সকাল সাতটার দিকে এলেন মাদাম রিও। রিও ওর সার্জারি রুমে গিয়ে টেলিফোন করল হাসপাতালে। ওর জায়গায় অন্য একজন ডাক্তারের ডিউটির ব্যবস্থা করল, প্রতিদিন সকালে ডাক্তারদের সঙ্গে যে পরামর্শ হত সেটাও বাতিল করে দিল ও। এরপর খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেক পরে আবার, তারিউ-এর ঘরে ঢুকল ও। বিছানার পাশেই বসে আছেন মাদাম রিও। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে তারিউ। হঠাৎ বিস্ফারিত হলো ওর দৃষ্টি। সেটা দেখে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চেয়ার থেকে উঠে বিছানার পাশের বাতিটা নিভিয়ে দিলেন মাদাম রিও। একটা হাত রাখলেন ওর ঘামে ভেজা জট পাকানো চুলে। অনেক দূর থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল তাঁর কানে, ধন্যবাদ। এখন মোটামুটি ভাল লাগছে। আবার চেয়ারে এসে বসলেন মাদাম রিও। তখন দেখতে পেলেন, চোখ বন্ধ করে ফেলেছে তারিউ। ওর মুখটাও বন্ধ হয়ে আছে। বিকৃত হয়ে, উঠেছে চেহারা। তবু একটা কোমল হাসি খেলা করছে মুখের চারপাশে।
দুপুরে জ্বর বাড়তে বাড়তে চরমে উঠল। রক্ত উঠে এল থুতুর সাথে। কাশির ফাঁকে ফাঁকে ও তখনও ওদের দিকে তাকাচ্ছে। আস্তে আস্তে কমে এল ওর চোখ খোলার পালা। বিধ্বস্ত চেহারায় যে উজ্জ্বল আভাটা ফুটে উঠছিল সেটাও ম্লান হয়ে এল ক্রমশ। মারা গেল তারিউ। তার আগে কখন ও দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কখন একটা আর্তনাদ করে নিজেকে সঁপে দিয়েছে মৃত্যুর হাতে, রিও সেসবের কিছুই লক্ষ করেনি। দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বন্যা নেমে এল ওর। সে অশ্রু অসহায় ক্রোধের।
রাতে মা ও ছেলে লাশ পাহারা দিতে বসল। মাঝে মাঝে স্ত্রীর কথা মনে পড়তে চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রিও-র। থেকে থেকে ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন, মাদাম রিও। চোখাচোখি হতেই হাসছে রিও।
বার্নার্ড?
বলো, মা।
খুব ক্লান্তি লাগছে?
না, মা।
চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন মাদাম রিও। মা-র দিকে তাকিয়ে হাসল রিও। তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল, সত্যিই ও ক্লান্ত বোধ করছে না। ছেলের দিকে তাকিয়ে মা বললেন, এবার দূরে পাহাড়ী কোন স্বাস্থ্যনিবাসে গিয়ে তোর কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া দরকার।
হ্যাঁ, মা। তাই করব এবার।
পরের দিন সকালে নিজের সার্জারিতে কাজ করছিল রিও, ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে ওকে একটা টেলিগ্রাম দিলেন মাদাম রিও। এরপর, যে ছেলেটা টেলিগ্রাম এনে দিয়েছে তাকে বকশিশ দেয়ার জন্যে ফিরে গেলেন তিনি।
ফিরে এসে তিনি দেখলেন, খোলা টেলিগ্রাম হাতে বসে আছে রিও। তাঁকে দেখে জানালার বাইরে চোখ মেলে দিল ও।
বার্নার্ড।
ঘুরে দাঁড়িয়ে মা-র দিকে তাকাল রিও। তাঁর মনে হলো একজন অপরিচিত মানুষকে দেখছেন তিনি।
খবর কী?
ওহ্। হ্যাঁ, সেই একই খবর। এক সপ্তাহ আগে মারা গেছে ও মাদাম রিও নিজেও জানালার দিকে মুখ ফেরালেন। মাকে কাঁদতে বারণ করল রিও। গত কয়েকমাস হলো, বিশেষ করে গত দুদিন থেকে এই দুঃখের ব্যথা সইতে হচ্ছে ওকে।
.
৫.০৪
চার ফেব্রুয়ারির এক ঝলমলে সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হলো শহরের সবগুলো ফটক। সেদিন উৎসবের আয়োজন করা হলো শহরে। স্টেশনে, ইঞ্জিন থেকে উঠল ধোয়া; জাহাজ এসে পৌঁছল বন্দরে। যারা ফিরছে তাদের হৃদয় কাঁপছে অজানা আশঙ্কায়। শহরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তারা তখনও কিছুই জানে না। মনে মনে এক বিভীষিকার চিত্র কল্পনা করে রেখেছে সবাই। বিচ্ছেদের দিনগুলোতে তাদের সময় কিছুতেই কাটতে চাইত না, তখন কামনা করত দ্রুত পার হয়ে যাক সময়। আজ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে তারা চাইছে সময়ের গতি আরও মন্থর হোক। ওদিকে, যারা বাসায় কিংবা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল, তারা ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে পড়ল; আশঙ্কায় কাঁপতে শুরু করল বুক। র্যাঁবেয়াও এসেছে স্টেশনে। প্রথম ট্রেনেই আসছে ওর প্রেমিকা। ও নিজেও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, ওর-ও বুক কাঁপছিল।
কিন্তু ইঞ্জিনের ধোঁয়া চোখে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে একটা দুর্বার উন্মত্ত আনন্দে ভরে উঠল সবার মন। ট্রেন স্টেশনে এসে থামতেই শত শত হাত দীর্ঘদিনের বঞ্চিত অধিকার ফিরে পাবার ব্যাকুল আগ্রহে এমন সব শরীরকে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে গেল সময়ের ব্যবধানে যাদের চেহারাও ওদের মনে নেই। র্যাঁবেয়ার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটল। যে রমণী ওর দিকে ছুটে এল, তার শরীরের দিকে একবার ভাল করে তাকাবারও সুযোগ হলো না ওর, তার আগেই ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর প্রেমিকা।
দুহাতে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরল র্যাঁবেয়া। মাথাটা চেপে ধরল কাঁধের ওপর। পরিচিত চুলগুলো ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। এরপর ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অবরুদ্ধ অশ্রু। কিন্তু বুঝতে পারল না এই অশ্রু সেই মুহূর্তের আনন্দের, নাকি দীর্ঘদিনের চাপা দুঃখের। পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। নিজের নিজের বাসার দিকে ফিরে চলল মানুষ। কিন্তু সবার ভাগ্যেই এই ঘটনা ঘটল না। কিছু কিছু লোক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখল তাদের জন্যে কেউ অপেক্ষা করে নেই।
রাস্তায়, পার্কে নাচতে শুরু করল মানুষ। রাস্তা ভরে গেল গাড়িতে গাড়িতে। সারাটা বিকেল ধরে গির্জার ঘণ্টা বেজে চলল পুরোদমে। ভরে উঠল আনন্দ ফুর্তির আঙ্গুলো। প্রতিটা কাফেয় বের করা হলো মদের শেষ বোতলটাও। প্রত্যেক পান্থশালার সামনে উন্মত্ত হয়ে উঠল মাতাল জনতা; তাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকাও আছে, সবার চোখের সামনে পরস্পরকে আদর করছে ওরা, কে কী ভাবছে সেটা খেয়াল করেও দেখছে না কেউ।