ফেরার তাড়া ছিল রিও-র। স্ত্রীকে চিঠি লিখতে হবে। তবে সবার আগে যেতে হবে দারোয়ানের বাসায়। গ্রাঁদ-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পথে নামল ও।
রিও শুনতে পেল, হকাররা সেদিনের তাজা খবর হেঁকে বেড়াচ্ছে। শহরের ইঁদুরের আর কোন চিহ্ন নেই। এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। হয়েছে ইঁদুর মরা।
মিশেল-এর ঘরে ঢুকে রিও দেখল, একটা হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে আছে ও। আর এক হাত দিয়ে ঘাড়। সেই অবস্থায় বমি করছে। রঙ, ফিকে গোলাপী। বমি করার পর হাঁপাতে লাগল মিশেল। এর পর বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল।
থার্মোমিটার লাগিয়ে রিও দেখল একশো তিন ডিগ্রীর কাছাকাছি জ্বর মিশেল-এর। ওর গলা ফুলে উঠেছে, এবং শরীরের আরও অনেক জায়গার গ্রন্থি। দুই উরুতে ক্রমশ ফুটে উঠছে কালো কালো চাকা। মিশেল জানাল, শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। আগুন, মনে হচ্ছে আমার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। অত্যধিক জ্বরে শুকিয়ে এসেছে ওর ঠোঁট; মুখ দিয়ে কথা বেরুতে চাইছে না; চোখের কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মণি দুটো। বার কয়েক বলল মিশেল, তার ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে।
মিশেল-এর বৌ উদ্বেগের সঙ্গে শুধাল, ডাক্তার সাহেব, দয়া করে বলুন, ওর কী হয়েছে?
ঠিক বলতে পারছি না। অনেক কিছুই হতে পারে। এখন থেকে হালকা খাবার খাওয়াবে। আর যত পানি চাইবে, দেবে।
বাসায় ফিরে ডাক্তার রিচার্ডকে টেলিফোন করল রিও। রিচার্ড ওর সহকর্মী, ভীষণ জমজমাট পশার। না, না। অস্বাভাবিক তেমন কিছু এখন দেখিনি, জানাল রিচার্ড।
ভীষণ জ্বর। জ্বালাপোড়া আছে। শরীরের কোথাও কোথাও ফোলা। এমন রোগী…?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। এরকম দুজনকে দেখেছি।
সে রাতে মিশেল-এর জ্বর পৌঁছল একশো চারে। সারাক্ষণ প্রলাপ বকল ও। ওই ইতরগুলো… ওই ইতর ইঁদুরগুলো… ওই ইতরগুলোই এই সর্বনাশটা করেছে আমার।
মিশেল-এর বৌকে রিও বলল, আজ রাতে তোমাকে ওর পাশে : থাকতে হবে। খারাপ কিছু দেখলে আমাকে খবর দিও।
পরের দিন, ৩০ এপ্রিল। আগের দিনের চেয়ে রাস্তাঘাটে কোলাহল আজ অনেক বেশি। ইঁদুর মরা বন্ধ হওয়ার খবর শুনে। সবাইকে মনে হচ্ছে উচ্ছল, মুখর, আনন্দিত।
রিও-র মনও আজ বেশ হালকা। সকালের প্রথম ডাকেই স্ত্রীর চিঠি পেয়েছে। মিশেল-এর বাসায় এসে ও দেখল ওর জ্বর নিরানব্বইয়ে নেমে গেছে। কিছুটা দুর্বল দেখাচ্ছে, তবে হাসছে এখন।
আমার মনে হচ্ছে ও আজ অনেকটা সুস্থ। আপনি কী বলেন? জানতে চাইল মিশেল-এর বৌ।
হতে পারে। তবে এত তাড়াতাড়ি কিছুই বলা যায় না, উত্তর দিল রিও।
রিও-র কথাই ঠিক হলো। দুপুরে মিশেল-এর জ্বর লাফিয়ে উঠল একশো চারে। আবার দেখা দিল বিকার, বমি; অসম্ভব রকম ফুলে উঠল শরীরের গ্রন্থিগুলো; সামান্য ছোঁয়ায় যন্ত্রণা হচ্ছে এখন। রিও, লক্ষ করল, মাথাটাকে উঁচু করে ধরে রাখার চেষ্টা করছে মিশেল।
মিশেল-এর বৌকে রিও বলল, ওকে এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্যে ফোন করছি।
দুইঘণ্টা পর। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর শুয়ে আছে মিশেল, মুখ হাঁ করে। দুই কষে ময়লা জমেছে। বিড়বিড় করে চলেছে ও, ওই ইতর ইঁদুরগুলো। ওগুলোকে জাহান্নামে পাঠাব। ওরাই আমার এই সর্বনাশটা করল।
হাসপাতালে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল ওর মুখ। রক্তহীন ঠোঁট দুটো শুকিয়ে খটখটে হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ বিরতি দিয়ে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগল। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ল ওর হাত পা। মনে হলো বিছানার সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে মিশেল। কোন আশা নেই, ডাক্তার? মিশেল-এর পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছে ওর বৌ।
না। ও মারা গেছে।
.
১.০৩
ইঁদুর মরার ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল শহরবাসী, মিশেল-এর |||||||||| মৃত্যুর ঘটনায় ওরা হলো আতঙ্কিত। দুটো ব্যাপারই ওদের কাছে মনে হলো অবিশ্বাস্য, অসম্ভব।
জাঁ তারিউ ওরাওঁ-এর বাসিন্দা নয়। ইঁদুর মরার ঘটনা আরম্ভ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে এখানে আসে সে। উঠেছিল শহরের এক বিরাট হোটেলে। এতে বোঝা যায় সে বেশ বড়লোক। আরও কতগুলো গুণ আছে ওর। ভাল সাঁতারু, কৌতুকপ্রিয়, ঠোঁটে সব সময় লেগে থাকে হাসি; জীবনকে উপভোগ করার সহজাত একটা আসক্তি আছে ওর।
প্রতিদিনের ঘটনা ডাইরিতে লিখে রাখত তারিউ। ওর ডাইরিতে সে সময়ের বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। ও লিখেছে :
জানালা দিয়ে রাস্তার ও-পারে একটা ছোট্ট গলি দেখতে পাই। সেখানে এক বাড়ির ব্যালকনিতে রোজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটত।
গলির দেয়া লর ছায়ায় ঘুমোয় বেশ কিছু বেড়াল। প্রতিদিন দুপুরের খাওয়ার পর ব্যালকনিতে আসেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তার। হাবভাব সৈনিকের মত। শরীরটা সব সময় টান টান করে রাখেন। পোশাকও সৈনিকদের মত। মাথার ধবধবে সাদা চুল সব সময় আঁচড়ানো থাকে।
ব্যালকনিতে ঝুঁকে, তিনি ডাকেন: পুষি, পুষি। বেড়ালগুলো ঘুমজড়ানো চোখে তার দিকে তাকায়। কিন্তু ওঠার কোন লক্ষণ দেখা। যায় না ওদের মধ্যে।
বৃদ্ধ এরপর কাগজ কুচি কুচি করে ছিঁড়ে টুকরোগুলো ছুঁড়ে মারেন নিচে। এবার, ওগুলোকে ধরার জন্যে এগিয়ে যায় বেড়ালগুলো। থাবা উঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করে।
এ সময় বেড়ালগুলোকে থুতু ছিটান বুড়ো ভদ্রলোক। থুতু ওদের গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে ডগমগ করে ওঠেন তিনি।