ্রাঁদ-এর বাড়ির বিপরীত দিকের বাড়িটা থেকে ভেসে এল সেই শব্দ। তিন তলার সেই জানালাটা থেকে ছিটকে পড়ল কয়েকটা টুকরো। আবার নীরব হয়ে গেল চারদিক। সারা দিনের উৎসবের পর রিও-র কাছে ব্যাপারটা মনে হলো অবাস্তব।
আরে, ওটা তো কটার্ড-এর জানালা, চিৎকার করে উঠল, গ্রাঁদ।
আপনারা ওভাবে গুলি করছেন কেন? সামনের পুলিসটাকে জিজ্ঞেস করল রিও।
লোকটাকে ব্যস্ত রাখছি। আমরা একটা পুলিসের গাড়ি আসার অপেক্ষা করছি। বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেখলেই গুলি করছে পাগল লোকটা। কিছুক্ষণ আগে একজন পুলিসকে জখম করেছে ও।
কিন্তু ওর এভাবে গুলি করার কারণ কী?
আমারও প্রশ্ন ওটাই। রাস্তার ওপর কিছু লোক আনন্দ ফুর্তি করছিল, এমন সময় ছাদ থেকে কে একজন ওদের দিকে গুলি ছোঁড়ে। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি ওরা। কিছুক্ষণ পর আবার গুলি হয়, তখন চিৎকার করতে করতে ওরা এদিক ওদিক ছুটতে থাকে; ওদের ভেতর আহত হয় একজন, অন্যরা পালিয়ে যায়। মনে, হয় লোকটার মাথা হঠাৎ বিগড়ে গেছে।
রাস্তায় একটা কুকুর বেরিয়ে এল। একটা রোগা স্প্যানিয়েল। কয়েক মাস পর এই প্রথম কুকুর দেখল রিও। হয়তো ওর মনিব এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল ওকে। দেয়ালের গা ঘেঁষে ধীরে ধীরে পা ফেলে কটার্ড-এর বাড়ির দরজার সামনে থামল সারমেয় জন্তুটা। তারপর রাস্তার ওপর বসে পড়ে মাছি তাড়াতে লাগল। পুলিসদের কয়েকজন শিস দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করল ওটাকে। মাথা তুলল কুকুরটা, এগিয়ে গেল সামনের রাস্তার ওপর, বার কয়েক শুকল পড়ে থাকা টুপিটা। এমন সময় তিনতলার সেই জানালাটা থেকে রিভলভারের গুলি এসে বিধল ওর গায়ে। শূন্যে একটা ডিগবাজি খেলো কুকুরটা, তারপর কাত হয়ে পড়ে গেল একপাশে। রিও-র পিছনে ব্রেক কষার শব্দ হলো, থামল একটা গাড়ি। গাড়ি।
এই যে এসে পড়েছে, বলল একজন পুলিস।
গাড়ির ভেতর থেকে রাস্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কয়েকজন পুলিস অফিসার। গাড়ি থেকে নামাল দড়ি, মই, দুটি মোড়ক। ঢুকে পড়ল বিপরীত দিকের বাড়িঘরের পিছনের একটা গলিতে। তখন থেমে গেছে কুকুরটার নড়াচড়া। চকচক করছে, চারপাশে জমা কালো রক্ত।
অকস্মাৎ উল্টো দিকের একটা বাড়ির জানালা থেকে বেরিয়ে এল এক ঝাক মেশিনগানের গুলি। তিনতলার সেই জানালাটা টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেল। দেয়ালে তৈরি হলো মস্ত বড় এক ফাঁক। অন্য একটা বাড়ি থেকে গুলি ঢুকল ওই ফাঁকটায়। ফুটপাথের ওপর ভেঙে পড়ল ইট, চুন, সুরকি। তিনজন পুলিস অফিসার গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঢুকে পড়ল কটার্ড-এর বাড়ির দরজায়। বাড়ির ভেতর দুটো বিস্ফোরণের শব্দ হলো। তারপর শুরু হলো ছোটাছুটি। কিছুক্ষণ পর দরজায় দেখা গেল ছোটখাট একটা লোক প্রাণপণে চিৎকার করছে, আর পুলিস তাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে আনার চেষ্টা করছে।
একসঙ্গে খুলে গেল আশেপাশের বাড়িঘরের সমস্ত জানালা। প্রত্যেক জানালায় দেখা দিল উৎসুক মুখ। দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এল লোকজন। রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বামন লোকটাকে। দুই হাত পিঠ মোড়া করে ধরে রেখেছে দুইজন পুলিস অফিসার। অনবরত চিৎকার করছে লোকটা। একজন পুলিস এগিয়ে এসে বিরাশি সিক্কা ওজনের দুটো ঘুসি বসিয়ে দিল ওর। চোয়ালে।