হ্যাঁ, তারিউ। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
স্বাভাবিক হয়ে এল তারিউ-এর গম্ভীর মুখটা। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, রিও। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমি আমার মৃত্যু কামনা করছি না। মৃত্যুকে বাধা দেবার জন্যে আমি আমার সাধ্যমত সব চেষ্টা করে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি হেরেই যাই; তাহলে আমার একটাই বাসনা, আমার মৃত্যুটা যেন ভালভাবে, হয়।
তারিউ-এর ওপর ঝুঁকে ওর কাঁধে একটু চাপ দিল রিও। না, না, মৃত্যু নয়, তারিউ। তুমি যেন মহাপুরুষ হয়ে উঠতে পারো, সে জন্যে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। তারিউ, সংগ্রাম করে যাও।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গায়ে ওভারকোট নিয়েই তারিউ-এর ঘরে ঢুকল রিও। ওর অবস্থা আগের মতই। জ্বরের প্রকোপে ঠোঁট দুটো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
কেমন আছ, তারিউ? জানতে চাইল রিও।
চাদরে ঢাকা কাঁধ দুটো একটু উঁচু করল তারিউ। মনে হয় সংগ্রামে হেরে যাচ্ছি।
ওর ওপর ঝুঁকে পড়ল রিও। শরীরের অনেক জায়গায় গ্রন্থিস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতর একটা ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। দু-ধরনের প্লেগের লক্ষণই ফুটে উঠেছে ওর শরীরে।
সোজা হয়ে দাঁড়াল রিও। বলল, সিরামের কাজ এখনও শুরু হয়নি। কী যেন বলতে চাচ্ছিল তারিউ। কিন্তু জ্বরের ঘোরে কিছুই বলতে পারল না।
রাতের খাওয়ার পর রিও এবং মা রোগীর পাশে এসে বসলেন। রিও ইনজেকশনের সাহায্যে উত্তেজক কিছু ঔষধ তারিউ-এর শরীরে ঢুকিয়ে ওর কেঁড়াগুলোকে খুব দ্রুত ফাটিয়ে দিতে চাইছিল, যদিও এতদিনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতার ফলে ও জানে এগুলোর কার্যকারিতা কতটুকু।
সারা রাত ধরে একটার পর একটা প্লেগের আক্রমণ প্রতিহত করল তারিউ। একবারও ওর ভেতর কোন চঞ্চলতা বা উদ্বেগ দেখা গেল না। কথা বলারও চেষ্টা করল না। অত বড় শরীরটায়। বোধশক্তি বলতে কিছুই নেই তখন। আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে কখনও কখনও হেরে যাচ্ছে ও। রিও সেটা বুঝতে পারছে ওর চোখ দেখে। কখনও কখনও চোখাচোখি হচ্ছে ওদের দুজনের সঙ্গে। সে সময় জোর করে হাসছে তারিউ।
হঠাৎ আরম্ভ হলো প্রবল বর্ষণ, আর সেই সাথে শিল পড়া। মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাচ্ছে রিও। সেটা কেটে যেতেই অন্ধকারের এপার থেকে চোখ দুটোকে মেলে ধরছে তারিউ-এর ওপর। মা ওর পাশে বসে কী যেন একটা বুনছেন, আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন ওর দিকে। বৃষ্টি থেমে যাবার পর ঘরের ভেতর আরও বেড়ে গেল নীরবতা। রিও অনুভব করল, উত্তেজনায় দপদপ করছে ওর সমস্ত স্নায়ু। ইশারায় মাকে বিছানায় যেতে বলল ও। মা নীরবে মাথা নাড়লেন, তার চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গভীর মনোযোগ দিয়ে ছুঁচের ডগাটা দেখতে লাগলেন তিনি। উঠে তারিউ এর মুখে একটু পানি দিল রিও, তারপর আবার ফিরে এল নিজের জায়গায়।
তখন ভোর হয়-হয়। রিও মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, মা, তুমি যাও। এবার একটু বিশ্রাম নাও। সকাল আটটায় তোমাকে আবার এখানে আসতে হবে। তখন আমি থাকব না। আর শোনো, শোয়ার আগে চোখে কয়েক ফোঁটা ওষুধ দিতে ভুলে যেয়ো না।
উঠলেন মাদাম রিও। হাতের জিনিসগুলো গুছিয়ে তারিউ-এর বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। অনেকক্ষণ হলো চোখ বন্ধ করে আছে তারিউ। কুঁচকে গেছে কপাল, ঘামে জট পাকানো চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে এর চারপাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাদাম রিও। ছোখ মেলে তাকে দেখল তারিউ। দেখল, শান্ত স্নেহভরা সেই মাতৃমুখ ঝুঁকে আছে ওর ওপর। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটুল ওর, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো আবার বন্ধ হয়ে গেল। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। মা-র ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটাতে বসল রিও।
ঝিমুচ্ছিল রিও। রাস্তার গাড়ির শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল। শিরশির করে উঠল ওর শরীর। সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল তারিউ-এর দিকে। চেহারায় একটা অবসাদের ভাব ফিরে এসেছে ওর। মনে হলো ঘুমুচ্ছে। ওর পাশে দাঁড়াল রিও। তখনই একটা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাল তারিউ। তখনও ঘুমের ঘোর পুরোপুরি। কাটেনি।
ঘুমুচ্ছিলে, না? কথা বলল রিও।
হ্যাঁ, হয়তো।
শ্বাস নিতে এখনও কষ্ট হচ্ছে?
একটু একটু। এ থেকে কিছু অনুমান করতে পারবে?
না, তারিউ। তুমি তো জানো সকালের দিকে বেগ একটু কমে আসে।
ধন্যবাদ। সত্যিকারের অবস্থা কখন কী রকম থাকে আমাকে সবসময় তা জানতে দেবে, এ আশাটুকু আমি তোমার কাছ থেকে করতে পারি নিশ্চয়।
ওর বিছানায় বসল রিও। তারিউ-এর পা দুটোকে মনে হলো লাশের পা-র মত শক্ত। ফের শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হলো তারিউ এর।
আবার জ্বর উঠবে, তাই না, রিও?
হয়তো। দুপুরের দিকে বুঝতে পারব সত্যিকারের অবস্থা কী।
চোখ বন্ধ করল তারিউ। মনে হলো নিজের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছে। যখন চোখ খুলল তখন দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে গেছে ওর। তখন রিও একটা গ্লাস হাতে ওর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা দেখে দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর।
এটা খাও।
গ্লাসের পানি খেয়ে ফেলল তারিউ। আস্তে আস্তে আবার মাথাটা রাখল বালিশের ওপর। আমার বেলায় অনেক সময় নিচ্ছে, তাই না, রিও, অস্কুটভাবে বলল ও।
ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরল রিও। বন্যার দুর্বার স্রোতের মত জ্বর উঠছে। লাল হয়ে উঠল দুই গাল, কপাল। ওর দিকে চোখ ফেরাল তারিউ। ঝুঁকে পড়ে রিও ওকে উৎসাহ দিল। হাসার চেষ্টা করল ও। কিন্তু মুখ শুকিয়ে যাওয়ায় চোয়াল আর ঠোঁট আটকে গেল, হাসি বেরুল না। শুধু চোখ দুটোকে তখনও মনে হচ্ছে জীবন্ত, সাহসে ভরা।