তারিউ আবার হাসল। দেখবেন, আপনারও সমস্ত অপরাধ ধুয়ে মুছে গেছে। আপনার জন্যেও নতুন সুযোগ আসবে।
কটার্ড-এর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে হাত মেলাল দুজনে। এখন মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক, বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল কটার্ড, সবাই আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পাবে।
সামনের অন্ধকার থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল দুজন লোক। অস্পষ্টভাবে তারিউ শুনতে পেল কার্ড সবিস্ময়ে বলছে, এই দুই। চিড়িয়া আবার কোত্থেকে আমদানি হলো? কী চায় এরা? অপরিচিত দুজনের ভেতর থেকে একজন কটার্ডাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কটার্ড?
একটা চাপা অস্ফুট শব্দ বের হলো কটার্ড-এর মুখ দিয়ে। এবং দেখতে না দেখতে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল ও।
তারিউ এবং অপরিচিত লোক দুজন বিস্ময়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারিউ ওদের প্রশ্ন করল, কী চান আপনারা?
কটার্ড-এর কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে চাই, দায়সারা উত্তর দিল লোক দুটো।
বাসায় ফিরে তারিউ ওর ডাইরিতে এই অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ লিখতে গিয়ে মন্তব্য করল: আজ রাতে বড় ক্লান্ত বোধ করছি।
ওর ডাইরির শেষে এই কথাগুলো লেখা আছে: রাত এবং দিনের মধ্যে এমন কতকগুলো নির্দিষ্ট সময় আছে যখন মানুষের শক্তি এবং সাহস নিঃশেষিত হয়ে আসে। এই সব সময়কে আমি ভীষণ ভয় করি।
.
৫.০৩
শহরের ফটক খোলার কয়েকদিন আগের ঘটনা। দুপুরে বাসায় ফিরছিল রিও। কদিন ধরেই স্ত্রীর কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম আশা করছে ও। মনে মনে ভাবছে টেলিগ্রামটা আসল কিনা। সবাই আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে যাচ্ছে, এ অনুভূতিটা তখন ওর ভেতরও জেগে উঠেছে।
দারোয়ানের ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ও। বুড়ো মিশেল-এর জায়গায় নতুন যে দারোয়ানটা এসেছে সে তখন জানালায় মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে একটু হাসল লোকটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপর পানে রওনা হলো রিও। চোখের সামনে। ভাসছে দারোয়ানের হাসি হাসি মুখখানা।
ফ্ল্যাটের বাইরের দরজা খোলার সময় রিও দেখল মা হলঘর পেরিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে বললেন, তারিউ অসুস্থ বোধ করছে। মাকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো রিও-র। তাড়াতাড়ি বলল, খুব সম্ভব এটা মারাত্মক কিছু নয়।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে তারিউ। বালিশের মধ্যে ডুবে গেছে মাথা। চাদরের নিচে ওর প্রশস্ত বুকটা বেশ উঁচু দেখাচ্ছে। একটু পর পর বাড়ছে জ্বর, সেই সঙ্গে মাথার যন্ত্রণা। লক্ষণগুলো তেমন সুস্পষ্ট নয়। তবে প্লেগ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই, রিওকে বলল তারিউ।
ওর শরীর পরীক্ষা করে রিও বলল, না। তেমন সুস্পষ্ট কোন, লক্ষণ এখনও দেখছি না।
কিন্তু ঘন ঘন প্রচণ্ড পিপাসা পাচ্ছিল তারিউ-এর। ঘরের বাইরে এসে রিও ওর মাকে বলল, মনে হচ্ছে ওর প্লেগই হয়েছে।
বলিস কী, আঁতকে উঠলেন মা। তা কী করে সম্ভব, অন্তত এখন? তারপর একটু ভেবে বললেন, বার্নার্ড, আমার মনে হয়, ওকে আমাদের কাছে রাখাই ভাল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করল রিও। মা, সবকিছু মেনে চললে ওকে আমরা বাসায় রাখতে পারি না। তবে কয়েকদিন পরেই শহরের ফটক খুলে দেয়া হবে, সে সময় তুমি যদি শহরের বাইরে চলে যাও, তাহলে আমি তারিউ-এর দায়িত্ব নিতে পারি।
বার্নার্ড, আমার কথা শোনো। তারিউও থাকুক, আমিও থাকি। এই তো সেদিন আমি টিকা নিলাম।
রিও মাকে বুঝিয়ে বলল, মা, তারিউও টিকা নিয়েছিল। তবে এমন হতে পারে শেষবারের টিকা নিতে হয়তো ও ভুলে গেছে, কিংবা অন্যান্য ব্যাপারেও সাবধান ছিল না।
কথা বলতে বলতে রিও ওর সার্জারি রুমের দিকে এগিয়ে গেল। যখন ফিরে এল, তারিউ দেখল ওর হাতে সিরামের বাক্স।
আচ্ছা, এতক্ষণে বুঝলাম। তাহলে আমাকে প্লেগই ধরেছে, বলল তারিউ।
তা নাও হতে পারে। তবে কোনরকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না, তাই।
কোন কথা না বলে টিকা নেয়ার জন্যে ওর একটা হাত রিও-র দিকে বাড়িয়ে দিল তারিউ। এই টিকা ও নিজেও বহু লোককে দিয়েছে। অনেক সময় লাগে।
সন্ধ্যার দিকে বোঝা যাবে ব্যাপারটা কী? ওর চোখের দিকে তাকাল রিও।
কিন্তু আমাকে আলাদা রাখার কী ব্যবস্থা করছ?
এখনই সে প্রশ্ন উঠছে না। তোমার প্লেগ হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
কষ্টের হাসি হাসল তারিউ। রিও, বোধ হয় এই প্রথম কোন রোগীকে আলাদা না করে তুমি টিকা দিলে।
ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল রিও। দেখো, তুমি এখানে। থাকলে তোমার দেখাশোনাটা ভাল হবে। মা এবং আমি দুজনেই তোমার পাশে থাকতে পারব।
কোন তর্ক করল না তারিউ। সিরামের বাক্স গুছিয়ে নিল রিও। তখনও মুখ ফিরিয়ে আছে ও। আশা করছে কিছু বলবে তারিউ। কিন্তু কোন সাড়া দিল না সে। ওর বিছানার পাশে এল রিও। তারিউ-এর চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে ওর দিকে। চেহারা মলিন। হলেও, ধূসর চোখগুলো তখনও শান্ত।
রিও হাসল। তারিউ, ঘুমোনোর চেষ্টা করো। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। কথাগুলো বলেই কয়েক পা এগিয়ে গেল ও। এমন সময় শুনতে পেল তারিউ ওকে ডাকছে। আবার ফিরে এল রিও। তারিউ-এর ভাবভঙ্গি ওর কাছে কেমন অদ্ভুত ঠেকল। রিও দেখল, তারিউ কিছু একটা বলার জন্যে নিজের ভেতর প্রচণ্ড তাড়না অনুভব করছে, অথচ কিছুতেই সে কথা বলতে চাচ্ছে
রিও, মুখ খুলল তারিউ, আশা করি তুমি আমাকে সব কথা খুলে বলবে। এটুকু নিশ্চয় তোমার কাছ থেকে আশা করতে পারি।